কিংবদন্তিচয়ন
লুকোচুরি খেলা
রিয়োকোয়ান প্রকৃতি আর ছেলেপিলেদের নিয়েই বেশির ভাগ জীবন কাটিয়েছেন। ফিশার বলেন, তিনি কোনও জায়গাতে কিছুদিন থাকলেই ছেলেমেয়েরা তাকে চিনে নিত। ফিশার বলেননি কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রকৃতিও তাকে চিনে নিত এবং রবীন্দ্রনাথের ‘হাজার হাজার বছর কেটেছে কেহ তো কহে নি কথা’ কবিতাটি আমার মতের সায় দেবে।
রিয়োকোয়ান গাঁয়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাস্তার ছেলেমেয়েরা লুকোচুরি খেলছিল। রিয়োকোয়ানকে দেখে তাদের উৎসাহ আর আনন্দের সীমা নেই। বেশি ঝুলোঝুলি করতে হল না। রিয়োকোয়ান তো নাচিয়ে বুড়ি, তার ওপর পেয়েছেন মৃদঙ্গের তাল। তদ্দণ্ডেই খেলাতে যোগ দিলেন। খেলাটা বনের ভিতর ভালো করে জমবে বলে সবাই গ্রাম ছেড়ে সেখানে উপস্থিত। সবাই হেথায় হোথায় লুকালো। রিয়োকোয়ান এ খেলাতে বহু দিনের অভ্যাসের ফলে পাকাপোক্ত– তিনি লুকোলেন এক কাঠুরের কুঁড়েঘরে। ঘরের এক কোণে কাঠ গাদা করা ছিল, তিনি তার উপরে বসে ঝোলা ঝোলা আস্তিন দিয়ে মুখ ঢেকে ভাবলেন, ওখানে তাকে কেউ কখনো খুঁজে পাবে না, আর পেলেই-বা কী, তাঁর তো মুখ ঢাকা, চিনবে কী করে?
খেলা চলল। সবাইকে খুঁজে পাওয়া গেল। রিয়োকোয়ান যে কুঁড়েঘরে লুকিয়ে ছিলেন, সেকথা কারও অজানা ছিল না, কিন্তু ছেলেরা বলল, “দেখি, আমরা সবাই চুপচাপ বাড়ি চলে গেলে কী হয়?’
রিয়োকোয়ান সেই কাঠের গাদার উপর বসে সমস্ত বিকেলবেলাটা কাটালেন– পরদিন সকালবেলা কাঠুরের বউ ঘরে ঢুকে চমকে উঠে বলল, ‘ওখানে কে ঘুমুচ্ছে হে?’ তার পর চিনতে পেরে থ’ হয়ে বলল, “সে কী, সন্ন্যাসী ঠাকুর যে! আপনি এখানে কী করছেন?’
রিয়োকোয়ান আস্তিন-ফাস্তিন নাড়িয়ে মহা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন, “আরে চুপ, চুপ, চুপ। ওরা জেনে যাবে যে। বুঝতে পার না!’
.
‘চলো’ খেলা
রিয়োকোয়ানকে যে ছেলেমেয়েরা হামেশাই বোকা বানাতে পারত, সেকথা সবাই জানে, আর পাঁচজনও তাঁকে আকসার ঠকাবার চেষ্টা করত। কিন্তু প্রশ্ন, রিয়োকোয়ানের কাছে এমন কী সম্পদ ছিল মানুষ তাকে ঠকাবার চেষ্টা করবে? ফিশার বলেন, রিয়োকোয়ানের হাতের লেখা ছবির চেয়েও বেশি কদর পেত এবং সেই হাতের লেখায় তাঁর কবিতার মূল্য অনেক লোকই জেনে গিয়েছিল। কিন্তু রিয়োকোয়ান চট করে যাকে-তাকে কবিতা দিতে রাজি হতেন না, বিশেষ করে যারা তার কবিতা বিক্রি করে পয়সা মারার তালে থাকত, তাদের ফন্দি-ফাঁদ এড়াবার চেষ্টা সবসময়ই করতেন। গল্পগুলো থেকে জানা যায়, তিনি ফাঁদে ধরা পড়েছেনই বেশি, এড়াতে পেরেছেন মাত্র দু একবার।
জাপানে ‘চলো’ খেলার খুবই চলতি, আর রিয়োকোয়ানকে তো কোনও খেলাতেই নামাবার জন্য অত্যধিক সাধাসাধি করতে হত না।
রিয়োকোয়ান বন্ধু মনসুকের সঙ্গে একদিন দেখা করতে গিয়েছিলেন। মনসুকে বললেন, ‘এস, “চলো” খেলা খেলবে?’ রিয়োকোয়ান তো তৎক্ষণাৎ রাজি। মনসুকে খেলা আরম্ভ করার সময় বললেন, ‘কিছু একটা বাজি ধরে খেললে হয় না? তা হলে খেলাটা জমবে ভালো।’
রিয়োকোয়ান বলেন, ‘তা তো বটেই। যদি আমি জিতি তা হলে তুমি আমাকে কিছু কাপড়-জামা দেবে–শীতটা তো বেড়েই চলেছে।’
মনসুকে বললেন, ‘বেশ, কিন্তু যদি আমি জিতি?’
রিয়োকোয়ান তো মহা দুর্ভাবনায় পড়লেন। তাঁর কাছে আছেই-বা কী, দেবেনই-বা কী? বললেন, ‘আমার তো, ভাই, কিছুই নেই।’
মনসুকে অতি কষ্টে তাঁর ফুর্তি চেপে বললেন, ‘তোমার চীনা হাতের লেখা যদি দাও তাতেই আমি খুশি হব।’ রিয়োকোয়ান অনিচ্ছায় রাজি হলেন। খেলা আরম্ভ হল। রিয়োকোয়ান হেরে গেলেন। আবার খেলা শুরু, আবার রিয়োকোয়ানের হার হল। করে করে সবসুদ্ধ আট বার খেলা হল, রিয়োকোয়ান আট বারই হারলেন। এবার চীনা হাতের লেখা না দিয়ে এড়াবার যো নেই।
রিয়োকোয়ান হস্তলিপি দিলেন। দেখা গেল, আটখানা লিপিতেই তিনি একই কথা আট বার লিখেছেন :
‘চিনি মিষ্টি
ওষুধ তেতো।’(১)
মনসুকে যখন আপত্তি জানিয়ে বললেন, আট বার একই কথা লেখা উচিত হয়নি তখন রিয়োকোয়ান হেসে উত্তর দিলেন, কিন্তু “চলো” খেলা কি সব বারই একইরকমের হয় না? তাই একই কথা আট বার লিখে দিয়েছি।’
————
১. খুব সম্ভব কবিতাটির গূঢ়ার্থ, ‘বাজি জেতাতে বড় আনন্দ, আর বাজি হারাতে খুব দুঃখ।’
.
কুড়িয়ে-পাওয়া
রিয়োকোয়ানকে কে যেন একবার বলেছিল রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়াতে ভারি আনন্দ। একদিন আশ্রমে ফেরার পথে তিনি মনে মনে সেইকথা নিয়ে চিন্তা করতে করতে বললেন, ‘একবার দেখাই যাক না, কুড়িয়ে পাওয়াতে কী আনন্দ লুকানো আছে।’ রিয়োকোয়ান ভিক্ষা করে কয়েকটি পয়সা পেয়েছিলেন। এগুলো তিনি একটা একটা করে রাস্তায় ছড়িয়ে ফের তুলে। নিলেন। অনেকবার ছড়ালেন, কুড়ালেন, কিন্তু কোনওরকম আনন্দই পেলেন না। তখন মাথা চুলকে আপন মনে বললেন, ‘এটা কীরকম হল? আমায় সবাই বলল, কুড়িয়ে পাওয়াতে ভারি ফুর্তি, কিন্তু আমার তো কোনও ফুর্তি হচ্ছে না। তারাও তো ঠকাবার লোক নয়।’ আরও বহু বার ছড়ালেন, কুড়োলেন, কিন্তু কোনও সুখই পেলেন না। এইরকম করতে করতে শেষটায়। বেখেয়ালে সবকটি পয়সাই ঘাসের ভিতর হারিয়ে গেল।
তখন তাঁকে অনেকক্ষণ ধরে পয়সাগুলো খুঁজতে হল। যখন পেলেন তখন মহা ফুর্তির সঙ্গে চেঁচিয়ে বললেন, ‘এইবারে বুঝতে পেরেছি। কুড়িয়ে পাওয়াতে আনন্দ আছে বৈকি।’
.
ধূর্ত নাপিত
রিয়োকোয়ানের হাতের লেখা এতই সুন্দর ছিল আর তাঁর কবিতাতে এমনি অপূর্ব রসসৃষ্টি হত যে তাঁর হাতের লেখা কবিতা কেউ যোগাড় করতে পারলে বিক্রি করে বেশ দু পয়সা কামাতে পারত। রিয়োকোয়ান নিজে শ্রমণ; কাজেই তিনি এসব লেখা বিক্রি করতেন না– গরিব দুঃখীকে বিলিয়ে দিতেন। কিন্তু কেউ ধাপ্পা দিয়ে তাঁর কাছ থেকে লেখা আদায় করার চেষ্টা করলে তিনি ফাঁদ এড়াবার চেষ্টা করতেন।
শ্রমণকে মাথা নেড়া করতে হয়। তাই রিয়োকোয়ান প্রায়ই এক নাপিতের কাছে যেতেন। নাপিতটি আমাদের দেশের নাপিতের মতোই ধূর্ত ছিল এবং রিয়োকোয়ানের কাছ থেকে অনবরত কিছু লেখা আদায় করার চেষ্টা করত। তাঁকে তাই নিয়ে বড় বেশি জ্বালাতন করলে তিনিও ‘দেব’ ‘দিচ্ছি’ করে কোনও গতিকে এ অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাবার চেষ্টা করতেন।
শেষটায় ধূর্ত নাপিত একদিন তাঁর মাথা অর্ধেক কামিয়ে বললে, “ঠাকুর, হাতের লেখা ভালোয় ভালোয় এই বেলা দিয়ে দাও। না হলে বাকি অর্ধেক আর কামাব না।’ এরকম শয়তানির সঙ্গে রিয়োকোয়ানের এই প্রথম পরিচয়। কী আর করেন? হাতের লেখা দিয়ে মাথাটি মুড়িয়ে– উভয়ার্থে আশ্রমে ফিরলেন। নাপিতও সগর্বে সদম্ভে লেখাটি ফ্রেমে বাঁধিয়ে দোকানের মাঝখানে টাঙাল– ভাবখানা এই, সে এমনি গুণী যে রিয়োকোয়ানের মতো শ্রমণ তাকে হাতের লেখা দিয়ে সম্মান অনুভব করেন।
কিন্তু খদ্দেরদের ভিতর দু-চারজন প্রকৃত সমঝদার ছিলেন। তাঁরা নাপিতকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে, লেখাতে একটা শব্দ সম্পূর্ণ বাদ পড়ে গিয়েছে। নাপিত ছুটে গিয়ে রিয়োকায়ানের ভুল দেখিয়ে শুদ্ধ করে দেবার জন্যে বলল। তিনি বললেন, ‘ওটা ভুল নয়। আমি ইচ্ছে করেই ওরকম ধারা করেছি। তুমি আমার মাথা অর্ধেক কামিয়ে দিয়েছিলে। আমিও তাই লেখাটি শেষ করে দিইনি। আর ওই যে বুড়ি আমাকে সিম বিক্রি করে সে সর্বদাই আমাকে কিছুটা ফাউ দেয়। তোমার লেখা যেটুকু বাদ পড়েছে সেটুকু বুড়িকে লেখা দেবার সময় ফাউ করে জুড়ে দিয়েছি। বিশ্বাস না হয় গিয়ে দেখে এস।’
তার পর রিয়োকোয়ান অনেকক্ষণ ধরে মাথা দুলিয়ে হাসলেন।
.
রিয়োকোয়ান ও মোড়ল তোমিতারি
শ্ৰমণদের দিন কাটে নানা ধরনের লোকের আতিথ্য নিয়ে। রিয়োকোয়ান একবার অতিথি হলেন মোড়ল তোমিতেরির। জাপানে তখন ‘চলো’ খেলার খুব চলতি এবং রিয়োকোয়ান সর্বদাই এ খেলাতে হারেন বলে সকলেই তাঁর সঙ্গে খেলতে চায়।
তাই খেলা আরম্ভ হল। কিন্তু রিয়োকোয়ানের অদৃষ্ট সেদিন ভালো ছিল। বাজির পর বাজি তিনি জিতে চললেন। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা ভারি খুশি– রিয়োকোয়ানও আনন্দে আত্মহারা। তোমিতারি রিয়োকোয়ানকে বিলক্ষণ চিনতেন, তাই রগড় দেখবার জন্য হঠাৎ যেন ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে বললেন, ‘তুমি তো আচ্ছা লোক হে! অতিথি হয়ে এসেছ আমার বাড়িতে আর জিতে জিতে আমার সর্বস্ব কেড়ে নিতে তোমার একটুকু লজ্জা হচ্ছে না? এরকম স্বার্থপর ছোটলোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভদ্রত্ব কী করে বজায় রাখা যায় আমি তো ভেবেই পাচ্ছিনে।’
রিয়োকোয়ান রসিকতা না বুঝতে পেরে ভারি লজ্জা পেলেন। তাড়াতাড়ি কোনও-গতিকে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন বন্ধু কেরার বাড়িতে। কেরা। বন্ধুর চেহারা দেখেই বুঝলেন, কিছু একটা হয়েছে। জিগ্যেস করলেন, ‘কী করেছ, খুলে বল।’ রিয়োকোয়ান বললেন, ‘ভারি বিপদগ্রস্ত হয়েছি। তোমিতোরির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। কী যে করব ভেবেই পাচ্ছিনে। তুমি কিছু বুদ্ধি বাতলাতে পার? তোমিতোরিকে যে করেই হোক খুশি করতে হবে।’
কেরা ব্যাপারটা শুনে তখনই বুঝতে পারলেন যে রিয়োকোয়ান রসিকতা বুঝতে পারেননি। কিন্তু তিনিও চেপে গিয়ে দরদ দেখিয়ে বললেন, ‘তাই তো! তা আচ্ছা, কাল তোমাকে তোমিতোরির কাছে নিয়ে গিয়ে মাপ চাইব।’
রিয়োকোয়ান অনেকটা আশ্বস্ত হলেন।
পরদিন ভোরবেলা দু জনা মোড়লের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলেন। রিয়োকোয়ান দোরের বাইরে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলেন। কেরা ভিতরে গিয়ে যেন ভয়ঙ্কর কিছু একটা হয়েছে, এরকমভাবে গম্ভীর গলায় রিয়োকোয়ানের হয়ে তোমিতোরির কাছে মাপ চাইলেন। রিয়োকোয়ান উদ্বেগে কাতর হয়ে কান খাড়া করে শুনতে পেলেন তোমিতোরি তাঁকে মাপ করতে রাজি আছেন। তদ্দশ্যেই দুশ্চিন্তা কেটে গেল আর মহা খুশি হয়ে তৎক্ষণাৎ তোমিতোরির সামনে গিয়ে হাজির। তোমিতোরি প্রচুর খাতিরযত্ন করে রিয়োকোয়ানকে বসালেন। রিয়োকোয়ানকে আর তখন পায় কে! খুশিতে সবকিছু বেবাক ভুলে গিয়ে এক লহমার ভিতরেই বললেন, ‘এস’, “চলো” খেলা আরম্ভ করা যাক।
রিয়োকোয়ান এমনই সরল মনে প্রস্তাবটা করলেন যে সবাই হেসে উঠলেন। খেলা আরম্ভ হল।
এবারও রিয়োকোয়ান জিতলেন।
.
কী বিপদ
রিয়োকোয়ান ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলো করতে ভালোবাসতেন। তারা মাঝে মাঝে তাঁকে বিপদগ্রস্ত করত।
কথা নেই বার্তা নেই একদিন হঠাৎ একটা ছেলে চেঁচিয়ে বলল, “ঠাকুর, আমায় একটা রায়ো দাও।’ (রায়ো মুদ্রার দাম প্রায় চার টাকার মতো)। রিয়োকোয়ান তো অবাক। এক রায়ো? বলে কী? তাঁর কাছে দু গণ্ডা পয়সা হয় কি না-হয়।
ছেলেরা ছাড়ে না। আরেক জন বলল, “আমাকে দুটো রায়ো দাও’। কেউ বলে তিনটে, কেউ বলে চারটে। নিলামের মতো দাম বেড়েই চলল আর রিয়োকোয়ান বিস্ময়ে হতবাক হয়ে হাত দু খানা মাথার উপর তুলে দাঁড়িয়ে ভাবছেন অত টাকা তিনি পাবেন কোথায়?
যখন নিলাম দশ রায়ে পেরিয়ে গেল তখন তিনি হঠাৎ দড়াম করে লম্বা হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।
ছেলেরা তো এতক্ষণ নিলামের ফুর্তিতে মশগুল হয়ে ছিল। রিয়োকোয়ানকে হঠাৎ এরকম ধারা মাটিতে পড়ে যেতে দেখে ভয়ে ভয়ে কাছে এগিয়ে এসে ডাকল, ‘ও ঠাকুর, ওঠ। এরকম করছ কেন?’ কোনও সাড়াশব্দ নেই। আরও কাছে এগিয়ে এসে দেখে তার চোখ বন্ধ, সমস্ত শরীরে নড়াচড়া নেই।
ভয় পেয়ে সবাই কানের কাছে এসে চেঁচাতে লাগল, ‘ও ঠাকুর, ওঠো। ওরকম ধারা করছ কেন?’ তখন কেউ কেউ বলল, ‘ঠাকুর মারা গিয়েছেন।’ দু-চারজন তো হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলল।
যখন হট্টগোলটা ভালো করে জমে উঠেছে তখন রিয়োকোয়ান আস্তে আস্তে চোখ মেললেন। ছেলেরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। যাক, ঠাকুর তা হলে মারা যায়নি। সবাই তখন তাঁর আস্তিন ধরে ঝুলোঝুলি করে চেঁচাতে লাগল, ‘ঠাকুর মরে যাননি, ঠাকুর বেঁচে আছেন।’
রায়োর কথা সবাই তখন ভুলে গিয়েছে। কানামাছি খেলা আরম্ভ হয়েছে। ঠাকুর হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।
***
ফিশার আরও বহু কিংবদন্তি উদ্ধৃত করে তাঁর পুস্তিকাখানি সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলেছেন। সেগুলো থেকে দেখা যায়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিয়োকোয়ান বয়স্ক লোকের সংসর্গ ত্যাগ করে ক্রমেই ছেলে-মেয়ে, প্রকৃতি আর প্রাণিজগৎ নিয়ে দিনযাপন করেছেন। কিংবদন্তির চেয়ে রিয়োকোয়ানের কবিতাতে তার এই পরিবর্তন চোখে পড়ে বেশি।
বস্তুত, রিয়োকোয়ানের জীবনী আলোচনার চেয়ে বহু গুণে শ্ৰেয় তাঁর কবিতা পাঠ। কিন্তু তিনি তাঁর কবিতা লিখেছেন এমনি হাল্কা তুলি দিয়ে যে তার অনুবাদ করা আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব।
কোনও প্রকৃত সমঝদার যদি এই গুরুভার গ্রহণ করেন তবে আমার এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধ লেখা সার্থক হবে।
.
মহা পরিনির্বাণ
ভিক্ষুণী তেইশা (তাইশিন) রিয়োকোয়ানের শিষ্যা ছিলেন সেকথা এ জীবনীর প্রথম ভাগেই বলা হয়েছে। রিয়োকোয়ানের শরীর যখন তেহাত্তর বৎসর বয়সে জরাজীর্ণ, তখন তিনি খবর পেলেন শ্রমণের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। সংবাদ পেয়ে তেইশা শুরুর পদপ্রান্তে এসে উপস্থিত হলেন।
সেই অবসন্ন শরীর নিয়ে শ্রমণ যে মধুর কবিতাটি রচনা করেছেন তার থেকে আমরা তাঁর স্পর্শকাতর হৃদয়ের খানিকটা পরিচয় পাই–
নয়ন আমার যার লাগি ছিল তৃষাতুর এতদিন
ভুবন ভরিয়া আজ তার আগমন
তারই লাগি মোর কঠোর বিরহ মধুর বেদনা ভরা
তারই লাগি মোর দিন গেল অগণন।
এতদিন পরে মনের বাসনা পূর্ণ হয়েছে আজ
শান্তি বিরাজে ঝঞ্ঝা-মথিত ক্ষুব্ধ হৃদয়-মাঝ ॥
শেষ দিন পর্যন্ত তেইশা রিয়োকোয়ানের সেবা-শুশ্রষা করেছিলেন। শুরুর মন প্রসন্ন রাখার জন্য তেইশা সবসময়ই হাসিমুখে থাকতেন, কিন্তু আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় ভিক্ষুণী কতটা কাতর হয়ে পড়েছিলেন ফিশার তাঁর পুস্তকে সে বেদনার কিছুটা বর্ণনা দিয়েছেন।
শেষ মুহূর্ত যখন প্রায় এসে উপস্থিত এখনও রিয়োকোয়ান তাঁর হৃদয়াবেগ কবিতার ভিতর দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন–
নলিনীর দলে শিশিরের মতো মোদের জীবন, হায়–
শূন্যগর্ভ বাতাহত হয়ে চলিছে সমুখ পানে।
আমার জীবন তেমনি কাটিল, এবার হয়েছে শেষ
কাঁপন লেগেছে আমার শিশিরে চলে যাবে কোনখানে?
রিয়োকোয়ান শান্তভাবে শেষ মুহূর্তের প্রতীক্ষা করেছিলেন, কিন্তু ভিক্ষুণী তেইশার নারীহৃদয় যে কতটা বিচলিত হয়ে পড়েছিল, সেকথা তেইশার ওই সময়ের লেখা কবিতাটি থেকে বোঝা যায় :
গভীর দুঃখে, হৃদয় আমার সান্ত্বনা নাহি মানে
এ মহাপ্রয়াণ দুর্দমনীয় বেদনা বক্ষে হানে।
সাধনায় জানি, জীবন মৃত্যু প্রভেদ কিছুই নেই
তবুও কাতর বিদায়ের ক্ষণ সমুখে আসিল যেই।
এ কবিতা পড়ে আমাদের মতো গৃহী একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়ে। সর্বস্ব ত্যাগ করে, আজীবন শান্তির সন্ধান করার পরও যদি ভিক্ষুণীরা এরকম কথা বলেন তবে আমরা যাব কোথায়? আমরা তো আশা করেছিলুম, দুঃখের আঘাত সয়ে সয়ে কোনও গতিকে শেষ পর্যন্ত আত্মজনের চিরবিচ্ছেদ সহ্য করার মতো খানিকটা শক্তি পাব, কিন্তু তার আর ভরসা রইল কোথায়? ঋষি বলেছেন, ‘একমাত্র বৈরাগ্যেই অভয়’; কিন্তু তেইশার কবিতা পড়ে মানুষের শেষ আশ্রয় বৈরাগ্য সম্বন্ধেও নিরাশ হতে হল।
জানি, এ কবিতা পড়ে রিয়োকোয়ান উত্তরে লিখেছিলেন–
রক্তপদ্মপত্রের মতো মানব জীবন ধরে,
একে একে সব খসে পড়ে ভূমি ‘পরে
ঝরার সময় লাগে তার গায়ে যে ক্ষুদ্র কম্পন
সেই তো জীবন।
কিন্তু রিয়োকোয়ান তো ওপারের যাত্রী– তাঁর দুঃখ কিসের? বিরহবেদনা তো তাদের তরেই, যারা পিছনে পড়ে রইল।
‘–কিন্তু যারা পেয়েছিল প্রত্যক্ষ তোমায়
অনুক্ষণ, তারা যা হারাল তার সন্ধান কোথায়,
কোথায় সান্ত্বনা?’ (রবীন্দ্রনাথ)
তাই ফিশার বলেন, ‘শত শত লোক শ্রমণের শবযাত্রার সঙ্গে গিয়েছিল। আর যে সব অগণিত ছেলে-মেয়ের সঙ্গে তিনি খেলাধুলো করেছিলেন, তারাই যেন শ্রমণের শোকসন্তপ্ত বিরাট পরিবার।’
ফিশার তাঁর পুস্তিকা শেষ করেছেন রিয়োকোয়ানের সর্বশেষ কবিতাটি উদ্ধৃত করে–
চলে যাব যবে চিরতরে হেথা হতে
স্মৃতির লাগিয়া কী সৌধ আমি গড়ে যাব কোন পথে?
কিন্তু যখন আসিবে হেথায় ফিরে ফিরে মধু ঋতু
পেলব-কুসুম মুকুলিত মঞ্জরি
নিদাঘের দিন স্বর্ণ-রৌদ্রে ভরা
কোকিল কুহরে, শরৎ-পবন গান গায় গুঞ্জরি
রক্তপত্র সর্ব অঙ্গে মেপল লইবে পরে
এরাই আমার স্মৃতিটি রাখিবে ধরে।
এরাই তখন কহিবে আমার কথা।
ফুল্লকুসুম মুখর কোকিল যথা।
রক্তবসনা দীপ্তা মেপল শাখা
প্রতিবিম্বিত আমার আত্মা– এদেরই হিয়ায় আঁকা।
.
ফুটবল
‘পরশুরামে’র কেদার চাটুজ্যে মশাই দূর থেকে বিস্তর মেমসাহেব দেখেছিলেন; আমিও দূর থেকে বিস্তর সিনেমা-স্টার, পলিটিশিয়ান আর ফুটবল খেলোয়াড় দেখেছি। দেখে ওঁদের প্রতি ভক্তি হয়েছে এবং গদগদ হয়ে মনে মনে ওঁদের পেন্নাম জানিয়েছি।
তাই কী করে যে ‘ইস্টবেঙ্গল’ ক্লাবের কয়েকজন খেলোয়াড় এবং ম্যানেজার মশায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল তার সঠিক ব্যাখ্যা আমি এখনও সমঝে উঠতে পারিনি। তবে শুনেছি আমরা যেরকম খাঁচার ভিতর সিংহ দেখে খুশি হই, সিংহটাও নাকি আমাদের দিকে কৌতূহলের সঙ্গে তাকায় তার বিশ্বাস মানুষকে নাকি জড়ো করা হয় নিছক তাকে আনন্দ দেবার জন্য, যেদিন লোকের সংখ্যা কম হয় সেদিন নাকি সিংহ রীতিমতো মনমরা হয়ে যায়। (আরও শুনেছি, একটা খাঁচার গোটাকয়েক শিক ভেঙে যাওয়াতে গরিলা নাকি দস্তুরমতো ভয় পেয়ে গিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল তার বিশ্বাস ছিল খাঁচাটার উদ্দেশ্য তাকে মানুষের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য।)।
তাই যখন ‘ইস্টবেঙ্গলে’র গুটিকয়েক রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমার দিকে তাকালেন তখন আমি খুশি হলুম বইকি। তার পর তাদের মাধ্যমে আর সকলের সঙ্গেও মোলাকাত হয়ে গেল। সবকটি চমৎকার সন্তান, বিনয়ী এবং স্ত্র। আমি বরঞ্চ সদম্ভে তাঁদের শুনিয়ে দিলুম ছেলেবেলার ‘বি’ টিমের খেলাতে কীরকম কায়দাসে একখানা গোল লাগিয়ে দিয়েছিলুম, অবশ্য সেটা সুইসাইড গোল ছিল।
কেউ কেউ জিগ্যেস করলেন, আমি তাঁদের খেলা দেখতে যাব কি না? বললুম, ফাইনালের দিন নিশ্চয়ই দেখতে যাব। ম্যানেজার বললেন, তা হলে তো যে-করেই হোক ফাইনাল পর্যন্ত উঠতে হবে বিবেচনা করুন, একমাত্র নিতান্ত আমাকে খুশি করার জন্যই তাঁদের কী বিপুল আগ্রহ।
ফাইনালের দিন ম্যানেজার আমাকে আমার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিলেন।
***
দিল্লিতে ফুটবলের কদর কম। খেলা আরম্ভ হওয়ার পনেরো মিনিট পূর্বে গিয়েও দিব্য সিট পাওয়া গেল। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম আমার এক চ্যালাকে সিটিফিটি দেওয়ার জন্য। পরে দেখলুম, ও ওসব পারে না, সে জন্মেছে পশ্চিমে। বললুম, ‘আরে বাপু, মুখে আঙুল পুরে যদি হুইসিলই না দিতে পারিস তবে ফুটবল খেলা দেখতে এসেছিস কেন? রবিঠাকুরের “ডাকঘর” দেখতে গেলেই পারিস।’
খেলা দেখতে এসেছে বাঙালি– তাদের অধিকাংশ আবার পদ্মার ওপারের– আর মিলিটারি; এই দুই সম্প্রদায়। মিলিটারি এসেছে গোর্খা টিমকে সাহস দেবার জন্য, আর আমরা কী করতে গিয়েছি সে কথা তো আর খুলে বলতে হবে না। অবশ্য আমাদের ভিতর যে ‘মোহনবাগান’ কিংবা ‘কালীঘাট’ ফ্যান ছিলেন না, সে কথা বলব না, তবে কলকাতা থেকে এত দূর বিদেশে তাঁরা তো আর গোর্খাদের পক্ষ নিতে পারেন না। ‘দোস্ত নিস্ত, লেকিন দুশমন ই-দুশমন হস্ত’ অর্থাৎ ‘মিত্র নয়, তবে শত্রুর শত্রু’ এই ফারসি প্রবাদ সর্বত্র খাটে না।
পিছনে দুই সর্দারজি বড় ভ্যাচর ভ্যাচর করতে লাগল। ইস্টবেঙ্গল নাকি ফাইনাল পর্যন্ত উঠেছে নিতান্ত লাসে কপাল জোরে, ওরা নাকি বড় রাফ খেলে (সবুট গোখার সঙ্গে রাফ খেলবে ইস্টবেঙ্গল!) আর পদে পদে নাকি অফসাইড। ইচ্ছে হচ্ছিল লোকটাকে দু ঘা বসিয়ে দিই কিন্তু তার বপুটা দেখে সাহস হল না।
***
খেলার পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই আমার মনে দৃঢ় প্রত্যয় হল ইস্টবেঙ্গল নিশ্চয়। জিতবে। দশ মিনিটের ভিতর গোখারা গোটা চারেক ফাউল করলে আর ইস্টবেঙ্গল গোটা তিনেক গোল দেবার মোকা নির্মমভাবে মিস করল। একবার তো বলটা গোলবারের ভিতরে লেগে দুম করে পড়ে গেল গোললাইনের উপর। গালি সেটা তড়িঘড়ি সরিয়ে ফেলে। আমি দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বললুম, ‘হে মা কালী, বাবা মৌলা আলী তোমাদের জোড়া পাঁঠা দেব, কিন্তু এরকম আস্কারা দিয়ে মস্কোরা কোরও না, মাইরি।’ বলেই মনে পড়ল ‘মাইরি’ কথাটা এসেছে ‘মেরি’ থেকে। থুড়ি গুঁড়ি বলে ‘দুর্গা, দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী’কে স্মরণ করলুম।
হাফটাইম হতে চলল গোল আর হয় না– এ কী গব্বযন্ত্রণা রে, বাবা। ওদিকে অবশ্য ফাউলের সংখ্যা কমে গিয়েছে– রেফারি দেখলুম বেজায় দড় লোক। কেউ ফাউল করলে তার কাছে ছুটে গিয়ে বেশ দু কথা শুনিয়েও দেয়। জিতা রহো বেটা। ফাউলগুলো সামলাও, তার পর ইস্টবেঙ্গলকে ঠ্যাকাবে কেডা।
না; হাফটাইম হয়ে গেল। খেলা তখনও আঁটকুড়ি– গোল হয়নি।
ওহে চানাচুর-বাদাম-ভাজা, এদিকে এস তো, বাবা। না, থাক, শরবতই খাই।
চেঁচাতে চেঁচাতে গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে। চ্যালাই পয়সাটা দিল; তা দেবে না? যখন হুইসিল দিতে জানে না! রেফারি আর ক বার হুইসিল বাজাল? সমস্তক্ষণ তো বাজালুম আমিই।
***
হাফটাইমের পর খেলাটা যদি দেখতেন। গপাগপ আরম্ভ হল পোলো দিয়ে রুই ধরার মতো গোল মারা।
আমি তো খেলার রিপোর্টার নই, তাই কে যে কাকে পাস করল, কে কতখানি প্যাটার্ন উইভ করল, কে ক জন দুশমনকে নাচাল লক্ষ করিনি, তবে এটা স্পষ্ট দেখলুম, বলটাই যেন মনস্থির করে ফেলেছে, সবাইকে এড়িয়ে গোখার গোলে ঢুকবেই ঢুকবে। একে পাশ কাটিয়ে, ওর মাথার উপর দিয়ে, কখনও-বা তিন কদম পেছিয়ে গিয়ে, কখনও-বা কারও দুপায়ের মধ্যিখানের ফাঁক দিয়ে বলটা হঠাৎ দেখি, ধাঁই করে হাওয়ায় চড়ে গোর্খা গোলের সামনে। সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃৎপিণ্ডটা এক লম্ফ দিয়ে টনসিলে এসে আটকে গিয়েছে–বিকৃত-স্বরে বেরুল ‘গো– অ– অ– ল!’ (‘রূপদর্শী’ দ্রষ্টব্য)।
ফুটবল ভাষায় একটি তীব্র ‘সট’-এর (‘Sot’–Shot নয়) ফলে গোলটি হল।
পিছনের সর্দারজি বললেন, ‘ইয়ে গোল বচানা মুশকিল নহি থা।’
আমি মনে মনে বললুম, ‘সাহিত্যে একে আমরা বলি, “মুখবন্ধ”। এরপর আরও গোটা দুই হলে তোমার মুখ বন্ধ হবে। লোকটা জোরালো না হলে–।’
***
এসব ভাবাভাবির পূর্বেই আরেকখানা রসের গোল হয়ে গিয়েছে। কেউ দেখল, কেউ না। একদম বেমালুম। তারই ধকল কাটাতে কাটাতে আরেকখানা, তিসরা অতিশয় মান-মনোহর গোল! সেটি স্পষ্ট দেখতে পেলুম। ও গোল কেউ বাঁচাতে পারত না। দশটা গোলি লাগিয়ে দিলেও না। এবার ম্যানেজারকে অভিনন্দন জানানো যেতে পারে। উঠে গিয়ে তাকে জোর শ্যাকহ্যান্ড করলুম। ভারি খুশি। আমায় বলল, প্রত্যেক গোলে আপনার রি-অ্যাকশন লক্ষ করছিলুম। আমরা আমাদের কথা রেখেছি (অর্থাৎ ফাইনালে উঠেছি) আর আপনিও আপনার কথা রেখেছেন (আমি কথা দিয়েছিলুম ওরা ফাইনাল জিতবেই)। তার সঙ্গী তো আমার হাতখানা কপালে ঠেকাল।
মোরগ যেরকম গটগট করে গোবরের ঢিপিতে ওঠে আমি তেমনি আমার চেয়ারে ফিরে এলুম। ভাবখানা, তিনটে গোলই যেন নিতান্ত আমিই দিয়েছি।
তার পর শাঁ করে আরও একখানা।
দশ-বারো মিনিটের ভিতর ধনাধন চারখানা আদি ও অকৃত্রিম, খাঁটি, নির্ভেজাল গোল!
পিছনের সর্দারজি চুপ।
চ্যালাকে বললুম, ‘চল বাড়ি যাই। খেলা কী করে জিততে হয়, হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলুম তো’
রাত্রে সব খেলোয়াড়দের অভিনন্দন জানাতে গেলুম। গিয়ে দেখি এক ঢাউস ট্রফি। সঙ্গে আরেকটা বাচ্চা। বললুম, ‘বাচ্চাটাই ভালো। বড়টা রাখা শক্ত (উভয়ার্থে)।’
ওদেরই বিস্তর নাইন-নাইন্টি পুড়িয়ে বাড়ি ফিরলুম।
.
বেমক্কা
বন্ধুবর
গুলাম কুদুসকে—
লোকসঙ্গীত ও বিদগ্ধ সঙ্গীতে যে পার্থক্য সেটা সহজেই আমাদের কানে ধরা পড়ে, তেমনি লোকসাহিত্য ও বিদগ্ধ সাহিত্যের পার্থক্য সম্বন্ধেও আমরা বিলক্ষণ সচেতন। আর্টের যে কোনও বিভাগেই–নাট্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য—-তা সে যাই হোক না কেন, এই বিদগ্ধ এবং লোকায়ত রসসৃষ্টির মধ্যে পার্থক্যটা আমরা বহুকাল ধরে করে আসছি।
তাই বলে লোকসঙ্গীত কিম্বা গণসাহিত্য নিন্দনীয় একথা কোনও আলঙ্কারিকই কখনও বলেননি। বাউল ভাটিয়াল বর্বরতার লক্ষণ কিম্বা বারমাসী যাত্রাগান রসসৃষ্টির পর্যায়ে পড়ে না, একথা বললে আপন রসবোধের অভাব ঢাক পিটিয়ে বলা হয় মাত্র।
কিন্তু যখন এই লোকসংগীত বা লোকনৃত্য শহরের মাঝখানে স্টেজের উপর সাজিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সাড়ম্বরে শোনানো এবং দেখানো হয়, তখনই আমাদের আপত্তি। যখনই বলা হয় এই সাঁওতাল নাচের সামনে ভরতনৃত্যম হার মানে কি বলা হয় এই ‘রাবণবধ’ পালা ডাকঘরের উপর ছক্কাপাঞ্জা মেরেছে–তোমরা অতিশয় বেরসিক বর্বর বুর্জুয়া বলে এ তত্ত্বটা বুঝতে পারছ না, তখন নিরীহ বুর্জুয়া হওয়া সত্ত্বেও আপত্তি না করে থাকতে পারিনে।
কথাটা খুলে বলি। লোকসঙ্গীত (এবং বিশেষত গণনৃত্য) ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে পার্থক্য অনেক জায়গায় আছে, কিন্তু একটা পার্থক্য এ স্থলে বলে নিলে আমার প্রতিবাদের মূল তত্ত্বটা পাঠক সহজেই ধরে নিতে পারবেন; এই ধরুন, সাঁওতাল কিম্বা গুজরাতের গরবা নাচ। এগুলো গণনৃত্য এবং এর সবচেয়ে বড় জিনিস এই যে, এ নাচে সমাজ বা শ্রেণির সকলেই হিস্যাদার। চাঁদের আলোতে, না-ঠাণ্ডা না-গরম আবহাওয়াতে জনপদবাসী যখন দু দণ্ড ফুর্তিফার্তি করতে চায়, তখন তারা সকলেই নাচতে শুরু করে। যাদের হাড় বড় বেশি বুড়িয়ে গিয়েছে তারা ঘরে শুয়ে থাকে, কিন্তু যারা আসে তাদের কেউই নাচ থেকে বাদ যায় না। হয় নাচে, না হলে ঢোল বাজায় বাচ্চা কোলে নিয়ে আধবয়সী মাদেরও নাচের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। তাই বলা যেতে পারে সাঁওতাল কিম্বা গরবা নাচ–অর্থাৎ তাবৎ গণনৃত্যই–নাচা হয় আপন আনন্দের জন্য লোককে দেখানোর জন্য, কিম্বা ‘লোক দেখানো’র জন্য নয়। অর্থাৎ লোকনৃত্যে দর্শক থাকে না।
কিন্তু যখন উদয়শঙ্কর নাচেন তখন আমরা সবাই ধেই ধেই করে নেচে উঠিনে, কিম্বা যখন খানসাহেব চোখ বন্ধ করে জয়জয়ন্তী ধরেন তখন আমরা আর সবাই চেল্লাচেল্লি করে উঠিনে। ইচ্ছে যে একদম হয় না সে কথা বলতে পারিনে, তবু যে করিনে তার একমাত্র কারণ উদয়শঙ্করের সঙ্গে পা মিলিয়ে কিম্বা খানসাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে রসসৃষ্টি আমরা এক মুহূর্তের তরেও করতে পারিনে। (যদি পারতুম তবে উদয়শঙ্করের নাচ দেখবার জন্য, খানসাহেবের গান শুনবার জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করতুম না– কিম্বা বলতে পারেন, সিঙ্গীর গলায় আপন মাথা ঢোকাতে পারলে সার্কাসে যেতুম না)।
তাই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত কিংবা নৃত্যের জন্য শ্রোতা এবং দর্শকের প্রয়োজন।
লোকনৃত্যে যখন সবাই হিস্যা নিতে পারে আপন পা চালিয়েই, তখন একথা আশা করি সকলেই মেনে নেবেন যে, সে নৃত্য খুব সরল হওয়াই স্বাভাবিক। তাতে সূক্ষ্ম পায়ের কাজ থাকার কথা নয়, ভাবভঙ্গি প্রকাশের জন্য দুর্বোধ্য মুদ্রা সেখানে থাকতেই পারে না এবং তাই বলা যেতে পারে, সে নৃত্যে আর যা থাকে থাকুক, বৈচিত্র্য থাকতে পারে না।
তাই গণনৃত্য মাত্রই একঘেয়ে।
কম্যুনিস্ট ভায়ারা (কমরেডরা) মনস্থির করেছেন গণ-কলা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ কলা এবং সেই গণনৃত্য শহুরে বুর্জুয়াদের দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে হবে। তাই মেহন্নত, ততোধিক তকলিফ বরদাস্ত করে তারা শহরে স্টেজ খাটান, পর্দা ঝোলান, রঙ-বেরঙের আলোর ব্যবস্থা করেন আর তার পর চালান দ্রৈাবাদী কিম্বা কুয়াম্বতুরেরও হতে পারে– জানিনে, ধোপার নাচ। কিম্বা গুজরাতি গরবা। বলেন, ‘পশ্য, পশ্য’–থুড়ি, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, এরই কয় লাচ।’
পূর্বেই নিবেদন করেছি গণনৃত্য নিন্দনীয় নয়, কিন্তু যে গণনৃত্য একঘেয়ে এবং বৈচিত্র্যহীন হতে বাধ্য, সেই নাচ দেখতে হবে ঝাড়া আধঘণ্টা ধরে? ঘন ঘন হাততালি দিয়ে বলতে হবে ‘মরি, মরি’? দু চার মিনিটের তরে যে এ নাচ দেখা যায় না, সেকথা বলছিনে।
আলো-অন্ধকারে ভিন্ গাঁয়ে যাচ্ছেন, দেহ ক্লান্ত, মন অবসন্ন, চাঁদ উঠি উঠি করেও উঠছেন না– এমন সময় দেখতে পেলেন গায়ের মন্দিরের আঙিনায় একপাল মেয়ে মাথায় ছাদাওলা কলসিতে পিদিম রেখে চক্কর বানিয়ে ধীরে ধীরে মন্দমধুর পা ফেলে নাচছে। জানটা তর হয়ে গেল। দু মিনিট দাঁড়িয়ে আলোর নাচ আর মেয়েদের গান, ‘সোনার দেওর, আমার হাত রাঙাবার জন্য মেহেদি এনেছ কি?’ দেখে নিলেন। কিন্তু তার পর? যে নাচ আস্তে আস্তে বিকাশের দিকে এগিয়ে যায় না, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি, পদবিন্যাসের ভিতর দিয়ে যে নাচ পরিসমাপ্তিতে পৌঁছয় না, সে নাচ দেখবেন কতক্ষণ ধরে? এ নাচের পরিসমাপ্তি কোনও রসসৃষ্টির অভ্যন্তরীণ কারণে হয় না; এর পরিসমাপ্তি হয় নর্তকীরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েন তখনই।
আলো-অন্ধকার, চাঁদ উঠি উঠি, শ্যাওলামাখা ভাঙা দেউলের পরিবেশ থেকে হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে নিয়ে আসা নৃত্য শহরের স্টেজে মূৰ্ছা তো যায় বটেই, তার ওপর মাইক্রোফোনযোগে চিৎকার করে তারস্বরে আপনাকে বলা হয় ‘এ নাচ বড় উমদা নাচ।’ এ নাচ আপনাকে দেখতে হয় আধঘণ্টা ধরে! আধঘণ্টা ধরে দেখতে হয় সেই নাচ, যার সর্ব পদবিন্যাস মুখস্থ হয়ে যায় আড়াই মিনিটেই।
পনেরো টাকার সিটে বসে (টাকাটা দিয়েছিলেন আমার এক গোলাপি অর্থাৎ নিম-কমুনিস্টি কমরেড) আমি আর থাকতে না পেরে মুখে আঙুল পুরে সিটি দিয়েছিলুম প্রাণপণ। হৈ হৈ রৈ রৈ। মার মার কাট কাট। এ কী বর্বরতা?
আমি বললুম, “কেন বাওয়া, আপত্তি জানাবার এই তো প্রলেটারিয়েটস অব দি প্রলেটারিয়েট কায়দা।’
.
আমরা হাসি কেন?
প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে কবিগুরু বিশ্বভারতী সাহিত্য-সভায় এক খ্যাতনামা লেখকের সদ্যপ্রকাশিত একটা রচনা পাঠ করেন। রচনার আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল, ‘আমরা হাসি কেন?’
এতদিন বাদে আজ আর সবকথা মনে নেই, তবে এইটুকু স্পষ্ট স্বরণে পড়ছে যে, বেসন হাসির কারণ অনুসন্ধান করে যেসব তত্ত্বকথা আবিষ্কার করেছিলেন, প্রবন্ধটি মোটের ওপর তারই উপর খাড়া ছিল।
প্রবন্ধ পাঠের পর রবীন্দ্রনাথ আপন বক্তব্য বলেন।
সভায় উপস্থিত অন্যান্য গুণীরাও তখন নানারকম মতামত দেন এবং সবাই মিলে প্রাণপণ অনুসন্ধান করেন, ‘আমরা হাসি কেন?’ যতদূর মনে পড়ছে, শেষ পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য কোনও পাকাপাকি কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না।
পরদিন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন সভার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘হাসির কারণ বের করতে গিয়ে সকলের চোখে জল বেরিয়ে গিয়েছিল।’ (ঠিক কী ভাষায় তিনি জিনিসটে রসিয়ে বলেছিলেন আজ আর আমার সম্পূর্ণ মনে নেই– আশা করি আচার্য অপরাধ নেবেন না)।
***
দিল্লির ফরাসিস ক্লাবের (‘সের্কল ফ্রাসেঁ’ অর্থাৎ ‘ফরাসি-চক্র’) এক বিশেষ সভায় মঁসিয়ে মার্তে নামক এক ফরাসি গুণী গত বুধবার দিন ওই একই বিষয় নিয়ে অর্থাৎ ‘আমরা হাসি কেন?’ একখানি প্রামাণিক প্রবন্ধ পাঠ করেন।
ফরাসি রাজদূত এবং আরও মেলা ফরাসি জাননেওয়ালা ফরাসি অ-ফরাসি ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা সভায় উপস্থিত ছিলেন। ফরাসি কামিনীগণ সর্বদাই অত্যুত্তম সুগন্ধ ব্যবহার করেন বলে ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছিল আমি বুঝি প্যারিসে বসে আছি।
(এ কিছু নতুন কথা নয়– এক পূর্ববঙ্গবাসী শিয়ালদা স্টেশনে নেমেও গেয়েছিলেন–
ল্যামা ইসটিশানে গাড়ির থনে
মনে মনে আমেজ করি
আইলাম বুঝি আলী-মিয়ার রঙমহলে
ঢাহা জেলায় বশ্যাল ছাড়ি।)
শুধু প্যারিস নয় আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন ‘কোতি’ ‘উবিগাঁর’ খুশবায়ের দোকানে বসে আছি।
ডা. কেসকর উত্তম ফরাসি বলতে পারেন। তিনি সভাপতির আসন গ্রহণ করে প্রাঞ্জল ফরাসিতে বক্তার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
সেই বের্গসন আর সেই চিরন্তন কারণানুসন্ধান, ‘হাসি কেন?’ আমি তো নাকের জলে চোখের জলে হয়ে গেলুম– ত্রিশ বৎসর পূর্বে যেরকম ধরা হয়েছিলুম– কিন্তু তবু কোনও হদিস মিলল না।
কিন্তু সেইটে আসল কথা নয়। আসল কথা হচ্ছে, এই দিল্লির শহর যে ক্রমে ক্রমে আন্তর্জাতিক মহানগরী হতে চলল সেইটেই বড় আনন্দের কথা।
এতদিন ধরে আমরা ইয়োরোপকে চিনতে শিখলুম ইংরেজের মাধ্যমে এবং তাতে করে মাঝে মাঝে আমরা যে মারাত্মক মার খেয়েছি। তার হিসেব-নিকেশ এখনও আরম্ভ হয়নি। একটা সামান্য উদাহরণ নিন।
ইংরেজের আইরিশ স্টু, মাটন রোস্ট আর গ্রাম পুডিং খেয়ে খেয়ে আমরা ভেবেছি ইয়োরোপবাসী মাত্রই বুঝি আহারাদি বাবতে একদম হটেনটট। তার পর যেদিন উত্তম ফরাসি রান্না খেলুম, তখন বুঝতে পারলুম, ক্রোয়াস রুটি কীরকম উপাদেয়, একটি মামুলি অমলেট বানাতে ফরাসি কতই না কেরানি-কেরামতি দেখাতে পারে, পাকা টমাটো, কাঁচা শসা আর সামান্য লেটিসের পাতাকে একটুখানি মালমশলা লাগিয়ে কী অপূর্ব স্যালাড় নির্মাণ করতে পারে। মাস্টার্ড, উস্টারসস আর বিস্তর গোলমরিচ না মাখিয়েও যে ইয়োরোপীয় রান্না গলাধঃকরণ করা যায় সেইটি হৃদয়ঙ্গম হল ফরাসি রান্না খেয়ে।
তাই আমার আনন্দ যে, ধীরে ধীরে একদিন ফ্রান্সের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত এ দেশে বসেই হবে।
সের্কল ফ্রাসেঁ দিল্লিবাসীকে তার জন্য তৈরি করে আনছেন।
***
প্রবন্ধ পাঠের পর মসিয়া মার্তে কয়েকটি রসালো গল্প বলেন। তিনি যে অনবদ্য ভাষায় এবং তার সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি সঞ্চালনে গল্পগুলো পেশ করেছিলেন যে জিনিস তো আর কালি-কলমে ওতরাবে না– তাই গল্পটি পছন্দ না হলে মসিয়োর নিন্দা না করে দোষটা আমারই ঘাড়ে চাপাবেন। এক রমণী গিয়েছেন এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। তিনি ডাক্তারের ঘরে ঢুকতেই ডাক্তার তাঁকে কোনও কথা বলবার সুযোগ না দিয়েই আধঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিতে লাগলেন। অতি কষ্টে সুযোগ পাওয়ার পর রমণী বললেন, ‘ডাক্তার, আমাকে অতশত বোঝাচ্ছেন কেন? আমি এসেছি আমার স্বামীর চিকিৎসা করাতে।’
ডাক্তার বললেন, ‘ও! তাঁর কী হয়েছে?’
রমণী বললেন, ‘ঠিক ঠিক বলতে পারব না তবে এইটুকু জানি, তার বিশ্বাস তিনি সিল মাছ।’
‘বলেন কী? তা, তিনি এখন কোথায়?’
‘তিনি বারান্দায় বসে আছেন।’
‘তাঁকে নিয়ে আসুন তো, দেখি, ব্যাপারটা কী।’
ভদ্রমহিলা বাইরে গিয়ে সঙ্গে নিয়ে এলেন একটা সিল মাছ।