কাহিনি রক্তসিক্ত
১৮৬৩ সাল, গ্রীষ্মের শেষ।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অধিকৃত মেক্সিকোর অন্তর্গত কলোর্যাডো টেরিটরি নামক রাজ্যে স্থানীয় শাসনকর্তা গভর্নর জন ইভান্সের কাছে চিঠি পাঠাল একজন মেক্সিকোর অধিবাসী।
তার নাম, ফিলিপ নিরিও এসপিনোসা।
ফিলিপের চিঠিতে যা লেখা ছিল তার সারমর্ম হচ্ছে, যদিও সরকার তাকে ছাব্বিশটি আমেরিকান কুকুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী করছেন, তবু পত্ৰলেখকের মতে এ-বিষয়ে স্থানীয় অধিবাসী ও সৈন্যদের মতামত গ্রহণ করা উচিত, কারণ শেষোক্ত ব্যক্তিদের মতে পত্রলেখক কর্তৃক নিহত মানুষের সংখ্যা কম করেও চল্লিশ। তবে এ-বিষয়ে জোর করে কিছু বলা যায় না, লোকে হয়তো পত্ৰলেখককে একটু বেশি সম্মান দিয়ে থাকে। যাই হোক, এই খুনখারাপির ব্যাপারটা পত্ৰলেখকের কাছে অত্যন্ত ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে, তাই সে এখন শান্তি চায়। শান্তির মূল্য হিসাবে তার কিছু চাহিদা আছে–সদয় সরকার যদি সেই যৎসামান্য দাবি পূরণ করেন, তাহলে পত্ৰলেখক ফিলিপ তার অস্ত্র নামিয়ে দলের লোকদের খুনোখুনি থেকে নিরস্ত করতে রাজি। নিম্নলিখিত শর্তগুলি পত্রে উল্লিখিত যৎসামান্য দাবি
১) ফিলিপ এবং তার দলবল সম্পর্কে যেসব হত্যা, লুণ্ঠন ও চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আছে, সেই অভিযোগগুলিকে প্রত্যাহার করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষমা করতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া চলবে না।
(২) এসপিনোসা পরিবারভুক্ত যাবতীয় ব্যক্তির অধিকৃত পশুগুলিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মেনে নিতে হবে (ওই পশুগুলি লুঠের মাল বলে সন্দেহ হলেও সে-বিষয়ে অনুসন্ধান করা চলবে না) এবং কয়েক হাজার একর জমি পূর্বোক্ত ব্যক্তিদের দান করতে বাধ্য থাকবেন আমেরিকান সরকার। শুধু তাই নয়, ওইসব জমির কাছাকাছি গো-চারণের উপযুক্ত তৃণভূমিও জমির মালিকদের দান করবেন সদাশয় সরকার। (সব মিলিয়ে পত্রে লিখিত জমির পরিমাণ সমগ্র কলোরাডো রাজ্যের এক দশমাংশ তো বটেই)।
(৩) ফিলিপ, তার ভ্রাতুস্পুত্র এবং আরও দুজন এসপিনোসা পরিবারের যোগ্য ব্যক্তি কলোরাডো ভলান্টিয়ার কোম্পানি নামক সেনাদলে ভরতি হতে চায়–অবশ্য সাধারণ সৈনিক হিসাবে নয়, ক্যাপ্টেন বা সেনানায়কের মর্যাদা দিয়েই উক্ত বাহিনীতে তাদের নিয়োগ করতে হয়। যোগ্যতার প্রমাণ হিসাবে পত্রলেখক জানিয়েছে, অত্যন্ত অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যে লড়াই করে তারা সরকারের ছাব্বিশটি প্রজাকে হত্যা করেছে, কিন্তু তাদের তরফে মারা গেছে মাত্র একজন এসপিনোসা–এটাই কি তাদের যোগ্যতার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নয়?
স্থানীয় শাসনকর্তা গভর্নর জন ইভান্স ফিলিপের চিঠি পেয়ে খুশি হলেন। দেশজোড়া অজস্র খুনখারাপির মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধীটিকে গ্রেপ্তার করার কাজটা সহজ হয়ে গেল। রাজধানী ওয়াশিংটনে ইভান্স সাহায্য চেয়ে পাঠালেন। উত্তর এল, গৃহযুদ্ধ নিয়ে সরকার এখন অত্যন্ত বিব্রত, অতএব নিজস্ব ক্ষমতায় গভর্নর যেন বর্তমান সমস্যার সমাধান করেন।
গভর্নর ইভান্স ওয়াশিংটনের ভরসা না-করে এইবার নিজের ক্ষমতায় সমস্যার সমাধান করতে সচেষ্ট হলেন। চিঠিতে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সরকারকে সময় দেওয়া হয়েছিল। ওই পত্রে ফিলিপ জানিয়েছিল তার যুক্তিসংগত ন্যায্য শর্তগুলি সরকার যদি মেনে নিতে রাজি না থাকেন, তাহলে আবার সে যুদ্ধ ঘোষণা করবে এবং তার ফলে আরও ৫৭৪ জন আমেরিকানের প্রাণহানি যে অবশ্যম্ভাবী এ-কথাটা যেন গভর্নর মনে রাখেন।
গভর্নর ইভান্স ঘোষণা করলেন, জীবিত বা মৃত ফিলিপ এসপিনোসাকে সরকারের কাছে যে হাজির করতে পারবে, সেই ব্যক্তিকে ২৫০০ ডলার পুরস্কার দেবেন সরকার।
এইবার পাঠকদের কাছে ফিলিপ এসপিনোসা নামক ভয়ানক মানুষটির পরিচয় দেওয়া দরকার। মেক্সিকো থেকে নিউ মেক্সিকোর কাঁচেটি অঞ্চলে পদার্পণ করেছিল ফিলিপ, কিন্তু ঠিক কোন সময়ে তার আবির্ভাব ঘটেছিল সে-কথা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। এসপিনোসা বংশ একটি বিরাট গোষ্ঠী–ভাই, ভাইপো, ভাগনে প্রভৃতি বিভিন্ন সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন নিয়ে বিরাট দল পরিচালনা করত পূর্বোক্ত ফিলিপ এসপিনোসা। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে সমগ্র স্প্যানিশ মেক্সিকোর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ ছিল এসপিনোসা বংশের অন্তর্গত।
স্যান লুই উপত্যকা থেকে কোর্যাডো রাজ্যের স্যান রাফাল নামক পর্বতবেষ্টিত শহরে এসে প্রথম হানা দেয় ফিলিপ এবং তার দলবল–তারপর শুধু হত্যা ও লুণ্ঠনলীলার বীভৎস ইতিহাস।
প্রথম প্রথম তারা ঘোড়া চুরি করত। একটা ঘোড়া বিক্রি করলে কম করেও পাঁচশো ডলারের প্রাপ্তিযোগ–অতএব বেশ কিছুদিন ওই লাভজনক ব্যাবসা চালিয়ে গেল ফিলিপের দল। দস্যুবৃত্তি করলেও তাদের মধ্যে রসবোধ ছিল বিলক্ষণ, তবে রসিকতার ধরনটা হয়তো সকলের কাছে উপভোগ্য ছিল না।
দস্যুদের রসিকতার একটি উদাহরণ পাঠকদের সামনে উপস্থিত করছি :
সান্টা ফি থেকে গ্যালিসটিওর পথে একটা গাড়ি লুঠ করে দস্যুদল শকটচালকের পা দুটি এমনভাবে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল যে, বেচারার শরীরটা মাটির ওপর পড়ে রইল অসহায় অবস্থায়। লোকটিকে ওইভাবে ঝুলিয়ে রেখে গাড়ির ঘোড়া দুটিকে চাবুক মেরে দস্যুরা ছুটিয়ে দিল। শকটচালককে তারা খুন করেনি, কারণ উক্ত গাড়োয়ান ছিল মেক্সিকোর অধিবাসী। কিন্তু প্রাণে বাঁচলেও গাড়োয়ান বেচারার অবস্থা হয়েছিল অতিশয় শোচনীয়, পথের ওপর ঠোক্কর খেতে খেতে তার সর্বাঙ্গ হয়ে গিয়েছিল ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত। বলা বাহুল্য, দস্যুদের রসিকতা ওই গাড়োয়ানটির কাছে খুব উপভোগ্য মনে হয়নি।
ঘোড়া চুরির ছোটো কাজে নিজেকে খুব বেশিদিন আবদ্ধ রাখল না ফিলিপ, বসন্তকাল শুরু হতে-না-হতেই দলবল নিয়ে হত্যা ও লুণ্ঠনকার্যে মনোনিবেশ করল সে। আরাকানসাস নদীতীরে এবং সাউথ পার্ক অঞ্চলে ফিলিপের হাতে নিহত মানুষের সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ণয় করাও সম্ভব হয়নি। স মিল গালচ নামক স্থানটি দুবৃত্তদের হত্যালীলার ফলে নাম বদলে হয়ে গেল ডেড ম্যানস ক্যানিয়ন অর্থাৎ মৃত মানুষের খাদ। পূর্বোক্ত স্থানে একটি কারখানার মধ্যে বাস করত ওই কারখানারই মালিক বৃদ্ধ হেনরি হার্কেন। হেনরির সহকারী ও অংশীদাররা কাজকর্মের শেষে স্থানত্যাগ করতেই অকুস্থলে আত্মপ্রকাশ করল ফিলিপ ও তার খুনে চ্যালাচামুণ্ডার দল। ওরা এতক্ষণ আড়াল থেকে নজর রাখছিল, এইবার বৃদ্ধকে একা পেয়ে আক্রমণ করল। কুঠারের প্রচণ্ড আঘাতে বৃদ্ধের মস্তক হল বিদীর্ণ, তারপর ঘরবাড়ি দরজার উপর চলল দুবৃত্তদের ধ্বংসলীলা। ঘরবাড়ির ভগ্নদশা দেখে প্রথমে রেড ইন্ডিয়ানদের সন্দেহ করা হয়েছিল, কারণ, ওই অরণ্যচারী জাতি কাউকে হত্যা করলে নিহত ব্যক্তির ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে যায়। তারপর আবার সন্দেহ পড়ল বৃদ্ধের দুই অংশীদারের উপর তাদের নাম মি. ফার্সন ও মি. ব্যাসেট। পরে অবশ্য আসল ঘটনা জানা যায় এবং নিরাপরাধ ভদ্রলোক দুটিও মুক্তি পান।
পরবর্তী ঘটনাগুলি হচ্ছে বীভৎস রক্তারক্তির ধারাবাহিক ইতিহাস। খুনের পর খুন করতে করতে সদলবলে ফিলিপ এগিয়ে চলল ক্যালিফোর্নিয়া গালচ নামক খনি-এলাকায়। জর্জ ব্রুস নামে একজন আমেরিকান ভদ্রলোককে তারা ওই অঞ্চলে খুন করেছিল। খুনের ধরনটা ছিল পূর্বে উল্লিখিত বৃদ্ধ হেনরির হত্যাকাণ্ডের অনুরূপ। স্থানীয় শেরিফ ও তার বাহিনী খুনিদের অনুসরণ করতে গিয়ে পথের মধ্যে আরও কয়েকটা রক্তাক্ত মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিল, কিন্তু খুনিদের সে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
হত্যার তাণ্ডব চলল দীর্ঘদিন ধরে। প্রথম প্রথম খুনির স্বরূপ নির্ণয় করতে পারেনি সরকার কে দায়ী এই হত্যাকাণ্ডগুলির জন্য? রেড ইন্ডিয়ান? সন্ত্রাসবাদী বিদ্রোহী? কর্তৃপক্ষ বিভ্রান্ত, বিমূঢ়। অনেক সময় দেখা গেছে নিহত মানুষের ধনসম্পত্তি তার সঙ্গেই অবস্থান করছে, অর্থাৎ নিছক রক্তপিপাসাকে তৃপ্ত করার জন্যই খুন করেছে খুনি। স্থানীয় দস্যুরা এভাবে অনর্থক নরহত্যা করে না। মৃতদেহের মাথার চামড়া অক্ষত দেখে বোঝা যায় রেড ইন্ডিয়ানরাও ওইসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী নয়, কারণ, রেড ইন্ডিয়ানদের প্রথা অনুসারে কাউকে হত্যা করলে নিহত ব্যক্তির চুলসুদ্ধ মাথার চামড়া তারা ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে যায়। মৃতদেহের অঙ্গে উজ্জ্বল পোশাকপরিচ্ছদ থাকলে সেগুলি অবশ্য খুনি লুঠ করত, আরও লুঠ করত ঘড়ি, আংটি, ছুরি প্রভৃতি বস্তু। মৃতদেহগুলো দেখলেই বোঝা যেত অন্ধ আক্রোশে হত্যাকারী তাদের উপর অস্ত্র চালনা করেছে। শুধু গুলি চালিয়ে নরহত্যা করে খুশি হত না খুনি, বারংবার ছুরিকাঘাত করে নিহত মানুষগুলোকে সে টুকরো টুকরো করে ফেলত। তবে খুনি যে খ্রিস্টধর্মের প্রতি অত্যন্ত অনুগত সে-বিষয়ে সন্দেহ ছিল না–নিহত মানুষের বুকের ওপর ছুরি দিয়ে আঁকা থাকত রক্তাক্ত ক্রসচিহ্ন অথবা দুটো গাছের ডাল কেটে আড়াআড়িভাবে ক্রস বেঁধে খুনি সেটাকে মৃতদেহের বুক ভেদ করে মাটির ওপর বসিয়ে দিত।
যে-লোকগুলো খুন হয়েছিল, তারা প্রায় সকলেই ছিল খুনির অপরিচিত। নিহত ব্যক্তিদের একমাত্র অপরাধ, তারা ছিল আমেরিকান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃদ্ধদের হত্যা করা হত। মনে হয়, ১৮৪৬ থেকে ১৮৪৮ সালের মধ্যে মেক্সিকো এবং আমেরিকার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের সময়ে ওই বৃদ্ধরা আমেরিকা-সরকারের সঙ্গে জড়িত ছিল সন্দেহ করেই খুনি তাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। মেক্সিকান ফিলিপ ছিল ঘোর সাম্প্রদায়িক আমেরিকানদের উপর সে ছিল বেজায় খাপ্পা। তার ক্রোধের আগুনে প্রাণ বিসর্জন দিতে লাগল বহু আমেরিকান। কলোরাডো রাজ্যে এমন হত্যাপাগল হন্তারক আগে কখনো আত্মপ্রকাশ করেনি।
ফিলিপ এসপিনোসাকে স্বচক্ষে দেখেও জীবিত আছে এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। তবু সেই অল্পসংখ্যক মানুষের বর্ণনা থেকে জানা যায় পূর্বোক্ত নরঘাতক দুবৃত্ত নাকি যেমন লম্বা তেমনই চওড়া–দুই কালো চোখে তীব্র প্রখর দৃষ্টি, চেপটা নাক, চোয়াল ঘিরে ঘন দাড়ির জঙ্গল এবং মাথার ওপর সুদীর্ঘ কালো কেশের নিবিড় সমাবেশ।
ফিলিপের নিত্যসঙ্গী ছিল ভিভিয়েন নামে একটি যুবক। ফিলিপের মতো বিপুল দেহ, প্রচণ্ড শক্তি ও দুরন্ত সাহসের অধিকারী না হলেও ভিভিয়েন ছিল পাকা খুনি–নরহত্যায় তার কুণ্ঠা ছিল না কিছুমাত্র। হিংস্র ও নির্মম ভিভিয়েন ছিল ফিলিপ এসপিনোসার যোগ্য সহচর।
ফিলিপকে যে-মানুষটি প্রথম স্বচক্ষে দর্শন করেছিল, সে এক ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান–নাম, এড মেটকাফ।ফেয়ার প্লে থেকে এলমা শহরে যাচ্ছিল এড, আচম্বিতে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক বীভৎস দৃশ্য–পথের উপর একটি নিশ্চল নরদেহের উপর পরমানন্দে ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে দুটি মানুষ। বলাই বাহুল্য যে, লোক দুটি হচ্ছে ফিলিপ আর ভিভিয়েন। ধাবমান শকটের পথ ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেল দুই খুনি, কিন্তু কাজে বাধা পড়ায় তাদের মেজাজ গরম হয়ে উঠল। শকটচালক এডকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ল ফিলিপ, অব্যর্থ লক্ষ্যে বুলেট এসে পড়ল এডের বুকে। এড লুটিয়ে পড়ল গাড়ির মধ্যে অবস্থিত কাঠের স্তূপের উপর। কিন্তু লক্ষ্যভেদ করতে পারলেও এডকে খুন করতে পারেনি ফিলিপ এডের বুকপকেটে ছিল একটা ছোটো বই, গুলিটা বইয়ের উপর পড়েছিল বলেই সে বেঁচে গেল। আঘাতের বেগ তাকে উলটে ফেলেছিল বটে, কিন্তু গুলি সেই বইটাকে ভেদ করে তার দেহ স্পর্শ করতে পারেনি।
শকটচালক এড মেটকাফ হত্যাকারীদের বর্ণনা দিয়ে বলেছিল, লোক দুটোর গায়ের রং ফর্সা নয়, সম্ভবত তারা রেড ইন্ডিয়ান। দুজনের মধ্যে যে-লোকটির বয়স বেশি তার মুখখানা থালার মতো, মাথায় লম্বা চুল; আড়েবহরে প্রকাণ্ড ওই খুনির কদাকার চেহারার দিকে তাকালে আতঙ্কে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়, মনে হয় একটা হিংস্র জন্তুর সামনে এসে পড়েছি। খুব চড়া রং-এর জমকালো পোশাক পরেছিল দুই খুনি, আর তাদের সর্বাঙ্গ ঘিরে ঝুলছিল মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র রাইফেল, পিস্তল, ছোরা।
ফিলিপের হত্যালীলা চলল অবিরাম। ওইসব হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা অত্যন্ত একঘেয়ে আর বৈচিত্র্যহীন। কলোরাডো রাজ্যের শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করে চলল ফিলিপ এসপিনোসার রক্তসিক্ত বিজয়-অভিযান।
অবশেষে একদিন মৌচাকে ঢিল পড়ল। লেফটেন্যান্ট জর্জ এল শুপ নামক সেনাবিভাগের একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কনিষ্ঠ ভ্রাতা মারা পড়ল ফিলিপের হাতে। মৃত ব্যক্তি ছিল সৈনিক, তার মৃত্যুতে হইচই পড়ে গেল চারদিকে। সৈন্যরা যদি এমনভাবে খুন হয়, তবে জনসাধারণের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? এমন ভয়ানকভাবে ওই সৈন্যটিকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল যে, তার মৃতদেহ দেখে তাকে শনাক্ত করা যায়নি–সৈনিকের ছিন্নভিন্ন পরিচ্ছদ বা ইউনিফর্ম থেকেই মৃত ব্যক্তির স্বরূপ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছিল।
ক্রোধ, ঘৃণা ও আতঙ্কে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল কলোরাডোর মানুষ। জন ম্যাকক্যানন নামে জনৈক প্রতিপত্তিশালী খনি-মালিক নিজে উদ্যোগী হয়ে একটি বেসরকারি বাহিনী গড়ে তুলল। বনপথে বিচরণ করতে অভ্যস্ত কুড়িটি স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গঠিত ওই বেসরকারি বাহিনীর প্রত্যেকটি লোক ছিল লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত, প্রাণ-দেওয়া-নেওয়ার রক্তাক্ত খেলা খেলতে তাদের আপত্তি ছিল না কিছুমাত্র। বন্দুক-পিস্তলে দক্ষ ভয়ংকর ওই মানুষগুলোর উপযুক্ত নেতা ছিল জন ম্যাকক্যানন। ম্যাকক্যাননের মুখে ছিল মস্ত দাড়ি, দেহ ছিল প্রকাণ্ড। দলবল নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে সে বেরিয়ে পড়ল হত্যাকারী ফিলিপের সন্ধানে।
বনপথে ঘোরাফেরা করে জীবিকা নির্বাহ করতে যারা অভ্যস্ত, তাদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া খুব কঠিন–সেইজন্যই বেছে বেছে ওই ধরনের মানুষ নিয়ে দল গঠন করেছিল ম্যাকক্যানন। কয়েকদিন অক্লান্তভাবে অনুসরণ করার পর ম্যাকক্যানন ও তার বাহিনী জঙ্গলের মধ্যে একদিন খুনিদের আবিষ্কার করতে সমর্থ হল।
অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে বসেছিল দুই দুবৃত্ত, সঙ্গে ছিল তিনটি ঘোড়া। ম্যাকক্যাননের বাহিনী থেকে জো ল্যাম্ব নামে একটি লোক প্রথমে গুলি চালিয়েছিল। গুলি লাগল ভিভিয়েনের পায়ে, সে তৎক্ষণাৎ মাটির উপর ঝাঁপ খেয়ে শুয়ে পড়ল। আহত সঙ্গীর সাহায্যে ছুটে এল ফিলিপ এবং হিংস্রকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে দু-হাতে পিস্তল ছুঁড়তে শুরু করল। অপরপক্ষও চুপ করে রইল না, অগ্নি-উদগিরণ করে গর্জে উঠল অনেকগুলো রাইফেল।
একটা ঘোড়া আর্তনাদ করে ধরাশায়ী হল। তার দেহের আড়ালে দুবৃত্ত দুজন গা-ঢাকা দিয়ে গুলি চালাতে লাগল। সেই ম্যাকক্যাননের সঙ্গে ছিল আটজন স্বেচ্ছাসেবক, বাকি লোকজন সেখানে ছিল না। ওই আটজন লোক নিয়ে খুনি দুটোকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করল ম্যাকক্যানন। তার চেষ্টা সফল হল না, দুটি ঘোড়াকে একসঙ্গে ছুটিয়ে দিল ফিলিপ–একটার পিঠে সে বসেছিল, অপর ঘোড়াটার লাগাম ধরে জন্তুটাকে সে ব্যবহার করছিল জীবন্ত ও চলন্ত ঢালের মতো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একটা ঘন ঝোপের মধ্যে প্রবেশ করল ঘোড়া দুটি; একটা ঘোড়াকে ছেড়ে দিয়ে অপরটির পিঠে সওয়ার হয়ে ঝড়ের মতো পার্বত্য পথ অতিক্রম করে অদৃশ্য হল ফিলিপ, পিছনে পড়ে রইল তার তরুণ অনুচরের মৃতদেহ। চার্লি কার্টার নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক গুলি চালিয়ে ভিভিয়েনের মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল।
ম্যাকক্যানন ও তার বাহিনী এবার অকুস্থল থেকে কয়েকটি থলি কুড়িয়ে পেল। অশ্বারোহীরা ওই ধরনের থলি ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বহন করে। বলাই বাহুল্য, থলিগুলো ছিল দুবৃত্তদের সম্পত্তি। এবার খানাতল্লাশি–থলিগুলোর ভেতর থেকে পাওয়া গেল কাপড়চোপড়, রিভলভার, ছোরা, ঘড়ি প্রভৃতি। ওই জিনিসগুলো ছিল দস্যুহস্তে নিহত একাধিক মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ওইসঙ্গে একটা ডায়েরিও পাওয়া গিয়েছিল। ডায়েরিতে তারিখ দিয়ে বহু নরহত্যার সংবাদ লেখা রয়েছে–কেমন করে ওই আমেরিকানদের খুন করা হয়েছে সে-কথাও লেখা আছে সবিস্তারে। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা ওই ডায়েরির পাতা থেকে জানা গেল ৬০০ আমেরিকানকে হত্যা করার সংকল্প নিয়েছে ফিলিপ এসপিনোসা।
আর একটা কাগজের স্তূপ থেকে এমন ভয়ানক প্রতিজ্ঞার কারণটা বোধগম্য হল। আমেরিকার সেনাবাহিনী বিগত যুদ্ধে মেক্সিকোর ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল, তার ফলে শোচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল একটি এসপিনোসা বংশ। ওই বংশেরই ছেলে ফিলিপকে প্রতিশোধ নিতে উৎসাহিত করছিল তার বাপ। ছেলেও বাপের মান রেখেছে, অনেকগুলো আমেরিকানকে সে পরলোকে পাঠিয়েছে–সবসুদ্ধ ৬০০ আমেরিকানকে হত্যা না-করে সে ক্ষান্ত হবে না। সংখ্যাটা বিশেষ করে ছ-শো কেন হল সে-বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
পূর্বোক্ত ডায়েরি ও জিনিসগুলো নিয়ে দলবলের সঙ্গে ফিরে এল ম্যাকক্যানন। ভিভিয়েনের মৃতদেহ অবশ্য তারা অকুস্থলেই ফেলে এসেছিল। ক্যালিফোর্নিয়া গালচ নামক স্থানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে অভিনন্দন জানাল উল্লসিত জনসাধারণ।
ম্যাকক্যানন ভেবেছিল স্বেচ্ছাসেবক চার্লির গুলিতে নিহত তরুণ ভিভিয়েনই দলের সর্দার, অতএব তার মৃত্যুতে এখন আপদের শান্তি। কর্তৃপক্ষ কিন্তু ম্যাকক্যাননের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। কিছুদিন পরেই জানা গেল কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা অমূলক নয়–প্রচণ্ড বিক্রমে আবার আত্মপ্রকাশ করেছে ফিলিপ।
ভিভিয়েনের মৃত্যুর পর এক সপ্তাহ যেতে-না-যেতেই ফিলিপের হাতের কাজ দেখা গেল বিল স্মিথ নামে জনৈক নাগরিক প্রথমে খুন হল, পরবর্তী শিকার হল এক অখ্যাত সৈনিক।
খবর নিয়ে জানা গেল ফিলিপ একটি নূতন সঙ্গী সংগ্রহ করেছে। নূতন সহচরটিও এসপিনোসা বংশের ছেলে, বয়স তার খুবই কম–নাম, জুলিয়েন। বয়সে কৈশোর অতিক্রম না-করলেও খুনোখুনিতে ওস্তাদ ছিল জুলিয়েন, মানুষ মারতে তার হাত কাঁপত না একটুও। ফিলিপ ও জুলিয়েনের কবলে প্রাণ হারাল আরও কয়েকজন অভাগা আমেরিকান।
হত্যা-হাহাকারে পরিপূর্ণ বর্তমান নাটকের রক্তাক্ত রঙ্গমঞ্চে এইবার প্রবেশ করল এক দুর্ধর্ষ ব্যক্তি–টম টবিন।
যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় দুর্গম অরণ্যপথে রেড ইন্ডিয়ানদের আক্রমণে বহু আমেরিকানের প্রাণহানি ঘটেছে। ওই ভয়ংকর রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়াই করে জীবিকা নির্বাহ করত একদল আমেরিকার মানুষ–ইতিহাসে তাদের নামকরণ হয়েছে স্কাউট।
পূর্বোক্ত স্কাউটরা ছিল নির্ভীক চরিত্রের মানুষ, বন্দুক পিস্তলে তাদের নিশানা অব্যর্থ। বনপথে অনুসরণ-কার্যে দুঃসাহসী স্কাউটের অসাধারণ দক্ষতা আজও জনশ্রুতি ও ইতিহাসের গল্পকথা হয়ে আছে। পূর্বে উল্লিখিত টম টরিন ছিল ওইরকম এক স্কাউট।
সেনাবাহিনী যখন অসহায় বলে প্রমাণিত হত, তখনই স্কাউটের সাহায্য গ্রহণ করতেন সেনাধ্যক্ষ। কিছুতেই ফিলিপকে জব্দ করতে না-পেরে কর্নেল ট্যাপ্পান চিরাচরিত পন্থা অবলম্বন করলেন ফোর্ট গারল্যান্ড দুর্গ থেকে কর্নেলের তলব পেয়ে তার সামনে উপস্থিত হল স্কাউট টম টবিন। সেনাবাহিনী থেকে দুরূহ কাজের ভার নিলে দস্তুরমতো পারিশ্রমিক পেত ভারপ্রাপ্ত স্কাউট, অতএব টম টবিনও যে কিছু প্রাপ্তিযোগের আশা নিয়ে এসেছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কর্নেলের বক্তব্য শুনে টম টবিন জানাল একটিমাত্র যোগ্য সহকারী পেলেই সে ফিলিপ এসপিনোসার পশ্চাদ্ধাবন করতে রাজি, কিন্তু কর্নেল ট্যাপ্লান বললেন, ফিলিপের মতো ভয়ানক দস্যুর মোকাবেলা করতে হলে যথেষ্ট লোকবল প্রয়োজন–অতএব, তার আদেশে পনেরোজন সশস্ত্র সৈনিক এগিয়ে এল টবিনকে সাহায্য করতে। ওই সেনাদল ছাড়া আরও একটি মেক্সিকান বালক ছিল টবিনের সঙ্গী। বালকটিকে নির্বাচন করেছিল টবিন স্বয়ং। ১৮৬৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ফোর্ট গারল্যান্ড নামক দুর্গ থেকে টম টবিন যাত্রা করল হন্তারক ফিলিপ এসপিনোসার সন্ধানে।
তিন দিন তিন রাত্রি ধরে চলল অবিরাম অনুসরণ-পর্ব, তারপর এক জায়গায় এসে কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখে থামল মানুষ-শিকারির দল।
উটা জাতীয় রেড ইন্ডিয়ানদের পায়ে পায়েই ওই চিহ্নগুলির সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু সেই পদচিহ্নগুলিকে মেক্সিকান খুনিদের পায়ের ছাপ মনে করে বিভ্রান্ত হল ছ-জন সৈন্য এবং টবিনের নির্দেশ অমান্য করে পূর্বোক্ত পদচিহ্নের অনুসরণ করতে সচেষ্ট হল। ফলে টবিনের লোকবল বেশ কিছু কমে গেল।
পরের দিন সকাল ন-টা কি দশটার সময়ে টবিনের দল বনপথে দুটি ষাঁড়ের পদচিহ্ন আবিষ্কার করল। টবিন পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে বুঝতে পারল, জন্তু দুটিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুবৃত্ত ফিলিপ এবং তার কিশোর সঙ্গী জুলিয়েন। নির্ভুলভাবে তাদের অনুসরণ করতে লাগল টবিন। কিছুক্ষণ করে দেখা গেল একটি ষাঁড়কে দস্যুরা ছেড়ে দিয়েছে। টবিন বুঝল, মেক্সিকান দস্যু দুটি মাংস খাওয়ার জন্য অপর ষাঁড়টিকে হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছে তাদের তাঁবুর দিকে।
আবার শুরু হল অনুসন্ধান। ঘন জঙ্গল আর ঘাসঝোপের ভিতর দিয়ে অপরাধীদের পদচিহ্ন পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু অভিজ্ঞ স্কাউট টবিনের শ্যেনচক্ষু একবারও ভুল করল না, স্থির লক্ষ্যে সে এগিয়ে চলল সৈন্যদের নিয়ে।
এক জায়গায় গোল হয়ে উড়ছিল কয়েকটা কাক। টম টবিন অনুমান করল ওইখানেই ষাঁড়টাকে হত্যা করা হয়েছে। সে আবার অগ্রসর হল। প্রায় এক-শো গজ দূরত্ব অতিক্রম করার পর অনেকগুলো ম্যাগপাই পাখি (এক ধরনের মাংসাশী পাখি) তার চোখে পড়ল। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দুবৃত্তদের তাবুটাকে আবিষ্কার করল টবিন। সৈন্যদের ডেকে টবিন তাদের কথা কইতে নিষেধ করল। সে আরও বলল, হাত তুলে সংকেত জানালেই সকলে যেন রাইফেল বাগিয়ে বসে পড়ে, কিন্তু নির্দেশ না-পেলে কিছুতেই যেন গুলি না-চালায়।
সঙ্গীদের সাবধান করে দিয়ে আরও কয়েক পা এগিয়ে একটি খুনিকে দেখতে পেল টবিন। ঠিক সেই সময় তার পায়ের তলায় একটা শুকনো গাছের ডাল মট করে ভেঙে গেল। শব্দটা শুনতে পেয়েছিল খুনি, শব্দ লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াতেই টবিনের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়।
সচমকে এক লক্ষ ত্যাগ করে দস্যু রিভলভারে হাত দিল, কিন্তু সে গুলি চালানোর আগেই টবিনের রাইফেল থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি অব্যর্থ সন্ধানে তার দেহ বিদ্ধ করল।
আহত দুবৃত্ত চিৎকার করে উঠল, হে যিশু, আমাকে দয়া করো! তারপরই সে সঙ্গীর উদ্দেশে হাঁক দিল, পালাও, পালাও! আমি মারা গেলাম!
রাইফেল গুলি ভরতে ভরতে টবিন দেখল নিকটবর্তী খাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক ধাবমান মূর্তি এবং তিরবেগে এগিয়ে চলল একটা ঘন ঘাসঝোপের দিকে–
দুই নম্বর খুনি।
টবিন চেঁচিয়ে উঠল, ওহে ছোকরার দল, গুলি চালাও।
তিনটি সৈনিক একসঙ্গে গুলি ছুড়ল। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ব্যর্থ হল।
ততক্ষণে টবিন তার রাইফেলে গুলি ভরে ফেলেছে।
অভ্যস্ত আঙুলের স্পর্শে চকিত অগ্নিশিখার গর্জিত আবির্ভাব, পরক্ষণেই ধাবমান দস্যুর দেহ ধরাশয্যায় লম্বমান।
এক গুলিতেই ফিলিপের কোমর ভেঙে দিয়েছে টবিন।
ভাঙা কোমর নিয়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারল না ফিলিপ, তবু সে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হল না–একটা গাছ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে গাছটার দিকে এগিয়ে গেল ফিলিপ, তারপর সেই ধরাশায়ী বৃক্ষে পৃষ্ঠ স্থাপন করে বাগিয়ে ধরল রিভলভার। একটি সৈন্য টবিনের নির্দেশ অমান্য করে বীরবিক্রমে এগিয়ে গেল দস্যুর দিকে কিন্তু ফিলিপের গুলি তার টুপি উড়িয়ে দিতেই বীরবরের চৈতন্য হল, চটপট পিছিয়ে এসে বনের আড়ালে সে আত্মগোপন করল।
অবশেষে শিথিল হয়ে এল ফিলিপের হাত, অবশ মুষ্টি থেকে খসে পড়ল রিভলভার। টবিন চিৎকার করে শত্রুকে ডাকল, উত্তরে দুর্বল কণ্ঠে একটা শপথ উচ্চারণ করল ফিলিপ। এইবার এগিয়ে গেল টবিন, ফিলিপের চুলের মুঠি ধরে তার ঘাড়টাকে স্থাপন করল গাছের গুঁড়ির উপর, তারপর কটিবন্ধ থেকে খুলে নিল ছোরা কর্তৃপক্ষের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ না নিয়ে গেলে পুরস্কার মিলবে না।
মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও এতটুকু কাতর হয়নি দুর্দান্ত মেক্সিকান। শত্রুর দিকে তাকিয়ে ফিলিপ বলেছিল, সিনর টবিন, কাজটা একটু তাড়াতাড়ি সারো। তোমার ছুরিতে তেমন ধার নেই!
এসপিনোসা বংশের দুই খুনি ফিলিপ আর জুলিয়েনের ছিন্ন মুণ্ড নিয়ে গারল্যান্ড দুর্গে উপস্থিত হল টবিন। একটা থলির ভিতর থেকে মুণ্ড দুটি বের করে গভর্নরের ডেস্কের উপর টবিন সাজিয়ে দিয়েছিল বলে শোনা যায়। সেই সময় সরকারি কোষাগারে টাকা ছিল না, তাই। তৎক্ষণাৎ টবিনকে পুরস্কার দেওয়া সম্ভব হয়নি কিন্তু গভর্নর ইভান্স তার পকেট থেকে নিজস্ব অর্থ ব্যয় করে একটি চমৎকার হরিণ-চর্মের পরিচ্ছদ এবং ভালো একটি রাইফেল টবিনকে উপহার দিয়েছিলেন।
পরবর্তীকালে পুরস্কার হিসেবে যে-অর্থ টবিন পেয়েছিল, তার অঙ্কটা কম নয়—
১৫০০ ডলার!