০৯.
সেহরাগড় থানার দোতলায় একটা ঘরে বসে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অর্জুন পাণ্ডে হালদারমশাইয়ের বিস্তারিত স্টেটমেন্ট নিলেন। তারপর বললেন, মিঃ হালদারের সতর্ক থাকা উচিত ছিল।
হালদারমশাই বিষণ্ণ মুখে বললন, আমি জানতুম না যে সুরেশ সিং আর তার সঙ্গী চাঁদ মিয়া আমাদের অনুসরণ করে এখানে এসেছে। আমি তো ওদের। দুজনকে কখনও দেখিনি।
কর্নেল বললেন, একে বলা যায় কমিউনিকেশন গ্যাপ। আমি জানি সুরেশ এসেছে। কিন্তু টেলিফোনে মিঃ হালদারের কাছে ডিটেলস কিছু শোনার সুযোগ। ছিল না। আমার পক্ষে কিছু খুলে বলারও সুযোগ ছিল না। রিস্ক নিতে চাইনি।
হালদারমশাই বললেন, ফোনে এত কথা তো বলা যায় না।
মিঃ পাণ্ডে বললেন, যাই হোক, ভদ্রমহিলা নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। এটা স্পষ্ট যে খুনী তার চেনা। সুরেশ সিং অথবা চাঁদ মিয়া তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে চিরদিনের মতো। ভদ্রমহিলা নিশ্চয় আরও কিছু গোপন তথ্য জানতেন। সে-কথা বলার জন্যই কর্নেল সাহেবকে ডেকেছিলেন।
কর্নেল সায় দিলেন। ঠিক বলেছেন। আমিও সেটাই অনুমান করেছিলুম।
জিজ্ঞেস করলুম, উনি যে নাজমা বেগম, তা কীভাবে জানা গেল?
মিঃ পাণ্ডে বললেন, ওর স্যুটকেস সার্চ করে কতকগুলো পুরনো চিঠি পাওয়া গেছে। লখনউ থেকে লেখা ওঁর বাবা-মায়ের চিঠি! আজিমাবাদের ঠিকানায় সেগুলো পাঠানো হয়েছিল। সবই উর্দুতে লেখা। আমি উর্দু জানি। আমাকে উর্দু শিখতে হয়েছিল এই পেশার কারণে। বিহার-উত্তরপ্রদেশে ক্রাইম ব্রাঞ্চে বা ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে অফিসারদের মোটামুটিভাবে উর্দু জানাটা খুব দরকার।
কর্নেল বললেন, মিঃ পাণ্ডে! নাজমা বেগম বাথরুম থেকে আড়ি পেতে শুনেছিলেন, কোটি টাকার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে–মিঃ হালদারের স্টেটমেন্টে তা আছে–তো সেই ব্যবসা সম্ভবত নিষিদ্ধ মাদকের।
সম্ভবত। আমারও সেই সন্দেহ জেগেছে।
নাজমা বেগম শুনেছিলেন, একজন তা টের পেয়েছে। তাকে কালো নেকড়ে তাই খতম করবে। এখন বুঝতে পারছি, কে টের পেয়েছিল। কারণ কালো নেকড়ের আক্রমণে সে মারা পড়েছে।
মিঃ পাণ্ডে চমকে উঠলেন। কে সে?
মির্জা হায়দার আলি বেগের প্রবীণ ভৃত্য কাদের বখশ।
আমি এই খবরটা জানি না। ওসি মিঃ ত্রিবেদী নিশ্চয় জানেন তাহলে। আসলে গত বছর এই এলাকার গ্রামাঞ্চলে নেকড়ের উপদ্রবের খবর শুনেছিলুম। কয়েকটা বাচ্চাকে নাকি নেকড়টা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নকড়েটা যে কালো, তা আমার জানা ছিল না। নেকড়ে কি কালো হয়?
লছমন নামে একজন পোস্টম্যান নাকি দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নেকড়েটার গায়ের রঙ কালো। মিঃ ত্রিবেদীর এসব কথা সম্ভবত জানা আছে। কারণ কাদের বখশের বডির পোস্টমর্টেম হয়েছিল।
অর্জুন পাণ্ডে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, সেই কালো নেকড়ে একজন বয়স্ক লোককে মেরে ফেলেছে। এদিকে নাজমা বেগমের কাছে মিঃ হালদার সেই রহস্যময় কালো নেকড়ের কথা শুনেছেন। নাজমা তার রহস্য ফাঁস করতে চেয়েছিলেন, কর্নেলসাহেব! আপনিও যে এই রহস্য ফাঁসের উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছেন, তা বুঝতে পারছি। ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত।
হালদারমশাই বললেন, সবচেয়ে বড় কথা, এই কালো নেকড়ের সঙ্গে কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত।
মিঃ পাণ্ডে গম্ভীর মুখে বললেন, আগে নাজমা বেগমের খুনীকে পাকড়াও করতে হবে। পুলিশ জানে গোপন তথ্য কিভাবে আদায় করতে হয়।
কথা হচ্ছিল ইংরেজিতে। মাঝে মাঝে টেলিফোন বেজে উঠেছিল। মিঃ পাণ্ডে চাপাস্বরে হিন্দিতে কথা বলছিলেন। কখনও তিনি নিজেও টেলিফোন করে কাকেও কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এবার টেলিফোন বেজে উঠলে তিনি বললেন, কর্নেলসাহেব। আপনার ফোন।
কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। …হ্যাঁ। বলুন মির্জাসাহেব! …ঠিক আছে। আপনি দিদিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। ..না, না। আমাদের জন্য গাড়ি। পাঠানোর দরকার নেই। আমরা থানায় আছি। …না, না। এ বেলা এখানেই লাঞ্চ খেয়ে নেব। তবে রাত্রে আর একজন গেস্ট আমাদের সঙ্গে যাবেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ কে. কে. হালদার। …হ্যাঁ। আর একটা কথা। নরেশজিকে রিং করে জেনে নিতে পারবেন কি যে তাঁর ভাই সুরেশ কোথায় আছে? …শুনুন। এটা খুব গোপনীয়। ট্যাক্টফুলি আপনাকে জেনে নিতে হবে। ..হ্যাঁ, ছাড়ছি। বিকেলের মধ্যে দেখা হবে।
টেলিফোন রেখে কর্নেল বললেন, ছোটে নবাবসাহেবের দিদি দিলোয়ারা বেগম প্রথমে আসতে রাজি হননি। মেয়ের প্রতি তাঁর নাকি কোনো মায়ামমতা নেই। যাই হোক, পুলিশকে সাহায্য করার জন্য তিনি মর্গে আসতে রাজি হন। বডি শনাক্ত করেছেন। মর্গে মিঃ ত্রিবেদী এখনও আছেন। তার ফিরে আসা পর্যন্ত কি আমরা অপেক্ষা করব?
মিঃ পাণ্ডে ঘড়ি দেখে বললেন, দেড়টা বাজে। ওসি দুটোর আগে ফিরছেন না। তাছাড়া আপাতত আপনাদের থাকার কী দরকার? বরং চলুন। আমারও খিদে পেয়েছে। পুলিশ ক্যান্টিনে খেয়ে আমার অরুচি ধরে গেছে। সকালে মিঃ ত্রিবেদীর বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট এসেছিল। সমস্যা হলো, মিঃ ত্রিবেদী একেবারে সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। আমিও ব্রাহ্মণ। কিন্তু আমিষভোজী।
অর্জুন পাণ্ডের সঙ্গে আমরা বেরিয়ে এলুম। কাছাকাছি একটা ওড়িয়া হোটেলে গিয়ে তৃপ্তি সহকারে ডাল-ভাত-মাছ খাওয়া হলো। নবাববাড়ির খাদ্য খেয়ে আমারও অরুচি ধরেছিল।
মিঃ পাণ্ডে বিল মিটিয়ে দিলেন। বললেন, প্রত্যেকদিন তো আপনাদের খাওয়াতে পারব না। এ বেলা আপনারা আমার অতিথি। কর্নেল সাহেব কি এখন নবাববাড়ি ফিরতে চান?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। একটু ধাতস্ত হওয়া দরকার। সময়মতো আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। মির্জাসাহেবের ফোন নাম্বার আপনি মিঃ ত্রিবেদীর কাছে পেয়ে যাবেন।
কিন্তু আপনারা যাবেন কিসে? শুনেছি ওই এলাকায় ভাড়া নিয়ে কেউ যেতে চায় না। পুলিশের জিপে যাওয়া ঠিক হবে না। যা বুঝেছি, তাতে অন্য পক্ষ সতর্ক হয়ে যাবে। এক মিনিট। বলে মিঃ পাণ্ডে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে থানার দিকে এগিয়ে গেলেন।
একটু পরে একটা প্রাইভেট কারে চেপে তিনি ফিরে এলেন। গাড়ি থেকে নেমে বললেন, এটাও পুলিশের গাড়ি। তবে পুলিশের ছাপ নেই। স্পেশাল ব্রাঞ্চের এস আই রাকেশ শর্মা এটা ব্যবহার করেন। রঘুবীর! মিঃ পাণ্ডে ড্রাইভারের কাঁধ চাপড়ে সহাস্যে ফের বললেন, তুমি পুলিশের গাড়ির ড্রাইভার। তোমার গায়ের গন্ধে নেকড়েটা লেজ তুলে পালিয়ে যাবে।
রঘুবীর ব্রিজ পেরিয়ে সোজা চড়াইয়ে ওঠার সময় হিন্দিতে বলল, পাণ্ডেসাব জানেন না। আমার বাড়ি ক্যায়লাসপুর। ওইগ্রামেই গত বছর নেকড়েটা প্রথম। হামলা করেছিল। তখন গরমের মাস। বাইরে খোলা উঠোনে রসুলালের বউ ঘুমোচ্ছিল। বুকের কাছে তিনমাসের বাচ্চা! মেয়েটা ঘুমোয়নি তখনও। বাচ্চাটা কাঁদছিল। আচমকা নেকড়েটা এসে বাচ্চাটাকে কামড়ে ধরে নিয়ে পালিয়েছিল। সে শুরু। তো দিনে দিনে জানোয়ারটার সাহস বেড়ে গেছে। আশ্চর্য স্যার! কত শিকারী চেষ্টা করেছেন। তাকে মারতে পারেননি।
সে সারাপথ নেকড়েটার মুখে কতগুলো বাচ্ছা মারা পড়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছিল। একসময় কর্নেল বললেন, নেকড়ের গায়ের রঙ নাকি কালো?
হ্যাঁ স্যার। তবে শোনা কথা।
তুমি জানো নবাববাড়ির একজন বুড়ো চাকরকে নেকড়েটা মেরে ফেলেছে?
জানব না কেন? তার লাশের পোস্টমর্টেম হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করেছে। তবে দেখুন স্যার। একটা ব্যাপারে আমার একটু খটকা লেগেছে।
কী ব্যাপার?
জানোয়ারটা শুধু এই রাস্তার দুধারে যত গ্রাম আর ছোট বসতি আছে, সেখানে হামলা করে বেড়াচ্ছে। রাস্তা শেষ হয়েছে ওই উঁচু পাহাড় দেখছেন, তার কাছে।
এই রাস্তার দুধারে কতগুলো গ্রাম আছে?
দুটো গ্রাম আর তিনটে আদিবাসী বসতি। খুব ছোট বসতি। গ্রাম দুটোও অবশ্য বড় নয়। জঙ্গল আছে। টিলা আছে। মানুষজন খুব গরিব।
রাস্তাটা পাহাড়ের কাছে শেষ হয়েছে কেন? ওধারে গ্রাম নেই?
পাহাড়ের ওধারে আছে। কিন্তু রাস্তাটা আগে কালামহল–মানে, নবাববাড়ি পর্যন্ত ছিল। বড়নবাবের ছেলের চাষের ফার্ম আছে ওদিক। ফার্মের ফসল আনার জন্য রাস্তাটা বাড়ানো হয়েছে। ইলেকট্রিক লাইনের এই যে সব খুঁটি দেখছেন, এগুলো গেছে ফার্ম পর্যন্ত! বড়নবাবের ছেলে দয়া করে শুধু আমাদের ক্যায়লাসপুরকে লাইন দিয়েছেন। তাও মাত্র চার-পাঁচটা বাড়ি পেয়েছে। কথাগুলো বলে শ্বাস ছেড়ে রঘুবীর স্বগতোক্তি করল, ইয়ে হ্যায় দেশকি হাল। গরিবোঁকে লিয়ে কৈ নেহি শোচতা হ্যায়!…..
গেটের সামনে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। রঘুবীর সেলাম ঠুকে কর্নেলের কাছে কিছু বখশিস নিয়ে চলে গেল। খুদা বখশ গাড়ির শব্দ শুনে গেটের কাছে এসেছিল। সেও সেলাম ঠুকে বলল, ছোটেনবাবসাব আধাঘণ্টা আগে এসেছেন।
আমরা মসজিদের ধ্বংস্তূপের পাশ দিয়ে এগিয়ে দেখি, বারান্দায় শাকিল মিয়াঁ দাঁড়িয়ে আছেন এবং মির্জাসাহেব বেতের চেয়ারে বসে আছেন। দুজনে কথা বলছিলেন। আমাদের দেখে শাকিল মিয়াঁ আদাব দিলেন। মির্জাসাহেব বললেন, আপনাদের খাওয়া হয়েছে? আমি কিন্তু আপনাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলুম।
কর্নেল বললেন, ওড়িয়া হোটেল খেলুম। একটু মুখ বদলানো হলো। যাই হোক, আপনার দিদি কেমন আছেন?
দিদি ঠিক আছেন। শুধু রহিমবাবাকে নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছিল। এখন সে একটু শান্ত হয়েছে।
কর্নেল হালদারমশাইয়ের সঙ্গে মির্জাসাহেবের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, তাহির খানের খবর কী?
মির্জাসাহেব গম্ভীরমুখে বললেন, ডাক্তার ভার্মা ওঁকে পরীক্ষা করে বুঝেছেন, তাহির খান কোনো সময়ে বিষাক্ত কিছু খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। ওঁর জিভ থেকে কণ্ঠমূল পর্যন্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ডাক্তার ভার্মা অবাক হয়ে বললেন, এতদিন কী করে বেঁচে আছেন, সেটাই আশ্চর্য!
নরেশ সিংকে ফোন করেছিলেন কি?
হ্যাঁ। একটু আগে করেছিলুম। নরেশজি বললেন, সুরেশ আর তার এক বন্ধু। গত রাতে এসেছে। তারা রাতে এখানকার বাগানবাড়িতে ছিল। সকালে দুজনে বেরিয়েছিল নরেশজির একটা গাড়ি নিয়ে। এখন পর্যন্ত আর তাদের খবর পাননি উনি। খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
কর্নেল বললেন, মিঃ হালদার এখানে থাকার কোনো অসুবিধা হবে না তো?
মির্জাসাহেব বললেন, কেন একথা ভাবলেন? কর্নেল হাসলেন। ভাবলুম। কারণ মিঃ হালদার অপরাধবোধে কুণ্ঠিত। তাঁর ধারণা, এত বড় মিসহ্যাপের জন্য তিনিই দায়ী। কাজেই মির্জাসাহেব তার প্রতি ক্রুদ্ধ। তিনি আমাদের সঙ্গে আসতে রাজি হচ্ছিলেন। তাই তাকে শুনিয়ে আপনাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলুম। কী হালদারমশাই?
হালদারমশাই বিষণ্ণমুখে বললেন, আমার ক্লায়েন্টকে আমি বাঁচাতে পারলুম না। এ দুঃখ এ জীবনে ঘুচবে না।
মির্জাসাহেব আস্তে বললেন, হতভাগিনী নাজমা তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। আপনি চেষ্টা করলেও তাকে বাঁচাতে পারতেন না। নিয়তিতে আমি বিশ্বাসী। যাই হোক আপনারা গেস্টরুমে গিয়ে বিশ্রাম করে নিন। শাকিল মিয়াঁ। এঁদের নিয়ে যান। কর্নেল সরকার! সাড়ে চারটেতে আপনার সঙ্গে একটু প্রাইভেট আলোচনায় বসতে চাই।
কর্নেল বললেন, আমারও কথা আছে। যাই হোক, আমি দিনে জয়ন্তের মতো ঘুমোই না। তবে মিঃ হালদার রাত্রে ঘুমুতে পারেননি। ওঁকে ঘুমুনোর সুযোগ দেব।
গেস্টরুমে গিয়ে দেখলুম, হালদারমশাইয়ের জন্য একটা ক্যাম্পখাট ঢোকানো হয়েছে। তাতে বিছানাও পাতা হয়েছে। কর্নেল বললেন, হালদারমশাই! আপনি পোশাক বদলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নিতে পারেন। জয়ন্ত! তুমিও ভাতঘুম সেরে নিতে পারো।
হালদারমশাই পোশাক বদলাতে বাথরুমে ঢুকলেন। শাকিল মিয়াঁ তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, কর্নির্লসাহেব! হামি একঠো বাত্ করব। কনফিডেন্সিয়াল বাত্। মেহেরবানি করে ভিতরের বারান্দায় চলেন।
ভেতরের বারান্দায় যাওয়ার দরজা বন্ধ ছিল। সেটা খুলে শাকিল মিয়াঁর সঙ্গে কর্নেল বারান্দায় গেলেন।
ক্লান্তিবশত আমি আর পোশাক না বদলে শুধু জুতো ঘুলে বিছানায় গড়িয়ে পড়লুম। হালদারমশাই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এলেন। আস্তে বললেন, সঙ্গে নকল গোঁফ-দাড়ি আর একখান টুপিও আনছি। যদি মুসলিম সাজবার দরকার হয়। তো কিছুই কাজে লাগল না।
বললুম, আগে আপনি শুয়ে পড়ুন হালদারমশাই। বলা যায় না, মুসলিম ছদ্মবেশে ধরতে হবে হয়তো।
হালদারমশাই করুণ হেসে ক্যাম্পখাটে বসে একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর শুয়ে পড়লেন। একটু পরে শুনি ওঁর নাক ডাকছে।
কর্নেল একা ফিরে এলেন। বললুম, মির্জাসাহেব কোথায়?
কর্নেল বললেন, উনি ভেতরের বারান্দা দিয়ে চলে গেলেন। তারপর কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরালেন এবং চোখ বুজে স্বগতোক্তি করার ভঙ্গিতে বললেন, শাকিল মিয়াঁ সকালে কথাটা আমাকে বললে ঘটনা এমন ট্র্যাজিক হতো না।
কী কথা?
তবে বুঝলে জয়ন্ত? আমি ঠিকই ধরেছিলুম ষণ্ডামার্কা লোকটা সুরেশ হতে পারে না।
আহা! কথাটা কী বলুন। তবে তো বুঝব!
কর্নেল চোখ খুলে চাপাস্বরে বললেন, শাকিল মিয়াঁ আজ ভোরে তার ঘরের জানালা দিয়ে দেখেছিলেন, একটা লোক বড় নবাববাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলছে। যার সঙ্গে লোকটা কথা বলছে, তাকে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু লোকটাকে তার চেনা মনে হচ্ছিল। একটু পরে তার মনে পড়ে যায় আজিমাবাদের সাজ্জাদ খানের কথা। তখন তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের ধ্বংসতূপের ওধারে খিড়কির দরজায় চলে যান। ওই দরজা দিয়ে জরুরি প্রয়োজনে এ বাড়ির লোকেরা বাইরে যায়। দরজাটা ভেতর থেকে তালা দিয়ে। আটকানো থাকে। চাবি থাকে শাকিল মিয়াঁর কাছে। তো তালা খুলতে একটু দেরি হয়েছিল। বেরিয়ে গিয়ে লোকটাকে হনহন করে চলে যেতে দেখেন। লোকটা নরেশ সিংহের বাড়িতে গিয়ে ঢুকেছিল। যাইহোক, শাকিল মিয়াঁর বিশ্বাস তিনি তার জন্মস্থান আজিমাবাদের সেই সাজ্জাদকেই দেখেছেন। সাজ্জাদ ছিল বড়লোক বখাটে ছেলে। এখন চেহারা যণ্ডামার্কা হয়েছে। কিন্তু তবু তাকে চিনতে ভুল হয়নি তার।
বুঝলুম। কিন্তু সেই লোকটাই যে সকালে আপনাকে হুমকি দিয়েছিল তার প্রমাণ কী?
পোশাক। শাকিল মিয়াঁ বললেন, গায়ে জংলা ছাপের শার্ট আর পরনে আঁটো নীলচে প্যান্ট ছিল। কাজেই আমি বুঝতে পারলুম একই লোক। ইশ! শাকিল মিয়াঁ সকালে যদি বলতেন।
কর্নেল আবার চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন।
ক্লান্তিতে অবেলায় আমার চোখের পাতা বুজে আসছিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। হালদারমশাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। রহমত কফি আর স্ন্যাক্স এনেছিল। সে সেলাম ঠুকে চলে গেল। হালদারমশাই বললেন, পাঁচটা বাজে। তিন ঘণ্টা সাউন্ড স্লিপ। নাও আই অ্যাম অলরাইট।
জিজ্ঞেস করলুম, কর্নেল কি বেরিয়েছেন?
না। নবাব সাহেবের সঙ্গে পোর্টিকোর সামনে বারান্দায় কী সব ডিসকাস করতাছেন।
দুজনে চুপচাপ বসে কফি খেলুম। কিছুক্ষণ পরে শাকিল মিয়াঁ এসে আদাব দিয়ে বললেন, কর্নিলসাব ঔর ছোটে নবাবসাব বাহার গেলেন। হামাকে কর্নিলসাব বললেন, আপলোগোকো মর্জি হোনেসে আপলোগোভি ঘুমনে শ্যকে। লেকিন বহত্ হোশিয়ার রহনা পড়ে।
বললুম, আমরা বরং নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে আসি। রহমতকে বলে আপনি কালামহলের দিকের দরজাটা খুলে দিন হালদারমশাই! প্যান্টশার্ট পরে নিন। টর্চ নিন।
শাকিল মিয়াঁ চলে গেলেন। একটু পরে আমি আর হালদারমশাই বেরোলুম। ওঁকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলুম সঙ্গে ওঁর ফায়ার আর্মস নিয়েছেন কি না। হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, হ্যাঁ। এই ডেঞ্জারাস এরিয়ায় আর্মস ছাড়া ঘোরা যায়?
রহমত টেনিস কোর্টের পূর্বদিকে কালামহলের ধ্বংসাবশেষের পাশে ছোট দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। দরজা খুলে দিয়ে সে বলল, হাম হঁহাপর খাড়া হ্যায় স্যার! দরওয়াজামে ধাক্কা দেনেসে খুল দেগা।
পাথরের বড়-বড় চাঁইয়ের ওপর দিয়ে নেমে আমরা নদীর ধারে পৌঁছুলুম। হালদারমশাই নদী দেখে বললেন, নদীও দেখি ডেঞ্জারাস! কী ফোর্সফুল কারেন্ট জয়ন্তবাবু!
ততক্ষণে সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়েছে। নদীর ওপারে খাড়া পাহাড়। আমাদের ডানদিকে কালামহলের ধ্বংসস্তূপ সোজা দক্ষিণে নদীর সমান্তরাল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অজস্র ঝোপঝাড় গজিয়েছে সেই ধ্বংসস্তূপে। হালদারমশাই দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি একটা পাথরে বসে পড়লুম।
একটু পরে হালদারমশাই হঠাৎ গুঁড়ি মেরে বসে চাপাস্বরে উত্তেজিতভাবে ডাকলেন, জয়ন্তবাবু! জয়ন্তবাবু! কাণ্ড দ্যাখছেন?
ঘুরে ওঁর দিকে তাকালুম। উনি যেদিকে লম্বাটে তর্জনী তুলেছিলেন, সেদিকে কিছু চোখে পড়ল না। তখন গুঁড়ি মেরে ওঁর কাছে গেলুম। তেমনি চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলুম, কী ব্যাপার?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, এইমাত্র কেউ কালোকুত্তা লইয়া জঙ্গলে ঢুকল। আর আমি ফলো করুম!
বলেই উনি গুঁড়ি মেরে পাথরের আড়ালে এগিয়ে চললেন। বরাবর দেখে আসছি, প্রাক্তন পুলিশ অফিসার হালদারমশাই কোনো ব্যাপারে গোঁ ধরলে তাকে বাধা দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। এমন একটা জায়গায় সন্ধ্যার প্রাক্কালে তাঁর সঙ্গী হওয়ার সাহস আমার ছিল না। তাছাড়া উনি তো কর্নেল নীলাদ্রি সরকার নন।…
.