০৮.
কালকের মতো আজও বারান্দায় ব্রেকফাস্টের আয়োজন করা হয়েছিল। মির্জাসাহেব তার ভাগনে রহিমবাবা-কে সঙ্গে নিয়ে ব্রেকফাস্টে যোগ দিলেন। রহিমের চেহারায় কালকের সেই চাপল্য ছিল না। তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।
খাওয়ার পর মির্জাসাহেব পাইপ ধরিয়ে বললেন, জামাইবাবু তাহির খান সম্পর্কে রহিমের কোনো স্মৃতি নেই। কারণ বিয়ের সময় ও ছিল নেহাত শিশু। কিন্তু কাল যে ও না জেনে তার পাগল জামাইবাবুকে তাড়া করে বেড়িয়েছে, ও জন্য ওর দুঃখ হয়েছে। তো ওকে বললুম, আমার সঙ্গে ডাক্তার ভার্মার। মেন্টাল হোমে চলো। ও রাজি হচ্ছে না। বাবা রহিম! মানুষের জীবনে এ ধরনের অনেক শোচনীয় ঘটনা ঘটে।
রহিম কিছু বলল না। কর্নেল বললেন, আমার মতে, রহিমের যাওয়া উচিত। কারণ ওকে দেখামাত্র তাহির খান প্রচণ্ডভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন। তাকে রহিম যদি বুঝিয়ে দিতে পারে, সে তাকে জামাইবাবু বলে চিনতে পেরেছে, তাহলে তার পুরনো স্মৃতি ফিরে আসতে পারে। তারপর একসময় রহিমের মাকে নিয়ে গেলে ভাল হয়।
মির্জাসাহেব বললেন, দিদি তো এখনই যেতে চাইছেন। তবে আগে তার জামাইয়ের অবস্থা না দেখে এবং ডাঃ ভার্মার কথা না শুনে দিদিকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। রহিম! আমি গাড়ি বের করছি। তুমি শিগগির তৈরি হয়ে এস।
রহিম চুপচাপ উঠে ভেতরে গেল। কর্নেল বললেন, রহিম তার দিদি নাজমা বেগমের ঘটনা নিশ্চয় জানে?
জানে। কিন্তু নাজমা সম্পর্কেও ওর কিছু মনে পড়ে না। তবে থাক ওকথা। গাড়ি বের করি। পৌনে দশটা বাজে। বলে মির্জাসাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত আর আমাকে তাহলে নদীর ব্রিজ অব্দি আপনার গাড়িতে লিফট দিন।
মির্জাসাহেব একটু অবাক হলেন যেন। ওদিকে কোথায় যাবেন?
কর্নেল হাসলেন। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নেই। নদীর ধারে-ধারে ঘুরব। তারপর নরেশজির সাপ্লাই এজেন্সির অফিসে যাব। তার ভাই সুরেশ সিংয়ের সঙ্গে আলাপ করারও ইচ্ছা আছে।
সুরেশ যদি এসে থাকে, তাহলে নরেশজি তাকে এখানকার বাগানবাড়িতেই রাখবেন বলে আমার ধারণা। কারণ সুরেশের নাম এখনও পুলিশের বেকর্ডে থেকে গেছে। সে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে সাহস পাবে না। বলে মির্জাসাহেব গ্যারাজে গেলেন। তারপর গাড়ি বের করে এনে পোর্টিকোর সামনে দাঁড় করালেন।
রহিম এলে মির্জাসাহেব তাকে সামনের সিটে বসতে বললেন। কর্নেল ও আমি বসলুম।
নদীর ব্রিজ পেরিয়ে কর্নেল বললেন, এখানেই নামিয়ে দিন।
আমরা নামলে মির্জাসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা ফিরবেন কী ভাবে? আজকাল কালামহল এলাকায় দিনের বেলাতেও কেউ যেতে রাজি হয় না।
কর্নেল বললেন, কিছু ভাববেন না। যানবাহন না পেলে পায়ে হেঁটে ফিরব।
মির্জাসাহেব উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, ঠিক আছে। উইশ ইউ গুড লাক।
ব্রিজ পেরিয়ে এসে হাইওয়ে পূর্বে বাঁক নিয়ে চলে গেছে। তাই এখানে। ট্যাক্সি, সাইকেল রিকশ, এক্কাগাড়ি, বাস ইত্যাদির ভিড়। মানুষজনেরও ভিড় আছে। হাইওয়ের ধারে ঘিঞ্জি বাজারও দেখতে পেলুম। কর্নেল একটা সাইকেল রিকশ ডেকে বললেন, সূর্য হোটেল। জলদি যানা ভাই।
বিশ রুপৈয়া ভাড়া হাঁকল রিকশওয়ালা।
কর্নেল বললেন, ঠিক হ্যায়।
নদীর সমান্তরালে একটা পরিচ্ছন্ন নতুন রাস্তায় এগিয়ে যেতে যেতে ঘরবাড়ি নতুন দেখে বুঝলুম, এলাকাটা নতুন গড়ে উঠেছে এবং এখানে পয়সাওয়ালা লোকেরা থাকে। নদীর ধারে একটা করে হোটেল চোখে পড়ছিল। সুদৃশ্য সব হোটেল। রাস্তার বাঁকের মুখে বাঁদিকে আঙুল তুলে রিকশওয়ালা বলল, আ গেয়া সাব!
সূর্য হোটেলও নদীর ধারে। কিন্তু বিশাল লন, ফুলবাগান, এবং একটা কৃত্রিম ফোয়ারা এই হোটেলটার সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে। পিছনদিকে সুইমিং পুলের একটু অংশ চোখে পড়ছিল।
বললুম, এটুকু পথ পায়ে হেঁটেই আসা যেত।
কর্নেল বললেন, তা যেত। কিন্তু লোকেদের জিজ্ঞেস করতে হতো। তাই পৌঁছুতেও দেরি হতো।
কাচের প্রকাণ্ড দরজা ঠেলে লাউঞ্জে ঢুকে দেখলুম, রিসেপশন কাউন্টারে দুই সুন্দরী স্মার্ট হয়ে বসে আছে। লাউঞ্জে কোনো লোকজন নেই। কর্নেল এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, হালদারমশাই লাউঞ্জে অপেক্ষা করবেন বলেছেন। কোথায় তিনি?
হঠাৎ আমার চোখে পড়ল, একটা থামের আড়ালে চিত্রবিচিত্র ভেলভেটমোড়া একটা সোফায় শরীর এলিয়ে কেউ ঘুমোচ্ছে। কর্নেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে একটু হেসে বললেন, মনে হচ্ছে উনিই তিনি। টাই-স্যুট পরেছেন দেখছি। হ্যাঁ–এই পোশাকে ওঁকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে।
সামনে গিয়ে দেখি, প্রাইভেট ডিটেকটিভ হাঁ করে ঘুমোচ্ছেন। নাক ডাকছে। কর্নেল তাঁর কাছে বসে যেই আস্তে ডেকেছেন, হালদারমশাই! অমনি উনি সটান সোজা হয়ে লাল চোখে বলে উঠলেন, কে ডাকল?
তারপর আমাদের দেখতে পেয়ে কাঁচুমাচু হেসে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। কর্নেল বললেন, রাত্রে ঘুম হয়নি নাকি হালদারমশাই?
হালদারমশাই করুণ মুখে বললেন, কেন্দ্রীয় সরকারের হোমরা-চোমরা লোকেরা সেমিনারে আইছেন। সব হোটেল ভর্তি। শুধু এই থ্রি স্টার্স হোটেলে একখানা স্যুইট খালি ছিল। কী করব? ক্লায়েন্ট কইলেন, ডোন্ট হেজিটেট! দুইজনে দুই খাটে থাকব। আপনি আমার দাদা। কিন্তু যা-ই কন আপনারা, এই অবস্থায় ঘুম আসব ক্যামনে? আমি বিছানায় শুই নাই। সোফায় শুইয়া রাত্রি কাটাইছি।
আমি বললুম, কর্নেল! তা হলে দেখনু আমি ব্যাড জোক করিনি!
কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন, হালদারমশাই! দেরি করা যাবে না। চলুন। আপনার ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করি!
ছ’তলা হোটেল। তাই লিফটে আছে। ছতলায় উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা স্যুইটের সামনে গিয়ে দরজায় নক করলেন হালদারমশাই। কিন্তু কোনো সাড়া এল না। হালদারমশাই বললেন, বাথরুমে আছে মনে হয়। একটু ওয়েট করা যাক।
করিডর নির্জন। হালদারমশাই আবার নক করলেন। কিন্তু সাড়া নেই।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কতক্ষণ আগে লাউঞ্জে গিয়েছিলেন?
হালদারমশাই বললেন, নটায় ব্রেকফাস্ট করতে নিচের ডাইনিং হলে গেছি। ক্লায়েন্টের ব্রেকফাস্ট তার এই ঘরে সার্ভ করতে বলেছি। তারপর আপনার জন্য লাউঞ্জে ওয়েট করছিলাম।
বলে তিনি আবার জোরে নক করলেন। কোনো সাড়া এল না। হালদারমশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, কী যে করে!
কর্নেল দরজার হাতল ঘোরানোর চেষ্টা করে বললেন, ইন্টার লকিং সিস্টেম। ভেতর থেকে খোলা যায়। বাইরে থেকে খুলতে হবে চাবির দরকার।
হালদারমশাই বললেন, চাবি তো ক্লায়েন্টের কাছে আছে। আমি চাবি লই নাই।
কর্নেলকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। বললেন চলুন! নিচে রিসেপশনে গিয়ে ওদের বলুন। ওদের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে।
লিফটে ঢুকে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, হোটেল রেজিস্টারে কার নামে সুইট বুক করা আছে।
হালদারমশাই চিন্তিত মুখে বললেন, আমার ক্লায়েন্টের।
রেজিস্টারে আপনি সই করেছিলেন কি?
না। আমি একপাশে খাড়াইয়া ছিলাম।
কর্নেল একটু ভেবে নিয়ে বললেন, এ ধরনের বড় হোটেলে অনেকসময় যে বুক করে, তার নাম-ঠিকানা লিখিয়ে নিয়ে অ্যান্ড পার্টি জুড়ে দেওয়া হয়। নাসিমা তা করেছে কি না কে জানে! আসলে অভিজাত বিত্তবান পরিবারের কোনো মহিলা তার পুরুষবন্ধুকে নিয়ে নিরুপদ্রবে এ সব হোটেলে বাস করতে পারেন।
হালদারমশাইয়ের মুখ করুণ হয়ে উঠল। বললেন, কী কাণ্ড!
যাই হোক। আপনি রিসেপশনে গিয়ে জানান, সুইট নাম্বার সিক্স টু ও-তে আপনি এক মহিলার সঙ্গে উঠেছেন। ব্রেকফাস্ট খেতে একা নিজের ডাইনিংয়ে এসেছিলেন। এখন ফিরে গিয়ে বহুক্ষণ নক করে তার কোনো সাড়া পাচ্ছেন না।
হালদারমশাই নিচে নেমে মরিয়া হয়ে গেলেন যেন। সোজা রিসেপশনে গিয়ে একটি মেয়েকে ইংরেজিতে কথাগুলো বললেন। মেয়েটি ইন্টারকমে কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও সাড়া পেল না। সে বলল, কেউ ধরছে না।
কর্নেল বললেন, উনি বাইরে যাননি তো?
মেয়েটি চাবিঝোলানো বোর্ড দেখে নিয়ে বলল, না। বাইরে গেলে বোর্ডাররা চাবি রেখে যান। সিক্স টু ও-র চাবি দেখতে পাচ্ছি না।
প্লিজ ম্যানেজারকে কথাটা বলুন। এটা জরুরি ব্যাপার।
মেয়েটি সংলগ্ন একটি কেবিন দেখিয়ে দিয়ে বলল, আপনারা ওখানে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলুন।
কর্নেল আমাদের দাঁড়াতে বলে ম্যানেজারের কেবিনে ঢুকলেন। মিনিট দু তিন পরে তাঁর সঙ্গে একজন রোগা ফর্সা টাই-স্যুট পরা ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে হালদারমশাইকে দেখে বললেন, আপনি কাল রাত্রে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে ৬২০ নম্বর সুইটে উঠেছেন! আমি তখন রিসেপশনে ছিলুম।
হালদারমশাই বললেন, হাঁ। আজ সকালে নিচের ডাইনিংয়ে ব্রেকফাস্ট করার পর এঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলুম। তারপর স্যুইটে গিয়ে কতক্ষণ নক করে সাড়া পেলুম না। এই মহিলা ইন্টারকমে রিং করলেন। কেউ ধরছে না।
ম্যানেজার রিসেপশনে ঢুকে তালাবন্ধ একটা দেয়াল আলমারি খুলে ডুপ্লিকেট চাবি বের করলেন। তারপর বললেন, চলুন, দেখি কী ব্যাপার।
লিফটে ঢুকে তিনি হালদারমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন, যদি কিছু মনে না করেন–ভদ্রমহিলার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক আছে নিশ্চয়? স্বামী-স্ত্রী অথবা নিকটত্মীয়া?
হালদারমশাই একটু ভড়কে গেলেন যেন। ঝটপট পকেট থেকে তার আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখালেন।
ম্যানেজার একটু অবাক হয়ে বললেন, আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ? আপনার সঙ্গিনী ভদ্রমহিলা কে?
আমার ক্লায়েন্ট। উনি অবশ্য মুসলিম। এখানে একটা জরুরি কাজে এসেছি ওঁর সঙ্গে। উনি আমাকে দাদা বলেন।
ম্যানেজার উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, ঈশ্বর না করুন–অবাঞ্ছিত কিছু ঘটলে হোটেলের সুনামহানি হবে।
হালদারমশাইয়ের মুখেও উদ্বেগ ফুটে উঠল। বললেন, আমার ক্লায়েন্ট নাসিমা বেগম আমাকে তেমন কোনো আভাস দেননি। দিলে পুলিশকে জানিয়ে রাখতুম।
ছতলার সেই স্যুইটের লকে চাবি ঢুকিয়ে ম্যানেজার দরজা খুলেন। সামনে একটা ফুট সাতেক উঁটু কারুকার্যখচিত কাঠের পার্টিশন। সোফাসেট এবং সেন্টার টেবিল। সেই টেবিলে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার চিহ্ন চোখে পড়ল। প্লেট, চা বা কফির পট ইত্যাদি একটা ট্রেতে রাখা আছে।
আমরা পার্টিশনের পাশ দিয়ে বেডরুমে ঢুকলুম। তারপরই চোখে পড়ল একটা বীভৎস দৃশ্য। মেঝের কার্পেটে চিত হয়ে পড়ে আছেন এক মহিলা। তার শ্বাসনালী কাটা। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। পরনের নাইটি রক্তে মাখা। এক পায়ে একপাটি স্লিপার আটকে আছে। অন্য পায়ের স্লিপার ছিটকে একটু তফাতে পড়েছে।
দেখামাত্র আমার মনে হলো, নাসিমা আত্মরক্ষার সুযোগ পাননি। সেইসঙ্গে এ-ও বোঝা যাচ্ছিল, আততায়ী তার পরিচিত। তা নাহলে পার্টিশনের ওধারে দরজার কাছেই তিনি আক্রান্ত হতেন।
ম্যানেজার এই সাংঘাতিক দৃশ্য দেখামাত্র ও মাই গড! বলে আর্তনাদ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। কর্নেল বললেন, মিঃ লাল! এখন কোনো হইচই করা ঠিক হবে না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে আপনি নিচে গিয়ে পুলিশকে খবর দিন। শিগগির চলুন! আপনার কোনো কর্মচারীও যেন জানতে না পারে কী ঘটেছে। আপনি আপনার ঘর থেকে পুলিশকে টেলিফোন করবেন।
ম্যানেজার মিঃ লাল বিভ্রান্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই সুযোগে হালদারমশাই তাঁর ব্রিফকেস তুলে নিলেন। আমরা বাইরে গেলে কর্নেল দরজা টেনে বন্ধ করলেন। আবার দরজা লকড় হয়ে গেল।
লিফট নিচে নামলে ম্যানেজার কর্নেলের কথামতো তার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। কর্নেলের ইঙ্গিতে আমার কাছেই একটা সোফায় বসে পড়লুম। কর্নেল ম্যানেজারের ঘরে চলে গেলেন।
রিসেপশনের মেয়ে দুটি পরস্পর তাকাতাকি করে চাপা স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকল। জিনস-টিশার্ট পরা একজন যুবক কম্পিউটারের সামনে বসে আপন মনে কাজ করছিল। সে মুখ তুলে একটি মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করল। মেয়েটি দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে দুটো হাত নাড়ল। অর্থাৎ সে কিছু জানে না।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল বেরিয়ে এসে হালদারমশাইয়ের পাশে বসে তার ব্রিফকেসটা তুলে নিজের পাশে রাখলেন। তারপর চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু আছে?
হালদারমশাই বললেন, নাহ্! সকালে শেভ করি নাই। দাঁত মাজি নাই! এক ঘরে ওই মহিলার সঙ্গে থাকা যায়? এক্কেরে মেমসায়েব! আচ্ছা কর্নেলস্যার, পুলিশ তো আমারে হ্যারাশ করবে। তাই না?
কর্নেল বললেন, চুপ। কোনো কথা নয়।
পুলিশ এল প্রায় পনের মিনিট পরে। দুজন অফিসার এবং চারজন কনস্টেবল। ম্যানেজার মিঃ লাল নমস্কার করে বললেন, সূর্য হোটেলে এই প্রথম এমন ঘটনা স্যার! হোটেলের সব রুমে ভি আই পিরা ছিলেন। তাই আপনাদের সিকিউরিটি তো ছিলই আমাদেরও যথারীতি সিকিউরিটি গার্ড মোতায়েন ছিল।
তাঁর কথায় ওপর একজন পুলিশ অফিসার বললেন, স্যুইট নাম্বার সিক্স টু ও?
হ্যাঁ স্যার।
দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার আমাদের দিকে ঘুরে বললেন, মর্নিং কর্নেল সরকার। আপনার সঙ্গে মুখোমুখি আলাপের সৌভাগ্য হলো। পুলিশ সুপার পরশু রাতে আমাকে আপনার সম্পর্কে খবর পাঠিয়েছিলেন। আমার নাম অর্জুন পাণ্ডে। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর। প্রয়োজনে আপনাকে সাহায্য করার জন্য আমি কাল সকালেই এখানে চলে এসছি। মিঃ ত্রিবেদী! ইনিই সেই প্রখ্যাত ব্যক্তি নীলাদ্রি সরকার।
প্রথম অফিসার একটু হেসে বললেন, আমি রত্নেশ ত্রিবেদী। এখানকার থানার অফিসার-ইন-চার্জ। মিঃ পাণ্ডের কথা সত্যি হলো।
কথার মধ্যে কর্নেলের সঙ্গে ওঁরা করমর্দনপর্ব শেষ করেছিলেন। কর্নেল আমার এবং হালদারমশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, জয়ন্ত এবং মিঃ হালদার এখানে অপেক্ষা করুন। ভিড় বাড়িয়ে লাভ নেই। চলুন, আমরা ঘটনাস্থলে যাই।
ত্রিবেদী বললেন, মিঃ লাল! ফোটোগ্রাফার আসবেন একজন। ডাক্তার রায় আসতে পারছেন না। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট আসবেন। রিসেপশনে বলে রাখুন। এঁরা এলে যেন কেউ ওই স্যুইটে নিয়ে যায়।
কর্নেল ব্রিফকেসটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, তোমরা অপেক্ষা করো জয়ন্ত
ইতিমধ্যে হোটেলের কর্মচারীদের মধ্যে চাপা হিড়িক পড়ে গেছে। এদিক ওদিক থেকে তারা উঁকি দিচ্ছে। সেই সময় লক্ষ্য করলুম, হালদারমশাই নস্যি নিলেন এবং তার গোঁফ উত্তেজনায় তিরতির করে কেঁপে উঠল। চাপা স্বরে বললুম, আপনি কর্নেলকে সম্ভবত সব বলেছেন। আমাকে সংক্ষেপে একটু বলুন।
হালদারমশাই আস্তে বললেন, কী আর কমু জয়ন্তবাবু? আমারই ভুল। আমার অফিসে গিয়ে ক্লায়েন্ট কইছিল, সুরেশ সিং ট্যার পাইছে সব। তাই সে মেট্রোর সামনে যায় নাই। আর সেই চান্দ মিয়াঁ হইল গিয়া আমার ক্লায়েন্টের লাভার। কিন্তু এই মিয়াই তারে সর্বনাশের পথে পাঠাইয়া দিছিল। মিয়া। যে সুরেশের চ্যালা, আমার ক্লায়েন্ট তা জানত না। হংকংয়ে লইয়া গিয়া মহিলারে খারাপ করছিল। বড়-বড় হোটেলে তারা রাখত আর বড়লোকদের সঙ্গ দিতে বাধ্য করত। পরে সুরেশ সিং হংকংয়ে পুলিশের তাড়া খাইয়া কলকাতা ফিরল। সেই মিয়া আর আমার ক্লায়েন্টেরও সঙ্গে আনল সুরেশ।
জিজ্ঞেস করলুম, চাঁদ মিয়াঁর আসল নাম কী?
পকেট থেকে খুদে নোটবই বের করে হালদারমশাই দেখে নিলেন। বললেন, সাজ্জাদ খান। বাড়ি আজিমাবাদ। সেখানেই আমার ক্লায়েন্টের হাজব্যান্ডের বাড়ি ছিল। এ লং স্টোরি জয়ন্তবাবু! পরে শুনবেন! এমন মুড নাই।
বললুম, শুধু এটুকু বলুন অন্তত। আপনার ক্লায়েন্ট কেন কালো নেকড়ের রহস্য ফাঁস করতে চেয়েছিল।
হালদারমশাই ফিসফিস করে বললেন, খুশবুমহলে সুরেশ সিং আর চাঁদ মিয়া কালো নেকড়ে সম্পর্কে চুপিচুপি কথাবার্তা বলত। কাগজে খবর ছাপছিলেন না আপনারা? একদিন আমার ক্লায়েন্ট বাথরুমে ছিল। ওরা দুজনে কনসাল্ট করছিল, একটা লোক নাকি সব ট্যার পাইছে। তারে কালো নেকড়ে ফিনিশ না করলে বিপদ বাধবে। কোটি টাকার বিজনেস!
গোয়েন্দাপ্রবর হঠাৎ থেমে গেলেন। কর্নেল এবং ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পাণ্ডে লিফট থেকে নেমে এগিয়ে এলেন। কর্নেল বললেন, চলুন, মিঃ হালদার! পুলিশের কাজ পুলিশ করবে। ততক্ষণ আমরা মিঃ পাণ্ডের সঙ্গে থানায় যাই।
বাইরে দুটো পুলিশ-জিপ দাঁড়িয়েছিল। একটা পুলিশভ্যান এবং অ্যাম্বুলেন্সও সবে লনে ঢুকছিল। আমরা একটা জিপে উঠে বসলুম। মিঃ পাণ্ডের পাশে বসলেন কর্নেল। মিঃ পাণ্ডে জিপে স্টার্ট দিয়ে বললেন, বরং থানা থেকে নবাববাড়িতে টেলিফোন করা যাবে। ছোটে নবাবসাহেবের দিদি তার মেয়ের লাশ শনাক্ত করতে পারবেন।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, এতক্ষণ আশা করি উনি বাড়ি পৌঁছে গেছেন।
বললুম, কর্নেল! আমার ধারণা তাহলে সত্যি হলো। নাসিমাই সেই নাজমা বেগম।…
.