০৭.
মির্জাসাহেব তার প্রাইভেট সেক্রেটারির কথা শুনে যেন একটু অবাক হয়েছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপ ইয়ে আদমিকো পহচানতা?
জরুর। আপ্ ইকো কভি দেখা নেহি ছোটেনবাবসাব! শাকিল মিয়াঁ ধরা গলায় বললেন। লেকিন মুঝে মালুম হ্যায়, ইনকা নাম আপ শুনা থা! আভি ভূল গেয়া। তো মেহেরবানি করকে ইধার আইয়ে। বাত কনফিডেন্সিয়াল হ্যায়। ম্যায় আপকো সমঝা দুঙ্গা।
শাকিল মিয়াঁ মির্জাসাহেবকে বারান্দার অন্যপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ কী সব বললেন। তারপর দেখলুম, মির্জাসাহেব প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ফিরে আসছেন। পাগলের কাছে এসে তিনি বললেন, রহমত! ডিব্ব! ইনকো উঠাকে লে যাও।
পাগল তেমনি চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে। শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। তবু ওর যেন কোনো কষ্ট হচ্ছে না। কিংবা কষ্টের বোধও তার নেই। ওর অবস্থা দেখে আমার খারাপ লাগছিল। বেচারার ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে।
শাকিল মিয়াঁ, রহমত ও ডিব্বু পাগলকে ধরাধরি করে মড়ার মতো শূন্যে তুলে নিয়ে বারান্দা দিয়ে চলে যাওয়ার পর মির্জাসাহেব জোরে শ্বাস ছেড়ে বসলেন। তারপর বললেন, মানুষের জীবনে কী মর্মান্তিক ঘটনা না ঘটে।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, কে এই তাহির খান?
মির্জাসাহেব আস্তে বললেন, এটা একটা পারিবারিক কেলেঙ্কারির ঘটনা। আপনাকে বলা উচিত ছিল। কিন্তু বলতে পারিনি। সেজন্য ক্ষমা করবেন।
না, না। ক্ষমার কথা কেন আসছে? আমি আপনাকে পীড়াপীড়ি করছি না। তবে এ কথা ঠিক, ঘটনাটা জানতে পারলে আমার সুবিধা হয়।
মির্জাসাহেব পাইপে তামাক ভরলেন। তারপর লাইটার জ্বেলে পাইপ ধরিয়ে বললেন, না। আপনাদের কাছে গোপন করব না। বিশেষ করে আপনার জানা দরকার। আমার দিদির সন্তান একটি নয়। দুটি। প্রথম সন্তান মেয়ে। রহিমের দিদি ছিল সে। তার নাম ছিল নাজমা কোম। নাজমা গ্রাজুয়েট হওয়ার পর। আমার জামাইবাবু জোর করে তার বিয়ে দিয়েছিলেন। জামাইবাবুর অবশ্য তত দোষ ছিল না। কারণ নাজমা ছিল উদ্ধৃত প্রকৃতির মেয়ে। লখনউয়ের মতো শহরে মোটামুটি একটা রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের পক্ষে স্বাধীনতার একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকে। নাজমা সেই সীমা গ্রাহ্য করত না। অনেক পুরুষবন্ধু জুটিয়েছিল সে। যাই হোক, জামাইবাবু আজিমাবাদের এক ভদ্র পরিবারে তার বিয়ে দিয়েছিলেন। পাত্র আলিগড়ের এম. এ। স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আমি এসব ঘটনার সময় আমেরিকায় ছিলুম। কাজেই প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, জানি না। দিদি তা আমাকে আজ পর্যন্ত খুলে বলেননি। যে কারণেই হোক, নাজমা একদিন স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তার স্বামী নাকি দ্বিতীয় বিয়ে করে পাকিস্তানে চলে যান। অথচ আজ শাকিল মিয়াঁ বলছেন–আবার জোরে শ্বাস ছেড়ে মির্জাসাহেব আবেগরুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বললেন, শাকিল মিয়াঁও আজিমাবাদের লোক। এই মির তাহির খান তার বন্ধু ছিলেন। কাজেই দেখামাত্র তাকে চিনতে পেরেছেন।
কর্নেল আস্তে বললেন, এই পাগল মির তাহির খান আপনার ভাগনি নাজমা বেগমের স্বামী?
হ্যাঁ। এখন সমস্যা হলো, ব্যাপারটা দিদি কী ভাবে নেবেন। দিদি অবশ্য খুব কঠোর প্রকৃতির মহিলা।
তাহির খান নিশ্চয় বোবা ছিলেন না?
না। যেভাবেই হোক, শুধু বোবা নন, পাগলও হয়ে গেছেন। মানসিক আঘাতও এর কারণ হতে পারে। তাই না?
পারে। আপনি আজ রাতেই ওঁকে সেই সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারের নার্সিং হোমে রেখে আসুন।
মির্জাসাহেব বললেন, হ্যাঁ। সেইজন্য ওঁকে স্নান করিয়ে জামাকাপড় পরিয়ে একটু ভদ্রস্থ করে তোলার নির্দেশ দিলুম। আপনারা বসুন। আমি ডঃ রবীন্দ্র ভার্মাকে ফোন করে গাড়ি বের করব।
কিছুক্ষণ পরে মির্জাসাহেব ফিরে এলেন। তারপর গ্যারেজের দিকে গেলেন। গাড়ি পার্টিকোর সামনে এনে তিনি বললেন, মিঃ চৌধুরি! যদি কিছু মনে না করেন, আমার রাইফেলটা দিন।
রাইফেলটা চেয়ারের পাশে দাঁড় করানো ছিল। সাবধানে তুলে ওঁর হাত দিয়ে এলুম। উনি ধন্যবাদ বলে গাড়ি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের কাছে নিয়ে গেলেন।
বললুম, নাটকীয় ব্যাপার! এরপর হয়তো জানা যাবে খুশবুমহলের নাসিমাই সেই নাজমা!
কর্নেল হাসলেন। আরও নাটকীয় ব্যাপার ঘটতে চলেছে জয়ন্ত! আজ রাতে হালদারমশাই তার ক্লায়েন্টসহ সেহরাগড় পৌঁছুচ্ছেন। আমার সঙ্গে শিগগির ওঁর যোগাযোগ হওয়া দরকার।
কাল কি সালিম বেগের ফার্মে যাবেন না তাহলে?
দেখা যাক। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে। বলে কর্নেল উঠলেন। চলো! ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে দিই। কেন যেন বড্ড টায়ার্ড লাগছে। আসলে সব তালগোল পাকিয়ে গেল।
বাথরুম থেকে ফিরে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। আমিও বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ রগড়ে ধুয়ে ফেললুম। তারপর বিছানায় হেলান দিয়ে বসলুম। আমার মাথাও ভোঁ-ভোঁ করছিল …।
মির্জাসাহেব যখন ফিরলেন, তখন রাত প্রায় পৌনে দশটা বাজে। গেস্টরুমে ঢুকে তিনি চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর ক্লান্তভাবে বললেন, ডাঃ ভার্মার মেন্টাল হোমে তাহির খানকে রেখে ডাক্তার জগদীশ রায়ের বাড়ি গিয়েছিলুম। উনি ওঁর ল্যাবে ছিলেন। ভেতরে ডেকে পাঠালেন। তারপ বললেন, এই পচা মাংস যে কেমিক্যাল সাবস্ট্যান্স পেয়েছেন, তা সাংঘাতিক উত্তেজক। কোনো মানুষের মুখের লালার সঙ্গে মিশে গেলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্রেনের নার্ভে ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের জন্য সেই মানুষ প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে ওঠে। সে কী করছে, বুঝতে পারে না। তারপর অবশ্য সে মারা পড়ে। বিশেষ করে কুকুর জাতীয় জন্তুর লালায় মিশলে প্রতিক্রিয়া একই রকমের হয়। কিন্তু জন্তুটা মারা পড়ে না। কারণ কুকুর জাতীয় জন্তুর রক্তে ন্যাচারাল রেসিস্ট্যান্স পাওয়ার আছে মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি। উনি আমাকে বসিয়ে রেখে টাইম করে এই রিপোর্টটা আপনার জন্য দিয়েছেন।
মির্জাসাহেব বুশশার্টের পকেট থেকে একটা মুখ-আঁট খাম দিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি দিদির কাছে যাই। ওঁর কানে কথাটা গেছে কি না জানি না। আপনারা কি চা বা কফি খাবেন?
কর্নেল খামের মুখ ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, থাক। অসুবিধে না হলে দশটায় ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়ব।
ঠিক আছে। বলে মির্জাসাহেব চলে গেলেন।
কর্নেল টাইপকরা রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আমি যা ভেবেছি, ডাক্তার রায় তা-ই বলেছেন। নেকড়ে হোক বা কুকুর হোক, পোষা প্রাণী। কারণ দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে লোকটাকে। তারপর সে প্রাণীটাকে কাজে লাগিয়েছে।
কে সেই লোক?
কর্নেল হাসলেন। তাকেই তো খুঁজছি। ডাক্তার রায়ের মতে, প্রাণিবিজ্ঞান এবং রসায়নবিজ্ঞানে দখল না থাকলে এ ধরনের চিন্তা মাথায় আসে না। তার মানে, দুটো বিষয়ে লোকটা পারদর্শী।
আচ্ছা কর্নেল, ডাক্তার রায় খামের মুখ এঁটে দিয়েছিলেন কেন?
তোমার কী ধারণা শুনি?
ডাক্তার মির্জাসাহেবকে বলেননি, এমন আরও কিছু কথা ওতে আছে।
হ্যাঁ, আছে। তবে ইচ্ছে করলে মির্জাসাহেব পড়ে নিতে পারতেন বা পারবেন। আমার কাছেও জানতে অসুবিধা নেই।
আমরা চাপাস্বরে কথা বলছিলুম। বললুম, ওঁর এই মানসিক অবস্থায় সে উৎসাহ নেই।
কর্নেল ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন, পৌনে দশটা। দশটায় ডিনার খাব। তারপর আবার রিপোর্টটা খুঁটিয়ে পড়া যাবে। যাকে বলে বিটুইন দ্য লাইনস, সেই রকম কিছু এতে আছে কি না দেখতে হবে। যাই হোক, তুমি ঠিক বলেছ। আপাতত মির্জাসাহেব তাহির খান সম্পর্কে বেশি মনোযোগী।
কিছুক্ষণ পরে শাকিল মিয়াঁ এসে বিনীতভাবে বললেন, ছোটেনবাবসাব আমাকে খবর দিতে বললেন, ডিনার ইহাপর সার্ভ কিয়া যায়েগা। উনহির বহিনসাহেবকি তবিয়ত আচ্ছা নেহি। আপনারা কুছু মনে করবেন না।
কর্নেল বললেন, না, না। মনে করব কেন? আপনি এখানেই আমাদের খাবার পাঠিয়ে দিন। বেগমসাহেবার মনের অবস্থা আমরা বুঝতে পারছি।
শাকিল মিয়াঁর পেছনেই বিশাল ট্রে হাতে নিয়ে রহমত দাঁড়িয়ে ছিল। উনি পর্দা তুলে ধরলে সে টেবিলে ট্রে রাখল। তারপর সেলাম ঠুকে চলে গেল।
কর্নেল বললেন, শাকিল মিয়াঁ! আপনাকে তদারক করতে হবে না। আমরা নিজেরাই খেয়ে নেব।
জি নেহি কর্নিলসাব! ইয়ে বাব খানদানের ট্রাডিশন আছে। মেহমান–আই মিন, গেস্ট যতক্ষণ খানাপিনা করবেন, এক আদমি হাজির থাকবে। ছোটে নবাবসাব হামাকো উয়ো কাম দিলেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, তাহলে আপনি বসুন।
শাকিল মিয়াঁ একটা চেয়ারে বসলেন। আমরা খেতে বসলুম। প্রকাণ্ড পরোটা, ডিমের হালুয়া, পনির মাখানো এবং সেদ্ধ কী একটা সবজি, রোস্টেড চিকেন, কয়েকরকমের মিঠাই সাজানো ছিল। কর্নেল বললেন, শাকিল মিয়াঁ। আপনিও আসুন। এত বেশি আমরা দুজনে খেতে পারব না।
ভদ্রলোককে রাজি করানো গেল না। তিনি নাকি পেটের রোগী। রাত্রে শুধু দুটো শুকনো রুটি আর একটু ডাল খান।
কর্নেল নিজেই বলেন, খেতে বসে কথা বলতে নেই। কিন্তু আজ নিয়ম ভঙ্গ করে শাকিল মিয়াঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন। একটু পরে বুঝলুম, কর্নেল আসলে ওঁকে জেরা করছেন। দুজনের মধ্যে এই সব কথাবার্তা হলো–
কর্নেল ॥ পীরের সমাধি দেখতে গিয়েছিলুম। দুই নবাব পরিবারের লোকেরা থাকতে সমাধির অবস্থা জরাজীর্ণ কেন?
শাকিল মিয়াঁ ॥ পীরের মাজারের তিন একর জমি নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে এখনও বিবাদ চলছে। সালিমসাহেব কোর্টে একটা দলিল সাবমিট করেছেন। আনরেজিস্টার্ড দলিল। ওতে ছোটে নবাবসাহেবের মায়ের সই আছে। উনি ভাসুরসাহেবকে ওই জমি দিয়ে গেছেন।
কর্নেল ॥ আপনি কি পীরের সমাধিদর্শনে যান?
শাকিল মিয়াঁ ॥ আগে কোনো কোনো দিন যেতুম। কালো নেকড়ের উপদ্রবের পর আর যাই না। কাদের বখশকেও যেতে নিষেধ করেছিলুম। কিন্তু নিষেধ শোনেনি।
কর্নেল ॥ আজ কি আপনার ওখানে যাওয়ার কথা ছিল?
কর্নেলের এই প্রশ্নটা শুনে শাকিল মিয়াঁ খুবই চমকে উঠলেন। আস্তে বললেন, জি হাঁ। বড়ানবাবসাবের ফ্যামিলির এক খিদমতগার (পরিচারক)
মোমিন খান হামকো বোলা, কাদের বখশ মর গেয়া। লেকিন কাদের বখশ হ্যাড ডিসকভারড় দা প্লেস অব হিন্ ট্রেজার। তো হুয়া একেলা মোমিন খান নেহি যানে শক্ত। উসকা বহত্ ডর লাকতা। তো ইফ আই এগ্রি টু অ্যাকম্পেন হিম, হি উইল গো দেয়ার। কর্নিলসাব! খাজনাকে লিয়ে মেরা কৈ লালচ নেহি হ্যায়। লেকিন আই ওয়াজ ভেরি মাচ ইনকুইজিটিভ, হোয়েদার মোমিন খান সাচ বোলতা কি ঝুট বোলতা! অব কোর্স, মোমিন খান ইজ এ ফেথফুল পার্সন।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, কখন যেতে বলেছিল সে?
মগরিবকি আগে। পাঁচ-সওয়া পাজ বাজকে। লেকিন আপলোগোনে উস ওয়াখত্ উধার থে। ইস লিয়ে হাম নেহি যা শ্যকে।
আপনার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছিল মোমিন খানের?
আজ সেহরাগড় টাউনকি বাজরমে মুলাকাত হুয়া। মোমিন খান খারাব আদমি নেহি হ্যায়। আজ এ গুড মুসলিম হি প্রেজ ফাইভ টাইমস এ ডে। সো আই বিলিভ হিম। ঔর হাম ইয়ে ভি শোচা, দো আদমি একসাথ রহনেসে উও জানোয়ার–আই মিন, দা ব্ল্যাক উলফ উইল নট ডেয়ার টু অ্যাটাক আস।
কর্নেল খাওয়া শেষ করে বললেন, শাকিল মিয়াঁ! আপনি খুব বেঁচে গেছেন আজ।
শাকিল মিয়াঁ হকচকিয়ে গেলেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কর্নেলের দিকে।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, মোমিন খান সাচ্চা মুসলমান হতে পারেন, কিন্তু তিনি নিশ্চয় কারও কথায় একা কোথাও যাবেন না।
শাকিল মিয়াঁ কাকুতি-মিনতি করে বললেন, হামার ভুল হইয়ে গেছে। কর্নিলসাব! চৌধুরিসাব! মাই রিকোয়েস্ট! প্লিজ ডোন্ট টেল দিস টু ছোটে নবাবসাব। মেরা নোকরি নেহি রহেগা।
কর্নেল তাকে আশ্বস্ত করে বাথরুমে ঢুকলেন।….
এ-রাত্রে আমি শিগগির ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। কর্নেল ভোরবেলা অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। সকাল আটটায় আমি যখন বিছানায় বসে বেড-ট পান করছি, তখন কর্নেল ফিরে এলেন। তাকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। আশা করেছিলুম, তার ব্যক্তিগত প্রথা অনুসারে তিনি সম্ভাষণ করবেন, গুড মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।
কিন্তু উনি চুপচাপ কিটব্যাগ, বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা টেবিলে রেখে ক্লান্তভাবে বসে পড়লেন। বললুম, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে বস্।
কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, আজ একা বেরিয়েছিলুম। মির্জাসাহেব এখনও শয্যাত্যাগ করেননি শুনলুম।
বললুম, কিন্তু আপনার মেজাজ খারাপ করে দিল কে?
সুরেশ সিং। বলে কর্নেল টুপি খুলে রেখে টাকে হাত বুলিয়ে নিলেন। তারপর অভ্যাসমতো সাদা দাড়ি ঝেড়ে ফেললেন। আপনমনে ফের বললেন, আগে কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করে নিই।
আমি এই সুযোগে বাথরুমে গেলুম। শেভ করে এবং দাঁত ব্রাশ করে বেরুতে মিনিট পাঁচ-সাত লাগল। দেখলুম, রহমত কফি আর স্ন্যাকের ট্রে রেখে সদ্য বেরিয়ে গেল। মুখোমুখি বসে বললুম, সুরেশ সিংয়ের সঙ্গে আপনার দেখা হলো কোথায়?
কর্নেল কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, বলছি।
ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেই হলো। কফি শেষ করে চুরুট করিয়ে কর্নেল আস্তে বললেন-নরেশজির বাড়ির সামনে দিয়ে আসার সময় দেখি, একটা যণ্ডামার্কা লোক বেরিয়ে আসছে। পোশাক আর লোকটার মধ্যে কোনো মিল নেই। সে হনহন করে। এগিয়ে আসছে দেখে আমি দাঁড়ালুম। লোকটা সরাসরি আমাকে চার্জ করল, আপনি কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? আমিও একই সুরে বললুম, আপনি কি সুরেশ সিং? সে বলল, হ্যাঁ। আমিই সেই সুরেশ সিং। তারপর
এক মিনিট। বাংলা কথা বলছিল সে?
হ্যাঁ। তো হঠাৎ ব্যাটাচ্ছেলে আমাকে হুমকি দিয়ে বলল, এটা আপনার কলকাতা নয়। সেহরাগড়ের জঙ্গল। এখানে একটা নয়, শয়ে শয়ে কালো নেকড়ে চরে বেড়াচ্ছে। প্রাণে বাঁচতে হলে আজই কেটে পড়ুন। পারেন তো কলকাতায় আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন।
কর্নেল চুপ করলে জিজ্ঞেস করলুম, তারপর?
কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, আমি মাথা ঠাণ্ডা রেখে ওকে বললুম, আপনার দাদার কাছে শুনেছি দশ বছর আগে আপনি এখান থেকে পুলিশের ভয়ে গাঢাকা দিয়েছিলেন। গত দশ বছরে এখানে অবস্থা বদলে যাওয়ারই কথা। ব্যাটাচ্ছেলে বলে কী, বাজে কথা ছাড়ুন। আমি এখানে দশ বছর ছিলুম না। কিন্তু আমার ছায়া এখানে ছিল। ইশারায় বললুম, বুঝে নিন কর্নেলসায়েব! কাল যদি এখানে আপনি থাকলে, কালো নেকড়ে আপনাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। কথাগুলো বলেই লোকটা গিয়ে নরেশজির বাড়িতে ঢুকল।
হতবাক হয়ে শুনেছিলুম। বললুম, মির্জাসাহেবকে কথাটা জানানো দরকার।
এইসময় শাকিল মিয়াঁ এসে বললেন, কর্নিলসাব! আপকা টেলিফোন আয়া।
কর্নেল তাঁর সঙ্গে চলে গেলেন। ভাবলুম, সুরেশ সিংয়ের ওইভাবে হুমকি দেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? তাছাড়া কালো নেকড়ের কথা বলে ভয় দেখানোতে রহস্যটা আরও জট পাকিয়ে গেল। কলকাতার খুশবুমহলের সেই নাসিমা প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের শরণাপন্ন হয়েছে। সে ওই বাড়ি থেকে কি তাহলে সুরেশের ভয়েই পালিয়েছিল?
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল একা ফিরে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে বললেন, হালদারমশাই তার ক্লায়েন্টসহ সূর্য হোটেলে উঠেছেন।
নদীর ওধারে একটা পশ এরিয়ায় সূর্য হোটেল। হালদারমশাই দশটা নাগাদ আমাকে যেতে বললেন। তার মক্কেল আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
কথাটা শুনে হাসি পেল। বললুম, একজন বারবধূর সঙ্গে একই ঘরে ওঠেননি তো?
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, তোমার মাথায় এই কথাটা এল কী করে?
জিভ কেটে বললুম, নাহ। আপনার মুড খারাপ। তাই একটু জোক করলুম।
ব্যাড জোক। বলে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকার পর আপনমনে বলে উঠলেন, যামার্কা লোকটা কি সত্যি সুরেশ সিং? আমার সন্দেহ বেড়ে যাচ্ছে।
জিজ্ঞেস করলুম, কেন?
কর্নেল বললেন, যে সুরেশ সিং কলকাতায় থাকে এবং নানা মহলে প্রভাব আছে, সে আমার ব্যাকগ্রাউন্ড জেনেও এভাবে মুখোমুখি হুমকি দেবে কি? শুনেছি সে ধূর্ত লোক। জয়ন্ত! এই লোকটা তার ডামি।…
.