১০.
প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আমি সাবধানে টর্চ জ্বেলে সেই খিড়কির দরজায় উঠে এলুম। কপাটে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। রহমত সেলাম ঠুকে বলল, উয়ো লম্বে সাব কাঁহা গেয়া স্যর?
লম্বা সাহেবের কথাটা খুলে বললুম। শুনেই রহমত কপালে মৃদু থাপ্পড় মেরে বহত্ খতরনাক্ বলে হন্তদন্ত দৌড়ে গেল গেটের দিকে। ততক্ষণে বাড়ির বিশাল লনে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আমি দরজাটা হুড়কো দিয়ে এঁটে দিলুম। টেনিস লন পেরিয়ে গিয়ে দেখি, বন্দুক কাঁধে নিয়ে খুদা বখ্শ আসছে। আমার কাছে ঘটনাটা শুনে নিয়ে সে হেসে ফেলল। তার পিছনে রহমত এসে গিয়েছিল। খুদা বস্ হাসতে হাসতে বলল, ইয়ে বুড়বক সবকুছমে খতরনাক দেখতা। আবে! তু জানতা নেহি ইস ওয়াখত কলিম ডাগদারসাব কুত্তা লেকে নদীকি কিনারমে ঘুমতে রহে? স্যার! কলিমসাব আচ্ছা শরিফ আদমি হ্যায়। উনহিকি এক কালা বিলায়তি কুত্তা হ্যায়। উনহি মরহুম (প্রয়াত) বড়েনবাবকা ছোটো বেটা মির্জা কলিম আলি বেগ।
খুদা বখশ আমাকে আশ্বস্ত করে চলে গেল। তার বক্তব্য, ডাগদারসাব এ বাড়ির একজন অতিথিকে চা-নাস্তা খাইয়ে তবে পৌঁছে দেবেন। চিন্তার কারণ নেই।
বারান্দায় গিয়ে বেতের চেয়ারে বসলুম। খুদা বখশের কথা শুনেও মনে অস্বস্তি থেকে গেল। একটু পরে শাকিল মিয়াঁ এলেন। ঘটনাটা ইতিমধ্যে তার কানে গিয়েছিল। তিনি বললেন, খুদা বখশ ঠিক বোলা স্যার! কলিমসাব আচ্ছা আমি! মিঃ হালদারকে লিয়ে মাত শোচিয়ে। কলিমসাব ছোটেনবাবসাবকো সাথ কভি-কভি বাতচিত করতো। হি ইজ নট লাইক হিজ এল্ডার ব্রাদার সালিমসাব।
কর্নেল এবং মির্জাসাহেব গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন। ওঁরা যখন ফিরে এলেন, তখন সাতটা বেজে গেছে। হালদারমশাইয়ের কীর্তি শুনে কর্নেল গম্ভীর হয়ে গেলেন। মির্জাসাহেব বললেন, ডিব্বু একদিন বলেছিল, আমার ঘোড়ার জন্য ঘাস কাটতে গিয়ে সে কলিমকে আমাদের কবরখানার নিচের জঙ্গলে কুকুর নিয়ে বেড়াতে দেখেছে। কলিমের একটা টেরিয়ার কুকুর আছে শুনেছি। সেটা কালো কি না জানি না। কুকুর সম্পর্কে আমার তত কিছু জ্ঞান নেই।
রহমত কফি আনল। কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন, মিঃ হালদারকে নিয়ে এই এক সমস্যা। উনি সবসময় বিপজ্জনক ঝুঁকি নেন। আচ্ছা মির্জাসাহেব, আপনার খুড়তুতো ভাইদের বাড়িতে কাউকে দিয়ে মিঃ হালদারের খবর নেওয়া যায় না?
তা যায়। কিন্তু এখন তো কলিমের নার্সিংহোমে থাকার কথা। ওর নার্সিংহোম সেহরাগড় টাউনের রোশনিবাগে। এখান থেকে অন্তত দশ কিলোমিটার দূরত্ব।
উনি গাড়িতে যাতায়াত করেন তাহলে?
হ্যাঁ। রহমত! খুদা বখশকে পুছকে আও। কলিকা গাড়ি উয়ো পছানতা।
রহমত তখনই গিয়ে খবর নিয়ে এল। খুদা বখশ এইমাত্র ডাগদারসাবের গাড়ি যেতে দেখেছে। কর্নেল চিন্তিত মুখে বললেন, তাহলে মিঃ হালদারের ফিরে আসা উচিত ছিল। মির্জাসাহেব! কফি খেয়ে নিন! ওঁর খোঁজে বেরুনো দরকার। বড্ড হঠকারী মানুষ।
এই সময় রহমতের মেয়ে মুন্নি এসে খবর দিল, ছোটনবাবসাহেবের টেলিফোন এসেচে। মির্জাসাহেব দ্রুত উঠে গেলেন। কর্নেল বললেন, তুমি ওঁর সঙ্গে গেলে না কেন? তোমার কাছে তো ফায়ার আর্মস আছে!
বললুম, আপনি হলে কথা ছিল। আপনি তো জানেন হালদারমশাই কেমন মানুষ! তাছাড়া কে কুকুর নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা নিয়ে অহেতুক মাথাব্যথার মানে হয় না। আমি ভাবলুম, শিগগির ফিরে আসবেন।
কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে গলার ভেতর বললেন, হোপলেস! তোমার আর্মস লাইসেন্স বাতিল হওয়া উচিত। তোমার বোঝা উচিত ছিল তোমাকে কেন ফায়ার আর্মস সঙ্গে নিতে বলেছিলুম।
চুপচাপ কর্নেলের ভর্ৎসনা হজম করলুম। সত্যি আমি ভুল করেছি। কেন যে তখন অত ভয় পেলুম!
মির্জাসাহেব ফিরে এসে হাসিমুখে বললেন, সুখবর আছে কর্নেল! সুরেশ আর সাজ্জাদ ওরফে চাঁদ মিয়া হাইওয়েতে বমাল ধরা পড়েছে। চণ্ডীপুর স্টেশনের কাছে রেলওয়ে ক্রশিংয়ে অ্যান্টি-নার্কোটিক সেলের অফিসাররা এবং স্থানীয় পুলিশ নরেশজির গাড়ির বর্ণনা অনুসারে একটা গাড়িতে হানা দেন। নাম্বারপ্লেট বদলানো ছিল। গাড়ি সার্চ করে পেছনের সিটের তলায় দশ কিলোগ্রাম আফিম আর পনের কিলোগ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে। ওদের সেহরাগড়ে আনা হচ্ছে। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অর্জুন পাণ্ডে বললেন, এই সব কাঁচামাল প্রসে হয়ে নানাধরনের মাদক তৈরি হয়। সত্যিই কোটি টাকার ব্যবসা!
কর্নেল বললেন, তাহলে বলুন আমার ম্যাথমেটিকসে ভুল ছিল না!
না। আসলে গাড়িটা তো নরেশজির। তাই ভেবেছিলুম ওরা সেহরাগড়েই ট্রেনে চাপবে।
আর আমার বক্তব্য ছিল, ওরা হাইওয়ে দিয়ে গিয়ে কোথাও গাড়িটা ফেলে রেখে অন্য কোনো স্টেশনে ট্রেনে চাপবে। কারণ ওদের পক্ষে এটুকু বোঝা সহজ যে, সেহরাগড় স্টেশনে পুলিশ ওত পেতে থাকবে।
মির্জাসাহেব রাইফেলটা কাঁধে তুলে অন্য হাতে টর্চ নিয়ে বললেন, চলুন। বেরুনো যাক।
কর্নেল কিটব্যাগটা সবসময় সঙ্গে রাখেন। সেটা পিঠে এঁটে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা গেস্টরুমে রেখে এলেন। একটু হেসে বললেন, জয়ন্ত আশাকরি এবার ভয় পাবে না। মির্জাসাহেবের রাইফেল দেখে ওর ভরসা পাওয়া উচিত।
চুপচাপ ওঁদের অনুসরণ করলাম।
গেটের বাইরে গিয়ে মির্জাসাহেব বললেন, পীরের মাজার হয়েই যাওয়া যাক।
আমরা পীরের সমাধিতে যাওয়ার রাস্তার কাছে সব পৌঁছেছি, হঠাৎ কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে বললেন কী আশ্চর্য! ওই তো মিঃ হালদার আসছেন।
ডানদিকে বাংলোধাঁচের বাড়িগুলো থেকে রাস্তায় আলো পড়েছে। দেখলুম, প্রাইভেট ডিটেকটিভ সবেগে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছেন। মির্জাসাহেব টর্চের আলো ফেলতেই গোয়েন্দাপ্রবর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বললেন, কেডা আলো জ্বালে? হাত গুঁড়াইয়া দিমু।
তিনি রিভলবার তাক করতেই কর্নেল সাড়া দিলেন, হালদারমশাই! অস্ত্র সম্বরণ করুন।
হালদারমশাইয়ের দাঁত ঝকমক করল। আরে কী কাণ্ড! কর্নেল স্যার নাকি?
মির্জাসাহেব ততক্ষণে টর্চের আলো নিভিয়ে বললেন, আপনি ওদিকে কোথায় গিয়েছিলেন?
রাস্তায় কথা নয় চলুন।…
মির্জাসাহেবের বাড়ি পৌঁছে বারান্দায় আবার আমরা বসলুম। হালদারমশাইয়ের জন্য এক পেয়ালা কফির ব্যবস্থা করে মির্জাসাহেব বললেন, আপনার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে খুঁজতে বেরিয়েছিলুম। ওই এরিয়া এখনও বিপজ্জনক। কারণ কালো নেকড়েটা–
বাধা দিয়ে হালদারমশাই বললেন, কুত্তা। কালো রঙের একটা লম্বাটে কুত্তা।
কর্নেল বললেন, আগে কফি খেয়ে চাঙ্গা হোন হালদারমশাই!
রহমত কাছাকাছি ছিল না। মুন্নি মাথার ওড়না চাপা দিয়ে এক পেয়ালা কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে হালদারমশাই যা বললেন তা এই
রোগাটে গড়নের এক ভদ্রলোক কালো লম্বা গড়নের একটা কুকুরের চেন ধরে একটা ফাঁকা জায়গায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ঝোপজঙ্গল আর পাথরের মধ্যে দিয়ে যেখানে গেলেন, সেটা একটা কবরখানা। হালদারমশাই অবাক হয়ে দেখলেন, সেখানে একটা লোক অপেক্ষা করছিল। তার পায়ের কাছে একটা মাটির কবর এবং তার হাতে একটা শাবল। ভদ্রলোক টর্চের আলো ফেললেন কবরটার ওপর। অমনি কুকুরটা কবরের খোঁড়া জায়গায় মুখ ঢুকিয়ে দিল। হালদারমশাই একটা পাথরের আড়ালে ছিলেন। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ভেসে আসছিল। তাই বুঝলেন, কুকুরটাকে মরা মানুষের মাংস খাওয়ানো হচ্ছে। একটু পরে কুকুরের চেন সেই লোকটার হাতে দিয়ে ভদ্রলোক জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেলেন। এবার কুকুরটা খাওয়া শেষ করে জিভ দিয়ে মুখের দুপাশে চাটতে থাকল। লোকটা কবরের মাটি ঠিকঠাক করে শাবলটা একটা ঝোপে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর কুকুরটাকে নিয়ে সোজা নাকবরাবর দক্ষিণে হাঁটতে থাকল। তারপর অন্ধকার ঘন হলে হালদারমশাই তাদের হারিয়ে ফেললেন। দৃশ্যটা বীভৎস। হালদারমশাই এবার ডানদিকে দূরে আলো লক্ষ করে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তাটা পেয়ে যান।
কর্নেল বললেন, মির্জাসাহেব! ওদিকে কি কোনো গ্রাম আছে?
মির্জাসাহেব বললেন, আছে। কৈলাসপুর। কিন্তু এ কী অদ্ভুত কাণ্ড! কলিম তার কুকুরকে মরা মানুষের মাংস খাওয়ায়? তাছাড়া একবছরের মধ্যে ওই কবরখানায় সদ্য কবর দেওয়া হয়েছে কাদের বখশকে। এর একটা ফয়সালা করা দরকার।
কর্নেল বললেন, এ মুহূর্তে ওকথা চেপে যান মির্জাসাহেব! আমাকে যা করার করতে দিন।
আশ্চর্য! মির্জাসাহেব উত্তেজিতভাবে বললেন। কলিমকে ভদ্র নিরীহ বলে জানতাম!
তার চেয়েও আশ্চর্য– হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, কুত্তাটা একেবারে নেকড়ের মতো দেখতে। কর্নেল স্যার! দ্য মিস্ট্রি অব দ্য ব্ল্যা উল ইজ সলভড। কী কন?
কর্নেল হাসলেন। কনগ্রাচুলেশন হালদারমশাই! তবে আপাতত এসব কথা আর নয়।…
সে-রাতে খাওয়াদাওয়ার পর গেস্টরুমে ঢুকে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা হালদারমশাই, কুকুরটা যখন কবর থেকে পচা মাংস খাচ্ছিল, তখন কি আপনি কুকুরটার কোনো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছিলেন?
হালদারমশাই বললেন, তখন তো দিনের আলো আর ছিল না। তবে মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালছিল ওরা। সেই আলোয় যেটুকু দেখলাম, কুত্তাটার দাঁতগুলি বড় আর ধারালো। নখগুলিও দেখছি। সাধারণ কুত্তার নখ এত বড় হয় না। কইলাম না? কুত্তাটা য্যান কুত্তা না, নেকড়ে। গলায় বকলেস আর চেন না থাকলে ওটা কুত্তা বলিয়া মনে হইব না।
বললাম, কিন্তু একটা কুকুরকে নেকড়েতে পরিণত করার কারণ কী?
সন্ত্রাস সৃষ্টি। যাতে নির্বিবাদে কারবার চালানো যায়। বলে কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন। একটু পরে ফের বললেন, গত একবছর ধরে এই সন্ত্রাস চলছে। এবার মনে করে দেখ, মির্জাসাহেবের স্ত্রী এমিলি আর তার ঘোড়াটার শোচনীয় মৃত্যুর কারণ কী হতে পারে? তুমি বলেছিলে, হয়তো কালো নেকড়েটা দেখেই ঘোড়াটা ভয় গোয়ে খাদে পড়ে গিয়েছিল। কথাটা খানিকটা ঠিক। আসলে তখন ইচ্ছাকৃতভাবে ওই জন্তুটাকে টক্সিক আরক মেশানো পচা মাংস খাইয়ে পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে কেউ অপেক্ষা করছিল। তারপর এমিলি সেখানে পৌঁছুনোর সময় জন্তুটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। মির্জাসাহেবকে নিয়ে জায়গাটা দেখতে গিয়েছিলুম। এবার ঘটনাটা আমার কাছে স্পষ্ট। কুকুর-নেকড়ে বলো বা নেকড়ে-কুকুর বলো, তার আক্রমণেই ঘোড়াটা খাদে পড়ে যায়।
বললুম, তার মানে এমিলিকে হত্যার দরকার হয়েছিল।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। যেমন কাদের বখশকে হত্যার দরকার হয়েছিল।
কিন্তু কেন?
এমিলি স্বামীর নিষেধ না মেনে সালিম বেগের ফার্মে যেতেন। এদিকে ডিব্দুর কাছে জেনেছি, সালিমের লোক মোমিন খান কাদের বখশকে মাঝে মাঝে টাকাকড়ি দিত। ডিব্বু আড়াল থেকে দেখেছিল। তার মানে, কাদের বখশের মুখ বন্ধ করতে সালিম টাকাকড়ি দিতেন। আজ শাকিল মিয়াঁ আমার জেরার চোটে কবুল করেছেন, সালিম সাহেবের ফার্মে কিছু বেআইনি কাজকারবার হয় এবং সেকথা তিনি তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় আবিদের কথায় আঁচ করেছিলেন। আবিদ ফার্মে কাজ করে। সরল এবং ধার্মিক মানুষ শাকিল মিয়াঁ একদিন কথায় কথায় মোমিন খানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ফার্মে নাকি গোপন কাজকর্ম হয়? মোমিন খান ধূর্ত লোক। কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর শাকিল মিয়াঁকে পীরের সমাধিতে হত্যার চক্রান্ত করা হয়েছিল। কালো নেকড়ের কামড়ে তাঁর মৃত্যু হতো। এখন বুঝতে পেরেছি, পাগল তাহির খান কাউকে ওখানে গর্ত করতে দেখেছিলেন। তারপর কৌতূহলবশে তিনি গর্তটা খুঁড়ছিলেন। সেই সময় আমরা গিয়ে পড়েছিলুম। এবার বুঝতেই পারছ, শাকিল মিয়াঁ ওখানে পৌঁছানোর আগেই গর্ত খুঁড়ে পচা মাংসটা বের করা হতো। সেই গন্ধে কলিম ডাক্তারের সাংঘাতিক প্রাণীটা ছুটে আসত।
বললুম, সব বুঝতে পারছি। কিন্তু সালিম বেগের ফার্মে কী এমন গোপন কারবার হতো?
হালদারমশাই ঝিমুচ্ছিলেন। সেই অবস্থায় বললেন, নার্কোটি। নিষিদ্ধ মাদক। আমার ক্লায়েন্ট কইছিল।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, প্রায় এগারোটা বাজে। শুয়ে পড়া যাক। জয়ন্ত হালদারমশাই! ভোর চারটেতে আমাদের উঠতে হবে।
জিজ্ঞেস করলুম, কেন?
এই রহস্যের শেষ পর্দা তোলা হবে আগামী প্রত্যূষে। গম্ভীর মুখে কথাটা বলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকলেন।….
ভোর চারটে নাগাদ কর্নেলের তাড়ায় আমাকে উঠে পড়তে হয়েছিল। মির্জাসাহেব রাইফেল কাঁধে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তখনও অন্ধকার মুছে যায়নি। হালদারমশাই উৎসাহে পা বাড়িয়ে বললেন, কুকুরটা আপনিই মারবেন। তবে তাকে খুঁজে পাবেন কি না জানি না।
আমরা খিড়কির দরজা খুলে নদীর ধারে নেমে গেলুম। শাকিল মিয়াঁ দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিলেন। মির্জাসাহেব আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। ঝোপজঙ্গল আর বড় বড় পাথরের মাঝখানে সাবধানে পা ফেলে আমরা হাঁটছিলুম। একবার কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলুম, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
কিন্তু কোনো উত্তর পেলুম না।
কিছুদূর চলার পর অন্ধকার বেশ কিছুটা স্বচ্ছ হয়ে গেল। মির্জাসাহেব বললেন, ডানদিকে কৈলাসপুর। আমরা কৈলাসপুর পেরিয়ে গেলে পাহাড়ি রাস্তা পাব।
প্রায় মিনিট কুড়ি পরে পাহাড়ের কাঁধে একটা পায়ে চলা রাস্তা পাওয়া গেল। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটেছে। চারদিকে পাখিরা ঘুমঘুম স্বরে ডাকাডাকি করছিল। ক্রমশ রাস্তাটা চড়াইয়ে এগিয়ে গেছে বলে হালদারমশাই বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন। আন্দাজ শতিনেক ফুট ওঠার পর রাস্তাটা উত্রাইয়ে নেমে গেছে। এবার রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের চূড়ার দিকে আমরা উঠছিলুম। পাহাড়ের মাথার দিকটা নগ্ন। একখানে চূড়াটা দুভাগ হয়ে গেছে। সেখানে পৌঁছে মির্জাসাহেব বললেন, কর্নেল সরকার! ওই দেখুন নিচে সালিমের ফার্মের জমি।
দিনের আলো এখন রক্তিম। কর্নেল বাইনোকুলারে ফার্মের জমি দেখতে দেখতে বললেন, যা ভেবেছিলুম। এখন হোয়াইট পপির মরশুম। ওদিকের জমিতে হেম্প বা ক্যানাবিস জাতীয় উদ্ভিদ। মির্জাসাহেব! আমার অনুমান, প্রায় নএকর জমিতে–বেশিও হতে পারে, হোয়াইট পপির চাষ করা হয়েছে। ক্যানাবিস প্রায় তিন একর জমিতে।
মির্জাসাহেব বললেন, হোয়াইট পপি? তার মানে–
আফিং। কর্নেল বাইনোকুলারে দেখতে দেখতে বললেন। আর ক্যানাবিস বলছি যাকে, তা সিদ্ধি আর গাঁজা। পুরুষ গাছগুলো থেকে সিদ্ধি পাওয়া যায়। স্ত্রী গাছগুলো থেকে গাঁজা। হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে নিয়ে বললেন, কিন্তু কুত্তাটা গেল কই?
কর্নেল বললেন, কুকুরটা এখানে থাকে কি না বলা কঠিন। মির্জাসাহেব! আপনার খুড়তুতো ভাইদের বুদ্ধি আছে। চারদিকে আখের চাষ করে মাদকচাষের জমি ঘিরে রেখেছেন। তাছাড়া জমিগুলো ঢালু।
মির্জাসাহেব ঘড়ি দেখে বললেন, পুলিশ এখনও এসে পৌঁছুল না?
কর্নেল হাসলেন। পৌঁছে গেছে। ফার্মের গোডাউন আর অফিস গাছপালার আড়ালে পড়েছে বলে দেখতে পাচ্ছেন না। বাইনোকুলারে দেখুন। পশ্চিমদিকের পাহাড় থেকে নেমে একদল পুলিশ আখের খেতের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে।
মির্জাসাহেব বাইনোকুলারে দেখতে দেখতে বললেন, হ্যাঁ। ফার্মের অফিসেও–
তার কথা থেমে গেল আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির শব্দে। হালদারমশাই নড়ে বসলেন। কুত্তাটারে গুলি করল নাকি?
তারপরেই অভাবিত ঘটনা ঘটল। ফার্মের দুজন গার্ড ছুটে এসে এই পাহাড়ের একটা খাঁজে সম্ভবত লুকোতে এসে মুখ তুলে আমাদের দেখতে পেয়েই গুলি ছুড়ল। আমাদের মাথার ওপরকার পাথরে লাগল গুলি দুটো। পাথরের টুকরো ছিটকে পড়ল। আমরা সহজাত আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিবশে মাথা নিচু করেছিলুম। মির্জাসাহেব তার রাইফেল তুলে তাক করতেই কর্নেল বললেন, আর এখানে নয়। বাড়ি ফেরা যাক। পুলিশ অ্যাকশানে নেমেছে। আমরা যেটুকু দেখলুম, তাই যথেষ্ট। তবে এক মিনিট। ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে রেখেছি। আফিং আর সিদ্ধি-গাঁজার জমিতে এবার রোদের ছটা পড়েছে। কয়েকটা ছবি তুলে নিই।
কর্নেল উপুড় হয়ে শুয়ে কয়েকবার ক্যামেরার শাটার টিপলেন। তারপর পিছিয়ে গিয়ে সোজা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চলুন। আর দেরি করা ঠিক নয়।
হালদারমশাই ক্ষুব্ধভাবে বললেন, হালার কুত্তাটা।…
ফেরার পথে মির্জাসাহেব বললেন, কর্নেল সরকার! চলুন! আমাদের পারিবারিক কবরখানাটা একবার দেখে যাই। কাদের বখশের কবরটা কী অবস্থায় আছে, দেখা যাক। বরং ওটা ইট দিয়ে বাঁধিয়ে দেব।
কালামহলের ধ্বংসস্তূপের কিছুটা আগে বাঁদিকে ঘুরে ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে উঁচু মাটিতে নবাবি কবরখানায় পৌঁছুলুম। সেই সময় কর্নেল চাপাস্বরে বলে উঠলেন, বেগতিক দেখে ওরা কুকুরটা ছেড়ে দিয়েছে দেখছি! গলায় শুধু বকলেস পরানো আছে।
হালদারমশাই বললেন, কৈ? কৈ?
তারপরই দেখতে পেলুম, লম্বাটে একটা কালো কুকুরের মতো জন্তুকে। জন্তুটা একলাফে নিচের ঝোপ থেকে কবরখানায় উঠল এবং দৌড়ে গিয়ে একটা মাটির কবরকে পালাক্রমে সামনেকার এবং পেছনকার পায়ে আঁচড়াতে শুরু করল। মির্জাসাহেব রাইফেল তাক করার আগেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ তাঁর রিভলবার দুহাতে ধরে পর পর দুরাউন্ড গুলি ছুড়লেন। হিংস্র চেহারার জন্তুটা গর্জন করে শূন্যে ছিটকে গেল। সেই অবস্থায় মির্জাসাহেবের রাইফেল গুলি মুহূর্তে আরো কিছুটা তফাতে সরিয়ে দিল নিস্পন্দ জন্তুটাকে।
কর্নেল বললেন, ওটাকে ডাক্তার রায়ের কাছে পাঠাতে হবে। পুলিশকেও জানাতে হবে।
হালদারমশাই দৌড়ে গেলেন। মির্জাসাহেব তাঁকে বললেন, মিঃ হালদার! কবরখানায় জুতো খুলে রেখে ঢুকতে হয়।
সরি! বলে জুতো খুলে রেখে হালদারমশাই লেজ ধরে রক্তাক্ত জন্তুটাকে টেনে নিচে ফেলে দিলেন। তারপর জুতো পরে আবার তার লেজ ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললেন। এবার মির্জাসাহেবের নির্দেশে আমরা পীরের সমাধির পাশ দিয়ে সদর রাস্তায় পৌঁছলুম। গুলির শব্দ শুনে বড় নবাববাড়ি থেকে কয়েকজন লোক বেরিয়ে এসেছিল। তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। হালদারমশাই জন্তুটার লেজ ধরে সবিক্রমে টানতে টানতে শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে আবার চাপা গর্জন করলেন, হালার কুত্তা!….