০১.
ভদ্রলোক কর্নেলের সঙ্গে মৃদুস্বরে কথা বলেছিলেন। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে চুপ করলেন এবং পাইপ ধরাতে মন দিলেন।
জানালার কাছে ডিভানে বসে তাকে লক্ষ্য করতে থাকলুন। মাথার আঁকড়া চুল ঝকমকে সাদা। খাড়া তীক্ষ্ণ নাকের নিচে কাঁচাপাকা ঝাপালো গোঁফে সামরিক অফিসারদের মতো কেতা। পরনে ছাইরঙা টি-শার্ট এবং জিনস। এই বয়সে এ পোশাক দেখে অবশ্য আজকাল অবাক হওয়ার কিছু নেই তবে ইনি ইউরোপীয় নন তা বোঝা যায়। দেহের গড়ন বলিষ্ঠ। সম্ভবত এখনও নিয়মিত শরীরচর্চা করেন। আর গায়ের রঙ ফর্সা হলেও পোড়-খাওয়া ছাপ আছে। ভাবলুম, কর্নেলের পরিচিত কোনো সামরিক অফিসার।
তিনি পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে আমার দিকে তাকালে আমার বৃদ্ধ বন্ধু বলে উঠলেন, আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত! ইনি সেহরাগড়ের নবাব মির্জা হায়দার আলি বেগ।
ভদ্রলোক আমাকে অবাক করে সহাস্যে বাংলায় বললেন, আর যা-ই বলুন, আমাকে নবাব বলে আলাপ করিয়ে দেবেন না কর্নেল সরকার! হ্যাঁ–একথা ঠিক যে, আমার পূর্বপুরুষ নবাবি করেছেন। কিন্তু আমি এখন নিছক মির্জাসাহেব।
কর্নেল বললেন, কিন্তু সেহরাগড়ের লোকেরা এখনও আপনাকে ছোট নবাব বলে। যা-ই হোক, আমার এই তরুণ বন্ধুর নাম জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার বিখ্যাত সাংবাদিক।
মির্জাসাহেব আমাকে করজোড়ে নবস্কার করে বললেন, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল।
আমিও নমস্কার করে বললুম, আপনি চমৎকার বাংলা বলতে পারেন। দেখছি!
পারি। মির্জাসাহেব উজ্জ্বল মুখে বললেন। কারণ আমার ছেলেবেলা থেকে তরুণ বয়স পর্যন্ত কলকাতায় কেটেছে। আমার বয়স যখন মোটে ছবছর, তখন আমার বাবা মির্জা হাসান আলি বেগ মারা যান। তারপর পারিবারিক ঝামেলায় বিপন্ন আমার মা জাহানারা বেগম আমাকে মেটিয়াবুরুজে তাঁর দাদা কাশিম খানের কাছে রেখে যান। মামা ছিলেন নামকরা অ্যাডভোকেট। কংগ্রেস দলে রাজনীতি করতেন। তো আমার পড়াশোনা কলকাতাতেই শুরু হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলুম। পরে সেহরাগড়ে মায়ের কাছে ফিরে যাই। তারপর অবশ্য অ্যামেরিকা–তো সে যা-ই হোক। মনে-মনে আমি সেই যে বাঙালি হয়ে গিয়েছিলুম, এখনও তা-ই আছি। এখনও সেহরাগড়ে আমার বন্ধুরা আমাকে বাঙাল বলে তামাশা করেন।
কর্নেল বললেন, বেগ পদবি শুনে জয়ন্তের মাথায় কোনো প্রশ্ন জাগা উচিত। কারণ সাংবাদিকদের সবজান্তা না হলে চলে না।
বললুম, আমি সাংবাদিক হিসেবে এখনও আনাড়ি। এটা আপনারই কথা কিন্তু!
মির্জাসাহেব হেসে উঠলেন। এই তুর্কি শব্দটা আমাদের বংশের একটুকরো লেজ। আমি প্রাচীন ইতিহাস আর পুরাতত্ত্বের ছাত্র ছিলুম। কিন্তু আমার পক্ষে বলা কঠিন, সত্যিই আমরা পূর্বপুরুষ মধ্য এশিয়ার তুর্কি ছিলেন কি না। তবে হ্যাঁ–বাংলায় তুরুকসোয়ার বলে একটা কথা আছে। কথাটা আসলে সওয়ার। তার মানে, তুর্কিদের ঘোড়ায় চড়ার বাতিক ছিল। সেই বাতিক কিন্তু আমারও আছে।
ষষ্ঠীচরণ কফি আনল। কর্নেল বললেন, আরেক দফা কফিতে আশা করি মির্জা সাহেবের আপত্তি নেই।
মির্জাসাহেব চুপচাপ কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। এবার তাকে একটু অন্যমনস্ক মনে হলো। পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আস্তে বললেন, কফির স্বাদ বছর তিনেক আগেকার সেই জ্যোৎস্নারাতের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। সেহরাগড় ফরেস্ট বাংলোর বারান্দায় বসে এমনি মার্চ মাসে আপনি, আমি আর এমিলি কফি খাচ্ছিলুম। আপনি এমিলিকে জিজ্ঞেস করছিলেন, ভারতীয় জ্যোৎস্নার সঙ্গে অ্যামেকিান জ্যোৎস্নার কোনো তফাত সে অনুভব করছে কি না।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, সেই রাতটার কথা আমার মনে আছে। এখন আপনার সব কথা শোনার পর মনে হচ্ছে, আপনার স্ত্রী এমিলি যেন এ দেশের জ্যোৎস্নার নেশায় পড়েছিলেন।
ঠিক তা-ই। মির্জাসাহেব সহসা যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ওকে প্রায়ই নিষেধ করতুম। এভাবে রাতবিরেতে তুমি ঘোড়ায় চেপে কোথাও ঘোরাঘুরি কোরো না। সে নিষেধ মানত না।
কর্নেল বললেন, অ্যাকসিডেন্টটা আপাতদৃষ্টে স্বাভাবিক মনে হওয়ার কথা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, শিক্ষিত ঘোড়ার পক্ষে এ ধরনের অ্যাকসিডেন্ট বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায় ছোটাছুটি করার অভ্যাস যার ছিল–
মির্জাসাহেব কর্নেলের কথার ওপর বললেন, ঠিক এই কথাটাই আপনাকে বলতে চাইছিলুম। রাস্তাটা পাথুরে হলেও মোটামুটি সমতল। বাঁদিকে হঠাৎ তার সরে আসার কারণ কী? বাঁদিকে তিনশো ফুট গভীর খাদ। ডাইনে যথেষ্ট জায়গা ছিল। অথচ সে বাঁদিকে সরে এসে গতির মুখে টাল সামলাতে না পেরে খাদে পড়ে গেল। হতভাগিনী এমিলির লাশের ফুট বিশেক ওপরে পড়ে ছিল ঘোড়াটা। তাকে মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়ে আমি গুলি করেছিলুম।
কর্নেল বললেন, আপনি তো রাস্তাটা পরীক্ষা করেছিলেন?
হ্যাঁ। কিন্তু ঘোড়াটা সোজা ছুটতে ছুটতে কেন বাঁদিকে সরে এসেছিল বুঝতে পারিনি।
সেহরাগড় অঞ্চলে তখন একটা মানুষখেকো নেকড়ের উৎপাত চলছিল। তাই না?
মির্জাসাহেব একটু চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু নেকড়েটা বয়স্ক মানুষ বা তার চেয়ে আকারে বড় কোনো জন্তুকে আক্রমণ করেনি। রাতদুপুরে চুপিচুপি হানা দিয়ে ঘুমন্ত শিশুকে তুলে নিয়ে গেছে। অনেক শিকারি তাকে মারবার চেষ্টা করেছেন। আমিও করেছিলুম। কিন্তু তার পাত্তা মেলেনি।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, এমন কি হতে পারে না যে, সেই নেকড়েটাকে হঠাৎ দেখে আপনার স্ত্রীর ঘোড়া ভয় পেয়েছিল?
মির্জাসাহেব আস্তে বললেন, সেদিন বিকেলে কিছুক্ষণ ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। রাতে আকাশ পরিষ্কার ছিল। জ্যোৎস্না ছিল। তাছাড়া অ্যাকসিডেন্টের জায়গাটা ছিল খোলামেলা। নেকড়ের মতো একটা খুদে জানোয়ার দেখে টনির ভয় পাওয়ার কথা নয়। সকালে আমি তন্নতন্ন খুঁজে ওখানে কোনো জানোয়ারের পায়ের চিহ্ন পাইনি।
কর্নেল বললেন, এবার বলুন পোস্টম্যান লছমনের কথা। সে নাকি নেকড়েটা দেখেছিল?
লছমন সিং সম্পর্কে আপনাকে বলেছি। সে সাহসী লোক। সাইকেলে চেপে দেহাতে চিঠি বিলি করে বেড়ায়। গত মাসে একদিন সে হরিপুরা থেকে বাড়ি ফিরছিল। পাহাড়ি শীত কী সাংঘাতিক তা আপনি জানেন। সন্ধ্যার আগেই সে বাড়ি ফেরার জন্য শর্টকাট করেছিল। হঠাৎ নাকি সে নেকড়টাকে দেখতে পায়। তার দিকে পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে হইহল্লা শুরু করে। তাই শুনে আদিবাসীরা দৌড়ে আসে। তবে তারা নেকড়টাকে দেখতে পায়নি। এখন লছমন আমাকে বলেছে, নেকড়েটার গায়ের রঙ নাকি কালো।
কালো নেকড়ে?
মির্জাসাহেব হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আমি ওকে বললুম, তুমি আসলে ভালুক দেখেছ। কিন্তু সে জোর গলায় বলল, ভালুক নয়। সে বনজঙ্গল এলাকার লোক। ভালুক সে চেনে। কিন্তু সেই জন্তুটা অবিকল প্রকাণ্ড একটা কুকুরের মতো। প্রথমে সে ভেবেছিল, জন্তুটা একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর। সেহরাগড়ে অনেকের বাড়িতে এই কুকুর আছে। হয়তো একটা কুকুর বাড়ি থেকে এতদূরে চলে এসেছে। কিন্তু সে পাথর ছুঁড়লে কালো জন্তুটা দাঁত বের করে গর্জন করছিল। তার পায়ের বড়বড় নখও দেখতে পেয়েছিল লছমন। আমার মতে, ওটা তার মনগড়া ধারণা।
কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সাংবাদিকদের নিশ্চয় জানা কথা। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ যেসব নেকড়েকে গৃহপালিত জীবে পরিণত করেছিল, তাদেরই বংশধরকে আমরা কুকুর বলি।
ওঁর কৌতুকে কান না করে বললুম, আপনিই বলেন, প্রকৃতিতে রহস্যের কোনো সীমা নেই। কাজেই কালো নেকড়েও থাকতে পারে। সেই কালো নেকড়েকে হঠাৎ দেখে মির্জাসাহেবের স্ত্রীর ঘোড়া ভয় পেতেও পারে।
মির্জাসাহেব চমকে উঠে আমার দিকে ঘুরে বসলেন। মিঃ চৌধুরিকে ধন্যবাদ। এই পয়েন্টটা আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু তাহলে তার পায়ের ছাপ খুঁজে পাইনি কেন কে জানে!
কর্নেল বললেন, আচ্ছা মির্জাসাহেব, অ্যাকসিডেন্টের জায়গা থেকে আপনার খুড়তুতো দাদার ফার্মহাউস কতদূরে?
বেশি দূরে নয়। হাফ কিলোমিটারের মধ্যেই।
আপনি কি কখনও সেই ফার্মহাউসে গেছেন?
মির্জাসাহেব জোরে মাথা নেড়ে বললেন, আমার সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আপনাকে বলেছি, আমার চাচা মির্জা আব্বাস আলি বেগের ফ্যামিলির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। চাচা আমার মাকে প্রচণ্ড অপমান করেছিলেন। চাচা মারা গেছেন প্রায় দশ বছর আগে। তার দুই ছেলে সালিম এবং কলিম। সালিমের এগ্রিকালচারে একটা ডিগ্রি আছে। সে তার বাবার মতোই উদ্ধত স্বভাবের লোক। তার ফার্মহাউসের আনাচে-কানাচে কেউ যেতে সাহস পায় না। কলিম অবশ্য ভদ্র। তার ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে সালিম কিন্তু তাকেও প্রপার্টির ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করেছে।
কলিমসাহেব কী করেন?
সে সেহরাগড়ের নামকরা ডাক্তার। আমাকে দেখলে কথা বলার চেষ্টা করে। সে। কিন্তু আমি এড়িয়ে থাকি।
বাই এনি চান্স, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ওঁদের দু ভাইয়ের কি কখনও আলাপ হয়েছিল?
মির্জাসাহেব একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, এমিলি কলিমের খুব প্রশংসা করত। আর–এমিলি একদিন রাত্রে বলেছিল, সালিম তার সঙ্গে যেচে পড়ে আলাপ করেছে এবং তার ফার্মহাউসে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমি এমিলিকে ওদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতার সব ঘটনা খুলে বলেছিলুম। তাই এমিলি সালিমকে এড়িয়ে চলত।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট অ্যাশট্রেতে রেখে বললেন, ফার্মহাউসের জমি কতখানি?
শুনেছি প্রায় পঞ্চাশ একর। ওই জমিতে আমারও কিছু অংশ আছে। মানে রেকর্ড অনুসারে আছে। কিন্তু আমি মামলা-মোকদ্দমা একেবারে পছন্দ করি না। বলে মির্জাসাহেব একটু নড়ে বসলেন। হ্যাঁ–আপনাকে বলা উচিত কথাটা। আমার শ্যালক গ্যারি কোহেন বছর দুই আগে বোনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। গ্যারির হবি বুনো জানোয়ারের ছবি তোলা। আমার এবং এমিলির অজ্ঞাতসারে সে সালিমের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছিল। ফার্মহাউসেও গিয়েছিল। কথাটা জানতে পেরে এমিলি তাকে বকাবকি করেছিল। কিন্তু গ্যারি বোনকে গ্রাহ্যই করেনি।
জিজ্ঞেস করলুম, আপনার স্ত্রীকে কি আপনি ধর্মান্তরিত করেননি?
মির্জাসাহেব পাইপের ছাই ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বললেন, করিনি। আসলে ইসলাম ধর্মের বিধানে আছে, কোনো মুসলিম যদি ইহুদি বা খ্রিস্টান মেয়ে বিয়ে করেন, তাহলে স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত না করলেও চলে। কারণ এই দুই ধর্মের প্রফেটরা মুসলিমদেরও শ্রদ্ধেয় প্রফেট।
এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন, ইয়া! জাস্ট এ মিনিট। প্লিজ হোল্ড অন।
তিনি মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে বললেন, এক মহিলা জানতে চাইছেন মির্জাসাহেব এখানে আছেন কি না!
মির্জাসাহেব রিসিভার নিয়ে সাড়া দিলেন। রোজি?….হোয়াট?….ওকে। আই অ্যাম গোয়িং। ডোন্ট বি ওয়ারিড!
টেলিফোন রেখে তিনি বললেন, আমার মামাতো বোন রোজি মেটিয়াবুরুজ থেকে ফোন করে জানাল, সেহরাগড় থেকে জরুরি খবর এসেছে। আমাদের একজন ওল্ড সারভ্যান্ট কাদের বখশকে গতকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। না। আমি উঠছি কর্নেল সরকার! আপনাকে যা বলার সবই বলেছি। আমি আপনার প্রতীক্ষায় থাকব। মিঃ চৌধুরিকেও সঙ্গে নিয়ে গেলে খুশি হব। আচ্ছা, চলি!
করজোড়ে নমস্কার করে মির্জাসাহেব দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল স্বগতোক্তি করলেন, মির্জাসাহেব আমার কাছে আসার সময় তাঁর মামাতো বোনকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছিলেন। তার মানে, উনি সেহরাগড়ে ওঁর বাড়ি বা লোকজন সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এমন কি, সম্ভবত নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারটাও তার মাথায় ছিল।
বললুম, মির্জাসাহেবের কেসটা কী?
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমার কাছে সবটা স্পষ্ট হয়নি। শুধু এটুকু বুঝেছি, সেহরাগড়ে ওঁকে কেন্দ্র করে রহস্যময় কিছু ঘটনা ঘটছে।
অতএব আপনি যাচ্ছেন!
তুমিও যাচ্ছ। মির্জাসাহেব তোমাকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন।
আমি–
আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, এই বসন্তকালে সেহরাগড় বিশেষ করে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে সংরক্ষিত অরণ্য এলকা মর্তে স্বর্গ হয়ে উঠেছে। এই সুযোগে দ্বিতীয়বার সেহরাগড় দর্শনের লোভ সম্বরণ করা আমার পক্ষে কঠিন।
কিন্তু আপনার কেসটা তো নবাববাড়ির।
তা ঠিক। বছর তিনেক আগে ওই জঙ্গলে গিয়ে মির্জাসাহেব এবং তার মার্কিন স্ত্রী এমিলির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার কেন যেন ধারণা হয়েছিল, ওঁদের দাম্পত্যজীবনে স্বাভাবিকতার লেশমাত্র নেই। ব্যাপারটা আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। এটুকু বলতে পারি, আমার মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগেছিল। ওঁরা কি কোনো গোপন ব্যাপারের চুড়ান্ত বোঝাপড়া করতেই নির্জন জঙ্গলে এসেছেন? সম্ভবত আমি হঠাৎ গিয়ে পড়ায় সেটা ওঁদের পক্ষে আর হয়ে ওঠেনি।
তা হলে বলুন দুজনের মধ্যে সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিল?
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, নাহ্। অতটা নয়।
আচ্ছা কর্নেল, মির্জাসাহেবের সঙ্গে আপনার কি তার আগে থেকে পরিচয় ছিল?
হ্যাঁ। মির্জা হায়দার আলি বেগ প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের এক উদ্যোক্তা। নৈনিতালের প্রকৃতি-পরিবেশ সংক্রান্ত একটা কনফারেন্সে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তখন অবশ্য এমিলি ওঁর সঙ্গে ছিলেন না।
আপনি সেহরাগড়ে ওঁর বাড়িতে কি গিয়েছিলেন?
না। আমন্ত্রণ পেয়েও যাওয়া হয়নি। তবে এটুকু জানি, নবাব পরিবারের বাড়িটা আসল একটা কেল্লাবাড়ি। ইংরেজিতে যাকে ক্যা বলা হয়। আর বাড়িটার নাম কালামহল।
অদ্ভুত নাম তো!
আসলে কালা পাথরের পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। মোগল আমলে ওঁদের প্রাসাদটাও ছিল কালো পাথরে তৈরি। শুনেছিলুম, সেই প্রাসাদটা এখন ধ্বংসস্তূপ।
এই সময় ডোরবেল বেজে উঠল। একটু পরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার–আমাদের প্রিয় হালদারমশাই ঘরে ঢুকে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে এক টিপ নস্যি নিলেন। তাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, শরীর খারাপ নাকি হালদারমশাই?
প্রাক্তন পুলিশ অফিসার যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটু হাসলেন। না কর্নেলস্যার! শরীর ঠিক আছে। মনের অবস্থা ঠিক না। যদি জিগান, ক্যান? আমি কইব, ক্লায়েন্ট যদি তঞ্চকতা করে, তাহলে আমার প্রফেশন চলবে ক্যামনে?
ব্যাপারটা খুলে বলুন। শোনা যাক। বলে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ আমার দিকে ঘুরে বললেন, জয়ন্তবাবুও শোনেন। মশাই! আপনারা–মানে কাগজের লোকেরা মাঝে মাঝে কী সব ঝামেলা বাধান!
বললুম, কী ঝামেলা বলুন তো?
হালদারমশাই তার লম্বা তর্জনী আমার দিকে তাক করে কর্নেলের উদ্দেশে বললেন, আচ্ছা! কন তো কর্নেলস্যার! উলফ কি কখনও ব্ল্যাক হয়? জয়ন্তবাবুরা কাগজে লিখছেলেন, কোথায় একটা ব্ল্যাক উল উৎপাত বাধাইছে।
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। এরকম একটা খবর কমাস আগে সব কাগজে বেরিয়েছিল বটে!
বললুম, সে কী! আমার তো চোখে পড়েনি!
বলেই অবাক হয়ে গেলুম। আশ্চর্য! এই তো কিছুক্ষণ আগে সেহরাগড়ের মির্জাসাহেব কালো নেকড়ের কথা বলে গেলেন। তা হলে কর্নেল আগে থেকেই ওই খবরটা জানতেন! তা ছাড়া আমি আসার আগে মির্জাসাহেবের সঙ্গে নিশ্চয় তা নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে।
উত্তেজিত হালদারমশাই বললেন, কিন্তু আমার ঝামেলাটা শোনেন। গত সপ্তাহে একটা ইংরেজি কাগজে আমার ডিটেকটিভ এজেন্সির বিজ্ঞাপন দিছিলাম। দুদিন পরে আমার অফিসে এক মহিলা টেলিফোন করলেন। বাঙালি না। বাঙালি মহিলাদের ইংলিশ প্রনানশিয়েশন আমি আইডেন্টিফাই করতে পারি। তা শোনেন।
এরপর প্রাইভেট ডিটেকটিভ যে ঘটনা শোনালেন, তা এই :
এক অবাঙালি মহিলা হালদারমশাইকে টেলিফোনে বলেন, খবরের কাগজে বিহারের সেহরাগড় জঙ্গল এলাকায় যে কালো নেকড়ের উৎপাতের খবর বেরিয়েছে তা নিশ্চয় ডিটেকটিভদ্রলোক দেখেছেন। না দেখে থাকলে লোক মারফত সেই খবরের কাটিং তিনি পাঠিয়ে দেবেন। মিঃ হালদার যার কালো নেকড়েটাকে ধরে দিতে পারেন, তা হলে তাকে দশ হাজার টাকা বখশিস দেওয়া হবে! হালদারমশাই খুব অবাক হয়ে যান। তিনি বলেন, এ কাজটা শিকারিদের। তিনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তখন সেই মহিলা বলেন, না! কালো নেকড়ের মধ্যে একটা রহস্য আছে। ওটা সম্ভবত নেকড়ে নয়। যাই হোক, সেদিন বিকেলে পাঁচটা নাগাদ হালদারমশাই যেন মেট্রো সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভদ্রমহিলা তাঁকে এক হাজার টাকা অগ্রিম দেবেন। ইতিমধ্যে তার লোক খবরের কাগজের কাটিং তাকে অফিসে পৌঁছে দেবেন। আশ্চর্য ব্যাপার, লোকটা সেদিন এল না। কিন্তু ডিটেকটিভ এসেন্সির অফিসের লেটারবক্সে হালদারমশাই কাটিংটা পেয়ে গেলেন। তারপর বিকেল পাঁচটায় যথারীতি তিনি মেট্রো সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে তার মক্কেলের অপেক্ষা করেন। অধৈর্য হয়ে ঘণ্টাটাক প্রতীক্ষার পর একটা বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা লোক এসে তাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করে, তিনি মিঃ হালদার কি না। হালদারমশাই সেই মহিলাকে নিজের চেহারা এবং বিশেষ করে ঘন ঘন নস্যি নেওয়ার ব্যাপারটা জানিয়ে রেখেছিলেন। হালদারমশাই লোকটাকে বলেন, ম্যাডাম কোথায়? লোকটা বলে, ম্যাডাম আসতে পারেননি। মিঃ হালদারকে কষ্ট করে তার সঙ্গে ওঁর বাড়িতে যেতে হবে। ম্যাডাম কাছেই থাকেন। সদর স্ট্রিট এলাকায় একটা গলির ভেতর পুরনো একটা বাড়ির সামনে হালদারমশাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে লোকটা ভেতরে যায়। তারপর আর সে ফিরে আসেনি। আরও একঘণ্টা প্রতীক্ষার পর তিনি পাশের একটা পান-সিগারেটের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, বাড়িটাতে যারা বাস করে, তারা খারাপ মেয়ে। অর্থাৎ আসলে ওটা একটা হোরহাউস। দোকানদার মুচকি হেসে অবশ্য বলেছিল, এই খানকিমহলে ঢোকার ইচ্ছে থাকলে বাবুসাহেব তাকে কুড়ি টাকা দিন। কথাটা শুলে হালদারমশাই সেখান থেকে কেটে পড়েন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, আবার গতকাল দুপুরে সেই মহিলা টেলিফোন করেছিলেন। রাগ করে হালদারমশাই তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবার হুমকি দিয়ে ফোন রেখে দেন। তারপর আর ফোন আসেনি।
সবটা শোনার পর কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন, আমরা সেহরাগড়ে বেড়াতে যাচ্ছি। হালদারমশাই ইচ্ছে করলে আমাদের সঙ্গী হতে পারেন। কালো নেকড়ের ব্যাপারটা সত্যি রহস্যময়।
হালদারমশাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ নড়ে উঠলেন। বললেন, দেন আই মাস্ট গো দেয়ার।…
.