কালোচিতার ফটোগ্রাফ – ৫

একটু বাদেই মিলিটারি কনভয়টা নিচে নেমে গেল। মাথা নিচু করে বসে রইল প্রদীপ। তারপর আর-একটু এগিয়ে গেল। এখন সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে চারজনকে। যে লোকটা অস্ত্র দুটো বরফের নিচে লুকিয়ে এসেছিল সে ওগুলো ফিরিয়ে আনল। এই নিয়ে নিজেরা বেশ হাসাহাসি করল। সম্ভবত মিলিটারিদের বোকা বানানোর আনন্দে।

ওদের একজন ঘড়ি দেখে কী বলতেই এবার জিপে উঠে বসল সবাই। জিপটা উঠে গেল ওপরে। মিনিট তিনেক বাদে অনেক দূরের রাস্তায় জিপটাকে দেখতে পেল। যদি পথে কাউকে নামিয়ে দিয়ে না যায় তাহলে আপাতত কোনও বিপদ নেই।

নামতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। শেষ ধাপে ব্যালেন্স না রাখতে পেরে প্রায় আছাড় খেয়ে রাস্তায় পড়ল প্রদীপ। কনুই এবং হাঁটুতে বেশ চোট খেল সে। উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিল। ফিরে যেতে হলে তাকে বাইকটার কাছে পৌঁছাতে হবে। ততক্ষণ শরীরটাকে যে করেই হোক নিটোল রাখা দরকার। পিস্তলটা ভালো করে দেখে হাতে নিয়ে ও এগোতে লাগল। জিপটায় এই মুহূর্তে কোনও আরোহী আছে কি না এতদূর থেকে দেখতে পায়নি সে। অতএব বিপদ যে-কোনও সময় ঘটতে পারে।

শেষপর্যন্ত তিনটে নিষ্পত্র গাছকে পাশাপাশি নিবিড়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল সে। তিনটে গাছ। লোকটা বলেছিল তিন ভাই। কিন্তু প্রদীপের মনে হল তিন নিঃসঙ্গ বুড়ি। রাস্তাটা এখানে ঘোড়ার নালের মতো বাঁক নিয়েছে। গাছদুটো তার ঠিক মাঝখানে। এখানে এসেই ট্যুরিস্টবাসের যাত্রীরা হত্যাকাণ্ড দেখেছিল। তিন ফটোগ্রাফার এখানেই ছবি তুলতে পেরেছিল। ব্যাপারটা সঠিক কি না বোঝা যাবে নিহত লোকটির মৃতদেহ গাছের পাশে খুঁজে পেলে। কিন্তু গাছটা যদি মঞ্চ হয় তাহলে ছবি তোলার পক্ষে যুৎসই।

প্রদীপ রাস্তা ছেড়ে পাশের একটু সমান জায়গায় উঠে গেল যেখানে তিনটে গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বরফে চারপাশে ঢাকা। এসব অঞ্চলে হয়তো খুব কম সময় আসে যখন বরফ পড়ে না। প্রদীপ চারপাশে তাকাল। ঠিক কোন জায়গায় মৃতদেহ রয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না। পরশুর ঘটনার পরে অনেক বরফ জমেছে এখানে। লোকটা বলেছিল, তিনটে গাছের পাশে ওরা বরফ চাপা দিয়েছিল মৃতদেহটাকে। কয়েকমাস ওভাবেই থেকে যাবে যতক্ষণ না বরফ গলে যায়। প্রদীপ পা দিয়ে বরফ সরাতে লাগল। মিনিট দশেক চেষ্টার পর আচমকা শক্ত কিছু পায়ের নিচে পড়ায় সে ধীরে-ধীরে পা সরাল। শার্ট পরা একটা হাত বেরিয়ে এসেছে বরফ থেকে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মানুষটাকে বের করে আনতে পারল প্রদীপ। বছর পঁচিশের একটি যুবক। বুকে গুলি লেগেছিল। মোক্ষম একটা গুলি। বরফের নিচে থাকায় শরীরে বিকৃতি আসেনি একটুও। সময় নষ্ট না করে প্রদীপ ওর পকেটে হাত দিল। বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে ও রুমাল, চিরুনি এবং পার্স বের করল। পার্সের ভাঁজ খুলতেই ছেলেটির ছবি একপাশে, অন্যপাশে সুন্দর হাতের লেখায় নাম-ঠিকানা লেখা কার্ড। দিলবাহাদুর। সেবক রোড, শিলিগুড়ি। পার্সের ভেতর শচারেক টাকা এবং একটা চিঠি। চিঠিটা কোমল নামের একটি মেয়ের লেখা। লিখেছে এই দিলবাহাদুরকেই। চোখ বোলাল প্রদীপ। বাবার নামে অনেক অভিযোগ করে কোমল লিখেছে তাকে উদ্ধার করতে। সে যেমন করেই হোক তিস্তাবাজারে গিয়ে দিলবাহাদুরের জন্যে অপেক্ষা করবে। দিলবাহাদুর তাকে নিয়ে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে, তার কোনও আপত্তি নেই। তবে আসার আগে দিলবাহাদুর যেন মনে রাখে পৃথিবীতে তার বাবার মতো নৃশংস মানুষ আর কেউ নেই। এখন তার ভালোবাসা আর বাবার প্রতি ভয়, এদুটো সম্পর্কে মন ঠিক করে নিক সে। তিস্তাবাজারে যদি সন্ধে নামে তা হলে ব্রিজের ওপর থেকে সে ঠিক জলে ঝাঁপ দেবে।

জিনিসগুলো পকেটে রাখার সময় প্রদীপ দিলবাহাদুরের গলায় হারটাকে দেখতে পেল। লকেট সমেত রুপোর হার। কোনওমতে মাথা দিয়ে বের করে নিল সে। এবার কী করা যায়? এই ছেলেটাকে আবার বরফ চাপা দিয়ে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। সে মৃতদেহ টানতে-টানতে রাস্তার মাঝখানে নিয়ে এল। যে-কোনও গাড়ি এই পথে গেলে দিলবাহাদুরের জন্যে থামতে বাধ্য।

এই সময় ওপর থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে এল। প্রদীপ ছুটল। যতটা পারে নিচে গিয়ে যখন ওপরে ওঠার কোনও সম্ভাবনা দেখতে পেল না তখন খাদের দিকে তাকাল। এবং তখনই চোখে পড়ল রাস্তার ঠিক নিচে চমৎকার একটা আড়াল তৈরি করেছে বরফের স্তূপ। মুখ বের করা একটি পাথরকে সর্বাঙ্গে ঢেকে ফেলেছে বরফ। প্রদীপ সন্তর্পণে পা ফেলে-ফেলে সেই স্তূপের পেছনে গিয়ে লুকোল। তার সামনে রাস্তা। অদূরে ছেলেটির মৃতদেহ পড়ে আছে। আর তার পেছনে কয়েক হাজার ফুট খাদ। একটু পা পিছলে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সামনের বরফের ওপর চাপ দিতে গিয়ে সামলে নিল সে। বরফের স্তূপটা যেন দুলে উঠল। নিচের পাথর অবশ্যই আলগা রয়েছে।

ওপর থেকে জিপটা ফিরে আসছিল হতাশ হয়ে। রাস্তার ওপর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে ড্রাইভার ব্রেক চাপল। ওরা যেন নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ঠিক তখনই নিচ থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে এল। কোনও ভারী গাড়ি উঠে আসছে।

ইতিমধ্যে দুজন লোক নেমে পড়েছে জিপ থেকে। তাদের একজনের হাতে অস্ত্র রয়েছে। ওরা মৃতদেহটা খুঁজে দেখল। ওদের একটু ধাঁধায় ফেলার জন্যে প্রদীপ উপুড় করে রেখে এসেছিল মৃতদেহটাকে। যে লোকটির হাতে অস্ত্র সেই সে পা দিয়ে ছেলেটাকে চিৎ করে দিল। দিয়েই চিৎকার করল, ‘একে এখানে কে আনল?’

জিপ থেকে একজন জানতে চাইল, ‘কে?’

‘ছানু যাকে মেরেছে। সেপাইটা বলেছিল বডি হাফিস করে দিয়েছে।’

‘যাওয়ার সময় ছিল না, এখন যখন আছে, তখন কেউ ওটাকে টেনে এনেছে।’

‘কে এনেছে তা বুঝতে পারছি কিন্তু সেই মালটা কোথায়? বাইকের আওয়াজ আমি একবারের জন্যেও পাইনি।’

‘আমি তোকে বলছি ও আমাদের বোকা বানাবার জন্যে হেঁটে এসেছে। লোকটাকে খাদে ফেলে দে। নিচ থেকে গাড়ি আসছে। কুইক।’

কিন্তু গাড়িটা ততক্ষণে কাছাকাছি চলে এসেছে। সেটা বুঝতে পেরে লোকদুটো দৌড়ে জিপের ভেতর উঠে বসল। জিপটা ব্যাক করার সুযোগ পেল না, একটা ট্যুরিস্টবাস বাঁকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। খানিকটা এগোতেই মৃতদেহ দেখতে পেল ড্রাইভার। সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে দিল সে।

বাসের যাত্রীরা মৃতদেহ রাস্তার ওপর পড়ে আছে দেখে কলবল করতে লাগল। ড্রাইভার চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, ‘খুন?’

জিপের একজন জবাব দিল, ‘তাইতো মনে হচ্ছে।’

‘তাহলে পুলিশকে খবর দিতে হয়’, ড্রাইভার চেঁচিয়ে উঠল।

‘ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। যাওয়ার পথে আমরাই দিয়ে যাব।’

মাইক হাতে নিয়ে গাইড বলল, ‘ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহিলাগণ। আমি খুব দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সামনের রাস্তায় একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। সেটা না সরালে আমরা এগোতে পারব না।’

ঘোষণা শেষ হওয়া মাত্রই হুড়মুড় করে যাত্রীরা নিচে নামতে লাগল। বরফের মধ্যে পা রাখার মজার সঙ্গে সামনে মৃতদেহ পড়ে থাকার আতঙ্ক মিশে থাকায় ওরা ঠিক কী করবে বুঝতে পারছিল না। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে জনা পনেরো মানুষ মৃতদেহটি দেখতে লাগল।

প্রদীপ সুজাতাকে দেখতে পেল। মেয়েটা তার কথামতো চলে এসেছে। এখন ওই ভিড়ের একজন হয়ে মৃতদেহ দেখছে। ওর কয়েক হাতের মধ্যে সে রয়েছে অথচ—। হঠাৎ জিপ থেকে নেমে দুটো লোক এগিয়ে এল। চিৎকার করে সবাইকে সরে যেতে বলল। তারপর দুজন মৃত লোকটির পোশাক ধরে টানতে-টানতে রাস্তায় একপাশে সরিয়ে দিল। যেন আপদ গেল এই রকম ভঙ্গিতে ওরা জিপে ফিরে গিয়ে হর্ন বাজাল। ট্যুরিস্টদের জটলা ভেঙে পথ করে দিতেই জিপটা স্টার্ট নিয়ে নিচের দিকে চলে গেল। প্রদীপ দেখল এবার গাইড মাইকে ট্যুরিস্টদের বাসে উঠে আসতে অনুরোধ করছে। এই সুযোগে ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে সে বাসের যাত্রীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। কিন্তু ওরা যাবে আরও ওপরে। সেখানে দ্রষ্টব্য জিনিস দেখিয়ে ফিরে আসবে বেশ কিছুটা সময় পরে। অতএব বাসটাকে চলে যেতে দিল প্রদীপ। সুজাতাকে নিজের অস্তিত্ব জানাবার কোনও সুযোগই পেল না।

একটু আগে যে জায়গাটা ছিল মানুষের ভিড়ে ভর্তি এখন সেখানে হাওয়ার শব্দ ছাড়া কিছু নেই। প্রদীপ ধীরে-ধীরে ওপরে উঠে আসতেই পাথরটা খুব জোরে নড়ে উঠে একপাশে কাৎ হতে-হতে থেকে গেল। এবার যদি কেউ ওর নিচে আশ্রয় নিতে চায় তাহলে তার ভাগ্য প্রসন্ন হবে না।

রাস্তায় উঠে এল সে। ধীরে-ধীরে দিলবাহাদুরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। খুব বিশ্রীভাবে শুইয়ে দিয়ে গেছে ওরা ওকে; প্রদীপ মাথাটা ঠিক করে দিল। তারপর জোরে হাঁটতে শুরু করল। এবার পায়ে একটা ব্যথা টের পেল সে। হাঁটতে গেলেই লাগছে, তবে তেমন তীব্র নয়।

ঠিক যেখান দিয়ে প্রদীপ নিচের রাস্তায় নেমে এসেছিল সেখানে পৌঁছে ওপরে তাকাল। দার্জিলিং-এর লেবং রেসকোর্সে যাওয়ার পথে পাহাড়-চড়িয়েদের শেখানোর জন্যে যে খাড়াই পাথরটা রয়েছে তার থেকেও এটাকে ভয়ঙ্কর বলে মনে হল। যে সোজা পথটা সামনে রয়েছে তা ব্যবহার করলে পুলিশ ফাঁড়ি ঘুরে যেতে হবে। এবং সেটা করতে হলে জিপের চারজন তাদের ভালোবাসা জানাবে। প্রদীপ সামান্য এগোল। তারপর ধীরে-ধীরে ওঠার চেষ্টা করল। বরফের নরম চাঁই খসে পড়ায় পা হড়কাতে-হড়কাতে কোনওমতে রক্ষে পেল।

প্রদীপ যখন কিছুটা সমান জায়গায় উঠে আসতে পারল তখন এই ঠান্ডাতেও তার সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গেছে। সেই ঘামে বাতাস লাগামাত্রই শরীর কনকন করে উঠল। চুপচাপ মিনিট পাঁচেক বসে থাকল সে। এই শূন্য চরাচরে, মাথার ওপর ঘোলাটে আকাশ আর চারপাশে বরফ আর বরফ, অদ্ভুত নিঃসঙ্গ বলে মনে হয় নিজেকে। কিন্তু মানুষ রয়েছে তার সন্ধানে। প্রদীপ উঠে দাঁড়াল।

বাইকটাকে যেখানে লুকিয়ে রেখেছিল সেখানে পৌঁছেও মনে হল চারপাশ সুনসান। কোথাও কোনও মানুষ নেই। তার পকেটে এখন দিলবাহাদুরের ব্যবহার করা কিছু জিনিস আর কোমল নামের একটি মেয়ের লেখা চিঠি। কে এই কোমল যাকে ভালোবেসে দিলবাহাদুরকে প্রাণ হারাতে হল? এখন একথা স্পষ্ট যে দার্জিলিং-এর ভদ্রলোক চাননি দিলবাহাদুর বেঁচে থাকুক। এবং তিনি এও চাননি যে তার হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য কোনও ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় ধরা থাক। প্রদীপের মনে হল সে বিশাল ভুল করে ফেলেছে। কোথায় কে কাকে হত্যা করেছে, তার ফটোগ্রাফ কে তুলল এই নিয়ে ভদ্রলোক বিব্রত হবেন এমন নাও হতে পারে। ফটো তোলার সময় যদি কোমলকেও ওখানে দেখা যায় তা উনি বরদাস্ত করতে পারেন না। ব্ল্যাক লেপার্ডের মেটিং মানে কি কোমল আর দিল বাহাদুরের প্রেম? তা হলে এই কোমল কে? দিলবাহাদুরকে কোমল লিখেছে যে তার বাবার মতো নৃশংস মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তা হলে কি কোমল দার্জিলিং-এর শ্রদ্ধেয় ভদ্রলোকের মেয়ে? দার্জিলিং-এর মেয়ে হলে সে কোনওদিন তাকে দেখেনি কেন? অথবা দেখলে চিনতে পারবে, নামে বুঝতে পারছে না।

দ্বিতীয়ত, ওরা এখানে ডেরা বেঁধেছে কেন? এখানে আসার সময় জিপের চাকাকে রাস্তা থেকে নেমে যেতে দেখেছে সে। সেই জিপটাই এই জিপ এমন নাও হতে পারে, আবার হতেও পারে। ওই নেমে যাওয়া রাস্তার কোনও এক জায়গায় কি ওদের আস্তানা? প্রদীপের মনে হল এ ব্যাপারে রাই তাকে সঠিক খবর দিতে পারে। অন্তত এই অঞ্চলের ভূগোলটা ওর জানা। ওই আস্তানায় তাকে একবার যেতেই হবে। কিন্তু হাতে সময় বড় কম। ট্যুরিস্ট বাস যখন ফিরে যাবে তখন সুজাতার সঙ্গে তার দেখা করার কথা। রাইকেও সে ওই বাসে ফিরে যেতে বলেছে। তাছাড়া সন্ধে নামলে এই খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা মানে আত্মহত্যা করা। পুলিশ ফাঁড়ি ছাড়া আশ্রয় নেওয়ার কোনও জায়গা তার জানা নেই। কিন্তু সেখানে এখন কী অবস্থা চলছে তা ঈশ্বর জানেন।

প্রদীপ ওপরে উঠছিল। এই পথটা, অবশ্য পথ করে নেওয়া পথ তেমন কষ্টকর নয়। বেশ দ্রুতই সে ওপরে উঠতে পারছিল। এবার হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে সে অনেক নিচে বাস-রাস্তাটাকে দেখতে পেল। ওখান দিয়ে কেউ গেলে তাকে কতটা বড় দেখতে পাবে তা বোঝা মুশকিল। একটা টিলার আড়াল সামনে। ওটার পাশ কাটিয়ে গেলেই সম্ভবত এক নম্বর গুহাটার কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে। টিলার আড়ালে এসে কয়েক পা ওপরে উঠতেই দাঁড়িয়ে পড়ল প্রদীপ। পাহাড়টাকে এখনও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মাত্র কয়েক হাত দূরে বরফের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা মৃতদেহটি যে রাই ছাড়া আর কারও নয় এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। ওর একটা হাতে তখনও নিয়ে আসা জিনিসগুলো রয়েছে। শরীরের পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়েছিল। মুখের ওপর ইতিমধ্যেই তুষার পড়তে শুরু করেছে।

আততায়ী ওপরে আছে। ওপর থেকে গুলি ছুড়ে রাইকে মারা হয়েছে। যে গুলির শব্দ তার কানে এসেছিল সেটা রাই-এর জন্যে ছোড়া হয়েছিল। আততায়ীর বন্দুকের হাত যে নিপুণ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রাই-এর জন্যে একটির বেশি গুলি ছোড়ার প্রয়োজন হয়নি।

এবং লোকটা নিশ্চয়ই ওপরে আছে। কে ওই লোকটা? যারা তার খোঁজে জিপে করে ঘুরছে তাদের কেউ অবশ্যই নয়। তাদের দলের কেউ? তা হলে ওদের সংখ্যা আপাতত পাঁচ? ওই লোকটা অত ওপরে উঠে বসে আছে কেন? এক নম্বর গুহাটা কি ইতিমধ্যে দখল হয়ে গেছে যা রাই জানত না? প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর প্রদীপের জানা নেই। কিন্তু এই আড়াল ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি সে নিতে পারছিল না। এখান থেকে নিচে নামতে অসুবিধে হবে না কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না। প্রদীপ ধীরে-ধীরে টিলার শেষ আড়ালে চলে এল। শরীরটাকে যতখানি সম্ভব বের না করে সে সামনে তাকাল। পাহাড়টাকে দেখতে পাচ্ছে সে। বাতাসের বিপরীত দিকে বলেই সম্ভবত বরফ তেমনভাবে জমেনি এপাশে। টিলা থেকে পাহাড়ের দূরত্ব অন্তত একশো গজ। আততায়ীর হাতে নিশ্চয়ই শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। সে কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ করেও কোনও মানুষের অস্তিত্ব ওখানে খুঁজে পেল না। অথচ কেউ একজন ওখানে অস্ত্র হাতে অপেক্ষা করছে। এই একশো গজ পেরিয়ে পাহাড়ের কাছে পৌঁছতে গেলে তার অবস্থা রাই-এর মতো হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ বাদে প্রদীপের মনে হল, পাহাড়ের গায়ে দুটো জায়গায় গুহামুখের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তাতে মানুষ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। নিচ দিয়ে ঘুরে পাহাড়ের কাছে পৌঁছবার একটা চেষ্টা করা অবশ্য যায়, কিন্তু তার জন্যে যে শারীরিক শক্তি এবং সময় হাতে থাকা দরকার তা এখন তার নেই। প্রদীপ ঠিক করল নিচেই ফিরে যাবে। রাই-এর মৃত্যুসংবাদ পুলিশ ফাঁড়িতে জানিয়ে দিলে নিশ্চয়ই নিচ থেকে ফোর্স আসবে তল্লাশিতে। একজন পুলিশকর্মীর এমন মৃত্যুকে কর্তৃপক্ষ সহজে মেনে নেবেন না। সে ধীরে-ধীরে নামতে লাগল। ওপরে একটি উগ্রমস্তিষ্কের লোক অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে বুক চিতিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

বাইকের কাছে পৌঁছে আবার এক সমস্যায় পড়ল প্রদীপ। ওটাকে চালু করলেই পাহাড় কাঁপিয়ে শব্দ বাজবে। আত্মগোপন করার কোনও উপায় থাকবে না। অগত্যা ওটাকে রেখে দিয়েই হাঁটতে শুরু করে সে। পুলিশ ফাঁড়িটা দেখা যাচ্ছে। সামনে কেউ নেই। জিপটাকেও দেখতে পেল না। কিছু করার নেই। জিপের আরোহীরা ওখানে নেই ধরেই এগোতে হবে।

ফাঁড়ির পাশে এসে সে দোকানগুলোর দিকে তাকাল। জীবন এখানে স্বাভাবিক। ধীরে-ধীরে আড়াল থেকে সে বেরিয়ে এসে কাঠের বারান্দায় উঠে এল! এ খুব বড় ঝুঁকি নেওয়া, দরজাটাকে কোনাকুনি রেখে প্রদীপ পৌঁছে গেল ঘরের সামনে। উঁকি মেরে দেখল দ্বিতীয় পুলিশটা টেবিলের ওপর একটা হাত আর মাথা রেখে পড়ে আছে। ঘরে কেউ নেই।

দ্রুত ঘরে ঢুকে লোকটার কাছে পৌঁছে গেল সে। লোকটার মাথা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল। না, গুলির চিহ্ন নেই, কোনও ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে ওকে। লোকটা মারা যায়নি। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে লোকটার জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারল সে। ওকে দেখে লোকটা হাউ-হাউ করে উঠল। পুলিশ ফাঁড়ির ফার্স্ট এইড বক্স থেকে ওষুধ আর ব্যান্ডেজ বের করে ওর মাথায় লাগিয়ে টেলিফোনের কাছে গিয়ে হেসে ফেলল প্রদীপ। এটা তার বোঝা উচিত ছিল। টেলিফোনের রিসিভারটাকে ভেঙে তার ছিঁড়ে দিয়ে গেছে ওরা। পৃথিবীর সঙ্গে এই মুহূর্তে যোগাযোগের আর কোনও উপায় নেই।

একটু সুস্থ হতেই লোকটা হড়বড় করে যা বলে গেল সেটা নতুন কিছু নয়। প্রদীপের সন্ধানে এসে লোকগুলো ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রদীপ যা শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তার বাইরে একটি শব্দও বলেনি লোকটা। শোনার পর ওরা চলে গিয়েছিল প্রদীপের খোঁজে। ফিরে এসে হঠাৎই রাই-এর কথা জানতে চাইল। তাকে সে বলেছে প্রদীপের সঙ্গে ঝগড়া করে পিস্তলের ভয়ে রাই পালিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। কথাটা ওরা বিশ্বাস করতে চায়নি। শেষপর্যন্ত পিছনে দাঁড়ানো লোকটা তাকে আঘাত করে। আর কিছু ওর মনে নেই।

লোকটা সত্যি কথা বলছে বলেই মনে হল। সে টেলিফোনটার দুর্দশা দেখাল লোকটাকে। লোকটা বলল, ‘ওরা যখন আপনার খোঁজে বর্ডারের দিকে গিয়েছিল তখন আমি গ্যাংটকে ফোন করেছিলাম। প্রথমবার এসে ওরা যদি টেলিফোনটাকে নষ্ট করে দিত তাহলে খবর পাঠাতে পারতাম না। এস পি সাহেব খবর পেয়েই রওনা হয়ে গেছেন।’

এই সময় গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। প্রদীপ চট করে ঘরের কোণে চলে গেল। ওরা আবার ফিরে এসেছে বোধহয়। কিন্তু পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ট্যুরিস্ট বাস এসে দাঁড়াল। সেটা দেখে প্রদীপ গম্ভীর হয়ে লোকটার পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

ট্যুরিস্টবাসের গাইড এবং কয়েকজন যাত্রী এগিয়ে এল। সকলেই বেশ উত্তেজিত এবং একসঙ্গে কথা বলছিল। প্রদীপ উঠে দাঁড়াল, ‘আপনারা যা বলার একজন বলুন।’

তখন গাইড মৃতদেহের বর্ণনা দিতে লাগল।

প্রদীপ বলল, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমাদের ফাঁড়িতে ফোর্স নেই। টেলিফোনটাও অচল। আপনাদের অনুরোধ করছি পথে কোনও পুলিশ ফাঁড়ি বা অফিসারকে পেলে ব্যাপারটা জানান। গ্যাংটকে গিয়ে বলুন ঘটনাটা। আপনাদের অভিযোগ লিখে নেওয়া হচ্ছে।’

ডায়েরিতে লিখে নেওয়ার পর প্রদীপ গাইডকে বলল, ‘আপনাকে একটু অনুরোধ করতে পারি?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘আমাকে একটা এনক্যুয়ারিতে যেতে হবে। একটু লিফট দেবেন আপনার বাসে।’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আসুন।’ লোকটা খুশি হয়েই বলল।

সব যাত্রী নামেনি। যারা বসেছিল তারা সম্ভবত ঠান্ডার জন্যেই চুপচাপ।

সবার শেষে বাসে উঠে যাত্রীদের দিকে তাকাতেই সুজাতাকে দেখতে পেল প্রদীপ। ফাঁড়ির উল্টোদিকের জানলায় চুপচাপ বসে আছে। ওর পাশের আসন ফাঁকা। সোজা সেখানে গিয়ে বসে পড়ে চাপা গলায় প্রদীপ বলল, ‘আমার দিকে না তাকিয়ে যা বলছি তা শোনো।’

কিন্তু নিষেধ করা সত্বেও না তাকিয়ে পারল না সুজাতা। তার মুখে যেন প্রাণ ফিরে এল। হাত বাড়িয়ে প্রদীপের হাত আঁকড়ে ধরল সে। প্রদীপ চারপাশে তাকাল। এই বাসের আসনগুলো মাথা-উঁচু বলে সামনে-পিছনের যাত্রীদের নজর আটকে যাচ্ছে। কিন্তু ওপাশের দুজন মানুষ স্বচ্ছন্দে দেখতে পারে। যদিও ওই জানলায় বসা যাত্রীটি প্রাকৃতিক শোভা দেখতে ব্যস্ত এখন।

প্রদীপ বলল, ‘তুমি এখন গ্যাংটকে ফিরে যাবে। তারপর—।’

‘না। আমি যাব না।’ চাপা গলায় বলল সুজাতা।

‘তার মানে?’

‘আমি তোমার সঙ্গে থাকব।’

‘অসম্ভব। এখানে চারজন লোক আমাকে খুন করবে বলে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি কিছু প্রমাণ পেয়েছি। আরও কিছু বাকি। আমার জীবন যে-কোনও মুহূর্তে চলে যেতে পারে। আমার সঙ্গে থাকলে কোনও কাজের কাজ হবে না। তার চেয়ে তুমি গ্যাংটকে ফিরে গিয়ে সানশাইন হোটেলে টেলিফোন করে লিটনের সঙ্গে কথা বলবে। তাকে ডেকে আনবে বাস টার্মিনাসে। বলবে, সন্ধে সাতটা পর্যন্ত আমার জন্যে অপেক্ষা করতে। তার মধ্যে যদি আমি না ফিরি তা হলে যেমন করে হোক গ্যাংটক ছেড়ে তোমরা নেমে যাবে।’ কথা বলতে-বলতে প্রদীপ রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিল।

‘তারপর?’

‘মানে?’

‘তারপর আমি কী নিয়ে থাকব?’

‘এতকাল কী নিয়ে ছিলে?’

‘এতকালের মধ্যে গতরাতের মতো রাত আমার জীবনে তো আসেনি।’

‘ওঃ, সুজাতা। বি এ গুড গার্ল। আমাকে সাহায্য করো।’

‘আমি সঙ্গে থাকলে কি তোমার কোনও সাহায্য হবে না?’

‘না। এই বরফের মধ্যে নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে পারছি না যেখানে সেখানে তুমি থাকলে আরও সমস্যা বাড়বে।’ স্পষ্ট বলল প্রদীপ।

‘তাহলে আসতে বললে কেন?’

‘এই খবরটা দেব বলে।’ হঠাৎ প্রদীপের মনে হল জায়গাটা এসে গেছে। একটা জিপের পথ বাঁ-দিকে উঠে গেছে বলে মনে হল। আসার সময় ডান দিক হলে এখন তো বাঁ-দিকই হবে। সে উঠে দাঁড়িয়ে শব্দ করতেই সামনে বসা গাইড তাকাল, ‘এখানে?’

‘হ্যাঁ।’ প্রদীপ জবাব দিতেই গাড়িটা থেমে গেল।

‘অনেক ধন্যবাদ।’ প্রদীপ বাস থেকে নেমে দরজা বন্ধ করে দিতেই সেটা চলতে শুরু করল। সুজাতার জন্যে খারাপ লাগছিল একটু। পৃথিবীর সব মেয়েই কি সময় বুঝে অবুঝ হয়?

একটা পাখি আচমকা ডেকে উঠতেই চমকে গেল প্রদীপ। তার সামনে সাদা ভ্যালি, পেছনে জঙ্গল। পাখিটা ডাকছে তার একটা ডালে বসে। সে বড় রাস্তা ছেড়ে জিপ-চলার পথে পা দিল। বনের মধ্যে সামান্য ঢুকতেই অদ্ভুত কাণ্ড হল। ওই তুষারমাখা গাছগুলোয় বসে থাকা পাখিরা সবাই মিলে একসঙ্গে চেঁচাতে লাগল। হয়তো এই পথে কেউ পায়ে হেঁটে যায় না বলেই ওদের এমন আচরণ কিন্তু এই চিৎকার শুনে সন্দেহ তৈরি হবে যে-কোনও মানুষের। পাথর দেখা যাচ্ছে না, একটা শক্ত বরফ তুলে ওপরে ছুড়ল প্রদীপ। সেটা বেশিদূর গেল না কিন্তু কাজ হল। পাখিরা ধীরে-ধীরে শান্ত হয়ে এল।

গাছের নিচে রাস্তা বলেই বেশি তুষার জমেনি। জিপ স্বচ্ছন্দে যেতে পারে, কিন্তু ড্রাইভারকে বেশ দক্ষ হতে হবে। পথ বিশ্রী রকমের সরু। প্রদীপ লক্ষ করছিল তুষারের ওপর সদ্য যাতায়াত করা জিপের চাকার দাগ রয়েছে। জিপটা উঠেছে দুবার, নেমেছে একবার। অর্থাৎ ওই জিপটাই একবার ওপরে ওঠার পর খবর পেয়ে তাকে খুঁজতে নিচে নেমেছিল। না পেয়ে আবার ওপরে উঠে গেছে। এই রকম পাণ্ডববর্জিত জায়গায় জিপের আরোহীরা কী করে খবর পেল? তাকে খুঁজে বের করার নির্দেশ নিশ্চয়ই টেলিফোন অথবা অয়্যারলেসে এখানে পৌঁছেছে। তা হলে সে যেদিকে এগোচ্ছে সেখানে নিশ্চয়ই একটা বড় ঘাঁটি রয়েছে।

মিনিট পনেরো হাঁটার পর বিশ্রাম নেবে বলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রদীপ। এই সময় ওপর থেকে জিপের শব্দ ভেসে এল। জিপটা আবার নামছে। এখানে লুকোনোর জায়গার অভাব নেই। রাস্তা থেকে লাফিয়ে সরে এসে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে তুষারে তার হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল। পা টেনে তুলতে অসুবিধে হচ্ছে। এই সময় যদি তাকে এখান থেকে পালাতে হয় তাহলে নির্ঘাৎ ধরা পড়তে হবে। আওয়াজটা এখন একদম কাছে। অতএব নড়াচড়ার চেষ্টা না করে পিস্তল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রদীপ। আর তখনই পাখিদের সেই চিৎকারটা আরম্ভ হল। যেন এতক্ষণ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল বলে ওরা তাকে উপেক্ষা করেছে এখন আর সেটা করতে রাজি নয়। তুষার পাকিয়ে ঢিল বানিয়ে ওপরে ছুড়ে মারা সত্বেও ওরা শান্ত হল না। জিপটা বেরিয়ে এল বাঁক ঘুরে। নামছে খুব আস্তে। প্রদীপ দেখল সেই চারজন একই ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। সামনে এসে ওরা ওপরের দিকে তাকাল। সম্ভবত পাখিদের চিৎকার শুনে বিস্মিত হল কিন্তু দাঁড়াল না। জিপটা নেমে গেল নিচে। একসময় তার শব্দও মিলিয়ে গেল। তুষারের কাদা থেকে পা ছাড়িয়ে আনতে রীতিমতো কসরৎ করতে হল প্রদীপকে। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অসাড় হয়ে গেছে। কিন্তু জুতো খোলার সাহস হচ্ছিল না তার। একবার জুতো খুললে আর ওটাকে পায়ে গলাতে পারবে না সে।

বাঁক ঘুরে কিছুটা উঠতেই থমকে দাঁড়াল প্রদীপ। জঙ্গলের মাথা ছাড়িয়ে পাহাড়টা এখন চোখের সামনে। জিপটা পাহাড় পর্যন্ত নিশ্চয়ই যেতে পারে না। দাগ শেষ হয়ে গেছে যেখানে সেখানে পৌঁছে ও জুতোর দাগ দেখতে পেল। অনেকগুলো দাগ পাথর টপকে চলে গেছে। পাথরগুলো তুষার ঢাকা। জিপটাকে তাহলে এখানেই রেখে যেতে হয়!

প্রদীপ সন্তর্পণে এগোল। পাথরের আড়ালে-আড়লে পাহাড়ের গায়ে পৌঁছে দেখল জুতোর দাগগুলো একটা খাঁড়ির মধ্যে চলে গেছে। পিস্তল হাতে সাবধান হয়ে সে খাঁড়িতে ঢুকল। ভেতরে কেউ যেন সিঁড়ি কেটে রেখেছে পাহাড়ের গায়ে। পা ফেলে-ফেলে অনেকটা ওপরে উঠে এল প্রদীপ। এবং তারপরেই গুহাটার মুখ দেখতে পেল। মুখটা বিপরীত দিকে ফেরানো। আড়াল থেকে সে গুহাটাকে লক্ষ করতে লাগল। ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না। কেউ ওর ভেতর থাকলে সামনে না গেলে বোঝা যাবে না। সামনে ধুধু বরফ নেমে গেছে। হঠাৎ বরফের ওপর এখান থেকে শখানেক গজ দূরে কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখে সে ভালো করে তাকাল। কালোমতো জিনিসটা যে মানুষের শরীর তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল ইতিমধ্যে ওর ওপর পড়া তুষারের জন্যে।

রাই। রাই-এর শরীরটা শুয়ে আছে বরফের ওপর। ওর কিছুটা পেছনে ছোট টিলার আড়ালে সে নিজে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ আগে। ওর মনে পড়ল রাই বলেছিল বিপরীত দিক দিয়ে জিপ গুহাটার কাছাকাছি যেতে পারে। সে কিছুই না জেনে একেবারে গুহার মুখে এসে গেছে।

এইসময় লোকটা বেরিয়ে এল গুহা থেকে। হাতে আধুনিক অস্ত্র। এসে সামনের বিস্তৃত বরফের দিকে তাকাল। লোকটার হাতের অস্ত্র সতর্ক ভঙ্গিতে ধরা। প্রদীপ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে সে সহজেই গুলি করতে পারে লোকটাকে। লোকটার ডান পাশ সে দেখতে পাচ্ছে। ও ভাবতেও পারছে না বিপরীত দিক থেকে কেউ গুহার এত কাছে উঠে আসতে পারে। ওর নজর তাই সামনে, যেখানে তাকে গুলি ছুড়তে হয়েছে কয়েক ঘণ্টা আগে।

লোকটা আবার ভেতরে চলে গেল। একটা লোককে খামোকা গুলি করে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে না। এখনও পর্যন্ত অনেক মানুষকে সে এই পিস্তল দেখিয়ে ভয় পাইয়েছে কিন্তু কখনও কাউকে মেরে ফেলেনি। বস্তুত পিস্তলের ট্রিগার টিপে গুলি ছোড়ার অভ্যেসও তার এখন নেই। আগে লক্ষ্য ঠিক রাখতে দার্জিলিং থেকে মোটরবাইক নিয়ে দূর-দূর নির্জনে চলে যেত যে। এখন যদি সে লক্ষ্য ভেদ না করতে পারে? কিন্তু ওই গুহায় যাওয়া দরকার। কোনও মূল্যবান জিনিস ওখানে না থাকলে লোকটা খামোকা পাহারা দিত না। একটা শক্ত বরফের ঢেলা তুলে নিয়ে প্রদীপ গুহার সামনে ছুড়ে মারল। সঙ্গে-সঙ্গে শব্দ হল এবং লোকটা তীরের মতো বেরিয়ে এসে শব্দ লক্ষ্য করে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরল। ওর আঙুল ট্রিগারে চাপ দেওয়ার অপেক্ষায়। শব্দের উৎস খুঁজতে লাগল লোকটা। প্রদীপ দ্বিধা করল না আর। লোকটার অস্ত্র ধরা হাত লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা লাফিয়ে উঠল। অস্ত্রটা পড়ে গেল হাত থেকে। পড়ে ছিটকে গেল কিছুটা দূরে।

সঙ্গে-সঙ্গে দ্বিতীয় গুলিটা ছুড়ল প্রদীপ। এবার লোকটার পা লক্ষ্য করে। উল্টে পড়ে গেল লোকটা। প্রদীপ কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। গুহার ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে এল না। কিন্তু গুলির শব্দ বরফের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে, ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলছে। অনেক দূর থেকেও এই শব্দ শুনতে চাইবে। যতটা সম্ভব দ্রুত প্রদীপ লোকটার কাছে পৌঁছে গেল। হাত এবং পায়ে গুলি লাগা সত্বেও লোকটা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। প্রদীপকে এত কাছে দেখে হকচকিয়ে গেল। পিস্তলটাকে পকেটে ঢুকিয়ে প্রদীপ লোকটির অস্ত্র তুলে নিয়ে নির্দয়ভাবে ওর মাথায় আঘাত করল। ওর মনে হচ্ছিল এই লোকটাই দুটো খুন করেছে। একজনের মৃতদেহ সামনে পড়ে আছে আর দিলবাহাদুর তো শক্ত হয়ে গেছে পরশু রাত থেকেই। ধপাস করে পড়ে গেল লোকটা জ্ঞান হারিয়ে। ওকে একেবারে মেরে ফেলার বাসনা তার নেই। অস্ত্রটাকে উঁচিয়ে সে গুহার মধ্যে ঢুকে তাজ্জব হয়ে গেল।

গুহাটা বেশ বড়। মাঝখানে পার্টিশন দেওয়া হয়েছে কাঠের, চেয়ার-টেবিল এবং একটি ওয়াকিটকি যন্ত্র রয়েছে সেখানে। ওপাশে স্টোভ এবং রান্না করার জিনিসপত্র। পার্টিশনের ওপাশে আলো জ্বলছে। অর্থাৎ ব্যাটারিচালিত বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে এখানে। পার্টিশন এবং দেওয়ালের মাঝখানে যে ফাঁকটুকু সেটাই দরজা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রদীপ এগিয়ে গিয়ে সেখানে দাঁড়াতেই মেয়েটি মুখ ফেরাল। চাঁদের মুখে যতই মেঘ ঘষাঘষি করুক চাঁদের ময়লা লাগে না। প্রায় উন্মাদিনীর মতো চেহারা এই মেয়েটি যে সুন্দরী তাতে কোনও সন্দেহ নেই। খাটিয়ার মতো একটা কিছুর সঙ্গে বেঁধে ওকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ওর তাকানোর ভঙ্গিতেই হিংসা এবং ঘৃণা একসঙ্গে ফুটে উঠল।

প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কোমল?’

মেয়েটি মুখ বিকৃত করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

প্রদীপ বলল, ‘আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। তোমার পাহারাদারকে অজ্ঞান করে এখানে ঢুকতে পেরেছি। কিন্তু ওর সঙ্গীরা ফিরে এলে আমি বিপদে পড়ব। তুমি কি আমার সঙ্গে এখান থেকে—।’

প্রদীপকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মেয়েটি প্রশ্ন করল, ‘কে আপনি?’

‘আপাতত তোমার বন্ধু বলে মনে করতে পারো। আমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তোমার বাবা। তিনিই দিলবাহাদুরকে খুন করিয়েছেন। এখন তাঁর লক্ষ্য আমি।’ কথা বলতে-বলতে প্রদীপ লক্ষ করল মেয়েটার মুখ-চোখ পালটাচ্ছে। হঠাৎই কেঁদে উঠল ও। সম্ভবত দিলবাহাদুরের প্রসঙ্গ শুনে নিজেকে সামলাতে পারল না। প্রদীপ এগিয়ে গিয়ে ওর বাঁধন খুলে দিল। তারপর বলল, ‘চেষ্টা করো সোজা হয়ে দাঁড়াতে।’

মেয়েটি নড়বড়ে হয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘আপনার নাম কী?’

‘আমি প্রদীপ গুরুং। তুমি কোমল তো?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে আমি কী করে বিশ্বাস করব?’

‘আশ্চর্য! এখানে বন্দি হয়ে থাকার চেয়ে খোলা হাওয়ায় হাঁটতে পারবে, এর পর আর বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে কথা বলছ কেন? হাঁটতে পারবে? হাত ধরো।’ কোমলকে নিয়ে গুহার মুখ পর্যন্ত আসতে একটু সময় লাগল। মেয়েটার পায়ে জোর নেই তেমন।

গুহার মুখে এসে অজ্ঞান হয়ে থাকা লোকটিকে দেখে চিৎকার করে উঠল কোমল।

প্রদীপ ধমক দিল, ‘আস্তে। আমরা এখানে বেড়াতে আসিনি।’

‘এই লোকটা, এই লোকটাই ওকে খুন করেছে। ওকি মরে গেছে? না হলে মেরে ফেলুন, মেরে ফেলুন। উঃ মাগো।’ মুখে হাত চাপা দিয়ে ককিয়ে উঠতেই প্রদীপ ওকে টেনে নিয়ে চলল। ওর মাথায় এখন সেই চারজন মানুষ যারা যে-কোনও মুহূর্তে জিপ নিয়ে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু কোমলের শরীরের যে অবস্থা তাতে ওকে নিয়ে বেশিদূরে যাওয়া সম্ভব নয়, দ্রুত যেতে পারবে না ও। অথচ এখান থেকে পালাতে হলে তাদের মোটরবাইকের কাছে পৌঁছতেই হবে।

প্রদীপ দাঁড়াল, ‘শোনো, তুমি এখন গুহায় ফিরে যাও।’

অর্থটা বুঝতে পেরে কোমল মাথা নাড়ল, ‘না। অসম্ভব।’

‘আমাকে পরিস্থিতিটা বুঝতে দাও। ওখানে তুমি নিরাপদে থাকবে। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে আজই গ্যাংটকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।’

‘কিন্তু ওরা যদি আবার ফিরে আসে? আবার যদি—’ কোমলের মুখে আতঙ্ক।

‘আমি এখানে আছি। তোমার কোনও ভয় নেই। শোনো, ওই লোকটা আহত, অজ্ঞান হয়ে আছে। গুহার ভেতরে দড়ি দেখলাম। ওকে এমনভাবে বেঁধে ফেলো যাতে জ্ঞান ফিরলে উঠে দাঁড়াতে না পারে। ওর পায়ে যদিও গুলি লেগেছে তবু বিশ্বাস নেই।’

কোমল লোকটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর আবার ধীরে-ধীরে গুহার মধ্যে ঢুকে গেল। মেয়েটাকে দড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে প্রদীপ পা চালাল। খাঁড়ির ওপরে এসে সে গোটা জায়গাটা দেখতে পেল। চারজন ফিরে এলে জিপটাকে যেখানে পার্ক করবে সেই জায়গাটা এখন লক্ষের মধ্যে।

এখন পালাতে হবে। কিন্তু কোমলকে নিয়ে বাইকের কাছে পৌঁছবে কী করে? হঠাৎ তার খেয়াল হল। সরল পথটার কথা সে কেন ভাবছে না? যে পথ দিয়ে উঠতে গিয়ে রাই গুলি খেয়ে মারা গিয়েছে সেই পথে নেমে গেলে বাইকের কাছে পৌঁছতে মিনিট কুড়িও লাগবে না। কিন্তু মোটরবাইক নিয়ে এই বরফের রাস্তায় জিপের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আগে জিপের জন্যে অপেক্ষা করতেই হবে তাকে।

কিন্তু জিপটা গেল কোথায়? যদি ওটা আবার তার খোঁজেই গিয়ে থাকে তাহলে অনেক সময় নষ্ট করবে। সন্ধে নেমে গেছে এইসব জায়গায় বাইক চালানো মানে আত্মহত্যা করা। প্রদীপের খুব শীত করছিল। ঠান্ডাটা উঠছে পা থেকে। সঙ্গে একটু ব্র্যান্ডি থাকলে ভালো হতো। গুহার ভেতর কী ওসব আছে? এইসময় জিপের শব্দ কানে এল ওর। জিপটা ফিরে আসছে।

ভালোরকম একটা আড়াল রেখে বসল প্রদীপ। আর কোনও মায়ামমতা নয়। যারা আসছে তারা তার জন্যে রসগোল্লা আনছে না। শেষপর্যন্ত জিপটাকে দেখতে পেল সে। অনেক আওয়াজ তুলে উঠে সে দাঁড়াতেই ড্রাইভারের পাশের লোকটা অস্ত্র হাতে নেমে দাঁড়াল। ওর ভঙ্গিতে এমন সতর্কতা ছিল যে বুঝতে অসুবিধে হল না, ওরা সন্দেহ করছে কিছু। এবং তখনই প্রদীপ লক্ষ করল জিপের আরোহী মাত্র দুজন। বাকি দুজন ফেরত আসছিল। সঙ্গে-সঙ্গে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ট্রিগার টিপল প্রদীপ। খট করে শব্দ হল কিন্তু গুলি বের হল না। শব্দটা যত অল্পই হোক এগিয়ে আসা অস্ত্রধারীর কানে পৌঁছতেই সে জিপের পেছনে ছুটে গেল। সেইসঙ্গে ড্রাইভারও।

হতাশ হয়ে অস্ত্রটার দিকে তাকাল প্রদীপ। এই বস্তু সে কখনও ব্যবহার করেনি। ব্যবহার করার যে বিশেষ কায়দা আছে তা তার জানা নেই। মাঝখান থেকে শত্রুপক্ষ সতর্ক হয়ে গেল। এখান থেকে জিপটা পিস্তলের আওতার মধ্যে নেই। প্রদীপ মরিয়া হয়ে অস্ত্রটাকে সচল করতে চাইছিল। ইতিমধ্যে নতুন কোনও শব্দ না পেয়ে লোকটা আবার বেরিয়ে এসেছে আড়াল থেকে। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল একটা নাম ধরে। সম্ভবত গুহার পাহারাদারের নাম। প্রতিধ্বনি বাজল। ড্রাইভারও বেরিয়ে এসেছে এবার। প্রদীপ তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অস্ত্রটির মুখ যখন আকাশের দিকে তখনই গুলি বের হতে লাগল। সেই শব্দ শুনে লোকদুটো এমন হকচকিয়ে গেল যে প্রদীপ অস্ত্রের মুখ নামাবার সময় পেল। সঙ্গে-সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্থির হয়ে গেল লোকদুটো।

বরফের ওপর ছিটকে পড়া রক্ত দেখতে পেয়ে প্রদীপ নিশ্চিত হল ওখানে গিয়ে যাচাই করার প্রয়োজন নেই। যন্ত্রটাকে যে শেষপর্যন্ত কাজ করাতে পারল তার জন্যে মন হালকা লাগছিল এখন। কিন্তু বাকি লোকদুটো কোথায়? ওরা কি জিপটাকে এগোতে গিয়ে পেছনে আসছে?

এইসময় চিৎকার কানে এল। মেয়েলি গলার আর্তনাদটা যে কোমলের তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রদীপ যতটা সম্ভব দ্রুত ভেতরে ঢুকে ওপরে উঠতেই থমকে গেল। কোমলকে সামনে রেখে একটা লোক অস্ত্র উঁচিয়ে আছে। কোমলের মাথায় ওর অস্ত্র ঠেকানো। দ্বিতীয় লোকটা অজ্ঞান হয়ে থাকা লোকটির বাঁধন খুলছে দ্রুত হাতে। প্রদীপ ঠোঁট কামড়াল। ভুল হয়ে গেছে খুব। যে পথ দিয়ে রাই এখানে আসার চেষ্টা করছিল সেই পথ দিয়েই উঠে এসেছে লোকদুটো। গুলির শব্দে ওরা নিশ্চয়ই বিপদ বুঝতে পেরেছিল তাই দুই দলে বিভক্ত হয়ে এখানে পৌঁছতে চেষ্টা করেছে।

এখন কোমল ওদের সামনে, এই অবস্থায় কোনওমতেই গুলি ছোড়া যায় না।

প্রদীপ নিজেকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করল। ওদের সামনে না গেলে ওরা আর যাই হোক তার ওপর মানসিক চাপ তৈরি করতে পারবে না। হঠাৎ ওদের একজন চিৎকার করল, ‘বেরিয়ে আয় শালা, তিন মিনিটের মধ্যে না বেরিয়ে এলে এই মেয়েটাকে খুন করব।’

প্রদীপ চুপচাপ মাথা নাড়ল। ওরা কখনওই সেটা করতে পারে না। বস-এর মেয়েকে খুন করার হিম্মত ওদের কখনওই হবে না। তা ছাড়া, কোমলকে খুন করলে ওদের হাতে নিজেদের আড়াল করার কোনও অস্ত্র থাকবে না। সে কোনও সাড়া দিল না। মিনিট পাঁচেক চলে গেল। প্রদীপ ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে। ওরা যদি আজ রাত্রে গুহার মধ্যে থেকে যায় তা হলে সে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতেই পারে না। ওরা যদি বুদ্ধিমান হয় তা হলে সেই চেষ্টাই করবে।

কিন্তু এই সময় কোমল আবার চিৎকার করে উঠল। আড়ালে থেকে প্রদীপ দেখল কোমলকে সামনে রেখে, প্রায় ঠেলতে-ঠেলতে এগিয়ে আসছে লোকটা। দ্বিতীয়জন কাছেপিঠে নেই। আহত লোকটাকে গুহার মধ্যে নিয়ে গিয়েছে ওরা। প্রদীপ সরে দাঁড়াল। ধীরে-ধীরে নিচে নেমে এল সে, তারপর লোকদুটোর মৃতদেহ যতটা পারে আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিপে উঠে বসে স্টার্ট দিল। কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে সে অপেক্ষা করল যতক্ষণ না কোমল আর লোকটাকে দেখা যায়। ব্রেক চেপে ইঞ্জিনের আওয়াজ তুলতে লাগল যেন অনেকটা দূর থেকে উঠে আসছে। ওদের পোশাক চোখে পড়ামাত্র সে জিপটাকে তুলে নিয়ে এসে ব্রেক কষল আড়াআড়িভাবে। যেন এইমাত্র উঠে এসেছে। লোকটা চেঁচিয়ে কিছু বলল। তারপর আচমকা কোমলকে নিয়ে পাহাড়ের দিকে মুখ করে ঘুরে গেল। এবার জিপের দিকে পিছন ফিরে হাঁটছিল সে। এভাবে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল কোমলের। আর এই হাঁটার সময় সমানে চিৎকার করে সঙ্গীদের ডাকছিল লোকটা। এখন ওর পিছন দিক প্রদীপের সামনে। জিপের কাছাকাছি চলে আসায় পিস্তলের আওয়তার মধ্যে। তবু গুলি ছুড়তে সাহস হচ্ছিল না ওর। এই সময় দ্বিতীয় লোকটাকে খাঁড়ির ওপরে দেখা গেল। লোকটা চিৎকার করে কিছু বলতে কোমলকে টেনে আনা লোকটা স্থির হয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে গুলি চালাল প্রদীপ। দ্বিতীয় লোকটা ছিটকে পড়ে গেল খাঁড়ির মধ্যে।

প্রথম লোকটা দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। ওর অস্ত্র কোমলের মাথায় ঠেকানো। আঙুল ট্রিগারে। প্রদীপের সামনে ওর পিছন দিক। এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়িয়ে গুলি ছুড়লে প্রদীপ পাল্টা গুলি ছুড়তে পারবে না। প্রদীপ চিৎকার করল, ‘আমার কাছে তুমিও যা আর তোমার বসের মেয়েটাও তাই। ওর জন্যে যদি ভাব গুলি করব না তা হলে ভুল করবে। বাঁচার ইচ্ছে থাকলে যন্ত্রটা ফেলে দাও।’

লোকটা মাথা নাড়ল, ‘আমি তোকে বিশ্বাস করি না।’

সঙ্গে-সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে বরফের ওপর লুটিয়ে পড়ল কোমল, লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে নিচু হতেই প্রদীপ জিপ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অস্ত্রটা দিয়ে আঘাত করল ওর মাথায়। লোকটা ঘুরে সোজা হতে-হতে প্রদীপ দ্বিতীয়বার আঘাত করল, ওর মুখে। এবার লোকটা গড়িয়ে পড়ল। পড়ে স্থির হয়ে গেল। কোমলকে টেনে তুলল সে। মেয়েটা তখন থরথর করে কাঁপছে। এই তিন দিনের ঝড়, মেয়েটার সমস্ত শক্তি যেন শুষে নিয়েছে। প্রদীপ এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল। নিচু গলায় বলল, ‘আর কোনও ভয় নেই।’

‘আপনি কে?’ অদ্ভুত গলায় প্রশ্নটা উচ্চারণ করল মেয়েটা।

‘আমি তো তোমাকে আমার নাম বলেছি। চলো, এবার আমরা ফিরে যাব।’ প্রদীপ ঘুরে জিপটার দিকে তাকাল। জিপ চালিয়ে সে স্বচ্ছন্দে গ্যাংটক ফিরে যেতে পারে। কিন্তু তাহলে বাইকটার কী হবে? এই জিপ তার নয় কিন্তু বাইকটা নিজস্ব। ওটাকে এখানে বরফের মধ্যে ফেলে রেখে সে চলে যেতে পারে না।

সে মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘গাড়ি চালাতে পারো?’

কোমল মাথা নাড়ল, না।

‘তা হলে তোমাকে কষ্ট করতে হবে। আমার হাত ধরে চলো।’

কোমলকে নিয়ে প্রদীপ আবার খাঁড়ির ভেতর দিয়ে ওপরে উঠে এল। এখন এই বরফের পৃথিবীতে ছায়া নেমেছে। দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এই রকম পরিস্থিতিতেও প্রদীপের খিদে পাচ্ছিল। ও গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ল। স্টোভের পাশে কিছু খাবার রয়েছে। কার খাবার কে খায়।

কোমল খেতে চাইল না। প্রদীপ তাকে কয়েকবার অনুরোধ করেও রাজি করাতে পারল না। একজন স্বেচ্ছায় না খেয়ে থাকা মানুষের সামনে ভালোভাবে খাওয়া যায় না। প্রদীপ কিছুটা কোনওমতে গিলে নিয়ে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেল। শব্দ হচ্ছে গুহায়। শব্দটা আসছে ওয়াকিটকি থেকে। এক মুহূর্ত চিন্তা করে সে এগিয়ে যন্ত্রটা তুলে কানের কাছে ধরে সুইচ অন করল, ‘হ্যালো। হ্যালো।’ খুব ক্ষীণ স্বর ভেসে এল, ‘জিরো জিরো টু জিরো টু?’

‘ইয়েস। জিরো জিরো টু স্পিকিং।’

‘জি-ওয়ান কলিং। জি-ওয়ান কলিং। হোয়াট ইজ দ্য রেজাল্ট?’

‘রেজাল্ট ইজ গুড। ভেরিগুড।’

‘ও কে। কাম জি ইমেডিয়েটলি। বস উইল মিট ইউ। ওকে?’

‘ও কে!’

‘ওভার।’ যন্ত্রটা থেমে গেল।

এই ছোট্ট অথচ শক্তিশালী যন্ত্রটার সঙ্গে গ্যাংটক শহরের একটি যন্ত্রের সরাসরি সংযোগ আছে। জি ওয়ান মানে গ্যাংটক এক তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। গ্যাংটকে আর কতগুলো ঘাঁটি আছে ওদের? প্রদীপ ঠিক করল এই যন্ত্রটা নিয়ে যাবে সঙ্গে।

বের হওয়ার আগে সে গুহাটাকে ভালো করে দেখে নিল। একটা ছোট্ট বাক্সের মধ্যে সে ভাঁজ করা কতগুলো ম্যাপ পেল। ম্যাপের ওপর চোখ বুলিয়ে প্রদীপ অবাক হয়ে গেল। সিকিম থেকে বেরিয়ে তিব্বতের ভেতর অনেকটা জায়গা জুড়ে এই ম্যাপ ব্যবহারকারীর যাওয়া-আসা আছে। পেন্সিল দিয়ে বেশ কিছু জায়গা চিহ্নিত করা। সীমান্তের ওপাশে এরা কী করতে যায়?

কোমলকে নিয়ে বরফের ঢাল পেরিয়ে মোটরবাইকের কাছে পৌঁছতে-পৌঁছতে সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় চলে এল। বাইকটার ওপর ইতিমধ্যে ভালো তুষার জমে গেছে। সেসব ছাড়িয়ে ওটাকে চালু করতে বেশ কসরৎ করতে হল। ইতিমধ্যে পথে নতুন তুষার পড়েছে। পথটাও সরু। কোমলকে পিছনে বসিয়ে শক্ত করে ধরে রাখতে বলল প্রদীপ। কাদা তুষারে বাইকের চাকা আটকে যাচ্ছে। কোনওমতে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে নেমে এল ওরা।

দোকানগুলো এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ওরা সারাদিনে ক’টা খদ্দের পায় কে জানে। বাইকের হর্ন বাজাল প্রদীপ। সে আশা করছিল ভেতর থেকে দ্বিতীয় পুলিশটা বেরিয়ে আসবে কিন্তু কেউ এল না। অগত্যা বাইক দাঁড় করিয়ে প্রদীপ বারান্দায় উঠে এল। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল লোকটা পড়ে আছে মাটিতে, চিৎ হয়ে। কাছে গিয়ে বুঝতে পারল লোকটাকে আবার মারা হয়েছে, মেরে ফেলেনি। গুলির চিহ্ন নেই, রক্তপাতও হয়নি। ওর জ্ঞান ফেরাতে সামান্য সময় লাগল। প্রদীপ লোকটাকে বলল, ‘বারান্দায় গিয়ে বসো। মিলিটারি ভ্যান দেখতে পেলেই থামাবে। তাদের বলবে এখনই এক নম্বর গুহায় তল্লাশি করতে। বুঝতে পারছ?’

লোকটা আচ্ছন্ন হয়েছিল। সেই অবস্থায় মাথা নাড়ল। প্রদীপ একটা চেয়ার টেনে দরজার কাছে লোকটাকে বসিয়ে দিল। কিন্তু তার ঠিক ভরসা হচ্ছিল না ওর ওপর।

মিনিট খানেকের মধ্যে মোটরবাইকটা গতি তুলল। চাকার ধাক্কায় তুষার ছিটকে যাচ্ছে। কোমল তার পেছনে বসেও আছে চুপচাপ। মুখে রুমাল জড়িয়ে নিয়েছিল প্রদীপ। কিন্তু তা সত্বেও ঠান্ডা ছুঁচোলো বাতাসের কামড় তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি চলকে উঠল। একটুও দ্বিধা না করে সে বাইক নিয়ে উঠে এল এক নম্বর গুহার পিছনে। শরীরগুলো এখনও বরফের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যাকে সে শেষবার আহত করেছিল সেই লোকটা এখন নড়ছে। তার জ্ঞান ফিরে আসছে। কোমলকে বাইক থেকে নামতে বলল সে। তারপর জিপের পিছনের কপাট খুলে ফেলল। খুব বেশি জায়গা নেই। তার ওপর স্টেপনিটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে। সে টেনে-টেনে স্টেপনিটাকে বরফের ওপর নামাল। তারপর বাইকটাকে স্টেপনির ওপর তুলতে মনে হল বাকি উচ্চতাটুকু তুলতে পারবে। কিন্তু শক্তি প্রয়োগ করে বুঝতে পারল ব্যাপারটা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। সে বাইকটাকে খুব সামান্যই ওপরে তুলতে পারছে। এই ঠান্ডাতেও ওর শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছিল। এতক্ষণ কোমল চুপচাপ প্রদীপকে দেখছিল। এবার সে এগিয়ে এল। ওকে হাত লাগাতে দেখে দ্বিগুণ উৎসাহে প্রদীপ বাইকটাকে তুলতে চাইল। একটু-একটু করে বাইকটা জিপের মেঝেতে পৌঁছে দিয়েই ঠেলতে লাগল ওরা। বাইক ঘষটে গেল অনেকটা কিন্তু শেষপর্যন্ত ওটাকে ওপরে তুলতে সক্ষম হল ওরা। প্রদীপ দেখল চাকা বাইরে বেরিয়ে থাকায় জিপের কপাট তোলা যাচ্ছে না। সে দ্রুত গাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। গুহায় পৌঁছবার মুখে সে লোকটিকে দেখতে পেল। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। ওকে দেখামাত্র আতঙ্কিত হয়ে উঠল ওর মুখ। কোনও কথা না বলে দড়ি কুড়িয়ে নিল প্রদীপ। তারপর বেরিয়ে আসার মুখে ব্যান্ডির বোতলটা নিচে দেখতে পেয়ে তুলে নিল।

খাঁড়ি থেকে বেরিয়ে জিপের দিকে তাকিয়ে ও লোকটাকে দেখতে পেল। এখন উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা। বাইকের চাকায় হাত দিয়ে কোমল লোকটার দিকে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে আসতে দেখে লোকটা আবার বরফের ওপর বসে পড়ল। শত্রুকে জাগিয়ে রাখতে নেই। ব্যান্ডির বোতল দিয়ে লোকটার মাথায় সামান্য আঘাত করতেই ও আবার লুটিয়ে পড়ল বরফের ওপর।

বাইকটাকে ভালো করে জিপের সঙ্গে বেঁধে অস্ত্র এবং ওয়াকিটকি নিয়ে সে চলে এল ড্রাইভিং সিটে। পাশের দরজা খুলে কোমলকে বলল উঠে বসতে। সামনের কাচে তুষার জমেছে। সেটাকে পরিষ্কার করে ইঞ্জিন চালু করল প্রদীপ। ধীরে-ধীরে জিপটাকে নামাচ্ছিল প্রদীপ। রাস্তা এত সরু যে প্রতি মুহূর্তে নিচে গড়িয়ে পড়বে বলে আশংকা হচ্ছিল। শেষপর্যন্ত নিচে পৌঁছবার আগের মুহূর্তে সে গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেয়ে ব্রেক চেপে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেল। গাছের আড়ালে থাকায় ওদের দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নিচ থেকে কম। প্রদীপ দেখল একটা মিলিটারি কনভয় ফিরছে। পরপর আটটা গাড়ি চলে গেল পুলিশ ফাঁড়ির দিকে! ওরা যাবে সীমান্তে। কিন্তু তাকে দ্রুত চলে যেতে হবে এই এলাকা ছেড়ে। মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়লে ওরা কোনও ব্যাখ্যাই মানতে চাইবে না। সেপাইটা নিশ্চয়ই ওদের থামাবে।

চওড়া রাস্তায় পড়ে যতটা সম্ভব জোরে জিপ চালাচ্ছিল প্রদীপ। পাশে পুতুলের মতো বসে আছে কোমল। সন্ধে নেমে গেছে। জিপের হেডলাইট জ্বালিয়ে দিতে হয়েছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক আসার পরে জিপ থামাতে হল সামনের কাচ পরিষ্কার করার জন্যে। ওয়াইপারের ক্ষমতা নেই ওই তুষার সরানোর।

মাটিতে নামতেই প্রদীপের মনে হল দুটো পা নেই। এত অবশ হয়ে গেছে হাঁটুর নিচু অংশ যে সে ভালো করে দাঁড়াতে পারছিল না। জিপে ফিরে এসে সে ব্যান্ডির বোতল খুলে গলায় ঢালল। তারপর এগিয়ে ধরল কোমলের সামনে।

মাথা নাড়ল কোমল, না। প্রদীপ ধমকাল, ‘একটু গলায় ঢালো। শরীর গরম হলে ডিফারেন্সটা বুঝতে পারবে। সব সময় বোকার মতো না বলো না।’

কোমল তাকাল, ‘আমি কোনওদিন ওসব খাইনি।’

‘এটা এখন ওষুধ। কে কবে ওষুধ খেয়েছে?’

কোমল এবার হাত বাড়াল। বোতলটাকে নিয়ে যেন প্রতিবাদ জানাতেই অনেকখানি গলায় ঢেলে মুখ বিকৃত করে কোনওমতে গিলতে লাগল। ওর হাত থেকে বোতলটা নিয়ে প্রদীপ আর এক ঢোঁক গিলতেই ওয়াকিটকি শব্দ করে উঠল। সুইচ অন করে সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘জিরো জিরো টু স্পিকিং।’

‘জি ওয়ান কলিং, জি ওয়ান কলিং। আর ইউ কামিং ব্যাক?’

‘ইয়েস। উই আর অন দ্য ওয়ে।’

‘গুড। বস ইজ ওয়েটিং ইন আঙ্কল’স শপ। ও কে!’ লাইনটা কেটে গেল। যন্ত্রটা নামিয়ে সে কোমলের দিকে তাকাল, ‘আঙ্কলের শপটা কোথায় জানো?’

‘না।’ ব্র্যান্ডির প্রতিক্রিয়ায় কোমলকে একটু স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল।

‘তোমার বাবা সেখানে অপেক্ষা করছে।’

‘ইম্পসিবল। আমি বাবার কাছে যাব না।’ সোজা হয়ে গেল কোমল।

‘তোমার বাবা আমাকে এতক্ষণে মৃত ভাবছেন। ভেবে খুশি হয়েছেন। তাঁর সামনে গেলে আমারও ভাগ্য ভালো থাকবে না। কিন্তু এই আঙ্কলস শপটা কোথায় সেটা জানতে হবে।’

‘আপনি আমাকে এখানে নামিয়ে দিন।’

‘পাগল। ঠান্ডায় জমে মরে যাবে তুমি। বিশ্বাস করতে পারছ না কেন আমাকে? পকেট থেকে দিলবাহাদুরের জিনিসগুলো বের করে সে কোমলের হাতে দিল। ওগুলো দেখা মাত্র কোমল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। জিপ চালু করল প্রদীপ।

মেয়েটা কেঁদে যাচ্ছে দেখে সে আবার ব্যান্ডির বোতলটা এগিয়ে ধরল। একটুও দ্বিধা না করে খানিকটা খেয়ে নিল কোমল। দিলবাহাদুরের জিনিসগুলো ওর হাতে ধরা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কোমল জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কে?’

‘প্রদীপ গুরুং। দার্জিলিং-এ থাকি। একটা আশ্রমের জন্যে টাকার দরকার ছিল। তোমার বাবা সেই টোপ দিয়ে মিথ্যে কথা বলে আমাকে দিয়ে কিছু কাজ করাতে চেয়েছিলেন। আমি প্রথমে বোকার মতো বিশ্বাস করেছিলাম। এখন তিনি আমাকে সরিয়ে ফেলতে চান।’

‘এখন আপনি কী করবেন?’

‘দার্জিলিং-এ ফিরে যাব। তবে যাওয়ার আগে ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে হবে।’

‘আমি কোথায় যাব? আমার তো যাওয়ার জায়গা নেই। কেন আপনি নিয়ে এলেন আমাকে? আমার তো মরে যাওয়াই সবচেয়ে ভালো ছিল।’

‘মরতে তো সবাইকে হবেই।’

‘বাজে কথা বলবেন না।’

বাইরে এখন ঘন অন্ধকার। হঠাৎ হেডলাইটের আলোয় রাস্তার পাশে দুটো গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। বড় গাড়িটা যে ট্যুরিস্টবাস তা বুঝতে পেরে জিপের গতি কমাল। কাছে পৌঁছে বুঝতে পারল ট্যুরিস্টবাস খারাপ হয়েছে এবং একটা মিলিটারি জিপ দাঁড়িয়েছে সাহায্য করার জন্যে। বাসের যাত্রীরা সবাই ঠান্ডার জন্যে ভেতরে বসে আছে। সেই গাইডটাকে দেখতে পেল প্রদীপ। টর্চ হাতে মেকানিককে সাহায্য করছে। জিপ থেকে নামতেই পাদুটো কনকন করে উঠল। কোনওমতে কাছে গিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে?’ গাইড মুখ তুলে তাকে চিনতে পারল, ‘আরে আপনি? ব্যাড লাক। তবে এঁরা ঠিক করতে পারছেন।’

প্রদীপ বলল, ‘আমার সঙ্গে একজন মহিলা আছেন। জিপে কষ্ট হচ্ছে। জায়গা হবে?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘ধন্যবাদ। আচ্ছা, আঙ্কল’স শপটা কোথায়?’

‘ওটা এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। একটা বুড়োর চায়ের দোকান।’

‘ও।’ প্রদীপ কোনওমতে জিপের কাছে ফিরে এল। কোমল বসেছিল চুপচাপ। সে ওকে বলল, ‘নেমে এসো। জিপে যেতে হবে না তোমাকে। জিপের ওপর তোমার বাবার লোকজন নজর রাখবে। তুমি ওই বাসে উঠে যাও। আরামে গ্যাংটক পৌঁছে যাবে।’

‘তারপর?’

‘ওই বাসে উঠে জিজ্ঞাসা করবে সুজাতা কার নাম। তাকে আমার কথা বলবে। মনে হয় তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করতে পারবে।’

‘বাসের ভেতরে যে ওই নামের কোনও মেয়ে আছে তা আপনি কী করে জানলেন?’

‘আমি জানি। মেয়েটি একা, যাও।’

‘না। আমি আপনার সঙ্গে থাকব।’

‘বোকামি করো না।’

‘আপনার পায়ে কী হয়েছে?’

‘কিছু না। সুজাতাকে বলবে আমি যে হোটেলে উঠেছিলাম সেই হোটেলে গিয়ে উঠতে। আমি পরে দেখা করব।’ প্রদীপ আর দাঁড়াল না। সোজা মিলিটারি জিপটার দিকে এগিয়ে গেল। জিপের ভেতর ড্রাইভার ছাড়া আর একজন অফিসার বসেছিলেন। সে পাশে গিয়ে বলল, ‘এক্সকিউজ মি স্যার!’

আধঘণ্টা সময় চলে গেল। ইতিমধ্যে বাস ইঞ্জিন সারিয়ে চলে গেছে গ্যাংটকের দিকে। কোমল শেষপর্যন্ত বাধ্য মেয়ের মতো কথা শুনেছে। মিলিটারি অফিসারটি এতক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন ওপরওয়ালাদের সঙ্গে ওয়ারলেসে কথা বলতে। এর মধ্যে পুলিশ ফাঁড়ির সেপাইটির কথা মতো ওরা এক নম্বর গুহা আবিষ্কার করে অনেক তথ্য পেয়ে গিয়েছেন। নিহত এবং আহত লোকগুলোকে ওঁরা ধরতে পেরেছেন। আহত পুলিশটি জবানবন্দি দিয়েছে।

শেষপর্যন্ত অফিসারটি প্রদীপের কাছে এগিয়ে এল। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিল বলে প্রদীপ জিপে উঠে বসেছিল। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার কাছে অস্ত্র আছে?’

‘না।’ সরাসরি মিথ্যে কথা বলল প্রদীপ। যদিও ওর পায়ের নিচে কেড়ে নেওয়া আধুনিক অস্ত্র এবং পকেটে পিস্তলটা রয়েছে তখনও। ‘তা হলে ওদের সঙ্গে লড়াই করলেন কী করে?’

‘ওদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে।’

‘সেটা কোথায়?’

‘ওখানেই ফেলে এসেছি।’

‘বেশ। আপনি এখন এগিয়ে যান। আঙ্কল’স শপের সামনে পৌঁছে মাঝরাস্তায় দাঁড়াবেন কিন্তু জিপ থেকে নামবেন না। আমরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলছি। লেট দেম কাম আউট। ওরা যেন বিশ্বাস করে ওদেরই জিপ ফিরে এসেছে। ও কে?’ অফিসার ঘড়ি দেখল।

প্রদীপ ঘাড় নাড়ল। তারপর জিপ চালু করল।

এ ছাড়া উপায় ছিল না। তার একার পক্ষে অতবড় সংগঠিত দলের সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাওয়া মানে আত্মহত্যা করা এটা সে জানত। তবু কোমলকে নিয়ে জিপে করে এগিয়ে যাওয়ার সময় সে বেশ ধন্দে ছিল। তখন আঙ্কল’স শপ কোথায় তা না জানা থাকায় সোজা গ্যাংটকে পৌঁছে যেত। এখন একটা যুদ্ধ সামনে অপেক্ষা করছে। টোপ হিসেবে জিপটাকে নিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে। এই মিলিটারি অফিসারকে সে কিছু সত্য গোপন করে গিয়েছে। দার্জিলিং-এর ভদ্রলোকের টোপ গিলে যে সে এসেছিল একথা বলেনি। বলেছে ট্যুরিস্ট হিসাবে এই অঞ্চলে বেড়াতে এসে হত্যাকাণ্ড আবিষ্কার করে সে বিপাকে পড়ে গিয়েছে। সুজাতা বা লিটনের প্রসঙ্গ বলার কোনও প্রয়োজন হয়নি। ইতিমধ্যে যাচাই করে তথ্যের সত্যতা মিলিটারি অফিসার পেয়েছেন বটে কিন্তু ওঁরা তার সম্পর্কে কখনওই সন্দেহ মুক্ত হতে পারেন না। যে ঘটনাই এখন ঘটাতে থাক তারপর জীবিত অবস্থায় সে থাকলে অনেক জবাবদিহি তাকে দিতে হবে। আত্মরক্ষা করার জন্যে সে মানুষ মারতে বাধ্য হয়েছে সেটা প্রয়োগ করতে তাকে হিমসিম খেতে হবে।

হঠাৎ ওয়াকিটকির সিগন্যাল শুনতে পেয়ে যন্ত্রটাকে কানের কাছে আনল প্রদীপ, ‘হ্যালো!’

‘জিরো জিরো টু?’

‘জিরো জিরো টু স্পিকিং।’

‘জি ওয়ান কলিং। তোমার কি কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে?’

‘ইঞ্জিন গোলমাল করছিল। এখন ঠিক আছে।’

‘সে কি তোমাদের সঙ্গে আছে?’

‘ইয়েস।’

‘বস ইজ ওয়েটিং ফর ইউ। ওভার।’

অন্ধকারে বাইরেটার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কোনও আলো দেখা যাচ্ছে না। হেডলাইটের আলো যেন পর্যাপ্ত নয়। হঠাৎ অস্ত্রটার কথা মনে এল। পায়ের নিচে হাত দিয়ে ওটাকে তুলে গাড়ি থামিয়ে দূরের খাদে ছুড়ে ফেলল সে। একটা অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষায় থাকা অনেক অস্ত্রের সঙ্গে লড়াই করতে যাওয়া বোকামি। বরং মিলিটারিকে দেওয়া স্টেটমেন্টকে সত্যি করতে তার কাছে অস্ত্র না থাকা উচিত। কিন্তু পিস্তলটা? জিপ চালাল সে। পিস্তলটার ওপর তার বেশ মায়া পড়ে গেছে। মতিলালের পায়ের কাছে ফেলে দেওয়ার সময় সে নিতান্তই বাধ্য হয়েছিল। না। মায়া ত্যাগ করতে হবে। পিস্তলটা বের করে ছুড়ে দিল সে বাইরে। পাহাড়ের কোনও খাদে উড়ে গিয়ে পড়ল সেটা। সারা রাতের তুষার তাকে মানুষের চোখের আড়ালে রেখে দেবে, অনেকদিন। এখন সে মুক্ত। একেবারে সাধারণ মানুষ। কেউ একটা ছুরি নিয়ে এগিয়ে এলে প্রতিরোধ করার মতো কিছু সঙ্গে নেই।

পায়ের যন্ত্রণা বাড়ছে। অ্যাকসিলেটার থেকে পা সরিয়ে সেটাকে আবার যথাস্থানে নিয়ে যেতে ব্যাপারটা বুঝতে পারল প্রদীপ। দুটো পা অবশ হয়ে গেছে। যন্ত্রণাটা জন্ম নিয়েছে হাড়ে। হাড়ের বাইরে মাংস, চামড়া আছে কি না তা বোঝা যাচ্ছে না হাত না বোলালে। সে স্পিড কমাল। প্রয়োজনের সময় যদি ব্রেকে পা নিয়ে যেতে না পারে?

এবং তখনই দূরে আলো দেখল। সামনেই ছোট জনপদ। বরফ শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। একটু-আধটু তুষার পড়ছে গুঁড়ো ধুলোর মতো। পাহাড়ে গরিব মানুষেরা যেভাবে থাকে। একটা দোকানের সামনে আলো জ্বলছে। দোকানটা চা-বিস্কুটের। গাড়িটা একটু আগে দাঁড় করল। ক্ল্যাচ এবং ব্রেকে যে সে চাপ দিয়েছে তা নিতান্তই অভ্যেস। প্রদীপ চিনতে পারল। সকালে যাওয়ার সময় এই বুড়োর কাছে সে হদিশ জানতে চেয়েছিল।

বুড়ো অবিকল একই ভঙ্গিতে বসে আছে দোকানে।

প্রদীপ চিৎকার করল, ‘হ্যালো আঙ্কল! আই অ্যাম হিয়ার।’

বৃদ্ধ হাত নেড়ে ভেতরে যেতে বলল।

প্রদীপ চিৎকার করল, ‘ইম্পসিবল। আমি হাঁটতে পারছি না। বরফ আমার পায়ে থাবা বসিয়েছে।’

বৃদ্ধ সেটা শোনার পর ভেতর দিকে মুখ ঘুরিয়ে কিছু বলল চাপা গলায়। প্রদীপ দেখল একটি লোক বেরিয়ে আসছে। লোকটা যদি তাকে গুলি করে তাহলে তার কিছু করার নেই। কিন্তু লোকটা সেসব কিছুই না করে ইশারায় তাকে অনুসরণ করে হেডলাইটের আলো ধরে সামনে হাঁটতে লাগল। অর্থাৎ এটা যদি আঙ্কলের দোকান হয় তা হলে বিশিষ্ট ভদ্রলোক এখানে নেই। তিনি অনেক বেশি সতর্ক।

মিনিট তিনেক যাওয়ার পর লোকটা তাকে ইশারায় দাঁড়াতে বলে বাঁ-দিকে চলে গেল। প্রদীপ দেখল ওপাশে পাহাড়ের গা ধরে একটি গাড়ি স্বচ্ছন্দে যেতে পারে। লোকটা ঢুকেছে সেই পথে। সে পিছনে তাকাল। কোনও মানুষের অস্তিত্ব নেই। সামনেও কোনও গাড়ির আলো জ্বলছে না। অথচ সেইরকম কথা ছিল। মিলিটারি অফিসার তাকে ওইরকম আশ্বাস দিয়েছিলেন।

এইসময় তিনজন লোক বেরিয়ে এল অন্ধকার ফুঁড়ে সেই রাস্তা দিয়ে। তিনজনের হাতে অস্ত্র। একজন চিৎকার করল, ‘কে হাঁটতে পারছে না?’

‘আমি।’ গলা তুলে বলল প্রদীপ।

‘বাকিদের কি পায়ে বাত হয়েছে? অ্যাই, তোর নাম কী?’

এই প্রশ্নটাই শেষপর্যন্ত ওরা করবে তা জানত প্রদীপ। সে আচমকা গিয়ার পালটে অ্যাকসিলেটারে চাপ দিয়ে জিপটাকে সরু রাস্তায় নিয়ে গেল। হেডলাইটের আলোয় তিনটে মুখ আচমকা ভয়ার্ত হয়ে উঠল। পাহাড়ের দিকে সরে যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। পেছনের দিকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে ওরা ঝাঁপ দিল যেদিকটায়, সেদিকে শুধুই শূন্য। তিনটে মানুষের আর্তচিৎকার শোনা গেল রাতের নিস্তব্ধতা চূর্ণ করে।

আর তখনই গুলি ছুটে আসতে লাগল সামনে থেকে। সামনের কাচ ভেঙে পড়তেই প্রদীপ কোনওমতে শরীরটাকে পেছনে নিয়ে এল। সামনের সিটে তখন গুলি বিঁধছে। প্রদীপ দ্রুত হাতে মোটরবাইকের দড়ির বাঁধন খুলতে চেষ্টা করছিল। বাঁধবার সময় খেয়াল করেনি এভাবে খোলা দরকার হতে পারে। হঠাৎ একটা চিৎকার শোনা গেল। কেউ একজন ধমকে গুলি না চালাতে বলছে। গুলি যখন বন্ধ হল তখন প্রদীপের মনে হল গলার স্বর যেন একটু চেনা-চেনা।

ততক্ষণে বাইকটাকে মুক্ত করে সে নিচে নামাতে পেরেছে। লোকগুলোর সঙ্গে তার একমাত্র আড়াল এখন জিপটা। ওরা নিশ্চয়ই এগিয়ে আসছে। বাইকে বসে সে স্টার্ট নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু পা উঠছে না তার। দুই পায়ে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। বাইক চালু করতে যতটুকু শক্তি পায়ে দরকার হয় তা জোগাড় করতে না পেরে সে সাইকেলের মতো বাইরের চাকা গড়িয়ে যেতে দিল। ঢালু রাস্তা বলে মোটরবাইকটা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছিল। সেই অবস্থায় ইঞ্জিন চালু করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল প্রদীপ।

পিচের রাস্তায় পড়ে সেগ্যাংটকের দিকে বাঁক নিল। এবং তখনই পেছনে গাড়ির আলোকে ছুটে আসতে দেখল সে। ঢালু পিচের পথ পেয়ে বাইক তখন বেশ জোরে ছুটছে। এবার সামনে থেমে গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসতেই ব্রেক চেপে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করল সে। বাইকটা থেমে যাওয়ামাত্র মাটিতে পা দিতেই আছাড় খেয়ে পড়ল প্রদীপ। হাঁটুর নিচ থেকে কোনও কিছু যেন তার অবশিষ্ট নেই। কোনওমতে বাইকটাকে টেনে-হিঁচড়ে রাস্তা থেকে অনেকটা সরে যাওয়ামাত্র ওপর থেকে একটার পর একটা মিলিটারি আর পুলিশের গাড়ি জায়গাটা পেরিয়ে চলে গেল। অর্থাৎ এতক্ষণে দ্বিমুখী অভিযান শুরু হল। ওরা ওকে বিশ্বাস করেনি তাই টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এতক্ষণে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার কথা ওর।

অন্ধকারে উঠে বসতে চেষ্টা করল প্রদীপ। হাত বোলাল পায়ে। তারপর জুতো খুলতে লাগল। দুটো পা দারুণ ফুলে গেছে। ভেজা জুতো বসে গেছে চামড়ায়। কোনওমতে জুতো-মোজা খুলে ফেলতেই ওপরে গুলির আওয়াজ শুরু হল। মাটিতে পা ঘষতে-ঘষতে মনে হল সাড় আসছে। কোনওমতে বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে সে উঠে বসে স্টার্ট নেওয়ার চেষ্টা করতেই থমকে গেল। অন্ধকারে কিছু একটা নড়ছে। একটা মানুষ। পাহাড় থেকে লাফিয়ে নিচে নামল। তারপর দৌড়তে লাগল সামনে। লোকটা ভালো করে দৌড়তে পারছিল না।

চট করে হেডলাইট জ্বালাল প্রদীপ। আতঙ্কিত লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। ওর হাতে একটা রিভলভার। ভদ্রলোকের ভয়ার্ত মুখ চিনতে অসুবিধে হল না তার। চটপট হেডলাইট নিভিয়ে দিয়ে সে শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে স্টার্ট নিতে চাইল। সঙ্গে-সঙ্গে বাইকটা চালু হয়ে গেল। প্রদীপ রাস্তায় নামল।

হেডলাইটের আলোয় লোকটাকে দৌড়তে দেখল সে।

সে বাইকের গতি বাড়াল। মুহূর্তেই লোকটি তার সামনে। রাস্তার একপাশে সরে যেতে-যেতে রিভলভার তাক করছে। কোনও চিন্তাভাবনা না করে বাইক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে লোকটার ওপর। একটুও চিৎকার করল না লোকটা। প্রদীপ দেখল সে বাইক সমেত শূন্যে ভেসে যাচ্ছে। পরক্ষণেই রাস্তায় পড়ল বাইকটা। সে প্রাণপণে হ্যান্ডেল দুটো ধরে রাখতে চেষ্টা করছিল। দুটো চাকা একসঙ্গে পড়ার পর বাইকটা লাফিয়ে উঠতেই আবার ব্যালেন্স রাখতে চেষ্টা করল প্রদীপ। পড়তে-পড়তে শেষ মুহূর্তে সোজা হয়ে বাইকটা ছুটে যেতে লাগল সামনে। প্রদীপ দাঁড়াল না। পিছন থেকে কোনও শব্দ ভেসে আসছিল না। দুহাতে বাইকটাকে আঁকড়ে ধরে সে স্পিড বাড়াতে লাগল। মিলিটারি অথবা পুলিশ জানতে পারলেই তার পেছনে ছুটে আসবে।

গ্যাংটক শহরে সে যখন পৌঁছাল তখন মধ্যরাত। বাস টার্মিনাসের পাশ দিয়ে ওপরে ওঠার সময় তার দৃষ্টি ঝাপসা। হঠাৎ যে লোকটা রাস্তার মাঝখানে চলে এসে হাত নাড়তে লাগল, তার শরীরের ওপর বাইকটা তুলে দিতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে ব্রেক চাপল সে। সঙ্গে-সঙ্গে ছিটকে পড়ে গেল প্রদীপ বাইক থেকে। পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

দু-দিন পরে যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন সে প্রথমে লিটনের মুখ দেখতে পেল। ছেলেটার মুখে দাড়ি, চোখে রাত জাগার চিহ্ন।

‘কেমন আছ গুরু?’

‘ভালো।’ নিশ্বাস নিল প্রদীপ।

‘আর একটু হলে তুমি আমাকে খতম করে দিয়েছিলে।’

প্রদীপের মনে পড়ল। বাস টার্মিনাসের কাছে যে লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিল সে যে লিটন তা বুঝতে পারেনি তখন, বোঝার ক্ষমতা ছিল না।

‘আমার পা?’ সে নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল।

‘বেঁচে যাবে। অল্পের জন্যে বেঁচেছে, হাঁটু থেকে কেটে ফেলতে হতো, ডাক্তার বলেছে।’

‘ওঃ।’ বুক থেকে স্বস্তি জড়ানো বাতাস বেরিয়ে এল।

‘গুরু?’

‘বল।’

‘একটা ছবি দ্যাখো।’ লিটন সন্তর্পণে একটা ফটোগ্রাফ তুলে ধরল। বরফের মধ্যে একটি লোক পড়ে যাচ্ছে, তার পাশে কোমল, দূরে বন্দুক হাতে একজন। লিটন বলল, ‘কাপুরের ফিল্ম ম্যানেজ করে নিয়েছি আমি।’

‘গুড। আমি এখন কোথায়?’

‘হাসপাতালে।’

‘পুলিশ?’

‘সব খুলে বলেছি আমি। এই ছবি দেখার পর ওরা সব মেনে নিয়েছে।’

‘সেই লোকটা?’

‘কোন লোক? কোমলের বাবা? নেই। ওকে পুলিশ মেরুদণ্ড ভাঙা অবস্থায় পরদিন রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দ্যাখে।’

‘যাচ্চলে। ফিরে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে কীভাবে বাঁচাব জানি না।’

‘বাঁচাবার দরকার হবে না। যে কিনছিল সে-ই তো নেই।’ লিটন হাত ধরল প্রদীপের। বলল, ‘গুরু। রেস্ট নাও এখন। কিন্তু তার আগে একটা সমস্যা আছে।’

‘কী সমস্যা?’

‘দুজন দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে।’

‘দুজন?’ ভাঁজ পড়ল প্রদীপের কপালে।

‘সুজাতা আর কোমল। কাকে আগে ঢুকতে বলব?’ লিটন ফাজিল হাসি হাসল।

চোখ বন্ধ করল প্রদীপ, ‘আমি এখন ঘুমাব। অনেকক্ষণ ঘুমাব। বাই।’

***