কাগজের ফুল – ৫

আবার হিন্দুস্থান পার্ক। ফিরতে রাত একটা বাজল।

কলাপী শুয়েই ছিল, কিন্তু জেগে ছিল বোধ হয়। আলো জ্বালতেই বিছানায় উঠে বসল।

এতক্ষণে ফেরার সময় হল তোমার? থমথমে মুখে কলাপী প্রশ্ন করলে।

জবাব দিলে না নায়ক। এ প্রশ্নের কী—ই বা জবাব দেবে?

রাত ক’টা বেজেছে খেয়াল আছে? কোথায় ছিলে এত রাত অবধি?

নায়ক চুপচাপ পোশাক বদলাতে লাগল।

কী, ভেবেছ কী তুমি? কলাপীর গলা এক পর্দা চড়ল।

কিছুই ভাবেনি নায়ক। অতএব চুপচাপ রইল। চোলির বোতাম আঁটতে আঁটতে কলাপী এবার উঠে এল বিছানা ছেড়ে। নায়কের বাহু ধরে নাড়া দিয়ে তীক্ষ্ন গলায় বললে, শুনতে পাচ্ছ?

তারপরেই যেন একটা শক খেয়ে সরে গেল। গলাটা আরো সরু করে বলে উঠল, তুমি মদ খেয়েছ!

ব্যাপারটাকে সহজ করে নেওয়ার জন্যে নায়ক বললে, হ্যাঁ, হোটেলে গিয়েছিলাম।

ও! রাত একটা অবধি হোটেলে কাটিয়ে এলে! চমৎকার!

নায়ক শান্ত ভাবেই বলার চেষ্টা করলে, হোটেলে কি কোনো ভদ্রলোক যায় না? এ নিয়ে এত রাগ করার কি আছে?

সঙ্গে কেউ ছিল নিশ্চয়?

আমি একাই ছিলাম।

একদিকের আঁকা ভুরু অল্প তুলে কলাপী বললে, এও বিশ্বাস করতে হবে?

তোমার ইচ্ছে।

কিন্তু এ বাড়িটা হোটেল নয় যে যখন খুশি আসবে। আমার দাদার অনুগ্রহেই এখানে বাস করছ, সেটা ভুলে যেও না।

নায়কের সবচেয়ে নরম জায়গায় চাবুক পড়ল। একটা অদ্ভুত হাসিতে তার ঠোঁটের কোণটা বেঁকে গেল। তারপর শুধু বললে, ভোলবার উপায় নেই।

কলাপী কেটে কেটে বলতে লাগল, আমার বন্ধুদের তুমি খারাপ বলছিলে না? তারা অন্তত হ্যাগার্ড মাতাল নয়।

ভেতর থেকে জ্বালা—করা একটা উত্তাপ বেরিয়ে আসতে চাইছিল। তাকে চেপে রেখে নায়ক বললে, এটা কিন্তু বাড়িয়ে বলছ রিনি! চেষ্টা করেও মাতাল আমি হতে পারিনি। বিয়ে করেও সবাই যেমন সুখী হতে পারে না, মদ খেয়েও তেমনি সবাই মাতাল হয় না।

কলাপী ফণা ধরে ফোঁস করে উঠল। বললে, কী বললে, বিয়ে আর মদের নেশা সমান?

সমান কিনা নিজেই ভেবে দেখো না। মদের নেশা থাকে একটা রাত, বিয়ের নেশা বড়জোর দেড় বছর!

ঘাড় বেঁকিয়ে কলাপী বললে, মাতলামো কোরো না! তোমার মতো পুরুষকে নিয়ে কোনো মেয়েই সুখী হতে পারে না।

এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল নায়ক। আবার সেই একই কথার প্রতিধ্বনি! কেউ সুখী হতে পারে না! কেউ সুখী নয়! তবে আর কেন চেষ্টা?

অসম্ভব শান্ত আর ক্লান্ত গলায় নায়ক বললে, তাই যদি বুঝে থাকো, বাঁধন খোলার আইন তো রয়েছে।

উদ্যত ফণা থেকে বিষ ছিটিয়ে ছিটিয়ে কলাপী বলতে লাগল, তা তো বলবেই! আমায় ডাইভোর্স করলে তোমার অনেক সুবিধে! এতক্ষণ হোটেলে যাকে নিয়ে কাটিয়ে এলে, তার সঙ্গে পাকা বন্দোবস্ত করতে পারো!

নায়ক আর পারলে না। হাতজোড় করে বলে উঠল, প্লিজ রিনি, চুপ করো। অনিমেষ না হয় বিদেশে, নিচে বুধন রয়েছে—বাবুর্চি রয়েছে—

কলাপী থামলে না। সরু গলার ধাতব আওয়াজে বলেই চলল, নিজের স্ত্রীকে খাওয়াবার ক্ষমতা যার নেই, হোটেলে ফুর্তি করার শখ কেন তার? নির্লজ্জ!

সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই নিয়ে নায়ক বারান্দায় বেরিয়ে গেল।

ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল সেই রাতেই। আরো ঘণ্টাখানেক পরে।

.

অন্ধকার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে নায়ক ভাবনার ডুবে গেছে।

অথচ ভাবনার কী—ই বা আছে? রোজগার নেই, সুতরাং সংসারের দায়দায়িত্ব নেই। স্ত্রীর ভালোবাসা নেই, অতএব ভালোবাসা হারাবার ভয়ও নেই। শুধু একটা ভাবনাই দড়ির আগুনের মতো ধিকিধিকি পোড়াচ্ছে। নায়ক আজ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে, কলাপী আর তার দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে এখন যা আছে, সেটা কেবল পরস্পরের প্রতি অসহ্য ঘৃণা। ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই। বাকি জীবনটা কি তাহলে সেই অসহ্য ঘৃণার সঙ্গে আপস করেই চলতে হবে? সেটা কি সম্ভব? মানুষ কি তা পারে?

ক্লান্ত—ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার। এখন যদি একটু ঘুমোতে পারত সে।

ঘুমের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুম এসে গেল। ঘুম ঠিক নয়, গাঢ় ক্লান্তির পাতলা তন্দ্রা।

ঠিক এই সময় শোনা গেল ভয়ার্ত চিৎকারটা।

চমকে জেগে উঠল। আবার চিৎকার! সরু ধাতব গলার। সঙ্গে সঙ্গে নায়কের মনে পড়ে গেল ঘরে কলাপী একা! স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠে নায়ক ছুটল। ঘরের কাছে পৌঁছবার পূর্বেই দুটো বিশ্রী শব্দ। দুটো গুলির আওয়াজ। হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল চিৎকারটা।

শোবার ঘরের দরজা খোলা। দরজার সামনে আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এক ছায়া—পুরুষ। মুখ ফেরাতেই রাস্তার বাতির একফালি আলো পড়ল তার মুখে।

গাল—ভাঙা রোগা তরুণ মুখ, পাতলা দাড়ি! কোথায় যেন দেখা—দেখা। হাতের মুঠোয় কি একটা জিনিস চকচক করছে!

আধ সেকেন্ডের জন্য থমকে গিয়ে নায়ক আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল আততায়ীর ওপর। নায়কের দেহভার সইতে পারল না সে, পড়ে গেল মেঝেয়। শুরু হয়ে গেল ধস্তাধস্তি। কিন্তু বড়জোর দু’মিনিট, তারপরেই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে লোকটা ছুট দিল। বারান্দার অপর প্রান্তে পৌঁছে অদ্ভুত কায়দায় সে রেলিং টপকে কার্নিশ ধরে ঝুলে পড়ল। দোতলার কার্নিশ থেকে বাগানের পাঁচিলে, পাঁচিল থেকে রাস্তায়। তারপর চোখের নিমেষে অদৃশ্য।

বারান্দার রেলিংয়ে ভর দিয়ে নায়ক তাকিয়ে রইল। আর, তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল ওই গালভাঙা রোগা তরুণ মুখ সে দেখেছে তিন বছর পূর্বে। পেয়ারাবাগান লেনে।

কিন্তু এতদিন বাদে কেন এল ভুলু? কেন এল কলাপীকে খুন করতে? তাহলে কলাপী কি আর বেঁচে নেই?

রেলিংয়ের ধার থেকে দ্রুত পায়ে সে আসতে লাগল ঘরের দিকে। পায়ে কি একটা ঠেকল। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে নায়ক দেখলে, ছোট একটা অটোমেটিক রিভলভার। ধস্তাধস্তির সময় ভুলুর হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল, কুড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ হয়নি।

শোবার ঘরে এসে পা দিল নায়ক। অন্ধকার। সেই অন্ধকারে জোড়া খাটের বিছানায় শরীরটাকে দুমড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে কলাপী। আলো জ্বালতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিলে নায়ক। ভয়ঙ্কর বীভৎস দৃশ্যটা সহ্য করতে পারবে না বলেই বোধহয়। শেষই হল তবে! রাত শেষ হওয়ার আগেই। কলাপী আর ভোর দেখবে না।

আশ্চর্য, বুধন আর বাবুর্চির কোনো সাড়া নেই এখনো!

.

আমাদের গল্প কোথা থেকে কোথায় এসে পড়েছে দেখুন!

আমাদের কিন্তু কোনো হাত নেই। গল্প বয়ে চলেছে নিজের আঁকাবাঁকা খাতে, নিজের খেয়ালে। একটা ঘটনার পাথরখণ্ডে ধাক্কা খেয়ে আরেকটা ঘটনায় গিয়ে পড়েছে। সেখান থেকে আরেকটায়। সঙ্গতি খোঁজবার চেষ্টা করবেন না। কারণ আজকের জীবনের সঙ্গতি নেই। মিল নেই আজকের সঙ্গে কালকের। আজকের যুগ বিবর্তনের নয়, পরিবর্তনেরও নয়। দিগ্বিদিক জ্ঞানহারানো দৌড়ের যুগ। সত্তর দশক হচ্ছে এমন একটা মোটরকার, যার অতীব শক্তিশালী ইঞ্জিন আর অ্যাকসিলিরেটর আছে; কিন্তু স্টিয়ারিং নেই, ব্রেক নেই। উন্মাদ গতিতে ছুটতে গিয়ে অন্ধের মতো বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। পরকে ভাঙছে, নিজেও ভেঙে পড়ছে।

রাজনীতি বলুন, সমাজ—ব্যবস্থা বলুন, শিক্ষা বা সাহিত্য বলুন, এমনকি ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও বলুন, আজকের সঙ্গে কালকের সঙ্গতি কোথায় খুঁজে পাচ্ছেন? অতএব আমাদের গল্পও যদি এলোমেলো হয়ে থাকে, আমাদের নায়ক—চরিত্রেও যদি সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া না যায়, সেটা আর এমন কি দোষের? নায়ক—নায়িকার প্রণয়—কাহিনি চলতে চলতে হঠাৎ আজ খুনের ঘটনায় পৌঁছেছে। তাতেই বা অবাক হওয়ার কী আছে? বর্তমান কালে খুন তো সবচেয়ে স্বাভাবিক কাণ্ড, সবচেয়ে নিরুত্তাপ ঘটনা।

কলাপী যখন খুন হয়েছে, তখন পুলিশ আসবে জানা কথা।

সকাল হতেই পুলিশ এল হিন্দুস্থান পার্কের মজুমদার বাড়িতে। কলাপীর লাশ দেখল। একটা গুলিই লেগেছে। বুকের ঠিক মাঝখানে নয়, একটু বাঁ দিক ঘেঁষে। গায়ের রঙে মিশিয়ে—থাকা ফিকে—হলুদ চোলি কালচে গাঢ় রক্তে ভিজে চটচটে হয়ে আছে।

শুধু কলাপীর লাশ নয়, শোবার ঘরটায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল পুলিশ। ফোটো তুলল। নায়কের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনল। আততায়ীর নাম, চেহারার বর্ণনা আর পরিচয় জানল। তার অটোমেটিক রিভলভারটা নিল সাবধানে। বাইরে থেকে হুড়কো—দেওয়া একতলার ঘরে আটক বুধন আর বাবুর্চিকে উদ্ধার করল। জেরা করল আলাদা আলাদা ভাবে। তারপর ময়না তদন্তের জন্যে কলাপীর লাশ চালান দিয়ে পুলিশও চলে গেল।

কিন্তু এসব পুলিশের ছকে—বাঁধা কাজ। এ নিয়ে আমাদের গল্পের প্রয়োজন নেই। আমাদের গল্প এখন ফেরার আততায়ী ভুলুকে খুঁজছে। চাইছে জমাট সাসপেন্স।

দুঃখের বিষয়, তাও তেমন জমাট বাঁধল না। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি, তিন দিনের মাথায় গুপ্ত আস্তানা থেকে পুলিশ ভুলুকে ধরে নিয়ে এল থানায়।

সত্তর দশকের ছেলে ভুলু। ভয়—ডর জানে না। পুলিশের জেরার উত্তরে সোজাসুজি স্বীকার করলে, হ্যাঁ, আমি খুন করতে গিয়েছিলাম। আমিই খুন করেছি। না, টাকা বা গয়নার লোভে নয়, আমার দিদির আত্মহত্যার বদলা নেব বলে। তিন বছর জেলে ছিলাম, তাই দেরি হয়ে গেল। নইলে অনেক আগেই খতম করতাম।

অফিসার বললেন, তোমার দিদির আত্মহত্যার সঙ্গে কলাপী দেবীর সম্পর্ক কি!

ভুলু বললে, আমার দিদির জায়গায় তিনিই তো উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন। কলাপী দেবী বড়লোকের মেয়ে, তাঁকে বিয়ে করার সুযোগ পেয়ে আমার দিদির জীবনটা বরবাদ করে দিল দ্যাট বাগার! ইচ্ছে ছিল, স্বামী—স্ত্রী দুজনের জন্যেই দুটো গুলি খরচ করব। কিন্তু ব্যাড লাক, বিছানায় একজনকে পেলাম, আরেকজনকে পেলাম না। আর কিছু জানতে চান?

এ রিভলভারটা তোমার?—অটোমেটিকটা দেখালেন অফিসার।

হ্যাঁ, এটাই।

পেলে কোত্থেকে?—অফিসার প্রশ্ন করলেন।

নির্বিকার মুখে ভুলু জবাব দিলে, ওটা ফালতু কোশ্চেন। ফালতু কথার জবাব আমি দিই না। খুন করেছি বললাম—ব্যস!

পাঠক, এত সহজ স্বীকারোক্তির পর সাসপেন্সের চমক আর কি করে থাকে বলুন? আমাদের গল্প না হল সামাজিক কাহিনি, না হল রহস্য—কাহিনি। এ গল্প কোন জাতের, আপনারাই ঠিক করুন।

তবে একেবারে হতাশ হবেন না। জীবন চিরকালই গল্প—উপন্যাসের চেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর, বেশি রহস্যময়। একটা সাধারণ জীবনের মধ্যে যে সাসপেন্স, যে অদ্ভুত চমক লুকিয়ে থাকে, বানানো গল্পে তা মেলে না।

এ গল্পে সেইটুকুই শুধু বাকি।

.

মানুষ মরে, কিন্তু আশা মরে না।

আজ যেখানে হতাশ্বাসের অন্ধকার, কাল সেখানে নতুন আশার বাতি জ্বালবার চেষ্টা। হাওয়ার মুখে দেশলায়ের কাঠি যতবার নিভে যায়, ততই মনে হয় পরের কাঠিটা নিশ্চয় জ্বলবে। ভাগ্যের মার যে খেয়েছে, সেই চায় ভাগ্যকে আরেকবার পরীক্ষা করতে।

জীবনের আরেক নাম আশা।

আমাদের গল্পের নায়কও তাই ভাবছে, জীবনটাকে নতুন করে গড়লে কেমন হয়? অবশ্য এত বড় বিপর্যয়ের পরে তার বৈরাগ্য আসা উচিত ছিল। উচিত ছিল কোনো আশ্রমে—টাশ্রমে সংযুক্ত হয়ে বাকি দিন ক’টা ‘কা তব কান্তা’ ইত্যাদি পড়ে কাটিয়ে দেওয়া। কিন্তু যা উচিত, সংসারে কি তাই হয়? অন্তত আমাদের গল্পের গোড়া থেকেই তা হচ্ছে না। মানুষের কামনা—বাসনা জীবন—তৃষ্ণা এমনই সত্য ও স্বাভাবিক যে, কোনো সজীব মন তাকে অস্বীকার করতে পারে না।

দূর্বা মরেছে, কলাপী মরেছে, মুক্তার যা হয়েছে, সেও এক রকম মৃত্যু। নায়কের বত্রিশ বছরের যৌবন এখনো মরেনি। ভাগ্যের মার খেয়েও সে আবার ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইছে। জীবনকে নতুন করে গড়তে চাইছে। সবচেয়ে আশ্চর্য, সুখী হতে চাইছে।

সুখের আশাই বোধ হয় সুখ।

কলকাতায় অসহ্য হয়ে উঠেছে। বিষিয়ে উঠেছে নগর—সভ্যতা। এখানে আর নয়, নায়ক চলে যাবে নগর থেকে দূরে—কোনো গণ্ডগ্রামে। অতি—সাধারণ চাষি বা শ্রমিক হয়ে থাকবে। সেই হাজার জনের মধ্যে মিশে—যাওয়া কোনো সঙ্গিনী যদি খুঁজে পায়, দু’হাত বাড়িয়ে তাকে গ্রহণ করবে। তার দায়িত্ব নেবে। তার বিশ্বাসের মান রাখবে। তাকে সুখী করবে।

নায়ক আর বড় হতে চায় না। চায় না বড়লোক হতে। চায় না চাকরির উন্নতি, সামাজিক পদমর্যাদা, সুন্দরী স্ত্রীর স্বামী হওয়ার মূঢ় গর্ব। সে শুধু চায় সুখী করতে আর সুখী হতে।

গতকাল বিদেশ থেকে ফিরেছে অনিমেষ। তার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর্বও শেষ হয়েছে। আজ সে চলে যাবে। সকালে নিজের সামান্য জিনিসপত্র গোছগাছ করতে করতে নয়া জমানার নায়কের বাস্তববাদী মন স্বপ্ন দেখছে: আম—কাঁঠালের ছায়া—মেটে ঘর—পুকুরঘাটে বাসনের পাঁজা নিয়ে বউ—উঠোনে দামাল উলঙ্গ শিশু—

ঠিক এই সময় থানা—অফিসার এলেন। সঙ্গে অনিমেষ।

কি খবর অফিসার?

অফিসার বললেন, একটু বিরক্ত করতে এলাম। গোটা কয়েক প্রশ্ন আছে।

বেশ তো, বলুন।—হাতের কাজ বন্ধ করলে নায়ক।

আচ্ছা, সে—রাতের ঘটনাটা ঘটতে কতক্ষণ সময় লেগেছিল বলতে পারেন? বেশিক্ষণ নয় নিশ্চয়?

তিন মিনিট বড়জোর। নায়ক জবাব দিলে।

ভুলু সোম কোথা থেকে গুলি চালিয়েছিল বলুন তো?

নায়ক বললে, এ তো পুরানো প্রশ্ন। সব কথাই আগে জানিয়েছি।

একটু কিন্তু হয়ে অফিসার বললেন, আরেকবার ভালো করে জেনে নিতে চাই। ভুলু কি ঘরে ঢুকে এসেছিল?

না, দরজার চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে সে ফায়ার করেছিল।

ও। আচ্ছা, ক’বার গুলি করেছিল মনে আছে?

তিনবার।

পর পর, না থেমে থেমে?

দুটো গুলি পর পর। তৃতীয়টা কিছু পরে।

কতক্ষণ পরে?

অসহিষ্ণু গলায় নায়ক বললে, মিনিট পাঁচ—সাত হবে। কিন্তু আর কেন অফিসার? এসব কথা আমার নার্ভে কতখানি ঘা দেয়, তাও কি বুঝিয়ে বলতে হবে? ভুলু সোম যখন নিজেই কবুল করেছে—

না। অফিসারের গলার আওয়াজটা এবার বদলে গেল। অত্যন্ত নীরস গলায় বললেন, ভুলু সোম কলাপী দেবীকে খুন করেনি।

সেকি! চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল অনিমেষ।

হ্যাঁ। ভুলু খুন করতে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অন্ধকারে তার গুলি আপনার বোনের গায়ে লাগেনি। ভুলু নিজেও একথা জানে না।

তাহলে কলাপীকে খুন করল কে? জীবন্ত মমির মতো ঠোঁট নেড়ে প্রশ্ন করলে নায়ক।

সেটা আপনার চেয়ে ভালো কে জানে?

কি বলতে চান অফিসার?

কলাপী দেবীকে খুন করার চার্জে আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করলাম।

অফিসারের গম্ভীর আওয়াজ সারা ঘরে গমগম করতে লাগল।

রুখে উঠল অনিমেষ: কী বলছেন অফিসার! বুঝে—সুঝে কথা বলুন।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নায়ক বললে, কিসের ওপর ভিত্তি করে আমার বিরুদ্ধে চার্জ আনলেন? কি প্রমাণ পেয়েছেন?

অফিসার বললেন, প্রমাণ কোর্টেই দাখিল করা নিয়ম। তবু চ্যালেঞ্জ যখন করলেন, তখন বলছি। প্রথম প্রমাণ: আপনি নিজেই বলেছেন, ভুলু গুলি ছুড়েছিল দরজার চৌকাঠের কাছ থেকে। দরজা থেকে শোবার খাট অন্তত বিশ হাত দূরে। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাত্র চার—পাঁচ হাত তফাত থেকে গুলি করা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রমাণ: আপনি স্বীকার করেছেন, সমস্ত ঘটনাটা ঘটতে সময় লেগেছিল বড়জোর তিন মিনিট। তাহলে আরো পাঁচ—সাত মিনিট পরে তৃতীয় গুলিটা ভুলু সোম ছোড়ে কি করে? সে তো তিন মিনিট বাদেই পালিয়েছিল! ঘটনাস্থলে তখন আপনি ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিল না। এবার অঙ্ক মিলিয়ে দেখুন তো খুনি কে?

নায়ক প্রশ্ন করলে, কিন্তু রিভলভারে কার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে? আমার, না ভুলুর?

কারো ছাপই পাওয়া যায়নি। আমার সন্দেহের প্রথম কারণ সেটাই। নিজের আঙুলের ছাপ মুছতে গিয়ে আপনি ভুলু সোমের ফিঙ্গারপ্রিন্টও মুছে ফেলেছেন।

নিশ্চল পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নায়ক। আর, অনিমেষ আস্তে আস্তে আবার চেয়ারে বসে পড়ল।

অফিসার বললেন, অনিমেষবাবু, আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। আঘাতের ওপর আঘাত দিতে হল বলে আমি দুঃখিত।

অনিমেষ যেন হঠাৎ বুড়ো হয়ে গেছে। বিষণ্ণ ভারি গলায় ধীরে ধীরে বললে, কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারছি না কিছু—কলাপীকে ও মেরে ফেলল কেন? কোন স্বার্থে? কি কারণে?

অফিসার বললেন, কারণটা আপনার জানবার কথা নয়। কেননা, বেশির ভাগ সময় আপনি থাকেন বিদেশে। কখনো কি খোঁজ রেখেছিলেন, স্বামী—স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন ছিল? আপনাদের বেয়ারা বুধনকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারতেন, ওঁদের দাম্পত্য সম্পর্কটা কতখানি তিক্ত হয়ে উঠেছিল।

শোনা গেল কি গেল না এমন আওয়াজে অনিমেষ শুধু বললে, আশ্চর্য!

অফিসার বললেন, খুন করতে এসে ভুলু সোমের পালিয়ে যাওয়া অবধি আমরা জানতে পেরেছি। তারপর থেকে ঘটনাটা মোটামুটি অনুমান করলে যা দাঁড়ায়—

আমিই বলছি।

নিষ্প্রাণ রক্তহীন মুখে নায়ক হঠাৎ বলে উঠল। হাজার ফিট খাদে গড়িয়ে পড়তে পড়তে যেমন জ্ঞান থাকে, অথচ অনুভূতি অসাড় হয়ে যায়, তেমনি নিরাবেগ যান্ত্রিক গলায় নায়ক বলতে লাগল, সবই যখন জেনেছেন, তখন বাকিটুকুও শুনুন। মোটামুটি অনুমান করে লাভ কি? যা সত্যিকার ঘটেছিল, তাই বলছি:

.

অদ্ভুত কায়দায় রেলিং টপকে ভুলু ঝুলে পড়ল। বারান্দার কার্নিশ থেকে বাগানের পাঁচিলে। পাঁচিল থেকে সদর রাস্তায়। তারপর চোখের নিমেষে অদৃশ্য। রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নায়ক আকাশ—পাতাল ভাবতে লাগল। ভুলু সোম কি কলাপীর জুয়েলারি বাক্সের লোভে এসেছিল? কি জন্যে এল খুন করতে? কলাপী তাহলে শেষ হয়েই গেল!

আর ভাবতে পারলে না নায়ক। দ্রুত পায়ে ঘরের দিকে এগোল। চলতে চলতে পায়ে কি যেন একটা ঠেকল। অন্ধকারেও চকচক করছে। কুড়িয়ে নিয়ে দেখলে, ছোট একটা অটোমেটিক রিভলভার। ধস্তাধস্তির সময় ভুলুর হাত থেকে ছিটকে পড়েছে।

শোবার ঘরে পা দিয়েই থমকে গেল নায়ক। বেডসুইচ থাকা সত্ত্বেও আলো জ্বালেনি কলাপী, আততায়ীর ভয়ে ঘাবড়ে গিয়েই হয়তো জ্বালেনি। রাস্তার বাতির তেরছা আলোর আভাসে অন্ধকার যেটুকু ফিকে হয়েছে, তাতেই দেখা যাচ্ছে জোড়া খাটের বিছানায় কলাপীর দেহটা দুমড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে!

শেষ! একেবারে শেষই হয়ে গেছে তাহলে! আলো জ্বলতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিলে নায়ক। ভয়ঙ্কর একটা বীভৎস দৃশ্য সহ্য করতে পারবে না বলে।

হঠাৎ অন্ধকার কথা কয়ে উঠল, পালিয়ে গেল ডাকাতটা?

চমকে উঠল নায়ক। নিষ্পলক চোখ মেলে দেখলে, বিছানায় উঠে বসেছে কলাপী।

অজান্তে নায়কের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল: তুমি বেঁচে আছ!

সরু গলায় শ্লেষ মিশিয়ে কলাপী বললে, খুব হতাশ হয়েছ, না? ভেবেছিলে জন্মের মতো আপদ গেছে!

গায়ে কোথাও লাগেনি তো?—নায়কের গলায় উদ্বেগ।

কলাপী তেমনি বিদ্রুপ করে বললে, লাগলে তুমি খুশি হতে জানি। কিন্তু ভাগ্য তোমার ওপর বিরূপ!

আঃ, কী যা—তা বলছ রিনি! বাকি রাতটা আর কেন তেতো করছ?

তোমার মনের কথাগুলো টেনে বলছি বলেই তেতো লাগছে! সত্যি, তোমার এমন চমৎকার প্ল্যানটা ভেস্তে গেল!—ধাতব আওয়াজে হাসল কলাপী।

হতবুদ্ধি হয়ে নায়ক বললে, আমার প্ল্যান! কি প্ল্যান?

কলাপীর গলা তীক্ষ্নতর হল। বললে, ন্যাকামি কোরো না! তোমার মতলব আমি বুঝতে পারিনি ভেবেছ? নিজের হাতে আমাকে খুন করলে তুমি বিপদে পড়তে পারো, তাই ভাড়া—করা গুন্ডা লাগিয়েছিলে!

আমি গুন্ডা লাগিয়েছি তোমাকে খুন করার জন্যে?

অসহ্য বিস্ময়ে, অসহ্য যন্ত্রণায় নায়কের মাথা ঝিমঝিম করে উঠল।

কলাপী বললে, ডাইভোর্স যখন আমি দেব না, তখন গুন্ডা লাগানো ছাড়া তোমার রেহাই পাবার উপায় কী?

রিনি, এ তুমি বিশ্বাস করতে পারলে!

আরেক পর্দা গলা চড়িয়ে কলাপী বললে, থাক, আর অভিনয়ে কাজ নেই। গুন্ডাটাকে দেখে আমি যখন ভয়ে ‘কে’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম, সে তখন কি বললে জানো? দাঁতে দাঁত চেপে বললে, ‘তোমার সুখের জীবন খতম করে দিতে এসেছি!’ আমার সুখের জীবন খতম করতে তুমি ছাড়া দুনিয়ায় কার এত আগ্রহ? জীবনে আমায় সুখী করেছ কোনোদিন?

তীব্র রাগে আর চেপে—রাখা কান্নায় কলাপীর গলার স্বর আরো ধারালো হয়ে উঠল।

ঘরে আলো থাকলে দেখা যেত, অসহ্য যন্ত্রণায় নায়কের মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। কলাপীর সরু ধাতব আওয়াজে তার ক্লান্ত স্নায়ুমণ্ডলী ঝনঝন করে উঠছে। অস্থির গলায় সে বলে উঠল, রিনি, রিনি, চুপ করো—দোহাই তোমার, চুপ করো!

নিষ্ঠুরের মতো কলাপী বললে, না, চুপ করব না! দুনিয়াকে জানিয়ে দেব তোমার এই কীর্তির কথা! বলে দেব, স্বামী হয়ে তুমি স্ত্রীকে—

শোনো রিনি, শোনো!—মরিয়া হয়ে নায়ক তাকে থামাবার চেষ্টা করলে, তোমাকে খুন করার মতলব করে কী লাভ আমার বলতে পারো? কী স্বার্থ?

কী স্বার্থ, জানো না, না?—যেন বিষাক্ত ছুরি দিয়ে কেটে কেটে কলাপী বলতে লাগল, দিনের পর দিন আমার দাদার কাঁধে চেপে দিব্যি খাচ্ছ—দাচ্ছ, আর লজ্জায় অপমানে আমার মাথা হেঁট করে দিচ্ছ! এই তো তোমার জীবন! এবার আমায় খুন করতে পারলেই যা কিছু আমার, সর্বস্ব তোমার মুঠোয়! আবার বলছ কী স্বার্থ? তুমি মানুষ? তুমি ইতর, তুমি লোফার! ঘেন্না করি—তোমায় আমি ঘেন্না করি!

নায়কের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল প্রচণ্ড যন্ত্রণায়। কলাপী তাকে ঘৃণা করে! বেকার স্বামীর জন্যে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই তার। সারা জীবন স্ত্রীর ঘৃণার সঙ্গে আপস করে চলা—স্ত্রীর ঘৃণার কাছে মাথা হেঁট করে থাকা কি সম্ভব? কোনো স্বামী কি তা পারে? দুনিয়ার কাছে বেকারের কোনো মূল্য নেই, সম্মান নেই। দুনিয়ায় কোনো মায়া—মমতা—ভালোবাসা নেই বেকারের জন্য। কিন্তু নিজের স্ত্রীর কাছেও নেই? তবে আর কেন এ প্রহসন? সাজা রাজা—রাণির মতো কেন মিথ্যে স্বামী—স্ত্রী সেজে থাকা? হয়ে যাক এই ঠাট্টার ইতি।

একেবারে শান্ত হয়ে গেল নায়ক। বুকের মধ্যে সেই অসহ্য অস্থির যন্ত্রণাটাও যেন শান্ত হয়ে গেল। শুধু দপদপ করতে লাগল কপালের দু’পাশের রগ দুটো। স্থির গলায় নায়ক বললে, তা হলে আর নয় রিনি। পরস্পরের কাছ থেকে এবার আমাদের রেহাই নেওয়াই দরকার।

ফুঁসে উঠল রিনি, না, কিছুতেই না। তোমার জন্যে সমাজের মুখ হাসাব, এ—আশা ভুলেও কোরো না।

কপালের রগ দুটো ভীষণ দপদপ করছে। রক্তের চাপে যেন ফেটে পড়বে। গলার স্বর আরো শান্ত অথচ স্পষ্ট করে নায়ক বললে, রেহাই তোমাকে দিতেই হবে রিনি। দিতেও হবে, নিতেও হবে।

কক্ষনো না! রেহাই তোমাকে জীবনে দেব না।

দিতেই হবে রিনি! দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে নায়ক বললে।

অন্ধকারে কলাপী দেখতে পেল না নায়কের মুঠোয় অটোমেটিকটা তারই বুক লক্ষ্য করে স্থির হয়ে আছে। চিৎকার করে সে বললে, না—না—না! আমাকে মেরে না ফেললে তুমি রেহাই—

কথাটা আর শেষ হল না। এক ঝলক আগুন চিৎকারকে থামিয়ে দিল। কলাপী রেহাই দিয়েও গেল। রেহাই নিয়েও গেল।

.

আমাদের গল্প এইখানেই থেমে গেছে। এই বিশ্রী পরিণতিতে এসে থেমে যাওয়া ছাড়া গল্পের আর উপায় কি বলুন? নায়কের বত্রিশ বছর বয়সের জীবন—মোটর হঠাৎ ব্রেক ফেল করে প্রচণ্ড ধাক্কায় চুরমার হয়ে যাবে, তা কি আমাদের নায়কই জানত? এ যুগের কোনো নায়ক কি জানে?

চলুন, আমাদের নায়কের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করে আসি। না, দুঃখ প্রকাশ করতে বা সমব্যথা জানাতে নয়। ও—সবের কোনো প্রয়োজন নেই তার। আত্মগ্লানি বা অনুশোচনার ধার ধারে না সে। জীবনে সে আজ প্রথম হালকা বোধ করছে! সব বোঝা তার হালকা হয়ে গেছে, কেবল কর্তব্য আর দায়িত্বের বোঝা নয়, কত সুখের ভাবনা, কত সুখের কামনা, কত সুখের স্বপ্ন—সব কিছুর বোঝা। জীবনে আজ আর সুখের প্রত্যাশা নেই। সে নিশ্চিন্ত। পরম নিশ্চিন্ত।

ঝাঁ ঝাঁ করছে রাত। বাইরে শুধু ওয়ার্ডারের ভারি বুটের শব্দ।

জেলের সেল—এ বসে বসে নিজের কথাই ভাবছে নায়ক। ভাবছে, কেন সে সুখী হতে পারল না? চেষ্টা তো করেছিল সে। সুখের তিনটি উপকরণ টাকা নারী প্রেম—তাও পেয়েছিল জীবনে। তবু কেন সুখী হতে পারল না? যা চাইল, তা পেল না। যা পেল, তাও রইল না।

নিজের থেকে সরে এসে নিজেরই পানে ফিরে তাকাল নায়ক।

তার স্বাস্থ্য ছিল, শিক্ষা ছিল, মন ছিল, প্রেম ছিল। আর ছিল জীবনে সুখী হওয়ার প্রবল তৃষ্ণা। মুক্তাকে সে কি ভালোবাসেনি? ভালোবাসেনি দূর্বাকে? সহস্র ভালোবাসা কি দেয়নি তার বিবাহিত স্ত্রী কলাপীকে? তবু কী হল? তার অস্থির যাযাবর যৌবন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে মুক্তার কাছ থেকে দূর্বার পাশে, দূর্বার পাশ থেকে কলাপীর বাহুবন্ধনে। তারপর ছিটকে পড়ল বিশাল শূন্যতায়! একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল জীবনটা। শুধু হা হা করছে অসীম তৃষ্ণা!

লা বোহেমিয়া হোটেলে বসে মাতাল মুক্তা বলেছিল, ‘দুনিয়ায় কেউ বোধ হয় সুখী নয়।’ সেই কথাটা আজ বারবার মনে পড়ছে নায়কের। কে সুখী হল? নায়ক, মুক্তা, দূর্বা, কলাপী, ছোট থাপার, জ্যাঠামশাই, ভুলু সোম, অনিমেষ—কেউ তো সুখী হতে পারল না! কেন? কি দোষে? কার দোষে?

পাঠক, নায়ক বোধ করি আপনাদের প্রশ্ন শুনতে পেল। মুখ তুলে বললে, দোষ কারো নয়। দোষ এই অন্ধ আত্মঘাতী যুগের। এ যুগে শিক্ষা আছে, আদর্শ নেই। মন আছে, বিবেক নেই। প্রবৃত্তি আছে, সংযম নেই। প্রেম আছে, শ্রদ্ধা নেই। সর্বোপরি কোনো কিছুতেই বিশ্বাস নেই। তাই সুখী হওয়াও যায় না, সুখী করাও যায় না। আমি এ যুগের নায়ক, আমাকে নিয়ে গল্প লিখতে বসে আপনারা ভুল করেছেন। গল্প বিফল হবেই। কেননা, এ যুগটাই বিফলতার যুগ!

একটু চুপ করে থেকে নায়ক আবার বললে, আচ্ছা, সুখটা কি বলতে পারেন আপনারা? সুখ নামে একটা চমৎকার রঙিন ফুল দেখে আমরা সবাই হাত বাড়িয়ে ছুটছি। কাছে গিয়ে দেখছি, সেটা রঙ—করা একটা কাগজের ফুল!

সমাপ্ত