৪
কাল থেকে দূর্বা অপেক্ষা করে আছে! অনিমেষের বাড়ি যাবে কি যাবে না ভাবছিল নায়ক। না যাওয়াটা কিন্তু অভদ্রতা, পুরানো বন্ধুত্বের অমর্যাদাও বটে। আর, চলে যাওয়ার সময় কলাপী মজুমদারের সেই চাউনির অর্থটাই বা কি? শুধু চাউনি নয়, মেয়েটা নিজেও অদ্ভুত!
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অনিমেষ মজুমদারের বাড়ি বালিগঞ্জ হিন্দুস্থান পার্কে। কলেজ—দিনে দু’চারদিন গিয়েছিল নায়ক। তখন অবশ্য কলাপীর দেখা পাওয়া যেত না।
সন্ধ্যা পার করে নায়ক পৌঁছল। অনিমেষ ড্রইংরুমেই ছিল। খুশি মুখে বললে, আরে, এসো, এসো! ভাবছিলাম, বুঝি আসবে না।
কেন?
রিনি বললে কাল তুমি নাকি ওর ওপর রাগ করেছিলে।
হাসলে নায়ক। বললে, সেকি! আমিই বরং ভেবেছিলাম, তোমার বোন আমার ওপর চটে গেছেন।
সিগারেট কেস এগিয়ে দিয়ে অনিমেষ বললে, ওর কথায় কিছু মনে কোরো না। দুমদাম করে ও কখন কি বলে, খেয়াল থাকে না। যাক, এখন কি খাবে বলো? একটু কফি চলুক?
চলুক।
অনিমেষ ভেতরে চলে গেল। একটু পরে ঘরে ঢুকল কলাপী, পেছনে চাকরের হাতে কফির ট্রে। শ্যাওলা রঙের পাতলা শাড়ি নাভির নিচে পরা, কোমর যে কত সরু বুঝতে অসুবিধা হয় না, হাত—কাটা একটুকরো চোলি উত্তুঙ্গ যৌবনকে কোনোমতে সামলে রেখেছে। চোখে হালকা কাজল, রঙ—করা পুরন্ত ঠোঁটে আরক্ত আগুন।
কয়েক মুহূর্ত পলক ফেলতে ভুলে গেল নায়ক। উনত্রিশ বছরের পরুষ যৌবন তার কানে কানে বললে, নারী বলতে যদি শুধু দেহ বোঝায়, তবে কলাপী আদর্শ নারী।
কোনো সম্ভাষণ নয়, শুধু নমস্কারের ভঙ্গি করলে কলাপী। তারপর পট থেকে কাপে কফি ঢালতে ঢালতে আড়চোখে তাকিয়ে মিহি সুরে বললে, রাগ পড়েছে?
নায়ক বললে, রাগ কার? আমার, না আপনার?
মিহি আওয়াজ আরো মিহি হল: আমার রাগ কোথায়? রাগ, মেজাজ, অহঙ্কার—এসব তো পুরুষদেরই একচেটে। মেয়েরা তাদের পাঁজরা থেকে তৈরি, মেয়েদের কি রাগ করা সাজে?
মনে মনে কৌতুক বোধ করে নায়ক বললে, নাঃ, রাগটা আপনার এখনো পড়েনি দেখছি!
কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে কলাপী বললে, জানেন, আমার সঙ্গে কেউ কখনো আপনার মতো খোঁচা দিয়ে কথা বলতে সাহস করেনি!
আমি না হয় দুঃসাহসী বদনাম কিনলাম!—আরো কৌতুক বোধ করে নায়ক বললে।
কলাপী বললে, আচ্ছা, কিসের জন্যে আপনার এত অহঙ্কার বলুন তো? দেখতে ভালো আর স্মার্ট বলে?
কপট অনুনয় করে নায়ক বললে, দয়া করে এ কথাটা লিখে দিন। সার্টিফিকেটটা আমার কাজে লাগবে।
এবার হেসে ফেললে কলাপী। আঁকা ভুরু বাঁকা করে বললে, মেয়েমহলেই কাজে লাগাতে চান তো? কিন্তু সরি, এক মেয়ের সার্টিফিকেট অন্য মেয়ের কাছে চলে না।
তবু নৃত্যপটিয়সী যশস্বিনী কলাপী মজুমদারের সার্টিফিকেটের দাম আছে বইকি!
কাজল—টানা চোখে তির্যক দৃষ্টি হেনে কলাপী বললে, আবার খোঁচা দিয়ে কথা।
কিরে, কি হল?—ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অনিমেষ বললে।
কলাপী বললে, তোমার বন্ধুটি ভারি ঝগড়াটে রাঙাদা!
বটে! এক কাজ কর রিনি। তুই দু’একখানা গান শোনা, তাহলেই ও ঝগড়ার চান্স পাবে না।
বয়ে গেছে আমার!—সারা শরীরে ঢেউ তুলে কলাপী দ্রুত চলে গেল।
.
খাওয়া—দাওয়া মিটতে রাত দশটা বাজল।
অনিমেষ দিলদার লোক। তিন ঘণ্টার হাসি—গল্পে সে সাত বছরের ফাঁকটুকু অনায়াসে পার হয়ে গেল। নায়কের সঙ্গে যেন রোজই দেখা হয় তার।
খাবার ঘর থেকে আবার বসবার ঘরে। তিনজনে আরো আধ ঘণ্টার মজলিশ। তারপর নায়ক বললে, এবার চলি অনিমেষ।
অনিমেষ উঠে দাঁড়িয়ে বললে, হ্যাঁ, চল যাই।
তুই আবার কোথায় যাবি এখন?
তোকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসি।
কি দরকার? আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই।
চল না, তোর ফ্ল্যাটটা চিনে আসি। জাস্ট এ মিনিট, গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বার করি।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল নায়ক।
আপনার সন্ধেটা আজ নষ্ট হয়ে গেল বোধ হয়?
নায়ক ফিরে তাকিয়ে দেখলে, কলাপী ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
নষ্ট হবে কেন?—নায়ক বললে।
কত ভালো ভালো মেয়ের সঙ্গ ছেড়ে একটা ঝগড়াটে মেয়ের সঙ্গে কাটালেন বলে।
মৃদু হেসে নায়ক বললে, আমি ঝগড়াটে মেয়েই পছন্দ করি। বিশেষ করে সে—মেয়ে যদি সুন্দরী হয়।
বাঁকা চোখে তাকিয়ে কলাপী বললে, থাক, স্তুতি—বিদ্যেটা খুব জানা আছে দেখছি! আবার কবে আসা হবে?
অনিমেষ তো কাল ফরেনে চলে যাচ্ছে, কাজেই—
অনিমেষ ছাড়া এ—বাড়িতে আর কেউ থাকে না বুঝি?—কলাপীর কাজল—টানা চোখে দেখা দিল সেই অদ্ভুত চাউনি। আর রক্তপলাশ—ঠোঁটে নেশা—ধরানো হাসি। ঈষৎ ঘাড় বেঁকিয়ে সে আবার বললে, না হয় ঝগড়া করতেই আসবেন।
বুকের সন্নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে কলাপী। গা থেকে একটা বিদেশি সেন্টের অতি মৃদু সুগন্ধ বেরোচ্ছে। একটা নতুন মাদকতায় ঝিমঝিম করে উঠল উনত্রিশ বছরের উগ্র যৌবন। নায়কের একখানা হাত সরু কোমর বেষ্টন করে আকর্ষণ করতেই, মিহি গলায় ফিসফিস করে কলাপী বললে, এই, রাঙাদা আসছে!
মুহূর্তে সরে গেল হাতখানা। আর, হঠাৎ—আসা বৃষ্টির মতো হাসতে হাসতে কলস্বরা কলাপী ছুটে পালিয়ে গেল।
অনিমেষ অবশ্য ঠিক তখনই গাড়ি নিয়ে এল না। এল আরো একটু বাদে।
যেতে যেতে এ—কথা সে—কথার পর অনিমেষ বললে, রিনিকে কেমন দেখলি?
নায়ক সংক্ষেপে জবাব দিলে, বেশ মেয়ে।
ওকে নিয়ে বড় ভাবনায় পড়েছি।
ভাবনার কি আছে?
একটু চুপ থেকে অনিমেষ বলতে লাগল, বহুদিন হল আমাদের মা নেই। ছোটবেলা থেকে রিনি তাই বাবার আদরে একটু বেশি আদুরে হয়ে উঠেছে। প্রকৃতিটা ওর সরল বটে, তবে কেমন খামখেয়ালি। কলেজে পড়তে পড়তে হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে বললে, নাচ শিখব।
নাচ শেখা তো খারাপ নয়।—নায়ক বললে।
খারাপ বলিনি, কিন্তু নাচের সূত্র ধরে রিনি এমন একটা সোসাইটিতে মিশছে, যেখানে জীবন বড় অস্থির, তাই সব কিছুর বাঁধনই আলগা।
নায়ক বললে, আজকের সমাজ মাত্রই তাই। এ যুগের সমাজ—ব্যবস্থা দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে অনিমেষ, তাকে স্বীকার না করে উপায় নেই।
জানি। কিন্তু সামাজিক জীবনে নীতি, ধর্ম, ঘর, ভালোবাসা—কোনো কিছুর বাঁধন যদি না থাকে, তবে মানুষ তো খড়—কুটোর মতো ভেসে যাবে! আর ভেসে যাচ্ছেও।
হেসে উঠে নায়ক বললে, সাতের দশকের মানুষ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অনিমেষ মজুমদারের মুখে এমন সেকেলে তত্ত্বকথা শুনব আশা করিনি।
অনিমেষ বললে, কথাটা সেকেলে বটে, কিন্তু সত্য। বাবার বদলে এখন আমিই রিনির অভিভাবক। ওর এখনকার জীবন থেকে ওকে আমি সরিয়ে আনতে চাই।
কি ভাবে?
ওর বিয়ে দিয়ে।
সিগারেটের টুকরোটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে নায়ক বললে, তাহলে আর ভাবনার কি আছে? বোনের জন্যে একটি ভালো পাত্র দেখে নে। তোর বাবা ব্যারিস্টারি করে প্রচুর ব্যাঙ্ক—ব্যালান্স রেখে গেছেন। টাকা থাকলে কি ভালো পাত্রের অভাব হয়?
হয়।—অনিমেষ বললে, টাকা থাকলেও ভালো পাত্রের অভাব হয়। আমাদের সমাজে যতগুলো ছেলেকে আমি জানি, তারা কেউ ধনী, কেউ সুদর্শন, কেউ বা বিলেতি ডিগ্রিধারী বড় চাকুরে। কিন্তু ভালো পাত্র কেউ নয়।
তার মানে? ভালো পাত্র বলতে কি বুঝিস তুই?
যে—পুরুষের দায়িত্ববোধ আছে। যে—বিয়ে শুধু দেহের সুখের জন্য, আমি তাকে বিয়ে বলি না। দেহের সুখ তো আজকাল সস্তা, বিয়ে না করলেও মেলে। সত্যিকার বিয়ে তাকেই বলব, যেখানে স্ত্রীকে স্বামী মনের দিক থেকেও সুখী করে। কিন্তু আজকের সমাজে ক’জন পুরুষের এই দায়িত্ববোধ আছে বল? খোঁজ করে যদি দেখিস, তবে দেখবি বাইরে স্বামী—স্ত্রীর সম্পর্ক দিব্যি মিষ্টি, ভেতরে একদম তেতো! দুজনেই প্রচণ্ড অসুখী! আমি চাই রিনি বিয়ে করে সুখী হোক।
নায়ক বললে, আচ্ছা, তেমন ভালো পাত্রের সন্ধান যদি পাই, তোকে জানাব।
হঠাৎ রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করলে অনিমেষ। তারপর বললে, তুই রিনিকে বিয়ে কর না।
আচমকা কথাটা যেন বুঝতে পারলে না নায়ক। কয়েক সেকেন্ড হতবাক হয়ে থেকে বললে, আমি!
খুব সহজভাবেই অনিমেষ বললে, হ্যাঁ, তুই। রিনিকে তো ভালোই লেগেছে তোর।
হেসে ফেললে নায়ক। বললে, ইয়ার্কি রাখ! আমাকে তুই ভালো পাত্র ঠাওরালি!
ইয়ার্কি নয় রে, আমি সিরিয়াসলি বলছি। রিনির জন্যে যতগুলো ছেলে দেখেছি, তাদের মধ্যে তোকেই ভালো পাত্র বলা যায়। তোর স্বাস্থ্য আছে, বিদ্যেবুদ্ধি আছে, চাকরিতে উঁচু পোস্ট আছে। সেই কলেজের দিন থেকেই জানি, তোর মধ্যে একটা ভদ্র সৎ মন রয়েছে। আর কি চাই!
মনে মনে আরেকটা ধাক্কা খেল নায়ক। আরো একটু জোরে। অনিমেষ তাকে ভদ্র আর সৎ বলছে! সে কি তাই? নয় কেন? সে তো কখনো কারো টাকা মারেনি বা অন্ধকারে কারো পেটে ছুরি বসিয়ে দেয়নি। ছোট থাপারকে খুশি রাখতে যা করেছে, সেটা স্রেফ চাকরির উন্নতির জন্যে। সেটা এমন কিছু দোষের নয়। চাকরির উন্নতির জন্যে লোকে কত কী করে, নিজের বউকে পর্যন্ত দিয়ে দেয়!
তার কাঁধে হাত রেখে অনিমেষ বললে, কি ভাবছিস? রিনিকে তুই বিয়ে করলে, আমি খুশি হব।
এ বিষয়ে রিনির মত কি?—নায়ক জিজ্ঞেস করলে।
অনিমেষ বললে, তার মত এখনো নেওয়া হয়নি। তবু আমার ধারণা, তার অমত হবে না।
কি করে বুঝলি?
অনিমেষ হাসলে। হেসে বললে, মেয়েদের ভালো—লাগা লক্ষ করলেই বোঝা যায়।
নায়ক তা জানে। তার সুস্থ সবল দেহ, তার সপ্রতিভ কথাবার্তা, তার পরুষ যৌবন কলাপীকে যে আকর্ষণ করেছে, আজ নিঃসন্দেহে সে বুঝেছে। কলাপীও কি তাকে আকর্ষণ করেনি? নিঃসন্দেহে করেছে। যৌবন যৌবনকে কামনা করে। কিন্তু তাই বলে বিয়ে? অবশ্য বিয়ে করবে না, এমন ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা তার নেই। বরং বিয়ের কথা সে মাঝে মাঝে ভাবে। পছন্দসই মেয়ে পেলে বিয়েতে তার অরুচি নেই। কিন্তু বিয়ে তো শুধু যৌবনকালের নয়—যাবজ্জীবনের চুক্তি। তার এক বিশেষ দায়িত্ব আছে। সে—দায়িত্ব কাঁধে নিতে হলে বিশেষ প্রস্তুতির দরকার। নিজেকে বদলাতে হবে।
অনিমেষ বললে, এখন তোর মত কি, তাই বল।
আমাকে ভাবতে সময় দে অনিমেষ। নায়ক বললে।
ঠিক আছে। বার্সেলোনা থেকে আমি দিন পনেরো বাদেই ফিরব। তখন জানাস।
অনিমেষ আবার গাড়িতে স্টার্ট দিলে।
.
কলাপী বলেছে, ‘না হয় ঝগড়া করতেই আসবেন।’
এ কথার আড়ালে যৌবনের যে আমন্ত্রণ ছিল, তা উপেক্ষা করার মতো বোকা বা বেরসিক অন্তত নায়ক নয়। সুতরাং প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কলকাতার অন্য সব রাস্তা ভুলে গেল নায়ক। যে রাস্তায় তার যাতায়াত শুরু হল, তার নাম হিন্দুস্তান পার্ক।
গত কয়েক বছরে যুবতী মেয়ে অনেক দেখল নায়ক। কিন্তু কলাপী মজুমদারের মতো মেয়ের সংশ্রবে সে পূর্বে কখনো আসেনি। যৌবনের স্পন্দনে, চটুলতায়, রসালাপে এমন টগবগে উচ্ছ্বল নারীর সঙ্গ পাওয়া আগে আর ঘটেনি। আঘাত দিলে কলাপী চকমকি পাথরের মতো আগুন ছিটকোয়, আদর করলে সে কাশ্মীরি আঙুরের মতো মিষ্টি রসালো হয়ে ওঠে। কলাপীর সবচেয়ে বড় গুণ, নিজেকে সে একঘেয়ে হাত দেয় না। তাই তার নতুনত্বে, তার মাদকতায়, তার প্রভাবে ভেসে গেল নায়ক—ডুবে গেল।
বার্সেলোনা থেকে ফিরে এল অনিমেষ। আরো একমাস বাদে কলাপী মজুমদারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল নায়কের।
আমাদের গল্পের—নায়ক—যার স্বভাব ছিল জ্ঞানবৃক্ষের ফল চেখে চেখে বেড়ানো, সে হঠাৎ বিয়ে করে ‘গেরস্ত’ বনে গেল কেন? এ প্রশ্ন যদি আপনারা করেন, তবে আমি সোজা কথায় জবাব দেব, বিয়েটা সচরাচর হঠাৎই হয়। আর বিয়ে নিয়ে বিতর্ক করলে বলব, প্রকৃতি প্রাণীকে জোড় বাঁধবার প্রবৃত্তি দিয়েছে, আর সভ্যতা মানুষকে শিখিয়েছে ঘর বাঁধতে। আমাদের নায়ক ব্যতিক্রম নয়।
বিয়েটা অবশ্য রেজিস্ট্রি করেই হল। কিন্তু ফুলশয্যার ঘটাপটা হল পুরো হিন্দু মতে। নায়কের ফ্ল্যাট ছোট বলে অনুষ্ঠানটা হিন্দুস্থান পার্কের বাড়িতেই হল। অনেক রাতে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল, কলরব থেমে এল, বাতিগুলো এক এক করে নিভতে শুরু করল। ফুল—ছড়ানো বিছানায় অপেক্ষা করছিল নায়ক। ফুলের সাজে সেজে ঘরে এল কলাপী। নায়কের জীবনে তৃতীয় নায়িকা।
আজ রাতে আপনাদের আরেকটি রাত মনে পড়ে যেতে পারে। দিঘার সমুদ্র সৈকতে ঝাউবন—মর্মরিত সেই রাত! মনে পড়তে পারে বিয়ে—করেও— বিধবা সেই দূর্বাকে।
কিন্তু দূর্বা সোমকে অনেক আগেই আড়াল করে এসে দাঁড়িয়েছে কলাপী মজুমদার। আর নায়কের পৃথিবীর মানচিত্র থেকে পেয়ারাবাগান লেনও বেশ কিছুদিন হল মুছে গেছে।
.
কিন্তু দেখা যায় পৃথিবীর মানচিত্রে কোনো দ্বীপ সমুদ্রগর্ভে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও জীবনের মানচিত্র থেকে অত সহজে মুছে যায় না। যে—দ্বীপ আজ জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেল, একদিন সেই আবার আগ্নেয়গিরি হয়ে মাথা তুলতে পারে।
দূর্বা সোমও একটি দ্বীপ। নায়কের যৌবন—জাহাজ একদা ভাসতে ভাসতে সেই দ্বীপে এসে নোঙর ফেলেছিল। ঝড়ের সময় বন্দর বাছাবাছি করেনি, বরং সেই ছোট্ট দ্বীপের সবুজ ছায়ার আদর ভালো লেগেছিল। কিন্তু সে আর ক’টা দিনের জন্যেই বা! তারপর কোনো গ্রহ—নক্ষত্রের ষড়যন্ত্রের ফলে জীবন—সমুদ্রে এল জলোচ্ছ্বাস। নোঙর ছিঁড়ে বাউন্ডুলে যৌবন—জাহাজ আবার ভাসতে ভাসতে আরেক নতুন দ্বীপের চড়ায় আটকে গেল, আর সেই ছোট্ট সবুজ দ্বীপটি গেল নায়কের জীবনের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে।
কিন্তু কে ভেবেছিল সেই দূর্বা—দ্বীপ হঠাৎ একদিন অগ্নিগর্ভ হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে?
টেলিফোন বাজবার আগে আমাদের গল্পের নায়ক অন্তত ভাবেনি।
রিসিভার তুলে নায়ক রীতি অনুযায়ী বললে, থাপার ট্রেডিং!
অপর দিক থেকে উত্তর এল: আমি দূর্বা।
রিসিভারটা হাত থেকে পড়তে পড়তে রয়ে গেল। সহজ হবার চেষ্টা করে নায়ক বললে, ও, দূর্বা! কি খবর?
আজ সন্ধ্যার পর আসবে?
আজ সন্ধেবেলা একটা ঝামেলা আছে, বুঝলে! আরেকদিন সময় করে যাব ‘খন।
সময় তোমার হবে না জানি। কিন্তু বড় দরকার, তাই ডাকছি।
দূর্বার গলাটা কেঁপে গেল।
হঠাৎ দিঘার সমুদ্র সৈকতে ঝাউবন—মর্মরিত সেই সন্ধ্যা মনে পড়ল। আর মনে পড়ামাত্র নায়কের মন—কম্পাসের কাঁটা ঘুরে গেল পেয়ারাবাগান লেনের দিকে। অফিস—ফেরতই সে চলে গেল সেখানে।
বাড়িটার চেহারা সেই একই আছে। দাবার ছক সাজিয়ে জ্যাঠামশাই বসে আছেন ধ্যানস্থ হয়ে। ঘরের এককোণে কালো মতো একটি ছেলে কি একটা বই মুখে বসে আছে।
জ্যাঠামশাই হেসে বললেন, এসো। হবে নাকি এক হাত?
নায়ক যেন প্রতিদিনই আসে, এমনি সহজ জ্যাঠামশায়ের সম্ভাষণ।
খেলাটা প্রায় ভুলেই গেছি। হেসে নায়ক বললে।
দাবা খেলা কেউ ভোলে? তাহলে জগৎটা চলছে কি করে? জগৎ—সংসারটাই তো একটা বিশল দাবার ছক। ওই ভুলুকে খেলা শিখিয়েছিলাম, ও যখন দশ বছরের. . . ভুলুর সঙ্গে আলাপ নেই বুঝি? ভুলু আমার ভাইপো, দূর্বার ছোট।
ছেলেটি এবার বই থেকে মুখ তুলে তাকাল। বয়সে নিতান্তই ছোকরা, কুড়ি—একুশের বেশি হবে না। রোগাটে চেহারা, রোদে—পোড়া তামাটে রঙ, গাল—ভাঙা মুখে পাতলা দাড়ি, চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। পথে—ঘাটে হামেশা যেসব পার্টির ছেলে দেখা যায়, ভুলু তাদেরই একজন। তেমনি আধময়লা চোঙা প্যান্ট আর চিত্রবিচিত্র বুশ শার্ট পরা।
জ্বলজ্বলে চোখ তুলে ভুলু একবার তাকাল নায়কের দিকে। তারপর আবার বইয়ে মুখ দিল। একটু হাসিও না, একটা নমস্কারও না।
দূর্বা কেমন আছে? নায়ক জিজ্ঞেস করলে জ্যাঠামশাইকে।
ফ্লু হয়েছে বোধ হয়। বলে না তো কিছুই। যাও না, দেখে এসো।
নায়ককে দেখে বিছানায় উঠে বসল দূর্বা। বেশ খানিকটা রোগা হয়ে গেছে এই তিন মাসেই। মুখের সেই পুতুল—পুতুল ভাব আর নেই। নায়কের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।
জ্বর হয়েছে নাকি?
না।
বিছানার কাছে গিয়ে নায়ক তার কপালে হাত রাখলে।
জ্বর তো এখনো অল্প রয়েছে।
মুখ নামিয়ে চুপ করে বসে রইল দূর্বা। নায়কও বসল বিছানায়। হালকা গলায় বললে, কথা নেই কেন? রাগ হয়েছে? কতটা রাগ, দেখি!
দূর্বার চিবুকে আঙুল ঠেকিয়ে তুলে ধরতেই দেখা গেল, ফ্যাকাশে গাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল নেমেছে। ভিজে গেল নায়কের মনটা। জলে—ভেজা ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরতেই দূর্বা সরে বসল। চাপা গলায় বললে, ভুলু রয়েছে বাড়িতে।
আর, তার মুখে জ্বরের বিশ্রী গন্ধ পেয়ে নায়কের মনটা মুহূর্তে বিস্বাদ হয়ে গেল।
দূর্বা বিছানা থেকে নেমে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে, চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়াল।
তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
বলো।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাঁ—হাতের চুড়িটা ঘোরাতে লাগল দূর্বা। তারপর হঠাৎ বললে, জ্যাঠামশাইকে বলে তাড়াতাড়ি একটা দিন ঠিক করো।
দিন! কিসের দিন?
আমাদের বিয়ের।
আচমকা যেন ধাক্কা খেল নায়ক। শুধু বলে উঠল, বিয়ে!
কিন্তু আরো জোরালো একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিল নায়কের জন্য! কাঁপা কাঁপা গলায় দূর্বা বললে, নইলে আমার ছেলের পরিচয় কি দেব?
তোমার ছেলে!
দূর্বা বললে, হ্যাঁ, তোমার ছেলে।
একটা পাথরের মূর্তির মতো আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল নায়ক। অনেকক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বললে, কবে জানতে পেরেছ?
তিন মাস আগে।
দিঘার সমুদ্র সৈকতে সেই সন্ধ্যাবেলাটি আবার মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, তিন মাসই হবে দিঘা থেকে তারা ফিরেছে।
একটা সিগারেট ধরাল নায়ক। কয়েকবার টানল। তারপর বললে, কিন্তু বিয়ে তো আমাদের হতে পারে না দূর্বা। তোমার স্বামী এখনো বেঁচে।
না। দূর্বা বললে, ট্রেনের তার কাটতে গিয়ে রেল—পুলিশের গুলিতে সে মারা গেছে।
ও!—নিঃশব্দে সিগারেট টানতে লাগল নায়ক।
জ্যাঠামশাইকে আজই বলে যাও। দূর্বা বললে, জ্যাঠামশাইকে এ মুখ আর দেখাতে পারছি না।
তার গলাটা আবার কেঁপে গেল।
কোনো জবাব দিলে না নায়ক। তার বিবেক—বুদ্ধি বললে, দূর্বাকে বাঁচাও। ওকে বাঁচানো তোমারই কর্তব্য। সঙ্গে সঙ্গে তার বাস্তব—বুদ্ধি বললে, আগে নিজেকে বাঁচাও। তোমার বড় চাকরি আছে, সামাজিক সম্মান আছে, কলাপীর মতো স্ত্রী আছে। একটা দূর্বার জন্য এতগুলো ত্যাগ করা চলে না। ত্যাগ করার কথা ভাবাও বোকামি। নিজেকে বাঁচানোই মানুষের একমাত্র ধর্ম।
সিগারেটের টুকরোটা জুতোর তলায় পিষে ফেললে নায়ক। তারপর শান্ত সহজ গলায় বললে, দেখো দূর্বা, একটা কাজ করো। এটা বিজ্ঞানের যুগ, আমি একটা নার্সিংহোমে তোমার ব্যবস্থা করে দিই। টাকার জন্যে ভেবো না, সে আমি—
দূর্বার হাড়—ওঠা ফ্যাকাশে মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল। গলার আওয়াজটাও এবার কাঁপল না। শান্ত স্পষ্ট গলায় বললে, আমি টাকা চাই না—স্বামী চাই।
দূর্বা—দ্বীপ সত্যিই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে! অগ্ন্যুৎপাতের আগেই মুখ বন্ধ করা দরকার।
যেন ছোট মেয়েকে বোঝাচ্ছে, এমনি ভাবে নায়ক নরম গলায় বললে, দেখো, তোমাকে বিয়ে করতে আমারও অনিচ্ছা ছিল না। কিন্তু এখন আর সম্ভব হচ্ছে না. . . মানে একটা মুশকিল হয়ে গেছে।
কি মুশকিল?
একটু শুকনো হেসে নায়ক বললে, মাস দেড়েক হল আমি বিয়ে করেছি।
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল দূর্বা। যেন কিছুই দেখছে না, কিছুই শুনছে না। ছোট ছোট সরু আঙুল দিয়ে চেয়ারের পিঠ শক্ত করে আঁকড়ে ধরল শুধু।
গলায় দুঃখ এনে নায়ক বলতে লাগল, দেড় মাস আগে যদি আমাকে জানাতে! কাজের ঝামেলায় আমি না হয় আসতে পারিনি; তাই বলে তুমি তো একটা খবর—
তুমি এখন এসো। ক্লান্ত গলায় দূর্বা বলে উঠল।
যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল নায়ক। কিন্তু গেল না। অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করে বললে, তাহলে একটা নার্সিংহোমে বন্দোবস্ত করে ফেলি? আর দেরি না করাই ভালো।
আশ্চর্যরকম শান্তভাবে দূর্বা বললে, যা করবার আমিই করব।
আর কি বলা যায় ভেবে পেল না নায়ক। আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। ঢাকা বারান্দায় ভুলু পায়চারি করছিল। জ্বলজ্বলে চোখ মেলে একবার তাকাল, আবার পায়চারি করতে লাগল।
দাবার ছকের সামনে জ্যাঠামশাই ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন। পা টিপে টিপে নায়ক দরজাটা পার হয়ে গেল।
.
দূর্বা বলেছিল, যা করবার আমিই করব।
করবার অনেক কিছুই ছিল। সে ব্ল্যাকমেল করতে পারত, নায়কের নামে কেস করতে পারত, তার বিবাহিত জীবন বিষাক্ত করে দিতে পারত। কিন্তু দূর্বার মতো যে—মেয়েরা ভাগ্যের শিকার, তারা এসব কিছুই করতে পারে না। পারে কেবল একটাই কাজ করতে।
দিন তিনেক বাদে দূর্বাকে পাওয়া গেল তার বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থায়। সে—ঘুম আর ভাঙেনি।
পুলিশ এসে লাশ নিয়ে গেল ময়নাতদন্তের জন্যে। রিপোর্টে দুটো জিনিস পাওয়া গেল। পাকস্থলীতে অনেকগুলো ঘুমের বড়ি, আর জরায়ুতে অপরিণত একটি ভ্রূণ।
রিপোর্ট শুনে ভুলু জ্যাঠামশাইকে কিছু বলেনি। তার গালভাঙা মুখের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠেছিল শুধু। জনকয়েক বন্ধুকে নিয়ে দিদির কাটা—ছেঁড়া লাশ আর অপরিণত ভ্রূণ একসঙ্গে পুড়িয়ে এল শ্মশানে।
আর, সেইদিনই ভোর—রাতে পুলিশ এসে ঘিরে ফেলল পেয়ারাবাগানের বাড়িটা। ভুলুকে নিয়ে গেল ব্যাঙ্ক—ডাকাতির চার্জে।
বছর তিনেকের জন্য সরকারি আশ্রয়ে তার থাকা—খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে গেল।
।। নায়ক।।
এ গল্প আমাদের খুশি করতে পারছে কিনা জানি না। যদি না পারে, আমি কি করতে পারি বলুন? এ তো সাবেক কালের ফর্মুলায় বাঁধা ইচ্ছাপূরণের গল্প নয়। এ গল্প আপনারাই ফেঁদেছেন। আপনারা জীবনধর্মী গল্পই পছন্দ করেন, তাই আজকের প্রবহমান খরস্রোত জীবনকে আমি বেঁধে রাখার চেষ্টা করিনি, ছেড়ে দিয়েছি তার নিজস্ব উন্মত্ত গতিপথে। এখন আর আমার কোনো হাত নেই। এ গল্প কোথায় কোন পরিণতিতে গিয়ে পৌঁছবে, তাও বলা যায় না।
অতএব, আসুন আমরা গল্পের পিছনে পিছনে এগোতে থাকি।
নায়কের বিয়ে আর দূর্বার আত্মহত্যার পর সময়—গঙ্গায় অনেক জোয়ার—ভাটা এল গেল। পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক আকাশে ধূমকেতুর মতো উদয় হল কয়েকটি পলিটিক্যাল পার্টি, শুরু হয়ে গেল বড় রকমের ওলোট—পালোট। কংগ্রেসের হল পরাজয়, যুক্তফ্রন্টের হল অভ্যুদয়। তার পরের ঘটনাবলি আপনাদের মুখস্ত থাকার কথা।
রাজ্যে হু হু করে প্রগতির হাওয়া বইতে লাগল। আর তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফাটতে লাগল বোমা, চলতে লাগল পাইপগান আর ছুরি, পুড়তে লাগল ট্রাম—বাস। দ্রব্যমূল্য হল আকাশ—ছোঁয়া। কথায় কথায় বনধ আর ধর্মঘট। ক্লোজার আর লক—আউট। স্কুল—কলেজে পরীক্ষার নামে ঠাট্টা।
সময়—গঙ্গার মত্ত স্রোতে একে একে তিনটি বছর ভেসে গেল। মিশে গেল মহাকাল—সমুদ্রে।
ওলোট—পালোট হয়ে গেল নায়কেরও জীবন। তার বিয়ের বছর দেড়েক বাদেই থাপার ট্রেডিংয়েও গণজাগরণের ঢেউ লাগল। বোনাস বাড়ানোর দাবিতে শুরু হয়ে গেল লাগাতার ধর্মঘট। ছোট থাপারের দূত হয়ে মিটমাট করতে গিয়ে ‘মালিকের দালাল’ নায়কের মাথা ফাটল। ছোট থাপার শান্তিপ্রিয় লোক, পাঁচ মাস ধর্মঘটের মাথায় অফিস তুলে দিয়ে সোজা কানাডায় গিয়ে বসে রইল। ছ’মাস বাদে নায়কের অফিস—সুপারভাইজার হবার কথা। হল না। চোদ্দশো টাকা মাইনের ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজার রাতারাতি বেকার হয়ে গেল।
লিটল রাসেল স্ট্রিটে অফিসের ফ্ল্যাট পেয়েছিল, সেটা ছাড়তে হল। নায়ক দিশি পাড়ায় একটা সস্তার ফ্ল্যাট নিতে চেয়েছিল। অনিমেষ বললে, রিনির কষ্ট হবে। তোমরা হিন্দুস্থান পার্কেই চলে এসো। আমি তো বছরে আট মাস বিদেশেই থাকি, তোমরা বাড়িটার দেখাশুনো করতে পারবে।
অতএব, নায়ক তার শ্বশুরবাড়িতেই এসে উঠল। কোনো আপত্তি করলে না। আপত্তি করার মতো জোর ছিল না বলে।
সামনে যার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, সঞ্চয়ের দিকে তার মন থাকে না। সামান্য ব্যাঙ্ক ব্যালান্স যা পড়েছিল, তাই দিয়ে একটা বছর চলল। তারপরেও দিন চলতে লাগল। দিন কারো মুখ চেয়ে বসে থাকে না। চলতে লাগল কলাপীর টাকায়—মানে কলাপীর হাত দিয়ে অনিমেষের টাকায়। কোনো কাজই আর রইল না নায়কের। শুধু রোজ একবার করে চাকরির বাজারে ঘুরে আসা ছাড়া। ট্যাক্সি থেকে ট্রাম—বাসে, স্টেট এক্সপ্রেস থেকে উইলস—এ নেমে এল সে। কিন্তু কলাপীর দুটো আঁকা ভুরুর মাঝখানে কপালের খাঁজটা আর সমতল হল না।
চোদ্দশো’ টাকা মাইনের সেই গর্বিতস্বভাব মানুষটি কলাপীর চোখে আজ ছোট হয়ে গেছে। নায়কও তা বোঝে। কলাপীকে কিন্তু দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ যুগটাই হচ্ছে টাকার যুগ। আলু—পটল আর মানুষ—দুয়েরই মূল্যায়ন হয় টাকা দিয়ে। ‘আমার স্বামী বেকার’—এ চিন্তাটা কোনো স্ত্রীই সহ্য করতে পারে না।
বাইরের সম্পর্ক আগের মতোই বজায় রয়েছে। কিন্তু ভেতরের সম্পর্কে কোথায় যেন চিড় খেয়েছে। জোড়া খাট তফাত হয়নি, অথচ স্বামী—স্ত্রী দুজনেই বুঝতে পারছে, পাশাপাশি থেকেও তারা ক্রমশই তফাত হয়ে যাচ্ছে। হাসিটা আজকাল মাপা, কথাগুলো শুধুই কথা—হৃদয়ের সুর নেই, রাতের চুম্বন—আশ্লেষ নেহাতই যান্ত্রিক নিরুত্তাপ, বাসি মাংসের মতো ঠান্ডা।
মনের এই ফাঁকি পরস্পরের কাছে যতই ঢাকবার চেষ্টা, ততই ধরা পড়ে যাচ্ছে।
.
বাড়িতে ঢোকার মুখেই আওয়াজ পাওয়া গেল। তবলার বোলের সঙ্গে ঘুঙুরের আওয়াজ।
থমকে থেমে গেল নায়ক। কলাপী এখন নাচ প্র্যাকটিস করছে। ইদানীং নাচের ওপর তার ঝোঁকটা আবার বেশি মাত্রায় ফিরে এসেছে। তার পুরনো বন্ধু—মহলের অনেকজনকেই ঘন ঘন দেখা যাচ্ছে হিন্দুস্থান পার্কের এই বাড়িতে।
দোতলায় উঠে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল নায়ক। আর বারান্দা দিয়ে চলতে চলতেই ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রইংরুমটা একবার দেখে নিলে।
উজ্জ্বল আলোর নিচে দাঁড়িয়ে কলাপী নাচছে। পায়ের গোছ অবধি তুলে শাড়ি পরা, দড়ির মতো পাকানো আঁচল পৈতের মতো বুকের মাঝখান দিয়ে উঠে গিয়ে, পিঠ বেয়ে নেমে কোমরে জড়ানো। টাইট কাঁচুলির মতো আড়াল থেকে উগ্র যৌবন যেন শিং উঁচিয়ে আছে। চুড়িদার পায়জামা পরা বাবরি—চুল যে ছেলেটি একহাতে কলাপীর কোমর জড়িয়ে নাচের বোল বলছে, নায়ক তাকে জানে। কলাপীর নতুন নাচের মাস্টার গোপীনাথন। আরো চার—পাঁচজন যুবক বসে আছে। তারা নাচিয়ে নয়, কলাপীর অনুরাগী ভক্ত। তারা আসে কলাপীর নৃত্য—প্রতিভায় চমৎকৃত হয়ে অনর্গল স্তুতিবাদ করতে।
নিজের ঘরে চলে গেল নায়ক। কলাপী তাকে দেখেছে কিনা সে জানে না। দেখলেও নাচ ছেড়ে আসবে না, তা সে জানে। নাচের প্র্যাকটিস আর বন্ধু—মহলের গুণগান শেষ হতে রাত সাড়ে দশটা বাজে, কোনোদিন এগারোটা।
নিজের হাত—ঘড়িটায় দেখলে রাত সবে আটটা। পোশাক না বদলে চেয়ারটায় বসে পড়ল নায়ক। সন্ধ্যার পর এই সময়টা তার অত্যন্ত বোদা লাগে। একেবারে একা মনে হয়, নিজেকে নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না। অথচ একটা বছর আগেও এই সময়টার জন্যে সারাদিন সে উৎসুক হয়ে থাকত। কলাপী অপেক্ষা করত তার জন্যে। এক একদিন এক একরকম সাজত কলাপী। কেবল তারই জন্যে। সেদিন অবশ্য সে বড় অফিসার ছিল। চোদ্দশো টাকা মাইনের পদস্থ অফিসার।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল নায়ক। আর শুনতে লাগল তবলার বোল, ঘুঙুরের শব্দ আর পুরুষ—গলার সমবেত হাসির আওয়াজ। কলাপীর এখন আসার অবসর নেই, তা সে জানে। সন্ধ্যার পর এই সময়টা অত্যন্ত বোদা লাগে।
বুধন বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করলে, কফি আর জলখাবার আনবে কিনা। ইশারায় তাকে যেতে বলে দিলে নায়ক। দেহে—মনে একটা বিশ্রী ক্লান্তি। নিজেকে নিয়ে কি যে করা যায়, ভেবে পাচ্ছে না সে। হাতঘড়িতে দেখল সাড়ে ন’টা। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল নায়ক। একটা ছোট অর্ডার সাপ্লাইয়ের দালালি বাবদ শ’ দেড়েক টাকা পেয়েছিল গত পরশু। আলমারি খুলে দেখলে, খানকয়েক নোট এখনো রয়েছে। সেগুলো পকেটে পুরে বেরিয়ে পড়ল।
বেরোবার মুখেই ঝুমঝুম করতে করতে কলাপী এল।
আবার কোথায় বেরোচ্ছ?
খানিকটা ঘুরে আসি।
বুধন কফি দিয়েছে?
দিতে এসেছিল, দরকার হয়নি।
কেন?
খাবার ইচ্ছে নেই।
ও!—কলাপীর আঁকা ভুরুর মাঝখানে সেই খাঁজটা আবার দেখা দিলে। বললে, আচ্ছা, আমার পুরানো বন্ধুরা এলেই তোমার মুখ ভারি হয় কেন বলো তো?
নিঃশব্দে একবার কলাপীর দিকে তাকাল নায়ক। টাইট চোলি—আঁটা বুকের ভেতরে মন বলে কোনো বস্তু আছে কি? ছিল কি কোনোদিন? চোখ সরিয়ে নিয়ে নায়ক বললে, নিজের স্ত্রীকে নিয়ে অপরে মাতামাতি করলে কোনো স্বামীই খুশি হতে পারে না।
মাতামাতি মানে?—তেতো গলায় কলাপী বললে, ইতরের মতো কথা বোলো না। ওরা নাচ বোঝে। ওদের কালচার আছে।
কলাপীর তেতো গলার চেয়েও তেতো হাসিতে কুঁচকে গেল নায়কের ঠোঁটের কোণ। হেসে বললে, কালচার! ডিক্সনারিতে আজকাল কালচার শব্দটার নতুন মানে দিয়েছে বুঝি?
কলাপী চাপা তীক্ষ্ন গলায় বললে, এ বাড়ির একটা প্রেস্টিজ আছে। এখানে কোনো সিন ক্রিয়েট কোরো না বলছি!
সংযত গলায় নায়ক বললে, না, কোনো সিন করব না। যে সিন চলছে, সেটা চলুক।
নায়ক আর দাঁড়াল না।
.
হিন্দুস্থান পার্ক থেকে পার্ক স্ট্রিট। ‘লা বোহেমিয়া’র সামনে।
নিয়মিত মদ্যপানের অভ্যাস নায়কের কোনোদিন ছিল না। কখনো—সখনো খেত। বিয়ের পর একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল। আজ অনেক দিন বাদে ‘বারে’ এল। সন্ধ্যার পর এই সময়টা আজকাল ভয়ানক বিস্বাদ লাগে। একটা কিছু না হলে আর চলে না।
রাত দশটা বাজে। বারে ভিড় এখন পাতলা। একটা নিরিবিলি কোণ বেছে নিয়ে বাইরেই বসে পড়ল নায়ক। কেবিনে গেল না। কিন্তু এই বিশাল পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে ঠিক এই লা বোহেমিয়া বারে দেখা হয়ে যাবে, কে ভেবেছিল! একটা জংশন স্টেশনে বিভিন্ন দুটো ট্রেনের দুজন আলাপী যাত্রীর যেমন হঠাৎ দেখা হয়ে যায়।
দেখা হল চার বছর বাদে।
প্রথম পেগ শেষ করে নায়ক সবে দ্বিতীয় পেগ নিয়েছে, এই সময় সামনের একটা কেবিন থেকে বেরিয়ে এল মাঝারি বয়সের এক ভদ্রলোক। মোটা থলথলে চেহারা, ফর্সা রঙ, গিলে—করা আদ্দির পাঞ্জাবিতে হীরের বোতাম লাগানো। কেবিনের পর্দা সরিয়ে বললে, একটু বোসো। ম্যানেজারের ঘরে মাসকাবারি হিসেবটা মিটিয়ে আসি।
কেবিনটা নায়কের সামনাসামনি। সরানো পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, ভেতরে বসে আছে একটি মহিলা। দৃশ্যটা অতিশয় সাধারণ। বারে আজকাল পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের ভিড়ই বরং বেশি। চোখ সরিয়ে নিয়ে নায়ক একটা সিগারেট ধরাল। তারপর খাবারের মেনুটার ওপর চোখ বোলাতে লাগল।
একটু পরেই একজন বয় এসে জানালে, সাত নম্বর কেবিনের মেমসাহেব ডাকছেন।
অবাক হবার কথাই বটে। বয় লোক—ভুল করেনি তো?
না, ভুল করেনি। মেমসাহেব নায়ককেই সেলাম দিয়েছেন।
উঠতে হল। সাত নম্বর কেবিনে পা দিয়ে চিনতে দেরি হল না।
মুক্তা! গড়িয়াহাটা মোড়ে সেই ‘প্রচ্ছদ’—এর সেলস গার্ল মুক্তা। চেহারা অনেকখানি বদলেছে বইকি। বেশ মোটাসোটা হয়েছে। অ্যালকোহলিক ফ্যাট লেগেছে গায়ে। দামি শাড়ি, দামি পাথরের গয়না, ফাঁপানো খোঁপার বাহার, মুখে নিপুণ প্রসাধন। শুধু চোখের নিচে কালির দাগ সবটা চাপা পড়েনি।
কি? চিনতে পারছ না বুঝি? মুক্তা বললে। স্বরটা একটু জড়ানো।
চিনতে পারব না কেন? —নায়ক সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করলে।
তবে দেখেও চোখ ফিরিয়ে নিলে কেন?
দূর থেকে অতটা লক্ষ্য করিনি।
তা বটে। চার বছর—অনেক দূর!
একটা মামুলি প্রশ্ন করে বসল নায়ক: কেমন আছ?
হেসে উঠল মুক্তা। বললে, জিজ্ঞেস করছ কেন? দেখে বুঝতে পারছ না?
নায়কও অল্প হাসল। হেসে বললে, দেখে শুধু এইটুকুই বুঝতে পারছি যে তুমি অনেক বদলে গেছ।
মুক্তা বললে, আমি তো চার বছরে বদলেছি। তুমি কিন্তু রাতারাতি বদলে গিয়েছিলে।
ইঙ্গিতটা বুঝেও বুঝল না নায়ক। বললে, তোমাকে এখানে দেখব আশা করিনি মুক্তা।
যা আশা করা যায় না, তাই তো হয়। আমিই কি আশা করেছিলাম, ছোট থাপারের খাটে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তুমি পালিয়ে যাবে?
একথার জন্য নায়ক তৈরি ছিল না। একটু থেমে বললে, কি করব? সে—রাতে তোমার খুব বেশি নেশা হয়ে গিয়েছিল—
মুক্তার রঙ—করা ঠোঁট দু’খানা বিভক্ত হল। পাকা লঙ্কার মতো টকটকে লাল ঠোঁটের হাসিটাও ঝাল। বললে, আজ আর আসল কারণটা বলতে লজ্জা কিসের? ভেবেছিলে একটা রিফিউজি মেয়ের সম্মানই বা কী, সতীত্বই বা কী? তাই না?
শুকনো মুখে নায়ক বললে, এতদিন বাদে সেদিনের জের টেনে আর লাভ কি বলো?
লাভ! যার সবটাই লোকসান, সে কি আর লাভের আশা করে? থাপারকে আমার দেহটা ঘুষ দিয়ে তুমি চাকরির উন্নতি কিনলে। কিন্তু আমি? স্ত্রীলোকের দেহ নিয়ে পুরুষের লাভ, কিন্তু স্ত্রীলোকের আগাগোড়াই লোকসান।
মুক্তার গলার স্বর আরো জড়িয়ে আসছে।
মুক্তাকে দেখা অবধি ঝিমিয়ে—থাকা বিবেক আস্তে আস্তে সজাগ হয়ে উঠছিল। নিজের কাছে নিজেই কেমন ছোট হয়ে যাচ্ছিল নায়ক। বয়কে ডেকে নায়ক বাইরের টেবিল থেকে হুইস্কির গেলাসটা আনিয়ে নিলে। বিবেক মানে কমপ্লেক্স। পায়ে পায়ে যখন জীবনের মোকাবিলা করতে হবে, তখন বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে রাখাই ভালো। যেমন করে মুক্তাকে একদিন থাপারের খাটে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল।
এক চুমুকে গেলাসটা খালি করে নায়ক চাঙ্গা হল। বললে, তোমারই বা লোকসান কোথায়? ছোট থাপার তোমাকে তো সুখেই রেখেছিল শুনেছি। কিন্তু ও ভদ্রলোকটি কে?
মুক্তা বললে, বেনেটোলার মল্লিক—বাড়ির মেজোবাবু। ছোট থাপার বছর ঘুরতেই আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর আরো দু’হাত ঘুরে মেজোবাবুর হাতে। জানো, আমি আর মুক্তা বসু নই। আমি এখন একটা দামি মোটরকার, বা একটা শখের আসবাব বলতে পারো।
খিলখিল করে হেসে উঠল মুক্তা। নায়কের মনে হল, সমস্ত পুরুষকে ব্যঙ্গ করছে সে। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন রাগ হয়ে গেল তার। বললে, নেশার ঝোঁকে যাই বল, লাভ তোমারই বা কম কিসে? জীবনে তোমরা যা চাও, সবই তো পেয়েছ—দামি গয়না, অনেক টাকা।
কে বললে আমরা এই চাই?
অকারণে গলা চড়িয়ে নায়ক বললে, হ্যাঁ, এই চাও। টাকা ছাড়া তোমাদের কাছে পুরুষের দাম কী? তোমাদের দুনিয়ায় টাকা মানেই সুখ। টাকা মানেই প্রেম।
হুইস্কির উত্তেজনায় নায়কের খেয়াল হল না, আজ মেয়ে—জাতের বিরুদ্ধে যে নালিশটা সে করছে, আসলে সেটা শুধু কলাপীর বিরুদ্ধেই।
আস্তে আস্তে মুক্তা বললে, জীবনে তো আরো কত মেয়ের সঙ্গে মিশলে, মিশে কি এই বুঝলে? আমি তো টাকা চাইনি। আমি শুধু সুখী হতে চেয়েছিলাম। একটি স্বামী আর একটি ঘর নিয়ে। কিন্তু তা আর হল কই?
মুক্তার গলার নেশা—জড়ানো বিষণ্ণ আওয়াজটা যেন অনেক দূর থেকে শোনাল। একটু থেমে থেকে আবার যেন কাছে থেকে বললে, যাকগে ওসব কথা। মরা স্বপ্নকে কবর খুঁড়ে বার করে কি হবে? তোমার খবর বলো। বিয়ে করেছ?
হুঁ। ছোট্ট করে জবাব দিলে নায়ক।
সুখী হয়েছ?
নায়ক চুপ করে রইল।
মুক্তা বললে, সুখী হওনি, তা বুঝতে পেরেছি।
তারপর তার গেলাসের তলানিটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে বললে, দুনিয়ায় কেউ বোধহয় সুখী নয়।
পর্দা সরিয়ে সেই মোটা থলথলে চেহারার মেজোবাবুর আবির্ভাব হল। ভদ্রলোক খুবই লিবারেল বলতে হবে। নিজের রক্ষিতাকে অপরের সঙ্গে দেখেও রাগ করল না। শুধু ডাকলে, কই গো, এসো।
উঠে পড়ল মুক্তা। নায়কের দিকে একবার তাকিয়ে বললে, চলি।
নায়ক শুনতে পেল, যেতে যেতে মেজোবাবু বলছে, কি গো? পুরোনো মক্কেল বুঝি?
উত্তরে জড়ানো গলার বেসামাল কলহাস্য।
একা একা আরো অনেকক্ষণ বসে রইল নায়ক। পর পর আরো কয়েকটা পেগ খেল। জীবনটা চাকার মতো ঘুরছে। নইলে চার বছর বাদে মুক্তার সঙ্গে আজ দেখা হল কেন?
সব কথার শেষে মুক্তা বলে গেল, দুনিয়ার কেউ বোধহয় সুখী নয়।
দুনিয়ায় কে সুখী হল আর হল না, নায়ক তা জানতে চায় না। নিজে সে সুখী হতে চেষ্টা করেছে বরাবর। কিন্তু হতে পারল কি?
জীবনটা সত্যিই চাকার মতো ঘুরছে। আর সুখ কখনো সেই চাকার ওপরে, কখনো নিচে। নায়ক যখনই হাত বাড়িয়েছে চাকার ওপরে, সুখ চলে এসেছে নিচে। যখনই হাত বাড়িয়েছে নিচে, সুখ চলে গেছে ওপরে।
কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না সুখকে। অথচ দুনিয়াময় সুখী হবার কী দুশ্চেষ্টা!
.