কাগজের ফুল – ৩

সেদিন ওই পর্যন্ত।

কিন্তু আবার দেখা হল কিছুদিনের মধ্যেই। মানিকতলার সেই পেয়ারাবাগান লেন, সেই তিন বাই একের বি নম্বর। সন্ধ্যার পর নায়ক একদিন গেল। যাওয়ার একটা উপলক্ষও ছিল।

পুরানো আমলের ছোট দোতলা বাড়ি। একতলায় অন্য পরিবার, দূর্বারা থাকে দোতলায়। দোতলার দরজার কড়া নাড়তেই খুলে দিলেন চশমা—চোখে রোগা এক বৃদ্ধ।

কে?

দূর্বা সোম আছেন?

চশমাটা কপালে তুলে ভদ্রলোক একবার দেখলেন নায়ককে। তারপর বললেন, কোত্থেকে আসছেন?

আমি আসছি একটি অফিস—ক্লাবের থিয়েটার সম্পর্কে।

চশমাটা আবার যথাস্থানে নামিয়ে বৃদ্ধ বললেন, অ! তা দূর্বা তো এখন ঘরে নেই, কোথায় যেন থিয়েটারের ব্যাপারেই গেছে।

আচ্ছা, তাহলে এখন যাই।

যাবেন কেন? বৃদ্ধ বললেন, তার আসবার সময় হয়েছে, আপনি বরং ঘরে এসে বসুন। আমি দূর্বার জ্যাঠামশাই

একফালি বারান্দা পার হয়ে নায়ককে তিনি নিজের ঘরেই বসালেন। সেকেলে মানুষের সেকেলে ঘর। প্রাচীন একখানা একানে খাট, আলনা, টুলের ওপর একটা তোরঙ্গ, তার ওপর সুটকেশ, আর সাধারণ একখানা টেবিলের দু’—পাশে পিঠ—উঁচু দু’খানা চেয়ার। টেবিলে একটা দাবার ছক পাতা। ভদ্রলোক বোধ হয় একাই খেলছিলেন।

হবে নাকি একহাত? প্রসন্ন হেসে জিজ্ঞেস করলেন দূর্বার জ্যাঠামশাই। সমুখের একটা দাঁত পড়ে গিয়ে হাসিটাকে প্রসন্নতর করেছে।

নায়ক একটু কিন্তু হয়ে বললে, দাবা আমি জানি নে।

জ্যাঠামশাই স্বচ্ছন্দে বললেন, জানেন না! আসুন, শিখিয়ে দিই! জগৎ—সংসারটাই তো একটা দাবার ছক! শিখে রাখা ভালো, বুঝলেন?

নতুন করে ঘুটি সাজাতে লাগলেন জ্যাঠামশাই। আর, খেলা শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে সেরে নিলেন পরস্পরের পরিচয়। জ্যাঠামশাই চিরকুমার, এক সময় পোস্টমাস্টার ছিলেন, এখন বছর পাঁচেক হল রিটায়ার করেছেন। ছোট ভায়ের দুই ছেলেমেয়ে দূর্বা আর ভুলুকে নিয়েই তাঁর সংসার। ভুলু বি. এস. সি. পর্যন্ত পড়েছিল, এখন সে পার্টি করে বেড়ায়। মধ্যে মধ্যে পুলিশ আসে, কিন্তু ভুলু বোড়ের চাল দিয়ে সরে পড়ে। পুলিশ মাত হয়ে ফিরে যায়। বাড়িটা নিজেদের, একতলাটা ভাড়া দিয়ে আর রিটায়ার্ড পোস্টমাস্টার জ্যাঠামশায়ের একশো দশ টাকা পেনসনে সংসারটা চলে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ বছর দেড়েক নিচের ভাড়াটের চাকরি নেই, ভাড়া দিতে পারছে না। তা পারছে না বলে তো আর তাড়িয়ে দেওয়া যায় না। জীবনে এক—আধবার মাত সকলেই হয়। তাই সংসার—দাবায় নৌকো বাঁচাবার জন্যে দূর্বা অভিনয়কে পেশা করে নিয়েছে।

নায়ক বুঝলে, দাবাভক্ত বৃদ্ধ সব কথাই দাবার ভাষায় বলেন, সব ভাবনাই দাবার চালে ভাবেন। জ্যাঠামশাই বলতে লাগলেন, পাড়ার অনেকে অনেক কথা বলে, কিন্তু জ্যাঠামশাই জানেন তাঁর দূর্বা বড় সৎ মেয়ে। দূর্বার গায়ে আকাশের রোদ আর শিশির ছাড়া কোনোদিনই ধুলো লাগবে না!—ওকি হল? ঘোড়ার চাল দিলে আপনার গজ মারা পড়বে যে!

আবার দাবায় বসেছ জ্যাঠামণি?

দুজনের চোখ দাবার ছক থেকে ঘরের দরজার ওপর সরে গেল। দাঁত—পড়া মুখে প্রসন্ন হেসে জ্যাঠামশাই বললেন, দূর্বা এসেছিস! আয়। বেড়াতে বেরোব ভাবছিলাম, এই ভদ্রলোক এসে পড়লেন।

আর, তুমি অমনি দাবার ক্লাসে ভর্তি করে নিলে!—দূর্বা বললে।

দাঁত—পড়া মুখ আরো প্রসন্ন করে জ্যাঠামশাই বললেন, শিখে রাখা ভালো, বুঝলি মা? জগৎ—সংসারটাই যে দাবার ছক!

দূর্বা এবার নায়কের দিকে তাকাল। পুতুল—পুতুল মুখে হাসির আভাস এনে প্রশ্ন করলে, আপনি হঠাৎ?

একটা কাজের খবর নিয়ে এসেছি।—নায়ক বললে।

কি কাজ?

চৌধুরি অ্যান্ড চৌধুরির অফিস—ক্লাব তাদের থিয়েটারে আপনাকে চায়।

প্লে কবে?

আসছে মাসের সাতাশে।

জ্যাঠামশাই বললেন, কথা পরে বলিস দূর্বা, আগে ওনাকে চা—টা দে। আর আমাকেও একটু—

গম্ভীর মুখে দূর্বা বললে, তোমাকে হরলিকস।

নিতান্ত বাধ্য ছেলের মতো জ্যাঠামশাই বলে উঠলেন, ঠিক! হরলিকসই ভালো। চা অতি অনিষ্টকর, কেন যে লোকে খায়!

কষ্টে হাসি চাপলে নায়ক। দূর্বাকে জিজ্ঞেস করলে, সাতাশে আপনি ফ্রি আছেন?

আসুন, ডায়েরি দেখে বলছি।

.

ঢাকা বারান্দায় চা ঢালতে ঢালতে দূর্বা বললে, হ্যাঁ, সাতাশে আমি ফ্রি আছি।

ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে বারান্দায়। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে দূর্বার কপালের রুখু চুল আর গায়ের আঁচল। সেদিকে তাকিয়ে নায়ক বললে, আর একটা কথা। ওদের কাছে বলেছি, আপনার ফি তিনশো।

চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে দূর্বা বললে, বাড়িয়ে বললেন কেন? আপনি তো জানেন, আমি অত টাকা পাই না।

নায়ক বললে, অ্যামেচার থিয়েটার—মহলে আপনার নাম হয়েছে। এখনো দেড়শো টাকায় পড়ে থাকবেন? নিজে না বাড়ালে রেট কখনো বাড়ে না দূর্বা দেবী। জীবনে নামের সঙ্গে সঙ্গে দামেরও প্রয়োজন আছে বইকি।

হরলিকসের কাপটায় চামচ নাড়তে নাড়তে দূর্বা প্রশ্ন করে বসল, আপনি হঠাৎ আমার উপকার করতে গেলেন কেন?

প্রশ্নটা অশোভন, কিন্তু দূর্বার পুতুল—পুতুল মুখে অতিশয় সরল মনে হল। নায়ক অল্প হেসে বললে, অন্যায় করেছি কি? মনে করুন না, আমি আপনার বন্ধু।

বন্ধু তো সবাই।—ঠান্ডা গলায় দূর্বা বললে।

তবে না হয় আমাকে আত্মীয় মনে করুন।

আত্মীয় কোন সম্পর্কে?

নায়ক বললে, আত্মীয়তা কি শুধু রক্তের সম্পর্কেই হয়? মনের সম্পর্কে নয়? আপনাদের ছোট্ট পরিবারকে আমার ভালো লেগেছে। বিশেষ করে চমৎকার মানুষ আপনার জ্যাঠামশাই!

জ্যাঠামণির মতো মানুষ হয় না। আস্তে আস্তে দূর্বা বললে।

আর, আপনার মতো এত সাদাসিধে মেয়েও বড় একটা দেখিনি। তাই আপনাদের সহজেই আপন মনে হয়েছে—আপনাকে বন্ধু বলে ভেবেছি। দোষ হয়ে থাকলে কিছু মনে করবেন না।

অপ্রস্তুত হয়ে গেল দূর্বা। বললে, না, না, দোষ হবে কেন?—একটু বসুন, হরলিকসটা জ্যাঠামণিকে দিয়ে আসি।

দূর্বা ফিরে এলে নায়ক বললে, তাহলে চৌধুরি অ্যান্ড চৌধুরিকে জানিয়ে দিই যে কাজটা আপনি নিলেন?

ঘাড় নেড়ে দূর্বা জিজ্ঞেস করলে, রিহার্সাল কোথায় হবে? ঠিকানাটা দিয়ে যান।

ঠিকানা কি হবে? আমি এসে নিয়ে যাব।

কেন কষ্ট করবেন? আমি নিজেই চিনে যেতে পারব।

নায়ক বললে, তা পারবেন জানি। কিন্তু মনে হচ্ছে, এখনো আমাকে বন্ধু বলে ভাবতে পারেননি। বিংশ শতাব্দীর মেয়ে হয়েও কোথায় যেন সংস্কারে আটকাচ্ছে, তাই না?

হেসে ফেললে দূর্বা। হাসলে ওর ফুলো ফুলো গালে টোল পড়ে। বললে, আপনি ভীষণ জেদি মানুষ দেখছি! আচ্ছা, আপনার সঙ্গেই না হয় যাব।

হাসিমুখে নায়ক বললে, এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো কথা।

উনত্রিশ বছরের যৌবন প্রশ্ন করলে, আমার সঙ্গে কতদূর যেতে পারবে দূর্বা? যতদূর আমি নিয়ে যাব, ততদূর যেতে পারবে কি?

দূর্বা বললে, রিহার্সাল কবে?

যাবার জন্যে উঠে পড়ে নায়ক বললে, আপনার জ্যাঠামশায়ের দাবার ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। প্রায়ই আমাকে আসতে হবে। সময়মতো খবর দেব।

.

এরপর থেকে নায়কের দিনের রুটিন হয়ে দাঁড়াল দূর্বাদের বাড়ি যাওয়া। ঘণ্টাখানেক দাবার ক্লাসে, তারপর দূর্বার সঙ্গে ঢাকা বারান্দায়। ময়দানে নয়, সিনেমায় নয়, রেস্তোরাঁয় নয়—শুধু পুবের সেই একটুকরো ঢাকা বারান্দায়।

বারান্দায় বসলে একফালি আকাশে তারা দেখা যায়, কুণ্ডুদের চিলেকোঠার পাশ দিয়ে চাঁদ মুখ বাড়ায়। দক্ষিণ ঘুরে ফুরফুরে শৌখিন হাওয়া খামখেয়ালে ঢুকে পড়ে আর দূর্বার টবের বেলকুঁড়ি শিউরে ওঠে।

ঢাকা বারান্দায় স্টোভ জ্বেলে দূর্বা চা করে, রান্না করে, আর গল্প করে। তার সেই ঠান্ডা আড়ষ্টতা একটু একটু করে অনেকটা কেটে গেছে। খোলসের ভেতর থেকে শামুক মুখ বাড়ায় আজকাল। চাপা প্রকৃতির মেয়ে দূর্বার ভেতর থেকে তেইশ—চব্বিশ বছরের একটি যুবতী মাঝে মাঝে উঁকি দেয়।

সন্ধ্যার পর গা ধোয়া অভ্যাস দূর্বার, হালকা করে পাউডার ছাড়া আর কোনো অঙ্গরাগ সে ব্যবহার করে না। কোনোমতে জড়ানো এলোখোঁপায় কখনো—সখনো গুঁজে রাখে দুটো বেলফুল। দেখে দেখে নায়কের ভদ্র মন বলে ওঠে, বাঃ! যেন কোন পল্লি—কবির তৈরি একটা প্রেমের গান!

আবার যখন মেঝেয় বসে বঁটিতে আনাজ কুটতে থাকে, তখন ব্লাউজের ফাঁকে তেইশ বছর বয়সটাকে দেখে নায়কের উনত্রিশ বছরের যৌবন তারিফ করে বলে, বাঃ! যেন ওমর খৈয়ামের হাতের এক পেয়ালা নেশা!

পাঠক, আমাদের গল্প মাস কয়েক ধরে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে দূর্বাদের সেই ঢাকা বারান্দায়। নায়ক মাঝে মাঝে বলে, এই ছোট্ট বাড়ির খাঁচাটার মধ্যে কি আছে বলো তো? এখান থেকে নড়তে চাও না কেন?

নিতান্ত উদাসীনের মতো দূর্বা বলে, কোথায় যাব?

চলো না, কোথাও বেড়িয়ে আসি। কোনো ফাঁকা জায়গায়।

স্টোভে তরকারি চাপিয়ে দূর্বা জবাব দেয়, এই তো বেশ।

একদিন কিন্তু দেখা গেল, দূর্বা ছোট একটা সুটকেশে জামা—কাপড় গুছিয়ে রাখছে।

নায়ক জিজ্ঞেস করলে, কি ব্যাপার?

রঙ্গরূপা দলের সঙ্গে খড়্গপুরে যাচ্ছি। প্লে আছে।

খাঁচার দরজা খুলল তাহলে! ক’দিনের জন্যে যাচ্ছ?

দু’দিন থিয়েটার।

এ দু’দিন আমি কি করব? একদম বেকার হয়ে যাব যে!

হেসে দূর্বা বললে, জ্যাঠামণির সঙ্গে দাবা খেলবে। তিনদিনের দিন সকালের ট্রেনেই তো ফিরছি।

দূর্বা চলে গেল খড়্গপুরে। তৃতীয় দিন ভোরবেলা রঙ্গরূপার ম্যানেজার দূর্বাকে বললে, আপনাকে এক ভদ্রলোক খুঁজছেন।

অবাক হয়ে গেল দূর্বা। খড়্গপুরে তার পরিচিত কেউ নেই। বাইরে এসে দেখলে নায়ক অপেক্ষা করছে!

নায়ক বললে, কলকাতা ভালো লাগল না। তাই অফিসে ছুটি নিয়ে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি ফিরবে তো চলো।

ছোট থাপারের তিনখানা মোটরের একখানা চেয়ে এনেছে নায়ক। ড্রাইভিং লাইসেন্স আগেই করানো ছিল। সুটকেশ নিয়ে এসে দূর্বা গাড়িতে উঠে বসল। গম্ভীর হয়ে বললে, এ পাগলামির কি দরকার ছিল? ওরা কি ভাবলে বলো তো?

কি ভাবলে ওরা? গাড়ি চালাতে চালাতে নায়ক জিজ্ঞেস করলে।

উত্তর দিলে না দূর্বা। পথের দিকে তাকিয়ে রইল।

তার দিকে এক ঝলক চেয়ে নায়ক ভালো ছেলের মতো বললে, চলো, তোমাকে তাহলে ওদের কাছেই রেখে আসি।

হঠাৎ ব্রেক টিপে গাড়ি ঘোরাবার উপক্রম করলে নায়ক।

হেসে ফেলে দূর্বা বললে, আচ্ছা পাগল তো! আবার বুঝি ফিরে যাওয়া যায়?

অ্যাক্সিলিরেটর চেপে নায়ক বললে, তাহলে সামনের দিকেই এগনো যাক।

গাড়ি চল্লিশ মাইল স্পিড নিলে। চওড়া রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দু—পাশে দীর্ঘ গাছের সারি, পাতার ফাঁক দিয়ে সকালের ঝিলমিল রোদের টুকরো রাস্তাময় রুপোলি জরির কাজ করে রেখেছে। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায় নতুন জীবনের চঞ্চলতা। পাখি ডাকছে।

কেমন লাগছে সকালবেলাটা? প্রশ্ন করলে নায়ক।

গালে টোল পড়িয়ে মিষ্টি করে হাসলে দূর্বা। ভালো লাগছে—খুব ভালো লাগছে তার। নগর থেকে দূরে এসে পেয়ারাবাগানের সেই ছোট্ট বাড়ির খাঁচাটাকে ভুলে যাচ্ছে সে। ভুলে যাচ্ছে তার বাঁধা জীবনের রুটিন। জ্যাঠামণির হরলিকস তৈরি, রান্না, থিয়েটারের রিহার্সাল। খোলা আকাশের নিচে, ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায়, ধ্রুব ধাবমান পথের ওপর জীবনের একটা নতুন স্বাদ পাচ্ছে দূর্বা।

সমুদ্র দেখেছ কখনো? নায়ক জিজ্ঞেস করলে।

দূর্বা বললে, কবে আর দেখলাম!

দেখতে যাবে?

চোখ বড় বড় করে দূর্বা বললে, সমুদ্র! কোথায়?

নায়কের বলতে ইচ্ছে হল, তোমার আমার রক্তের মধ্যে।

মুখে বললে, চলো, দিঘা ঘুরে যাই।

.

একটা কটেজ ভাড়া নিলে নায়ক।

গাড়ির ক্যারিয়ারে বেতের বাক্স ছিল, তার মধ্যে রুটি, জ্যাম, ফল আর ফ্লাস্কে কফি। কটেজেই স্নান সেরে দুজনে ব্রেকফাস্ট করে নিলে। হোটেলে অর্ডার দিয়ে এল নায়ক, দুপুরবেলাটা কাটল খাওয়া—দাওয়ায়।

দুনিয়ার যেখানেই হোক, বাসা বাঁধা মেয়েদের স্বভাব। সে—বাসা নিতান্ত সাময়িক, নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী হলেও। দূর্বাও এরই মধ্যে গুছিয়ে ফেলেছে। একদিনের সংসার, রোদে মেলে দিয়েছে ভিজে শাড়ি আর তোয়ালে, ধুয়ে রেখেছে ব্রেকফাস্টের প্লেট আর কাপ। পেয়ারাবাগানের বাড়িতেও তাকে সংসার করতে দেখেছে নায়ক, কিন্তু মনে হল আজ দূর্বার সব কাজে একটা অশ্রুত সুর, খুশির ছন্দ রয়েছে। ভালো আজ নায়কেরও লাগছে। ব্যাচিলর সে, জীবনের অনেকখানি অংশ কেটেছে জীবনের সরাইখানায় পান্থ হিসাবে। নারীর এই ঘরোয়া রূপটা তার দেখা হয়নি। আজ সারাটা দিন সেও মনে মনে একটা ভিন্ন স্বাদ উপভোগ করছে। সে—স্বাদ শুধু মিষ্টি নয়, মাদকও বটে।

সারাটা দিন দূর্বার ঘুরে ঘুরে কাজ করা দেখছে সে। বারে বারে দেখছে তার যুবতী—দেহের চলন, দোলন, ছন্দ। আর মনের মধ্যে সেই মিষ্টি মাদক স্বাদ আরো তীব্র মাদক হয়ে উঠছে।

বিকেলে রোদ পড়ে এলে দুজনে সমুদ্রের ধারে গেল। অন্য ভ্রমণকারীদের থেকে বেশ খানিকটা তফাতে একটা নির্জন জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ল বালির ওপর। আশপাশে ঝাউয়ের বন, বাতাসে অবিরাম অদ্ভুত শব্দ।

দূর্বার সমুদ্র দেখা এই প্রথম। সূর্যাস্তের সোনায় শান্ত জলের বিস্তার চিকচিক করছে, যতদূর চোখ যায়, ততদূর অবধি জলে আকাশে একাকার। চুপ করে চেয়ে রইল দূর্বা।

নায়ক প্রশ্ন করলে, সমুদ্র কেমন দেখছ?

মৃদু গলায় দূর্বা বললে, ভালোও লাগছে, আবার ভয়ও করছে!

ভয় কেন?

দূর্বা বললে, মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা এইখানে এসে যেন ফুরিয়ে গেছে!

হেসে উঠল নায়ক। বললে, ভারি ভিতু তুমি! যাক না পৃথিবী ফুরিয়ে, আমরা তো আর ফুরিয়ে যাইনি। আকাশের অসংখ্য গ্রহের মধ্যে পৃথিবী একটা ছোট্ট উপগ্রহ, আমরা না হয় অন্য কোনো গ্রহে চলে যাব।

দূর্বা বললে, বারে, বাড়ি ফিরতে হবে না বুঝি?

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নায়ক বলে উঠল, হোপলেস! সমুদ্রের ধারে বসেও তুমি সেই পেয়ারাবাগানের খাঁচার কথা ভাবছ! সেই একটুকরো ঢাকা বারান্দা, রান্না, জ্যাঠামশায়ের হরলিকস, আর রিহার্সাল ছাড়া জীবনে কি আর কিছুই নেই?

কী—ই বা আছে?

দূর্বার গলাটা কেমন উদাস শোনাল।

নায়ক বললে, কী নেই? জীবনে অনেক সুখ, অনেক আনন্দ আছে—ভালোবাসবার, ভোগ করবার অনেক বস্তু আছে!

তেমনি গলায় দূর্বা বললে, ওসব আমার জন্যে নয়।

কেন নয়? কতই বা বয়স তোমার! জীবনে সুখের স্বাদ নেওয়ার এই তো সময়! কেন তুমি নিজেকে সরিয়ে রেখেছ দূর্বা? কেন ঠকাচ্ছ নিজেকে?

মুখ নিচু করে বালির ওপর আঁচড় কাটতে লাগল দূর্বা। একটু বাদে আস্তে আস্তে বললে, নিজেকে কেউ কি ঠকায়? আমার কথা তুমি কিছুই জানো না, জানলে বুঝতে আমিও নিজেকে ঠকাইনি—ঠকে গেছি কপাল দোষে।

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নায়ক বললে, কি তোমার কথা? আমাকে বলা যায় না?

দূর্বা হঠাৎ মুখ তুলে বললে, আমি বিধবা।

খুব সহজভাবে নায়ক বললে, তাতে কি হয়েছে? আজকের সমাজে বিধবা বলে কিছু নেই। সিঁদুরের দাগ আজকাল এত ফিকে হয়ে এসেছে যে, মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখাই যায় না।

হেসে উঠে নায়ক আবার বললে, আমাদের সমাজ অনেকটা এগিয়ে গেছে। সংস্কারের চেয়ে মানুষের সুখের দাম এখন বেশি। স্বামী মরলে স্ত্রীকেও সারাটা জীবন মরে থাকতে হবে—এটা কোনো যুক্তি নয় দূর্বা।

দূর্বা বললে, কিন্তু আমার স্বামী বেঁচে থাকতেই আমি বিধবা।

সেকি! অবাক হয়ে গেল নায়ক।

নায়কের ওপর থেকে সমুদ্রের ওপর চোখ রাখেলে দূর্বা। বহু দূরে দৃষ্টি ভাসিয়ে বলতে লাগল, চার বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছিল। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে জ্যাঠামণি পাত্র পছন্দ করেছিলেন। বি. কম. পাস, স্বাস্থ্যবান চেহারা, ব্যবসা করে। পাত্রের বাপ—মা, আত্মীয়স্বজন সব বিদেশে থাকেন, বিয়ের সময় কেউ আসতে পারেননি। তাই ফুলশয্যাও আমাদের পেয়ারাবাগানের বাড়িতেই হল। পরের দিন ভোর থেকে আমার স্বামীকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সেই সঙ্গে আমার গায়ের সমস্ত গয়নাও নিখোঁজ! মাসখানেক বাদে জানা গেল সে জেল খাটছে।

জেল খাটছে! কি জন্যে?

সে একজন দাগি ওয়াগন ব্রেকার ছিল। আরো বছরখানেক পরে খবরের কাগজ থেকে জানতে পেরেছিলাম, জেল ভেঙে সে পালিয়েছে।

তারপর?

যেন বহুদূর থেকে ভেসে এল দূর্বার গলার স্বর, তারপর আর কিছু নেই। সে আর আসেনি।

নায়কের মনে পড়ল জ্যাঠামশাইয়ের সেই কথা, ‘জগৎ—সংসারটাই তো একটা দাবার ছক!’ দূর্গার জীবনের এই বিশ্রী ট্র্যাজেডির পর থেকেই তিনি হয়তো এই সত্যটা উপলব্ধি করেছেন।

তুমি কি তাকে ভালোবেসেছিলে দূর্বা? নায়ক জিজ্ঞেস করলে।

না। ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। স্বামীকে ভালোবাসতে কে না চায়?

এখনো তার জন্যে অপেক্ষা করে আছ?

না।

তবে? কামনা—বাসনা ত্যাগ করে নিজের মনটাকে গেরুয়া পরিয়ে রেখেছ কি জন্যে?

এই তো ভালো। আর ঠকবার ভয় নেই।—আস্তে আস্তে দূর্বা বললে।

নায়ক বললে, একটি মাত্র পুরুষ তোমাকে ঠেকিয়ে গেছে বলে এতবড় দুনিয়ার সমস্ত পুরুষকেই তুমি ঠকবাজ ভাবছ? তাই যদি ভাবো, তাহলে থিয়েটারের লাভ—সিন’এ অত ভালো অভিনয় করো কি করে?

এ প্রশ্ন তুমি আগেও করেছিলে!—একটু থেমে দূর্বা বললে, অভিনয়ের আগে মনে মনে আমি একজন পুরুষকে কল্পনা করে নিই, যে শুধু আমাকেই চায়, আমাকেই ভালোবাসে।

তেমন পুরুষ কি শুধু কল্পনা ছাড়া তোমার আশপাশে কোনোদিন দেখনি?

না, পুরুষদের সঙ্গে আমার পরিচয়টা থিয়েটার—মহলে, সেখানে যা দেখেছি, তা ভালোবাসা নয়।

দূর্বার আরো কাছে সরে বসল নায়ক। সমুদ্রের হাওয়ায় তার গালের পাশে চুল উড়ছে, পিঠের আঁচল উড়ছে। তার গায়ের পাউডারের একটা ক্ষীণ সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সূর্য সবে ডুবেছে। ঠিক অন্ধকার নয়, অন্ধকারের আবেশ নামছে। সেই ছায়া—গোধূলির পরিবেশে সমুদ্রতীরে বসে নায়কের মনেও একটা অদ্ভুত আবেশের সঞ্চার হল। দূর্বার একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে সে বললে, তেমন পুরুষ আছে দূর্বা—তোমার থিয়েটার—মহলের বাইরেই আছে—যে শুধু তোমাকেই চায়, শুধু তোমাকেই ভালোবাসে। জানো তুমি?

নায়কের মুঠির মধ্যে দূর্বার নরম হাত একবার কেঁপে উঠল। অস্পষ্ট গলায় বললে, জেনে কি হবে! সে হয়তো আজও বেঁচে আছে!

কে?

সেই লোকটা—দু’দিনের জন্যে যে আমার স্বামী হয়েছিল।

দূর্বার হাতখানা শক্ত করে ধরে নায়ক বললে, কিন্তু তোমার কাছে সে আজ মৃত। যেমন করে তুমি মাথার সিঁদুর মুছে ফেলেছ, তেমনি করে সেই ওয়াগন—ব্রেকারের নামটাও মুছে ফেলে দাও। তার কথা ভেবে তোমাকে আর অসুখী হয়ে থাকতে দেব না দূর্বা, আমি তোমাকে সুখী করব। তোমাকে আমি ভালোবেসেছি—অনেক, অনেক ভালোবেসেছি!

এমন কথা শোনা দূর্বার তেইশ বছরের জীবনে এই প্রথম। শুনতে শুনতে দূর্বার দেহের শিরা—স্নায়ুগুলো সব একসঙ্গে ঝংকার দিয়ে উঠল; শুধু হাতখানা নয়, সারা দেহটাই তার থরথর করে উঠল বাতাসে কাঁপা ঝাউপাতার মতো। একটা আশ্চর্য সুখের অনুভূতিকে প্রাণপণে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে করতে সে বলে উঠল, বোলো না—ওসব কথা বোলো না আমায়—

তার মুখের ওপর মুখ রেখে দুরন্ত হাওয়ার মতো নায়ক বলতে লাগল, বলব—আবার বলব—বার বার বলব: তোমায় আমি ভালোবেসেছি দূর্বা, অনেক—অনেক—অনেক ভালোবেসেছি!

হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল নায়কের কথা। দু’জোড়া তৃষ্ণার্ত ঠোঁট পরস্পরের সঙ্গে লেগে রইল। আর, উষ্ণ নিশ্বাসের শব্দ মিশে গেল ঝাউবনের নিশ্বাসে।

রাত কত, কে জানে।

ঘুমের পাখি আজ উড়ে গেছে, বাসা বাঁধেনি দু’চোখের পাতায়। দারুচিনির স্বাদের মতো মিষ্টি ঝাঁঝালো স্বাদে এখনো জ্বালা করছে ঠোঁট দু’খানা।

কটেজের বিছানায় একা শুয়ে দূর্বা। বিছানায় যেন কাঁকর ছড়ানো।

দূর্বা! দূর্বা!

কে ডাকছে? সমুদ্র? না, নিশি ডাকছে?

দূর্বা!

আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে বসল দূর্বা। না, সমুদ্র নয়, নিশি নয়, দূর্বা বুঝতে পেরেছে কার ডাক। ঝড় ডাকছে। যে—ঝড় ডাকাতের মতো এক মুহূর্তে তার সর্বস্ব লুটে নিয়ে তাকে নিঃস্ব উলঙ্গ করে দেবে! না, সাড়া দেবে না দূর্বা। কিছুতেই খুলবে না তার দরজার আগল।

আবার শুয়ে পড়ল দূর্বা।

কিন্তু তেইশ বছর বয়সটা তার কানের পাশে বলতে লাগল, দরজা খুলে দিলে ক্ষতি কি? দেহটাকে যতই বিধবার সাজে সাজিয়ে রাখো, মনে মনে তুমি এই ঝড়কেই তো চেয়েছ! ওঠো, খুলে দাও আগল।

আবার উঠে বসল দূর্বা। কি করবে সে এখন? দরজা খুলবে? না, খুলবে না? আর, এই কথা ভাবতে ভাবতেই সে দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়ে বিছানায় ফিরে এল।

অন্ধকারে একটা ছায়া—পুরুষ ঘরে ঢুকল। এগিয়ে এল বিছানার কাছে।

কাঁপা গলায় দূর্বা উচ্চচারণ করলে, কে?

তার জঙ্ঘার ওপর হাত রেখে আবছা গলায় নায়ক বললে, আমি।

একটা তীব্র মাদক রসে দূর্বার জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে। সেই জড়ানো স্বরে সে শুধু বলতে পারল, না—

তারপর ঝড় উঠল। আর, সে—ঝড়ে দেহে—মনে নিঃশেষ হয়ে গেল দূর্বা।

.

দিঘা থেকে আবার পেয়ারাবাগানের গলি।

পরদিন নায়কের মোটর যখন গলির মুখে থামল, বেলা তখন প্রায় দুপুর। সারাটা পথ দূর্বা কথা বলেছে কম, চুপ করে থেকেছে বেশি। নায়কের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসেছিল। যেন ওই একটিমাত্র পুরুষের ওপর নির্ভর করে দুনিয়ার শেষপ্রান্ত অবধি সে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারে।

বেশির ভাগ পুরুষের প্রেমের বীজ থাকে দেহজ কামনার মধ্যে। দেহ বেয়ে উঠে সে—প্রেম মনে ফুল ফোটায়। মেয়েদের বেলায় উলটো। মেয়েদের প্রেম জন্মায় মনে! কিন্তু সে—প্রেম আকাশ কুসুম, মাটিতে তার শিকড় নেই। দেহের সম্পর্ক হলে তবেই সে—প্রেম স্পষ্ট হয়, সত্য হয়, পাকা ফলের মতো পরিণতি লাভ করে। তাই আজ দূর্বার কাছে আমাদের নায়ক রাতারাতি হয়েছে ‘মাই ম্যান’—’আমার পুরুষ’। আর, দূর্বার ক্লান্ত সুন্দর মুখের পানে তাকিয়ে নায়কও ভাবছে, ‘মাই গার্ল’—’আমার রমণী’।

গলির মুখে গাড়ি থেকে নামবার আগে দূর্বা নায়কের হাতটা ছুঁয়ে প্রশ্ন করলে, কবে আসবে?

হাসি মুখে নায়ক বললে, কাল।

কিন্তু ‘কাল’ আর আসেনি। পেয়ারাবাগানের বাড়িতে পরদিন আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি নায়কের। তার পরের দিনও নয়, তারপর আরো অনেকদিন নয়।

।। কলাপী।।

এই পর্যন্ত এসে আমাদের গল্প হঠাৎ বাঁক নিয়েছে। গল্পের ধারা বেঁকে গেছে বটে, কিন্তু তার গতি হয়েছে দ্রুততর; ঘটনার নুড়ি ডিঙিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। হয়তো ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি, কোথাও বা অসঙ্গতি এসে পড়েছে। তা হোক, অসঙ্গতি আর অসংলগ্নতাই আজকের গল্পের লক্ষণ। কেননা, আজকের যৌবন অতিমাত্রায় অস্থির, তার চিন্তায় কাজে আর মনে কোনো সঙ্গতি নেই।

অতএব, ফরমায়েস করবেন না। এ—যুগের গল্প আপনার ফরমায়েস শুনবে না, তাকে নিজের খেয়ালে চলতে দিন।

দিঘা থেকে ফিরে আসার পরদিন ছোট থাপার নায়ককে তার কামরায় ডেকে পাঠালে। একখানা কার্ড দিয়ে বললে, আজ সন্ধে সাতটায় রবীন্দ্র—সদনে কালচারাল ক্লাবের একটা চ্যারিটি শো আছে। আমার তো যাবার সময় হবে না, তুমি আমার হয়ে পাঁচশো টাকার একখানা চেক দিয়ে আসতে পারবে?

কাকে দিতে হবে? নায়ক জিজ্ঞেস করলে।

ক্লাবের সেক্রেটারি মিসেস জাহানারা চৌধুরিকে।

নিশ্চয় পারব স্যার।

মনিবকে কখনো অখুশি করতে নেই। সুতরাং থাপারের চেক নিয়ে নায়ক সেদিন সন্ধেবেলা রবীন্দ্র—সদনে হাজির হল। ভেবেছিল, চেকখানা পৌঁছে দিতে আর কতক্ষণ লাগবে? তারপর রবীন্দ্র—সদন থেকে সোজা পেয়ারাবাগান। দূর্বা অপেক্ষা করছে।

কিন্তু সব ভেস্তে গেল। রবীন্দ্র—সদনে গিয়ে মিসেস জাহানারা চৌধুরির খোঁজ করতেই ক্লাবের এক কর্মকর্তা বললেন, তিনি এখন গ্রিনরুমে, একটু বসুন।

বলে থাপারের জন্য নির্দিষ্ট সিটে নায়ককে তিনি বসিয়ে দিলেন। ‘বস’কে খুশি করা চাই সবার আগে। অগত্যা বসে থাকা ছাড়া আর উপায় রইল না। আর, বসে থাকতে থাকতে নিভে এল অডিটোরিয়ামের বাতি, মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে সরে গেল স্টেজের পর্দা, শুরু হল রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’র নাচ।

কী আর করা যায়। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুক দূর্বা।

নাচের কিছুই বোঝে না আমাদের নায়ক। তবু আলোর বাহারে ঢেউ—খেলানো যুবতী—দেহের লাস্য দেখতে মন্দ লাগছিল না। তবে এই স্পিডের যুগে সবটাই এত মন্থর যে, হাত আড়াল দিয়ে দু’একবার হাই তুললে নায়ক।

এই রবীন্দ্র—সদনেই আমাদের গল্পের তৃতীয় নায়িকার আবির্ভাব। তার কোনো নামকরণের দরকার নেই। সে নাম—করা মেয়ে, যথাকালে তার নাম জানা যাবে।

শো ভাঙল রাত দশটায়। ক্লাবের সেই ভদ্রলোকটি এসে বললেন, আসুন, মিসেস চৌধুরি আপনাকে ডাকছেন।

ভদ্রলোকটি নায়ককে গ্রিনরুমের দিকে নিয়ে গেলেন। ঢোকবার মুখেই বাধা। দেখা গেল, একটা ধাপের ওপরে দক্ষিণ ভারতীয় ধাঁচের সাজপোশাকে সেজে একটি যুবতী আত্মপ্রসাদের হাসি হাসছে। একগোছা ফুল বুকের কাছে ধরা। আর, তাকে ঘিরে একদল ছোকরা প্রেস—ফোটোগ্রাফার বাংলা—ইংরেজি অভিধানের বাছা বাছা কড়া বিশেষণগুলো ছুড়ে মারছে—

একসেলেন্ট!

সুপার্ব!

ওয়ান্ডারফুল!

অপূর্ব!

সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো ক্যামেরার ক্লিক আর ফ্ল্যাশ।

মিহি আদুরে গলায় শোনা গেল, নো মোর প্লিজ—আই অ্যাম সো টায়ার্ড!

তফাতে দাঁড়িয়ে নায়ক চিনলে, এই মেয়েটিই স্টেজের শ্যামা। ছোকরা ফোটোগ্রাফারদের ভিড় পাতলা হয়ে এল। ভদ্রলোকের পেছন পেছন স্টেজের প্রবেশ—মুখে এগোতেই নায়কের কাঁধে একটা হাত পড়ল।

চিনতে পারছ?

তারই সমবয়সী একজন যুবক তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পরনে বড় গোছের হাওয়াই অফিসারের পোশাক। দীর্ঘ অদর্শনের কুয়াশা কাটতে একটু সময় গেল। নায়ক চিনলে—অনিমেষ মজুমদার, একদা তার কলেজের সহপাঠী।

হাসতে হাসতে অনিমেষ বললে, হাওয়াই অফিসার না হয়ে আমার গোয়েন্দা হওয়াই উচিত ছিল। এক নজরেই তোমাকে চিনে ফেলেছি। কিন্তু কতদিন বাদে দেখা বলো তো?

মনে মনে হিসেব করে নায়ক বললে, সাত বছর।

একসঙ্গে অনেক কথা বললে অনিমেষ, এই সাত বছরে পুরানো বন্ধুরা কে কোথায় ছিটকে পড়েছে, কে জানে! ভারি খুশি লাগছে তোমায় দেখে। একদিন এসো না আমার ওখানে। কালই ইভনিংয়ে এসো, কেমন?

দূর্বার কথা মনে পড়ে গেল। নায়ক বললে, কাল না হলেও দু’চারদিনের মধ্যেই যাব।

না, না, কালই এসো; পরশু মর্নিংয়ে আমি বার্সেলোনা ফ্লাই করছি। কাল রাতে আমার সঙ্গে ডিনার খাবে, বুঝলে?

রাঙাদা, চলো।—সেই মিহি আদুরে গলা।

অনিমেষ বললে, এদিকে আয়, আলাপ করিয়ে দিই। আমার কলেজের বন্ধু, আর আমার ছোট বোন কলাপী মজুমদার—আজকের শো—তে ‘শ্যামা’ সেজেছিল।

ছোট্ট নমস্কার সেরে নায়ক বললে, সে তো দেখলাম।

কলাপী মজুমদারকে এতক্ষণে ভালো করে দেখার অবকাশ পেলে নায়ক। সরু কোমর আর গুরু নিতম্বের সুঠাম গড়নটাই সবার আগে চোখে পড়ে। রঙ—মাখা মুখ তেমন সুশ্রী না হলেও কাজলটানা চোখের চাউনিতে বিভ্রম সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙে হলুদের আভা মেশানো। কলাপী মজুমদারের চেহারায় রূপের চেয়ে মোহ বেশি।

অনিমেষ বললে, তোরা আলাপ কর, গাড়িটা এল কিনা আমি দেখে আসি।

চলে গেল অনিমেষ।

বাঁ—দিকের আঁকা ভুরু তুলে কলাপী প্রশ্ন করলে, আমার নাচ কেমন লাগল বললেন না?

একটু হেসে নায়ক বললে, কি বলব? যতটা প্রশংসা করবার, সবই তো একটু আগে করা হয়ে গেল।

আদুরে গলায় কলাপী বললে, সত্যি, ওদের প্রশংসা শুনে শুনে আমি ক্লান্ত! আপনি বরং নিন্দে করুন।

হালকা সুরে নায়ক বললে, প্রথম দিনের আলাপেই আমাকে নিন্দুক ভাবলেন?

ও! আপনি বুঝি মেয়েদের মোটেই নিন্দে করেন না? শুধুই খোশামোদ?

মিহি আওয়াজে হেসে উঠল কলাপী। হাসলে ওর গলার স্বরটা কেমন ধাতব মনে হয়।

নায়কের পৌরুষে বোধকরি ঘা লাগল। বললে, কি করব বলুন! পুরুষের একটি মাত্র পাঁজরা থেকে যারা তৈরি হয়েছে, তাদের মনে কষ্ট দিতে বাধে।

এ ধরনের জবাব কলাপী আশা করেনি। কয়েক সেকেন্ড গুম হয়ে রইল সে। তারপর বললে, পুরুষ বলে আপনার খুব গর্ব, না? তাই বুঝি মেয়েদের ছোট করে দেখেন?

নায়ক কিছু বলবার আগেই অনিমেষ এসে পড়ল।

গাড়ি এসেছে, আয় রিনি। চলি হে, কাল এসো কিন্তু। বাড়িটা মনে আছে তো? সেই হিন্দুস্থান পার্ক।

নায়কের দিকে কেমন এক অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে চলে গেল রিনি ওরফে কলাপী মজুমদার। আর, তার সেই গুরু নিতম্বের দোলন দেখতে দেখতে নায়ক ভাবতে লাগল, অত কড়া জবাব না দিলেই ভালো হত। কে জানে তাকে কী ভাবলে কলাপী!

আশপাশে চেয়ে দেখলে, সঙ্গের সেই ভদ্রলোকটি কখন সরে পড়েছেন। নায়ক এবার নিজেই মিসেস জাহানারা চৌধুরির সন্ধানে এগোল।

.