কাগজের ফুল – ২

পার্টির কথা শুনে মুক্তা বললে, তোমার সঙ্গে যাব, তা আবার জিজ্ঞেস করছ কেন?

নিমন্ত্রণটা সে এত সহজভাবে নেবে আশা করেনি নায়ক। ভেবেছিল, বুঝিয়ে—সুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। হালকা বোধ করলে নায়ক।

মুক্তা বললে, পার্টি—ফার্টির কায়দা—কানুন আমি কিছুই জানি না। সামলে নিও কিন্তু।

নায়ক বললে, পাঁচজন আসবে, একটু ভালো করে সেজে এসো, কেমন?

মাথা ঝাঁকিয়ে মুক্তা বললে, ওসব আমার আসে না। তারপর চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়ে বললে, সাজগোজ শুধু একজনের জন্যে, পাঁচজনের জন্যে সাজতে আমার বয়ে গেছে!

কিন্তু সেজেই এল মুক্তা। সোয়া দু’শো টাকা মাইনের চাকুরে মেয়ের পক্ষে যতটা সাজতে পারা সম্ভব। সিল্ক নয়, বেনারসি নয়, দোপাটি রঙের মিহি তাঁতের শাড়ি পরেছে, তারই সঙ্গে ম্যাচ করা ব্লাউজ, চোখের পাতায় হালকা করে কাজল ছুঁইয়েছে, কপালে কুমকুমের টিপ ঘিরে ফুটফুট শ্বেত—চন্দনের ফোঁটা, বেণীতে ছ’পয়সা দামের একছড়া বেলফুলের হার জড়ানো।

সাজের বাহার নাই থাক, মুক্তা সাজতে জানে। নায়ক তাকে কাছে টানতেই তার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে মুক্তা বললে, এখন নয়, পার্টির পরে।

পার্টি! ছোট থাপারের লালচে মুখখানা মনে পড়ল। নায়ক বললে, থাকগে পার্টি, চলো অন্য কোথাও বেড়িয়ে আসি।

খুশি হয়ে মুক্তা বললে, তাই চলো। মাঠের দিকে।

একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে বসল দুজনে। কিন্তু ময়দানের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল ক্যামাক স্ট্রিটের একটা বাড়ির সামনে। রাত তখন আটটা কুড়ি।

মুক্তা বললে, এ কার বাড়ি?

নামতে নামতে নায়ক বললে, মিস্টার থাপারের। ‘বস’ যখন নিজে নেমন্তন্ন করেছেন, তখন ভেবে দেখলাম—পার্টিতে একেবারে না যাওয়াটা নেহাত অভদ্রতা হবে। এসো।

ফটকের পাশে শ্বেতপাথরে ইংরেজি হরফে লেখা ‘গুলমার্গ’। ছোট থাপারের ফ্যামিলি থাকে বর্ধমান রোডের পৈতৃক বাড়িতে। সেটাই তার আসল বাড়ি। ‘গুলমার্গ’—এর তিনতলার ফ্ল্যাটটা সে মাসিক সাতশো টাকায় ভাড়া নিয়েছে শুধু অবসর—বিনোদনের জন্য। এখানে শনিবার সন্ধ্যা থেকে সোমবার সকাল অবধি সে কাটায়।

নায়ক আলাপ করিয়ে দিলে, মিস্টার থাপার—মুক্তা বসু।

মুক্তার নমস্কারের বদলে ছোট থাপার বিলিতি সৌজন্যে মাথা নুইয়ে বললে, আপনি এসেছেন, ভারি খুশি হলাম। বসুন।

ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে নায়ক বললে আমরা বোধ হয় একটু আগেই এসে পড়েছি। অন্য গেস্টরা এখনো—

ওরা আসতে পারল না।—ছোট থাপার বললে, হয়েছে কি জানো? আমার এক বন্ধুকে হঠাৎ লিভারপুল যেতে হচ্ছে, ওরা তাই এয়ারপোর্টে গেছে।

কেন জানি না, নায়কের মনে হল এই কৈফিয়ৎটা আগে থেকেই তৈরি করা। থাপার বোধ হয় চায়নি আজকের পার্টিতে আর কেউ উপস্থিত থাকে। তবু একটা সুযোগ নিতে চেষ্টা করলে নায়ক। বললে, আমাদের জন্যেই আপনাকে আটকে থাকতে হয়েছে নিশ্চয়—আমরা বরং আরেকদিন—

হেসে উঠে ছোট থাপার বললে, না, না, তা কি হয়? আজ না হয় তিনজনেই পার্টি হোক।

তারপর মুক্তার দিকে চোখ রেখে বললে, আজ না হয় একটি ফুলেই ‘গুলমার্গ’ আলো হয়ে থাক।—প্লিজ, আপনি আরাম করে বসুন মিস বোস। মনে করুন না, এটা আপনারই ঘর।

সৌজন্য আর আতিথেয়তার দিক দিয়ে ছোট থাপার একেবারে টিপটপ।

অল্প হেসে মুক্তা বললে, ব্যস্ত হবেন না মিস্টার থাপার, আমি ঠিক আছি।

আপনাদের কি দিয়ে এন্টারটেন করি বলুন তো? মিউজিক শুনবেন, না একটা গান শোনাবেন?

মুক্তা বললে, ছোটবেলায় গাইতাম। এখন আর অভ্যেস নেই।

শোনাবেন না যখন, তখন শুনুন।

রেডিওগ্রামে ছোট থাপার মৃদু সুরে বিলিতি বাজনার রেকর্ড চালিয়ে দিলে। তারপর ডাকল, বেয়ারা!

বেয়ারা প্রস্তুত হয়েই ছিল। দুটো গ্লাসে স্কচ আর সোডা এনে হাজির করলে।

হুইস্কিতে নায়কের হাতেখড়ি এই প্রথম নয়। তবু মনিবের সামনে সঙ্কোচ বোধ হল। এছাড়া মুক্তার সামনেও সে আগে কখনো খায়নি। বুঝতে পেরে ছোট থাপার বললে, দেখো, অফিসে কড়া ‘বস’ বলে আমার বদনাম আছে বটে। কিন্তু এটা তো আর অফিস নয়, এখানে আমরা সবাই বন্ধু। সারা সপ্তাহ কাজ করি, একটা সন্ধ্যা এনজয় করলে দোষটা কী? আপনিই বলুন মিস বোস! আপনাকে একটা সফট ড্রিঙ্ক—মানে অরেঞ্জ স্কোয়াশ দিতে বলি?

মুক্তার জন্য অরেঞ্জ স্কোয়াশ আসতেই ছোট থাপার বললে, আসুন, চিয়ার্স!

রেডিওগ্রামে আবছা সুরে বিলিতি মিউজিজ বাজতে লাগল, আর চলতে লাগল টুকরো টুকরো কথাবার্তা। অফিসের কথা, মুক্তার কথা। সে কোথায় থাকে, বাড়িতে কে কে আছেন, কি কাজ করে—এই সব। আজকাল মেয়েরাও রোজগারের ক্ষেত্রে নেমে পড়েছে—সমাজের পক্ষে এটা খুবই ভালো কথা। তবে জীবনের উচ্চচাশা পূর্ণ করার জন্য আরো ভালো সুযোগ চাই। সুযোগ হচ্ছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ—যাদু—ই—চিরাগ—যা পেলে সুখের দুনিয়া তোমার হাতের মুঠোয়! আজকের সমাজ সোশ্যালিজমের বুলি আওড়ায় বটে, কিন্তু মানুষকে সুযোগ দিচ্ছে কই? মিস বোসের কথাই ধরা যাক। তাঁর মতো স্মার্ট মেয়ের কি সামান্য সেলস গার্ল হওয়ার কথা? সুযোগ পেলে—কে বলতে পারে—তিনি হয়তো দ্বিতীয় ক্লিওপেট্রা হতে পারতেন ঠিক নয় কি?

একশোবার ঠিক! হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নায়ক মনে মনে বললে। কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছে তার। এখন আর ছোট থাপারকে অত খারাপ বলে মনে হচ্ছে না। বাইরে থেকে মানুষকে বিচার করা উচিত নয়। মানুষটাকে এখন বেশ সহৃদয়, বেশ মাইডিয়ার মনে হচ্ছে।

মুক্তা আস্তে আস্তে বললে, সবার আশা সমান উঁচু হয় না মিস্টার থাপার।

তা হতে পারে। কিন্তু সুখে—শান্তিতে থাকতে কে না চায় বলুন? আপনিও কি চান না?—মিস বোস আপনাকে আরেকটু অরেঞ্জ দিক, কেমন?

কথাবার্তা চলতে লাগল। সমাজতন্ত্র থেকে ফিল্ম। ফিল্ম থেকে কলকাতার আবহাওয়া। বেয়ারা মাঝে মাঝে গ্লাস বদলে দিয়ে যাচ্ছে। বক্তা এখন থাপার আর নায়ক দুজনে কথা মুক্তা ঝিম হয়ে শুনছে।

ছোট থাপার এবার মজার গল্প? দিল। ওদের জার্মানিতে পানীতে গিয়ে একবার কি রকম বিপদে পড়েছিল সেই ঘটনা বিপদ হয়েছিল একটা সুট বানাতে। ট্যাক্সিতে উঠে থাপার বলল, চলো দর্জির দোকানে নিয়ে চলো। কিন্তু মুশকিল হল যে জার্মান ভাষা জানে না, আর ট্যাক্সিওয়ালা ইংরেজি জানে না। থাপার তাকে যত বোঝাতে চেষ্টা করে, সে ততই বলে, হের—র—র—ঘোঁৎ!

মুক্তার কি হল কে জানে, হঠাৎ হেসে উঠল। প্রথমে মৃদু মৃদু, ক্রমশ উচ্চচগ্রামে। তারপর হাসি আর থামতে চায় না।

অবাক হয়ে চেয়ে রইল নায়ক। মুক্তাকে এমন বেসামালভাবে হাসতে আগে কখনো দেখেনি। হাসির ধমকে তার শরীরের জ্যামিতিক রেখাগুলো আরো বেঁকেচুরে যাচ্ছে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এসেছে। তবু হাসছে। তারপর একসময় হাসি থামিয়ে হেঁচকি তুলতে শুরু করলে।

তার গায়ে একটা ঝাঁকানি দিয়ে নায়ক বললে, কি হল মুক্তা? শরীর খারাপ লাগছে?

উঁহু, আমি ঠিক আছি।

মুক্তার কথাগুলো জড়ানো।

নায়ক বললে, না, ঠিক নেই। চলো, বাড়ি চলো।

বাড়ি? চলো।

উঠতে গিয়ে মুক্তা সোফার ওপর টলে পড়ল।

তাকে আরেকটা ঝাঁকানি দিয়ে নায়ক ডাকলে, মুক্তা!

ছোট থাপার বললে, ব্যস্ত হয়ো না। একটা কাজ করো, মিস বোসকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দাও। খানিকক্ষণ রেস্ট নিলেই সামলে উঠবে।

একটা বিশ্রী সন্দেহে নায়কের মনটা বিগড়ে গিয়েছিল। সরাসরি প্রশ্ন করলে, কি খাইয়েছেন ওকে?

বিশেষ কিছু নয়।—হালকা গলায় ছোট থাপার বললে, অরেঞ্জের সঙ্গে একটু জিন আর ভারমুথ মেশানো ছিল। ওইটুকুতেই যে আউট হয়ে যাবে, কে জানত!

একটু গুম হয়ে থেকে নায়ক বললে, ওকে না খাওয়ালেই পারতেন। একেবারে অনভ্যস্ত।

তাই নাকি! কি করে জানব বল? পার্টিতে দেখেছি, মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে বেশি অভ্যস্ত। যাই হোক, রেস্ট দাও, ঠিক হয়ে যাবে।

বিশ্রাম দেওয়া ছাড়া এখন আর উপায় কি? মুক্তার চোখ দুটো বার বার বুজে আসছে। তাকে তুলে ধরে, আস্তে আস্তে পাশের ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিলে নায়ক। থাপার পাখাটা খুলে একটা নীলাভ ল্যাম্প জ্বেলে দিলে।

ড্রইংরুমে ফিরে এসে ছোট থাপার ধীরে—সুস্থে নিজের চতুর্থ গ্লাসটা খালি করলে। তারপর পাইপটা ধরিয়ে বললে, অনর্থক দেরি করে লাভ কি? ডিনারটা খেয়ে নাও। তোমাকে তো অনেকটা পথ যেতে হবে।

একটা সিগারেট মুখে গুঁজে নায়ক বললে, মুক্তা একটু সামলে উঠলেই আমরা যাব।

হেসে উঠে ছোট থাপার বললে, বলছ কী! ঘড়িটা দেখেছ? রাত পৌনে বারোটায় একজন মাতাল মেয়ে নিয়ে তুমি কোথায় যাবে? মিস বোসকে ঘুমোতে দাও, কাল সকালে আমি ওকে পৌঁছে দিয়ে আসব।

নায়কের ঠোঁট থেকে সিগারেট খসে পড়ল।

কাল পৌঁছে দেবেন! না, না, তা হয় না।

কেন, হবে না কেন?

নায়কের ভদ্র মনের জবাবটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল: মুক্তা আমার ওপর বিশ্বাস করে এসেছে।

আরেকবার হেসে উঠল ছোট থাপার। বললে, তুমি বড় বেশি সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ছ! যা বলছি শোনো। মিস বোসের ভার আমার, তুমি নির্ভাবনায় চলে যেতে পারো।

এরপর পরিপাটি ডিনার খেয়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো নায়কের চলে যাওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু তা হল না। তার বিবেক—বুদ্ধি বললে, মুক্তা একটি ভদ্রঘরের মেয়ে—সরল বিশ্বাসে তোমার সঙ্গে এসেছে, একটা মাংসাশী জানোয়ারের মুখে তাকে ফেলে রেখে যাওয়া উচিত হবে কি?

হুইস্কি বোধ হয় তরুণ বয়সকে দুঃসাহসী করে তোলে, পৌরুষকে জোর দেয়। নায়কের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। শার্টের আস্তিন একটু তুলে সে উঠে দাঁড়াল। থাপারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে স্পষ্ট জোরালো গলায় বললে, না। ওকে আমি নিয়ে যাবই।

একটুও চটল না ছোট থাপার। খুব শান্তভাবেই বললে, নিয়ে যাবে? বেশ তো, নিয়ে যাও। আমার গাড়িটা তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসুক।

এতটা ভদ্রতা আশা করেনি নায়ক। পাশের ঘরের দিকে এগোতে যাবে, ছোট থাপার আবার ডাকলে, হ্যাঁ, ভালো কথা, তোমার ফাইলটা আমার টেবিলে এসেছে। কিন্তু ভেবে দেখলাম, মাসে সাড়ে আটশো করে বাড়তি খরচ করার অবস্থা এখন অফিসের নয়। পরে দেখা যাবে।

নায়কের পা দুটো কার্পেটের ওপর আটকে গেল। সে লক্ষ করলে, ছোট থাপারের ঠোঁটের কোনায় আর ছোট ছোট চোখের তারায় সেই কৌতুক চিকচিক করছে—নগণ্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একটা মারাত্মক চাল দিয়ে পাকা দাবা—খেলোয়াড় যে কৌতুক উপভোগ করে।

চুপ করে গেল ভদ্র মন। বোবা হয়ে গেল বিবেক—বুদ্ধি। শুধু বাজতে লাগল সাড়ে আটশো টাকার ঝনঝন আওয়াজ। কার্পেটের দিকে তাকিয়ে বাধ্য বিনীত ভঙ্গিতে নায়ক বললে, আমিও ভেবে দেখছি স্যার, এত রাতে ওকে নিয়ে না যাওয়াই ভালো। গুডনাইট স্যার!

গুডনাইট! গাড়িটা নিচেই আছে।

নায়ক আর দাঁড়াল না।

.

পরের মাসেই প্রমোশন হয়ে গেল নায়কের। আপার গ্রেড ক্লার্ক থেকে এক লাফে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজার। এখানেই কি থেমে থাকবে? কে বলতে পারে সে একদিন অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে অফিস—সুপারভাইজার হবে না? সেখান থেকে বিজনেস ম্যানেজারের চেয়ারে বসবে না? পাঁচশো থেকে সাড়ে আটশো, তারপর দেড় হাজার, তারও পরে আড়াই হাজার—বিলেতি পাড়ায় ঝকঝকে ফ্ল্যাট, চকচকে গাড়ি। শুধু সুযোগের অপেক্ষা। আর, ‘সুযোগ হচ্ছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ—যাদু—ই—চিরাগ, যা পেলে সুখের দুনিয়া তোমারই হাতের মুঠোয়!’

এই জ্ঞান তো তার ‘বস’ই দিয়েছে। গুরু বলে মানতে হয় ছোট থাপারকে।

মুক্তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। দিন কয়েক বাদে দোকানে গিয়ে জেনেছিল, সে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। না, টালিগঞ্জের বিধান কলোনিতে নায়ক যায়নি। কী হবে আর দেখা করে? পুরানো আলাপের জের টেনে? হতে পারে মুক্তা তাকে ভালোবেসেছিল। তারও ভালো লেগেছিল মুক্তার সেই কানায় কানায় ভরা দীর্ঘছন্দ দেহটাকে—হয়তো ভালোও বেসেছিল তাকে। কিন্তু বাসলেই বা! ভালোবাসা তো স্ট্যাম্প—মারা কাগজের ওপর সই—করা চুক্তি নয়। সত্যি কথাই বলেছে তার গুরু, ‘দুনিয়ায় লাভটাই বড়—নীতি—টিতি কিছু নয়!’ ইংরেজি লাভ নয়, সাদামাটা বাংলা লাভ। সেই লাভের সুযোগ কখনো ছেড়ে দেওয়া যায়?

অতএব চুপ করুক ভদ্র মন। বোবা হয়ে থাক বিবেক—বুদ্ধি। আমাকে উন্নতির ধাপে ধাপে উঠে যেতে দাও। আগে সুখের দুনিয়া হাতের মুঠোয় আসতে দাও, ভালোবাসা—টাসা তার পরে।

নায়ক ভেবে দেখলে, মুক্তার কোনো ক্ষতি সে করেনি, বরং ভালোই করেছে। কোটিপতি ছোট থাপারের প্রসন্নতায় তারও জীবনে যথেষ্ট লাভের সম্ভাবনা। মুক্তা নিশ্চয় তা বুঝবে।

মুক্তার কথা ভাবতে ভাবতেই একদিন নায়কের জীবন থেকে মুক্তা—পর্ব মুছে গেল।

দূর্বা

আমাদের গল্পকে আরো এগোতে দিন। আসুন, খেই ধরে আমরা বসে থাকি, গল্প এগিয়ে চলুক নিজের গতিতে—নিজের পথে।

মুক্তা চলে গেল, তাই বলে কি রঙ্গমঞ্চ অন্ধকার থাকবে? আজকের দিনে তা হয় না। আজকাল পরিবার পরিকল্পনার চেষ্টা যতই জোরদার হচ্ছে, গোটা পৃথিবীর লোকসংখ্যা ততই ফুলে—ফেঁপে উঠছে—ভারতবর্ষে তো বটেই। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আর কুলোয় না, পথে—ঘাটে উপছে পড়ছে জনতার ওভারফ্লো—অতিরিক্ত প্রাচুর্য। এটা তাই জনতার যুগ—জনগণের যুগ। পথে—ঘাটে যেমন গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি, ঠেসাঠেসি, এ যুগের নাটকেও তেমনি বহুর ভিড়। এক নায়ক এক নায়িকার দিন আর নেই, আজকের জীবননাট্যে বহু নায়ক, বহু নায়িকা। একজনের প্রস্থান, আরেকজনের প্রবেশ। অতএব একটি মুক্তা চলে গেছে বলে রঙ্গমঞ্চের বাতি নিভবে না। আমাদের গল্পও থামবে না।

মাস গেল, বছর গেল। আমাদের নায়ক এখন অফিসার গ্রেডের। ছোট থাপারের হাতের লোক। কালীঘাটের নেপাল ভটচায্যি লেন থেকে বাসা বদল করেছে। সাড়ে আটশো টাকা মাইনেতে ক্যামাক স্ট্রিস্টে ফ্ল্যাট নেওয়া যায় না, তাই নিউ আলিপুরে দেড় কামরার একটা ছিমছাম ফ্ল্যাট নিয়েছে। সুটের কাপড় টেরিকটন থেকে টেরিলিনে, আর সিগারেটের ব্র্যান্ড উইলস থেকে রিজেন্টে পৌঁছেছে।

ভালোই আছে নায়ক। এই একটা বছরে তার জীবনে দু’—চারটি নতুন বান্ধবীর আনাগোনা কি আর হয়নি? হয়েছে। তবে তারা ‘ক্ষণিকের অতিথি’। জীবনের চলতি বাসে তারা মাত্র দু’—চারটে স্টপেজ সঙ্গে ছিল। তারা নায়িকা নয়, পার্শ্বচরিত্র।

দ্বিতীয় নায়িকা এল আরো মাস কয়েক বাদে।

কিন্তু আমাদের গল্পে দ্বিতীয় নায়িকা আসবার আগে তাকেও একটা নামের চিহ্ন দেওয়া দরকার। নইলে সে শুধুই একটি মেয়ে হয়ে থাকবে, নায়িকা বলে চেনা যাবে না। একমুঠো নতুন দূর্বা ঘাসের মতো নরম ছোটখাটো একটি মেয়ে। গায়ের রঙটাও স্নিগ্ধ শ্যাম। তার নাম দেওয়া যাক দূর্বা—দূর্বা সোম।

এইবার চলুন থাপার ট্রেডিংয়ের অফিসে। ঠিক অফিসে নয়, অফিস—স্টাফের ক্লাব—ঘরে। যেখানে কয়েকদিন ধরে সন্ধ্যার পর নাটকের মহলা চলছে। প্রতি বছরের মতো এবারও অফিসের রিক্রিয়েশান ক্লাব থিয়েটার করবে। এ বছর ব্যবস্থাপনার ভার পড়েছে আমাদের নায়কের ওপর।

অফিসের ক্লাব—ঘরেই নায়কের সঙ্গে দূর্বা সোমের আলাপ। নাটকের হিরোইনের ভূমিকার জন্য যখন দূর্বা সোমের নাম করা হয়েছিল, নায়কের তখন আদপেই মনে ধরেনি। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিল, কী সব আজেবাজে আর্টিস্ট নিচ্ছ তোমরা! থিয়েটার যদি ভালো করে করতে হয় তো নাম—করা ফিমেল নাও। আমি না হয় ছোট থাপারকে বলে কিছু বেশি টাকার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।

নাটকের ডিরেক্টর অনিল চৌধুরি বলেছিল, না হে, দূর্বা সোমের অভিনয় তুমি দেখনি, তাই বলছ। মেয়েটা উঠতি হিরোইন, চেহারাটাও ভালো, অ্যাকটিংও করে চাবুকের মতো! বাজারে ডিম্যান্ড হচ্ছে।

ডিরেক্টরের ওপর কিছু বলা চলে না। থিয়েটার ব্যাপারে নায়কেরও তেমন মাথাব্যথা ছিল না। রিহার্সালেও সে যেত না।

ডিরেক্টর একদিন নায়ককে পাকড়াও করলে। বললে, প্রোডাকশনের ভার নিয়েছ, অথচ তোমার পাত্তাই নেই! ডোবাবে নাকি হে? রিহার্সালে এসো একদিন।

পরদিন ছুটির পর নায়ক ক্লাব—ঘরে হাজির হল। নাটকের মহলা তখন সবে শুরু হয়েছে। ডিরেক্টর একখানা ফর্দ তার হাতে দিয়ে বললে, এই সেটি প্রপার্টি আর কস্টিউমের লিস্ট। সব ঠিকঠাক রেডি থাকে যেন। দেখো দাদা, ডুবিও না শেষটায়!—ভালো কথা, এসো আলাপ করিয়ে দিই। ইনিই দূর্বা সোম, আর ইনি আমাদের বড় অফিসার—থিয়েটারের ব্যবস্থাপক।

মামুলি সৌজন্যের মৃদু হাসি আর নমস্কার বদল হল। নায়ক দেখলে, অল্পবয়সী ফর্সা একটি মেয়ে, মাথায় একটু খাটো, চেহারায় কেমন একটা পুতুল—পুতুল ভাব। মস্তবড় এলো খোঁপা, আর মস্তবড় একজোড়া শান্ত চোখ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষত্ব নায়কের চোখে পড়ল না। তবে সাজপোশাকে বিশেষত্ব আছে বটে। পরনে খয়েরি—পাড় শাদা তাঁতের শাড়ি আর শাদা ব্লাউজ। গলায় সোনার সুতলি—হার ছাড়া অলঙ্কারের বালাই নেই। নেই প্রসাধনের পারিপাট্য, কসমেটিকের ব্যবহার।

আশ্চর্য বোধ করলে নায়ক। আলুনি আলুভাতের মতো সাত্ত্বিক চেহারার এই মেয়েটিই দূর্বা সোম, হাল জমানার উঠতি নায়িকা! যার নামে ডিরেক্টরেরা মূর্ছা যায়!

সহকর্মীদের পাল্লায় পড়ে নায়ককে সেদিন অনেকক্ষণ থাকতে হয়েছিল ক্লাব—ঘরে। দেখতে হয়েছিল অনেকটা রিহার্সাল। সেদিক দিয়েও দূর্বা হতাশ করলে নায়ককে। নায়িকা—চরিত্রের কথাগুলো আউড়ে গেল শুধু, জীবনের স্পন্দন খুঁজে পাওয়া গেল না, পাওয়া গেল না জীবনের উত্তাপ! যাবার সময় ডিরেক্টরকে বলে গেল নায়ক, ডোবায় যদি, আমি নয়, দূর্বা সোমই তোমাদের ডোবাবে।

কিন্তু নায়কের সমস্ত হিসেবে গোলমাল হয়ে গেল অভিনয়ের দিন।

স্টেজের সামনে দ্বিতীয় সারির আসনে বসেছিল নায়ক। দেখলে, নায়িকার সাজে দূর্বা সোম ফুটলাইটের আলোয় ঝলমল করছে! তার চলায় প্রাণের উত্তাপ, দীর্ঘায়ত চোখে কখনো মেঘ, কখনো দূর্বা সোমকে নায়ক ক্লাব—ঘরের মহলায় দেখে নি। সে একটা মানুষ যে আগাগোড়াই বদলে যায়, কে জানত! মেয়ের মধ্যেও যে এতখানি আগুন লুকিয়ে থাকতে পারে হতেই পারেনি। নায়কের মনে হল, কোন মেয়ের মধ্যে ফুলকি না রইল, তবে সে মেয়ে কিসে? রূপ নয়, সেই কিই তাকে করে তোলে পুরুষের কামিনী, প্রেমিকের।

উনত্রিশ আবার নেশা লাগল। এবার আগুন নিয়ে খেলার।

অ্যামেচার রাং নাটক শেষ হতে রাত এগারোটা হল। আর্টিস্টদের গাড়ির অবস্থা ছিল, তবু ব্যবস্থাপক নিজেই হিরোইনকে ভার নিলে।

গাড়িতে উঠে ‘রুণ অ্যাকটিং করেছেন আপনি! এত ভালো অভিনয় দেখিনি।

দূর্বা সোম একটু ন বলে শুধু। কথা সে কমই বলে। নায়ক দেখলে, এ সেই সোম। পরনে খয়েরি—পাড় শাদা শাড়ি আর ব্লাউজ, মুখে এখন আর প্রাণের উত্তাপ নেই, বড় বড় অতি হয়ে গেছে জীবনের ভাষা।

নায়ক আবার বললে, আপনার অভিনয় এই প্রথম দেখলাম। ভবিষ্যতে কোথায় আপনার প্লে আছে জানাবেন, দেখার আগ্রহ রইল।

জানাব। —ছোট্ট উত্তর দিলে দূর্বা।

তারপর চুপচাপ।

একটু পরে নায়ক বললে, ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়?

না, এমন কিছু নয়।

আপনার রিহার্সাল দেখে কিন্তু বুঝতে পারিনি যে আপনার অভিনয় এত সুন্দর হবে। আমি অবশ্য ক্রিটিক নই, তবু আমার মনে হয়, রোম্যান্টিক সিনটায় আপনাব অভিনয় বেস্ট! এত ফ্রী, এত বাস্তব! আচ্ছা, কী করে এমন অভিনয় করেন বলুন তো?

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রইল নায়ক। কোনো জবাব এল না। নায়ক পাশে তাকিয়ে দেখলে, রাস্তার দিকে চেয়ে আছে দূর্বা সোম। সত্যিই ক্লান্ত, না নিন খেতে চায়?

মোটর …. এসে পড়েছে।

….. আর কোথায় যেন আপনার বাড়ি?

পেয়ারাবাগান লেনে।

একটা গলির মুখে গাড়ি আসতেই দূর্বা বললে, গাড়ি এখানে থাক।

কেন? গলিটা তো বেশ চওড়া। ভেতরেই যাক না।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে দূর্বা বললে, আমি এইখানেই নামব। বাড়ি কাছেই।

কত নম্বর?

নামতে নামতে দূর্বা বললে, তিন বাই একের বি।

তারপর ছোট্ট একটা নমস্কার জানিয়ে গলির অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

.