কাকাহিগড় অভিযান – ৬

পাহাড়ের এই ছোট্ট গুহায় অন্ধকারে একাকী মালার খুব ভয় করতে লাগল এবার। এই কি কাকাহিগড়? কিন্তু এখানে আশ্রয় কই? সাধুবাবা থাকেন কোথায়? এখানে কোনও আলোও তো নেই। এই গুহায় সাপ থাকতে পারে। বাঘভাল্লুক আসতে পারে।

একটু পরেই অবশ্য আলো হাতে একজন লোক এল। লোকটিকে মালা চিনতে পারল না। তার হাতে একটি খাবারের থালা। তাইতে দু’খানা রুটি আর সামান্য ডাল ছিল। লোকটি বলল, খা লেও।

মালা বলল, না। আমার খিদে নেই।

আরে মা ভবানী কী পরসাদ। জলদি খা-লো।

মালা আর দ্বিরুক্তি না করে খেয়ে নিল। তারপর বলল, জল।

লোকটি বলল, আতে হেঁ। বলে চলে গিয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই এক লোটা জল নিয়ে এল।

মালা ঢকঢক করে সেটা খেয়ে নিল। তারপর লোকটা চলে যেতেই গুহা থেকে নামা শুরু করল সে। কিন্তু নীচে নেমেই অবাক। আরে এ তো ওর অতি পরিচিত জায়গা। এই কাকাহিগড়! এখানে তো ও বহুবার এসেছে। কিন্তু না। মালা বুঝতে পারল লোক দু’জন ওকে বোকা বানিয়েছে। আসলে ওরা চুরিডাকাতি যাই করুক। মালাকে অপহরণ করার ঝুঁকিটা নিতে চায়নি। তাই কাকাহিগড়ে না-নিয়ে গিয়ে ওকে এনে ছেড়ে দিয়ে গেছে তপোবন পাহাড়ের এক গুহায়।

মালা তখন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ঘরে ফেরাই ঠিক বলে মনে করল। তাই প্রাণপণে দৌড় লাগাল সে। দেওঘর অনেক দূর। তবু ছুটল।

হঠাৎ ওর মুখের ওপর একটা জিপের জোরালো আলো এসে পড়ল। মালা

চোখ আড়াল করে দাঁড়াতেই কে যেন খপ করে ধরে ফেলল ওকে। তারপর বলে উঠল, এই তো পেয়েছি। একা একা এখানে কী করছিলে তুমি?

মালা বলল, কে আপনি?

তার আগে বলো সেই ছোকরা কোথায়?

মালা কেঁদে বলল, জানি না।

জানবার দরকার নেই। একটাকে যখন পেয়েছি, তখন আর একটাকেও খুঁজে বার করব। উঃ। রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছিলে তোমরা? কোনও বদলোকের পাল্লায় পড়েছিলে নিশ্চয়ই?

মালা অতিকষ্টে ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

ওঠো গাড়িতে ওঠো। পুলিশের জিপ মালাকে নিয়ে দেওঘরের দিকে এগিয়ে চলল।

পুলিশের গাড়ি এসে যখন মালাকে ওর বাসায় পৌঁছে দিল তখন মধ্যরাত। বাড়িতে এতক্ষণ কান্নার রোল উঠেছিল। এবার মালাকে ফিরে আসতে দেখে মুখে হাসি ফুটল সকলের। কিন্তু চন্দন? চন্দন কই? সে নেই কেন?

দিদা ছুটে এসে মালাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আমি তোকে কালই রেখে আসব তোর বাবার কাছে।

দেবযানী ছুটে এসে বললেন, আমার চন্দন! তাকে কোথায় রেখে এলি মা? বল সে কোথায় ?

মালা ঝর ঝর করে কাঁদতে লাগল।

কী হল? কিছু বল? চুপ করে আছিস কেন?

সুনন্দবাবু নির্বাক ভাবে বললেন, তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি নির্ভয়ে আমাকে সব কিছু খুলে বলো তো মা! তোমরা কোথায় গিয়েছিলে, কী করছিলে বা কী হয়েছিল?

মালা সব বলল।

শোনা মাত্রই দেবযানী সংজ্ঞাহীন হলেন।

রূপামাসী বললেন, সন্ধে হয়ে গেল তবু তোদের পাত্তা নেই দেখে জামাইবাবু আর তোর কাকু থানায় গিয়েছিলেন। গিয়েই শুনলেন তোরা নাকি কাল রাতের ঘটনা থানাতে জানিয়ে এসেছিলি। তোদের কথার ভিত্তিতে পুলিশ ওই লোকদুটোকে ধরে ফেলেছে। কিন্তু সেই যে ভরদুপুরে ছেলেটাকে নিয়ে উধাও হলি তুই। সেটা কি না করলেই চলছিল না? এখন কোথায় খুঁজব ছেলেটাকে? নিরুপমবাবু বললেন, সে আর নেই। মালার কথা যদি সঠিক হয় তা হলে

বাঘের পেটেই গেছে সে।

এমন সময় ভাস্করমামা এসে হাজির হল। বলল, নাঃ। অনেক খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না ওদের। তবে এখানকার পুলিশ সম্বন্ধে আমার যা ধারণা ছিল তা পালটে গেল। তারপর হঠাৎ মালাকে দেখে বলল, আরে মালা! কখন ফিরলে তোমরা?

দিদা বললেন, তোমরা নয়, ও কালামুখী একা ফিরেছে। সে ছেলে ফেরেনি। এই পোড়া মুখ নিয়ে ও যে কেন ফিরল তা বুঝতে পারছি না। অজানা অচেনা জায়গায় শান্তশিষ্ট ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে বেঘোরে মারলে গো মেয়েটা। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

ভাস্করমামা বলল, চন্দন ফেরেনি?

না।

মালা একবার ভাস্করমামার মুখের দিকে তাকাল। তারপর কী যেন বলতে গিয়েও বলতে পারল না।

এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠল।

নিরুপমবাবু দরজা খুলে দিতে দু’-তিনজন কনস্টেবলসহ পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকলেন। তারপর সরাসরি মালার কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মালা ঠিক করে বলো তো, তোমরা হারলাঝুরিতে কীজন্য গিয়েছিলে?

মালা বলল, আমার সাইকেল উদ্ধার করতে।

বেশ। তুমি কী করে জানলে যে তোমার সাইকেল ওইখানে আছে? আমার এক বান্ধবী কমলু ওটা দেখেছে! কাল্লু নামে এক বদমাইশ ওটা চুরি করে। ওর বাড়ি হায়লাঝুরিতে।

কমলু কোথায় থাকে।

নন্দন পাহাড়ে।

বুঝেছি। গুণধর ঝাজির মেয়ে, তাই না?

হ্যাঁ। কাল্লু আমার দাদাকে নদীর খাদে ফেলে দিয়ে আমাকে জঙ্গলের পুরনো মন্দিরে আটকে রাখে। পরে ও কমলুকে ধরে আনতে যায়। ওকে বোধহয় ওই মন্দিরেই নিয়ে যাবে ওরা।

সে কী! কই এসব কথা তো তুমি গাড়িতে বললে না আমাদের? চলো চলো শিগগির চলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দিদা বললেন, ওকেও আবার যেতে হবে বাবা?

হ্যাঁ মা, ও সঙ্গে থাকলে আমাদের সুবিধে হবে। কারণ ক্রিমিন্যাল ধরার চেয়েও এখন ওই ছেলেটার ব্যাপারে একটু নিশ্চিন্ত হতে হবে। ব্যাপারটা তো রহস্যজনক। কারণ এখনও পর্যন্ত এখানে নরখাদক জন্তুজানোয়ারের অস্তিত্বের কোনও খবর আমরা পাইনি। কাজেই ছেলেটা যে বাঘের পেটে গেছে, এ আমরা বিশ্বাস করতে রাজি নই। আমরা কথা দিচ্ছি ছেলেটাকে যে ভাবেই হোক ফিরিয়ে আনবই। আর ওই লোকদুটোকে গ্রেফতারের পর আপনাদের মূর্তি চুরির রহস্যও অনেকটা ফাঁস হয়ে এসেছে।

রূপামাসি বলল, আর আমাদের মূর্তির দরকার নেই। দয়া করে ছেলেটাকে উদ্ধার করে ওর মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিন।

পুলিশের গাড়ি মালাকে নিয়ে ঝড়ের বেগে নন্দন পাহাড়ের দিকে ছুটল। যতদূর যাওয়া যায় ততদূর যাবার পরই জিপ থামিয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু করল কিন্তু ওপরে উঠেই যে দৃশ্য ওরা দেখল তা রীতিমতো রোমাঞ্চকর।

মন্দিরপ্রাঙ্গনে ঝাজির রক্তাক্ত মৃতদেহটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মনে হচ্ছে রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধের পর মৃত্যুকে বরণ করতে বাধ্য হয়েছেন প্রবীণ পূজারি। মালা জোরে ডাক দিল, কমলু! এ কমলু! কমলু বহিন। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। সাড়া দেবে কে?

পুলিশ অফিসার বললেন, ওরা তা হলে ঝাজিকে মেরেই কমলুকে নিয়ে গেছে। মেয়েটার এখন কী হাল তা কে জানে? এদের বিরাট একটা চক্র তো।

মালা বলল, শুনুন, আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, ওই কাকাহিগড়ের সাধুও এই পাপচক্রের সঙ্গে জড়িত।

কাকাহিগড়ের সাধুবাবা!

হ্যাঁ।

তুমে ক্যাওসে মালুম হুয়া?

আমি জানি। জানতে পেরেছি।

এমন সময় আরও এক ঝাঁক পুলিশ এবং একজন পুলিশ অফিসার এসে হাজির হলেন সেখানে। বললেন, কিউ স্যার কুছ মিলা?

প্রথম অফিসার ইঙ্গিতে পড়ে থাকা ঝাজির মৃতদেহটা দেখিয়ে দিলেন। আরে! মার্ডার ! একদম মর চুকা?

ওদিককার খবর কী?

আপনার কথামতো ওই লোকদুটোকে বেদম পিটিয়েছি। ওরা সব কথা কবুল করেছে।

কী বলছে ওরা?

এর উত্তরে দ্বিতীয় অফিসার যা বললেন তা হল এই, এখানে এদের তিনটি দল। এর মধ্যে কাকাহিগড়ের সাধুবাবাও আছেন। আসলে নিরুপমবাবুদের ওই রাধাকৃষ্ণমূর্তি এই তিন দলের কারও কাছেই নেই। এই নিয়েই এদের মধ্যে বিরোধ। তিন দলের মধ্যে কাল্লু এবং ওর তিন সঙ্গীকে নিয়ে একটি দল। একটি দলে আছে হীরুক ও ভীরুক নামে দুই শয়তান। আর একটি দল হল শোভরাজ সিং আর জগমোহনের। অর্থাৎ যে লোকদুটোকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওরা বলছে নিরুপমবাবুদের ওই অগাধ সম্পত্তি এবং বহুমূল্য ওই রাধাকৃষ্ণমূর্তির প্রতি লোভ ওদের অনেকদিনই ছিল। তাই ওরা সকলেই মূর্তিটি অপহরণ করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল অনেকদিন থেকে। কিন্তু অপহরণ করলেই তো হল না। এ মূর্তি বেচবে কার কাছে ? তা ছাড়া উপযুক্ত দাম না পেলে অযথা চুরিডাকাতি করেও তো লাভ নেই। এই সময় মুঙ্গেরের ভগবানদাস জেঠিয়া এগিয়ে এলেন। ইনি একজন ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলার। এরই মাধ্যমে কাজ করবার কথা ওরা স্থির করল। ভগবানদাসের নামে ওয়ারেন্ট আছে। লোকটা তাই সাধুর ছদ্মবেশ নিয়ে কাকাহিগড়ে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। অনেক উঁচু মহলের লোকের সঙ্গে তাঁর দহরম মহরম। তাই মুঙ্গের পুলিশ সব জেনেশুনেই আর ওকে ঘাঁটায়নি। বিশেষ করে তিনি যখন এলাকার বাইরের চলে গেছেন তখন আর তাঁকে নিয়ে মাথাব্যাথা কেন? কাকাহিগড়ের এই সাধুর প্রতি এখানকার পুলিশেরও যে সন্দেহ ছিল না তা নয়। এই মূর্তিটাকে চারদিকে তন্ন তন্ন করে খোঁজার পরও ওই সাধুর আস্তানার দিকে দৃষ্টি পুলিশ ঠিক রেখেছিল।

কিন্তু মুশকিল যেটা হল সেটা হচ্ছে, মূর্তিটা তা হলে গেল কোথায়? কাকাহিগড়ের ধারেকাছেও মূর্তির অস্তিত্ব পুলিশ পায়নি।

শোভরাজ সিং ও জগমোহনের মুখ থেকে পুলিশ যে তথ্য আবিষ্কার করেছে তা হল, ওই দিনের ডাকাতির পর ওই মূর্তিটা সাধুবাবা নিজের কাছে রাখতে চাননি। কারণ উনি জানতেন মূর্তি নিজের কাছে রাখা মানেই পুলিশের খপ্পরে পড়া। তাই কাল্লুকে দিয়ে নন্দন পাহাড়ে ঝাজির কাছে পাঠিয়ে দিতে গিয়েছিলেন। ঝাজি মূর্তিটা ঠাকুরের আলমারিতে লুকিয়ে রাখলে কেউই টের পেত না। এবং পরে সময়মতো পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে মূর্তিটা ওখান থেকে সরিয়ে দুমকায় নিয়ে গিয়ে রাখা হত। তারপর চলে যেত যথাস্থানে। কিন্তু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ঝাজি কোনও প্রলোভনেই রাজি হননি ও কাজ করতে। এই নিয়ে কাল্লুর সঙ্গে সে-রাতে দারুণ বচসা হয়। আর সবচেয়ে আশ্চর্য সেই বচসার ফাঁকে মূর্তিটা যেন কর্পূরের মতো উধাও হয়ে যায় সেখানে থেকে। তা হলে কী তৃতীয় কোনও ব্যক্তি সেখানে ছিল? যদি থাকে, সে কে?

এরপর দলের লোকেদের মধ্যে শুরু হয় পরস্পরের পরস্পরকে সন্দেহ করার পালা। কেউ কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারে না। এবং সবার রাগ গিয়ে পড়ে ওই কাল্লুরই ওপর। কেন না মূর্তিটা তো ওর হাত দিয়েই গিয়েছিল। আর সেই সঙ্গে চারুভিলার বাগানবাড়িটাও হয়ে ওঠে ওদের একটা ঘাঁটি। কারণ ওদের দৃঢ় ধারণা হয়েছিল মূর্তিটা কাল্লু আদৌ বেশি দূরে নিয়ে যায়নি। হয়তো এই চারুভিলার বাগানেই কোনও গোপনস্থানে লুকিয়ে রেখেছে। নন্দন পাহাড়ে মূর্তি নিয়ে যাওয়ার পর ঝাজি ওই মূর্তি রাখতে রাজি না হওয়ায় সে-রাতে ওরা ওই বাগানেই কোথাও এসে মূর্তিটা লুকিয়ে রাখে অথবা হারলাঝুরিতে কাল্লুর নিজের এলাকায় বাড়ির কাছাকাছি রাখে কোথাও। তবে ওই মূর্তি হারলাঝুলিতে নিয়ে যাওয়ার চেয়েও এই বাগানে নিয়ে আসার সুবিধেটাই বেশি।

শোভরাজ সিং এও বলেছে ওইদিন রাতে মালা ও চন্দনকে বাগানে ঘুরতে দেখে ও অনুমান করেছে মূর্তি বাগানেই আছে। এবং ওই মেয়েটি এবং ছেলেটি নিশ্চয়ই সে খবর জানে। তাই ওরা ওদের তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওরা যে এমন মারাত্মক, তা ওরা জানত না।

যাই হোক, এখানকার সব কিছু তদারকির পর দু’জন কনস্টেবলকে ঝাজির মৃতদেহ পাহারা দিতে বলে পুলিশ মালাকে নিয়ে চলল হারলাঝুরির দিকে। যেখানে কর্মনাশা নদীর খাদে চন্দনকে ওরা ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়েই আর এক বিস্ময়। ওরা দেখল নদীর বালিতে পর পর তিনটি মৃতদেহ লাইন দিয়ে সাজানো আছে। তাদের সর্বাঙ্গে নিদারুণ ক্ষতচিহ্ন। এই মৃতদেহগুলি আর কারও নয়। কাল্লুর তিনসঙ্গীর। কাল্লু হয়তো ওই তিনসঙ্গীকে মেরে কামলুকে নিয়ে পালিয়েছে। যাই হোক, কাল্লুকে এখন ধরতেই হবে। না হলে কমলু উদ্ধার হবে না। মালা সকলকে নিয়ে এরপর জঙ্গল পার হয়ে সেই পাহাড়ে পুরনো মন্দিরে

গেল। কিন্তু কোথায় কে? না কমলু, না কান্নু, কারও সন্ধান পাওয়া গেল না

সেখানে।

এইবার চন্দনের কথায় আসা যাক।

জীবনে যে ছেলে কখনও বাবা-মা’র কাছে সামান্য একটা চড়ও খায়নি তার মাথায় লাঠির ঘা পড়লে সে সহ্য করতে পারবে কেন? তাই ওই দারুণ আঘাতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল সে। মাথার একটা পাশ সামান্য কেটে অথবা ফেটে রক্তও ঝরছিল ছুঁয়ে ছুঁয়ে। সেই সঙ্গে রক্ত ঝরছিল নাক দিয়ে। এর ওপর ওকে নদীর বালিতে খাদের মধ্যে ফেলে দেওয়ায় গা-গতরও যথেষ্ট ব্যথা হয়ে ওঠে। ওর যখন ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এল তখন প্রথমটা খুব হকচকিয়ে গেল ও। তারপর নিজেকে বালির মধ্যে আবিষ্কার করে শঙ্কিতও হল। এরপর সামনেই জল দেখে বুকে হেঁটে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে। তারপর জলে মুখ দিয়ে একটু একটু করে জল খেল। নদী বা ঝরনার জল কখনও এভাবে খেতে নেই জেনেও খেল। না-খেয়ে উপায় নেই। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। জল খেয়ে মুখহাত ধুয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে হাঁফ ছাড়ল ও। সর্বাঙ্গে ব্যথা। কেন না পাহাড়িয়া নদী তো, চারদিকে বালির সঙ্গে পাথর নুড়ির ছড়াছড়ি। তাই ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য সর্বত্র আঘাত।

প্রথমেই ওর মালার কথা মনে পড়ল। কোথায় গেল মালা। দুর্বৃত্তরা কি মালাকে নিয়ে চলে গেছে? না মালা পালাতে পেরেছে আত্মরক্ষা করে? চন্দন তখন ধীরে ধীরে ডাঙার ওপর উঠে এল। উঠে দেখল এ তো সেই জায়গা। যেখানে ওরা ওর মাথায় আঘাত করেছিল। মালার সাইকেলটা তখনও পড়েছিল সেইখানে ঝোপঝাড়ের পাশে।

চন্দন সেটা টেনে আনল। যাক। আর কিছু হোক-না-হোক এখন পালিয়ে তো বাঁচা যাবে। আর মালাকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ প্রশাসন, বাড়ির লোকেরা সকলেই আছে। এমন সময়—

এ কী? এ কার গলা? কমলুর না? ও দেখল হারলাঝুরির ডাঙা থেকে কাল্লু  ও তার সঙ্গীরা প্রায় টানতে টানতে নিয়ে আসছে কমলুকে

কমলু চিৎকার করছে, ছোড় দো। মুঝে ছোড় দো।

ছেড়ে তো দেব। তার আগে বল ওই মূর্তিটাকে কোথায় হাপিস করিয়ে দিল তোর বাবা?

ম্যায় কুছ নেহি জানতা।

সব কিছু জানিস তুই। আসলে তোর বাবা আর তুই হলি পাক্কা শয়তান। না হলে চোখের পলকে ওই মূর্তিটা হাওয়া হল কী করে? আর ওই মালা। ও লেড়কি ভি সব জানে। মূর্তিটা হাপিস হল, আর ও লেড়কির সঙ্গে তোর দোস্তি বাড়ল? বল শিগগির?

আমি জানি না।

এমন সময় নদীর ওপারের জঙ্গলের ভেতর থেকে একজন ভয়ংকরদর্শন লোককে ছোরা হাতে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল।

তাকে দেখা মাত্রই কী রকম যেন হয়ে গেল কাল্লুর দলবল। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। পরক্ষণেই ওর সঙ্গীরা হুপহাপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই লোকটির ওপর। শুরু হল খণ্ড যুদ্ধ। কিন্তু সেই ভয়ংকর শক্তির সঙ্গে ওরা পারবে কেন? তাই চুনোপুঁটির মতো মরতে লাগল। এলোপাথারি ছোরা চালিয়ে তিনজনকে ঘায়েল করতেই কাল্লু পিছন দিকে দৌড় লাগাল।

কিন্তু পালাবি কোথায় বাছাধন? চন্দন তখন পাণ্ডব গোয়েন্দা। একটি মাঝারি সাইজের পাথর কুড়িয়ে সজোরে ছুড়ে মারল কাল্লুর মাথাটা লক্ষ্য করে। অব্যর্থ টিপ। বেলের মতো ফেটে গেল মাথাটা। কাল্লু মুখ থুবড়ে পড়ে গেল পথের ওপর।

চন্দন ছুটে গেল কাছে। গিয়ে সমবেদনার সুরে বলল, লেগেছে ভাই? আহা! আমারও তখন এমনিই লেগেছিল। এখন বল তো আমার বোন কোথায়? জানি না।

ততক্ষণে কমলু ছুটে এসেছে, আরে! চন্দনদাদা? মেরা বহিন কাহা? মালা ! সেই কথাই জিজ্ঞেস করছি ওকে। ও বলছে, জানে না।

কমলু সঙ্গে সঙ্গে ওর চুলের বেণী থেকে একটা কাঁটা বার করে কাল্লুর একটা চোখে সজোরে গেঁথে দিল। বলল, শয়তান। তুই আমার পিতাজিকে খুন করেছিস। এখন বল মালা কোথায়?

কাল্লু আর্তনাদ করে উঠল, আ-আ-আ।

এখনও বল। একটা চোখ গেলে দিয়েছি। আর একটা দেব। বল শিগগির। পুরানা মন্দির মে পাহাড় পর।

নদীর গর্ভে যে ভয়ংকর লোকটি এতক্ষণ হত্যালীলায় মেতে উঠেছিল সে লোকটি এবার ধীরে ধীরে উঠে এল ওপরে। তারপর কাল্লুকে ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল, তোকে আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছিলাম রে কাল্লু। সামান্য একটা সাইকেল চুরি করতে গিয়ে কেমন ফেঁসে গেলি দেখ। আয় আমার সঙ্গে। মা কালীর কাছে তোকে বলি দেব আজ। জয় মা কালী কী।

কমলু বলল, হীরুভাইয়া। কাল্গুনে হামারা পিতাজিকো মারডালা। ক্যা বোলা! ঝাজিকো মারডালা ইয়ে কুত্তা? হ্যাঁ।

ঠিক হ্যায়। তুম রোও মাত, যাও, ঘর চলা যাও।

লেকিন ও মালা বহিন?

তুমহারা মালা বহিন তো কাকাহিগড় চলি গয়ী ভীরুভাইয়া কা সাথ। যাও, তুম ঘর চলা যাও। বলে আবার নদীর জলে নেমে গেল লোকটি। অবশ্যই কাল্লুকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে।

চন্দন আর কমলু অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল পরস্পরের মুখের দিকে।

চন্দন সাইকেলটা টেনে নিয়ে কমলুকে বলল, চাপো তুমি সামনের দিকে। আমি ডবল ক্যারি করছি। তোমার বাবা যখন নেই, তখন আজ রাত্রিটার মতো আমাদের ঘরেই চলো তুমি। তারপর মেসোকে দিয়ে পুলিশে খবর দেওয়াব।

কমলু বলল, চন্দনদা! আমি কাকাহিগড়ের পথ চিনি। আগে চলো আমরা সেখানেই যাই। মালাকে উদ্ধার করি। না হলে ও তো ভাববে। আর থানা-পুলিশ করেই বা কী হবে? কাল্লু আমার পিতাজিকে খুন করেছে। কিন্তু তুমি ওর মাথা ফাটিয়েছ, আমি চোখ কানা করেছি, আর হীরুভাই ওকে জ্যান্ত কবর দেবে। এখানেই তো বদলা নেওয়া হয়ে গেল আমাদের।

ওই হীরুভাইটা কে?

ও ভি ডাকু হ্যায়।

বলো কী?

হ্যাঁ, ওরাই তো সবাই মিলে ডাকাতি করেছে মালাদের বাড়িতে। ওরা যখন নন্দন পাহাড়ে আমাদের মন্দিরের পিছনদিকে বসে সব কিছুর আলোচনা করত, আমি তখন লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতাম। হীরুক আর ভীরুভাইয়া আমাকে খুব ভালবাসে। বাবাকেও খাতির করত।

কমলুর নির্দেশিত পথ ধরে চন্দন দ্রুত সাইকেল চালনা করতে লাগল। সারাগায়ে এত ব্যথা। তবু এক অপূর্ব মনোবলে এগিয়ে চলল ওরা।

কাকাহিগড়। চারদিকে ছোট বড় পাহাড়ের সমাবেশ। ওই তো ত্রিকূট পাহাড়ের চুড়ো দেখা যায়। কত ছোট-ছোট টিলা। টিলাগুলোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বড়জোর দু’বছর এগুলোর মেয়াদ। কেন না এখানে পাথর কাটার কাজ দ্রুত চলছে। চারদিকে নুড়িপাথর জড়ো করা। অরণ্যনিধনের তোড়জোড়ও চলছে পুরো দমে। বড় বড় গাছের কাটা ডাল পড়ে আছে যেখানে সেখানে।

ওরা এক পাশে সাইকেলটা লুকিয়ে রেখে ধীরে ধীরে পথ চলতে লাগল, জঙ্গল আর টিলার মাধখানে দিয়ে! পথ চলার সময় চন্দন বুঝল কমলু কাঁদছে। বলল, কেঁদে কী করবি রে? যা তোর কপালে ছিল, তা হয়েই গেছে। চন্দন বড়দাদার মতো তুমির বদলে তুই বলতে লাগল কমলুকে।

এখন আমি কী করব দাদা? আমার যে কেউ নেই।

চন্দন বলল, কে বললে তোর কেউ নেই? আমি তো আছি। আমি তোর দাদা। আমার কত বোনের শখ ছিল। তা এমন একটি বোন পেলাম, সে কী ছেড়ে দেব বলে? কী সুন্দর দেখতে তোকে। লোককে দেখিয়ে আমার বোন বলে গর্ব করব। আমাকে রাখি পরিয়ে দিবি, ভাইফোঁটা দিবি। আর আমি বড় হয়ে চাকরি করলে রাজপুত্তুর ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব।

কমলু বললে, আচ্ছা দাদা, তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছ, কিন্তু তোমার মা-বাবা আমাকে রাখবেন? সে দায়িত্ব আমার।

কিন্তু আমার বাবুজি। বাবুজির দেহান্ত হয়ে গেল তাঁর সৎকারের কী হবে? সব ঠিক হয়ে যাবে। আগে মালাকে উদ্ধার করি আয়। তারপর ব্যবস্থা করব। আর আমি কথা দিলাম আজ থেকে তুই আমার কাছেই থাকবি।

এইভাবে যেতে যেতে এক জায়গায় থমকে দাঁড়াল ওরা। দেখল সামনেরই একটি পাহাড়ের উচ্চস্থানে এক রুদ্র-মূর্তি সন্ন্যাসী ওদের দিকে তাকিয়ে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছেন। সন্ন্যাসীর চোখের যেন পাতা পড়ছে না।

চন্দন ও কমলুকে দেখেই তিনি আকাশ ফাটিয়ে হাঃ হাঃ শব্দে হেসে উঠলেন। বললেন, আরে কমলু বিটিয়া, তুম হিয়া পর ক্যায়সে আ গয়ি, তুমহারা পিতাজি কাহা?

কমলু বলল, পিতাজিকা নিধন হো গিয়া।

আ-হা-হা-হা-। হায় রে।

চন্দন বলল, সাধুবাবু! আমার বোন মালা আপনার এখানে আছে। ওকে ফিরিয়ে দিন। আমরা ওকে নিতে এসেছি।

আরে বাঙ্গালি বাচ্ছা। তুম কৌন?

ওই যে মালা, যাকে ভীরুভাই নিয়ে এসেছে আমি তার দাদা।

ও। তব তুম চারুভিলা কা লেড়কা?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে। তোমার বোন মালা আমার কাছেই আছে। এসো এখানে এসো। ওই দিকের রাস্তাটা দিয়ে এসো।

ওরা সাধুর নির্দেশিত রাস্তাটা ধরে নেমে আসতে গিয়েই দেখল, এক জায়গায় কয়েকজন বলিষ্ঠ চেহারার লোক ওদের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের দেখেই শিউরে উঠল কমলু। ভয়জড়ানো কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, চন্দনদা! পালিয়ে চলো এখান থেকে। এদের মতলব ভাল নয়। আমি এদের সবাইকে চিনি। এরা বড় সাংঘাতিক।

চন্দন বলল, তবে তাই চল। কিন্তু আমরা কি পারব এদের খপ্পর থেকে পালাতে। আর পালিয়েই বা লাভ কী? মালাকে তো উদ্ধার করতে হবে।

আমরা এখুনি গিয়ে পুলিশে খবর দেব। না হলে শুধু হাতে দু’জনে আমরা কী করে কী করব বল? আমার বাবুজি মরে গেল। এখন যদি ওরা তোমাকেও মেরে ফেলে তো আমার কে থাকবে?

চন্দন বলল, তবে আয়। খুব জোরে ছুটতে হবে কিন্তু।

এই বলে ওরা দ্রুত ছুটতে লাগল।

কাকাহিগড়ের সেই সাধু চিৎকার করে উঠলেন, পাকড়ো, পাকড়ো, জলদি পাকড়ো উয়ো দোনোকো।

ওরা তখন তিরবেগে ছুটছে জ্যোৎস্নালোকিত কাকাহিগড়ের বন্ধুর প্রান্তরে। খানিক ছুটে যাওয়ার পরই দেখল মূর্তিমান যমের মতো দু’জন লোক ওদের সামনে ছোরা উঁচিয়ে দাড়িয়ে আছে।

দেখেই থেমে পড়ল ওরা।

পাশেই একটি পাহাড়ের ঢাল ছিল। সেটা দিয়ে গড় গড় করে খানিকটা গড়িয়ে নেমে এল ওরা। একটু সমতল প্রান্তরে। তারপর আবার ছুট। ছুট ছুট-ছুট। কিন্তু আবার খানিক আসার পর দেখল, এখানেও ওদের পালাবার পথ রুদ্ধ। এদিকেও দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে ছোরা হাতে।

ইতিমধ্যে ওরা ভয়ে এমনই হতচকিত হয়ে গিয়েছিল যে সাইকেলটা কোন পথে কোনখানে রেখে এসেছিল, তাও আর মনে করতে পারল না।

হঠাৎ একসময় দু’-তিনজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের দু’জনকেই পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।

চন্দন ও কমলু আত্মরক্ষার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।

ওরা ওদের নিয়ে এল একটু সমতলে। সেখানে একটি গাছের গুঁড়ির সঙ্গে চন্দনকে বাঁধল। তারপর কমলুকে ছাড়া অবস্থাতে রেখেই ওরা একটু দূরে সরে গিয়ে পাহারা দিতে লাগল ওদের।

কমলু চিৎকার করতে লাগল, ছোড় দো, ছোড় দো মেরা ভাইয়া কো। এমন সময় কাকাহিগড়ের সেই সাধু এসে এসে দাঁড়ালেন সেখানে। বললেন, আরে! কমলু বিটিয়া! তু ইতনা ডরতি হ্যায় কিঁউ মুঝে দেখ কর?

কমলু সন্ন্যাসীর পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে বলল, আমার দাদাকে ছেড়ে দিন সাধুবাবা।

দেগা। জরুর দেগা। তবে তুই আমাকে ঠিক করে বলত মা ওইদিন রাতে মূর্তিটা তোর পিতাজি কোথায় লুকিয়ে ফেলেছিল?

সাধুবাবা। আপনার কসম খেয়ে বলছি, ওই দিন রাতে মূর্তিটা আমার বাবা থানা-পুলিশের ভয়ে রাখতে না চাইলে ওই কাল্লু শয়তানটা ওটা নিয়ে পালিয়ে যায়।

তারপর!

তার পরের ব্যাপার আমি কিছুই জানি না।

সাচ।

হ্যাঁ সাধুবাবা।

না। তুই ঠিক বলছিস না। সাচ বাত কী আছে ঠিক করে বল দেখি? বলে চন্দনের দিকে এগিয়ে গেলেন সাধুবাবা। তারপর ওর চুলের মুঠি ধরে বললেন, এই তুই কিছু জানিস? জেনে থাকিস তো বল।

চন্দন বলল, জানি। কমলুও জানে, আমিও জানি। আর আমার বোন মালাও জানে। আগে ওকে মুক্তি দিন। তারপর সব বলব।

তোর বোন এখানে তো নেই। তপোবন পাহাড়ের গুহায় তাকে রাখা হয়েছিল, কিন্তু পরে তাকে আর দেখছি না। হয়তো সে এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছেই গেছে।

চন্দন বলল, তা হলে জেনে রাখুন এখুনি পুলিশও আসছে।

পুলিশ। আসুক না। আমার কাছে মন্ত্রী কমিশনার সবাই তো আসে। বুরবাক লেড়কা। আমাকে পুলিশের ভয় দেখাচ্ছিস তুই? তা হলে জেনে রাখ, অনেক বড় নৌকোয় আমার দড়ি বাঁধা। পুলিশ আমার কিছু করতে পারবে না। যদি পারত, তা হলে এতদিনে আমার অনেক কিছুই করত। এখন যদি বাঁচতে চাস তো ঠিক করে বল, ওই মূর্তিটা কোথায়?

ওই মূর্তিটা আমাদের বাগানেই এক জায়গায় পুঁতে রেখেছি আমরা। কোনখানে?

আমাদের নিয়ে চলো দেখিয়ে দিচ্ছি।

সাধুবাবা বললেন, ঠিক বলছিস?

হ্যাঁ, আমার হাত-পা খুলে দাও এবার। বড্ড লাগছে আমার। সাধুবাবা বললেন, বেশ খুলে দিচ্ছি। তবে আজ রাতের মতো আমাদের এখানে থাকতে হবে তোদের দু’জনকে। যদি ওটা পাই তা হলে কাল এমনিই ছাড়া পাবি। না হলে কিন্তু মা কালীর কাছে বলি দেব তোদের দু’জনকেই।

বেশ তাই দেবেন। এখন ছাড়ুন তো।

সাধুবাবা ওর বাঁধন মুক্ত করে বললেন, ঠিক কোনখানে আছে বল তো ওটা। বাগানের পিছনে পাঁচিলের গায়ে যে শিরীষ গাছটা আছে সেইখানে। সাধুবাবা দলের লোকদের বললেন, যাও! তুমসব জলদি চলা যাও হুঁয়া পর। সাধুর লোকেরা তখনি ছুটল।

সাধু ওদের দু’জনকে নিয়ে তাঁর আশ্রমের দিকে এগোতে লাগলেন।

ইতিমধ্যে কমলু ও চন্দন ইশারা করে নিল। তারপর চোখে চোখে কথা বলে যেই-না একটা পাথর কুড়িয়ে মারতে যাবে, অমনি সাধুবাবা খপ করে এক হাতে ধরে নিলেন কমলুকে, কিন্তু চন্দন ততক্ষণে সাধুর জটা ধরে ঝুলে পড়তেই নকল জটা খুলে এল খস করে।

এ কী! এ তো ছদ্মবেশী। এ তো সাধু নয়।

চন্দন বলল, কে আপনি? আপনি তো কাকাহিগড়ের সাধু নন।

সাধুবাবা ক্রোধে আত্মহারা হয়ে বললেন, কে আমি একটু পরে বুঝবি। শয়তান ছেলে, যদি তোর কথা মিথ্যে হয়, ওরা মূর্তি না-পেয়ে ফিরে আসে তা হলে আজই শেষরাতে তোদের বলি দেব মায়ের কাছে। এখন চল তোদের দু’জনকে মায়ের মন্দিরে রেখে আসি।

এই বলে দু’জনের হাতের নড়া ধরে টানতে টানতে সাধুবাবা ওদের নিয়ে একটা টালির চালা দেওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে শিকল তুলে নিল।

আসলে হারলাঝুরিতে মাথায় ঘা খেয়ে নদীর খাদে পড়ে গিয়ে চন্দনের শরীরে শক্তি বলে আর কিছুই ছিল না। তাই সে আর বেশিরকম বাধা দিতে পারল না। তবু ওরা দু’জনে সেই বন্ধ দরজায় লাথির পর লাথি মেরেই চলল।

এক সময় ক্লান্ত হয়ে থামল দু’জনে। যে ঘরে ওরা ছিল সেই ঘরে মিট মিট করে একটি প্রদীপ জ্বলছিল। সেই প্রদীপের আলোয় ওরা দেখল, এইটাই মায়ের মন্দির। এক পাশে কয়েকটি নরমুণ্ডের করোটি রাখা আছে। তারই মাঝখানে মাকালীর মূর্তি।

কমলু বলল, আচ্ছা চন্দনদা।

বল।

তুমি যে ওদের মিথ্যে করে বললে মালাদের বাগানে শিরীষ গাছের নীচে মূৰ্তিটা পোঁতা আছে। কিন্তু একথা তো ঠিক নয়, কাজেই ওরা যখন মূর্তি না পেয়ে ফিরে আসবে, তখন কী হবে?

আরে বুঝলি না কেন, এই অছিলায় ওদের একটু দূরে সরিয়ে দিলাম। এর ফলে হল কী ওরা মূর্তি উদ্ধার করতে গিয়ে নির্ঘাত ধরা পড়বে। কেন না মালা কি এতক্ষণে বাড়ি গিয়ে হই-চই পাকিয়ে থানা-পুলিশ করেনি ভেবেছিস? আর এই সময়ের মধ্যে আমরাও এখান থেকে পালাবার কোনও মতলব বার করতে পারব।

কী করে পালাবে?

শোন, তুই এক কাজ কর। দুটোহাত পিছনে রেখে আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে জুড়ে শক্ত করে দাঁড়া। আমি তোর হাতে পা দিয়ে কাঁধে উঠে ওপরের টালি ফাঁক করে পালাই। তারপর ওদিকে নেমে দরজার শিকল খুলে তোকে নিয়ে পালাব।

কমলু বলল, বাঃ। তোমার বেশ বুদ্ধি তো।

এ ছাড়া উপায় নেই রে।

চন্দনের কথা মতো কমলু তাই করল। এবং এই উপায়ে চন্দনও অনায়াসে ওর হাতে পা রেখে কাঁধে উঠল। তারপর টালি সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে দরজা খুলে দিতেই মুক্তি পেল কমলু।

এবার আর কোনওদিকে না গিয়ে সোজা পাহাড়ি পথে দৌড়তে লাগল ওরা। চন্দন কমলুর একটা হাত শক্ত করে ধরে ছুটতে লাগল।

ইতিমধ্যে কী করে যেন টের পেয়ে সাধুবাবাও ছুটে এসেছেন তখন, রুখ যা! এ বাঙ্গালি রুখ যা। নেহি তো মার ডালুঙ্গা।

চন্দন ঘুরে তাকিয়ে দেখল কাকাহিগড়ের সাধুবাবা আবার সেই আগের মতো জটাজুটধারী হয়ে দাড়িয়ে আছেন।

হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এসে ‘চন্দনদা’ বলে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মালা। তারপর বাচ্চা মেয়ের মতো হাউ হাউ করে কেঁদে বলল, তুমি বেঁচে আছ চন্দনদা! আমি তো ভেবেছিলাম মরেই গেছ। আমার জন্য তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ না? সামান্য একটা সাইকেলের জন্য কী কাণ্ড।

চন্দন মালাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, তোমার সাইকেল আমি উদ্ধার করেছি মালা। কিন্তু তুমি এখানে কী করে এলে।

আমি এসেছি পথ খুঁজে। তবে একা নয়। সঙ্গে এক গাড়ি পুলিশ নিয়ে। একটু আগেই একটা দলকে রাস্তায় ধরে ফেলেছে পুলিশ। এখন বাকি শুধু ওই যত নষ্টের গোড়া সাধুটা। ব্যাটা ভণ্ড।

কোন সাধু! ওটা তো ছদ্মবেশী, ওই জটা ওর পরচুলা। তাই নাকি?

হ্যাঁ।

হতে পারে। তবে কাকাহিগড়ের সাধু উনিই।

মালার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই গুডুম করে একটা শব্দ। আর সেই শব্দের সঙ্গে আর্ত চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল কমলু। চন্দন মালাকে টেনে নিয়ে বড় একটা পাথরের খাঁজে গা আড়াল করল।

আবার একটা গুলি এসে লাগল পাথরের গায়ে।

কাকাহিগড়ের সাধু ক্ষিপ্ত হয়ে গুলি চালাচ্ছেন।

ততক্ষণে দলে দলে পুলিশ ছুটে এসেছে সেখানে।

মালা ও চন্দন আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল কমলুর কাছে। কমলু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ওরা দু’জনে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল কমলুকে।

এদিকে পুলিশের লোকেরা হিড়হিড় করে টেনে আনল সাধুবাবাকে।

একজন অফিসার হাতে হাতকড়া পরিয়ে বলল, তারপর ভগবানদাসব্জি। আপনি এতদিন অনেক খেল দেখিয়েছেন। এইবার আপনার পালা শেষ।

সাধুবাবা উত্তেজিত হয়ে বললেন, ম্যায় সর্বানন্দ গিরি হুঁ। ভগবানদাস নেহি। চন্দন ছুটে গিয়ে সাধুর জটাটা টেনে খুলে দিয়ে বলল, এইবার বলুন আপনি কে?

সাধুবাবা উত্তেজিত হয়ে বললেন, মেরা ক্যা কসুর?

আপনার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। শুধু প্রমাণের অভাবে এতদিন আপনাকে গ্রেফতার করতে পারছিলাম না আমরা, আপাতত অন্য কোনও প্রমাণ নাথাকলেও ছেলেমেয়ে ধরে আটক করা এবং খুনের অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হল। নাউ ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট ফর কিডন্যাপিং অ্যান্ড মার্ডার।

মালা ততক্ষণে একটা টুকরো পাথর তুলে নিয়ে সাধুর নাকে ছুড়ে মেরেছে। সবাই হাঁ-হাঁ করে উঠল, এ ক্যা হ্যায়। তুমনে হাত মাত লাগাও।

মালা বলল, ও আজ জেলে ঢুকলে কাল ঠিক বেরিয়ে যাবে। কিন্তু আমার দেওয়া এই স্মৃতিচিহ্নটুকু যাতে চিরকাল আঁকা থাকে সেই ব্যবস্থাই করলাম।

এরপর যন্ত্রণাকাতর কমলুকে ধরাধরি করে জিপে ওঠানো হল। তারপর ওর চিকিৎসার জন্য পুলিশের জিপ দ্রুত ওকে নিয়ে এগিয়ে চলল দেওঘরের হাসপাতালের দিকে। সঙ্গে মালা, চন্দনও চলল।

এর দিন তিনেক পরের কথা। চারুভিলায় সেদিন দারুণ উৎসব। সেই রাধাকৃষ্ণমূর্তি আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠার দিন আজ। বহু লোক নিমন্ত্রিত হয়েছেন। আর তো কোনও ভয় নেই। দলের সবাই ধরা পড়েছে। হীরুক ও ভীরুক মরেছে পুলিশের গুলিতে। কাল্লুর মৃতদেহটা নদীর চরায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বাদবাকির সবাই লকআপে। কমলুর কথানুসারে নন্দন পাহাড়ের পানি ট্যাঙ্কির ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে রাধাকৃষ্ণমূর্তিকে। শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে কমলুই বলে গেছে, ওর বাবার সঙ্গে কাল্লুর কথা কাটাকাটির সময় মূর্তিটা ও লুকিয়ে ট্যাঙ্কের মধ্যে ফেলে দেয়। সেই সূত্রেই পাওয়া গেছে মূর্তিটা। কিন্তু এত আনন্দর মধ্যে কমলুই নেই, এটা যেন দুঃস্বপ্নের মতো। এ যেন ভাবাই যায় না। তাই চারুভিলার ছাদে আলশের ধারে হাতে হাত রেখে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা মালা ও চন্দনের চোখ বেয়ে টপ টপ করে অশ্রুর ধারা মুক্তোর মতো ঝরে পড়তে লাগল। দূরের পাহাড়, সবুজ অরণ্যানি এবং মেঘমুক্ত আকাশ কমলুর অভাব কতখানি বোধ করবে জানি না। তবে এই দুই কিশোরকিশোরীর হৃদয়ে কমলুর স্মৃতি হয়তো বরাবরের জন্য আঁকা হয়ে থাকবে।