কাকাহিগড় অভিযান – ৫

ওরা কিন্তু দারোগাবাবুর কথামতো ঘরে ফিরল না। কেনই বা ফিরবে? সবে তো সকাল ন’টা। এখনই কী কেউ ঘরে ফেরে? ওরা দু’জনে পায়ে পায়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এগিয়ে চলল।

মালা বলল, চন্দনদা, আজ দুপুরে কিন্তু তুমি ঘুমিয়ো না। আমি তোমাকে নিয়ে নন্দন পাহাড়ে যাব। তুমি খেয়েদেয়ে বাগানে চলে আসবে। আমিও তাই। তারপর সবাই শুয়ে পড়লেই পালাব আমরা। কেমন? কমলুর সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব। তারপর ওর কাছ থেকে আরও কিছু বিশদ জেনে নিয়ে আজকালের ভেতরেই শুরু করব আমরা কাকাহিগড় অভিযান।

এমন সময় হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয়ে গেল ভাস্করমামার সঙ্গে। ভাস্করমামা তখন একটা দোকানে বসে গোগ্রাসে কচুরি খেয়ে চলেছে। এদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখেই তো কচুরি গলায় আটকাবার উপক্রম হল।

মালা বলল, ভয় নেই আমরা ভাগ বসাব না।

চন্দন বলল, কেন বসাব না? চলো তো, আমরাও খেতে বসি। তবে ভাস্করমামার পয়সায় খাব না। আমার কাছে গোটা কুড়ি টাকা আছে। তাতেই চালাব।

মালা চন্দনকে অনুসরণ করল।

দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর মালা আর চন্দন বাগানে এল। পূর্ব পরিকল্পনা মতো ওরা এসে প্রথমে একটি গাছতলায় বসল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে বাগানের গাছের ডালে বেঁধে রাখা দোলনায় দোল খেল দু’জনে।

হেমন্তের দুপুর। মিষ্টি রোদের হাসি ছড়িয়ে দুপুর গড়াতে লাগল। একসময় মালা বলল, এবার নিশ্চয়ই সবাই বিশ্রাম করছে। চলো আমরা পালাই। চন্দন বলল, চলো।

ওরা চুপিসারে বাগান থেকে বেরিয়েই আবার মন্দিরমুখো হল। খানিক যাবার পরে একটা রিকশা ডেকে তাতেই চাপল দু’জনে। না হলে হাঁটাপথে নন্দন পাহাড় অনেক দূর।

দেওঘর শহর এখন পুজোর ছুটির যাত্রীতে ভরে আছে। চেঞ্জারদেরও আমদানি মন্দ হয়নি। তাই শহরের একপ্রান্তে নন্দন পাহাড়ের যাত্রী সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

ওরা বেশ কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির হল নন্দন পাহাড়ের পাদদেশে। চন্দনের মন কিন্তু ভরল না পাহাড় দেখে। এটা কী! পাহাড়, না টিলা? মালভূমির মতে৷ খানিকটা জায়গা ছাড়া কী এটা? ভাস্করমামা ঠিকই বলেছিল, এটা আসলে উঁচু একটা মাটি ও পাথরের ঢিপি ছাড়া আর কিছু নয়।

যাই হোক। তবু এমন সুন্দর পরিবেশ তো কলকাতায় নেই। তাই এই উন্মুক্ত পরিবেশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ওরা দু’জনে নানা কথায় কল কল করতে করতে এগিয়ে চলল।

একেবারে শেষধাপে পৌঁছে ওরা ছোট-ছোট কয়েকটি মন্দির দেখতে পেল। মালা চেঁচিয়ে ডাকল, কমলু! এ কমলু বহিন?

একটি ঘরের ভেতর থেকে উত্তর এল, যাচ্ছি। তারপরই মালার বয়সি ফ্রকপরা একটি গোলগাল চেহারার কিশোরী মেয়ে ছুটে এল সেখানে।

এই কমলু।

চন্দন অবাকচোখে দেখল কমলুকে।

মালা বলল, আমার চন্দনদা।

কমলু হেসে বলল, সমঝ গিয়া। তুমনে তো মুঝে সব কুছ বাতায়া। বলে চন্দনকে বলল, আপনি মালার দাদা, তা হলে আমারও দাদা।

এমন সময় খড়মপায়ে এক বৃদ্ধ মৈথিলী ব্রাহ্মণ এগিয়ে এলেন সেখানে, এ লেড়কা কৌন হ্যায়রে কমলু?

মালার দাদা।

জিতে রহো বেটা। কাঁহা মকান তুমহারা?

চন্দন মালার দিকে তাকাল।

কমলু বলল, বাবা আপনাকে জিজ্ঞেস করছেন আপনার বাড়ি কোথায়? চন্দন বৃদ্ধকে প্রণাম করে বলল, কলকাতায়।

বৃদ্ধ কমলুকে বলল, ইয়ে দোনোকো থোড়া পরসাদ তো দে দো কমলু বিটিয়া।

কমলু মালা ও চন্দনকে ডেকে নিয়ে গেল লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে। তারপর একবার এদিকে সেদিক দেখে নিয়ে বলল, তুমহারা সাইকিল কাঁহা?

মালা বলল, কাল রাত্রে চুরি হয়ে গেছে।

কমলু বলল, আমি জানি।

তুমি কী করে জানলে?

আমি সব কিছু জানি। তুমহারা সাইকিল কাল্লুনে চুরায়া।

মালা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ও। এটা তা হলে ওই বদমাশটার কাজ? হ্যাঁ। আজ সবেরে ও আয়া থা। ওই সাইকিল লে কর। তোমার সাইকিল তো আমি চিনি। যেই–না বলেছি এই সাইকিল তুম কাঁহাসে চুরায়া কাল্লু? ও হাস হাস কর ভাগ গিয়া।

চন্দন ও মালাকে কমলু তখন প্রসাদ খেতে দিয়েছে। খেতে খেতে চন্দন বলল, তুমি কাল্লুকে চেনো মালা?

হ্যাঁ চিনি। গুন্ডা-বদমাশ একটা।

কমলু বলল, এইখানকার মানুষ যত ভাল ও তত খারাপ। বুঝলেন তো চন্দনদাদা, এই মালাদের বাড়িতে যে বড় একটা ডাকাইতি হয়ে গেল তার মধ্যে ওই কাল্লু ভি ছিল। ওই দিন রাতে আমার বাবুজির কাছে ও এসেছিল চুরি করে আনা রাধাকিষণজির ওই মূর্তি রাখনে কে লিয়ে। লেকিন আমার বাবুজি বহুত গোঁস্সা কিয়া। উসকো মার মারকে হটা দিয়া।

চন্দন বলল, তোমার বাবুজি তো ভুল করলেন কমলু। মূর্তিটা রেখে তো মালাদের খবর দিতে পারতেন।

কমলু বলল, না। দলে তো কাল্লু একা ছিল না। বিরজু, শ্যাম এরাও সব ছিল। এরা তো ভাল লোক নয়। যদি ওরা বাবুজিকে মেরে ফেলত?

চন্দন বলল, আচ্ছা মালা, এই কাল্লু, বিরজু, শ্যাম এদের তুমি চেনো? সবাইকে চিনি, বদের ধাড়ি এক একটা।

কমলুর কথামতো এরাই যদি তোমাদের মূর্তি চুরির সঙ্গে জড়িত থাকে তা হলে ওই যে লোকদুটো কাল রাতে আমাদের দু’জনকে চুরি করতে আসছিল ওরা কারা? তুমি ওদের চেনো?

না।

এরা কি কাকাহিগড়ের সাধুর লোক?

তাও জানি না।

চন্দন এবার কমলুকে বলল, কমলু বহিন, ওই কাকাহিগড়ের সাধুবাবা কেমন লোক?

কী করে জানব? তবে মূর্তিচুরির পর থেকেই তো ওই সাধুবাবাকে এখানে আসা যাওয়া করতে দেখেছি। আর কাল্লু, বিরজু, শ্যাম এরা হয়ে উঠেছে ওর আসল চ্যালা।

মালা বলল, ঠিক আছে। চন্দনদা, আর এখানে গল্প করে লাভ নেই। এখন দেখি সাইকেলটার কোনও গতি করতে পারি কী না। কাল্লুর ডেরায় একবার আমি হানা দেব।

কাল্লুর ডেরা কোথায়?

কমলু জানে।

কমলু বলল, ও তো হিয়াসে বহুত দূর পড় যায়ে গা। তুমকো হারলাঝুরি যানা পড়েগা।

হারলাঝুরি?

ইঁ।। করমনাশা নদী কে কিনার মে।

তুমি আমাদের নিয়ে যাবে কমলু?

কমলু যেন শিউরে উঠল, নেহি। নেহি। ও সমঝ যায়ে গা। তুম দোনো যাও। চন্দন বলল, তা হলেও তো সেই একই ব্যাপার হবে। আজ হঠাৎ আমাদের দু’জনকে হারলাঝুরিতে দেখলে ও তো বুঝেই নেবে কমলুর মুখে শুনেই আমরা এসেছি।

মালা বলল, তাও তো বটে। তবে এক কাজ করা যাক। যেন আমরা বেড়াতে বেরিয়েছি এইভাবে দু’জনে একটা রিকশায় চেপে হারলাঝুরিতে গিয়ে পড়তে পারি।

সেই ভাল।

এই বলে ওরা দু’জনে নেমে এল পাহাড় থেকে। পাহাড়ের নীচে দু’-তিনটি রিকশা যাত্রী পাবার আশায় অপেক্ষা করছিল। ওরা গিয়ে তাদেরই একজনকে ঠিক করল হারলাঝুরি দেখিয়ে আনবার জন্য। কথা হল হারলাঝুরি দেখিয়ে রিকশা ওদের শিবগঙ্গার কাছে ছেড়ে দেবে।

ওরা সেই রিকশায় চেপে প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হারলাঝুরিতে গিয়ে পৌঁছুল। ভারী চমৎকার জায়গা। কর্মনাশা নদীর ধারে এখানকার শিবমন্দিরের তুলনা নেই। কিন্তু মুশকিল হল এখানে কোথায় কাল্লুর বাড়ি? ওরা সন্ধানী দৃষ্টিতে এদিকসেদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল।

ওই তো। ওই তো মালার সাইকেলটা। একটি গাছতলায় নিতান্ত খেলো জিনিসের মতো পড়ে আছে। কোনও লোক নেই, জন নেই। শুধু মাটিতে কাত হয়ে শোয়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু কেন? কাল্লু যখন চুরি করেছে তখন হয় এটাকে ব্যবহার করবে নয় তো বেচে দেবে। কিন্তু এ কী রহস্য?

যাই হোক। মালা আর চন্দন টেনে আনল সাইকেলটাকে। তারপর যেই না মালা তাইতে চেপে বসতে যাবে, অমনি আশপাশের পাথরের আড়াল থেকে তিন-চারজন ছিপছিপে চেহারার বড় বড় ছেলে বেরিয়ে এল। তাদের সকলকেই মালা চিনল। তারা হল কাল্লু ও তার তিন সঙ্গী।

কাল্লু বলল, আরে মালা! আমি তোমারই জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম তুমি আজ আসবে। ওই জন্যেই তো সাইকেলটা নিয়ে ওই কমলু ছুঁড়িটাকে দেখিয়ে এনেছিলাম। যা ভেবেছি তাই। ও তোমাকে বলল, আর তুমি অমনি ছুটে এলে। কিন্তু তোমার সঙ্গে এই লালটু ছেলেটাকে কখনও ঘুরতে দেখিনি তো? ও চিড়িয়াটি কে?

মালা রুখে দাঁড়িয়ে বলল, মুখ সামলে কথা বলবি কাল্লু। নেহি তো চপ্পল মারকে মুখ তোড় দুঙ্গা। এ মেরা দাদা। বলেই সাইকেলটা ঠেলে দিল কাল্লুর দিকে।

আচমকা সাইকেলের ধাক্কায় কাল্লু ছিটকে পড়ল।

ওর সঙ্গে আরও যে তিন সঙ্গী ছিল তারা তখন ঝাঁপিয়ে পড়ল মালার ওপর। তারপর শুরু হল ধস্তাধস্তি। চন্দনও মালাকে মুক্ত করবার জন্য লাফিয়ে পড়ল তাদের ঘাড়ে। তারপর আঁচড়ে কামড়ে কিল-চড়-ঘুসি মেরে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল সকলকে। ইতিমধ্যে কাল্লুও উঠে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে একটা শক্ত মোটা লাঠি। সেই লাঠির বাড়ি চন্দনের মাথায় এক ঘা দিতেই মাথাটা কী রকম যেন ঘুরে উঠল চন্দনের। ও চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে লাগল। ও বেশ বুঝতে পারল কারা যেন পাঁজাকোলা করে ওকে তুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল নদীর খাদে। উঃ। সে কী অসহ্য যন্ত্রণা। ধীরেধীরে চোখেমুখে জাল পড়ে এল। সব কিছু কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল চোখের সামনে।

এদিকে মালাও শরীরের যথাশক্তি প্রয়োগ করে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু চারজনের সঙ্গে একা ও পেরে উঠবে কেন? তার ওপর চোখের সামনে চন্দনের ওই মর্মান্তিক পরিণতি ওকে দারুণ নার্ভাস করে দিল। মনে মনে ভয়ও পেল যথেষ্ট। যদি কোনওরকমে নিজেকে অক্ষত শরীরে বাঁচিয়ে নিয়ে ও ফিরতে পারে তা হলেই বা হবেটা কী? চন্দন কী বাঁচবে? তা ছাড়া ওর মা-বাবার কাছে গিয়ে কোন মুখে ও এই নিদারুণ সংবাদটা পৌঁছে দেবে? ওর চোখফেটে যেন জল এল।

ততক্ষণে ওর অসর্তকতার সুযোগ নিয়ে কাল্লু আর ওর তিন সঙ্গী ওকে আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এই সব কাজে ওরা দারুণ অভ্যস্ত। তাই এমন কায়দা করে মালাকে বাঁধল ওরা, যে একটু শব্দ পর্যন্ত বের করতে পারল না।

এই অঞ্চলটা অত্যন্ত নির্জন। তাই কোনও লোকজনই এগিয়ে এল না ওদের সাহায্য করতে। অসহায় চন্দন আহত ও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে রইল কর্মনাশার খাদে। কে বলতে পারে না যে, গভীর রাতে ত্রিকূটের কোনও বাঘ জল খেতে এসে ওর নরম নধর শরীরটাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে যাবে না? মালাও অসহায় ভাবে ভগবানকে ডাকতে লাগল। মনে মনে বলতে লাগল, হে ভগবান। আর যেন ওকে ঘরে ফিরতে না হয়, কারণ চন্দনের এই অবস্থার জন্য ও-ই তো দায়ী। ওর এই রকম ক্ষতি করে চন্দনের মা-বাবার সামনে ও কী করে দাঁড়াবে?

কাল্লুর দল এবার বন্দিনী মালাকে কাঁধে নিয়ে নদী পার হল। তারপর ঘন বনের ভেতর দিয়ে নিয়ে চলল চুপিসাড়ে। ততক্ষণে সূর্য অস্ত গেছে। আঁধারের ধূসর যবনিকা ধীরে ধীরে নেমে আসছে প্রকৃতির বুকে। ওরা মালার হাত-পা-মুখ সবই বেঁধেছে। বাঁধেনি শুধু চোখদুটো। মালা এখন স্থির হয়ে আছে। কেন না ও বুঝেছে এখন আর অস্থির হয়ে কোনও উপায় নেই। ধীরে ধীরে দুর্বৃত্তদের অত্যাচারের কাছে ওকে আত্মসমর্পণ করতেই হবে।

যাই হোক। ওরা এক সময় একটু উচ্চস্থানে উঠতে লাগল। মালা বুঝল এ জায়গাটা পাহাড়ি এলাকা। চারদিকে পাহাড়। এই পাহাড়ের একটু উচ্চস্থানে একটি পুরনো মন্দিরের ভেতর ওরা আটকে রাখল মালাকে।

মন্দিরের জানালাদরজা সবই পুরনো। কিন্তু মজবুত। সেই ঘরে ওকে রেখে কাল্লু বলল, আজকের মতো থাকো তুমি এই ঘরে। ওই কমলু ছুঁড়ির সঙ্গে একবার মুলাকাত করে আসি। ওকে আমি এমন শিক্ষা দেব যে বুঝবে ও। তারপর ওই ছেলেটার মতো তোমারও অবস্থা আমি খারাপ করে দেব।

কাল্লু চলে গেল ওর তিন সঙ্গীকে নিয়ে।

হাত-পা-মুখ বাঁধা মালা একাকী সেই অন্ধকার ঘরে পড়ে রইল চুপ চাপ। জলপিপাসায় জিভ যেন শুকিয়ে আসতে লাগল। তার ওপর মশার কামড়। কী যে আছে কপালে তা কে জানে?

ওরা চলে যাবার অনেক পরে মালা অনুভব করল কারা যেন আশপাশে ঘোরাফেরা করছে! তবে কী ওরা ফিরে এসেছে এতক্ষণে? কিন্তু না। এরই মধ্যে ওদের ফিরে আসা তো সম্ভব নয়! তা হলে!

একটু পরেই যমদূতের মতো চেহারার দু’জন লোক আলোহাতে ওই ঘরে ঢুকল। তারা ওইভাবে মালাকে পড়ে থাকতে দেখেই চমকে উঠল, এই কৌন হো তুম?

মালার তো মুখবাঁধা।

একজন এসে ওকে বাঁধন মুক্ত করল।

মালা বলল, থোড়া পানি পিয়েগি।

পানি পিয়োগি? হিয়া তো পানি উনি কুছ নেহি হ্যায়। ক্যা নাম হ্যায় তুমহারা? মকান কাহা।

আমার নাম মালা। মকান দেওঘর।

হিয়া কৌন লে আয়া?

দো-তিন বদমাশ লে আয়া হামকো।

সমঝ গিয়া।

মালা বলল, শুনুন, আপনারা কে তা জানি না। দয়া করে আমাকে বাঁচান। আমার এক দাদাকে ওরা মেরে কর্মনাশার খালে ফেলে দিয়ে এসেছে। তাকে উদ্ধার করুন।

ওদের একজন বলল, যারা তোমাকে নিয়ে এসেছে তাদের কাউকে তুমি পয়হানবে?

হ্যা। হারলাঝুরির কাল্লু আর ওর দোস্তরা নিয়ে এসেছে আমাকে।

আচ্ছা, কাল্গুনে লে আয়া তুমকো? তো ইয়ে বাত পহলে বতায়া নেহি কিউ?

ঠিক হ্যায়। তুম ভাগো। হাম সমঝেগা উসকা সাথ।

আর একজন বলল, তুমকো হিয়া রাখকে ও কাঁহা গয়া?

মালা বলল, নন্দন পাহাড়ে যে পূজারি ব্রাহ্মণ আছেন, ওনার লেড়কি কমলুকে ও জোর করে নিয়ে আসতে গেছে। ও হয়তো কমলুকে মেরেই ফেলবে। নয়তো আমাদের দু’জনকেই পাচার করে দেবে অন্য কোথাও।

লোকদুটো হো হো করে হেসে উঠল। বলল, তো তুম এক কাম করো। আভি মাত যাও হিয়াসে। চুপ চাপ বৈঠা রহো। যব ও আদমি আয়েগা তব মার মারকে হাড্ডি তোড় দুঙ্গা উসকো। আউর কমলুকো ভাগাকে লে আয়াগা তো উসকো লে কর তুম দোনোনে এক সাথ চলি যাওগি।

মালা বলল, তার আগে একটু জল খেতে পারলে হত।

লোক দু’জনের একজন বলল, ঠিক আছে। বইঠো তুম। ডরো মাত। আমি জল আনছি। বলে চলে গেল।

আর একজন যে বসেছিল, মালা তাকে বলল, আপনারা কে তা জানি না। কিন্তু আপনারা না–এসে পড়লে আমার খুব বিপদ হয়ে যেত।

লোকটি বলল, খোকি, আমরা ভাল লোক না আছি। আমরা ডাকাইতি করে খাই। ও কাল্লু বদমাশ ভি হামারা সাথ থা লেকিন—

এখন আর নেই। এই তো?

হা। এক রাত হামলোক বহুত বঢ়িয়া ডাকাইতি কিয়া। কমসে কম পাঁচ সাত লাখ রুপিয়াকা এক মূর্তি চুরায়া থা। তো ও মুরত কাকাহিগড় ভেজনা থা উসকো। লেকিন ও কাহা-হাপিস কর দিয়া কৌন জানে। ওইদিন সে ও স্রেফ ভাগতা।

মালা অবাক হয়ে বলল, বলেন কী! মূর্তিটা একেবারে লোপাট করে দিল? হাঁ। আজ আমরা একটা খারাপ কাম করবার জন্যে ইখানে এসে পড়েছিলাম। তা ভালই হল, কাল্লুকা সাথ মোকাবিলা হো যায়েগা।

মালা বলল, আচ্ছা কাকাহিগড়ে কী আছে?

ও সাধুবাবা আছে না ? ওই সাধুবাবা ফরেন কানট্রিতে মূর্তি সাপ্লাই করে ফরেন মানি কামাই করেন। হামারা হিয়া পর যো চিজ কা দো-দশ লাখ রুপিয়া দাম হোগা, ওই চিজ ফরেন ভেজলে সাধুবাবা পঁচাশ লাখ কামিয়ে নেবেন।

মালা বলল, তা ওই মূর্তিটা যে কাল্লু আপনাদের ফাঁকি দিয়ে কাকাহিগড়ের সাধুকে দেননি, তার কী প্রমাণ আছে?

কাকাহিগড়ের সাধুর হাতে ওই মূর্তিটা গেলে ও তো আমাদের দু’জনের হাতেই পাচার হবে। ওই সাধুবাবা ভি তাজ্জব বনে গেছেন। কাল্লু বলেছে মূর্তিটা নন্দন পাহাড়েই হাপিস হয়ে গেছে।

কিন্তু কী করে? কমলুর বাবা অত্যন্ত ভালমানুষ।

জানি। ঝাজি আচ্ছা আদমি। উয়ো অ্যায়শা কাম নেহি কিয়েগা। মালুম হোতা হ্যায় কাল্লু অকেলে কাম করনে মাংতা।

আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে আপনাদের কোনও পালটি দল তৈরি হয়েছে?

উঁহু। ও নেহি হো সতা।

তা হলে! কাল্লুকে ঘা কতক দিয়ে কথাটা আদায় করতে পারছেন না আপনারা?

আরে! ও সাধুবাবা বহুত মার মারা উসকো।

ওকে জানে মারছেন না কেন আপনারা?

জানে মারলে ফায়দা কী? আমরা চারদিকে নজর রাখছি। ও মাল এইখান থেকে বাইরে যাবে তো হাতে হাতে ধরব। উসকে বাদ মজা দেখায়গা বদমাশ কো।

মালা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনারা কোথায় থাকেন? আমরা জঙ্গলে থাকি। পাহাড়ে থাকি। তা কাল্লু তোমাকে কীভাবে এখানে নিয়ে এল? আনলই বা কেন?

আমি কমলুর দোস্ত ছিলাম। আমার একটা সাইকেল ওই কাল্লু শয়তানটা চুরি করে এনেছিল। সেই খবর পেয়ে ওর ডেরাতে আমি আমার দাদা যাই। সেই সময় কাল্লু আমার দাদাকে মেরে নদীতে ফেলে দেয়। আর আমাকে হাত-পা-মুখ বেঁধে এখানে নিয়ে আসে।

আরে বাঃ। কাল্গুনে তুমহারা সাইকিল চুরায়া? অ্যায়শা ছোট কাম কব সে শুরু কিয়া ও? হামলোক অ্যায়শা কাম তো কভি নেহি কিয়েগা। ঘড়ি, আংটি, রেডিয়ো; সাইকিল এ সব কভু নেহি চুরায়াগা। হামারা বিজনেস লাখ লাখ রুপিয় কা।

এই সমস্ত আলোচনার পর মালার মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করতে লাগল। যা কিছু সূত্র ও অনুসন্ধান করেছে সবই যেন কীরকম পরস্পরবিরোধী হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হল। যেমন, কমলুর মুখে ও শুনেছে ওদের মূর্তি চুরি যাওয়ার পর কাকাহিগড়ের সাধুবাবা নন্দন পাহাড়ে বেশি করে যাতায়াত করছেন। কিন্তু কেন? ও আরও শুনেছে কাল্লু এবং তার দলবল সাধুবাবার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। যদি তাই হয় তা হলে কাল্লু মূর্তিটাকে হাপিস করার পরও সাধুবাবার প্রিয় পাত্র কী ভাবে হতে পারে? এবার প্রশ্ন, এত জায়গা থাকতে কাল্লু মূর্তিটা ওই নন্দন পাহাড়েই বা নিয়ে গেল কেন? মূর্তিটা তো সরাসরি কাকাহিগড়েই নিয়ে যেতে পারত। এর পরের প্রশ্ন ওইটুকু সময়ের মধ্যে মূর্তিটাকে পাহাড় থেকে হাপিস করল কে? এবার যেটা মনে আসে সেটা হল ওই অসময়ে মালা ও চন্দন হারলাঝুরিতে যাওয়া মাত্রই যেখানে কাল্লুর দেখা পেয়ে গেল সেখানে এই লোকদুটো কাল্লুকে খুঁজে পায় না কেন? সর্বোপরি লোকদুটো মালার কাছেই বা গড় গড় করে তাদের প্রকৃত পরিচয় দিতে গেল কেন? এবং গতরাতে ওদের যে লোকদুটো খুন করতে আসছিল তারাই বা কারা, কীসের জন্যই বা ওই বাগানে ঘোরাফেরা করে? মালার চিন্তার গ্রন্থিগুলো সব যেন জট পাকিয়ে যেতে লাগল। ওর বার বারই মনে হতে লাগল এই লোকদুটো ওকে আগাগোড়া সব বানিয়ে বলছে না তো?

ইতিমধ্যে অপর লোকটি একটি বোতলে করে জল নিয়ে এল।

তৃষ্ণার্ত মালা সেই জল ঢক ঢক করে খেয়ে নিল এক নিশ্বাসে। তারপর বলল, আমার দাদাকে ওরা মেরে নদীর খাদে ফেলে দিয়েছে। আপনারা একটু আসবেন আমার সঙ্গে? ধরাধরি করে তুলে আনতাম দাদাকে।

লোক দু’জন একবার পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, জরুর যায়েঙ্গে। লেকিন ইস মওকে মে কাল্লু আ যায়েগা তো?

এত তাড়াতাড়ি ও কী করে আসবে? নন্দন পাহাড় কী এখানে?

হুঁ। ঠিক হ্যায় চলো। বলে লোক দু’জন মালাকে নিয়ে সেই উচ্চস্থান থেকে ধীরে ধীরে জঙ্গলের পথ ধরে কর্মনাশা নদীর দিকে এগোতে লাগল। সামনেই কোজাগরি পূর্ণিমা বলে নির্মল আকাশে জ্যোৎস্নার প্রভাব খুব। কাজেই চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল প্রকৃতির বুকে কোনও অন্ধকার নেই। তাই পথ চলতেও অসুবিধা নেই।

ওরা ধীরে ধীরে কর্মনাশার খাদে এসে নামল। কিন্তু কই? কোথায় কে? এক জায়গায় একটু রক্তের দাগ রয়েছে। এবং এক পাটি চটি জুতো পড়ে আছে। এ ছাড়া আর কোনও অস্তিত্বই কোথাও নেই। রক্তের দাগটা নদীর জলের কাছ পর্যন্ত এসেছে। অর্থাৎ এদিক থেকেই কোনও বন্য জন্তু এসে নিয়ে গেছে চন্দনকে। চলে গেছে অরণ্যের বক্ষভেদ করে ভয়ংকর ত্রিকূটের দিকে। মালা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে লুটিয়ে পড়ল পাথরের বুকে।

ওর কান্না দেখে সঙ্গের লোক দু’জনেই কী রকম হয়ে গেল যেন। ওদের মনটা খুব নরম হয়ে গেল। বলল, কাঁদছ কেন খুকি? মাত রোনা। চলো আমরা তোমাকে দেওঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। যদিও অনেক দূর তবু ভয় নেই। এসো।

মালা কাঁদতে কাঁদতে বলল, না না না, আমি এই মুখ বাড়িতে গিয়ে কাউকে দেখাতে পারব না। তোমরা আমাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে চলো। না হলে মেরে ফেলো। ওর মা-বাবার ওই একটিই মাত্র ছেলে। ওকে না নিয়ে আমি কিছুতেই বাড়ি ফিরতে পারব না।

লোক দু’জন মালার হাত ধরে তুলে দাঁড় করাল। তারপর বলল, ঠিক আছে। আও মেরা সাথ। বলে পাথরের খাঁজ ধরে ওপরে উঠে অন্ধকারে বেশ খানিকটা যাবার পর ছোট্ট একটি গ্রামে এসে পৌঁছুল ওরা।

ওদের একজন একটি বাড়ি থেকে একটি মোটর বাইক নিয়ে এসে মালাকে তাইতে বসাল। তারপর বাইকটাকে ঝড়ের গতিতে ছুটিয়ে নিয়ে চলল দূরের পাহাড়ের দিকে।

মালা বলল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

কাকাহিগড়।

কাকাহিগড়?

হ্যাঁ। হামারা সাধুবাবাকা পাস।

ও আদমি তো আচ্ছা নেহি। মুঝে ডর লাগতা।

তা হলে চলো। তোমার ঘরেই তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি?

মালা বলল, না।

তব চুপ চাপ রহো।

একটা বুলেট যেন রাতের বিভীষিকার মতো ভটভট শব্দে ছুটে চলল। এত জোরে যে তা বলবার নয়। এক এক সময় মালার মনে হল ওটা এখুনি বুঝি দুর্ঘটনায় পতিত হবে। কিন্তু না! এই সময় সাহসী শক্তিমান লোকটা নির্বিঘ্নেই ওকে নিয়ে পথ চলতে লাগল। এক জায়গায় এসে বাইক থামাল।

এখানে চারদিকে শুধু পাহাড়-পাহাড় আর পাহাড়। আর কী দারুণ নির্জনতা। একসময় একটি ছোট পাহাড়ের একেবারে উচ্চস্থানে একটি গুহার কাছে এসে লোকটি বলল, শোনো, আজ রাতটার মতো তুমি এখানে থাকো, কেমন? তারপর কাল সকালে এসে তোমার ব্যবস্থা করছি।

মালা বলল, সাধুবাবা কোথায়?

উনি আছেন। এখন দেখছি তোমাকে কিছু খাবার দিতে পারি কি না। ভুগ লাগ গিয়া না? বলে সে চলে গেল।