কাকাহিগড় অভিযান – ৪

বাইরে বেরনোর দরজার পাশে ওর মেসোর রেখে যাওয়া সেই লোহার ডাল্ডাটা ছিল দেখে চন্দন সেটা হাতে নিল। তারপর দরজার খিল খুলে দু’জনে মিলে শুরু করল ওদের নৈশ অভিযান। খুব সন্তর্পণে, পা টিপে টিপে চলল ওরা। অপূর্ব জ্যোৎস্নালোকে এই ফুট ফুটে কিশোর কিশোরীকে যেন আলোকের দূত বলে মনে হল।

যেতে যেতে মালা বলল, চন্দনদা তুমি আমার ওপর খুব রাগ করেছিলে, না? কেন?

বাঃ রে। আমি যে তোমার সঙ্গে ভাল করে কথা বলতাম না। তোমাকে ‘নেকু নেকু’ বলে রাগাতাম। তোমার বই চুরি করে এনে আমার ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলাম।

চন্দন হেসে বলল, প্রথমে সত্যিই খুব রেগে গিয়েছিলাম। পরে যখন বুঝলাম তোমার ওপর রাগ করা উচিত নয়, তুমি এমন এক মেয়ে যে, তোমার প্রকৃতিই এইরকম, তখন থেকে আর রাগ করিনি।

আসলে তোমাকে না আমার খুব ভাল লেগে গিয়েছিল। তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম তোমার মতো সহজ সরল ভাল ছেলে আর হয় না। তুমি এখনকার ছেলেদের মতো নও। তোমাকে রাগালে তুমি রাগবে। কিন্তু কিছু বলবে না। তাই তোমাকে একটু রাগিয়ে দিয়ে মজা দেখছিলাম।

চন্দন বলল, ওরে দুষ্টু মেয়ে, তুমি তা হলে মজা করবার জন্যে এই সব করেছিলে?

হ্যাঁ, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি চন্দনদা।

ক্ষমা করলাম। তবে জেনে রেখো, আমারও তোমার সঙ্গে ভাব জমাবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। আর খুব ইচ্ছে করত তোমার সঙ্গে চারদিকে বনে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে।

বেশ তো এবার ঘোরো না কত ঘুরবে। আমি তোমাকে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব।

ঠিক আছে, আর কোনও কথা নয়। এবার মুখবুজে চুপচাপ চলো। বলে বড় বড় গাছের গুঁড়ির আড়ালে ছায়ায় ছায়ায় সন্তর্পণে পা টিপে টিপে ওরা এগিয়ে চলল।

ওরা যখন সেই ঘন গাছপালার আড়ালে বাগানের অর্ধপথে, তখন হঠাৎই একটা টর্চের আলো ওদের ওপর পড়েই নিভে গেল। আর তারপরেই মনে হল কেউ বা কারা যেন ছুটে পালাল সেখান থেকে।

চন্দন ও মালাও ছুটল।

মালা চেঁচাতে লাগল, চোর চোর! জেঠু তাড়াতাড়ি এসো। ভাস্করমামা, তুমি ওই পাশ দিয়ে যাও। চন্দনদা, দারোগাবাবুকে বলো গেটের দিকে তাড়া করতে। যাও শিগগির যাও।

চন্দন তো হতচকিত। কোথায় মেসো, কোথায় ভাস্করমামা আর কোথায়ই বা দারোগাবাবু! মালার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? একটুক্ষণ ছুটে ছোটা থামিয়ে মালা মিষ্টি করে তাকাল চন্দনের দিকে। তারপর এক চোখ টিপে হেসে বলল, ঢপ দিলাম! না হলে আমাদের দু’জনকে ছোট দেখে যদি ওরা তাড়া করে?

চন্দন বলল, তোমার এত বুদ্ধি মালা?

এরকম না হলে গোয়েন্দাগিরি করব কী করে? ঠিক আছে, কোনও চিন্তা নেই। দ্যাখো না দু’দিনে তোমাকেও আমি তৈরি করে নেব!

এখানে বাগানটা খুবই ঘন! তবুও মালা আর চন্দন দু’জনে মিলে চারদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল কোথাও কিছু পাওয়া যায় কি না দেখতে। না, কেউ কোথাও নেই। কোথাও কিছু নেই। আশ্চর্য।

চন্দন বলল, পালিয়েছে ব্যাটারা।

মালা বলল, পালাবে কোথায়? চারদিকে পাঁচিল আর পাঁচিলের গায়েগায়ে কাঁটাঝোপ। ওরা ঠিক এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে। দারোগাবাবু তো বলেইছেন কাউকে দেখতে পেলেই শিস দিতে। তা হলেই উনি ছুটে আসবেন।

ওরা এই ভাবে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল। দেখল সেখানে পাঁচিলের একাংশ সামান্য ধসে গেছে। খুবই সম্প্রতি বলে মনে হল। অর্থাৎ বদমাইশ লোকগুলো এইখান দিয়েই ওদের পালাবার পথ তৈরি করে রেখেছে।

মালা বলল, বুঝেছি। এই তোমাদের পালাবার পথ।

চন্দন বলল, কিন্তু মালা, এখান দিয়ে সাইকেল পাচার করবে কী করে? ওরা তবুও পাঁচিলের কাছে এসে দেখল এখান দিয়ে পালানোও খুব একটা সহজসাধ্য নয়। তবুও শয়তানের অসাধ্য কিছু তো নেই।

চন্দন বলল, লোকগুলো সত্যিই পালিয়েছে, নাকি গাছে উঠে লুকিয়ে বসে আছে?

কে জানে? নেই যখন, তখন চলে যাই চলো।

ওরা বাগানের সোজা পথ ধরে বেশ কিছুটা ওদের বাড়ির দিকে এগিয়ে এল।

তারপর এক জায়গায় ঘন ঘাসের গালিচার ওপর বসে পড়ল।

মালা বলল, কী চমৎকার পরিবেশ এখানকার, না?

চন্দন বলল, সত্যি, তোমাদের এই বাগানটা দেখার পর মনে হয় না স্বর্গেও কখনও বেড়াতে যাই। ফুলের গন্ধে বুক যেন ভরে উঠেছে। আর এই অপূর্ব জ্যোৎস্না রাত। মনে হয় এখানকার এই ফুলবনে যেন সারারাত ঘুরে বেড়াই।

আমারও খুব ইচ্ছে করে, তবে কী জানো চন্দনদা, সাহস আমার অফুরন্ত হলেও আমি একা তো। এখন না হয় তুমি এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছ, কিন্তু এতদিন তো একাই ছিলাম। মাঝে-মধ্যে রাত্রিবেলাও এই বাগানে আমি একা এসেছি। তবে খুব ভয় করত।

রাত্রে একা এসেছ? কেন?

বললাম না, আমাদের বাড়িতে যে সেই ভয়াবহ ডাকাতিটা হয়ে গেল, তারপর যখন আমি মা-বাবার সঙ্গে এখানে আসি, তখন আমি নিজেই চারদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকি কোথাও কোন সূত্র পাই কি না। একদিন হঠাৎ বাগানে ঘাসের ওপর ঠাকুরের মোহন বাঁশিটি আমি কুড়িয়ে পাই…।

তারপর?

কেউ জানে না। কাউকে বলিনি। ওটা এখনও আমার জিম্মাতেই ছে।

ভুল করলে মালা, এই কথাটা তোমার মেসোকে জানানো উচিত ছিল। উনি তা হলে পুলিশকে জানাতে পারতেন ব্যাপারটা।

মালা এবার একটু রাগতসুরে বলল, কিচ্ছু হবে না তোমার দ্বারা। এই তা হলে তুমি ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ পড়? চন্দনদা, আমি ধাপে ধাপে অনেক এগিয়ে গেছি। ওই মূর্তিকে উদ্ধার পুলিশে নয়, আমিই করব।

সে কী! এত তোমার মনের জোর?

হ্যাঁ।

তা হলে মালা, আমিও তোমার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছি। কেন না এই রকম একটা কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি, এ আমার বহুদিনের শখ। ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’র বাবলুর মতো আমিও একজন হতে চাই।

আমি জানি। তোমার মা, কাকিমার কাছ গল্প করছিলেন আমি শুনেছি। তুমি নাকি বাইরে বেরোলে ছুরি, নাইলনের দড়ি, টর্চ এইসব সঙ্গে রাখ? ভাস্করমামা বলছিলেন তুমি নাকি ফেয়ারলি প্লেসের বুকিং অফিসে একজনের হাত মুচড়ে দিয়েছিলে?

ও বাবা, আমার সম্বন্ধে এত খবরও তুমি রেখেছ? অথচ এমন ভান দেখাতে যেন আমাকে দেখলে তুমি জ্বলে যাও?

এমন সময় হঠাৎ কর্কশ চিৎকারে চমকে উঠল দু’জনেই।

চন্দন ভয়ে নীল হয়ে গেল। মালা সস্নেহে ওর বুকে হাত বুলিয়ে বলল, ভয় নেই। ওটা প্যাচা। হয়তো কালপ্যাঁচা হবে।

একটুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মালা আবার বলল, সাইকেলটা হারিয়ে আমার কত ক্ষতি হল তা জানো? নন্দন পাহাড়ের পথে একদিন পাহাড়ে ওঠার মুখে পথের ধারে কুড়িয়ে পাই ঠাকুমার গোপালকে। পা-ভাঙা অবস্থায়। তারপর থেকে রোজ দু’বেলা যাই। পাহাড়টাকে চষে ফেলি। সে কী!

সাইকেলটা ছিল বলেই সম্ভব হয়েছিল। দিদা বেনারস থেকে পাথরের ওই নাড়ুগোপাল কিনে এনেছিলেন। একটা পেতলের গণেশ, লক্ষ্মীঠাকুর আর নাড়ুগোপাল ছোট একটি সিংহাসনে বসানো থাকত। ওরা ঝোঁকের মাথায় সেগুলোকেও নিয়ে পালাবার সময় অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকে যেখানেসেখানে ফেলতে ফেলতে যায়।

রুপোর বাঁশিটা তো অপ্রয়োজনীয় নয়। ওটার তো দাম আছে?

ওটা আসলে পড়ে যায়। অন্ধকারে ছুটে পালাবার সময় পড়ে যায় ওটা। ওরা সোজা পথে না-গিয়ে বাগানের পাঁচিল টপকে উলটো পথে চলে যায়। পাঁচিল কী করে টপকাল?

আগে থেকে ব্যবস্থা করে রেখেছিল নিশ্চয়ই। একদল পাঁচিল টপকে যায়। অন্য দল সামনের গেট দিয়ে। অর্থাৎ দু’ভাগ হয়ে। তা হলে পুলিশের হাতে এক দল ধরা পড়লে অন্য দল বেঁচে যাবে। প্রথমেই ওরা চলে যায় নন্দন পাহাড়ের নির্জনতায়। তারপর… তারপর যে কোথায় যায় সেটাই খুঁজে বার করতে হবে আমাদের।

তোমার কী মনে হয় কাছাকাছিই কোথাও আছে মূর্তিটা?

হতে পারে। একদিন ত্রিকূট বেড়াতে গেছি, ওখানে কাকাহিগড়ের সাধুর সঙ্গে দেখা। কী ভীষণদর্শন চেহারা। আমাকে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে একজনকে ফিস ফিস করে কী যেন বললেন।

যাকে বলল সে কে?

সে ওইখানেই আশ্রমে থাকে।

তুমি কী করে জানলে যে ওই সাধুই কাকাহিগড়ের সাধুবাবা?

পরে একদিন সাধুবাবা নন্দন পাহাড়ে গিয়েছিলেন। ওইখানে কমলু নামে আমার এক বান্ধবী আছে। সে বলল। সে-ই বলেছে ওই সাধুবাবার কথা। কমলু মেয়েটা-না খুব ভাল। আমি ওর সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব। ওর মুখে আমি অনেক কথা শুনেছি। ও আমায় কয়েকটা লোককে চিনিয়ে দিয়েছে। ও বলেছে আমাদের বাড়িতে যারা ডাকাতি করেছে, তাদের কয়েকজনকে ও নাকি চেনে।

বলো কী?

ওই জন্যেই তো সকাল-সন্ধে সব সময় আমি ওর কাছে যাই। ওর সঙ্গে আমার খুব ভাব বলে কেউ আমাকে সন্দেহও করে না। ওকে আমি তোমার কথাও বলেছি।

চন্দন উৎসাহ নিয়ে বলল, কী বলেছ আমার কথা?

বলেছি আমার এক দাদা এসেছে কলকাতা থেকে। একদিন দাদাকে নিয়ে এসে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। সত্যি?

সত্যি। চলো না ভোরবেলা তোমাকে নিয়ে যাই কমলুর কাছে। ও-ই বলবে সত্যি কি না।

চন্দন হেসে বলল, আচ্ছা মালা, আমি যদি তোমার ওপর রাগ করতাম। তোমার সঙ্গে না যেতাম?

এঃ, তা তুমি পারতেই না। তোমার চোখ দেখেই আমি বুঝেছিলাম তুমি আমার সঙ্গে আলাপ করতে চাও। তা ছাড়া আমাকে এড়ানো বড় কঠিন। বুঝলে তো? শুধু তুমি কেন, আমার সুন্দর চেহারার জন্য সবাই আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।

চন্দন অবাক। নিজের চেহারা সুন্দর সেটাও কোনও মেয়ে নিজে থেকে বলে?

পাগলি নাকি? বলল, তোমার মতো মেয়ে সত্যিই হয় না মালা। কিন্তু তুমি অত ভোরে অন্ধকার থাকতে যাও কেন? সকালে দিনের আলোয় যেতে পার না?

না। অত ভোরে কেন যাই জানো? ওখানে ভোরে মঙ্গলারতির সময় আমি আর কমলু ঘণ্টা বাজাই। আবার সন্ধেবেলাও যখন আরতি হয়, তখনও ঘণ্টা বাজাই আমরা। ওখানকার পাণ্ডাঠাকুর কমলুর বাবা হন। আমাকে মেয়ের মতো ভালবাসেন। আর কমলু? সে আমার বান্ধবী হলেও ঠিক যেন মা’র পেটের বোন।

ওরা বাগানে নির্জনে ঘাসের ওপর বসে যখন সেই অপূর্ব জোছনালোকে কথাবার্তা বলছিল, তখন হঠাৎই চন্দনের নজর পড়ল দুটো কালো ছায়া যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।

মালা অন্যমনস্ক ছিল। তাই সে ঠিক বুঝতে পারেনি। কিন্তু চন্দন বুঝল পিছন দিক থেকে কেউ যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। মালা বলল, কী হল চুপ করে গেলে কেন চন্দনদা?

চন্দন চোখের ইশারায় সেই ছায়াদুটির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওই দেখো। মালা দেখল।

চাঁদ পিছনের দিকে বলেই লোকদুটির ছায়া এত বড় আকারে পড়েছে। ওরা নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে থাবা বাড়িয়ে এই দুই কিশোরকিশোরীকে গ্রাস করবার জন্য। হঠাৎ মালা চেঁচিয়ে উঠল, চন্দনদা।

চন্দন দেখল একটি ছায়ামূর্তি মালার ওর ঝাঁপিয়ে পড়ে মালাকে তুলে নিয়েছে। আর একটি যেই-না ওর দিকে এগোতে যাবে ও অমনি ওর হাতে রাখা সেই লোহার রড দিয়ে সজোরে মারল লোকটার পায়ে।

লোকটা মুখ থুবড়ে যন্ত্রণায় ককিয়ে পড়ে গেল ঘাসের ওপর। আর একজন যে মালাকে শূন্যে তুলে নিয়েছিল, এক সময় সেও বিকট একটা চিৎকার করে উঠল। মালা দু’হাতের নখ দিয়ে তার চোখদুটো কানা করে দিয়েছে একেবারে।

চন্দন তখন বেপরোয়া। দুটো লোককেই ধরে তখন সে কী দারুণ ডান্ডাপেটা। রামে রাম, রামে দুই, রামে তিন, রামে চার। কী মার! কী মার। মারের চোটে ভুবন অন্ধকার করে দিল তখন। কিন্তু ওরা ভেবে পেল না নিশিরাতের এই আগন্তুকরা ওদের দু’জনকে অপহরণ বা আক্রমণ করতে এল কেন?

ইতিমধ্যে ওদের চেঁচামেচিতে সবাই ছুটে এসেছে। সুনন্দবাবু, নিরুপমবাবু, ভাস্করমামা, বনমালী সবাই। তারপর এসে দেখেন এই রক্তারক্তি কাণ্ড! সবাই জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী?

মালা আর চন্দন সব কথা খুলে বলল।

নিরুপমবাবু বললেন, কিন্তু তোমরা যে একেবারে শেষ করে ফেলেছ লোকদুটোকে। এখন থানা-পুলিশ করতে গেলে ব্যাপারটা অন্যদিকে গড়িয়ে যাবে। একেবারে হাফ মার্ডার।

মালা বলল, তা বললে হয়? পুলিশে খবর তো দিতেই হবে। আমাদের বাড়ির মূর্তি চুরি এবং ডাকাতির ব্যাপারে এরা নিশ্চয়ই ছিল। না হলে আমাদের আক্রমণ করল কেন? পুলিশের রুলের গুঁতো খেলে বাপ বাপ করে বলতে পথ পাবে না।

সুনন্দবাবু লোকদুটোকে জেরা করলেন, কী নাম তোমাদের? লোকদুটি কোনও উত্তর দিল না!

তোমাদের যা জিজ্ঞেস করব যদি সঠিক বল তো পুলিশে দেব না। লোকদুটি নিরুত্তর।

মালা বলল, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। ধরে বেধড়ক মার দিতে পারলে ঠিক বলবে। বলেই লোহার রডটা নিয়ে একজনের পায়ের গাঁটে দড়াম করে মারতেই চিৎকার করে উঠল লোকটা।

মালা বলল, বল এবার, আমাদের নিয়ে পালাবার মতলব করেছিলি কেন? লোকটি বলল, নেহি। লে যানে কা মতলব নেহি থা।

তবে? কোন মতলব ছিল? তোদের সঙ্গে তো আরও লোকজন ছিল। তারা কোথায়?

ও লোক নিকাল গয়া।

তোরা এখানে কী করছিলি?

ভাঙ্ খানেকে লিয়ে আয়া থা।

ভাঙ্ খেতে এসেছিলি? এই কথাটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? আমাদের বাড়িতে তোরাই ডাকাতি করতে এসেছিলি। হাম লোক নেহি থে

ভাস্করমামা এতক্ষণে একজনের পেটে লাথি কষিয়ে বলল, তো কোন লোক ছিল বল! চোরে-চোরে তোরা সব মাসতুতো ভাই।

মালা বলল, তা হলে তোরা নিশ্চয়ই আমার সাইকেল চুরি করতে এসেছিলি? নেহি। হামলোক চোর নেহি।

তা হলে এত রাতে বাগানে কী করতে এসেছিলি বল? কেন আমাদের আক্রমণ করেছিলি?

এ কথার আর কোনও উত্তর নেই।

হঠাৎ বাগানের ভেতর থেকে দুম দাম বোমা ফাটার শব্দ শোনা যেতে লাগল। নিরুপমবাবু বললেন, আর এখানে থাকা ঠিক নয়। চলো পালাই। ওদের লোককে ওরা তুলে নিয়ে যাক।

ওরা সবাই তখন প্রায় ছুটে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। সুনন্দবাবু ও নিরুপমবাবু ছাদে উঠে লুকিয়ে দেখতে লাগলেন মালার সাইকেলে চেপে একজন লোক চলে গেল বাগানের বাইরে। জনা চারেক লোক আহত লোক দু’জনকে তুলে নিয়ে গেল! আর শেষজন করল কী সবাই চলে গেলে সদর দরজার ওপর একটি বোমা ছুড়ে ছুটে পালাল সেখানে থেকে।

প্রথমে ‘বুম’ করে একটা শব্দ। তারপর সব যেন ঝনঝনিয়ে কেঁপে উঠল একবার। সুনন্দবাবু ও নিরুপম নেমে এলেন ছাদ থেকে। রূপামাসি বলল, মৌচাকে ঢিল পড়েছে এবার। কী যে হবে ভগবান জানেন। তবে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে এখন থেকে।

নিরুপমবাবু বললেন, এবার তো দেখছি রাস্তায় ঘাটে বেরুনো দায় হয়ে উঠবে।

সুনন্দবাবু বললেন, কাজটা খুবই খারাপ করে ফেলল ছেলেমেয়ে দুটো। এখন যত রাগ না এদের ওপর পড়ে।

দেবযানী বললেন, আমার বাবা ভয় করছে। তুমি কালই সকালে চলে চলো, পালাই এখান থেকে। আর দরকার নেই দেওঘর বেড়িয়ে। খুব হয়েছে।

মালা আর চন্দন চুপ। কাজটা যদিও ভাল হয়নি, তবুও লোকদুটোকে ওইরকম ঘায়েল করতে না পারলে তো ওদের দু’জনকে চুরি করে নিয়েই পালাত ওরা।

ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটে উঠছে। পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে চারদিক।

গত রাত্রের ওই ঘটনার পর আর ভোরে বেরনো যায় না। তাই মালা ও চন্দন যে যার ঘরে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠল। সকালে জলযোগের পর মালা রূপামাসিকে বলল, চন্দনদাকে নিয়ে একটু মন্দির থেকে ঘুরে আসব কাকিমা?

নিরুপমবাবু বললেন, না। একদম ঘর থেকে বেরোবে না। আজ থেকে বেরিয়েছ কী মরেছ। তোমরা কী ভেবেছ ওরা ওই মারের বদলা নেবে না?

সুনন্দবাবু বললেন, কথাটা তুমি যা বলেছ তা ঠিক। তবে সে ভয় করলে তো এখুনি আমাদের সবাইকে এখানকার পাট তুলে দিতে হয়। তা যখন সম্ভব নয় তখন কী হবে অযথা ভয় পেয়ে?

চন্দন বলল, ঠিক! তুমি ঠিক কথাই বলেছ বাবা। ওরা আমাদের অপহরণ করবার ধান্দায় ছিল, তাই মোক্ষম দাওয়াই দিয়েছি ওদের। আবার এলে পেটাব। দেবযানী বললেন, ভারী তো বীরপুরুষ!

মালা বলল, বীরপুরুষই তো। ওই রকম নৃসিংহঅবতারের মতো চেহারা যে লোকদুটোর তাদের আমরা কী অবস্থা করে ছেড়েছি বলুন তো!

চন্দন বলল, আমি যাব মা, মালার সঙ্গে?

দেবযানী বললেন, চল তবে আমিও যাই।

রূপামাসি বললেন, সেই ভাল। তুইও যা দিদি। ছোড়দাকেও সঙ্গে নিয়ে যা। মালা বলল, কে ভাস্করমামা। উনি অনেক আগেই বেরিয়ে গেছেন। যাই হোক! দেবযানী মালা ও চন্দন মন্দির দেখতে চলল। বাড়ি থেকে বেরোতেই একটা সাইকেল রিকশা পেয়ে গেল ওরা। সেই রিকশায় চেপে একেবারে শিবগঙ্গার সামনে এসে নামল। তারপর পায়ে হেঁটে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল মন্দিরের দিকে।

আবার সেই পাণ্ডার উপদ্রব।

দু’-একজনকে শংকর পাণ্ডার নাম বলতেই সরে পড়ল তারা। কিন্তু শেষকালে এমন একজন এসে হাজির হল যাকে আর এড়ানো গেল না। বলল, আমি শংকর পাণ্ডারই লোক মা! শংকর এখন এখানে নেই। ‘ও গেছে বেগুসরাইতে গানবাজনা করতে। আপনাদের পূজাপাঠ আমিই করিয়ে দেব।

দেবযানী বললেন, কিন্তু বাবা আমি তো এখন স্নানটান কিছু করিনি। তাতে কী হয়েছে? এই শিবগঙ্গার জল মাথায় নিন। তা হলেই হবে। বলুন কত টাকার পুজো দেব?

দশটা টাকা আছে। এতেই যা হয় করে দাও।

পাণ্ডা তাতেই খুশি। বলল, এতেই হবে। যান শিবগঙ্গার জল মাথায় নিয়ে আসুন। তারপর চলুন আমার সঙ্গে।

দেবযানী তাই করলেন। মালা-চন্দনও জলস্পর্শ করল। তারপর চলল পাণ্ডার পিছু পিছু।

পাণ্ডাটি বয়সে প্রবীণ। এবং জানেও অনেক কিছু। যেতে যেতে বলল, মা, এই দেওঘরের বাবা বৈদ্যনাথ বড় যা তা দেবতা নন। বাবার অনুগ্রহে এই মহাতীর্থে কারও মৃত্যু হলে যদি সে মহাপাপীও হয়, তবু তাকে এই সংসারে আর ফিরে আসতে হয় না। এবং দুর্লভ মনুষ্যজন্ম পেয়েও যদি কেউ এই তীর্থে না আসে, তবে তার জন্মই বৃথা। মানুষের জীবনের সর্বপাপ তীর্থদর্শনে ক্ষয় হয়। তীর্থের পাপ নষ্ট হয় কাশীদর্শনে। কিন্তু কাশীতে বসে কোনও পাপ করলে সেই পাপ সদ্য বিনাশিত হয় বৈদ্যনাথদর্শন করলে।

দেবযানী বললেন, বলেন কী?

হ্যাঁ মা, এসব আমার কথা নয়। শাস্ত্রের কথা।

চন্দন বলল, আপনি খুব ভাল বাংলা বলতে পারেন তো?

কেন পরব না? এক সময় এ দেশ তো বাংলাতেই ছিল। তা ছাড়া আমি মিথিলার লোক। আর এখানে বাঙালি যাত্রীরও অভাব নেই। কাজেই ভাল বাংলা শিখে গেছি। তবে লিখতে বা পড়তে ভাল পারি না। আরও শুনুন, এখানকার জল গঙ্গাজলের মতো পবিত্র এবং মাটি কাঞ্চনের মতো মূল্যবান। আর এর মাহাত্ম্য শুনবেন? পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডে আছে—

ত্রেতাযুগে লঙ্কাপতি রাবণ একবার চিন্তা করেছিলেন স্বর্ণলঙ্কার পূর্ণ উন্নতি করতে হলে কৈলাসপতি মহাদেবের চির প্রসন্নতার একান্ত প্রয়োজন। এই ভেবে তিনি কৈলাস পর্বতে গমন করলেন। কৈলাসে হরপার্বতীর মধ্যে তখন কী নিয়ে যেন মনোমালিন্য হয়েছিল। পার্বতী তাই অভিমান করে বসেছিলেন। এমন সময় রাবণ কৈলাসে উপস্থিত হলে দ্বারদেশে দণ্ডায়মান নন্দী বাধা দিল রাবণকে। এবং ভেতরে যেতে নিষেধ করল। কিন্তু লঙ্কাধিপতি কখনও কারও নিষেধ শোনেন না। তাই ক্রোধে কম্পিত হয়ে নন্দীকে আক্রমণ করলেন তিনি। এবং ছুড়ে ফেলে দিলেন নন্দন কাননে। রাবণের ভয়ে কৈলাস তখন কেঁপে উঠল। আর কৈলাশ কেঁপে ওঠায় পার্বতীও ভয়ে অভিমান ভুলে মহাদেবের পায়ের কাছে সরে এলেন। মহাদেব তাড়াতাড়ি এক হাতে পার্বতীকে ধরে, অপর হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে কৈলাসকে টিপে ধরে তার কাপুনি থামালেন। এবং নন্দীকে আহ্বান করলেন। ততক্ষণে রাবণ শিবসমীপে উপস্থিত হয়েছেন। নন্দীও এসে দাঁড়াল একটু পরে। রাবণ বললেন, হে, দেবাদিদেব! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি জগৎপিতা। আপনার কাছে প্রয়োজনে আমি যখন খুশি আসব। সেখানে নন্দী আমাকে বাধা দেবার কে? তাই রাগে আমি নন্দীকে নন্দন কাননে নিক্ষেপ করেছি। এই বলে রাবণ মহাদেবের স্তবস্তুতি করতে লাগলেন। অল্প স্তবেই সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব বললেন, তোমার স্মৃতিতে আমি প্রসন্ন হয়েছি রাবণ। কী বর চাও তুমি বল? রাবণ বললেন, আমি আপনাকে চাই প্রভু! আমি চাই আপনি চিরকাল আমার স্বর্ণলঙ্কায় বিরাজ করুন। মহাদেব বললেন, তা তো হতে পারে না রাবণ। তবে আমি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের রূপে দ্বাদশ ক্ষেত্রে বিরাজ করতে চাই। এই বলে একটি জ্যোতির্লিঙ্গ রাবণের হাতে দিয়ে বললেন, এটি তুমি নিয়ে যাও। কিন্তু সাবধান। পথে কোথাও যেন এই লিঙ্গকে তুমি নামাবে না। যদি নামাও তবে এই লিঙ্গ কিন্তু সেখানেই বরাবরের জন্য রয়ে যাবে। আর তাকে নড়াতে পারবে না। রাবণ তাতেই সম্মত হয়ে জ্যোতির্লিঙ্গ উত্তোলন করতে গেলেন। তাই দেখে পার্বতী বললেন, হে রাবণ! আপনি একজন নিষ্টাবান ব্রাহ্মণ, আপনি আচমন না করে প্রভুর লিঙ্গ উত্তোলন করতে যাচ্ছেন কীরকম? পার্বতীর কথায় লজ্জিত হয়ে রাবণ বললেন, অপরাধ ক্ষমা করুন দেবী। আমাকে আচমনের জন্য জল দিন। পার্বতী তখন ছল করে রাবণকে মেঘমিশ্রিত জল দিলেন। রাবণ বুঝতে না পেয়ে সেই জলেই আচমন করে জ্যোতির্লিঙ্গ কাঁধে নিয়ে রওনা হলেন লঙ্কার পথে। দেবযানী বললেন, এগুলো মনে রাখ চন্দন। শুধু তীর্থস্থানে এলেই হয় না। সব কিছু জানতে শিখতে হয়। পুরাণের অনেক কিছুই অবাস্তব হলেও পুরাণ মিথ্যে না বুঝলি ?

মালা বলল, আমি অবশ্য এই কাহিনিটা কিছু কিছু শুনেছিলাম তবে এত ভাল করে নয়।

কাহিনি আবার শুরু হল এদিকে প্রবল পরাক্রান্ত রাক্ষসরাজ রাবণ জ্যোতির্লিঙ্গ নিয়ে যাচ্ছেন দেখে দেবগণ প্রমাদ গণলেন। তাঁরা সকলে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বিষ্ণুর চরণ। তাঁদের সঙ্গে পার্বতীও ছিলেন। বললেন, সর্বনাশ হয়েছে প্রভু। রাবণ শিবকে সন্তুষ্ট করে জোতির্লিঙ্গ নিয়ে লঙ্কায় যাচ্ছে। শিবশক্তি লঙ্কায় অধিষ্ঠিত হলে লঙ্কাপুরী কখনওই ধ্বংস হবে না এবং রাবণ অপরাজেয় থেকে যাবে। আপনি এক্ষুনি এর একটা বিহিত করুন। বিষ্ণু বললেন, কী বিহিত করব? পার্বতী বললেন, যে করেই হোক রাবণের কাঁধ থেকে জোতির্লিঙ্গ নামাতে হবে। বিষ্ণু বললেন, হ্যাঁ। এ ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখছি না। বলেই বরুণকে ঢেকে বললেন, তুমি রাবণের উদরে প্রবেশ করতে পারবে? বরুণ বললেন, পার্বতী রাবণকে মেঘমিশ্রিত জল পান করিয়েছেন। আমি তখন থেকেই ওর পেটের ভেতর ঢুকে বসে আছি প্রভু। বিষ্ণু বললেন, ভালই করেছ। রাবণ এখন হার্দপীঠ (দেওঘর) অতিক্রম করছে। ওই পবিত্র ভূমিই জ্যোতির্লিঙ্গ নামাবার উপযুক্ত স্থান। তুমি এক্ষুনি রাবণের পেটের ভেতর তোলপাড় শুরু করে দাও। তারপর আমি দেখছি। এই বলে বিষ্ণু এক ব্রাহ্মণের রূপ ধরে হার্দপীঠে উপস্থিত হলেন এবং রাবণের কাছে গিয়ে তাঁর কাঁধের জ্যোতির্লিঙ্গটির বিষয়ে নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলেন। এদিকে বরুণও তাঁর খেলা শুরু করে দিয়েছেন তখন। বরুণের প্রচণ্ড প্রভাবে রাবণের প্রবল প্রস্রাবের বেগ এল। তিনি ব্রাহ্মণবেশী বিষ্ণুকে বললেন, যদি কিছু মনে না করেন তা হলে আমার এই জ্যোতির্লিঙ্গটি আপনি কি একদণ্ড একটু ধরবেন? আমি তা হলে একটু প্রস্রাব করে আসি। ব্রাহ্মণ বললেন, নিশ্চয়ই ধরব। দেবাদিদেব মহাদেবকে কাঁধে নেব এ তো আমার পরম সৌভাগ্যে। তবে এ অতি পবিত্র ভূমি। আপনি এখানে প্রস্রাব না করে একটু দূরে গিয়ে করবেন কিন্তু। রাবণ বললেন, ঠিক আছে। তবে আপনি কিন্তু ভুলেও যেন এটি মাটিতে নামাবেন না। তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই বলে রাবণ সেখান থেকে এক ক্রোশ দূরে গিয়ে প্রস্রাব করতে লাগলেন। বরুণের প্রবল প্রভাবে সেই প্রস্রাব কিছুতেই আর বন্ধ হয় না। প্রস্রাব তখন নদী হয়ে ছুটতে লাগল। এই নদীই বর্তমানে কর্মনাশা। এর জলে কোনও পবিত্র কর্ম হয় না। এদিকে রাবণ সরে যেতেই ব্রাহ্মণবেশী বিষ্ণু করলেন কী, সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির্লিঙ্গটি নামিয়ে সেই খানেই মন্ত্রপূত করে স্থাপন করলেন। বিষ্ণু প্রতিষ্ঠা করা মাত্রই সেই জ্যোতির্লিঙ্গ মাত্র আট আঙ্গুল প্রমাণ বাইরে থেকে সপ্তপাতাল ভেদ করল। এই পর্যন্ত শুনেই দেবযানী দু’হাত জোড় করে বৈদ্যনাথের উদ্দেশে প্রণাম করলেন।

আবার শুরু হল কাহিনি

এদিকে প্রস্রাবের বেগ তিরোহিত হলে রাবণ ফিরে এসে যখন দেখলেন ব্রাহ্মণ নেই, তখন ভয়ে বুক কেঁপে উঠল তাঁর। দেখলেন জ্যোতির্লিঙ্গ সেইখানে স্থাপিত হয়েছে। এবং ব্রাহ্মণের বদলে একজন ভিল দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। রাবণ গায়ের জোরে তখন সেই জ্যোতির্লিঙ্গটিকে উৎপাটন করতে গেলেন। এমন সময় দৈববাণী হল, যে এই শিবলিঙ্গকে উৎখাত করবে তার বংশ ক্ষয় হবে। দৈববাণী শুনে রাবণ ক্রোধে আত্মহারা হয়ে জ্যোতির্লিঙ্গের মাথায় এমন মুষ্ঠাঘাত করলেন যে মাথার খানিকটা ভেঙেই গেল। বর্তমানে বৈদ্যনাথের ভাঙা মূর্তিই দেখা যায়। যাই হোক, রাবণ সেই ভিলকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করে কী হল? ভিল সবই দেখেছিল। তাই বলল, এই জ্যোতির্লিঙ্গ স্বয়ং বিষ্ণু স্থাপন করেছেন। এর পুজো করলে সর্বকাম সিদ্ধ হবে। রাবণ তাই শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে ধুলায় গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। তারপর ক্ষোভে নিজের দশমুণ্ড কেটে ফেলতে উদ্যত হলে রাবণকে দেখা দিয়ে শিব বললেন, হে রাবণ! আমি তো আর এখান থেকে উঠব না। তবে তুমি অকারণে কেন বিলাপ করছ? তুমি এখানেই আমার যথাযোগ্য পূজা করো। এবং হরিদ্বার থেকে গঙ্গাজল এনে আমাকে স্নান করাও। রাবণ তাই করলেন এবং সেইখানেই তিরনিক্ষেপ করে একটি কূপ খনন করে তাইতে সর্বতীর্থের জল এনে রাখলেন। এই কূপের নাম চন্দ্ৰকৃপ। ওই দেখুন, ওই সেই চন্দ্ৰকৃপ।

কথা বলতে বলতে কখন যে ওরা মন্দিরের দরজার কাছে এসে পড়েছে তা কারও খেয়াল ছিল না। সেখানে জুতো জমা দিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকে চন্দ্রকূপের জল নিয়ে পূজার প্রস্তুতি করতে লাগল। শংকর পাণ্ডার লোক একটি দোকান থেকে ফুলমালার ডালা নিয়ে এল। তারপর চলল মূল মন্দিরে বিগ্রহ দর্শন করতে।

ওঃ সে কী প্রচণ্ড ভিড়। দেবযানী, মালা ও চন্দনের হাত শক্ত করে ধরে নিয়ে চললেন। বহু কষ্টে দর্শন হল। পূজাও হল কষ্ট করেই।

দেবযানী ওই দশটাকা ছাড়াও লোকটির হাতে দক্ষিণাস্বরূপ আরও পাঁচটি টাকা দিতে সে তো আরও খুশি। বলল, আপনার মতো মানুষ হয় না মা। তবে আমি এতক্ষণ যা বললাম তা আপনার শুনতে ভাল লাগল কী না জানি না। তবু আমার কর্তব্য বলা তাই বললাম।

দেবযানী বললেন, আমার খুব ভাল লেগেছে বাবা। আপনি না বললে এসব মহিমা জানতামই না।

লোকটি বলল, ধৈর্য ধরে তা হলে আর একটু শুনুন। পুরাকালে এই পবিত্র ক্ষেত্রের কাছে একটি হ্রদের ধারে কতকগুলি ব্রাহ্মণ বাস করতেন। আর এখানকার জঙ্গলে বাস করত ভিলেরা। ব্রাহ্মণেরা চাষ-আবাদ করতেন এবং ভিলেরা গোরু-মোষ চরাত ও শিকার করত। ব্রাহ্মণরা চাষ-আবাদ ছাড়াও রাবণেশ্বর (বৈদ্যনাথ) শিবের পূজা করতেন। আর ভিলরা পূজা করত তিনটি পাথরকে। কালক্রমে ব্রাহ্মণরা অলস হয়ে পড়লেন। তাঁরা মিথ্যাবাদী ও ব্যাভিচারী হলেন। সেই সময় ভিলদের দলপতি বিজু নামে এক যুবক, ব্রাহ্মণদের এই অনাচারে দারুণ কুপিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করল যে, প্রতিদিন সে ব্রাহ্মণদের উপাস্য দেবতা রাবণেশ্বরের মাথায় লাঠির ঘা না-মেরে জলগ্রহণ করবে না। মালা বলল, বলেন কী। ভারী সাংঘাতিক তো?

হ্যাঁ। প্রতিজ্ঞা করার পর সে তাই করত। একদিন সে কোনও কারণে ভুলে খেতে বসে গিয়েছিল। কিন্তু যেই তার সেই কথা মনে পড়ে গেল অমনি সে খাওয়া ফেলে রেখে ছুটল লাঠি নিয়ে। যখন সে ছুটতে ছুটতে হ্রদের কাছে এসে পৌঁছেচে, তখন হ্রদের ভেতর থেকে হঠাৎ এক দিব্যপুরুষ আবির্ভূত হয়ে কতকটা স্বগতোক্তির মতই বললেন, কী আশ্চর্য! একজন আমাকে মনে রেখেছে বলে ক্ষুধাতৃষ্ণা ফেলেও আমাকে মারতে আসছে আর আমার পূজারি ব্রাহ্মণরা আমাকে ভুলে গিয়ে এমন ব্যাভিচারী হয়েছে যে, দিনান্তে একটি ফুল-বেলপাতাও আমাকে দেয় না। বিজু সেই কথা শুনতে পেয়েই সেই দিব্যপুরুষকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কে তুমি? দিব্যপুরুষ বললেন, আমি সেই, যাকে তুমি লাঠি দিয়ে মারতে যাচ্ছ। বিজু তৎক্ষণাৎ লাঠি ফেলে দিয়ে সেই দিব্যপুরুষকে প্রণাম করে বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু। আমি ব্রাহ্মণদের প্রতি ক্রোধবশত এই কাজ করছিলাম। না হলে আপনার প্রতি আমার কোনও ক্ষোভ নেই। দিব্যপুরুষ বললেন, ওরা আমার পূজারি হলেও তুমিই আমার প্রধান ভক্ত। আমি তোমাকে বর দিতে চাই। কী বর চাও তুমি বলো? বিজু বলল, আমি অন্য কিছুই চাই না প্রভু, শুধু আমার নামে আপনার নাম হোক এই আমি চাই। আমার নাম বিজু। আর আপনি জগতের নাথ। দুয়ে মিলে আপনার নাম হোক বিজুনাথ। দিব্যপুরুষ তথাস্তু বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সেই থেকে রাবণেশ্বর বিজুনাথ নামে খ্যাত হলেন। তারপর বিজুনাথ থেকে হল বৈজুনাথ। এবং বৈজুনাথ থেকে বৈদ্যনাথ। গল্প শুনে দেবযানী অভিভূত হয়ে পড়লেন।

মালা আর চন্দনও খুশিতে ভরে উঠল। বৈদ্যনাথের এত মাহাত্ম্য তা কে জানত!

মন্দিরের পরিবেশ অতি মনোরম। চারদিকে মন্দির। এইসব ঘুরে দেখতে দেখতে একসময় মালা প্রশ্ন করল, আচ্ছা এই মন্দির কে তৈরি করেছিলেন?

পাণ্ডা ঠাকুর বলল, আগে তো শ্রীবিষ্ণু বিশ্বকর্মাকে দিয়ে এটি তৈরি করিয়েছিলেন। তারপর কালক্রমে সেটি ধ্বংস হয়। তবে প্রাচীন মন্দিরের শিলালিপি দেখে জানা যায় যে ১৫৯৬ সালে পূরণমল্ল এটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। উচ্চতা ৭২ ফুট।

চন্দন বলল, পূরণমল্ল কে?

পূরণমল্ল ছিলেন গিরিধিরাজ (গিরিডিহি) বীর বিক্রম সিংহের ৯ম বংশধর। বিক্রম সিংহ ১১৬৭ খ্রিস্টাব্দে গিরিডি রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। পূরণের পঞ্চম বংশধর ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাজাহানের কাছে থেকে রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন।

এরপর অনেকক্ষণ ধরে মন্দিরএলাকা ঘুরে ফিরে ওরা আবার বাইরে এল। বাইরে কত রকমের দোকানপাট। সবকিছু দেখতে দেখতে ওরা এগিয়ে চলল ঘরির মোড়ের দিকে।

দেবযানী একটা দোকান থেকে লোহালক্কড়ের প্রয়োজনীয় অনেক কিছু জিনিসপত্তর কিনলেন।

চন্দন বলল, মা, তোমাকে একটা রিকশায় উঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি তাইতে চেপে সোজা বাড়ি চলে যাও। মালা আর আমি চারদিকে একটু ঘুরেবেড়িয়ে তারপর যাব। কেমন?

দেবযানী বললেন, বেশ তাই হোক। তোরা দু’জনে ঘুরে বেড়া। তবে খুব বেশি দেরি করিস না যেন। আমি তা হলে ভাবব।

মালা-চন্দন দু’জনেই বলল, আচ্ছা।

এরপর একটা রিকশা ডেকে দেবযানীকে বিদায় দিল ওরা।

মালা বলল, চন্দনদা, এখন আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে একবার থানায় যাওয়া। থানায়! কেন?

কাল রাতের ঘটনাটা আমার মতে একবার পুলিশকে জানানো উচিত।

তুমি যা ভাল বোঝ তাই করো। কিন্তু এ জন্য পুলিশ আবার আমাদের কিছু বলবে না তো? কারণ আমরাই তো প্রায় হাফ মার্ডার করে বসে আছি।

যা বলে বলবে। তবু চলো যাই।

ওরা আবার একটি রিকশা চেপে থানায় এসে হাজির হল। মালা এখানকার মেয়ে। কাজেই সব কিছুই ও চেনে। থানার দারোগাবাবুও চেনেন ওকে। তাই ওরা যেতেই হেসে বললেন, কী খবর মালাজি।

মালা বলল, আপনার কাছে আমরা অভিযোগ জানাতে এসেছি একটা ব্যাপারে!

কী ব্যাপার বলো?

আপনি তো জানেন আমাদের বাড়ির বিগ্রহ চুরির ব্যাপারটা। এবার আমার সাইকেল চুরি গেছে।

সে কী ! কখন?

মালা তখন সব কথা সবিস্তারে খুলে বলল। এমনকী ওই লোকদুটোকে বেদম পেটানোর কথা পর্যন্তও।

দারোগাবাবু বললেন, ব্যস। ও আসামি পাকড় যায়ে গা। আমি সব হসপিটালে খবর নিচ্ছি আর ডাক্তারদেরকেও ফোনে জানাচ্ছি। তুম দোনোনে আচ্ছা কাম কিয়া। আভি ঘর চলা যাও। বাহার মাত ঘুমো। যাও। বলেই টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল ঘোরাতে লাগলেন।