কাকাহিগড় অভিযান – ২

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আরে সত্যিই তো। এই তো। এই তো চলেছে ধীরে শ্লথ গতিতে। একটু একটু করে আলো ঝলমল জনমানবহীন স্টেশনের প্লাটফর্মের সামান্য পেরিয়ে ট্রেন এখন লিলুয়ামুখো। এ ট্রেন অবশ্য লিলুয়ায় থামবে না। একেবারে বর্ধমানে।

চন্দনরা বাড়িতে অল্প স্বল্প খেয়ে এসেছিল। এখানে আর একটু জলযোগ সেরে নিল। বড় বড় লাড্ডু আর ক্ষীরকদম টপা টপ গালে ফেলে ঢক ঢক করে জল খেয়ে নিল সবাই।

ভাস্করমামা লাড্ডু খেতে খেতে বলল, ট্রেনজার্নিতে সব চেয়ে আমোদের ব্যাপার হল এই খাওয়াটা। আর খেতে গেলেই মনে পড়ে যায় শ্রীমন্তদার মেয়ে সোমার কথা। কী দারুণ মিষ্টিখোর ওইটুকু মেয়ে। মুখে বলবে একদম মিষ্টি খাব না। মিষ্টি খেলে গা গুলোয়। আর মিষ্টি একবার হাতে পেলে রক্ষে নেই। সঙ্গে সঙ্গে গপা গপ। তার ওপর পুরী কিংবা বেনারস বেড়াতে গেলে তো কথাই নেই। ট্রেনে উঠেও মিষ্টি। সেখানে গিয়েও মিষ্টি।

ট্রেন তখন হুড় হুড় করে ছুটেছে। পাশের সিটে পা গুটিয়ে বসে এক বুড়ো আপন মনেই বলল, লেলুয়া গেল।

চন্দন ফিক করে হেসে ভাস্করমামার দিকে তাকাল, লেলুয়া আবার কী গো মামা। লিলুয়া তো।

ভাস্করমামা বলল, চুপ। শুনতে পেলে রেগে যাবে।

ট্রেন ছুটছে তো ছুটছেই। দারুণ স্পিডে ছুটছে। ট্রেনের যাত্রীরা বার্থের ওপর শয্যা পেতে শুয়ে পড়ল সব।

ভাস্করমামা বলল, নে শুয়ে পড়। ভোরবেলা নামতে হবে। চন্দনও শুয়ে পড়ল।

ওর মাথার কাছে ঝোলাব্যাগে সেই ছোরা নাইলন দড়ি সব রেডি। কেন না ও জানে আজকাল ট্রেনজার্নিতে মানুষের নিরাপত্তা নেই, যে কোনও মুহূর্তে চোর-ডাকাতের আবির্ভাব হতে পারে। ও শুয়ে শুয়ে পিট পিট করে দেখতে লাগল সেরকম কেউ ওঠে কি না। উঠলেই দড়িটাকে ল্যাসোর মতো করে চোরের গলায় আটকে মারবে অ্যায়শা টান যে ঘুঘুমশাই ফাঁদে আটকে ছটফটাং। কিন্তু না। অনেকক্ষণ জেগে থেকেও সে রকম কারও অস্তিত্ব টের পেল না ও। অবশেষে ট্রেনের দুলুনিতে দু’চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল ওর, ঘুম আর ঘুম।

ঘুম ভাঙল ভাস্করমামার ডাকে, এই ওঠ ওঠ। জসিডি এসে গেছে। এই চন্দন।

চন্দন ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।

কীরে। কখন থেকে ডাকছি। উঠবি তো।

চন্দন বলল, যাঃ। এই তো ডাকলে তুমি।

তোকে দু’-তিনবার ডেকেছি। খুব ঘুমিয়েছিস তুই। বাবা-মা সবাই তখন উঠে দাঁড়িয়ে মালপত্তর হাতে নিয়েছেন।

চন্দনও ভাস্করমামার পিছু পিছু ট্রেন থেকে নেমে পড়ল।

শেষ শরতের রাত্রিশেষের এই জসিডিতে এখন রীতিমতো ঠান্ডার ভাব। আর কী সুন্দর মুক্ত বাতাস। চন্দন বুকভরে নিশ্বাস নিল। ওরা ট্রেন থেকে নামার একটু পরেই ছেড়ে দিল ট্রেন। খুব অল্প সময় স্টপেজ। চলে যাওয়া ট্রেনের লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে চন্দন আপন মনেই একবার টা-টা করল।

টিকিটটা ওদের বৈদ্যনাথধাম পর্যন্তই ছিল। তাই ওভার ব্রিজ পেরিয়ে ওপাশের প্ল্যাটফর্মে ওরা গেল ওরা। বৈদ্যনাথধামের ট্রেনও তখন দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। সে কী অপূর্ব পরিবেশ।

এরই মধ্যে কম্বল সোয়েটার সব বেরিয়ে পড়েছে এখানে। কিছু বাঙালি যাত্রী থাকলেও বেশির ভাগ যাত্রীই হিন্দুস্থানি। কিছু প্লাটফর্মে কিছু ট্রেনের কামরায় উঠে বসে আছে। কেউ কেউ ট্রেনের কামরায় বাঙ্কে উঠে শুয়ে আছে। চন্দনরাও একটা পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন বগি দেখে উঠে বসল। এখন শেষরাতের ট্রেনে যাত্রী খুব বেশি নেই। কাজেই বেশ আরাম করে গুছিয়ে বসা গেল।

সুনন্দবাবু বললেন, বাবাঃ। বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে তো এখানে? চন্দন আর ভাস্করমামা প্লাটফর্মে হয়েছিল। ওদেরও শীত করছিল। তবে গায়ে মাখছিল না।

দেবযানী বললেন, এই তোমরা উঠে এসো ভেতরে। না হলে ঠান্ডা লাগবে।

চন্দন বলল, না। আমি এখুনি ভেতরে ঢুকব না। আমার একটুও শীত করছে না। তা ছাড়া ট্রেন ছাড়তেও দেরি আছে। এই অন্ধকারে কী চুপচাপ ভূতের মতো বসে থাকা যায়?

সত্যিই বগিতে আলো ছিল না। ছিল না মানে, জ্বলছিল না। সব বগিই অন্ধকার। ইঞ্জিন না লাগা পর্যন্ত জ্বলবে না।

ভাস্করমামা বলল, এখনও পঁয়তাল্লিশ মিনিট চুপচাপ বসতে হবে।

সুনন্দবাবু বললেন, ততক্ষণে একটু করে চা খেয়ে নিতে পারলে হত। একটা ভাল দেখে চা-ওয়ালা ডাকো তো দেখি?

ভাস্করমামা বলল, না না। এখানে চাওয়ালাকে ডেকে চা খাবার দরকার নেই, রেলের স্টলে যে চা তৈরি হয়, তা খুব ভাল। ওই চা-ই নিয়ে আসছি আমি। বলে স্টলে গিয়ে চার কাপ চায়ের অর্ডার দিল ভাস্করমামা।

সুনন্দবাবু নিজেও ট্রেন থেকে নেমে এলেন এবার। তারপর ওদের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

স্টলওয়ালা চা দিলে, এক কাপ চা জানালা গলিয়ে দেবযানীর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে প্লাটফর্মে দাড়িয়েই চা খেতে লাগলেন।

ভাস্করমামা আর চন্দনও চায়ের পেয়ালা নিয়ে পায়চারি করতে করতে চায়ে * চুমুক দিতে লাগল। ভাস্করমামা চা খেতে খেতেই বলল, জানিস চন্দন, যে বাঙালি এই শেষরাতে জসিডি স্টেশনে চা খেতে খেতে একটু পায়চারি না করল তার জীবনই বৃথা।

চন্দন বলল, সত্যি মামা, চা যে কতখানি এনার্জিদায়ক, তা আজই প্রথম অনুভব করলাম। সত্যি, কী ভাল যে লাগছে।

চা খাওয়া শেষ হলে কাপ জমা দিয়ে ভাস্করমামা বলল, চল, একটু ওদিক করে এগিয়ে চল। একটা জিনিস দেখাব তোকে।

ওরা পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল। মস্ত প্লাটফর্ম। তাই ধরে বেশ খানিকটা এগোবার পর এক জায়গায় ওরা অনেক পাখির কলরব শুনতে পেল। আকাশ তখনও অন্ধকার। তবে সামান্য ফিকে হয়ে আসছে। কিন্তু তারায় তারায় ভরে আছে আকাশ।

ভাস্করমামা ডানদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই যে দূরের দিকে অন্ধকারে সব ঢাকা রয়েছে দেখছিস, ওই দিকে হল ত্রিকূট পাহাড়। আর এ পাশেও আছে অনেক পাহাড়ের সারি। এগুলোর নাম জানি না। আমাদের এই ট্রেনটা নন্দন পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাবে।

‘নন্দন পাহাড়’ নামটা খুব মিষ্টি, না? ওই পাহাড়ে ওঠা যায়?

ভাস্করমামা বলল, কেন যাবে না? আসলে ওটা একটা ঢিবি। আমার মতে ওটাকে কখনওই পাহাড় বলা উচিত নয়। টিলা অবশ্য বলা যেতে পারে। হঠাৎ পি-ই-প করে একটা ইঞ্জিন ভকস ভক ভকস ভক করতে করতে পাশ দিয়ে চলে গেল।

, ভাস্করমামা বলল, চল, আর ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। এই ইঞ্জিনটাই আমাদের গাড়ির সঙ্গে লাগবে। সময়ও বেশি নেই।

ওরা ধীরে ধীরে ওদের বগিটার দিকে এগিয়ে চলল।

এমন সময় যমদূতের মতো একটা লোক এগিয়ে এল ওদের দিকে। লোকটা ভাস্করমামার দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় যাবেন বাবুরা, দেওঘর? হ্যাঁ।

উঠবেন কোথায়?

বিলাসী টাউন।

কে পাত্তা আছে?

শংকর।

শংকর। কোন শংকর?

বিলাসী শংকর। তবলা বাজায়। কেরামৎ খাঁ সাহেবের ছাত্র। অ। তা ওখানেই উঠবেন, না অন্য কারও বাড়ি যাবেন? আমরা যাব একেবারে শেষমাথায়। নিরুপম বসুর বাড়ি। অ। সমঝ গিয়া। তো তুম চারুভিলা যাওগে? হ্যা। চারুভিলাতেই যাব।

কুছ দিন পহলে বহুত বঢ়িয়া ডাকাইতি হো গিয়া হুঁয়া পর। তুমি তো সবই জান দেখছি। তা ওই চুরি যাওয়া মূর্তিটার কোনও হদিস পাওয়া গেছে?

লোকটি আর সে কথার কোনও উত্তর না দিয়েই চলে গেল।

ভাস্করমামা আর চন্দনও এল ওদের বগিটার কাছে।

একটু পরেই, ইঞ্জিন জোড়া লাগল ট্রেনে। সব কম্পার্টমেন্টে আলো জ্বলে উঠল। যথাসময়ে ছাড়ল ট্রেন। শেষরাতের আবছা আঁধারে সে এক অপূর্ব অভিযান।

বৈদ্যনাথধাম স্টেশনে ট্রেন যখন থামল, আকাশের ঘোর তখনও কাটেনি, জসিডি থেকে বৈদ্যনাথধাম মাত্র একটিই স্টেশন। এর মাঝে আর কোনও স্টেশন নেই। ওরা সকলে স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মের বেঞ্চিতে বসে রইল।

কয়েকজন পাণ্ডাও ওদের তীর্থযাত্রী ভেবে শুরু করল নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু শংকর পাণ্ডার নাম শুনে বেশি বিরক্ত না করে সরে পড়ল যে যার।

এখানকার পাণ্ডাদের ভেতর এই একটা ভাল নিয়ম রয়েছে, যে এরা যেমন নতুন যাত্রীদের নিজের করে পাবার জন্য ঝুলোঝুলি করে, তেমনি অপর কোনও পাণ্ডার যাত্রী পরিচয় পেলে আর তাকে জ্বালাতন করে না।

ভাস্করমামা বলল, শংকর আমাদের বহু দিনের পুরনো পাণ্ডা। আসলে ওর বাবাই পাণ্ডা ছিল আমাদের। এখন বাবা তো নেই। শংকর আছে। তবে শংকর এইসব যাত্রীধরা ব্যবসা করে না। কেন না ও এখন এই অঞ্চলের এক বিখ্যাত তবলিয়া। ওর ছেলেরাই এ সব কাজ করে।

দেবযানী বললেন, আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগে এই সব ব্যাপারগুলো, তীর্থস্থানে আসব, ঠাকুর দর্শন করব, আমার যা মন চায় তাই দিয়ে পুজো দেব এই তো জানি। পাণ্ডার খপ্পরে পড়ব কেন?

ভাস্করমামা বলল, তুই বুঝিস না দিদি। আসলে যে কোনও তীর্থে পাণ্ডারা যেমনই বিরক্তিকর, তেমনি আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে এদের যে কোনও একজনকে মেনে নেওয়া তেমনি বুদ্ধিমানের কাজ। বাইরে গেলে দু’দশ টাকা খরচা করতেই হয়। কাজেই এদের মারফত ঠাকুরের পূজা-পাঠ করলে এরাও ঠান্ডা হয়, অন্যেও বিরক্ত করে না। এক সময় অবশ্য ছিল যখন ওদের উপদ্রবে মানুষের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হত। এখন আর সেদিন নেই।

ওরা যখন বসে বসে নিজেদের ভেতর এইসব আলোচনা করছে, তেমন সময় একজন টাঙ্গাওয়ালা এসে বলল, টাঙ্গা লাগবে নাকি বাবুসাব?

সুনন্দবাবু বললেন, হ্যাঁ লাগবে।

আকাশ তখন ফর্সা হয়ে গেছে। চারদিকের গাছপালা, ঘরবাড়ি বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যদিও সকাল নয়, ভোর। তবুও এখন যাওয়া যেতে পারে। রাস্তায় লোকজনও চলাচল করছে।

কাঁহা যায়েঙ্গে?

বিলাসী টাউন।

বিলাসী টাউন? কাহা পর।

একেবারে শেষমাথায়। চারুভিলা জানো তো?

হাঁ হাঁ। ঠাকুরবাড়ি।

ওইখানে যাব। চলিয়ে।

ভাড়া কত নেবে?

ও লোক যিতনা বোলে গা।

দেবযানী বললেন, কে কী বলবে না-বলবে সে কথা রাখো। তুমি কী নেবে তাই বলো দেখি?

আমি জায়দা ভাড়া নেব না মাজি। দশ রুপিয়া লাগে গা। ভাস্করমামা দেবযানীকে ইঙ্গিত করে বলল, ঠিক আছে। ওরা সবাই টাঙ্গায় চেপে বসল।

চন্দন তো খুব খুশি। আসলে বিদেশে এসে টাঙ্গা চাপবার একটা আনন্দ আছে। বিশেষ করে দেওঘর, রাজগির এবং বুদ্ধগয়ায় টাঙ্গা না চাপলে সত্যিকারের ভ্রমণ-রসই পাওয়া যায় না। এখানকার পরিবেশ, বাতাসে নতুন জায়গায় আসার গন্ধ, সব কিছু চন্দনের মনকে পরিপূর্ণ করে তুলল। স্টেশন এলাকা ছেড়ে আসতেই এক জায়গায় একটা ঘড়ির টাওয়ার চোখে পড়ল।

ভাস্করমামা বলল, আমরা এবার বাজারের পাশ দিয়ে মন্দির বাঁয়ে রেখে এগোতে থাকব।

চন্দন বলল, আচ্ছা মামা, তুমি কতবার দেওঘরে এসেছ?

সে কী মনে আছে? তবে অনেকবার। আসলে ছোড়দির কাছে আসা-যাওয়া তো আমিই করি। এখানকার সব আমি চিনিয়ে দেব তোকে। প্যাড়াগলি থেকে প্যাড়া কিনে খাওয়াব।

টাঙ্গা তখন জনবহুল দেওঘর শহরের ওপর দিয়ে টুংটাং শব্দ করতে করতে বিলাসী টাউনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শিব-গঙ্গা বাঁয়ে রেখে সোজা বিলাসী টাউন ধরে যাবার সময় ডানদিকে একটি কালভার্টের পাশে বড় একটি অশ্বত্থ গাছের পিছনে ‘অর্জুন নিবাস’ নামে একটি বাড়ি দেখিয়ে ভাস্করমামা বলল, ওই আমাদের পাণ্ডার বাড়ি।

বাড়ির ভেতর থেকে তখন ‘তুং তাং’ করে তবলার আওয়াজ আসছে।

যাই হোক। টাঙ্গাটা এই পথ ধরে আরও কিছু দূরে এক জায়গায় এসে থেমে গেল। সেইখানে রাস্তার ধারে বারো বিঘে জমির ওপর পাঁচিলঘেরা বাগানের মধ্যে বহুদিনের পুরনো একটি বাড়ি। আগেকার দিনের চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা ইটের গাঁথনি দেওয়া। পাঁচিলের মরচে ধরা লোহার গেট খোলাই ছিল। সেটা পেরিয়ে বাগানের মধ্যে ঢুকে একটু এগোতেই বাড়িটা। গেটের দু’পাশে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস গাছ। তাদের ধপধপে সাদা বিশাল গুঁড়ি দেখে অবাক হয়ে গেল চন্দন। কী সুন্দর। দূরে বহু দূরে পাহাড়ের রেখা। আর খুব সামনেই এক বিশাল পাহাড়। চন্দন অবাক হয়ে চেয়ে রইল সেই পাহাড়টার দিকে, ভাস্করমামা বলল, কী দেখছিস? ওই হচ্ছে ত্রিকূট।

চন্দন বলল, দুপুরে খেয়েদেয়ে যাবে মামা?

দূর বোকা। ও কি এত কাছে নাকি যে যাব? ও এখান থেকে অনেক দূর। ওখানে যেতে হলে ভোর ভোর বেরোতে হয়! তারপর গাইড নিয়ে পাহাড়ে উঠে, নেমে ফিরতে সেই বেলা একটা।

টাঙ্গাওয়ালা ওদের নামিয়ে দিয়ে ভাড়া পেয়ে চলে যেতেই ওরা হাতাহাতি করে মালপত্তর নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ঢুকেই হাঁক দিল ভাস্করমামা, ছোড়দি! এই ছোড়দি! কে এসেছে দেখ।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই রূপামাসি ছুটে এল, ওমা বড়দি! জামাইবাবু! আসুন আসুন। কী ভাগ্যি। চন্দন তুই কত বড় হয়ে গেছিসরে!

দেবযানী আবেগে জড়িয়ে ধরলেন রূপাকে। তারপর বললেন, তোর চিঠি পেয়ে ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। এতদিনের ঠাকুর তোদের।

আর বলিস না দিদি। ঠাকুর চলে যাবার পর থেকে কী দুর্যোগ যে যাচ্ছে আমাদের। আজ এর অসুখ, কাল ওর অসুখ। তা ছাড়া তোর ভগ্নিপতিরও মন মেজাজ ভাল যাচ্ছে না। মানসিক ভারসাম্য একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। এক এক সময় ভাবি কী যে হবে।

নিরুপম কোথায়?

এই একটু বেরিয়েছে। এসো এসো, ভেতরে এসো।

ওরা পায়ে পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল।

রূপামাসির একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছেলেটির নাম বুবাই। মেয়েটির নাম বুবুন। খুবই ছোট। একটির বয়স পাঁচ, অপরটির তিন।

চন্দনের সব কিছু দেখে শুনে মনে হল, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা এইখানেই। এটা বাড়ি না তপোবন? না কোনও আশ্রম? মাসির অনেক ভাগ্য তাই এইরকম একটি পরিবেশে রয়েছে। তবে হ্যাঁ, এ যা জায়গা তাতে এখানে ধন-সম্পত্তি নিয়ে বাস করা যায় না। এই রকম নিরালা প্রান্তরে এত বড় একটা বাড়িতে কেনই বা ডাকাতি হবে না! একপাশে শূন্য মন্দির। ঠাকুর দালান। বাড়িটা বেশ অভিনব। চারদিকে ঘর, মাঝখানে উঠোন। পিছনের দিকে জলকল বাথরুমের ব্যবস্থা।

ভেতরে যেতেই একজন বর্ষীয়সী মহিলা এগিয়ে এলেন। মুখে তাঁর বিষাদের ছায়া। বললেন, এসেছ মা? আমরা তো সর্বস্ব খুইয়ে বসে আছি। আমাদের সাত পুরুষের ঠাকুর। এক সন্ন্যাসীর দেওয়া। এই ঠাকুর চুরি যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। সন্ন্যাসী, ঠাকুর দেবার সময় বলেছিলেন ‘একে যত্ন করবি। নিত্য ভোগ দিবি। তবে মনে রাখিস এই ঠাকুর যেদিন চলে যাবে সেদিনই জানবি তোদের সর্বনাশ ঘনিয়ে আসবে।’ তাই কী যে ভয়ে ভয়ে আছি বাবা, তা তোমাদের কী বলব। আমরা তো কখনও কোনও অনাচার করিনি। তবে কেন এমন হল?

দেবযানী, সুনন্দবাবু ভাস্করমামা ও চন্দন সকলেই প্রণাম করল তাঁকে। ইনি রূপামাসির শাশুড়ি। খুব ভাল মানুষ।

দেবযানীর হাত ধরে তিনি সস্নেহে সকলকে ঘরে নিয়ে গেলেন।

রূপামাসির বাড়িতে একটা চাকর ছিল। নাম বনমালী। সে কোথায় গিয়েছিল কে জানে। এখন পরিচয় পেয়ে সকলের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম শুরু করল। বনমালীর বয়স সাতাশ-আঠাশ। বেশ করিতকর্মা লোক। ভাস্করমামার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসল যে তাতেই বোঝা গেল ভাস্করমামার সঙ্গে দারুণ ভাব। ভাস্করমামাকে বনমালী ‘মামাবাবু, মামাবাবু’ করতে লাগল।

ভাস্করমামা বলল, তা হলে বনমালী, আমাকে আমার ঘরটা খুলে দাও। ওই ঘরে আমরা দু’ মামা-ভাগ্নায় থাকব। চন্দন তুই আমার কাছেই থাকবি তো? চন্দন বলল, নিশ্চয়ই। মা রূপামাসির কাছে থাকুক। বাবা যেখানে হোক। আমি তোমার কাছ ছাড়া থাকছি না।

বনমালী সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘরের চাবি খুলে ঝাড়মোছ করে সব পরিষ্কার করে তক্তাপোশের ওপর বিছানা পেতে বেড কভার বিছিয়ে মনোরম করে তুলল। তারপর বলল, যান বাবুরা, মুখহাত ধুয়ে আসুন আগে, জামাপ্যান্ট ছেড়ে ফেলুন। এখুনি হয়তো আপনাদের চা জলখাবারের ডাক পড়বে।

ভাস্করমামা ও চন্দন তাই করল। বাথরুমে মুখহাত ধুয়ে দাঁত মেজে একেবারে ঝকঝকে হয়ে নিল দু’জনে।

দেবযানী একটু ক্রিম মাখিয়ে দিলেন চন্দনকে। তারপর রূপামাসির সঙ্গে খোসগল্পে মেতে উঠলেন।

সুনন্দবাবুও এবার পোশাক পালটে তাঁর অতি সাধারণ লুঙ্গিটি পরে বাথরুমে যাবার ব্যবস্থা করতে লাগলেন।

রূপামাসির রান্নাঘরে তখন জনতা স্টোভে চায়ের জল ফুটছে।

রূপামাসি বলল, জামাইবাবু এসেছেন এতে যে আমার কী আনন্দ তা কী বলব। ওঃ কতবার যে বলেছি আসতে তার ঠিক নেই। তবে আসবার আগে একটা চিঠি দিতে পারতেন তো?

দেবযানী বললেন, কেন চিঠি পাসনি? আমরা তো রিজার্ভেশন করেই চিঠি দিয়েছিলাম। আমি নিজে লিখেছি চিঠি। তোর জামাইবাবুর ভুলো মন, পাছে ভুলে যায় তাই নিজে চিঠি পোস্ট করেছি।

ওমা, সে কী! কই চিঠি পাইনি তো?

এমন সময় বিদ্যুতের মতো ঝলক লাগানো ফ্রকপরা একটি কিশোরী মেয়ে বেণী দুলিয়ে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নীচে এসে পাশের ঘরে ঢুকল। তারপর একটা মোটা বই বগলদাবা করে রান্নাঘরে এসে ঢুকল।

রূপার মাসির শাশুড়ি বললেন, কীরে, কোথায় ছিলি তুই?

আমি তো ছাদে পড়ছিলাম।

অ। তাই ভাল, আমি ভাবছিলুম সাড়াশব্দ পাচ্ছি না যখন, তখন নিশ্চয়ই কোথাও গেছিস তুই। যা তোকে পাহাড়ে পেয়েছে।

মেয়েটি বলল, এনারা কে দিদা?

তোর কাকিমার বড়দি-জামাইবাবু। নে পেন্নাম কর।

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে দেবযানী ও সুনন্দবাবুর পায়ে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল। ভাস্করমামা তখন নিজের ঘরে ছিল তাই প্রণামটা পেল না। থাকলে পেত নিশ্চয়ই।

দেবযানী বললেন, বাঃ বেশ মেয়েটি তো। একেবারে ফুলের মতো। এটি কে মা?

রূপামাসির শাশুড়িকে দেবযানী ‘মা’ বলেন।

রূপামাসি বলল, ও হচ্ছে মালা। আমার বড়জায়ের মেয়ে। ও তাই নাকি?

সুনন্দবাবু বললেন, খুব ফর্সা তো! এত ফর্সা সচরাচর দেখা যায় না। ওর মা খুব ফর্সা।

দেবযানী বললেন, ওরা তো ধানবাদে থাকে শুনেছি। কবে

এসেছে ওরা?

রূপামাসির শাশুড়ি বললেন, ওরা মানে ও একাই এসেছে। ওর বাবা এসেছিল। কালীপুজোর পর আমি যাব। তখন আমার সঙ্গে চলে যাবে। ওই একটিই মেয়ে। দিনরাত শুধু বই মুখে দিয়ে বসে আছে। আর ফাঁক পেলেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। কী ঘোরান ঘুরতে পারে মেয়েটা। একদণ্ড ঘরের কোনায় থাকে না।

দেবযানী বললেন, চমৎকার মেয়ে।

মালা আর বসল না প্রণাম করেই ওপরে চলে গেল।

রূপামাসি বলল, চন্দন, তোর মামা কি করছে রে?

মামা ওঘরে শুয়ে আছে। মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে খুব।

চন্দন জানে, মামা এখন মোটেই শুয়ে নেই এবং মাথার যন্ত্রণাও হচ্ছে না। আসলে মামা ঘরের দরজা বন্ধ করে বিড়ি খাচ্ছে। কিন্তু একথা তো গুরুজনদের সামনে বলা যায় না। তাই ওই কথা বলল।

একবার ডাক তো! বল, চা হয়ে গেছে।

চন্দন গিয়ে ডাকতেই আধ খাওয়া বিড়িটা ভাস্করমামা জানালা গলিয়ে পিছনে বাগানের দিকে ফেলে দিল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই চন্দন বলল, মাসি ডাকছে। চা খাবে এসো।

যাচ্ছি, তুই যা।

চন্দন চলে আসার একটু পরেই ভাস্করমামা এল। রূপামাসি বলল, এই শোন, চা খেয়ে তুই একবার তোর জামাইবাবুর খোঁজে যা দিকিনি। বনমালীই যেত। ওকে পাঠিয়েছি বাজারে।

রূপামাসি চা আর টোস্ট প্রত্যেককে ভাগ করে দিলেন। তারপর নীচের থেকেই ডাকলেন, মালা।

ওপর থেকে সাড়া এল, কেন?

চা খাবি?

না।

সুনন্দবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, আমি আসলে খুব নিরিবিলি জায়গা পছন্দ করি। কিন্তু তোমাদের এখানটা যে এত নিরিবিলি, এত মনোরম তা জানতাম না। এলাকাটাও তো শহরের শেষপ্রান্তে। দূরে পাহাড়।

তবু তো ছাদে ওঠেননি। ছাদে উঠলে শুধু পাহাড় আর বনভূমি দেখবেন। তা ছাড়া আমাদের নিজেদের বাগানের গাছপালাই একটা ছোটখাটো বনভূমি। চন্দন ছাদে ওঠবার জন্য উশখুশ করছিল। তাই চা–টোস্ট খেয়েই বলল, মা, একবার ছাদে যাবে?

রূপামাসি বলল, তুই যা না!

ভাস্করমামা বলল, চন্দন, আমার সঙ্গেও যেতে পারিস।

সুনন্দবাবু.বললেন, না না ওকে এখন কোথাও নিয়ে যেয়ো না। একটু রেস্ট নিক। বিকেলে বরং যেখানে যাবার যাবে। সারারাতের ট্রেন জার্নি। এখন স্নান করে খেয়েদেয়ে আগে একটু ঘুমোক।

চন্দন বলল, আমি তা হলে ছাদে যাই? বলেই সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে ছাদে উঠে এলো চন্দন।

প্রকাণ্ড ছাদ। হবে নাই বা কেন? এই বাড়ির চৌহদ্দিটাই কী কম। ছাদে উঠেই দেখল চারদিকে শুধু পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়। আসলে ঘেরা ছাদ। তাই ছাদের বাহার আছে। এক পাশের বাগানে কত ফুল গাছ। আর সেই দিকেই আলসের কোণে সতরঞ্জি বিছিয়ে সেই লাল টুকটুকে কিশোরী মালা একমনে কী একটা বই যেন মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।

চন্দন পাহাড়, বনভূমি ও মালভূমির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পায়ে পায়ে সেই দিকে এগিয়ে এল। ওর খুব ইচ্ছে হল এই ফুটফুটে মেয়েটির সঙ্গে আলাপ জমাতে। কিন্তু মুশকিল হল ও তো ওর সমবয়সি কোনও মেয়ের সঙ্গে কখনও কথা বলেনি। তাই দূরের ত্রিকূট পাহাড়টার দিকে আঙুল দেখিয়ে আলাপের ভঙ্গিতে সলজ্জভাবে বলল, আচ্ছা, ওই পাহাড়টার নাম কী?

মালা ওর দিকে না তাকিয়েই বলল, নেকু, সব জানে। বলে আর একটুও না বসে শতরঞ্জি গুটিয়ে নেমে এল নীচে।

অপমানে চন্দনের মুখটা লাল হয়ে উঠল। একে ও অভিমানী ছেলে। তার ওপর এই অবহেলা। বেদনায় দুটিচোখ জলে ভরে উঠল। তারপর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল একবার যদি সুযোগ ও পায়, তা হলে এই অপমানের চরম প্রতিশোধ ও নেবেই নেবে। গায়ের রং ফর্সা বলে এত অহংকার। সেও কি ফর্সা কম? কী স্পর্ধা, একেবারে মুখের ওপর বলে গেল ‘নেকু’। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

চন্দন আহতও হল। আবার মনে মনে নিজেকে ধিক্কারও দিল। সত্যিই তো ‘নেকু’। কেন সে নিজের থেকে যেচে কথা বলতে গেল? না-গাল বাড়ালে এমন চড় তো সে খেত না। সে তো জানতই ওটা ত্রিকূট পাহাড়। তবু কেন গায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করতে গেল?

এমন সময় ভাস্করমামার গলা শোনা গেল, চন্দন! চন্দন ! আমি এখানে।

ভাস্করমামা উঠে এসে বলল, কীরে, কী হয়েছে তোর? মুখখানা এমন করে আছিস কেন?

ও কিছু না। তুমি কই গেলে না মেসোমশাইকে খুঁজতে?

জামাইবাবু এসে গেছেন। বনমালী বাজার যাচ্ছিল। যাবার পথে রাস্তায় দেখা পেয়ে খবর দিয়েছে।

চলো তবে নীচে যাই। মেসোমশাইকে পেন্নাম করে আসি।

চল। তারপর তোকে বাগানটা ঘুরিয়ে দেখাব।

চন্দন ও ভাস্করমামা নীচে এসে নিরুপমকে প্রণাম করল নিরুপম জড়িয়ে ধরল চন্দনকে, থাক থাক বাবা।

চন্দন অবাক হয়ে গেল নিরুপমকে দেখে। এ কী হয়েছে মেসোর। সেই দীপ্ত চেহারার জৌলুস কোথায় গেল? এক মুখ দাড়ি। কেমন যেন পাগল পাগল ভাব। ঠিক যেন গাছের ডালেই বোঁটায় আটকে শুকিয়ে আছে একটি ফুল।

ভাস্করমামার সঙ্গে চন্দন একাত্ম হয়ে শুরু করল ঘুরে বেড়ানোর কাজ। এখন অখণ্ড অবসর। খাওদাও ঘুমোও গল্পের বই পড়ো আর ঘুরে ঘুরে বেড়াও। ভাস্করমামা চন্দনকে নিয়ে এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে যে বিশাল বাগানটা আছে তাই ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল।

সত্যি, কী মনোরম। এত বড় বাগান চন্দন এর আগে আর কখনও দেখেনি। কত যে জানা অজানা গাছ রয়েছে সেখানে তার যেন হিসেব নেই। ভাস্করমামা আর চন্দন যখন বাগানে ঘুরছে, তখন হঠাৎ দেখতে পেল একটি কাঁঠাল গাছের নিচু ডালে দোলনা খাটিয়ে এক মনে দোল খেয়ে যাচ্ছে কিশোরী মালা। ফ্রক পরে বেণী দুলিয়ে যেন একটি বিদ্যুৎ ঝিলিক মারছে।

চন্দন সেদিকে তাকিয়েই এমনভাবে চোখটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল যেন সে ভ্রূক্ষেপই করছে না ওকে।

কী মামা ভাল

মালাই ভাস্করমামাকে দেখে দোল খাওয়া থামিয়ে বলল, আছেন?

ভাস্করমামা হেসে বলল, হ্যাঁ, তোমার খবর কী?

ভাল, কখন এলেন?

সকালেই এসেছি। তুমি এসেছ জানতাম না তো!

আমিও জানতাম না আপনি এসেছেন। ছাদে পড়ছিলাম কিনা।

তোমার মা-বাবার খবর ভাল?

হ্যা। বাবা তো পুজোর আগে এসেছিলেন।

ভাস্করমামা আর চন্দন ঘুরে ঘুরে বাগানের গাছপালা দেখতে লাগল।