কাকাহিগড় অভিযান – ১

[মূল বইতে অধ্যায় ভাগ করা নেই। আমরা ভাগ করে পোস্ট দিলাম।]

অবশেষে অনেক জল্পনা-কল্পনার পর দেওঘরেই যাবার ঠিক হল। চন্দনের খুশির আর অন্ত নেই তাই। পুরী অনেকবার গেছে। দিঘাও ফাঁক পেলেই যাওয়া হয়। রাজগির খুবই ভাল জায়গা। বেনারসও বার পাঁচেক যাওয়া হল। অথচ দেওঘর কত কাছে। কিন্তু যাচ্ছি যাব করে, যাওয়া আর হয় না। ওর ছোট মাসি দেওঘরে বিলাসী টাউনে থাকেন। অনেকবার যেতে বলে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু বাবা না-গেলে?

চন্দন একাও যেতে পারে। আজকালকার দিনে পনেরো বছর বয়সের একটি ছেলে সুযোগ পেলে দুনিয়া চষে ফেলতে পারে। কিন্তু এমনই এক পরিবারে মানুষ হচ্ছে চন্দন যে, ওর মা-বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামান্য দক্ষিণেশ্বরেও বেড়াতে যাবার উপায় নেই ওর। চন্দন ওর স্কুলের লাইব্রেরি থেকে পাণ্ডব গোয়েন্দার অভিযানমূলক বইগুলো এনে পড়ে। মা-বাবা, কাকা-কাকিমা, জেঠুমণি সবাই পড়েন। চন্দন বলে, ওই সব একরত্তি ছেলেমেয়েগুলো যদি দেশ-দেশান্তরে গিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে আসতে পারে, তা হলে আমি একলা কোথাও বেড়াতে যেতে পারব না কেন?

বাবা সুনন্দ চৌধুরী অত্যন্ত কড়া মেজাজের লোক। বলেন, ওসব গল্পের বইতেই সম্ভব। বাস্তবে নয়। বুঝলি? যত্ত সব গাঁজাখুরি লেখা। তবে পড়তে কিন্তু ভাল লাগে।

মা বলেন, সে তুমি যাই বলো, পাণ্ডব গোয়েন্দাদের মতো ছেলেমেয়ে হয় না। আর ওদের ওই কুকুর পঞ্চু….।

সুনন্দবাবু হোঃ হোঃ করে হাসিতে ফেটে পড়েন।

চন্দন বলে, বাবা, তোমরা আমাকে কাছ ছাড়া করতে চাও না জানি। কিন্তু জেনে রেখো আমি স্কুলে প্রথম ছেড়ে দ্বিতীয় হইনি কখনও। সামনের বছর ফাইনাল দেব। সেখানে কী হব তা জানি না। তবে এটুকু জেনে রেখো আমার মন কল্পনার জগতে ওড়ে। আমি ঘাটশিলার ফুলডুংরি পাহাড়ে উঠে পূর্ণিমার রাতে চাঁদের জ্যোৎস্না গায়ে মাখতে চাই। আমি বেলপাহাড়ির ডাকবাংলোয় বসে অরণ্যের শোভা দেখে চোখ জুড়াতে চাই। পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, ঝরনা-জলপ্রপাত এইসব দেখতে আমি খুব ভালবাসি। কিন্তু তোমরা যদি আমাকে সঙ্গে নিয়ে সময় পেলেই ওই সব জায়গায় ঘুরতে, তা হলে কত খুশি হতাম। তোমাদের শুধু পুরী, বেনারস আর দিঘায় পেয়েছে। একবার কীরকম ভুল করে রাজগির চলে গিয়েছিলে। তোমরা মধুপুর গেছ, অথচ দেওঘর যাওনি। দেওঘরে গেলে থাকার অসুবিধে নেই। ছোট মাসি তো প্রায়ই চিঠি লেখেন। এবার হয় সবাই মিলে চলো, নয়তো আমাকে যেতে দাও! আমি ঘরকুনো একটা জড়ভরত হয়ে থাকতে চাই না।

সুনন্দবাবু কেন্দ্রীয় সরকারের একজন পদস্থ অফিসার। অত্যন্ত দাম্ভিক লোক তিনি। আর দারুণ কড়া মেজাজের মানুষ। দীর্ঘ উন্নত বলিষ্ঠ চেহারা। গায়ের রং ফর্সা। যেমন-তেমন ফর্সা নয়, একেবারে ধপধপে ফর্সা। সবসময় একটা লাল আভা ফুটে বেরোয় গা থেকে। ঘনঘন চুরুট খান। চায়ের বদলে কফি। চন্দনের কথা শুনে হেসে বলেন, উঁহু। ও তুমি যাই বলো, একা যাওয়া তোমার হচ্ছে না। স্ত্রী দেবযানীও যেন সাক্ষাৎ দুর্গাপ্রতিমাটি।

আর চন্দন? শুভ্র সুন্দর স্বাস্থ্যবান এক কিশোর। বড় বড় ভাসা ভাসা চোখদুটো ভ্রমরের মতো। মাথায় ঘন চুল। লাল টুকটুকে গায়ের রং। যেন সোনা কুঁদে তৈরি। স্কুলে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে এন্তার গল্পের বই পড়ে। আর কল্পনায় দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখে। কেউ কোথাও থেকে ঘুরে এলে ও অবাক দুটি চোখে তার ভ্রমণের বৃত্তান্ত শোনে। শুনতে শুনতে ওর মনও সেই শোনার মাঝে হারিয়ে যায়।

বাবার কথা শুনে চন্দন বলে, বেশ, একা আমি কখনও যাব না, একা গেলে আমারও কষ্ট হবে বইকী খুব। তোমাকে, মাকে ছেড়ে আমি কখনও কোথাও থাকিনি তো। তবে দেওঘরে যাবার শখ আমার বহুদিনের। তোমরা আমাকে একবার দেওঘরে নিয়ে চলো। যদি যাও ভাল। না-গেলে কিন্তু…।

পালাবে। এই তো? বলে সুনন্দবাবু একটু হেসে বললেন, আসলে ব্যাপার কী জানিস, কোথাও গিয়ে কারও বাড়িতে থাকাটা আমার ঠিক পোষায় না। মনে হয় যেন, সব সময় পরাধীন। দিঘা, পুরী যেখানেই যাই সেখানেই আমি হলিডে হোম পাই। কেমন স্বাধীন ভাবে ঘুরিফিরি। কিন্তু দেওঘরে গেলে তো সেটা পারব না। তোর ছোট মাসি দুঃখ করবে তা হলে। অতএব ওখানে গেলে সেই পরের বাড়িতেই উঠতে হবে।

দেবযানী বললেন, পরের বাড়ি বলছ কেন? আমার বোন। সে যদি তোমার পর হয় তো আপনার জনটা কে শুনি? বেশ, তুমি না যাও না যাবে। চন্দনকে নিয়ে তা হলে এ বছর আমিই যাব দেওঘরে। তুমি তোমার হলিডে হোম খুঁজে যেখানে হোক চলে যেয়ো।

চন্দন আনন্দে লাফিয়ে উঠল, হু-র র-রে।

এমন সময় হঠাৎই একদিন ছোট মাসির চিঠি এল, এক মর্মান্তিক দুঃসংবাদ নিয়ে। মাত্র কয়েকদিন আগে ওদের বাড়িতে এক বড় ধরনের ডাকাতি হয়েছে। তাইতে ওরা প্রাণে বাঁচলেও, ওদের একজন সাঁওতাল মুনিষকে ডাকাতদলের পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে। সেই ডাকাতিতে ওর ছোট মাসির সমস্ত গয়নাগাটি, সিন্দুকের টাকা-পয়সা এবং তার চেয়েও বড় জিনিস ওদের সাতপুরুষের প্রতিষ্ঠা করা অষ্টধাতুর রাধাকৃষ্ণ মূর্তিটি খোয়া গেছে! ওই মূর্তির বর্তমান মূল্য প্রায় লক্ষাধিক টাকা। ওরা এই ব্যাপারে যথারীতি থানা-পুলিশ করেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। চারদিক তোলপাড় করেও পুলিশ সন্ধান পায়নি সেই অষ্টধাতু বিগ্রহের। ছোট মাসির অনুরোধ এই দুঃসময়ে ওরা যেন একবার এসে ওদের পাশে দাঁড়ায়। কেন না ওর শাশুড়ি ব্লাড প্রেশারের রুগি। তিনি শয্যাশায়ী এবং স্বামী নিরুপম মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কেমন যেন অপ্রকৃতস্থের মতো হয়ে গেছে।

এই চিঠির পর আর না-যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। দিঘা, পুরী, রাজগির সবকিছু নাকচ করে সুনন্দবাবু দেওঘর যাওয়াই ঠিক করলেন।

দেওঘরে যাবার ঠিক তো হল। কিন্তু যাওয়াটা হবে কী ভাবে সেই নিয়ে জোর আলোচনা বসল। ছোট মাসির চিঠি শুধু যে এ বাড়িতেই এসেছিল তা নয়, দেবযানীর বাপের বাড়িতেও গিয়েছিল। দেবযানীর দুই ভাই, অর্থাৎ চন্দনের দুই মামা বীরেন ও ভাস্কর ছুটে এল তাই। বীরেন বলল, রূপার চিঠি পেয়েছিস বড়দি?

রূপা হল ছোট মাসির নাম।

বীরেন বলল, আমার তো জানিস যাওয়ার কত অসুবিধে। তাই ভাবছি

ভাস্করটাই যাক। তোরা যদি যাস তো খুবই ভাল হয়। রূপার চিঠি পড়ে যা বুঝলাম তাতে মনে হচ্ছে ওখানকার পুলিশ ঠিক গা করছে না। শুধুই লোকদেখানো তল্লাসি চালাচ্ছে। না হলে এত বড় ডাকাতি, একটা খুন, অথচ একজনও অ্যারেস্ট হল না?

সুনন্দবাবু বললেন, আমরা তো যাচ্ছি। দেখি না ওখানকার ব্যাপারস্যাপার কীরকম। না হলে প্রয়োজনে কলকাতা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ নিয়ে গিয়ে তদন্ত করাব।

বীরেন বলল, চিঠি পড়ে জানা যাচ্ছে এটা মাত্র দিন পনেরোর ব্যাপার। কিন্তু ওই রকম একটি মাল হাপিস করার পক্ষে পনেরোটা দিন বড় কম নয়। এই পনেরো দিনে অষ্টধাতুর রাধাকৃষ্ণমূর্তি হয়তো এখন সিঙ্গাপুরে পৌঁছে গেছে। সে মাল কি এখনও ধারেকাছে আছে ভেবেছেন? পুলিশও প্রাথমিক তদন্ত করে কি না-পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কাজেই অযথা এক কাড়ি টাকা-পয়সার শ্রাদ্ধ করে ওসব গোয়েন্দা পুলিশ করতে না যাওয়াই ভাল।

দেবযানী বললেন, বাঃ! তা হলে লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি একদল ডাকাত এসে লুটে নিয়ে যাবে, আর আমরা তা চুপচাপ মেনে নিয়ে তাদের ধরবার চেষ্টা না করে বসে বসে কপাল চাপড়াব। এ কী রকম কথা?

বীরেন বলল, ওঃ বড়দি তোদের বোঝাতে পারব না। কয়েক লাখ টাকার সম্পত্তির চেয়ে কয়েকটা জীবন খুব বড় নয় কি? তোরা তো গেলি না কখনও দেওঘরে। গেলে বুঝতিস কী ভয়ংকর নির্জনে ওরা থাকে। অত টাকাকড়ি গয়নাগাটি, ওই রকম একটা দুষ্প্রাপ্য বিগ্রহ নিয়ে বাস করতে গেলে কয়েক ব্যাটেলিয়ান মিলিটারি সবসময় বাড়ির দোর গোড়ায় রাখতে হয়। না হলে যে কোনও মুহূর্তে জীবন তো বিপন্ন হবেই। ওরা যে বাড়িশুদ্ধ লোককে প্রাণে মারেনি এই ঢের। সাঁওতাল মুনিষটা বোকার মতো প্রভুভক্তি দেখাতে গিয়েই মরেছে। ওই অবস্থায় সশস্ত্র কিছু ডাকাতদলের পিছু নিতে আছে কখনও।

সুনন্দবাবু বললেন, এটা অবশ্য একটা যুক্তিপূর্ণ কথা, আর আমারও মনে হয় এই ধরনের বহুমূল্য কোনও জিনিস ব্যক্তিগত জিম্বায় না রেখে সরকারের হাতেই তুলে দেওয়া উচিত।

দেবযানী রেগে বললেন, কী যে আবোল-তাবোল কথা বলছ তোমরা। সন্ন্যাসীর দেওয়া প্রতিষ্ঠা করা গৃহদেবতা কাউকে দিতে আছে নাকি?

বীরেন বলল, না দেওয়ার ফলটা দেখতে পেলি তো? যখন যেমন যুগ তখন তেমন ব্যবস্থা নিতে হবে। তুই নিজে তোর গায়ের গয়নাগুলো ব্যাঙ্কের লকারে রেখেছিস কেন বল? কেন কোথাও বেড়াতে গেলে ওগুলো পরে যাস না? কেন মাসে-মাসে গোছা গোছা টাকা ঘরের সুটকেসে না রেখে ব্যাঙ্কে দিয়ে আসিস? দেবযানী আর কোনও কথা না বলে গজ গজ করতে লাগলেন।

সুনন্দবাবু বললেন, তবে হ্যাঁ, এই চুরিডাকাতি একেবারে যেমন মেনে নেওয়া যায় না, তেমনি ওদের দিক থেকে কিন্তু ভাল হয়েছে। আর কেউ কোনও কিছুর লোভেই ওদের বাড়ি চড়াও হতে আসবে না। ওই রকম পরিবেশে নিঃস্ব হয়ে থাকাটাই শান্তির থাকা।

বীরেন বলল, যাক। এখন ওসব কথা বাদ দাও। তোমরা কি তা হলে সত্যিই যাচ্ছ?

সুনন্দবাবু বললেন, হ্যাঁ যাচ্ছি।

রূপা খুব খুশি হবে তা হলে, কিন্তু কীভাবে কোন গাড়িতে যাবে ঠিক করেছ কিছু?

ভাস্করমামা বলল, জামাইবাবু, আমি বলছিলাম কী দেওঘরে যাওয়ার পক্ষে তুফানই বেস্ট ট্রেন। সকাল দশটা দশে হাওড়া থেকে ছাড়ে। বিকেল তিন, সাড়ে তিনটে নাগাদ জসিডিতে পৌঁছে দেয়। ওখান থেকে বাস, টাঙ্গা, অটো যা মন চাই তাই নেবে। চাই কী ট্রেনেও যেতে পারো। লাগোয়া ট্রেনও আছে।

দেবযানী বললেন, সবই তো শুনলাম। কিন্তু তুফানে উঠবে কী করে। ওই হিন্দুস্থানিদের ভিড়ে মারামারি করে গোরু-ছাগলের মতো বোঝাই হতে আমি কিন্তু রাজি নই।

বীরেন বলল, তা হলে বম্বে জনতায় যা।

সুনন্দবাবু সঙ্গে সঙ্গে টাইম টেবল খুলে গাড়ির সময়টা দেখে নিয়ে বললেন, হ্যা, এটাও ভাল গাড়ি। আর এ গাড়িটা একেবারে ফাঁকা যায় শুনেছি। আগে সপ্তাহে তিন দিন ছিল। সোম, বুধ, শুক্র। এখন তো দেখছি এটা বাই উইকলি হয়ে গেছে। বুধ আর শুক্র। তা চলো সপ্তমীর দিন বেরিয়ে পড়া যাক।

ভাস্করমামা বলল, আমার কোনও আপত্তি নেই। গোছগাছ করে ফেলো তা হলে।

চন্দন এতক্ষণ চুপ করে সকলের কথা শুনছিল। এবার বলল, তোমরা বেশ তো। সপ্তমীর দিন কোন দুঃখে যাব। আমাদের এত বড় একটা জাতীয় উৎসব। এই সময় কখনও দুর্গাপ্রতিমার মুখ না-দেখে ট্রেন জার্নি করে কেউ? পুজোর ক’দিন আমি কলকাতা ছাড়ছি না। এই সময় গেলে আমারও কিন্তু খুব মন খারাপ হয়ে যাবে।

সুনন্দবাবু বললেন, অবাক কাণ্ড। দেওঘরে যাবার জন্যে এতদিন কী কান্নাকাটি। আর যেই যাবার ঠিক হল অমনি আজ নয়, কাল।

চন্দন বলল, তুমিই বলো না বাবা, পুজোর ক’দিন কী কোথাও যেতে মন চায়? সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দেখব। চুটিয়ে খাব। দশমীর দিন গুরুজনদের পায়ের ধুলো মাথায় নেব। তারপর একাদশীর দিন যাওয়া।

ভাস্করমামা বলল, তা হলে তো বম্বে-জনতা পাব না। সেই তুফানেই যেতে হবে।

দেবযানী বললেন, কী যে তোমরা তুফান তুফান করো। কেন রাত্তিরে কি কোনও গাড়ি নেই? রিজার্ভেশান করে নিশ্চিন্তে চলো। কোন-থ্রি টায়ার পাও কি না দেখো।

সুনন্দবাবু বললেন, রাতের গাড়িতে থ্রি টায়ারে গেলে আরামে যাওয়া যায় তবে কী জান, ঠিক সকাল বেলায় তো পৌঁছয় না। শেষ রাতে নামিয়ে দেয় সব। সেই রকমই একটা গাড়ি দ্যাখো যেটা হাওড়া থেকে সবার শেষে ছাড়ে আর জসিডিতে ভোরবেলা পৌঁছয়।

ভাস্করমামা বলল, রেলের ব্যাপার স্যাপারগুলোই যেন আলাদা। এদিকে দেখুন গিরিডির জন্যে কী চমৎকার দিল্লি এক্সপ্রেসে একটা প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণীর থ্রি টায়ার বগি লাগিয়ে দেয়। বগিটা মধুপুরে কেটে রেখে দিল্লি এক্সপ্রেস চলে যায়। তারপর গিরিডির লোক্যাল সেই কাটা বগি জুড়ে নিয়ে ভোরবেলা পৌঁছে দেয় গিরিডিতে। সেই রকম কোনও একটা ট্রেনেও যদি দেওঘরের ওই রকম একটা থ্রি টায়ার বগি লাগিয়ে দিত তা হলে কী ভালই না হত। মোগলসরাই প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে যদিও বা একটা বৈদ্যনাথ ধামের বগি দেয় তাও সেটা সাধারণ বগি। থ্রি টায়ার নয়। কাজেই সেই ভিড়ের গুঁতোগুঁতি। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়েবসে যাওয়া যাবে না। অথচ দেওঘরের ট্যুরিস্ট কি কম? গিরিডির চেয়েও হাজার গুণ বেশি।

সুনন্দবাবু বললেন, আমার মনে হয় এই ব্যাপারে রেলের নিশ্চয়ই কোনও দূরত্বের ব্যাপার আছে। না হলে দিচ্ছে নাই বা কেন?

দেবযানী বললেন, ওসব কথা থাক। এখন যাবার একটা উপায় করো। মোট কথা রাতের গাড়িতেই যাব আমি।

চন্দন বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ সেই ভাল। রাতের গাড়িতেই যাব আমরা, রাতের গাড়িতে যেতে আমার খুব ভাল লাগে। যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়।

ভাস্করমামা বলল, দিদি তোর এ ছেলেটা কিন্তু কবি হবে দেখিস।

সুনন্দবাবু মানিব্যাগ থেকে একগোছা নোট বার করে ভাস্করমামার হাতে দিয়ে বললেন, তবে তাই হোক। যাও, গিয়ে চারটে বার্থ রিজার্ভ করে এসো। যে গাড়িতে পাও।

চন্দন বলল, আমি যাব বাবা, ভাস্করমামার সঙ্গে?

যাও। তবে সাবধানে পথঘাট চলবে। মামার হাত ধরে থাকবে সবসময়। বোকার মতো হাঁ করে তাকাবে না কারও দিকে। বুঝলে?

চন্দন ‘আচ্ছা’ বলে ভাস্করমামার সঙ্গে বেরিয়ে গেল। ওর মন আনন্দে ভরে উঠেছে।

কলকাতা। কথায় বলে এ এক বিচিত্র শহর। সত্যিই তাই। রূপে-রসে-গন্ধে আর বৈচিত্র্যে অনুপম এই শহরের জুড়ি মেলা ভার। সারা ভারতে এমন ব্যস্ত শহর আর কি কোথাও আছে? চন্দনের অন্তত তাই মনে হল। ভাস্করমামার সঙ্গে ফেয়ারলি প্লেসে রেলের বুকিং কাউন্টারের কাছে আসতেই ও দেখল, নানা জাতের নানা ভাষার নানান রঙের মানুষ টিকিটের জন্য মারামারি করছে সেখানে। চন্দন বলল, এরা সব এখানে কী করছে মামা?

ওরা সবাই টিকিট কাটতে এসেছে।

সে কী! এত লোক টিকিট কাটতে চায়? তবে যে শুনি লোকে টিকিট কাটে না।

ভাস্করমামা বলল, আমি খেয়ে যদি বলি খাইনি তো কার কী বলার আছে? তা ছাড়া মিথ্যে কথা বলতে তো ট্যাক্সো লাগে না। ওটা হচ্ছে ভাড়া বাড়ানোর একটা অজুহাত।

ও।

তবে সবাই যে টিকিট কাটে এমন নয়। কিছু কিছু লোক তো আছেই যারা সব সময় ফাঁকি দেবার চেষ্টা করে। বিশেষ করে লোক্যাল ট্রেন গুলোয় চেকিং-এর ব্যবস্থা ভাল থাকে না বলে চ্যাংড়া ছেলেপুলের দল অথবা গরিব দুঃখী লোকেরা ভাড়া বাঁচানোর সুযোগ নিয়েই থাকে। তবে ধরা যখন পড়ে তখন মোটা টাকা ফাইন দেয়, নয়তো জেল খেটে প্রায়শ্চিত্ত করে। দুশো লোক যদি বিনা টিকিটে ট্রেনে চাপে, সেখানে তিরিশ জন ধরা পড়লেও সাতশো জনের ভাড়া দিতে বাধ্য হয়। কাজেই বিনা টিকিটের যাত্রীরা বরং রেলের আয়ের একটা উৎস বলতে পারিস। সেইজন্যে ইচ্ছে করেই রেল কর্তৃপক্ষ চেকিং ব্যবস্থা জোরদার না করে সাধারণ যাত্রীদের বিনা টিকিটে ট্রেনে চাপার প্রবণতা বাড়িয়ে দেন এবং লক্ষ লক্ষ লোক টিকিট কাটা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে কয়েকটা বিনা টিকিটের যাত্রী ধরে ‘লোকসান হচ্ছে’ ‘লোকসান হচ্ছে’ করে চেঁচিয়ে বছর বছর ভাড়া বাড়ান।

চন্দন বলল, তবে যে খবরের কাগজে লেখে রেলের ঘাটতি মেটাতে ভাড়া বাড়ে।

সেটাও আর এক কারণ বইকী। রেলের সম্পদ চুরি যে হারে বেড়ে চলেছে, তাতে সারা ভারতবর্ষের লোক যদি মাত্র একটি স্টেশন যাবার জন্যে একশো টাকা ভাড়া দিয়েও টিকিট কাটে তবুও আমার মনে হয় রেল একদিন উঠে যাবে। সে কী।

হ্যাঁ।

এই চুরি কারা করে মামা?

সর্ষের ভেতর যে সব ভূতেরা বাস করে তারাই।

এর কি কোনও ওষুধ নেই?

কেন থাকবে না? এর পরিচালনার দায়িত্ব সম্পূর্ণ রূপে কোনও বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিলেই ঠান্ডা হয়ে যাবে। আসলে আমাদের দেশের সরকার সেরকম কঠোর নন বলেই আশকারা পেয়ে এরা এত মাথায় উঠেছে।

যাই হোক, ভাস্করমামা চন্দনকে একপাশে দাঁড় করিয়ে নিজে টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়াতেই কয়েকজন লোক এসে হেঁকে ধরল ওদের। একজন জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন দাদা?

মিনিম্যাকাও।

সে আবার কোথায়?

ইমবুমপিপে জানো?

না। হিক্কাহিয়াও?

না।

তা হলে ফুটে পড়ো।

লোকগুলো একটু সরে গেল। তারপর তাদেরই ভেতর থেকে আবার দু’-একজন এগিয়ে এসে বলল, বলুন না দাদা কোন গাড়ি, কোথায় যাবেন? ভাস্করমামা এবার আর ফাজলামি না করে বলল, যাব তো দেওঘর। দেখি কোন গাড়ি পাই।

দেওঘর। দেওঘর নামে কোনও স্টেশন নেই। আপনাকে বৈদ্যনাথধামের টিকিট কাটতে হবে। কবে। কবে যাবেন বলুন?

একাদশীর দিন। মানে সাত তারিখে।

লোকগুলো হোঃ হোঃ করে হেসে বলল, সাতাশ তারিখ পর্যন্ত কোনও ট্রেনে একটু বসবার জায়গাও নেই তো, সাত তারিখে কী করে যাবেন দাদা? ক’টা টিকিট?

এই ধরুণ চারটে।

হয়ে যাবে, বেরিয়ে আসুন। টিকিট পিছু এক্সট্রা পঁচিশ টাকা লাগবে।

ভাস্করমামা বলল, আমার কাছে পকেটমারা টাকা নেই বাবা, বুঝলে? ওসব ধান্দাবাজি এখানে না করে কেটে পড়ো দেখি সব বলার সঙ্গে সঙ্গেই একজন ভাস্করমামার জামার কলারটা ধরে টেনে আনল লাইন থেকে। বলল, কী বললি?

ভাস্করমাও জেদি খুব। হঠাৎ লোকটার পেটে সজোরে একটা ঘুসি মেরেই চন্দনের হাত ধরে টান দিল, চন্দন! কুইক। কেটে পড়ি আয়। আর টিকিটের দরকার নেই।

কিন্তু হলে কী হয়। ততক্ষণে ওদেরই দলের দু’-তিনজন ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভাস্করমামার ওপর। একজনের হাতে ধারালো ছুরি।

চন্দন চিৎকার করে উঠল ভয়ে।

বিচিত্র কলকাতা। এত লোক, কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না সাহায্য করতে। সবাই দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগল। উলটে একজন কিনা বলল, ঠিক হয়েছে। যেমন ঘাঁটাতে যায় এদের।

কিন্তু কেউ এগিয়ে না এলেও চন্দনের মাথায় তখন ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ চেপে গেছে। সে নিজেই হঠাৎ এক দুর্জয় সাহসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই ছুরিধরা লোকটার ওপর। তারপর যে হাতে লোকটা ছুরি ধরেছিল, সেই হাতটা ধরে এমনভাবে পাকিয়ে দিল যে চিৎকার করে উঠল লোকটা। ততক্ষণে কয়েকজন আর পি এফ মানে রেলের পুলিশ ছুটে এসেছে। তাদের একজন চন্দনের গালে এক থাপ্পর কষিয়ে বলল, এই তুম কাহে কো ঝামেলা লাগা দিয়া। হঠো হিয়াসে। ভাস্করমামা বলল, বাঃ রে। ওর দোষটা কোথায়? ওই লোকটা যে আমাকে ছুরি মারতে এসেছিল তার বেলা?

আর একজন আর পি এফ এসে ভাস্করমামার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বার করে দিল, যাও হঠো। ভাগো হিয়াসে।

হাতে মোচড় খাওয়া লোকটার দলের লোকেরা তখন হাসতে হাসতে চলে গেল সেখান থেকে।

এদের এত হাসির কারণটা যে কী চন্দন তা বুঝতে পারল না প্রথমে। পরে যখন রাস্তায় এসে পকেটে হাত দিয়েই শিউরে উঠল ভাস্করমামা ‘যাঃ সর্বনাশ হয়ে গেছে’, তখনই সব পরিষ্কার হয়ে গেল।

চন্দন বলল, কত টাকা ছিল মামা?

সে অনেক টাকা। কিন্তু তোর বাবার কাছে কী করে মুখ দেখাব রে? আমি একটা বেকার ছেলে।

চন্দন বলল, তবু শুনি না কত টাকা?

তোর বাবা আমাকে চারশো টাকা দিয়েছিল।

তাতে কী হয়েছে? আমি বাবাকে সব বলব। যাক চারশো টাকা। তবু তুমি তো প্ৰাণে বেঁচেছ।

তুই কিন্তু বাঁচিয়েছিস আমাকে। যেভাবে হাতটাকে তুই পাকিয়ে দিয়েছিস তাতে ওই হাতে আর কোনদিনও হয়তো ছুরি ধরতে হবে না ওকে। তুই না-আটকালে ও ছুরিটা আমার পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিত।

চন্দন শিউরে উঠে বলল, ওঃ। কী সর্বনাশ যে হত তা হলে। জানো মামা, পাণ্ডব গোয়েন্দার বাবলু-না এই রকম সাহসী। আচমকা ভয় না পেয়ে সেটা কাটিয়ে ওঠবার চেষ্টা করে। প্রতিরোধ করে। বিনা যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে না। আমিও বাবলুর মতো ছেলে হবার স্বপ্ন দেখি। মৃত্যু তো একদিন হবেই। তাই মরব বীরের মতোই মরব। কাপুরুষের মতো কেন?

চন্দনের বড় মামা ডালহৌসি পাড়াতেই একটি অফিসে কাজ করতেন। ওরা সেখানে গিয়ে সব কথা খুলে বলতেই ভাস্করমামাকে খুব বকাবকি করলেন বড় মামা। তারপর কিছু নিজের কাছ থেকে, কিছু সহকর্মীদের কাছ থেকে চেয়ে ভাড়ার টাকার হিসেব করে শ’দুই টাকা দিয়ে দিলেন।

সেই টাকা নিয়ে ওরা আর ফেয়ারলিতে নয়, সোজা চলে গেল অন্য একটি সিটি বুকিং-এ। এখানে আবার অন্য ছবি। ভিড় প্রায় নেই বললেই হয়।

যাই হোক, একটা ফর্মে সবকিছু লিখে চন্দনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ভাস্করমামা এনকোয়ারিতে কী যেন জিজ্ঞেস করতে গেল। একটু পরেই ঘুরে এসে ফর্মে ট্রেনের নম্বরটা বসিয়ে দিয়ে বলল, একটা খুব ভাল গাড়ির সন্ধান পেয়ে গেছিরে। ১০৫ আপ নর্থ বিহার এক্সপ্রেস। গাড়িটা নতুন। সপ্তাহে একদিন মাত্র ছাড়ে। রাত এগারোটায়। হাওড়া থেকে।

তা হলে নিশ্চয়ই গাড়িটা দেরি করে পৌঁছবে। অর্থাৎ আমরা রাতের অন্ধকারে নয়, সকালেই নামতে পারব।

সেই রকম তো আশা করছি।

দু’-একজন লোকের পরই ভাস্করমামা কাউন্টারে পৌঁছতে পারল।

কাউন্টারে পৌঁছেই ফর্মটা এবং দুটো একশো টাকার নোট বুকিং ক্লার্কের হাতে ধরিয়ে দিল মামা।

বুকিং ক্লার্ক ভদ্রলোক চার্টটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, আপনি যে গাড়ি চাইছেন ওটা তো সাত তারিখে নেই। ওটা আছে আট তারিখে। শুক্রবার। তাও তিনটের বেশি বার্থ হয় না।

কেন হয় না?

কেন আবার, কোটা নেই।

চন্দন আর ভাস্করমামা মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল।

ভদ্রলোক বললেন, শুনুন এক কাজ করুন। আমি এখানে তিনটে বার্থ দিয়ে দিচ্ছি। বাকি একটা বার্থ বরং অন্য কোথাও থেকে করিয়ে নিন।

ভাস্করমামা বলল, বেশ ঠিক আছে। তাই দিন।

ভদ্রলোক ফর্মটা ফেরত দিয়ে বললেন, তারিখটা বসিয়ে দিন তা হলে। আর যে নামটা কাটা যাবে সেটাও কেটে দিন।

ভাস্করমামা তো আনন্দে ডগমগ। ঘ্যাঁচ করে আগে নিজের নামটাই কেটে দিয়ে তারিখটা আট তারিখ করে ফর্মটা আবার জমা দিল। বুকিং-ক্লার্ক ভদ্রলোক প্রশান্ত বদনে খুব যত্নের সঙ্গে তিনখানি টিকিট নামটাম লিখে ফেরত দিয়ে সিগারেট খেতে খেতে তাঁর এক সহকর্মীর সঙ্গে গল্প করতে করতে চলে গেলেন।

ভাস্করমামা বলল, কী হল মশাই, আমার ব্যালেন্সটা?

ভদ্রলোক যেন শুনতেই পেলেন না। ভাস্করমামা চেঁচাতে লাগল, ও মশাই শুনছেন? এই যে, এই যে দাদা আমার ব্যালেন্সটা?

ভদ্রলোক এবার এগিয়ে এসে বললেন, কেন আপনাকে ফেরত দিইনি? না।

এবার নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে এবং বিরক্তিভরে বললেন, কত টাকা দিয়েছিলেন যেন?

দুশো টাকা।

একশো টাকার দুটো নোট দিয়েছিলেন না? কেন যে আপনারা ভাঙিয়ে দেন না। এখন ভাঙানি কোথায় পাই বলুন তো? সব পঞ্চাশ, একশো টাকার নোট। বলে হাতড়ে হাতড়ে যা ফেরত দেবার কথা তার চেয়ে দশ টাকা কম দিলেন। ভাস্করমামা বলল, আর দশ টাকা?

আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই। আপনাদের কাজ করে আমরা কিছু পেয়ে থাকি। পুজোর সময় সামান্য দশটা টাকা দিতে পারছেন না।

ভাস্করমামা বলল, কোথায় পাব দাদা? বেকার ছেলে! আমাকে দশটা টাকা ফেরত দিন। আপনাকে বরং একটা টাকা দিচ্ছি চা খাবেন। বলে একটা টাকা কাউন্টারে গলিয়ে দিতেই একটা দশ টাকার নোট হাতে এল। টিকিট ও টাকা পকেটে নিয়ে কাউন্টার থেকে সরে আসতেই চন্দন বলল, আচ্ছা মামা, এটা তো ঘুষ দেওয়া হল তাই না?

হ্যাঁ।

কিন্তু এক টাকা কেউ ঘুষ খায়?

কেন খাবে না? যাক গে একটা টাকা। তিন-তিনটে টিকিট তো পেয়ে গেলাম।

তবু তোমারটা তো হল না।

না হোক। ও আমি অন্য কোথাও থেকে ম্যানেজ করে নেব। অনেক বুকিং অফিস আছে। না হয় বিনা রিজার্ভেশনেই চলে যাব।

কথা বলতে বলতে ওরা রাস্তায় বেরিয়ে এল। চন্দন বলল, আচ্ছা মামা, ওই লোকটা তো কেমন ভাল জামা-প্যান্ট পরে আছে। চোখে চশমা। কী রকম ভদ্রলোকের মতো দেখতে। সামান্য ওই একটা টাকা নিতে ওর প্রেস্টিজে বাধল না?

ভাস্করমামা দুঃখ করে বলল, নারে। আমাদের দেশে দারিদ্রতাটা এখন এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁচেছে, যেখানে পাবলিকের কাছ থেকে টাকা-পয়সা খাবার সুযোগ পেলে কেউই ছেড়ে দেয় না। ওই যে লোকটাকে দেখলি ও মোটা টাকা মাইনে পায়, বোনাস পায়, সপরিবারে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়াবার পাস পায়। তবুও ওর স্বভাব।

তবে মামা, আমি কিন্তু ও রকম হব না। আমি যদি কখনও বড় হয়ে চাকরি করি তো, জেনে রেখো ভগবানের দিব্যি আমি কখনও ঘুষ খাব না।

চন্দন তুই ভাল ছেলে হ! আমি জানি তুই জীবনে অনেক উন্নতি করবি। তবুও জেনে রাখ ওই যে ভদ্রলোক নির্লজ্জের মতো একটা টাকা ঘুষ খেল। হয়তো ওর সাত-আটটি ছেলেমেয়ে। হয়তো তারা যখনতখন অসুখে ভোগে। হয়তো ওর ঘরে বুড়ো মা-বাবা আছে। এবং দু’-তিনটি আইবুড়ো বোনের বিয়ে দিতে হবে।

হয়তো ওর স্ত্রীর কোনও বড় ধরনের অপারেশন হয়েছে। তাই ওই বাইরের চেহারায় ভদ্রলোকের খোলটাই রয়েছে ওর, কিন্তু ভেতরের ভদ্রসন্তান অনেক আগেই মরে গেছে।

তার মানে তুমি এটাকে সমর্থন করছ মামা? তবে জেনে রেখো, আমি কখনও ওই অবস্থায় পড়লে ঘুষ খাব না, ফলিডল খাব।

তা তুই পারিস চন্দন। তবে সবাই কী তুই? রামকৃষ্ণও নরদেহ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল, পেশাদার খুনিরাও এসেছিল। সবাই কি এক? রাস্তার মাইল পোস্টটাও পাথর আবার কাশীর বিশ্বনাথও পাথর! তফাত আছে বইকী। তবে ওই একটি লোককে দেখেই তুই সকলের বিচার করিস না। কিছু সৎ লোক নিশ্চয়ই আছেন, না হলে দেশটা যেটুকু চলছে এটুকুও চলত না।

ওরা কথা বলতে বলতে কলেজ স্ট্রিটের দিকে এগোল। ভাস্করমামা বলল, তুই কখনও কফি হাউসে গেছিস?

না মামা। কার সঙ্গে যাব?

চল তোকে নিয়ে কফি হাউসে যাই।

চন্দনের আনন্দের আর শেষ নেই। এমন স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো ওর জীবনে এই প্রথম।

অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত সেই যাবার দিনটি এগিয়ে এল। চন্দনের আনন্দের আর অবধি নেই। ইতিমধ্যে লুকিয়ে সে বাজার থেকে একটা বড় ছোরা কিনে এনেছে। একটা লোক রাস্তার ধারে বসে ছুরি-কাঁচি এবং অন্যান্য জিনিসপত্তর বিক্রি করছিল। চন্দন তার কাছ থেকেই কিনল ছোরাটা এবং সেটা নিজের কাছে সযত্নে লুকিয়ে রাখল। কাউকে বলল না সে কথাটা। সঙ্গে রাখল একটা হুকে বাঁধা নাইলনের দড়ি। কোথায় কী কাজে লাগে তা কে জানে? পাণ্ডব গোয়েন্দারা এইগুলো সবসময় কাছে রাখে বলেই অনেক ক্ষেত্রে বাধা-বিঘ্নকে জয় করে ফেলে। পাণ্ডব গোয়েন্দার বাবলুর হাতে অবশ্য পিস্তল থাকে। ওর তো সেরকম কিছু নেই। তবে বিপদকালে একটি ছোরার শক্তিও বড় কম নয়।

যাই হোক, নির্দিষ্ট দিনে রাত এগারোটার অনেক আগেই ওরা স্টেশনে এসে পৌঁছল। সুনন্দবাবু বললেন, আজকাল রাত দশটায় ট্রেন ধরতে গেলে কলকাতার লোকেদের বিকেল চারটেয় ঘর থেকে বেরনো উচিত। কিন্তু একথা তিনি মুখে বললেও নিজের বেলায় তা করে উঠতে পারেননি। যাচ্ছি-যাব করেও ঘর থেকে বেরোলেন রাত আটটায়। ভবানীপুর থেকে হাওড়া আসতে সময় লাগল পাক্কা দু’ঘণ্টা। আজ দ্বাদশী হলেও প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা ছিল অনেক। গতকাল বৃহস্পতিবার থাকায় আজই ঠাকুর বিসর্জনের হিড়িক যেন বেশি করে লেগে গেছে। কিন্তু ট্রেনে ওঠার মুখেই সেএক দারুণ ঝামেলা। কেন না কোনও চার্টেই নাম ছিল না ওদের।

সুনন্দবাবু তো মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। বললেন, এরকম তো সাধারণত হয় না। তারিখ ভুল হয়নি তো?

ভাস্করমামা বলল, না। তারিখ, ট্রেন নম্বর সবই তো ঠিক আছে। দেবযানী বলল, আর দরকার নেই আমাদের দেওঘর গিয়ে। চলো ফিরে যাই। খুব হয়েছে। এত নাম রয়েছে অথচ আমাদের নেই?

অবশেষে দু’-একজন কোচ অ্যাটেনডেন্ট-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাদেরই একজন খুঁজে পেতে বার করলেন নামগুলো। আসলে একটু এদিক ওদিক হয়ে গিয়েছিল।

সুনন্দবাবু টিকিট নম্বর মিলিয়ে দেখে বললেন, হ্যাঁ, এই তো। তাই তো বলি এমন তো কখনও হয় না।

ভাস্করমামার টিকিটটা অন্য বুকিং অফিস থেকে করা হয়েছিল বলে বগিটা আলাদা হয়েছিল। অবশ্য চার্টে নাম খুঁজতে কোনও অসুবিধা হয়নি। যাই হোক। এতক্ষণে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সকলে।

চন্দনের বুক ঢিপ ঢিপ করছিল এতক্ষণ। তীরে এসে তরি ডুববে নাকি রে বাবা?

কিন্তু না। শেষপর্যন্ত সব দিক রক্ষা হল। ওরা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে ঢুকে বার্থে বসে জানালার শার্সিটা তুলে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ভাস্করমামার অন্য কোচে পড়ায় চন্দনের মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব। এমন চমৎকার রাতভ্রমণে একসঙ্গে এসেও ভাস্করমামার অন্যত্র থাকাটা ঠিক যেন মেনে নেওয়া যায় না।

ভাস্করমামা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই বলল, একটা রাত তো। তাও সারা রাত নয়। শেষরাতে মানে ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই আমরা নেমে পড়ব জসিডিতে। ওর জন্য মন খারাপ করিস না চন্দন।

সুনন্দবাবু বললেন, আচ্ছা দাঁড়াও। দেখি একবার আমাদের অ্যাটেনডেন্টকে বলে কোনও ব্যবস্থা করতে পারি কি না। বলে সহাস্য বদনে এগিয়ে গেলেন অ্যাটেনডেন্ট ভদ্রলোকের কাছে। ভদ্রলোক বাঙালি। কী সাম রায় যেন। সুনন্দবাবু তাঁকে সব কথা খুলে বলতেই উনি বললেন, না না। কোনও অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া ওনারাও যখন থ্রি টায়ারে রিজার্ভেশান রয়েছে, তখন অসুবিধা কোথায়? এমনিতেই দশ বারোটা বার্থ ফাঁকা আছে। ওনাকে ওই এগারো নম্বর সাইড লোয়ারে চলে যেতে বলুন।

হু-র-র-র-রে। চন্দন প্রায় আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

ভাস্করমামাও উঠে পড়ল ওই ট্রেনে।

যাক। ভাস্করমামাকে তা হলে আলাদা থাকতে হচ্ছে না। অর্থাৎ চন্দন সব সময়ই ভাস্করমামাকে কাছে পাবে। ওঃ কী মজা। সেই স্বপ্নের দেওঘর। সেই ত্রিকূটের চূড়া। নন্দন পাহাড়। তপোবন।

এসবের কত গল্পই না শুনেছে এতকাল। এখন স্বচক্ষে সব দেখবে, আর সেই দেখার সময় ওর পাশে থাকবে তার অতি প্রিয় ভাস্করমামা। সত্যি, ভাস্করমামাকে যে কী ভাল লাগে ওর, তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। এত ভাল কাউকে লাগে না। ঠিক যেন বন্ধুর মতো। ভাস্করমামা সঙ্গে থাকলে কোনও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিশতেও ইচ্ছে করে না ওর। হঠাৎ মা দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করলেন, জয় বাবা বৈদ্যনাথ।

কী হল মা?

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে বাবা। তাই বৈদ্যনাথের উদ্দেশে একটা প্রণাম।