কর্ণ – ৫

অবশেষে সেই চরম লাঞ্ছনার মুহূর্তটি এগিয়ে এল। শকুনির সঙ্গে পাশাখেলায় মহারাজ যুধিষ্ঠির সর্বস্ব হেরে গেলেন। হেরে গেলেন একে একে প্রাণপ্রিয় ভাইদের বাজি রেখে। হেরে গেলেন নিজেকেও। যুধিষ্ঠিরের তখন প্রায় উন্মত্ত অবস্থা। জুয়াখেলার সময় জুয়াড়ি যেমন ভাবে—পরের দানটা নিশ্চয় জিতব, ঠিক সেই প্রত্যাশায় তিনি শেষ পর্যন্ত নিজেকেও বাজি রেখেছেন। কিন্তু হল না, কিছুতেই হল না। অন্তঃপুরচারিণী কৃষ্ণার কথা তাঁর মনেই ছিল না ; কিন্তু যারা আগে থেকেই জানে যে, যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে ভালবাসেন, কিন্তু পাশাখেলাটাই তিনি ভাল জানেন না—‘দ্যুতপ্রিয়শ্চ কৌন্তেয়ো ন স জানাতি দেবিতুম্’—সেই তারা যে কিচ্ছুটি না ভুলে একটি একটি করে সবই আদায় করে নেবেন যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে, তাতে সন্দেহ কী। শকুনিই মনে করিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। বললেন—নিজেকে বাজি রেখে হেরে যাওয়াটা বড় কষ্টকর মহারাজ! তা ছাড়া তোমার তো জিনিস রয়েছে। অন্য ধন অবশিষ্ট থাকতেও নিজেকে হেরে বসাটা একেবারেই ঠিক নয়—শিষ্টে সতি ধনে রাজন্ পাপ আত্মপরাজয়ঃ। ঠিক এইটুকু বলে শকুনি, পাঞ্চালী-কৃষ্ণার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। দ্রৌপদীর কথাটা ধরিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই যার পণ্য বস্তুর গুণ গাইতে থাকলেন। পণ রাখার এই নিয়ম—যেখানে টাকা পয়সা সব হেরে বহু আগে সেখানে প্রথাবহির্ভূত জিনিস বাজি রাখতে গেলে সে জিনিসের উৎকর্ষ বুঝিয়ে দিতে হয় পরপক্ষের কাছে। শকুনি বললেন—তোমার যে জিনিসটা এখনও হাতে আছে, সে হল দ্রৌপদী, তাকে বাজি রাখতে পার—পণস্ব কৃষ্ণাং পাঞ্চালীম্। সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠির যেন পণ্যের গুণ বলতে থাকলেন—জানেন তো, সে মোটেই বেঁটেও নয়, ঢ্যাঙা লম্বাও নয়, আবার রোগাও নয়। কালো-কোঁকড়া চুলের ঢাল নেমেছে পিঠ বেয়ে। মুখখানি দেখলে মনে হবে যেন পদ্মফুল ফুটেছে। ঠোঁট লাল, গায়ে লোম নেই-ই প্রায়, অঙ্গসংস্থান অপূর্ব—সুমধ্যমা চারুগাত্রী—আর স্বভাব-চরিত্তির থেকে সবকিছু—ঠিক যা যা একটা পুরুষ মানু একটা মেয়ের মধ্যে দেখতে চায়—যামিচ্ছেৎ পুরুষঃ স্ত্রিয়ম্—সেই রকমই এই পাঞ্চালী দ্রৌপদী। আমি তাকেই পণ রাখছি।

ঠিক এমনি একটা দিনের জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করে আছেন কর্ণ। প্রমত্ত যুধিষ্ঠিরের এই নগ্ন বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে সভাক্ষেত্রে যখন ধিক্কারের গুঞ্জন উঠল, তখন সবচেয়ে খুশি হলেন দুটি লোক—এক জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র যিনি কেবলই জিজ্ঞেস করছিলেন—শকুনি এই বাজিটা জিতেছে তো, জিতেছে তো? দ্বিতীয় হলেন কর্ণ। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় যাবার সময় ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সঙ্গে কর্ণের পরিচয় ছিল সহাৰ্থক তৃতীয়া বিভক্তিতে অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা এসেছেন, সঙ্গে কর্ণও গেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে দ্রৌপদীর এই বর্ণনা শুনে যিনি সজোরে প্রতিহিংসার হাসি হেসে উঠলেন তিনি কর্তৃপদে প্রযুক্ত, তিনি কর্ণ, অর্থাৎ কর্ণ হাসছেন, তাঁর সঙ্গে দুঃশাসন এবং অন্যান্য ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা হাসছেন—জহাস কর্ণো’তিভূশং সহ দুঃশাসনাদিভিঃ। বাস্তবিক পক্ষে যুধিষ্ঠির যেমনটি বর্ণনা দিলেন, এমনতর দ্রৌপদীর নগ্নরূপ কর্ণ মনে মনে অনেকবার কল্পনা করেছেন, কিন্তু সেরূপ তাঁর আয়ত্তে ছিল না। আজকে তিনি সেই রূপকল্পনায় হেসে উঠেছেন এইজন্যে যে, দ্রৌপদী, অর্জুনের জেতা দ্রৌপদী, পঞ্চপাণ্ডবের ঘরণী দ্রৌপদী আজ দুর্যোধন-শকুনির কৌশলে তাঁদের হাতের মুঠোয়। পঞ্চপাণ্ডবের উপভুক্তা নগ্না দ্রৌপদী যেমনটি কর্ণের কল্পনায় ছিল, সেই দ্রৌপদীকে আজ তিনি সবার সামনে নগ্ন দেখতে চান। তিনি আগ বাড়িয়ে হেসে উঠলেন, সবার চাইতে জোরে—অতিভূশম্।

শকুনি দ্রৌপদীর বাজি জিতবার সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনের আদেশ হল সভায় দ্রৌপদীকে নিয়ে আসবার জন্য। যে নিয়ে আসতে গেল দ্রৌপদীকে সেও কিন্তু এক সারথি জাতের লোক, সূতপুত্র। বারবার সে দ্রৌপদীর কাছে যাচ্ছে, দুর্যোধনের কাছে দ্রৌপদীর বক্তব্য পৌঁছে দিচ্ছে—এই পৌনঃপুনিকতায় দুর্যোধনের রাগ হল। তিনি দুঃশাসনকে বললেন—আসলে সূতপুত্র এই সারথির বেটা, ভীমকে দেখে ভয় পাচ্ছে, যাও তো , তুমি যাও তো ধরে নিয়ে এস দ্রৌপদীকে—স্বয়ং প্রগৃহ্যাঁনয় যাজ্ঞসেনীম্। এই যে সময়টা, সূতজাতীয় প্রাতিকামীর দ্রৌপদীর কাছে যাওয়া আসা এবং তার প্রতি ‘সূতপুত্র’ বলে দুর্যোধনের গালাগালি—এই, সময়টা কর্ন চুপ করেই ছিলেন, একটা কথাও বলেননি। কারণটা জলের মত স্পষ্ট। সূতপুত্রের পর্বটা চুকলে দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীকে অকথ্য গালাগালি দিতে দিতে উন্মুক্ত রাজসভায় নিয়ে এল, অসহায়া দ্রৌপদী যখন পাশার বাজিতে বাঁধা অসহায় পাণ্ডবদের দিকে জ্বলন্ত কটাক্ষ নিক্ষেপ করছেন, তখন দ্রৌপদীর সেই অসহায় অবস্থা বুঝেই তাঁকে এক ঝটকা দিয়ে দুঃশাসন সশব্দে হেসে বলল—তুই হলি আমাদের দাসী। সেকালের দিনে ‘দাসী’ মানে শুধু কাজকর্মের লোক বুঝত না, দাসী ছিল সময়ে অসময়ে, অবসরে পুরুষের ভোগ্যা। দুঃশাসনের এই কথাটা কর্ণের মনে এক অদ্ভুত বিকৃত আনন্দ জাগিয়ে তুলল। দুঃশাসনের ‘দাসী’ সম্বোধন মাত্রেই কর্ণ দারুণ খুশি হয়ে তাকে যেন ধন্যবাদ জানালেন শব্দটার জন্য, হেসে উঠলেন দুঃশাসনের মতোই সজোরে—কর্ণস্তু তদ্ বাক্যমতীব হৃষ্টঃ সম্পূজয়ামাস হসন্ সশব্দম্।

দ্রৌপদীকে সবার সামনে দুঃশাসন টানা-হেঁচড়া করছে, তাঁর উত্তমাঙ্গের উত্তরীয় বাস খসে পড়ে গেছে, তবু রেহাই নেই। পাণ্ডবপক্ষের ভীম খেপে উঠে দাদা যুধিষ্ঠিরকেই গালাগালি দিতে থাকলেন। কুরু-বৃদ্ধেরা কিছুই বলতে পারছেন না। এই অবস্থায় কৌরবপক্ষের একজনই এই ঘটনার নিন্দা করা আরম্ভ করলেন। তিনি দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণ। বিকর্ণ দ্রৌপদীকে পণ রাখার বৈধতা নিয়ে আইনসঙ্গতভাবে লড়াই আরম্ভ করলেন। কিন্তু পূর্বাহ্নেই যে পুরুষ-মানুষদের মধ্যে রাজ্যলোভ, পরশ্রীকাতরতা প্রবেশ করেছে তাদের কি আর আইন ভাল লাগে। অথচ যেখানে ছোটভাই হিসেবে বিকর্ণ ন্যায়সঙ্গতভাবে দুর্যোধনের বিরোধিতা আরম্ভ করেছেন, সেখানে দুর্যোধনের পক্ষে প্রতিবাদ করে জেতা মুশকিল। ঠিক এই অবস্থায় সভার হাল ধরলেন কর্ণ। কর্ণ এই মুহূর্তে ন্যায়-অন্যায় বোঝেন না। পাঁচ ভাই পাশাখেলার জাঁতাকলে আটকে ছটফট করছে, কর্ণের মজা লাগছে। পঞ্চস্বামিগর্বিতা দ্রৌপদীর বুকের প্রাবরণ-বাস খুলে পড়েছে দুঃশাসনের টানাটানিতে, কর্ণের ভাল লাগছে, তাঁর গহন মনের রুদ্ধ বিকার কথঞ্চিৎ শান্তি লাভ করছে। অন্তত দ্রৌপদীর ঘটনাটা বিকার জেনেও কর্ণ এই বিকারকে স্বাগত জানাচ্ছেন। বিকর্ণের কথা শুনে কর্ণের ভীষণ রাগ হল—ক্রোধমূৰ্ছিতঃ। রাগে বিকর্ণের হাতে একটা ঝাঁকাড় দিয়ে কর্ণ বিকর্ণকে তিরস্কার করতে থাকলেন।

কর্ণ বললেন—বিকর্ণ! অস্বীকার করি না এ সভায় অনেক বিকার দেখা যাচ্ছে—দৃশ্যন্তে বিকর্ণেহ বৈকৃতানি বহুন্যপি। অর্থাৎ কর্ণ জানেন কুলবধু দ্রৌপদীকে টানা-হ্যাঁচড়া করাটা একটা বিকার। কিন্তু তাঁর মতে দ্রৌপদী নিজেই এই বিকারের কারণ। কর্ণ বললেন—দুটি কাঠে ঘষা লেগে যে আগুন জন্মায়, সে আগুন যেমন ওই কাঠকেই পুড়িয়ে দেয়, তেমনি এই বিকারই ওই মেয়েছেলেটাকে শায়েস্তা করবে। কর্ণ বললেন—তা ছাড়া তোমার এত সোহাগ কিসের, বিকর্ণ? কই যাঁদের বউ এই দ্রৌপদী তাঁরা তো দ্রৌপদীর ডাক শুনেও টুঁ-শব্দটি করছেন না—এতে ন কিঞ্চিদপ্যাহুশ্চোদিতা হ্যপি কৃষ্ণয়া। তাঁরা তো মনে করছেন, দ্রৌপদীকে আমরা জিতেইছি। তুমি বাপু বিকর্ণ! বাচ্চা ছেলে, বাচ্চা ছেলের মতো থাক, ছোট মুখে বড়দের মতো কথা বলার দরকারটা কী তোমার—বালঃ স্থবিরভাষিতম্। তুমি দুর্যোধনের থেকে অনেক ছোট, ধর্মাধর্মের তুমি বোঝটা কী হে শুধু শুধু তখন থেকে বক বক করে বাজিতে জেতা দ্রৌপদীকে না-জেতা বলে যাচ্ছ? কর্ণ বিকর্ণকে হেঁইমারি কি সেই-মারি করে বসিয়ে দেননি পুরোপুরি। সভাস্থ লোক যেটাকে বীরপুরুষের মানসিক বিকার বলে মনে করতে পারে, সেটা যে আসলে দ্রৌপদীরই বিকার এবং সুস্থ সমাজের দিকে তাকিয়ে সে বিকার যে শান্ত করা একান্ত প্রয়োজন, সেটা বোঝাতেই যেন কর্ণ বিকর্ণকে শাসন করে কুরু-বৃদ্ধদের বোঝাতে চাইলেন।

কর্ণ বললেন-বিকর্ণ! এটা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে যে, যুধিষ্ঠির সর্বস্ব বাজি রেখে হেরেছেন। তা হলে এই দ্রৌপদী কি সেই সর্বস্বের বাইরে? কর্ণ জানেন দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের জীবন-সর্বস্ব ধন, কিন্তু সেই দ্রৌপদী এখন অঙ্কের হিসেবে পণ রাখা সর্বস্বের অভ্যন্তরা। তা ছাড়া—কর্ণ বলে চললেন—তা ছাড়া বাজির কথায় দ্রৌপদীর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে, সমস্ত

পাণ্ডবের মৌনতায় সে বাজি সমর্থিত হয়েছে, এখন তুমি বলছ দ্রৌপদীকে আমরা জিতিনি। কর্ণ এবার আসল বিকারের কথায় এলেন। দ্রৌপদীকে টানাটানি করা হচ্ছে, তাঁর উত্তরীয় খসে পড়েছে, তিনি এক কাপড়ে কুরুসভায় উপস্থিত—এগুলি কর্ণের ভাল লাগছে। বিকর্ণকে তিনি বললেন—“অবশ্য হ্যাঁ, তুমি যদি বল একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে সভায় টেনে এনে বড় অধর্ম হয়ে গেছে, তা হলেও কিন্তু আমার উত্তর আছে। তুমি তো জান, দৈববিহিত নিয়ম অনুসারে একটি স্ত্রীলোকের একটিই স্বামী থাকে। এই দ্রৌপদীর স্বামী তো একটা নয়, পাঁচটা। তবে এই মেয়েছেলে বেশ্যা ছাড়া কী—বন্ধকীতি বিনিশ্চিতা। এইরকম একটা বেশ্যা মেয়েকে উন্মুক্ত সভায় এনেছি দেখে আশ্চর্য হওয়ারও কিছুই নেই। তা ছাড়া কোনও বেশ্যা এক কাপড়ে এখানে এসেছে না উলঙ্গ হয়ে এসেছে, তাতেও মাথা খারাপ করার কিছুই নেই—একাম্বরধরত্বং বাপ্যথ বাপি বিবস্ত্ৰতা। বিকর্ণ তুমি জেনে রেখ, আমরা পাশার চালে সবাইকে জিতেছি—ধনরত্ন জিতেছি, একটি একটি করে সমস্ত পাণ্ডবদের জিতেছি, এই দ্রৌপদীকেও জিতেছি। কর্ণের মনের ভাব—সব এখন আমাদের, আমরা এদের নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করব।

যা ইচ্ছে তাই করব—এই তাগিদেই কর্ণ দুঃশাসনকে বললেন—দেখ ভাই এই বিকর্ণ ছেলেটা বড় বেড়ে পাকা হয়েছে—বিকর্ণ প্রাজ্ঞবাদিকঃ। তুমি ওর কথায় কান দিয়ো না। বরঞ্চ এক কাজ কর তো, তুমি এই সমস্ত পাণ্ডবদের আর দ্রৌপদীর কাপড়-চোপড় খুলে নিয়ে এসো তো। কর্ণের এই আদেশের নিরিখে অধিকতর অপমানের আশঙ্কায় পাণ্ডবেরা নিজেরাই নিজেদের উত্তরীয় বসনগুলি নামিয়ে দিলেন মেঝেতে। বস্তুত বীরপুরুষের পক্ষে এই ছিল যথেষ্ট অপমান। কিন্তু দ্রৌপদীর উত্তরীয় তো টানাটানিতে আগেই খসে পড়েছে এবার একবস্ত্রতার জায়গায় তাঁর বিবস্ত্রতা কাম্য হয়ে উঠেছে কর্ণের। অন্তত দুঃশাসনের কাছে কর্ণের আদেশের মর্ম ছিল তাই। ভীমের ভয়েই হোক কিংবা স্বেচ্ছায়, পাণ্ডবদের চাইতেও কুলস্ত্রীকে অপমান করতে বেশি ভাল লাগছিল বলেই দুঃশাসন দ্রৌপদীর পরিধানের বসন ধরে টান দিলেন—দ্রৌপদ্যা বসনং বলাৎ…ব্যাপাক্রস্টুং প্রচক্রমে! সবাই জানেন, কর্ণের এই আদেশ শেষ পর্যন্ত কার্যকরী করা যায়নি। অলৌকিকভাবেই হোক কিংবা লৌকিক কারণেই হোক, দ্রৌপদীর কাপড় টানার ব্যাপারটা দুঃশাসনের হাতের বাইরে চলে গেল। সুযোগ বুঝে বিদুর আবার গালাগালি দেওয়া আরম্ভ করলেন। কর্ণও যেন একটু থতমত খেয়ে গেলেন এবং যা চেয়েছিলেন তা করা গেল না বলে থতমত করেই দুঃশাসনকে আবার বললেন—“ঠিক আছে, এখন তুমি এই দাসীটাকে বাড়ির ভেতরে কোথাও রেখে এসো তো—কর্ণো দুঃশাসনং ত্বাহ কৃষ্ণাং দাসীং গৃহান্ নয়।

সত্যি বলতে কি পাশা খেলার পর যে অংশটা মহাভারতে আছে সেটা যদি অভিনয় করা যেত, তা হলে দেখা যেত নাটকের এই অংশটায় মঞ্চে প্রধান ভূমিকা হত কর্ণ এবং দ্রৌপদীর। দ্রৌপদী আত্মসম্মান বাঁচাতে ব্যস্ত আর কর্ণ যেভাবে হোক সেটা নষ্ট করতে। সভার মর্যাদা রক্ষায় একমাত্র চেষ্টা ছিল বিদুরের, আর সব কুরুবৃদ্ধেরা ছিলেন কর্তব্য নির্ণয়ে বিমূঢ়। এই অবস্থায় দুর্যোধন যে পাঁচ কথা বলে শেষ পর্যন্ত নিজের ‘কদলীস্তম্ভ সদৃশ’ ঊরুখানি দ্রৌপদীকে একবারের তরে দেখাতে পেরেছিলেন সেও বুঝি এই কর্ণের দৌলতে। দুঃশাসনের অসহায়তা দেখে দুর্যোধন আবার সেই মূল প্রশ্নে ফিরে গেলেন অর্থাৎ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলুন আমরা দ্রৌপদীকে জিতেছি কি না? দুর্যোধন খুব ভালই জানতেন যে, যুধিষ্ঠির এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না এবং এই উত্তরহীনতার অন্তরে মহাবলী ভীম আবার খানিকটা আক্রোশ প্রকাশ করায় সভামঞ্চে আবার কর্ণের ভূমিকা বড় হয়ে উঠল। যাতে আইনসঙ্গত ভাবে সব বদমায়েশি করা যায়, তারই একটা উপায় করার চেষ্টা করতে লাগলেন কর্ণ। কিন্তু মজা হল, তিনি ভীমের আক্রোশ সত্ত্বেও ভীমের সঙ্গে কথা বলছেন না। অথচ কোনও অবস্থাতেই তিনি দ্রৌপদীকে ছাড়ছেন না এবং যে সব কুরুবৃদ্ধেরা মৌনতার কৌশলে দ্রৌপদীর পক্ষ নিয়েছেন, তাঁদেরও কর্ণ এক হাত নিয়েছেন। কর্ণ বললেন—এ সভায় তিনজন আছেন যারা সবল এবং ধর্ম উল্লঙঘন করতে সমর্থ। এঁরা হলেন ভীষ্ম, দ্রোণ এবং বিদুর। এঁরা এঁদের প্রভু ধৃতরাষ্ট্রকেই দুষ্টতম বলে জানেন, অথচ তাঁর বাড়বাড়ন্ত হোক, এটাও চান, নিজেরাও কোনও পাপাচরণ করেন না—যে স্বামিনং দৃষ্টতমং বদন্তি বাঞ্ছন্তি বৃদ্ধিং ন চ বিক্ষিপন্তি। কর্ণের ভাবটা এই যে, ভীষ্ম, দ্রোণ এবং বিদুর এই তিনজনই রাজনির্ভর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও, এঁদের কিছু স্বত্ব আছে, কিন্তু দাস, পুত্র এবং স্ত্রীলোক এদের কোনও স্বাতন্ত্র্যই নেই। ঠিক যেমন এই মুহূর্তে দ্রৌপদীর কোনও স্বাতন্ত্র্যই থাকতে পারে না, কারণ তিনি দাসের পত্নী। যে মুহূর্তে পাণ্ডবেরা শকুনির পাশার চালে জিত হয়েছেন, সেই মুহূর্ত থেকেই তারা দাস, আর স্ত্রীলোকের সত্তা যেহেতু একান্ত ভাবেই পতি নির্ভর অতএব দাসের স্ত্রী দাসী। দাসের সত্তা এবং দাসের ধন যেহেতু প্রভুর অধীন তা হলে দাসের স্ত্রীতেও প্রভুরই অধিকার—দাসস্য পত্নী অধনস্য ভদ্রে হীনেশ্বরা দাসধনঞ্চ সর্বম্।

এটা বোঝা যাচ্ছে কর্ণের ওকালতি বুদ্ধি সাংঘাতিক। কর্ণ কিন্তু দ্রৌপদীর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। সেই সভাগৃহে প্রবেশ করার মুহুর্ত থেকে দ্রৌপদী যে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন অর্থাৎ যুধিষ্ঠির যদি নিজেকে আগে বাজি রেখে হেরে থাকেন তা হলে দ্রৌপদীকে আর তিনি বাজি রাখতে পারেন কিনা, এই প্রশ্নে কুরুবৃদ্ধেরা বিমূঢ় বোধ করছিলেন। কর্ণের বক্তব্য—অত কূট-কচালির দরকার কী। পাণ্ডবেরা বাজির চালে সবাই দাস আর সেকালে স্ত্রীলোকের যেহেতু স্ব-অধীনতা ছিল না—ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমৰ্হতি—সেই নিয়মে দাসের স্ত্রীও আপাতত কৌরবদের অধীন। তা ছাড়া স্বয়ং ধর্মরাজ তাঁর জন্ম, পরাক্রম এবং পৌরুষ মাথার মধ্যে না রেখে আপন স্ত্রীকে দ্যুতমুখে সমর্পণ করেছেন—এর থেকে বড় ‘পয়েন্ট’ আর কী হতে পারে। কর্ণের ওকালতি এতটাই মোটা দাগের ছিল যে, স্বয়ং ক্রোধ-কষায়িত ভীমও এক সময় যুধিষ্ঠিরকে বললেন—আমি এই সূতের ব্যাটাকে দোষ দিই না—নাহং কুপ্যে সূতপুত্রস্য রাজন্—সত্যিই তো আপনার জন্যেই আমরা দাস হয়ে গেছি, আজ অন্তত যদি পাঞ্চালী কৃষ্ণাকে আপনি বাজি না ধরতেন, তা হলে কি এই শত্রুরা আমাদের এত কথা বলতে পারে।

বেচারা ভীম! সরল ভীম জানেন না যে, তাঁর শত্রুরা বহুদিন ধরে এই মুহূর্তটির অপেক্ষা করছিল। ওকালতি নয়, কূটবুদ্ধি নয়, বিক্রম নয়—কিচ্ছু নয়, যেন তেন প্রকারেণ এই মুহূর্তটি তারা চেয়ে এসেছে। দ্রৌপদীকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করব, তাঁকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করাব—এমন একটি মুহূর্ত। অতএব কর্ণের ওকালতির ফল হল এই যে, কৌরবদের এক ভাই দুঃশাসন যখন কর্ণের আদেশ সত্ত্বেও দ্রৌপদীর পরার শাড়িটি খুলে ফেলতে পারল না, তখন বড় ভাই দুর্যোধন নিজের পরার কাপড়টিই তাঁর ঊরুমূল পর্যন্ত টেনে তুলে বাম ঊরুটি দেখাতে লাগলেন। এ এমন এক আক্রোশ যাতে অন্যজনকে বিবসনা করতে না পেরে নিজেই ন্যাংটো হয়ে গেলাম। শুধু ঊরু দেখানোই নয়, দুর্যোধন ঊরু দেখিয়ে দ্রৌপদীকে আহ্বানের হাসি হাসতে লাগলেন—স্ময়ন্নিবৈক্ষ্য পাঞ্চালীম্। দ্রৌপদীকে দেখিয়ে দেখিয়ে—দ্রৌপদ্যাঃ প্রেক্ষ্যমাণায়াঃ—দুর্যোধন যতই তাঁর ঊরু বিকশিত করতে থাকলেন, কর্ণের উৎসাহ ততই বাড়তে থাকল। এই কুৎসিত কর্মে কর্ণ যেন আপন মনোবৃত্তির চরিতার্থতা লাভ করলেন। তিনি খ্যাঁক্ খ্যাঁক্ করে হাসতে থাকলেন—অভূৎস্মায়িত্বা রাধেয়ম্।

দুর্যোধন যে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছেন, তার পেছনেও ছিল কর্ণেরই উৎসাহ। দ্রৌপদীর স্বাতন্ত্র্যহীনতা এবং দাসীত্ব প্রমাণ করার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণ বলেছিলেন—এখন থেকে পাণ্ডবেরা কেউ তোমার প্রভু নয়, কৌরবেরাই তোমার প্রভু। তুমি বরং এঁদের মধ্যে থেকে নতুন কোনও স্বামী বেছে, নাও—অন্যং বৃণীস্ব পতিমাশু ভাবিনি। কর্ণ বলেছিলেন—স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর যে কামসংক্রান্ত ব্যাপার তা বাইরে কখনও আলোচনার বিষয় হতে পারে না, কিন্তু দাসীভাবে সব কথাই চলে, আর সবচেয়ে বড় কথা ওই গোটা পাঁচেক স্বামীর রতি-বন্ধনের চেয়ে, অগুন্তি পুরুষের রতিসাহচর্য লাভ করা যাতে, এমন দাসীত্বই তোমার ভাল—পরিমিত-পতিকাদ্ দারভাবাদ্ অনন্তপতিকং দাস্যমেব তবাস্তু ইতি। কর্ণের এত কৌরবানকূল ওকালতির পরে দুর্যোধন আর স্থির থাকেন কী করে? বিশেষত দুঃশাসনের অপচেষ্টা ব্যাহত হওয়ার নিরিখে দুর্যোধন এবার নিজেরই কাপড় তুলে ফেললেন ঊরু থেকে। দেখতে থাকলেন দ্রৌপদীকে, আর বিকট কোন মর্ষকামিতায় আসতে থাকলেন কর্ণ।

না, শেষ পর্যন্ত দৈহিকভাবে কিছুই করা গেল না দ্রৌপদীকে। উপরন্তু কৌরবসভায় নানা দুর্লক্ষণ দেখা দিতে থাকল ; ভীমের ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞা উচ্চারিত হল, গান্ধারী এবং বিদুর পুনরায় ধৃতরাষ্ট্রকে প্রকৃতিস্থ করতে সফল হলেন। ধৃতরাষ্ট্রের বরে দ্রৌপদীই স্বামীদের একে একে দাসত্ব থেকে মুক্ত করলেন। সভাস্থলে কেউ আনন্দে, কেউ মুক্তিতে এবং কেউ বা নিরানন্দে—প্রত্যেকেই নিশ্চুপ হয়ে ছিলেন, কিন্তু কর্ণ দ্রৌপদীকে দেখে দ্বিতীয়বার মুগ্ধ হলেন। এই বিপরীত রঙ্গস্থলে বিপরীতধর্মী মানুষের কাছে ততোধিক বিপ্রতীপ আচরণে লাঞ্ছিতা হওয়া সত্ত্বেও দ্রৌপদী যে শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়েননি এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরই ধৈর্যে, বিদগ্ধতায় এবং তাঁরই অপমানের মুল্যে পাণ্ডবেরা যে আবার সব ফিরে পাওয়ার আশ্বাস পেলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে, এতে কর্ণ দ্বিতীয়বার মুগ্ধ হলেন। মহাভারতের কবি তাঁর এই লেখনীর পরিসরটুকু এমনভাবেই সাজিয়ে রেখেছেন যাতে মনে হবে কর্ণ বুঝি তখনই টিপ্পনী কাটছেন দ্রৌপদীর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু আমরা জানি এটি সেই মুগ্ধতা, যা তাঁকে পাঞ্চালরাজ্যের স্বয়ম্বর সভায় প্রথম মুগ্ধ করেছিল। কর্ণ বললেন—এমন কোনওদিন শুনিনি বাপু! মানুষের মধ্যে রূপবতী রমণীর কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু এমনটি কোনওদিন শুনিনি—যা নঃশ্রুতা মনুষ্যে স্ত্রিয়ো রূপেণ সম্মতাঃ! তাসামেতাদৃশং কর্ম ন কস্যাশ্চন শুশ্রুম॥ হ্যাঁ কর্ণের গলার সুর এখন অবশ্যই খুব নরম। পাণ্ডবেরা প্রত্যেকেই এখন দ্রৌপদীর কল্যাণে দাসত্বের দায় থেকে মুক্ত। কর্ণ সেদিকটাতেও একটু ইঙ্গিত করে দ্রৌপদীর প্রশংসায় যেন পাণ্ডবদের লজ্জা দিতে থাকলেন। কর্ণ বললেন-“হ্যাঁ, পাণ্ডব, কৌরব—সকলকেই যেন রাগে পেয়ে বসেছিল, সেখানে শান্তি নিয়ে এসেছে। শান্তির প্রতিমূর্তি দ্রৌপদী—কৃষ্ণা শান্তিরিহাভবৎ। কেমন এক অথই জলে ডুবে যাচ্ছিল যেন পাণ্ডবেরা সবাই, যেখানে পাঞ্চালী কৃষ্ণা যেন নৌকো হয়ে সমস্ত পাণ্ডবদের পারে এনে তুলল—পাঞ্চালী পাণ্ডুপুত্রানাং নৌরেষা পারগাভবৎ।

বাস্তবিক পক্ষে দ্রৌপদীর সম্বন্ধে কর্ণের ধারণাটা যদি এমন মুগ্ধতারই হয়, তা হলে সে মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ক্ষণেকের তরে। বিশেষত চূড়ান্ত অপমানের পর এই কথাগুলি সামান্য প্রলেপের কাজ করাতে পারে—এটা ভাবাও কর্ণের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মজা হল, যে নারকীয় অপমান শুধুমাত্র কথায় আর ভঙ্গিতে সম্পন্ন করেছিলেন কর্ণ, কোনও প্রলেপ, কোনও গৌরবই সেই কথা-ক্ষত পূরণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। তার ওপরে এখন একটা ভয়ও ধরেছিল। কৌরবদের পক্ষে প্রথমবার পাশাখেলাটা যদি ঈর্ষা কিংবা জ্ঞাতি-শ্রীকাতরতার ফল হয়, তবে দ্বিতীয়বার পাশাখেলাটা ছিল তাঁদের জীবনের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। এই কারণে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের সব কিছু ছেড়ে দিয়ে আবার অর্ধেক পথ থেকেই—ততো ব্যধ্বগতং পার্থং—দ্বিতীয়বার পাশা খেলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। পাণ্ডবেরা সভা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে দুঃশাসন তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দুর্যোধনের কাছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনের ঘরে যে ‘মিটিং’ বসেছে তাতে দেখছি এবার কর্ণও আছেন দুঃশাসন এবং শকুনির সঙ্গে। চারজনই যুক্তি করে বুঝেছেন—এবারে পাণ্ডবেরা ছাড়বেন না। ধৃতরাষ্ট্রকে তাঁরা সভয়ে জানিয়েছেন যে, অর্জুন যেভাবে বিনা কারণে গাণ্ডীব তুলে নিচ্ছে হাতে আর ভীম যেভাবে এমনি-এমনিই গদা ঘোরাচ্ছে, তাতে এবার কিছুতেই তারা ছেড়ে দেবে না—ন ক্ষংস্যন্তে। তা ছাড়া দ্রৌপদীকে যেভাবে অপমান করা হয়েছে তাতে কিছুতেই পাণ্ডবেরা বসে থাকবে না এবার—দ্রৌপদ্যাশ্চ পরিক্লেশং কস্তেষাং ক্ষন্তুমৰ্হতি। পুত্র, শ্যালক এবং কর্ণের কথার সারবত্তা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বুঝেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবদের ডেকে পাঠিয়েছেন বনবাসের পণ রেখে পাশা খেলার জন্য। কুরুবৃদ্ধেরা ধৃতরাষ্ট্রকে বারণ করেছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র কোনও যুক্তি মানেননি, কোনও প্রতিযুক্তিও দেননি। কিন্তু গান্ধারী বারণ করার পর ধৃতরাষ্ট্র একটাই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন—আমি কুরুকুলের সর্বনাশ কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারব না—অন্তঃ কামং কুলস্যাস্য ন শাক্লোমি নিবারিতুম্।

কুরুকুলের সর্বনাশের ব্যাপারে দুর্যোধনের যতখানি দোষ আছে, কর্ণের দোষ তার চেয়ে কিছু কম নয়। পরে, অনেক পরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ-শেষে শ্মশানভূমিতে দাঁড়িয়ে ধর্মদর্শিনী গান্ধারী কৌরবদের ন্যায়-অন্যায়ের একটা পর্যালোচনা করেছিলেন। গান্ধারী বলেছিলেন—মূল অপরাধটা অবশ্যই দুর্যোধন এবং শকুনির কিন্তু তাতে সব সময় ইন্ধন জুগিয়ে গেছে কর্ণ আর দুঃশাসন-কর্ণ-দুঃশাসনভ্যাঞ্চ বৃত্তো’য়ং কুরুসংক্ষয়ঃ। এই যে কৌরবসভায় দ্রৌপদীর চরম লাঞ্ছনা রূপায়িত হল তার কারণ যতখানি দুর্যোধন, তার চেয়ে অনেক বেশি কর্ণ। দুর্যোধন দ্রৌপদীকে রাজসভায় নিয়ে আসবার হুকুমটি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু রাজসভায় তাঁকে নিয়ে আসবার পর কতটা নোংরামি করা যায় এবং সেই নোংরামির মধ্যেও বা কতটা বৈচিত্র্য আনা যায় আবার সেই অশ্লীল বৈচিত্র্যও কতটা সীমাহীন করে তোলা যায়, তার সম্পূর্ণ শিল্পী ছিলেন কর্ণ। বস্তুত কৌরবসভায় অতিথি-শিল্পী হিসেবে এসেও পাশাখেলার পর্বে এমন এক জঘন্য নাটকের প্রস্তাবনা করে গেলেন তিনি, যাতে করে এরপর থেকে নাটকের গতি-প্রকৃতি রাজনীতির সুক্ষ্ম পথ ত্যাগ করে কুলবধূর ধর্ষণের কলঙ্কে কালিমাখা এক নতুন রূপ নিল,। এরপর থেকে পাণ্ডবদের রাজ্যপ্রাপ্তির প্রত্যেক প্রসঙ্গে দ্রৌপদীর কথা এসেছে। পাণ্ডবেরা বনে চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্র যখন মনে মনে ভয় পাচ্ছেন, তখন সঞ্জয় সমস্ত কথা বাদ দিয়ে দ্রৌপদীর প্রতি জঘন্য আচরণের কথা তুলেছেন। ধিক্কার দিয়েছেন দুর্যোধনের সহায় কর্ণকে, যিনি মুখে আনা যায় না এমন কথা বলেছেন দ্রৌপদীকে—দুর্যোধনশ্চ কর্ণশ্চ কটুকান্যভ্যভাষতাম্। ধৃতরাষ্ট্র নিজে স্বীকার করেছেন, কর্ণের আদেশে দ্রৌপদীর যে বস্ত্রহরণ সম্ভব হয়েছিল তাতে তৎকালীন সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণদের মধ্যে কী নিদারুণ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এবং তাঁরা কতটা রেগে গিয়েছিলেন—ব্রাহ্মণাঃ কুপিতাশ্চাসন্ দ্রৌপদ্যাঃ পরিকর্ষণে। মূলত দ্রৌপদীর কারণেই কুরুসভা থেকে বেরিয়ে যাবার পথে অর্জুনের মুখে কর্ণবধের ভীষণ প্রতিজ্ঞা উচ্চারিত হল। ভীম বললেন—সময় আসবে, যখন এই দুর্যোধন আর কর্ণ, শকুনি আর দুঃশাসনের রক্তপান করবে বসুন্ধরা। ঠিক ভীমের এই কথার সূত্র ধরেই অর্জুন প্রতিজ্ঞা করলেন—যে আমাদের দেখতে পারে না, যে আমাদের সব সময় বিদ্বেষ করে, খারাপ কথা বলে, সেই কর্ণকে আমি যুদ্ধে নাশ করব, কথা দিলাম—হন্তাহং কর্ণমাহবে।