৪
কর্ণ ছোট ছিলেন, বড় হয়েছেন। তাঁর জন্মের রহস্য তাঁর যতখানি বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে জন্ম-রহস্যে পরম্পরায় জমে ওঠা অপমান। অস্ত্রশিক্ষার ‘স্ট্রাগল’ তাঁর বয়স বাড়িয়েছে, বয়স বাড়িয়েছে রাজবাড়ির পরতন্ত্রতা। অঙ্গরাজ্যের রাজা হয়ে তিনি পরের দিনই পিতা অধিরথকে নিয়ে সিংহাসন দখলের জন্য রওনা হননি। বরঞ্চ দুর্যোধনের অসামান্য উপকারের প্রতিদানে তাঁর কাছে প্রতিদিনের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করাই যেন কর্ণের একমাত্র কাজ বলে মনে হল। দ্রোণ গুরুদক্ষিণা হিসেবে দ্রুপদকে ধরে আনতে বললে, কর্ণ কিন্তু দ্রোণের সম্পূর্ণ শিষ্য না হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলেন এবং অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এইখানে তাঁর প্রথম হার হল। আর কি, এবার তিনি হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির দৈনন্দিন পলিটিক্সে’ জড়িয়ে পড়লেন। দুর্যোধন প্রতিনিয়ত চিন্তা করছেন কী করে জ্ঞাতিভাই পাণ্ডবদের শায়েস্তা করা যায়। দুর্যোধনের সঙ্গে থাকতে থাকতে পাণ্ডবদের শাস্তিচিন্তা কর্ণেরও একান্ত আপন কর্তব্য বলে মনে হতে লাগল। আগুনে ঘি পড়ল যখন অস্ত্রপরীক্ষার দিন থেকে প্রায় এক বছর পরেই যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজের পদে অভিষেক করলেন স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র। শুধু যুবরাজ হলেও হত, রাজ্য পাওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই যুধিষ্ঠির আপন গুণ পিতা-পিতামহের কীর্তি ম্লান করে দিলেন। অন্যদিকে গুরু দ্রোণ গদগদ হয়ে অর্জুনকে দিয়ে দিলেন ব্রহ্মশিরা অস্ত্র, যা তিনি তাঁর গুরুর কাছে পরম্পরাক্রমে পেয়েছিলেন। কৌরবদের আরও রাগ হল এইজন্যে যে, যুধিষ্ঠিরের প্রতিনিধি হয়ে অর্জুন এমন কতগুলি রাজ্য জয় করে এলেন, যা তাঁর বাবাও পারেননি—ন শশাক বশে কর্তুং যং পাণ্ডুরপি বীর্যবান্। সবাই যখন ধন্যি ধন্যি করতে আরম্ভ করল, তখন দুর্যোধনের অন্তঃকক্ষে যে সামান্য কজন পাণ্ডবদের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারবার বুদ্ধি করলেন, তার মধ্যে একজন হলেন কর্ণ—দুঃশাসনশ্চ কর্ণশ্চ দুষ্টং মন্ত্রম্ অমন্ত্রয়ন্। এ কথা অবশ্য মানতে হবে যে, কৌরবদের এই সব হীন চক্রান্ত কর্ণ ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন না। কিন্তু পরতন্ত্রতা এবং অধমর্ণতার এই এক দায় যে, অনীস্পিত হলেও তিনি আস্তে আস্তে রাজবাড়ির কূট চক্রান্তগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠলেন। বারণাবতে জতুগৃহের আগুন পাণ্ডবদের গায়ে আঁচ লাগাতে পারল না, কিন্তু এই আগুনের পথ ধরে আরেক আগুন উলটে এসে লাগল হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে। এতে দুর্যোধনেরা যতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন কর্ণ। ব্যক্তিগতভাবে কর্ণ।
জতুগৃহ থেকে বেঁচে পাণ্ডবেরা এ বন সে বন ঘুরে গঙ্গাদ্বারে এসে পৌঁছলেন। সেখানে এসেই শুনলেন যজ্ঞের বেদী থেকে জন্মানো দ্রৌপদীর কথা—আগুনপানা দ্রৌপদীর কথা। শুনলেন, সেই দ্রোপদীর স্বয়ম্বর হবে। পাণ্ডবেরা ব্রহ্মচারীর বেশে এসে পৌঁছলেন পাঞ্চালে। অন্যদিক থেকে বড় বড় রাজ্যের যত রাজা-মহারাজা আছেন—তাঁরা সবাই এসে উস্থিত হলেন পাঞ্চালে। তিন ভুবনের সেরা সুন্দরী দ্রৌপদী। গায়ের রঙ কালো বটে, কিন্তু বিদগ্ধতা এবং ব্যক্তিত্বে তিনি সমস্ত রমণীকুলের মূর্ধন্যভূমিতে দাঁড়িয়ে আছেন। সবার ওপরে তাঁর জন্মলগ্নে অলৌকিকতার স্পর্শ থাকায় বহু রাজাই এলেন তাঁর পাণিপ্রার্থী হয়ে। স্বয়ম্বরা দ্রৌপদী যখন বরমাল্যের থালি নিয়ে অপেক্ষা করছেন রাজসভায়, তখন পাঞ্চাল রাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণিপ্রার্থী বড় বড় রাজাদের নাম ডাকতে থাকলেন জোরে জোরে। তার আগেই তিনি ঘোষণা করেছে—যে ওই যন্ত্রস্থিত মৎস্যচক্ষু ভেদ করতে পারবে, সেই হবে দ্রৌপদীর স্বামী! সৃষ্টদ্যুম্নর বলর মধ্যে একটু প্যাঁচ ছিল। তিনি বলেছেন—এই মহান কাজ যে করতে পারবে, সেই কুলীন, রূধান এবং বীর্যবান পুরুষই দ্রৌপদীর স্বামী হবে—কুলেন রূপেণ বলেন যুক্তঃ। তস্যাদা ভার্যা ভগিনী মমেয়ম্। হয়তো এ-কথা শুনে কর্ণের মনে একটু খটকা লেগেছিল—আবার সেই কুলের কথা! হয়তো ভাবলেন—সাজানো বক্তৃতার মধ্যে কুলের কথাটা অভ্যাসবশেই এসেছে নিশ্চয়। কিন্তু একী! বড় বড় রাজাদের নাম ডাকার সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন তো দুর্যোধন, দুঃশাসন, এমনকী, দুর্বিষহ, দুর্মুখ নামে ধৃতরাষ্ট্রের অকর্মা ছেলেগুলিরও নাম করলেন। এমনকী ধৃতরাষ্ট্রের যে ছেলেগুলির নাম বলা গেল না, ধৃষ্টদ্যুম্ন তাদেরও কারক-বিভক্তি ঠিক করে কর্ত্তৃপদে ব্যবহার করলেন। আর কর্ণের কথা বলতে গিয়ে বললেন—ওঁদের সঙ্গে এসেছেন কর্ণও—কর্ণেন সুহিতা বীরা স্তদর্থং সমুপাগতাঃ। কারক-বিভক্তির এই অপব্যবহার কর্ণের মনে লাগে বইকি! তবু তিনি ভাবলেন—যাকগে, তীর ছোঁড়ার সময় দেখা যাবে, তখন আর কাউকে কলকে পেতে হবে না।
সত্যিই তো তাই, মৎস্য-চক্ষু ভেদ করার সময় দুর্যোধন, শাল্ব, শল্যেরা তো কিছুই করতে পারলেন না। না হয় ধৃষ্টদ কর্ণের নামটা যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে বলেননি, তাই বলে কি মহাভারতের কবিও নির্মমতায় মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন কর্ণের দিক থেকে। কবি সমস্ত ধনুক-তোলা রাজাদের মধ্যে হাহাকার আর্তস্বর তুলে দিয়ে বলেছেন—রূপে, ক্ষমতায়, কুলগর্বে, টাকাপয়সা, যৌবনে যারা বলীয়ান,—রূপেণ বীর্ষেণ কুলেন চৈব শীলেন বিত্তেন চ যৌবনেন,—তারা তো প্রথম থেকেই একসঙ্গে কৃষ্ণাকে পাবার জন্য লাফিয়ে উঠেছিলেন লক্ষ্যভেদ করতে ; কিন্তু তাঁরা য়ে সবাই একে একে ধনুক তুলতে গিয়ে মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়েছেন—বিচেষ্টমানা ধরণীতলস্থাঃ। কর্ণ এতক্ষণ বংশবাগীশ রাজাদের মুরোদ দেখছিলেন। কর্ণের প্রতি মমতায় ব্যাস অন্তত তাই বলেছেন—সর্বান্ নৃপাংস্তান্ প্রসমীক্ষ্য কর্ণ—সমস্ত রাজাদের চেষ্টা-চরিত্তির দেখে, ধনুর্ধারী বীরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্ণ এর গলন ধনুকের কাছে-ধনুর্ধরাণাং প্রবরো জগাম।
না, অন্যান্য তথাকথিত বীরদের মতো দ্রুপদের রাখা ধনুক তুলতে গিয়ে কর্ণের গলার হারটি খসে পড়েনি, শিথিল হয়নি হাতের কাঁকন—বিস্রস্তহারাঙ্গদচক্রবালম্। কর্ণ ধনুক তুললেন এক মুহুর্তে, উদ্যত ধনুকে গুণ পরালেন সঙ্গে সঙ্গে এবং তাতে লক্ষ্যভেদী বাণ জুড়লেন চোখের নিমেষে। এই তৎপরতা দেখেও যাঁরা ভাবলেন কর্ণ লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে জিতে নিতে পারবেন না, তাঁরা হচ্ছেন সেই আহাম্মকেরা, যাঁরা পূর্বে ধনুক তোলার চেষ্টা করে মাটিতে গেঁড়ে বসেছেন। কিন্তু ধনুকের রীতিনিয়ম যাঁরা জানেন, সেই পাণ্ডবেরা কিন্তু ব্রহ্মচারীর মতো বসে থেকেও কর্ণকে দেখে সবিষাদে নিশ্চিত হলেন যে, আর দ্রৌপদীকে পাওয়া হল না, কর্ণ তাঁকে লক্ষ্যভেদ করে এই নিয়ে নিল বলে। আর দ্রৌপদী, যিনি এতক্ষণ বরমাল্য হাতে মজা দেখছিলেন, স্বয়ম্বরের শর্ত অনুযায়ী লক্ষ্যভেদ করলেই যাঁর বরমাল্য হাতে এগিয়ে আসার কথা, সেই দ্রৌপদী নিশ্চয় ভাবছিলেন—এ পুরুষটি যেন ধনুক তুলতেই না পারে। কিন্তু এবার! লোকে যে এই মানুষটাকে সূতপুত্র বলে জানে, শেষে অলৌকিক আগুন থেকে জন্ম নিয়ে সারথি জাতের গলায় মালা! সমস্ত সভাকক্ষ উচ্চকিত করে দ্রৌপদী রীতিমতো চেঁচিয়ে বললেন—আমি কিন্তু সূতপুত্রকে বরণ করব না—নাহং বরয়ামি সূতম্।
কর্ণ মনে মনে প্রচণ্ড রেগে গেলেন, সামনে হয়তো তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে তাঁর চিরপরিচিত বিকল্প, সূর্যের দিকে তাকালেন—সামর্ষহাসং প্রসমীক্ষ্য সূর্যম্—ছুড়ে ফেলে দিলেন ধনুকটি। এই যে কর্ণ মাঝে মাঝেই সংকটকালে সূর্যের দিকে তাকান, এর একটা অভিনব ব্যাখ্যা দিয়েছেন মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ। নীলকণ্ঠের ধারণা, কর্ণ তাঁর নিজের জন্মবৃত্তান্ত জানতেন, অন্তত সূর্যের ঔরসে যে তাঁব জন্ম, এটা তিনি জানতেন। পিতা অধিরথ এবং মাতা রাধার সগৌরব ব্যবহার এও হয়তো কর্ণের ধারণা ছিল যে, এই সূতবংশের সঙ্গে তার যোগ হয়েছে মাত্র, এঁরা তাঁর জন্মদাতা নন। ভাগ্যের পরিহাসে সূত পিতামাতার স্নেহসম্বন্ধ কর্ণ কখনও অস্বীকার করবেন না বা করতে চানও না, কিন্তু এই সব বিপন্ন মুহূর্তে সূতবংশের সঙ্গে তাঁর আরোপিত কৌলিক যোগ আছে বলে মনে মনে তিনি ভীষণ রেগে যান। নীলকণ্ঠের ধারণা দ্রৌপদীর উচ্চ প্রত্যাখ্যানের পর যে তাঁর রাগ হয়েছে তা এই কারণেই—নীচকুলযোগাদ্ অমর্যঃ। আর কর্ণ যে তবু হাসলেন, সে হাসি দ্রৌপদীকে তাচ্ছিল্য করে নয়। নীলকণ্ঠ মনে করেন, ও হাসিটা সূর্যের প্রতি কটাক্ষ। ভাবটা এই—কার অপরাধে কার শাস্তি,—অতএব সূর্যাপরাধত্বাৎ হাসঃ।
আমরা যদি নীলকণ্ঠের মতো অত গভীরে নাও যাই, যদি বলি যোগ্য ব্যক্তিকে অহেতুক ছুতোয় দ্রৌপদী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলেই কর্ণের রাগ হয়েছে এবং তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছেন তিনি, তা হলেও কোনও ক্ষতি নেই। বস্তুত কর্ণের মনস্তত্ত্ব-গঠনে দুটি নারীর অবদান সাংঘাতিক। কর্ণেব জীবনে যে বিকারগুলি ঘটেছে, যে আচরণগুলি তাঁর জীবনে পরস্পরবিরোধী—সেই বিকার এবং স্বতোবিরোধিতার মূলে আছে দুটি নারীর ভূমিকা—এবং সে দুটিই প্রত্যাখ্যানের কাহিনী। এই দুই নারীর প্রথমটি কুত্তী, দ্বিতীয়জন দ্রৌপদী। প্রথমজন অতি শৈশবে জন্মলগ্নেই কর্ণের প্রতি তাঁর পুত্র-সম্বন্ধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দ্বিতীয়জন যৌবনে যোগ্য-পুরুষের যোগ্যতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যদি বা কুন্তীর দিক থেকে পুত্রত্ব-অস্বীকারের পরেও সূতজননীর স্নেহপ্রলেপে সে জ্বালা কিছুটা কমেছিল, যৌবনোদ্দীপ্ত বীরপুরুষের পৌরুষ অস্বীকার করে সে জ্বালা চতুগুণ বাড়িয়ে তুললেন এমন এক রমণী, যিনি একমাত্র পুরুষকারের দ্বারা লক্ষ্যভেদ মাত্রেই যে কোনও পুরুষের দ্বারা জিতা হবেন বলে পূর্বাহ্নেই স্বীকৃত। উন্মুক্ত সভাস্থলে দ্রৌপদীর এই অপমান কর্ণ কোনওদিন ভোলেননি এবং ভোলেননি বলেই এ অপমান কর্ণের মনের গভীরে এমন এক কূট অন্তঃক্রিয়া করেছিল যা থেকে দ্রৌপদী কোনওদিন রেহাই পাননি; পরস্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও নয়।
বারণাবতের অগ্নিকাণ্ড বানচাল হয়ে গেল এবং উলটে পাণ্ডবেরা বেঁচে ফিরে উপহারের মতন পেলেন দ্রৌপদীকে—এই ঘটনা কৌরবশিবিরে দারুণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করল। দুপদের রাজসভায় দ্রৌপদীর বিয়েকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবেশী অর্জুনের সঙ্গে কর্ণের যুদ্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু কর্ণ তখন অর্জুনকে চিনতে পারেননি। সন্দেহ হয়েছিল অবশ্য ; কর্ণ বলেও ফেলেছিলেন—ব্রাহ্মণ! যুদ্ধে তোমার নৈপুণ্য দেখে আমি তুষ্ট হয়েছি—তুষ্যামি তে বিপ্রমুখ্য—কিন্তু সত্যি বলতে কি সাক্ষাৎ ইন্দ্র ছাড়া কিংবা অর্জুন ছাড়া আমার সঙ্গে এমনিতর এতক্ষণ যুদ্ধ করবে, এ হতেই পারে না। তুমি কি বাপু পরশুরাম না সাক্ষাৎ হরিহর। অর্জুন তখন মিথ্যে কথা বলেছিলেন। যুদ্ধ থামানোর জন্যই হোক, কিংবা নববধূর বিস্মিত, স্ফুরিত মুখখানি দেখার জন্যই হোক, অৰ্জুন বলেছিলেন—আমি পরশুরামও নই, অন্য কেউই নই ; আমি ব্রাহ্মণ। আজকে তোমাকে যুদ্ধে জয় করব বলেই এখানে উপস্থিত, তুমি ক্ষান্ত হও আজ—বীর স্থিরো ভব। অর্জুনের মধ্যে প্রচুর ব্রাহ্মতেজ আছে, এইরকম একটা বিচারেই কর্ণ সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষান্তি দিলেন—ব্রাহ্মং তেজস্তদাযজ্যং মন্যমানো মহারথঃ। কিন্তু আজকে যখন চর এসে কৌরবশিবিরে খবর দিল যে, দ্রৌপদীকে অর্জুনই জিতে নিয়েছে এবং ভীম, অর্জুন সকলেই ব্রাহ্মণের বেশ ধরে সবাইকে বোকা বানিয়েছে, তখন কৌরবপক্ষে নিজেদের মধ্যে যেন ধিক্কার উঠল। একে তো জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচেছে পাণ্ডরেরা, তার মধ্যে আবার অর্জুন জিতে নিল দ্রৌপদীর মত সুন্দরীকে—এত সব ভেবে দুর্যোধন, দুঃশাসুখ, কর্ণ, শকুনি—সবাই মাথা নিচু করে বসেছিলেন। দুঃশাসনটার লজ্জা একটু কম। সে যেন কর্ণয়ে তাঁর পুরনো সংলাপ স্মরণ করিয়ে দিয়েই চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকল—বেটা যদি বামুনের বেশ ধরে না থাকত তা হলে আর পেতে হত না দ্রৌপদীকে। ভাবটা এই—আমাদের কর্ণ তা হলে দিত ঠাণ্ডা করে ওই অর্জুনটাকে। দুঃশাসন বললেন—সবই কপাল, দাদা! সবই কপাল—দৈবঞ্চ পরমং মন্যে—নইলে একটা লোকও সেদিন অর্জুনকে চিনতে পারল না।
পাণ্ডবদের এমন সফলতায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রও বড় খুশি হলেন না। বিদুরের সামনে মিথ্যে আনন্দ দেখিয়ে দুর্যোধনকে তিনি বললেন—তোমাদের যা হচ্ছে, আমি তাই করব—যচ্চ ত্বং মনসে প্রাপ্তং তদ্ ব্রবীহি সুযোধন। কর্ণকে বললেন—এই অবস্থায় কী করা যায় শীগগির বলো, কর্ণ। কী করা যায়—এমন প্রস্তাবে স্বাভাবিকভাবে দুর্যোধনই প্রথমে বলবেন। তিনি অনেকগুলি প্রস্তাব দিলেন। বললেন—আমরা এবার ওদের মধ্যে পারস্পরিক ভেদ তৈরি করব। ভাল গুপ্তচর দিয়ে এমন কৌশল করা যেতে পারে যাতে সৎমা মাদ্রীর ছেলেদুটো কুন্তীর ছেলে তিনটেকে বিষ নজরে দেখে। দ্বিতীয়ত এমন করা যেতে পারে যে, দ্রুপদ, দ্রুপদের ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্ন, এমনকী দ্রুপদের মন্ত্রীদের পর্যন্ত টাকা পয়সা খাইয়ে এমন করব যাতে যুধিষ্ঠিরকে তাঁরা ত্যাগই করে বসবেন, কিংবা যুধিষ্ঠিরের কানের কাছে সদা-সর্বদা গুপ্তচররা বলবে—হস্তিনাপুর অতি বাজে জায়গা, তোমরা বাপু এখানেই থাক। তৃতীয়ত আর একটা উপায় হতে পারে যে, অত্যন্ত বিশ্বস্ত গুপ্তচর গিয়ে নববধু দ্রৌপদীর মনে বহুস্বামিতার দোষ জাগিয়ে তুলবে। এটা করা খুব কঠিন হবে না, কারণ দ্রৌপদী সে কষ্ট নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে বহুত্বৎ সুকরং হি তৎ—তারপর স্বামী স্বামীতে ঝগড়া-ঝাঁটি লাগিয়ে দিয়ে গুপ্তচর কেটে পড়বে। চতুর্থ উপায়, ছদ্মবেশে সেই রকম কিছু মানুষ গিয়ে ভীমকে মেরে ফেলুক, আর ভীম মারা গেলে ওই অর্জুনটা আমাদের কর্ণের কড়ে আঙুলের যোগ্যও নয়—রাধেয়স্য ন পাদভাক্ (‘পাদভাক্’ মানে নীলকণ্ঠ বলেছেন, কর্ণের এক চতুর্থাংশের সমানও হবে না)। দুর্যোধন বললেন—অথবা আরেক কাজ করা যেতে পারে, দারুণ দেখতে কতকগুলি মেয়েছেলে পাঠান। তারা গিয়ে এক একটি পাণ্ডবকে ধরবে আর রঙ্গ-রসে মজিয়ে দেবে, তখন দ্রৌপদীই ওদের ওপর রাগ করে ভেগে যাবে—অথবা দর্শনীয়াভিঃ প্রমদাভি র্বিলোভ্যতাম্। আর এটাও আপনার ভাল না লাগলে কর্ণকে পাঠান পাণ্ডবদের নিয়ে আসতে। তারপর নিয়ে আসার পথে গুপ্তঘাতক দিয়ে রাস্তাতেই পাণ্ডবদের সাবাড় করে দিন। এতগুলো প্রস্তাব দিলাম, আপনি যেটা ইচ্ছে করুন। একেবারে সব কথার শেষে দুর্যোধন বললেন—কর্ণ, কী বলো, উপায়গুলো দারুণ না?
গুপ্তহত্যা, মেয়েছেলে পাঠানো, শেষে—কৰ্ণ গিয়ে পাণ্ডবদের নিয়ে আসবেন আর রাস্তায় গুমখুন—এইসব কাপুরুষোচিত উপায় কর্ণের একটুও পছন্দ হল না। যুধ্যমান অবস্থায় অর্জুনকে ব্রাহ্মণ ভেবে হঠাৎ যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছেন, সেই ভুল এখনও কর্ণের হাতে পায়ে কামড় দিচ্ছে, সেই তিনি কিনা গুম-খুন করাবেন পাণ্ডবদের! তার ওপরে ওই এক লহমার দেখায়, একবার উচ্চ-চকিত কথায় দ্রৌপদীর স্বভাব তিনি বুঝে গেছেন। যাঁকে তিনি বীরতার প্রতিদানে পেতে চেয়েছিলেন তাঁকে যে কর্ণের ভাল লেগেছিল। সেই মনের মানুষ অপমান করেছে বলেই তাঁকে তিনি এখন ঘেন্না করেন। তবু দুর্যোধনের উপায় কৌশলগুলি কর্ণের একটুও পছন্দ হল না। এই প্রথম প্রকাশ্যে তিনি দুর্যোধনের কথার প্রতিবাদ করলেন। বিশেষত কর্ণ লুকিয়ে ছদ্মবেশী ঘাতক দিয়ে পাণ্ডবদের খুন করাবেন—এই স্তাব কর্ণের পৌরুষে আঘাত দিল। তিনি প্রতিবাদ জানালেন দুর্যোধনের প্রত্যেকটি প্রস্তাবে।
কর্ণ বললেন—তোমার কথা আমার একটুও ঠিক মনে হচ্ছে না, দুর্যোধন! পাণ্ডবদের বধ করার জন্য অনেক কূট কৌশল, অনেক সূক্ষ্ম উপায় আগেও তোমার মাথা থেকে বেরিয়েছে, কিছুই হয়নি, তুমি কিছুই করতে পারনি। পাণ্ডবেরা যখন শিশুটি ছিল, ডানা-না-গজানো পাখির মতো, তখন এখানে থাকা সত্ত্বেও তুমি তাদের কিছুই করতে পারনি। এখন তারা হাতের বাইরে, বিদেশে। তারপরে দ্রুপদ রাজার সহায়তায় তাদের শ্রীবৃদ্ধিও ঘটেছে। এখন কি আর তাদের কৌশল করে কাত করা যায়? তারপর দ্রৌপদীর কথাটা তুমি কী বললে? যেখানে পাঁচ ভাই মিলে একটি বউ বিয়ে করেছে, তাদের মধ্যে কখনও বিরোধ বাধে? বউদের জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়াঝাটি হবে না বলেই তো একটা বউ, সেখানে কখনও ঝগড়া বাধে—একস্যাং যে রতাঃ পত্নাং ন ভিদ্যন্তে পরস্পরম্? তার ওপরে আর একটা ব্যাপার কী জান। দ্রৌপদী যখন পাণ্ডবদের বরণ করেছেন, তখন তাঁদের খারাপ অবস্থা, দীন ব্রহ্মচারী বেশ—এসব দেখেশুনে মনে মনে তাঁদের দীনাবস্থা মেনে নিয়েই বরণ করেছেন, সেই দ্রৌপদীর মন ভাঙানো অত সহজ হবে না জেনো। দ্রৌপদীর দৃঢ়তা কতখানি কর্ণ তা সত্যিই জানেন। উন্মুক্ত সভাস্থলে তাঁর নিজের প্রতি যে অপমান-বাক্য বর্ষিত হয়েছিল তাতেও যেমন দৃঢ়তা ফুটে উঠেছিল দ্রৌপদীর, কর্ণ মনে করেন, সেই দৃঢ়তাতেই ওই মেয়ে সমস্ত রাজা-মহারাজা ত্যাগ করে অর্জুনকে অর্জুন না জেনেই, পাণ্ডবদের দীনতার সঙ্গেই বরণ করেছে। ওই মেয়েকে ফুসলানো কি অত সহজ? এইবার কর্ণের মনে ভেসে উঠল সেই অপমান, সূত্রপূত্র বলে তাকে বিয়ে না করার অপমান। দ্রৌপদীর সমস্ত দৃঢ়তা জেনেও তাঁর কেবলই মনে হতে লাগল তাঁরই খাবার গ্রাস, পাণ্ডবেরা সবাই মিলে যেন চেটেপুটে খাচ্ছে। এতে যে দ্রৌপদীরই কাম-অভিলাষ পরিতৃপ্ত হচ্ছে। কর্ণ বললেন—“জানো দুর্যোধন। মেয়েদে এক স্থায়ী কা সত্বেও সব সময় তাদের ইচ্ছা কারে আরও পুরুষমানুষ তাকে ভোগ করুক—ঈস্পিতশ্চ গুনঃ স্ত্রীণাম্ একস্য বহুভর্ত্তৃতা। সেখানে রমণীকুলের পরম বাঞ্ছিত এই বহুপুরুষের ভোগ একেবারে নাই মনেই পাচ্ছে দ্রৌপদী—এই রমণীকে কি ফুসলানো যায়–ন সা ভেদয়িতুং ক্ষমা।
শুধু অর্জুন নয়, এলেবেলে নকুল-সহদেবকে নিয়ে পাঁচজন পুরুষমানুষ দ্রৌপদীকে ভোগ করছে—মনে মনে এই পীড়নই কর্ণকে দ্রৌপদীর বিরুদ্ধে বারবার প্ররোচিত করেছে। তবু এ কথা পরে হবে। প্রথমে মনে রাখতে হবে, হস্তিনাপুরে একটা ‘ডাবল-অ্যাডমিন্ক্টেশন’ চলছিল। এই দ্বৈতশাসনের একদিকে আছেন ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ—এইসব প্রাজ্ঞ এবং বৃদ্ধ পুরুষেরা। অন্যদিকে আছেন দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি, কর্ণ, অশ্বত্থামা—এঁরা। মাঝখানে আছেন রাজা ধৃতরাষ্ট্র, যিনি চক্ষুষ্মত্তার পরিচয় দিয়ে একবার ভীষ্ম-দ্রোণের দিকে হেলেন আবার পরমুহূর্তে উচ্চাভিলাষের অন্ধতায় দুর্যোধন-কর্ণের দিকে হেলেন। কিন্তু এই দুর্যোধন-দুঃশাসনের যে যুবগোষ্ঠী, এই গোষ্ঠীতে অতি অল্পকালের মধ্যেই অতি উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছেন কর্ণ। এই স্থান এতটাই উঁচুতে যে, কর্ণ দুর্যোধনের সমস্ত কূট প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে সোজাসুজি যুদ্ধের প্রস্তাব দিয়েছেন। কর্ণের মতে ঠিক তখনই ছিল যুদ্ধের প্রকৃষ্ট সময়। কারণ পাণ্ডবদের শিকড় তত দৃঢ় নয়, পাঞ্চালেরাও কমজোরি। যতক্ষণে কৃষ্ণ যাদব বাহিনী নিয়ে না আসছেন, যতক্ষণে পাণ্ডবেরা সৈন্য-সামন্ত সংগ্রহ করে বলশালী না হচ্ছেন, তার আগেই কৌরববাহিনী সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ক পাণ্ডবদের ওপর—এই ছিল কর্ণের প্রস্তাব। কর্ণের মনোভাব যখন এতখানি দুঃসাহসিক, সেখানে ভীষ্ম-দ্রোণ যখন সস্ত্রীক পাণ্ডবদের প্রায় আরতি করে রাজ্যে ফিরিয়ে আনতে বললেন, তখন কর্ণ আর থাকতে পারলেন না। তিনি ভীষ্ম আর দ্রোণকে সোজাসুজিই প্রায় ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার ‘দুষ্ট মন্ত্রী’ বলে চিহ্নিত করেন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি পরিষ্কার জানান—মহারাজ! আপনি আপনার দুষ্ট মন্ত্রীদের থেকে সাবধান থাকবেন এবং আপনার মন্ত্রণাদাতাদের মধ্যে দুষ্ট নয় যাঁরা তাঁদেরও আপনি চিনে নিন—দুষ্টানাঞ্চৈব বোদ্ধব্যম্ অদুষ্টামাঞ্চ ভাষিতম্। কর্ণ যে ভীষ্ম-দ্রোণের মতো বৃদ্ধ মন্ত্রীদের সামনেই তাঁদের প্রতি কটুক্তি করতে পারলেন—এটা থেকে বোঝা যায় দুর্যোধনের গোষ্ঠীতে কর্ণ কতটা স্থান করে নিতে পেরেছিলেন। অবশ্য তাঁর এই শক্তি বাড়ার পিছনে দু-একটা সামান্য কারণ আছে, সেটা আগেই বলে নিই।
দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ—এঁরা সকলেই একসময় দ্রৌপদীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কারও অপদার্থতায়, কারও বা দুর্ভাগ্যে সে বিয়ে হয়ে উঠল না। এর মধ্যে কিছু সময় চলেও গেল এবং খবর এল যে, উড়িষ্যার রাজা চিত্রাঙ্গদ তার মেয়েকে স্বয়ম্বর সভায় ঈঙ্গিত পতি লাভের সুযোগ দেবেন। দুর্যোধন বলেন—দুর! দ্রোপদী কালো মেয়ে, তার ওপর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। ভাগ্যিস ধনুক তুলতে পারিনি। আর দ্রৌপদীর সঙ্গে বিয়ে হয়নি বলে, অন্য সুন্দরীদের হৃদয়ে স্থান না দিয়ে, তিনি মানব জমিন পতিত রাখবেন কেন? অতএব কর্ণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্যোধন উড়িষ্যা রাজ্যের রাজপুর নগরে এসে পৌঁছলেন। এখানেও অনেক বড় বড় রাজা—জরাসন্ধ, শিশুপাল—সবাই এসেছেন। স্বয়ম্বর সভায় একটা একটা করে রাজার নাম বলা হতে থাকল কিন্তু কলিঙ্গরাজনন্দিনী দুর্যোধনের নাম শুনেও তাঁকে অতিক্রম করে গেলেন—অত্যক্ৰামদ্ ধার্ত্তরাষ্ট্রং সা কন্যা বরবর্ণিনী। যত সুন্দরীই হোক একটি উড়িয়া রমণী পর্যন্ত তাঁকে অতিক্রম করে যাচ্ছে, এটা দুর্যোধনের কাছে দুর্বিষহ। তিনি সমস্ত রাজমণ্ডলের সামনে সেই কলিঙ্গ-নন্দিনীকে রথে নিয়ে তুললেন এবং চললেন হস্তিনাপুরের দিকে। এটা সমবেত রাজমণ্ডলীর অপমান। তাঁরা আক্রমণ করলেন দুর্যোধনকে। এবারে এই রাজমণ্ডলের পেছনে ধাওয়া করলেন কর্ণ। কর্ণ এক এক বাণে এক এক রাজার ধনুক-বাণ সব কেটে ফেললেন। কর্ণের বাণের গতিতে পর্যুদস্ত হয়ে তাঁদের আর দ্বিতীয়বার ধনুক তোলা হল না। তাঁরা এবার পালাতে লাগলেন। এবার শুধুমাত্র একা কর্ণের ক্ষমতায় দুর্যোধন একটি রাজকুমারীকে বিয়ে করে আনতে পারলেন। দুর্যোধন এতে বড় খুশি হলেন। এর অবধারিত ফল দুর্যোধনের গোষ্ঠীতে কর্ণের শক্তিবৃদ্ধি হল।
কর্ণের শক্তিবৃদ্ধির আরেক কারণ মগধরাজ জরাসন্ধ। মনে রাখতে হবে, দুর্যোধন, কর্ণ যখন প্রায় যুবক, সেইসময়ে জরাসন্ধের মত প্রবল রাজা দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। কলিঙ্গরাজ্যের এই স্বয়ম্বরে। যৌবনোদ্দীপ্ত কর্ণের যুদ্ধনৈপুণ্য দেখে প্রাজ্ঞ জরাসন্ধের বেশ ভাল লাগল। তিনি এই নতুন ছেলেটির মধ্যে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে তাঁকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। নিছকই পরীক্ষার জন্য। নানা অস্ত্রে, নানা প্রহরণে দুজনের যুদ্ধ আরম্ভ হল। কখনও এঁর বাণ কাটা পড়ে, কখনও ওঁর, কখনও অন্যতরের আঘাতে এঁর ধনুক কিংবা খড়গ খসে পড়ে হাত থেকে, কখনও বা ওঁর। এইভাবে অস্ত্র-শস্তর শেষ হয়ে এলে শেষে কুস্তাকুস্তি আরম্ভ হল। কেউ হারেন না। কিন্তু জরাসন্ধ অধিক বলবান হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু জীর্ণ হয়ে পড়েছিলেন, তাই তিনিই যুদ্ধে ক্ষান্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন কর্ণকে। ভারী খুশি হয়ে তিনি মগধের অন্তর্গত মালিনী নগরীটি উপহার হিসেবে দিয়ে দিলেন কর্ণকে—প্রীত্যা দদৌ স কর্ণায় মালিনীং নগরীমথ। নিজের রাজ্য অঙ্গের সঙ্গে মালিনীর যোগ হওয়ায় কর্ণের রাজ্য বড় হল। তাঁর পিতার আবাসভূমি চম্পা নগরীর শাসনভারও ছিল কর্ণের ওপরেই, যদিও অনেকে মনে করেন চম্পা ছিল অঙ্গরাজ্যেরই ভুক্তি বিশেষ। যাই হোক জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধ-পরীক্ষায় কর্ণ পাশ করায় তাঁর মান-সম্মান রাজ্য-সম্পদ সবই বেড়ে গেল। ঠিক এই অবস্থায় তাঁর স্নেহময় জনক-জননী যে ছেলের বিয়ে দেবার জন্য ব্যাকুল হবেন, তাতে আশ্চর্য কী? দ্রৌপদীর মত অভীষ্টা রমণীকে পাওয়া গেল না, অন্যদিকে তাঁরই সহায়তায় দুর্যোধনেরও বিয়ে হয়ে গেল। তাই বলে অন্য কোনও স্বয়ম্বর সভায় কন্যা-হরণ করতে গিয়ে আবার যদি কেউ দ্রৌপদীর মতো সূতপুত্রের কলঙ্ক দিয়ে বসে, তাই নিজে কোনও স্বয়ম্বর সভায় বিয়ে করতে যেতে সংকুচিত হয়েছেন কর্ণ। পিতা-মাতাও নিশ্চয় ব্যস্ত হয়েছেন তাঁর বিয়ের জন্য। আর বিশেষত প্রিয়বন্ধু দুর্যোধনের বিয়ের পর কর্মহীন কোনও অবকাশে তাঁর নিজের মনও বুঝি ব্যাকুল হল। অতএব পিতা-মাতার পছন্দ করা নির্ঝঞ্ঝাট সূত-সুন্দরীরাই তাঁর কাছে বেশ কাম্য মনে হল। পরবর্তীকালে কর্ণ স্বয়ং কৃষ্ণের কাছে সশ্রদ্ধে স্বীকার করেছেন যে, কত যত্ন করে তাঁর পিতা অধিরথ অন্তত তিনটি সূতজাতীয় রমণীর সঙ্গে কর্ণের বিয়ে দিয়েছিলেন—ভার্যাশ্চোঢ়া মম প্রাপ্তে যৌবনে তৎপরিগ্রহাৎ।
রাজ্য বড় হয়েছে, দুর্যোধনের যুবগোষ্ঠীতে তাঁর মর্যাদা বেড়েছে, তিনটি রমণীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে, তবু কিন্তু কর্ণের মনে সুখ নেই। সত্যি কথা বলতে কী দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না, দ্রৌপদীর বদলে তিন তিনটি বউ পেলেও উতলা বসন্ত-বাতাসের দীর্ঘশ্বাস তাঁর মনকে যে এখনও ভীষণ আকুল করে তোলে, দ্রৌপদীকে যে তিনি এখনও ভুলতে পারেন না। আর ভুলবেনই বা কী। করে? যাঁদের ঘরে দ্রৌপদী বধূ হিসেবে মিলিত হয়েছেন, তাঁদেরও যে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। যে জরাসন্ধের সঙ্গে কর্ণের দ্বৈরথ যুদ্ধমাত্রেই কর্ণের মর্যাদা বেড়ে গিয়েছিল, সেই জরাসন্ধকে মধ্যমপাণ্ডব ভীম মেরেই ফেলেছেন। তার ওপরে ধৃতরাষ্ট্রের দেওয়া খাণ্ডবপ্রস্থকে ভেঙে-গড়ে এখন ইন্দ্রপ্রস্থ বানিয়েছেন পাণ্ডবেরা, যা অনেকেরই ঈর্ষার কারণ। তার মধ্যে আছে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ষজ্ঞ। এই যজ্ঞের সূত্রেই জরাসন্ধবিজেতা ভীম কর্ণের রাজ্য অঙ্গদেশ আক্রমণ করেছিলেন—কৰ্ণমভ্যদ্রবদ্ বলী! তবে হ্যাঁ, ভীমের চতুরঙ্গ বাহিনী আর ভীমের শক্তির কাছে যে কর্ণ হার মানলেন, এ কথাটা আমরা সোজাসুজি বিশ্বাস করি না, কর্ণ হার মানলেন জরাসন্ধ বিজেতা ভীমের কাছে, যাঁর আধিপত্য সমস্ত পূর্ব ভারত তখনকার মতো স্বীকার করে নিয়েছে। সে যাই হোক ভারতবর্ষের সমস্ত রাজমণ্ডল রাজসূয় উপলক্ষে একযোগে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সভাপ্রাঙ্গণে হাজারো উপহার নিয়ে বশ্যভাবে উপস্থিত হওয়ায় দুর্যোধনের ঈর্ষার কারণ ঘটল, সঙ্গে সঙ্গে কর্ণেরও। রাজসূয়ের মূলপর্বে চরম সম্মান দেওয়ার জন্য কৃষ্ণকে বেছে নেওয়ায় জরাসন্ধের ডান হাত চেদিরাজ শিশুপাল প্রচণ্ড গালাগাল করলেন কুরু-কুলপতি ভীষ্মকে, এমনকী যুধিষ্ঠিরকেও। শিশুপালের মতে—নামকরা মানুষকে যদি সম্মান জানাতেই হয়, তা হলে আরও অনেকেই ছিলেন, যাঁদের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে পারতেন ভীষ্ম কিংবা যুধিষ্ঠির। শিশুপাল অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে কর্ণের নামও এখানে স্মরণ করছেন। বলেছেন—দেবরাজ ইন্দ্রের মতো যাঁর ক্ষমতা, ধনুক-চালনায় যিনি অসাধারণ, যিনি অঙ্গ-বঙ্গের অধীশ্বর, সেই কর্ণকে আপনি সম্মান জানাতে পারতেন ভীষ্ম—বঙ্গাঙ্গবিষয়াধ্যক্ষং… স্তুহি কর্ণমিমং ভীষ্ম…।
বোঝা যাচ্ছে, শক্তিমান এবং সম্মানিত পুরুষদের যদি আঙুলে গোনা যায় তবে এই পর্যায়ে এখন কর্ণেরও নাম করতে হচ্ছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে, তিনি শুধু অঙ্গ, চম্পা কিংবা জরাসন্ধের দেওয়া মালিনী নগরীর অধীশ্বর নন, আমাদের এই বাংলাদেশও ছিল তাঁরই রাজ্যের অন্তর্গত—বঙ্গাঙ্গবিষয়াধ্যক্ষং সংস্রক্ষসমং বলে। কিন্তু হলে কী হয় তিনি যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন হস্তিনাপুরের রাজনীতির সঙ্গে। ফলে হস্তিনাপুরের যুবরাজ দুর্যোধন যখন যুধিষ্ঠিরের সম্মান আর ইন্দ্রপ্রস্থের কারিগরি দেখে মনে মনে জ্বলে গেলেন, তখন কর্ণেরও মনে ব্যথা হল। ক্রোধ এবং ঈর্ষার কারণ ছিল দুটি—যুধিষ্ঠিরেরা তাঁদের পিতার রাজ্যাংশও ফিরে পেল, আবার দ্রৌপদীকেও পেল ওরাই—তৈর্লব্ধা দ্রৌপদী ভার্যা দ্রুপদশ্চ সুতৈঃ সহ। প্রথম ব্যাপারটায় কর্ণের তত কিছু আসে যায় না, কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাপারটা যে দ্রৌপদী—তাঁর আপন মুখের গ্রাস। আমরা জানি কুরুসভায় যে পাশাখেলার চক্রান্ত তৈরি হয়েছিল, এই চক্রান্তের মূল পর্বে কর্ণ দুর্যোধনের সঙ্গে ছিলেন না। এই পুরো চক্রান্তটাই ছিল শকুনি এবং দুর্যোধনের মস্তিষ্ক-প্রসূত, যার সহায়ক ছিলেন রাজা ধৃতরাষ্ট্র স্বয়ং। কিন্তু সব কিছুর পরেও যে পাশাখেলার আসরে বসে গেলেন কর্ণ, তার একমাত্র কারণ দ্রৌপদী, যদি দ্রৌপদীকে হেনস্থা করা যায় কোনওক্রমে।