৩
পুরোপুরি খুন করার চেয়ে খুন করার চেষ্টা করে বিফল হওয়া বুঝি আরও বিপজ্জনক। তাতে আসামীর সব সময় ভয় থাকে যে, অপরপক্ষ তাকে চিনে ফেলল কিনা। কুন্তী খুনের আসামী নন, খুনের চেষ্টাও তিনি করেননি; কিন্তু জননীর হৃদয় এমনই জিনিস যে, কুন্তী নিজেকে খুনের আসামী ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছেন না। নিয়মিত তাই তিনি খবর নিয়ে যাচ্ছেন। যে শিশুপুত্রটিকে শুধুমাত্র সহজাত কবচ আর কুণ্ডলের ওপর ভরসা করে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, সে যে বেঁচে থাকতে পারে—এ তিনি ভাবতেই পারেননি। বেঁচে থাকুক এটাই তিনি চাইছিলেন কিন্তু যদি বেঁচে থাকে তা হলে তাঁর যন্ত্রণা বাড়বে বই কমবে না। ততদিনে কুন্তীর বিয়ে হয়ে গেছে হস্তিনাপুরে, তিনি রাজরানি হয়েছেন। রাজরানি হওয়ার অনেক সুবিধে, দাস-দাসী, বিশ্বস্ততা, আনুগত্য—সবই কেনা যায়। ফলে তাঁর শিশুপুত্রের খোঁজ পেতে দেরি হল না। বিশ্বস্ত দাসী-চরদের তিনি বলে দিয়েছিলেন যে, সোনার বর্ম-পরা যদি কোনও ছেলে দেখতে পাও তো বোলো আমায়। তারা অনেক ঘুরে, অনেক খুঁজে পেতে খবর এনে দিয়েছিল তাদের রানিমাকে। বলেছিল—সেই যে মগধের পুবদিকে চম্পা বলে এক নগরী আছে—অঙ্গরাজ্যের রাজধানী, সেখানে আছে এই রকম এক ছেলে। সেখানে সারথিজাতের লোকেরা থাকে অনেক—সুত বিষয়ম্। কুন্তী চরের মুখে জানলেন—এক সারথির ঘরে তুখোড় একটি ছেলে বড় হচ্ছে, তার গায়ে জন্ম থেকেই সোনার বর্ম আঁটা আছে—চারেণ বিদিতশ্চাসীৎ পৃথয়া দিব্যবর্মভৃৎ। কুন্তী আর কৌতূহল দেখাননি ; রাজরানি হলেই কী? তাঁরও কলঙ্কের ভয় আছে যে।
মহাভারতের কাণ্ডকারখানা নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করলে কর্ণের সম্বন্ধে কুন্তী এবং সমস্ত পাণ্ডবদের বিচারই অত্যন্ত ভুল বলে প্রমাণিত হবে। কর্ণের অন্তকালে যুধিষ্ঠির কুন্তীকে যে খুব গালাগালি দেওয়ার সুযোগ পেলেন, এ সুযোগও তাঁর প্রাপ্য ছিল না। অন্যদিকে তাঁর বলিষ্ঠ ভায়েরা যে সারা জীবন ধরে কর্ণকে ‘সূতপুত্র সূতপুত্র’ বলে গেল, সেই চেঁচানিরও সারবত্তা বেশি নেই। অর্থাৎ কর্ণ যে কুন্তীর কুমারীপুত্র হয়ে কলঙ্ক লাভ করলেন আর ভাসতে ভাসতে এসে উঠলেন সুতের ঘরে—এই দুটি ব্যাপারে তাঁর যে হাত ছিল না—এটা বড় কথা নয়। বড় কথা, এই দুটি ব্যাপারেই কোনও কলঙ্ক লাভের প্রশ্ন ছিল না একটুও।
কুন্তী যদি পাণ্ডুকে কর্ণের জন্মকথাটা বলে দিতেন তাতে কোনও অসুবিধে হত না। তখনকার দিনের আন্দাজে পাণ্ডু ছিলেন যথেষ্ট ‘লিবারাল’। কিন্তু কলঙ্কের কথা বলতে যেন কুন্তীরই রুচিতে বেঁধেছে। তখনকার শিথিল সমাজে কন্যা-অবস্থায় পুত্র জন্মানটা কোনও আশ্চর্য ঘটনা নয়! কুন্তীর শাশুড়ি সত্যবতী স্বয়ংই কন্যা-অবস্থায় ব্যাসদেবের জন্ম দিয়েছিলেন। তিনি তো পুত্ৰকল্প ভীষ্মকে সবই বলে দিয়েছিলেন। তবে হ্যাঁ, আপনি বলবেন, সত্যবতীর বলার সময়টা ছিল খুব উপযুক্ত ; শান্তনু মারা গেছেন, কুরুকুলের বংশধর কেউ নেই, সেই অবস্থায় সংসারের প্রয়োজনে তিনি সব কথা বলে আপন কন্যাকালের পুত্রকে নিয়োগের জন্য স্মরণ করেছেন। আমরা বলব—প্রথমত স্বামীর কাছে যদি লজ্জা করে, তা হলে পাণ্ডু মারা গেলে অজস্রবার কুন্তীর সুযোগ এসেছে কর্ণের কথা পরিষ্কার করে বলার। কিন্তু আমাদের ধারণা, পাণ্ডু বেঁচে থাকতেই কুন্তীর সুযোগ ছিল বেশি। পাণ্ডু যে এ ব্যাপারে কতটা উদার ছিলেন, সেটা আগেই বুঝে নেওয়া যেতে পারে।
পাণ্ডু সুখন মুনির শাপে প্রজনন-ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন, তখন তিনি আরও বেশি করে পুত্রমুখ দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন। অন্যান্য মুনিদের সঙ্গে তাঁর পরামর্শ হল। তিনি তাঁদের বললেন—আমি যেমন আমার পিতার ঔরসপুত্র নই বরঞ্চ আমার মায়ের ক্ষেত্রে ব্যাসের নিয়োগজাত পুত্র তেমনি আমারও কি তেমন কোনও ক্ষেত্রজ পুত্র হতে পারে? মুনিরা বললেন—আমরা দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, দেবতার মতো পুত্র হবে তোমার। এই পরামর্শটা কিছুই না, নিয়োগের বিধিতে ব্রাহ্মণদের কিছু অনুমতি লাগে, সেই অনুমতিটা পাওয়া গেল। পাণ্ডু এবার কুন্তীকে নিয়োগপ্রথায় প্রস্তুত হওয়ার আগে অদ্ভুত একটা সুযোগ দিলেন। পাণ্ডু বললেন-দেখ কুন্তী! এটা আমাদের আপদ কাল, অন্যভাবে ছেলেপুলে হয় কিনা সেটা আমাদের ভাবতে হবে-অপত্যোৎপাদনে যত্নম্ আপদি ত্বং সমর্থয়। এবারে পাণ্ডু মস্ত একটা সুযোগ দিলেন। বললেন—কুন্তী! আমাদের সমাজে বারো রকমের ছেলে স্বীকৃত—সোজাসুজি বিয়ে করা বোয়ের ছেলে—সে তো ভালই। তা না হলে নিয়োগজাত পুত্র, স্ত্রীর কুমারী অবস্থায় জাত পুত্র—এরকম বারো রকমের ছেলে আছে। এর মধ্যে যে কোনও একরকমের ছেলে থাকলেই—সর্বেষামেব পুত্রাণাং যদ্যোকো’পি ভবেৎ সূতঃ—তা হলেই মনুর কথায় আমি নিজেকে পুত্রবান মনে করতাম। এত বড় সুযোগ সত্ত্বেও কুন্তী কিন্তু কর্ণের কথা বললেন না। মহাভারতের রুক্ষ টীকাকার নীলকণ্ঠ পর্যন্ত পাণ্ডুর ‘অফার’ বুঝে লিখলেন—ইস্! পাণ্ডু যে বারো রকম ছেলের লিষ্টি দিলেন তাতে অন্তত দুভাবে কর্ণের পুত্রত্ব সিদ্ধি হয়—কর্ণাদিসদৃশস্য কানীনস্যাপি অত্রৈব অন্তর্ভাবঃ—কিন্তু তবু কুন্তী কিচ্ছুটি বললেন না। এমন নয় যে, কুত্তী কর্ণের খবর রাখতেন না। তিনি কর্ণের খবর আগেই পেয়েছেন সে-কথাও আমরা জানিয়েছি।
কুন্তীর দিক থেকে যখন কোনও জবাব এল না, তখন পাণ্ড নিয়োগপ্রথারই গুণ গাইলেন। প্রকৃষ্ট নিয়োগের উদাহরণ দিয়ে কুন্তীকে বললেন তুমিও এক উৎকৃষ্ট ব্রাহ্মণের ঔরসে আমার পুত্র উৎপাদন কর। কুন্তী এমন ভাব করলেন, নিজের দেহের ওপর পাণ্ডুর অধিকার এমন সোচ্ছ্বাসে ব্যক্ত করলেন যেন অন্য পুরুষের মুখই তিনি জীবনে দেখেননি। পাণ্ডুকে আরও গভীর মোহে ডুবিয়ে দিয়ে কুন্তী বললেন—তুমি ছাড়া অন্য কোনও পুরুষ মানুষের সঙ্গে আমি রতিক্রিয়া করছি—এ যে আমি ভাবতেও পারি না—ন হ্যহং মনসাপ্যন্যং গচ্ছেয়ং তদৃতে নরম্। গভীর রসে কুন্তী এক পতিব্রতা রমণীর কাহিনী শোনালেন পাণ্ডুকে, যে রমণী তাঁর স্বামী মারা যাবার পরেও আপন পাতিব্ৰত্যগুণে স্বামীর শবের সঙ্গে শুয়ে থেকে পুত্র উৎপাদন করেছিল। অথাৎ কুন্তীর ভাবটা এই যে, পাণ্ডু মারা গেলে তাঁর শবের সঙ্গে শুয়েও জীবন কাটিয়ে দেবেন তিনি, তবু অন্য পুরুষ নৈব নৈব চ। যে নারীর কুমারীকালেই যৌন বিচ্যুতি ঘটে সে বুঝি কুন্তীর মতোই সতী-সাধ্বী হয়ে ওঠে। বিশেষত কুন্তীর মতো যার দোষ থাকে না, সে অহেতুক কোনও পাপবোধেই যেন সতীত্বের বিকাশ ঘটাতে চায় বেশি। কিন্তু মহারাজ পাণ্ডু অত্যন্ত উদার। তিনি বললেন—দেখ কুন্তী! তুমি যে নারীর কথা বললে, সে খুবই ধর্মসম্পন্না বটে, তবে আমিও ধর্মকথাই বলছি—অহং ত্বিদং প্রবক্ষ্যামি ধর্মতত্ত্বম্। দেখ কুন্তী! পুরাকালে মেয়েরা ছিল সব মুক্ত যে কোনও পুরুষের সঙ্গেই তাদের যৌন-সম্বন্ধ ঘটতে পারত এবং তা ঘটতে পারত কুমারীকাল থেকেই—বারবার—কৌমারাৎ শুভগে পতীন্। তাকে কিন্তু অধর্ম হত না কুন্তী! কারণ সেকালে সেটাই ছিল ধর্ম—স হি ধর্মঃ পুরাভবৎ।
‘কুমারীকাল থেকেই’-–এ শব্দগুলি নিশ্চয় কুন্তীর মনে তড়িৎ-ক্রিয়া করেছে। পাণ্ডু আজ স্বামী হয়ে যে কথা বলছেন, সে-কথা আরও একজন বলেছিলেন কুন্তীর স্বামিত্বলোভে। সেই কুমারীকালে সূর্য বলেছিলেন—কামনা করার ব্যাপারে স্ত্রী-পুরুষ সবাই মুক্ত—অনাবৃতাঃ স্ত্রিয়ঃ সর্বাঃ নরাশ্চ বরবৰ্ণিনি—কারণ স্ত্রীপুরুষের এইটেই স্বভাব, অন্যটাই বরং বিকার। কুন্তী অবশ্যই ভেবেছিলেন যে, এটা বড়ই বাড়াবাড়ি কথা, কিন্তু এই মুহূর্তে পাণ্ডুর কথা যখন সূর্যের কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে এবং ঠিক এইসব কথার পরেই কুন্তী যখন পাণ্ডুকে দুর্বাসার মন্ত্রসংবাদ দিচ্ছেন, তখন বেশ বুঝি কুন্তীর কুমারীকালের পাপবোধ আর নেই। আমাদের মতে, ঠিক এই মুহূর্তটি ছিল কর্ণের খবর দেবার ব্যাপারে আদর্শ সময়। কিন্তু কুন্তী কিচ্ছুটি বললেন না। চম্পা নগরীর সূতপল্লীতে যে শিশুটি বেড়ে উঠছিল, সে যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেল। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আপন রুচি, বিদগ্ধতা এবং সূক্ষ্মতাকে অতিক্রম করতে পারলেন না কুন্তী।
দ্বিতীয় কথা হল পাণ্ডবদের দিক থেকে, যাঁরা বীরপুরুষ হওয়া সত্তেবও সারাজীবন আরও এক বিপন্ন বীরপুরুষকে ‘সূতপুত্র’, ‘সূতপুত্র’ বলে সম্বোধন করে গেলেন। আমাদের জিজ্ঞাসা—পাণ্ডবেরা কি কখনও পেছন ফিরে নিজেদের মূল বংশপরম্পরা লক্ষ করেছেন? জাতিতত্ত্বের পুরোধা হিসেবে যদি মনুমহারাজের নাম করি তা হলে বলব—একটি ক্ষত্রিয় বীরপুরুষ যখন ব্রাহ্মণীর গলায় মালা দিয়ে তার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবে, তবে সেই পুত্রটি হবে জাতিতে সূত—ক্ষত্রিয়াদ্ বিপ্রকন্যায়াং সূতো ভবতি জাতিতঃ। সেই সূতের ছেলে হল সূতপুত্র। যদি এই দিক দিয়ে দেখি, তাহলে পাণ্ডবেরাও সমূহ বিপদে পড়বেন। পাণ্ডব-কৌরব এবং ভারতবর্ষের আরও অনেক গৌরবোজ্জ্বল বংশের মূল হলেন যযাতি রাজা। মহামতি শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী এই ক্ষত্রিয়পুরুষের প্রেমে পড়েছিলেন। স্বয়ং যযাতি নিজে ক্ষত্রিয় হওয়ার কারণে ব্রাহ্মণকন্যাকে অনেক বারণও করেছিলেন, কিন্তু ব্রাহ্মণীর প্রেম তাতে নিরুদ্ধ হয়নি। তাহলে দেবযানীর গর্ভে যযাতির ছেলেরা সব সূত এবং তার ছেলেরা সব সূতপুত্র। আপনারা বলবেন—পাণ্ডবেরা তো আর সোজাসুজি দেবযানীর গর্ভজাত সন্তানদের বংশধর নন, তাঁরা এসেছেন শর্মিষ্ঠায় বংশলতায়। আমরা বলি তাহলে তো আরও বিপদ, শর্মিষ্ঠা তো দানবরাজ বৃষপর্বার মেয়ে। ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণীর সংকর জন্মের তবু সংজ্ঞা আছে কিন্তু ক্ষত্রিয় এবং দানবীয় ধারায়, যাঁদের জন্ম, তাঁরা যে কী, তা শাস্ত্ৰকারেরাও বলেননি। বিপদ কি শুধু এইখানেই। যযাতির ঔরসে দেবযানীর গর্ভে প্রথম যে পুত্র, সে তো যদু, তাঁর বংশধরেরা হলেন সবাই যাদব। আর কে না জানে যে, পাণ্ডবেরা যাঁকে সব সময় মাথায় তুলে নাচতেন সেই কৃষ্ণ হলেন যদুবংশের লোক। তাহলে তিনিও তে সূতপুত্রের ধারায় জন্ম নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে কর্ণের কাছে যুদ্ধসন্ধির প্রস্তাব এলে কর্ণ বলেছিলেন—বসুদেবের ছেলে কৃষ্ণ যেমন সব সময় পাণ্ডবদের কাজ করে চলেছেন—বসুদেব-সুতো যদ্বৎ পাণ্ডবার্থে দৃঢ়ব্রতঃ—তেমনি আমারও সবকিছুই দূর্যোধনের জন্য। কুরু পাণ্ডবের বিরাট যুদ্ধে পাণ্ডবেরা যেমন কৃষ্ণকে সামনে রেখে এগোচ্ছিলেন, তেমনি দুর্যোধনেরাও এগিয়েছিলেন কর্ণকে সামনে রেখে—প্রাযুধ্যন্ত পুরস্কৃত্য মাতঙ্গা ইব যূথপম্। আমরা নিন্দুকের ভাষায় বলি, কুরুক্ষেত্রের বিরাট যুদ্ধে দুইপক্ষই কি তাহলে দুই সূতপুত্রের শৌর্য, বীর্য এবং বুদ্ধিমত্তার ওপর ভরসা রেখে ছিল? আসলে তা নয়, আমরা বলছিলাম—পাণ্ডবদের দিক থেকে কর্ণকে যখন তখন ‘সূতপুত্র’, ‘সূতপুত্র’ বলে অপমান করাটা ঠিক হয়নি।
বস্তুত মনুর মাকামারা জন্মের কলঙ্কে পাণ্ডবেরা যে কর্ণকে সূতপুত্র বলেছেন, তা আমাদের মানে হয় না। প্রাচীন পুরাণগুলি বলেছে—যাঁর নাম থেকে এই বসুন্ধরার নাম হয়েইেপৃ থিবী, সেই পৃথু যেদিন জন্মালেন সেইদিনই পিতামহ ব্রহ্মা সোমযজ্ঞের ভূমিতে সূত এবং মাগধদের সৃষ্টি করলেন। সূত এবং মাগধদের মুনিরা অনুরোধ করেছিলেন মহামতি পৃথুর স্তব করতে। সেই যে স্তব আরম্ভ হল, তারপর থেকে সূত এবং মাগধের চিহ্নিত হয়ে গেলেন বিভিন্ন রাজার স্তাবক হিসেবে। পুরাতন রাজাদের কীর্তিখ্যাতি স্মৃতিতে ধরে রাখতেন বলেই সূতেরা হলেন পৌরাণিক—সূতাঃ পৌরাণিকাঃ প্ৰোক্তাঃ। প্রাচীন সমাজে মুনি-ঋষিদের কাছে পর্যন্ত সূতদের যথেষ্ট সম্মান ছিল—কারণ বিভিন্ন পুরাণবক্তারা সবাই সূত। কিন্তু সুতেরা যেমন পৌরাণিক, তেমনি ব্যক্তিরাজার স্তাবকও বটে—বন্দিনস্তু অমলপ্রজ্ঞাঃ। বছরের পর বছর রাজবংশ স্মৃতিতে ধারণ করে, আর দিনের পর দিন পরিপোষক রাজার বন্দনা করেই বোধহয় সূতেরা জনসমাজে হেয় হয়ে গিয়েছিলেন। এই স্তাবকতার কারণেই হয়তো স্বাধীনচেতা ক্ষত্রিয়পুরুষেরা সময়ে অসময়ে তাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত করতেন, যদিও কারণ উপস্থিত না হলে এই আঘাত তাঁরা করতেন না ; যেমন কর্ণের পালক পিতা সূত অধিরথই ছিলেন কুরুকুলপতি ধৃতরাষ্ট্রের বন্ধু। অথচ প্রতিযোগিতার কারণেই হোক কিংবা বিষম নজরের জন্যই হোক, পাণ্ডবেরা অধিরথের পুত্রকে ‘সূতপুত্র’ বলে না ডেকে পারতেন না। আসল কথা এখানে ডাকবার কারণও ঘটেছে আবার অধিরথ হয়তো এককালে কুরুবংশের স্তাবকও ছিলেন।
মৎস্যপুরাণের এক জায়গায় দেখছি ঋষিরা কর্ণের সূতপুত্র সম্বোধনে কেচ্ছার গন্ধ পেয়েছেন। তাঁরা পৌরাণিককে বললেন—আমরা পুরু বংশের কীর্তিকাহিনী পরে শুনব। তার চেয়ে কর্ণকে লোকে সূতপুত্র বলে কেন, সেইটা আগে শোনান।
পৌরাণিক নিজে সূত, তিনি ঘরের কেচ্ছা মোটেই বেশি শোনাবেন না। তিনি সংক্ষেপে বললেন—বৃহদ্বাহুর পুত্র বৃহন্মনা কিন্তু রাজা ছিলেন, মানে অবশ্যই ক্ষত্রিয়। এই বৃহন্মনার দুই স্ত্রী—দুজনেই শৈব্যরাজার মেয়ে। প্রথমা স্ত্রী যশোমতীর গর্ভে জন্মালেন জয়দ্রথ বলে এক ছেলে আর দ্বিতীয় স্ত্রী সত্যার গর্ভে আসেন বিজয়। বিজয়ের ছেলে বৃহৎ, তাঁর ছেলে বৃহদ্রথ, তাঁর ছেলে সত্যকর্মা এবং তাঁর ছেলে হলেন অধিরথ। পুরাণকার প্রায় কিছুই না ভেঙে বললেন—এই অধিরথ সূত নামে বিখ্যাত হন—সূতশ্চাধিরথ স্মৃতঃ। যাঁর পূর্বপুরুষেরা রাজা ছিলেন তাঁদের ঘরের ছেলে হঠাৎ সূত বলে পরিচিত হলেন কেন—তার দুটো কারণ হতে পারে, যদিও পৌরাণিক সে কারণ স্বকণ্ঠে কিছু বলেননি। এক কারণ হতে পারে-রাজবংশের ছেলে হলেও এই রাজারা হয়তো ছিলেন সামন্ত রাজা। সেই বংশের ছেলে হঠাৎ করে আপন খেয়ালে কবিওয়ালা হয়ে উঠল। সে কুরুবংশের কীর্তিগাথা গাইতে গাইতে সেই বংশের গায়েন হয়ে গেল ; অধিরথকে সূত বলেই লোকে চিনল। আর এক কারণ হতে পারে—মনুর নিয়ম অনুসারে অধিরথের পিতা, অবশ্যই ক্ষত্রিয় ছিলেন, সত্যকর্মা বুঝি ব্রাহ্মণ-রমণীর প্রেমে পাগল হয়ে তাঁকে বিয়ে করে ফেলেন। লোকেরা, বামুনেরা, বন্ধুরা—বান্ধবাঃ কুলমিচ্ছত্তি—এই নিয়মে এমন বিয়েতে সায় দিলেন না মোটেই ; অতএব অধিরথ সূত বলেই পরিচিত হলেন—সূতশ্চাধিরথঃ স্মৃতঃ। আমাদের ধারণা, অধিরথের পিতার এই কুল অতিক্রম করে বিবাহের রটনা এবং ঘটনা—দুইই অধিরথের মর্যাদার পরিপন্থী হওয়ায় সময় বুঝে পাণ্ডবেরা কর্ণকে ‘সূতপুত্র’ বলে আঘাত করতে ছাড়েননি। মৎস্য পুরাণ বলেছে—শুধুমাত্র সুত অধিরথ কর্ণকে পালন করেছিলেন বলেই কর্ণ ‘সূতপুত্র’, আর কোনও কারণ নেই—তেন কর্ণস্তু সূতজঃ।
সূতেরা রাজবং স্মৃতিতে ধারণ করতেন বলেই, তাঁরা মুখে মুখে কবিতা তৈরি করতেন বলেই, অনেক ক্ষত্রিয়ের থেকে তাঁদের বিদ্যা-বুদ্ধি বেশি হত, আগেই বলেছি নির্মল বুদ্ধি তাঁদের—অমলপ্রজ্ঞাঃ। সূত অধিরথ আপন বংশে সূতের গ্লানি ভোগ করেছিলেন বলেই দৈবে পাওয়া ছেলেটিকে তিনি অতি যত্নে ক্ষত্রিয়ের মর্যাদায় মানুষ করেছিলেন। ছেলে যেই একটু বড় হল, অধিরথ সময় বুঝলেন। স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র তাঁর বন্ধু মানুষ-ধৃতরাষ্ট্রস্য বৈ সখা—তিনি সোজা বসুষেণকে পাঠিয়ে দিলেন হস্তিনাপরে। কারণ তিনি জানতেন যে, দ্রোণাচার্যের মত অস্ত্রগুরু সে যুগে ভূভারতে ছিল না! ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু তখন রাজা এবং তিনিই যেহেতু কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষার ভার দিয়েছেন দ্রোণাচার্যকে, অতএব ধৃতরাষ্ট্র যে বসুষেণকে দ্রোণের অস্ত্র-পাঠশালায় ঢুকিয়ে দিতে পারবেন—এ বিশ্বাস অধিরথের ছিল। অনেকে ধারণা করেন যে, বসুষেণ কর্ণ দ্রোণের কাছে কোনও অস্ত্রপাঠ পাননি, দ্রোণ তাঁকে ‘সূতপুত্র’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ভুল কথা। কোরব-পাণ্ডবদের সঙ্গে একই লগ্নে বসুষেণও দ্রোণের কাছে অস্ত্রকৌশল আয়ত্ত করতে থাকেন। অধিরথ তাঁকে ধৃতরাষ্ট্রের আস্তানাতেই রেখে দেন—দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষার জন্য—তএোপসদনং চক্রে দ্রোণস্য ইস্বস্ত্রকর্মণি। শুধু দ্রোণ নয়, যে কৃপাচার্য পরবর্তী সময়ে কর্ণের জন্ম, জাতি সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেই কৃপাচার্যও ছিলেন কর্ণের অস্ত্রগুরু। মহাভারত পরিষ্কার জানি—কর্ণের অস্ত্রগুরু ছিলেন তিনজন—দ্রোণ, কৃপ এবং পরশুরাম-দ্রোণাৎ কৃপাচ্চ রামাচ্চ সো’স্ত্রগ্রামং চতুর্বিধম্। ব্যাপারটা কিছুই নয়, হস্তিনাপুরে কৃপাচার্য ছিলেন ছোট শুরু আর দ্রোণাচার্য বড় গুরু। পাণ্ডব-কৌরবেরা প্রথমে সবাই কৃপাচার্যের কাছেই অস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যাদবেরা, বৃষ্ণিরা এবং অন্যান্য দেশের রাজপুত্রেরাও কৃপের পাঠশালায় ঢুকেছিলেন—বৃষ্ণয়শ্চ নৃপাশ্চান্যে নানা দেশ-সমাগতাঃ। এই যে নানা দেশ থেকে অন্যান্য রাজকুমারেরা এসেছিলেন, এদের মধ্যে বোধ করি কর্ণও ছিলেন। তারপর যখন পাণ্ডব-কৌরব—সবাইকেই অস্ত্রবিদ্যার ‘হায়ার কোর্স’ রপ্ত করার জন্য একযোগে দ্রোণের কাছে পাঠানো হল, আমাদের ধারণা, তখন একই সঙ্গে কর্ণও পাচার হয়ে গেলেন দ্রোণের পাঠগৃহে।
ভালই চলছিল। দ্রোণাচার্যের কাছে ক্রমান্বয়ে অস্ত্রবিদ্যার সমস্ত পাঠ তিনি ভালই রপ্ত করেছিলেন—চকারাঙ্গিরসঃ শ্ৰেষ্ঠাদ্ ধনুর্বেদং গুরোস্তদা। কিন্তু বাদ সাধল তাঁর উচ্চাভিলাষ। সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজকুমারদের মধ্যে ‘সূতপুত্র’ হওয়ার গ্লানি তিনি তখন থেকেই বুঝতে পারছিলেন। জন্মলগ্নেই যার গ্লানি থাকে এবং সে মানুষ যদি যথাযথ পুরুষ হয়, তবে তার কেটে বেরবার ইচ্ছে বাড়তেই থাকে, উচ্চাভিলাষ বাড়তেই থাকে। এটা ঠিক নয় যে, অস্ত্রপরীক্ষার দিনে রাজকুমার নয় বলে কর্ণের প্রতিযোগিতা বন্ধ হল আর দুর্যোধনের দেওয়া রাজমুকুট পরে দুর্যোধনের সঙ্গে কর্ণের হঠাৎ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দুর্যোধনের সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে দ্রোণের পাঠশালাতেই এবং তার কারণ একটাই—তিনি অর্জুনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছিলেন না। নারদ মুনি সেই শান্তিপুর্বে জানিয়াছেন যে কর্ণ পাণ্ডবদের দেখে জ্বলে-পুড়ে মরছিলেন। ভীম আর অর্জুনের ক্ষমতা আর যুধিষ্ঠির ঠাণ্ডা মাথার বুদ্ধি দেখে মনে মনে কর্ণের রাগ বেড়েই চলেছিল। তার ওপরে সেই ছোটবেলাতেই অতিবুদ্ধিমান কষ্ণের সঙ্গে অর্জুনের বন্ধুতা দেখে, পাণ্ডবদের ওপর সমস্ত প্রজাদের অনুরাগ দেখে কর্ণের হৃদয় জ্বলে উঠত—চিন্তয়ানো ব্যদহ্যত। কর্ণ অর্জুনদের এক কারণে দেখতে পারেন না, দুর্যোধন তাঁদের দেখতে পারেন না আরেক কারণে—জ্ঞাঞ্জিশক্রতার কারণ। কিন্তু এই দেখতে না পারার মধ্যে যে সাধারণ মিলটা আছে, তাতেই কর্ণের সঙ্গে দুর্যোধনের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অতি ছোটবেলায়—স সখ্যম্ অকরোদ্ একরো বাল্যে রাজ্ঞা দুর্যোধনেন চ। অন্যদিকে শুধুমাত্র দুর্যোধনের সঙ্গে বন্দুতের কারনে কর্ণের ওপর পাণ্ডবদের বিদ্বেষ স্বাভাবিক হয়ে গেল। তাঁদের ধারণা হতে লাগল নিচ-কুলে জন্মেছে এমন বীর্যবান পুরুষ যদি খারাপ সংসর্গে অর্থাৎ দুর্যোধনের অ্যাস্কারায় মাথায় উঠে বসে—বীর্যাধিকো নীচকুলো দুঃসঙ্গেন সমেধিতঃ—তা হলে সে বড় মানুষের ‘কেয়ার’ করে না, রাষ্ট্রেরও সে সমূহ ক্ষতি করে। অতএব দুর্যোধনের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণেই কর্ণ এবং পাণ্ডবেরা—দুই পক্ষই পরস্পর বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে উঠলেন।
তবু কিন্তু আসল কথাটা এখানে নয়। সত্যি কথা বলতে কি, দ্রোণাচার্যের ‘ক্লাশে’ অর্জুন ছিলেন ‘ফার্স্ট বয়’। কর্ণ ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারছিলেন যে, তিনি কোনওভাবেই ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের জায়গায় এসে দাঁড়াতে পারছেন না। রণক্ষেত্রে কৌশলের অভাব থাকলে প্রতিযোগী পুরুষ যেমন মারণাস্ত্রের ওপর শেষ ভরসা করে, তেমনি অর্জুনের যুদ্ধ-কৌশলে কর্ণ একসময় হতাশ বোধ করতে আরম্ভ করলেন এবং একসময় বুঝেও নিলেন যে, ধনুর্বেদে অর্জুনই সবার সেরা—সর্বথাধিকমালক্ষ্য ধনুর্বেদে ধনঞ্জয়ঃ উপায় একটা কিছু চাই। উপায়-মারণাস্ত্র, যার কাছে কৌশল খাটে না, রণনীতি খাটে না, ব্যক্তিবল খাটে না। কর্ণের মারণাস্ত্র চাই। একদিন যখন পাণ্ডব, কৌরব, কেউ কাছেপিঠে নেই, গুরুপূত্র অশ্বত্থামা পর্যন্ত পিতার এটির অনুপস্থিত, তখন কর্ণ একা চুপি চুপি এসে পৌঁছলেন দ্রোণাচার্যের কাছে। অর্জুনের ওপর হৃদয়-ভরা প্রতিস্পর্ধা নিয়ে একান্তে দ্রোণকে বললেন—গুরুদেব! আমাকে ব্রহ্মাস্ত্র ছোঁড়বার উপায় শিখিয়ে দিন, শিখিয়ে দিন ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়ে তার সম্বরণের উপায়। গুরুদেব! আমি ব্রহ্মাস্ত্র ছোড়বার কায়দা শিখতে চাই একটা কারণেই—আমি যাতে অর্জুনের সঙ্গে সমানে সমানে যুদ্ধ করতে পারি—অর্জুনেন সমং চাহং যুধ্যেয়মিতি মে মতিঃ।
অর্জুন নিশ্চয়ই দ্রোণাচার্যের কাছে পূর্বেই ব্রহ্মাস্ত্রের পাঠ পেয়ে গিয়েছিলেন। কর্ণ নিজেও কম যোদ্ধা নন, অতএব যোগ্য হওয়া সত্বেও কর্ণকে ব্রহ্মাস্ত্রের বিদ্যা দেননি গুরু অথচ অর্জুনকে দিয়েছেন—এই বিষমদর্শিতা গুরুর মনে কিছু ক্রিয়া করতে পারে এই ভেবেই কর্ণ বললেন—ঠাকুর! সমস্ত শিষ্যদের প্রতি আপনার সম-দৃষ্টি (ভাবটা এই যে, সমদৃষ্টি যদি নাই থাকে তো সেটাই হওয়া দরকার)! এমনকী আপনপুত্র এবং শিষের মধ্যেও আপনি ভেদ করেন না—সমঃ শিষ্যেষু বঃ স্নেহঃ পুত্রে চৈব তথা ধ্রুবম্। আপনার এই সমদর্শিতার পরেও কেউ যেন আমাকে না বলে, কর্ণ দ্রোণাচার্যের ছাত্র বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ বিদ্যে হয়নি তার। দ্রোণাচার্য সব শুনলেন, কিন্তু শুনলে হবে কি, প্রথম হওয়া ছাএ যদি নিপুণ এবং বিনয়ী দুইই হয়, তবে তার ওপরে মাস্টারের পক্ষপাত থাকবেই। মহাভারতের কবি পরিষ্কার জানিয়েছেন যে, গুরুমাত্রেই সমদর্শী হওয়া উচিত, কিন্তু সবার উপরে তিনি মানুষ। মনুষ্যধর্মে পক্ষপাত এসেই যায়। এইজন্য কর্ণের কথা শুনলেও দেখা যাচ্ছে দ্রোণাচার্যের অর্জুনের ওপর পক্ষপাত রয়েই গেছে, ‘বায়াস্’ রয়েই গেছে—সাপেক্ষঃ ফাল্গুনং প্রতি। তার ওপরে এতদিনের অস্ত্রশিক্ষার দৌলতে কর্ণকেও তিনি চিনেছেন। কর্ণের প্রতিযোগী মনোভাব, হিংসা, অহঙ্কার এবং সবার ওপরে দুর্যোধনের সঙ্গে তার ওঠা-বসা—কিছুই গুরুমশায়ের নজর এড়ায়নি। তিনি জানেন—শুধুমাত্র প্রতিস্পর্ধার জন্যই যে মারণাস্ত্র কামনা করে, তার হাতে সে অস্ত্র বিনা কারণে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সামনাসামনি কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করতে হলে এ কথা বলা যায় না। যে, বাপু হে তুমি বড় দুরাত্মা, তোমাকে আমি ব্ৰহ্মাস্ত্রের বিদ্যা শেখাব না। কিন্তু মনে মনে তিনি কর্ণের দুরাত্মতার কথা বুঝে-দৌরাত্মঞ্চৈব কর্ণস্য বিদিত্বা তমুবাচ ই—দ্রোণ বললেন—ব্রহ্মাস্ত্র! ব্রহ্মাস্ত্র জানার অধিকার আছে ব্রাহ্মণের, আর জানতে পারেন সচ্চরিত্র ব্রতচারী ক্ষত্রিয়, এমনকী সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীও ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করতে পারেন, কিন্তু আর কেউ নয়—নান্যো বিদ্যাৎ কথঞ্চন। বস্তুতঃ দৈব অস্ত্র লাভ করার জন্য যে নিষ্কাম উদাসীনতা দরকার, সেটা কর্ণের ছিল না বলেই দ্রোণ কর্ণকে এমন এক যুক্তিতে পরিহার করলেন, যেখানে কর্ণ একেবারেই নাচার। তিনি ব্রাহ্মণ নন, ক্ষত্রিয় নন, সূতজন্মা রাধেয় বলেই তিনি পরিচিত।
আসল কথা, যেখানে অর্জুনও আছেন এবং কর্ণও আছেন, সেখানে অর্জুনকে অতিক্রম করে যে কিছু পাওয়া যাবে না, এটা কর্ণ জানতেন। তাই দ্রোণের এই প্রত্যাখ্যানের জন্য তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন বলেই দেখা যাচ্ছে যে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে গুরু দ্রোণকে বিদায় জানিয়ে—আমন্ত্র্য প্রতিপূজ্য চ—কাউকে না বলে হঠাৎ করে গিয়ে পৌঁছলেন মহেন্দ্র পর্বতে। মহেন্দ্রপর্বতে আছেন পরশুরাম, ক্ষত্রিয়দের একুশবারের শত্রু নয়, চিরকালের শত্রু। তাঁর কাছে—‘আমি সচ্চরিত্র ক্ষত্রিয়’ বলেও লাভ নেই। কাজেই মহেন্দ্র পর্বতে উপস্থিত হয়ে পরশুরামের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে কর্ণ বললেন—আমি ভার্গব গোত্রের ব্রাক্ষণ—ব্রাহ্মণো ভার্গবো’স্মি। ভরদ্বাজ নয়, কাশ্যপ নয়, একেবারে ভার্গব! পরশুরাম নিজেই যে ভৃগুবংশী ভার্গব! এতদিন পর আরও একটি ভার্গব ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে বিদ্যা শিখতে আসায় পরশুরাম ভারী খুশি হয়ে কর্ণকে রীতিমত স্বাগত জানালেন—স উক্তঃ স্বাগতঞ্চেতি প্রতিমাংশ্চাভবদ্ ভৃশম্। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ কর্ণকে, শৈশবে গোত্রহারা কর্ণকে বুঝি বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন—কর্ণ যে নিজেকে ভার্গব বলে পরিচয় দিলেন, তার কারণ তিনি ভাবলেন—গুরু তো পিতার সমান হয়, অতএব ভার্গব পরশুরামকে তিনি যখন গুরু বলে ফেলেছেন, সেখানে নিজেকে ভার্গব বলে পরিচয় দিলে ক্ষতি কী! আমরা কিন্তু এই মুহূর্তে কর্ণের ওপর নীলকণ্ঠের এই মায়া ভাল চোখে দেখছি না। দেখছি না এইজন্যে যে, কর্ণ চরিত্রের শেষ পর্যন্ত গেলে আমাদেরও মায়াই হবে ; কিন্তু এই মুহূর্তে যে পবশুরামের কাছে নিজেকে ভার্গব বলে পরিচয় দিলেন তার একমাত্র কারণ সেই মারণাস্ত্র লাভের আশা, যা তাঁকে অর্জুনের সমকক্ষ করে তুলবে।
যাই হোক মহেন্দ্র পর্বতে কর্ণ অস্ত্রশিক্ষা করতে থাকলেন পরশুরামের কাছে। সেখানে থাকতে থাকতে অনেক দেবতা, গন্ধর্ব, রাক্ষস এবং অনেক অতিমানুষ লোকের সঙ্গে কর্ণের বন্ধুত্বও হয়ে গেল। এরই মধ্যে ঘটল এক অঘটন। দিনরাত মুক্ততরবারি আর ধনুক-বাণ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে যেখানে সেখানে লক্ষ্যভেদ অনুশীলন করার ফলে নিজের অজ্ঞাতেই তিনি এক ব্রাহ্মণের হোমধেনু মেরে ফেললেন। ব্রাহ্মণ রেগে শাপ দিলেন—যার কথা মনে করে তুই দিনরাত এই অস্ত্রাভ্যাস করে যাচ্ছিস, তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে তোর রথের চাকা বসে যাবে মাটিতে—যুধ্যতনে তে পাপ ভূমিশ্চক্রং গ্রসিষ্যতি। কর্ণ অনেক অনুনয় বিনয় করলেন, অনেক টাকা-পয়সা, গরু, ধনরত্ন দিতে চাইলেন কিন্তু ব্রাহ্মণ প্রসন্ন হলেন না। অধোমুখে ভীতমনে কর্ণ এসে পৌঁছলেন গুরুর আশ্রমে, কিন্তু কিচ্ছুটি বললেন না।
কর্ণের বাহুবীর্যে, কৌশলে, গুরুসেবায় পরশুরাম কিন্তু সম্পূর্ণ খুশি হয়েছিলেন। খুশির উপহার হিসেবে তিনি কর্ণকে ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়বার কৌশল এবং সে অস্ত্র সংবরণ করার নিয়ম—সবই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ব্রহ্মাস্ত্র জেনে বারবার তিনি সে অভ্যাস রপ্ত করছেন এবং যেন আর মন দিয়ে ধনুর্বিদ্যা অধিগত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কপাল যদি মন্দ হয় তবে জেনেও সে জানা কাজে আসে না। সেদিন উপবাসক্লিষ্ট পরশুরাম আশ্রমের কাছেই এক জায়গায় কর্ণের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে আছেন গুরু—এই সময়ে কাঁকড়া বিছে ধরনের এটি কীট কর্ণের উরুভেদ করে রক্ত খেতে লাগল। গুরুর ঘুম ভেঙে যাবে বলে কর্ণ একটুও নড়লেন না। অসহ্য বেদনা ভোগ করেও কর্ণ অপেক্ষা করতে লাগলেন—কখন গুরুর ঘুম ভাঙবে সেই সময়ের। তিনি গুরুকে একটুও নাড়ালেন না, একটু ব্যথার ভাব দেখালেন না, শুধু বীরের ধৈর্যে গুরুর মাথাটি নিশ্চল উরুতে ধারন করে রইলেন-অকম্পয়ন্ অব্যথয়ন্ ধারয়ামাস ভার্গবম্। রক্তের ধারা বয়ে গিয়ে এবার পরশুরামের গায়ে লাগল। ঘুম ভেঙে সচকিত মনে তিনি বললেন- রক্ত গায়ে লেগে আমি অশুচি হলাম, বল কী হয়েছে, ঠিক ঠিক বল। কর্ণ বললেন, সব বললেন। পরশুরাম বললেন—দেখ বাপু। ব্রাহ্মণেরু ধৈর্য-সহ্য কতটুকু সব আমার জানা আছে, এই দারুণ কীটের দংশন কোনও বেটা বামুন সইতে পারবে না, এই সহ্যশক্তি ক্ষত্রিয়ের মানায়, সত্যি করে বল তুমি কে? আমতা আমতা করে সানুনয়ে কর্ণ বললেন—আমার জন্ম হয়েছে সেই ঘরে, যে ঘরের ক্ষত্রিয় পুরুষ এক ব্রাহ্মণীর পাণিগ্রহণ করেছি—আমি সূত জাতির ছেলে—ব্ৰহ্মক্ষান্তরে জাতং সূতং মাং বিদ্ধি ভার্গব। আমাকে লোকে রাধেয় কর্ণ-রাধার ছেলে বলে ডাকে।
আমাদের জিজ্ঞাসা হয়— কর্ণ পিতার নাম বললেন না কেন? বিশেষত রাধার নামে কর্ণ পরিচিত বলে এমন বলা যায় কি যে, স্বয়ং রাধাই ছিলেন সেই ব্রাহ্মণী যিনি ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন অধিরথকে। উঁচু ঘরের মেয়ে বলেই হয়তো তাঁর নামেই কৰ্ণ বিখ্যাত হয়েছেন, অন্তত কর্ণের কথায় তো তাই মনে হচ্ছে। যাই হোক, কর্ণ সম্পূর্ণ সত্য স্বীকার করে বললেন—লোকে আমাকে রাধার ছেলে বলে ডাকে। সত্যি বলতে কি অস্ত্রের লোভেই আমি মিথ্যে কথা বলেছি—প্রসাদং কুরু মে ব্ৰহ্মন্ অস্ত্রলুব্ধস্য ভার্গব। আমি জানি, গুরু হলেন পিতার মতো, সেইজন্যে আপনার গোত্রেই আমি নিজের পরিচয় দিয়েছি।
টীকাকার নীলকণ্ঠ আগেই কর্ণের এই যুক্তি দেখিয়ে কর্ণের ওপর মায়া দেখিয়েছেন, কিন্তু আসলে কর্ণ ছলনাই করতে চেয়েছিলেন। বিপদে পড়লে যেহেতু যুক্তি মাথা থেকে বেরয়, তাই এখন তিনি বলছেন—আপনি আমার পিতার মতো, তাই আপনার গোত্রেই প্রথম পরিচয় দিয়েই। গুরুর গোত্রে শিয্যের পরিচয় অবশ্য শাস্ত্রসম্মত, কিন্তু সে গোত্র পরম্পরায় নেমে আসে গুরুর কাছে দীক্ষিত হবার পর অথবা বহুকাল শিষ্যত্বসিদ্ধির পর, শিষ হবার আগেই নয়। যাই হোক আপন পরিচয় দিয়ে কর্ণ ভয় পেয়েছেন, তিনি কাঁপছিলেন। শিষ্যের অতদূর ধৈর্যে, গুরুসেবাব নিশ্চল বৃত্তিতেও পরশুরামের মায়া হল না। তিনি মারণাস্ত্রলুব্ধ শিষ্যের মিথ্যা পরিচয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন—শুধুমাত্র অস্ত্রের লোভে তুই যেহেতু আমার সঙ্গে মিথ্যা আচরণ করেছিস, তাই তো বিনাশকালে কিংবা অসম্ভব সংকটের মুহূর্তে ব্রহ্মাস্ত্র ছোড়বার কৌশল তোর মাথায় আসবে না—ন তে মূঢ়, ব্রহ্মাস্ত্রং প্রতিভাস্যতি। তা ছাড়া এক্ষুনি তুই আমার মা থেকে দূর হ, কারণ মিথ্যের কোনও জায়গা নেই আমার আশ্রমে-গচ্ছেদানীং ন তে স্থানম্ অনৃতস্যেহ বিদ্যতে। তবে হ্যাঁ, অত ধৈর্য ধরে, অত যন্ত্রণা সহ্য করে কর্ণ যে গুরুর ঘুমের ব্যাঘাত করেননি, তাতে পরশুরাম একটু খুশি হলেন বইকি! তিনি বললেন—হ্যাঁ। তোমার এইটুকু হবে যে, যুদ্ধে অন্য কোনও ক্ষত্রিয় পুরুষ তোমার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না। বাস, এইটুকু। এর বেশি কর্ণ তাঁর সারা শিক্ষাজীবন ধরে এতগুলি গুরুর কাছে চেয়েছেন, কিন্তু পাননি। যাও বা গুরু পরশুরামের কাছে গোত্র ভাঁড়িয়ে পাওয়া গেল, সেই মারণাস্ত্রের ব্যবহার-ক্ষমতা তাঁর নিজেরই প্রবঞ্চনায় নিজের কাছে হারিয়ে গেল।
মহেন্দ্র পর্বত থেকে ফিরে এসে কর্ণ প্রথম দেখা করলেন দুর্যোধনের সঙ্গে এবং তাঁর কাছে ফের তিনি মিথ্যে কথা বললেন। বললেন—সমস্ত অস্ত্রের কৌশল আমি শিখে ফিরেছি, বন্ধু—দুর্যোধনম্ উপাগম্য কৃতাস্ত্রো’স্মি ইতি চাব্রবীৎ। স্বয়ং পরশুরামের সমস্ত অস্ট্রের কৌশল-শেখা কর্ণ দুর্যোধনের কাছে আরও প্রিয়তর হয়ে উঠলেন। দুজনের মিলনে দুজনেরই খুব আহ্লাদ হল-দূর্যোধনেন সহিতো মুমুদে…। কর্ণ ফিরে এসে সেই লোকটার সঙ্গে পুনরায় জুটে গেলেন যার সঙ্গে অর্জুনের বৈরিতা আছে, যার সঙ্গে পাণ্ডবদের শত্রুতা আছে। হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে তখন অস্ত্রপরীক্ষার দিন গণনা চলছিল! যাঁরা ভাবেন অস্ত্রপরীক্ষার দিন হঠাৎ কর্ণ এসে অর্জুনের প্রতিযোগী হয়ে রঙ্গস্থলে ধূমকেতুর মত উদয় হলেন, তাঁরা আমাদের পূর্বকথাগুলি ভেবে দেখবেন। আমাদের বিশ্বাস—রঙ্গস্থলে কর্ণের আসাটা পূর্ব-পরিকল্পিত এবং সেটি দুর্যোধনের সঙ্গেই কল্পিত। কর্ণের মনে দ্রোণ-গুরুর ব্যাপারে কিছু কাঁটাও ছিল এবং তাঁর ভাবটা এই—প্রতিযোগিতা যখন হচ্ছে, সেখানে অর্জুন তাঁর অস্ত্রকৌশল দেখিয়ে জনতার ধন্যধ্বনি তুলবেনই, ঠিক সেই মুহূর্তে দ্রোণের চরম-শিক্ষাটি না পেয়েও যদি অর্জুনের রণ-রস একটু খাটো করে দিতে পারেন সবার সামনে তাই বা মন্দ কী? পাঠক কিন্তু মনে রাখবেন কর্ণ পরশুরামের কাছ থেকে সোজা দুর্যোধনের কাছে এসেছিলেন ; পিতা অধিরথের কাছেও যাননি, মা রাধার সঙ্গেও দেখা করেননি। সুদূরে চম্পায় বসে অধিরথ হয়তো কেবল এইটুকু শুনেছেন যে, কর্ণ ভালয় ভালয় হস্তিনাপুরে পোঁছেছে। আধিরথ এও শুনে থাকবেন যে, হস্তিনাপুরে রাজপুত্রদের অস্ত্রপরীক্ষার দিন এগিয়ে আসছে। তিন প্রিয় পুত্রের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য এবং অস্ত্র পরীক্ষার দিন কর্ণ যাতে প্ররোচিত না হন সেই জন্যই হয়তো বা রওনা দিয়েছিলেন হস্তিনার পথে।
তবশেষে সেই দিন এল। অস্ত্রপরীক্ষার জন্য দ্রোণ নিজেই জায়গা পছন্দ করে ‘ডেকরেটর’দের মাপজোক দিয়ে দিলেন—মপিয়ামাস মেদিনীম্। একেবারে ঘাসকাটা সমভূমি জল ছিটোনো মাপা জায়গা। দুই দিকে ‘গ্যালারি, রাজার মঞ্চ, মেয়েদের আলাদা বসবার জায়গা—সব তৈরি। নির্দিষ্ট দিনে কাতারে কাতারে লোক এসে জায়গা দখল করল। ধৃতর, গান্ধারী, কুন্তী, ভীস্ম, দ্রোণ, কৃপ সবাই উপস্থিত। স্বয়ং দ্রোণ অস্ত্র পরীক্ষা শুভক্ষণ ঘোষণা করলেন। প্রথমে ভীম এবং দুর্যোধন যথেষ্ট দাযুদ্ধের কসরত দেখালেন। ক্রিতিম যুদ্ধ শেষে আসলে যুদ্ধে পিরণত না হয়, সেই ভয়ে দুজনকেই ‘ব্র্যাকেটে’ ফাস্ট করে নিন। দ্রোণ—কৃত যৌগ্যৌ উভৌ অপি। এবার ডাকলেন আর্জুকে। শুধু ডাকা নয়, তাঁর ডাকার মধ্যে গুরুর সমস্ত প্রশ্রয় মেশানো ছিল, অর্জুনের মধ্যে তিনি আপন প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি বললেন—বাজনাদারেরা বাজ না থামাও, কথা শোনো—যে আমার ছেলের থেকে প্রিয়, যে সমস্ত আস্ত্রের কৌশল জানে, সেই অর্জুন এবার এসো সামনে! অর্জুনে এলেন, দৃপ্ত ভঙ্গিতে ধনুকৰণ হতে নিয়ে অর্জুন এলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঢাক-ঢোল, কাঁসি একসঙ্গে বেজে উঠল। সমবেত জনতার আবেগ, অর্জুনের মহান উপস্থিতিতে কুরুপিতা ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত অর্জুনের প্রশংসায় মেতে উঠলেন। বললেন—বিদূর! আজকে সত্যিই আমরা সুরক্ষিত বোধ করছি! আনন্দশ্রুতে জননী কুন্তীর বুক ভেসে গেল বুক ভসে গেল—অস্রৈঃ ক্লিন্নমুরো’ভবৎ।
অর্জুন এবার অস্ত্রকৌশল দেখাতে থাকলেন! কখনও তিনি বাণমুখে আগুন সৃষ্টি করছেন, কখনও জল, কখনও ঝড়। কখনও তাঁকে রথের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, কখনও অন্তর্হিত, কখন তাঁকে লম্বা দেখাচ্ছে, কখনও বা হ্রস্ব—সবই অর্জুন দেখাচ্ছেন বাণের গতি-চাতুরিতে। যত অদ্ভুত বাণের খেলা দেখা যাচ্ছে, বাজনাদারেরা ততই উৎসাহে বাজনা বাজাচ্ছিল। তারপর অস্ত্রপরীক্ষার রঙ্গ প্রায়। শেষ হয়ে এসেছে, কমে এসেছে জনতার কোলাহল, বাজনাদারের বাজনা—মন্দীভূতে সমাজে চ বাদিত্রস্য চ নিস্বনে। এমন সময় রঙ্গদ্বার থেকে এক বিরাট শব্দ শোনা গেল, বজ্রের মতো তার আওয়াজ, মেঘধ্বনির মতো তার গাম্ভীর্য! সবাই একযোগে রঙ্গদ্বারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সোনার কবচ কুণ্ডলের শোভায় দীপ্তিমান হয়ে সূর্যের আলো-মাখা কর্ণ রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করলেন, তাঁর হাঁটা-চলায় যেন পাহাড়ের গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে—পাদচারীব পর্বতঃ। আমাদের ধারণা কর্ণ খুব দূরে কোথাও ছিলেন না, মনে মনে পণও ছিল—যাব না রঙ্গভূমিতে, দর্শক হিসেবেও না। কিন্তু অর্জুনের ধনুক-টঙ্কাবে, জনতার জয়ধ্বনিতে আর মুহুর্মুহু যুদ্ধ-বাজনা তীব্রতর হওয়ায় তিনি আর থাকতে পারেননি। অর্জনের প্রতি তাঁর আক্রোশই রঙ্গশেষের বেলায় তাঁকে টেনে আনল রঙ্গভূমিতে।
রঙ্গভূমির মাঝখানে, যেখানটা অর্জুন দাঁড়িয়েছিলেন, একেবারে সেইখানটা এসে কর্ণ চারিদিকটা দেখে একবার ঠাহর করে নিলেন। দ্রোণ আর কৃপকে একটা প্রণাম জানালেন অত্যন্ত অনাদরে, অবহেলায়—প্রণামং দ্রোণকৃপয়ো র্নাত্যাদৃতমিবাকরোৎ। ভাবটা এই—তোরা আমায় শেখালি না, কিন্তু আমি সব শিখেই এসেছি। বড় ভাই ছোট ভাইকে চিনল না—ভ্রাতা ভ্রাতরমজ্ঞাতম্—সবার সামনে অর্জুনকে উদ্দেশ করে কৃর্ণ বললেন—অর্জুন : এক একটা বাণ চালানোর মধ্যে যেন কত কায়দা আছে এমন একটা বিশেষ ভাব দেখিয়ে যে তুমি ধনুকবাণের কেতা দেখিয়েছ, সে সবই আমি আবার করে দেখাব করিষ্যে পশ্যতাং নৃণাং—তুমি নিজেকে নিয়ে অত বিস্ময়ের ভাব জাগিয়ে তুলো না বড়। যন্ত্রোৎক্ষিপ্ত বস্তুর মত জনতা একেবারে লাফ দিয়ে উঠল—লোকটা বলে কী, অর্জুনের মতো করবে। দ্রোণও অনুমতি দিলেন—একজনকে তিনি সম্পূর্ণ শিক্ষা দিয়েছেন, আর একজনকে শুধু জাতের লঘুতায় বঞ্চিত করেছেন, তাঁকে ছাড়াই সে কতটা শিখল, এই কৌতুহল থেকেই তিনি কর্ণকে অনুমতি দিলেন। সত্যি, কর্ণ সব করে দেখালেন, যা যা অর্জুন করেছিলেন—যৎ কৃতং তত্র পার্থেন তচ্চকার মহাবলঃ। একশো ভাইয়ের সঙ্গে একযোগে দুর্যোধন সবার সামনে জড়িয়ে ধরলেন কর্ণকে। বললেন—দারুণ দিয়েছ বন্ধু! তুমি আমার কুরুরাজ্যে যা ইচ্ছে ভোগ কর। কর্ণ বললেন—আমি শুধু তোমার বন্ধুত্ব চাই, তার এখনই অর্জুনের সঙ্গে সোজাসুজি লড়তে চাই। সেও ক্ষমতা দেখাক, আমিও দেখাব। দুর্যোধন বললেন—তুমি বন্ধুর মুখ উজ্জ্বল কর, শত্রুদের থোতা মুখ ভোঁতা করে দাও—দুহৃদাং কুরু সর্বেষাং মূর্ধি পাদম্ অরিন্দম। পাণ্ডবদের ওপর সাধারণ শত্রুতায় দুর্যোধন এবং কর্ণ আবার একসঙ্গে হাত মেলালেন।
অর্জুন খুব অপমানিত বোধ করলেন। তাঁর লজ্জাও হল রাগও হল। তিনি বললেন—না ডাকাতেও যারা রবাহূত আসে, না কথা বললেও যারা কথা বলে, তুমি তাদেরই মতো, কর্ণ! কর্ণ বললেন—রঙ্গস্থল সবার, সর্বসাধারণের, তোমার এতে বলার কী আছে অর্জুন—কিমত্র তব ফাল্গুন। যাঁরা বলবান, তাঁরা শক্তির পেছনে ধাওয়া করেন। তা ছাড়া তোমার এত বাক্যি দেওয়ার তো কিছু নেই, বাণের মুখে কথা বল, আমি জবাব দিচ্ছি। আজকে তোর গুরুর সামনেই তোর মাথাটা গলা থেকে খসিয়ে দেব আমি—গুরোঃ সমক্ষং যাবৎ তেহরাম্যদ্য শিরঃ শরৈঃ। বেশ বোঝা যায় অর্জুনের ওপর কর্ণের যত রাগ, তাঁর গুরু দ্রোণের ওপরেও ঠিক ততখানি। ফাঁকে ফোকরে, দ্রোণকেও তিনি। বক্রোক্তি করতে ছাড়ছেন না। অর্জুন দ্রোণের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে প্রস্তুত হলেন যুদ্ধের জন্য। কর্ণও প্রস্তুত। দুই মহাবীরের ‘চ্যালেঞ্জে’ সমস্ত রঙ্গস্থলের সমর্থকেরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল। কর্ণের পাশে পাশে থাকলেন ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা-ধার্ত্তারাষ্ট্রাঃ যতঃ কর্ণঃ। আর ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ—এঁরা দাঁড়ালেন অর্জুনের দিকে। রঙ্গস্থলের সমাজ দ্বিধা হল, এমনকী রমণীরা পর্যন্ত দুই বীরের সমর্থনে দ্বিধা হলেন। কিন্তু দ্বিধাভিন্ন রমণীকুলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন জননী অজ্ঞান হয়ে গেলেন। শেষে বিদুর, যিনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে রঙ্গস্থলের বিবরণ শোনাচ্ছিলেন, তিনি কোনওরকমে দাসীদের ডেকে চন্দন জলের ছিটায় কুন্তীকে বিপদমুক্ত করলেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরেও সেই পরস্পর-স্পর্ধী দুই পুত্রকে দেখে কুন্তী যে কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তিনি চেঁচিয়ে বলতে পারতেন—ওরে কর্ণও আমার ছেলে, তোরা কেউ যুদ্ধ করিস না। তাতে লোকলজ্জা, কন্যাগর্ভের কথা সর্বসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়ত। যদি বা এত কথা তিনি নিজমুখে নাও বলতেন, ত্রিকালজ্ঞ মুনি-ঋষিরা তাঁকে ছাড়তেন না। স্বয়ং ব্যাস এই অস্ত্রপরীক্ষার দিনে মঞ্চে বসে ছিলেন। কুন্তীর সংকটমুহূর্তে তিনি সব বলে দিতেন, তাতে জ্বালা আরও বাড়ত, কমত না। কিন্তু পুত্র পরিচয়ের সম্মান যে দিতে পারে না, তাকেও অসম্মানের জ্বালা বইতে হয়, আরেকভাবে। অনিবার্য যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তখন কৃপের মুখে নির্মম প্রশ্নবান নিক্ষিপ্ত হয়, তাতেও কুন্তীর জ্বালা বাড়ে, কমে না। কৃপ বললেন—ইনি পৃথার ছেলে, পাণ্ডব অর্জুন, ইনি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। তোমার কোন বংশে জন্ম, মাতৃকুল, পিতৃকুল সব বল। সেগুলো জেনেই ইনি যুদ্ধ করবেন তোমার সঙ্গে, কারণ রাজপুত্রের কুলমানহীন সাধারণের সঙ্গে যুদ্ধ করেন না।
আসলে দুয়ে দুয়ে যখন দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়, তখন এই নিয়ম, প্রত্যেককে আপন আপন কুলপরিচয় দিয়ে যুদ্ধে নামতে হয়। কৃপাচার্য কর্ণের প্রথম গুরু, ছোটবেলায় যখন কর্ণ এসে তাঁর পাঠশালায় ঢুকেছিলেন, তিনি তখন থেকেই সব জানেন এবং জানেন যে, ওই কথা বললে কর্ণ প্যাচে পড়বেন। বিশেষত কর্ণ প্রথম থেকেই কৃপ এবং দ্ৰোণকে যেভাবে তাচ্ছিল্য এবং অপমান করে যাচ্ছিলেন, তাতে কৃপের কিঞ্চিৎ বিরক্ত হওয়ারই কথা। তা ছাড়া শিক্ষা-দানের যে মনস্তত্ত্ব আছে সেই ব্যবস্থায় নাকি অত্যুৎসাহী ছাত্রদের কিঞ্চিৎ দাবিয়ে রাখার নিয়ম। কৃপ তাই কর্ণের কুলপরিচয় জিজ্ঞাসা করে একেবারে দাবিয়ে দিলেন। এত বড় বীর যে এক মুহূর্তে চুপটি করে গেলেন তাতে মহাভারতের কবির মনে আঘাত লেগেছে। তিনি বলছেন, কৃপের প্রশ্ন শুনে কর্ণের মুখটি লজ্জায় অবনত হল। অর্জুনের সঙ্গে প্রতিস্পর্ধী কর্ণের মুখটি লাগছিল সদ্য ফোটা পদ্মের মত। এই মুহূর্তে সেই ফুল্ল পদ্মের ওপর কৃপের প্রশ্ন যেন বর্ষার জল ঢেলে দিল—বভৌ বর্ষাম্বুবিক্লিন্নং পদ্মমাগলিতং যথা। পদ্মের উপমা কেন? পদ্ম যে পাঁকে ফোটে, কর্ণও যে সূতপঙ্কে পঙ্কজ। যদি বা পাঁকে পদ্ম ফুটল, তার ওপরে বর্ষার জলধারা নামল। নিজের মৃণাল-মেরুদণ্ডে তাঁকে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে হল না—বর্ষাম্বুবিক্লিন্নং পদ্মমাগলিতং যথা।
এগিয়ে এলেন দুর্যোধন। এই অপমানের দিনে দুর্যোধন সত্যিই বন্ধুর কাজ করলেন। তিনি বললেন, আচার্য! তিন রকমের রাজা হয়—যিনি সৎকুলে জাত, যিনি বীর এবং যিনি সৈন্যপরিচালনা করতে পারেন। তবু যদি রাজা নয় বলে অর্জুনের যুদ্ধে শুচিবাই থাকে, তবে এই মুহুর্তে কর্ণকে আমি অঙ্গরাজ্যের রাজা করে দিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে ফুল, খই, মুকুট, সোনার পিঁড়ি, সব এসে গেল! মন্ত্রবিদ ব্রাহ্মণেরা অভিষেকমন্ত্র পড়লেন। জয়শব্দ উচ্চারণ করলেন কৌরবেরা। যবনী কী কর্ণের মাথার ওপর ছাতা ধরে চামর চুলাতে লাগল—সচ্ছত্রবালব্যজনো জয়শব্দোত্তরেণ চ। কর্ণ একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লেন। দুর্যোধনকে তিনি বললেন—রাজ্য দিয়েছ তুমি, এর উত্তরে আমি কীই বা দিতে পারি তোমায়। দুর্যোধন বললেন—কিছু নয়, শুধু তোমার বন্ধুত্ব চাই। দুই পাণ্ডববিরোধী মহাবীর পরস্পর আলিঙ্গন করলেন।
তবু যুদ্ধ হত, অর্জুন—কর্ণে তবু একটা যুদ্ধ তখনই লাগত। কিন্তু সেই মুহূর্তে রঙ্গস্থলে প্রবেশ করলেন বৃদ্ধপ্রায় এক মানুষ, পথক্লেশে এবং তাড়াতাড়িতে তাঁর উত্তরীয়বাস লুটোচ্ছে ভঁয়ে। ঘেমে নেয়ে লাঠিতে ভর করে প্রবেশ করলেন কর্ণের পিতা সুত অধিরথ। তাঁকে দেখা মাত্র ধনুক ত্যাগ করে কর্ণ তাঁর অভিষেকের জল-ধোয়া মাথাটি লুটিয়ে দিলেন অধিরথের পায়ে—কর্ণো’ভিষেকাদ্ৰশিরাঃ শিরসা সমবন্দত। এতগুলি প্রণম্য লোকের সামনে পুত্রের এমন সগর্ব প্রণাম। পেয়ে অধিরথের যেন কেমন লজ্জা করতে লাগল। নিজের কাপড়ের খুঁটি দিয়ে নিজের পা দুখানি ঢেকে তিনি বললেন-থাক্ বাবা! থাক্ থাক্। অঙ্গরাজ্যের অভিষেকে আর্দ্র-শির কর্ণের মাথায় পিতৃতীর্থের আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
অসহিষ্ণু মধ্যম পাণ্ডব এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার সুত অধিরথকে দেখে তাঁর কথায় ধার এসে গেল। ভীম বললেন—ওরে সারথির বেটা, তুই না রাজপুত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করবি বলছিলি। তুই বরং যা, ধনুক ছেড়ে তাড়াতাড়ি ঘোড়ার লাগাম ধর হাতে-কুলস্য সদৃশস্তূর্ণং প্রতোদো গৃহ্যতাং ত্বয়া। এ আবার অঙ্গরাজ্যের রাজা হয়েছে, তোর কি সে যোগ্যতা আছে? কুত্তা যেন যজ্ঞের ঘি খেতে এসেছে। এইসব কাদা-ছোঁড়া কথার উত্তরে কর্ণের বিকল্প আছে শুধু দীর্ঘশ্বাস, আর আছে পিতৃকল্প সূর্যের দিকে তাকানো। আবার প্রতিবাদ করলেন দুর্যোধন। বললেন—এসব বাজে কথা বোলো না ভীম। ক্ষত্রিয়ের বলই সব ; বলবান পুরুষ আর নদীর উৎস খুঁজতে যেয়ো না, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরবে। এই বিশ্বামিত্র, দ্রোণ, কৃপ—এঁদেরও জন্মবিন্দুতে রহস্য আছে। আর ভীম! তোমাদের পাঁচভায়ের জন্ম কেমন করে হয়েছে তাও আমি জানি—ভবতীঞ্চ যথা জন্ম তদপ্যাগমিতং ময়া। তা ছাড়া চেয়ে দেখ, এই যাঁর চেহারা, সোনার বর্ম আর সোনার কুণ্ডল যাঁর জন্ম থেকে গায়ে আঁটা, সুর্যের মতো উজ্জ্বল গায়ের রং—এইরকম মানুষের জন্ম কি নীচকুলে হতে পারে, হরিণীর পেটে কি বাপু বাঘ জন্মায়—কথমাদিত্যসংকাশং মৃগী ব্যাঘ্রং জনিষতি। দুর্যোধন বললেন—আরে! শুধু অঙ্গরাজ্য নয়, সমস্ত পৃথিবীতেই রাজা হবার উপযুক্ত আমাদের কর্ণ। তা ছাড়া কারও যদি আমার কথাবার্তা ভাল না লাগে, সে এস না বাপু, যুদ্ধ করবে।
আবার যুদ্ধ হয় হয়। রঙ্গস্থলের লোকেরা, দর্শকেরা হাহাকার করে উঠল। কিন্তু ওই সময়ে সূর্য সম্পূর্ণ অস্ত গেল। কাজেই শুধুমাত্র আলোর অভাবে সে যাত্রা আর কিছু হল না। অস্ত্র-পরীক্ষার দিনে সবচেয়ে বড় লাভ হল দুর্যোধনের। সব শিখে এসেছি বললেও কর্ণেরও একটা পরীক্ষা প্রয়োজন ছিল। ব্রহ্মাস্ত্র পর্যন্ত নাই যাক, যতটুকু দেখেছেন, তাতেই দুর্যোধন দারুণ খুশি। তিনি হাতে ধরে আগে আগে নিয়ে চললেন তাঁকে এবং তাঁর একশো ভাই মশাল জ্বালিয়ে কর্ণের জয়ধ্বনি দিয়ে মিছিল করে চলল—দীপিকাগ্নিকৃতালোক স্তস্মাদ্ রঙ্গাদ্ বিনির্যযৌ। পাণ্ডবরাও ভীষ্ম-দ্রোণদের সঙ্গে বেরিয়ে নিজের নিজের ঘরে গেলেন। সমাজের লোকেরা কেউ অর্জুনের প্রশংসা করতে লাগল, কেউ বা কর্ণের, এমনকী কেউ কেউ দুর্যোধনেরও প্রশংসা করতে লাগল। পাণ্ডবভাইদের মধ্যে যুদ্ধবলে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ যুধিষ্ঠিরের ধারণা হল যে, কর্ণের মতো বীর বুঝি আর দুনিয়ায় নেই। অবশ্য এই ধারণা হল অর্জুনের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের অতিপরিচয়ের ফলেই, যাকে ইংরেজিতে বলি- familiarity breeds contempt. কিন্তু দুর্যোধনের লাভ, পাণ্ডবদের ক্ষতি, আচার্যদের অপমান। সব কিছু অতিক্রম করে অতি অদ্ভুত এক চাপা আনন্দ রঙ্গস্থলে বসে-থাকা এক রমণীকে আপ্লুত করে দিল! যেখানে পাণ্ডব-জননী কুন্তী অন্যান্য কুলবতীদের সঙ্গে তাঁদের মতো করেই কথা-বার্তা বলতে বলতে ঘরে ফিরছিলেন, সেখানে তাঁরই মধ্যে এক কুমারী-জননী হৃদয়-ভরা চাপা আবেগে ভেসে যাচ্ছিলেন। যাঁকে নাম ধরে ডুকুরেননি, লোকলজ্জায় যাঁকে জননীর প্রথম বাৎসল্য থেকে বঞ্চিত করেছেন, তাঁর সেই ছেলে আজ রাজা হয়েছে। কুমারী-গর্ভের মতো এ আনন্দও যে অপ্রকাশ্য—আনন্দ প্রকাশিত হলে লজ্জাও প্রকাশিত হবে, তাই চাপা আনন্দ-পুত্রম্ অঙ্গেশ্বরং স্নেহাচ্ছন্না প্রীতিরজায়ত।