১
মহাভারতের বিরাট যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। এখানে সেখানে স্তূপীকৃত মরদেহ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে এখন মরা পোড়ানো হচ্ছে। রীতি অনুযায়ী বিশিষ্ট ব্যক্তির মরদেহগুলির কাছেই লোকজন দিয়ে বড় বড় কাঠের গুঁড়ি, চন্দন-কাঠ, অগুরু, ঘি—এসব নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর শবটি তুলে দেওয়া হচ্ছে চিতায়। যুদ্ধজয়ী যুধিষ্ঠির বিদুরকে, সঞ্জয়কে দুর্যোধনের পুরোহিত সুধর্মাকে এবং ধৌম্য পুরোহিতকে গোটা দাহপর্বটা তদারকি করতে বলেছেন। তিনি বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন যে, কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে এসে যে সব নাম না-জানা সৈনিক মারা গেছেন, যে সব বীর মারা গেছেন, যাঁদের গোত্র-প্রবর কিছু জানা নেই—বেওয়ারিশ লোকের মতো তাঁদের মরদেহগুলি যেন শেয়ালে-শকুনে নষ্ট না করে—যথা চানাথবৎ কিঞ্চিচ্ছরীরং ন বিনশ্যতি।
বিদুর, সঞ্জয়—এঁরা একা একা কত করবেন? ইন্দ্রসেন এবং আরও সব কাজের লোকেরা সাধারণ সৈনিকদের এক এক জায়গায় একসঙ্গে ডাঁই করে রাখছিল। এদের প্রায় কাউকেই চেনা যায় না। তবে ছোট-বড় রাজাদের যাতে অন্তত চেনা যায়, সে জন্য যুদ্ধিষ্ঠির বুদ্ধি করে সারথিদের কাজে লাগিয়েছিলেন—ভৃত্যান্ সূতান্ চ সর্বশঃ। প্রথমে অবশ্য কুরুযুদ্ধের বড় বড় নায়কদের চিতায় তোলা হল। প্রথমে দুর্যোধন এবং তাঁর ভাইদের। তারপর একে একে শল্য, জয়দ্রথ, অভিমন্যু বিরাটরাজ, দ্রুপদ—এঁদের সবাইকে দাহ করা হল। দ্রৌপদীর পাঁচটি ছেলে, কর্ণের ছেলে, ঘটোৎকচ কর্ণ স্বয়ং, শিখণ্ডী, শকুনি, ধৃষ্টদ্যুম্ন—এঁদের প্রত্যেককে যথোচিত সম্মানে আলাদা করে চিতায় তোলা হল। আর বিভিন্ন রাজার সারথিরা, ভৃত্যেরা যে সমস্ত রাজাদের চিনিয়ে দিতে পেরেছিল, তাঁদেরও ঘৃতধারায় লিপ্ত করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। অন্যদিকে চলছিল গণদাহ—রাশীকৃত, সহস্রশঃ। যাদের চেনা যায় না, বিদেশি সৈনিক—তাদের সব এক জায়গায় ডাঁই করে, একটু বেশি বেশি ঘি ঢেলে—প্রভূতৈঃ স্নেহপাচিতৈঃ—পুড়িয়ে দেওয়া হল।
পাণ্ডব-কৌরবদের সমস্ত কাজের লোক এবং অন্যান্য দায়িত্বশীল মানুষদের কাজে লাগিয়েও এই দাহ-কর্ম সারতে দিন বয়ে রাত্রি এসে গেল। মরদেহগুলি চিতায় তোলার সঙ্গে সঙ্গে সুধর্মা আর ধৌম্য পুরোহিতের ঋক-মন্ত্র, সামগান ভেসে আসতে থাকে বাতাসে আর পরক্ষণেই মন্ত্র-গান আবিল হয়ে ওঠে স্বামীহারা, পুত্রহারা স্ত্রীলোকের চিৎকারে—সাম্নাম্ ঋচাঞ্চ নাদেন স্ত্রীণাঞ্চ রুদিতস্বনৈঃ। ব্যাস লিখেছেন—দিকে দিকে চিতার আগুন জ্বলে উঠেছে, দীপ্ত অগ্নির শিখায় সামনে থেকে একটুও ধোঁয়া চোখে পড়ে না যেন। কিন্তু হালকা একটা ধোঁয়া আশেপাশে, ওপর দিকে উঠছেই। এই কালো ধোঁয়ার আস্তরে বীর যুদ্ধনায়কদের মৃতদেহগুলি দেখাচ্ছে যেন পাতলা মেঘের আড়ালে গ্রহতারার মত—নভসীবান্বদৃশ্যন্ত গ্রহান্তম্বসংযুতাঃ। সূর্য অস্ত গেছে, আকাশে তারা ফুটেছে, কুরুক্ষেত্রের তারকারাও স্মৃতির মতো জ্বলছেন জীবিত জনের মনের আকাশে ; আজ যে যুদ্ধবীরেরা কাছে থেকেও অনেক দূরে। সবাই যে গ্রহ-তারা হয়ে গেছেন।
দাহকার্য শেষ হয়ে গেলে যুধিষ্ঠির কুরুবৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে নিয়ে চলে এলেন পুণ্যতোয়া গনদীর তীরে। তাঁর সঙ্গে আছেন কুরু এবং পাণ্ডব কুলের সমস্ত রমণীরা! গঙ্গায় এসে সবাই নিজের নিজের ভূষণ, উত্তরীয়বসন, উষ্ণীষ, কটিবন্ধ—সব নামিয়ে রাখলেন। পুরুষ এবং রমণীরা সবাই এবার প্রেত পুরুষের উদ্দেশে অঞ্জলি ভরে জল-তর্পণ শুরু করবেন। কারও বাবা মারা গেছেন, কারও ভাই, কারও স্বামী, কারও বা পুত্র। কুরুস্ত্রীদের হাহাকার বিলাপে গঙ্গার তীর একেবারে একই সঙ্গে কোলাহল এবং নিরানন্দে দীর্ণ হয়ে উঠেছে—বীরপত্নীভিরাকীর্ণং নিরানন্দম্ অনুৎসবম্। বেশির ভাগই কুরুবংশের বউ। তাঁরা একে একে গঙ্গায় নেমে যাচ্ছিলেন। তাঁদের চোখে জল, হাতের অঞ্জলিতে তর্পণের জল, সামনে পাপহারী গঙ্গার জল, আর অন্তরে দুঃখের প্রবাহ। সবাই তর্পণ করছেন—উদকং চক্রিরে সর্বা রুদত্যো ভৃশদুঃখিতাঃ।
এই বিশাল কুরুকুলের বিবাহিতা রমণীদের মধ্যে অন্তত তিনজনের ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছিলেন কুন্তী, পাণ্ডবজননী কুন্তী। একটু আগে দাহপর্বের পূর্বে এই তিন রমণীকে তিনি একটি বিশেষ মরদেহের পাশে আছাড়ি-পাছাড়ি করে কাঁদতে দেখেছেন। এঁদের স্বামীও মারা গেছেন, পুত্রও মারা গেছে। এবারে কুরুকামিনীদের পেছন পেছন এই তিন রমণীকে গঙ্গায় নামতে দেখে আর থাকতে পারলেন না কুন্তী। হঠাৎ করে—কারণ, কথাটা যখন বলতেই হবে, তখন হঠাৎ করেই বলতে হবে—অতএব হঠাৎই কুন্তী তাঁর পাঁচ ছেলে এবং বিশেষত যুধিষ্ঠিরের কাছে ব্যাকুল স্বরে বললেন বাছারা! সেই যে, সেই মহাবীর, হাজারো রথী-মহারথীর বাড়া মহাবীর-অর্জুন যাকে যুদ্ধে মেরে ফেলল, তার জন্যে গঙ্গায় একটু জল দে তোরা-কুরুধ্বম্ উদকং তস্য,—সে তোদের বড় ভাই। যাকে তোরা এতকাল সারথির ছেলে, সূতপুত্র বলে জানতিস, রাধেয় বলে জানতিস, অথচ সমস্ত সৈন্য-সামন্তের ভিড়েও যাকে সূর্যের মতো তেজস্বী বলে মনে হত—তার জন্যে একটু জল দে তোরা, সে তোদের বড় ভাই! যে তোদের সবার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, দুর্যোধনের যুদ্ধ-নায়কদের মধ্যে যে সব সময় জ্বলজ্বল করত, যার মতো বীর বোধহয় পৃথিবীতে কেউ ছিল না, যে নাকি নিজের প্রাণের চেয়েও যশকে বড় বলে মনে করত, যুদ্ধে যে পালাতে জানে না—সেই কর্ণের জন্য গঙ্গায় এক অঞ্জলি জল দে তোরা, সে তোদর বড় ভাই—কুরুধ্বম্ উদকং তস্য ভ্রাতুরক্লিষ্টকর্মণঃ! দেবদেব ভাস্করের ঔরসে আমারই গর্ভে সে তোদের আগে জন্মেছিল, সহজাত কবচ কুণ্ডল নিয়ে সূর্যিপানা ছেলেটা আমারই গর্ভে জন্মেছিল—তোরা জন্মানোর অনেক আগে—স হি বঃ পূর্বজো ভ্রাতা ভাস্করন্ময্যজায়ত।
পাণ্ডবরা তাঁদের ঘটনাবহুল জীবনে বহুবার চমকে গেছেন। বারণাবতে জতুগৃহের কৌশলে চমকেছিলেন, দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্র আকর্ষণের আকস্মিকতায় চমকেছিলেন, অরণ্যবাসের সময় দুর্বাসা মুনিকে দেখে চমকেছিলেন, বিরাটপর্বে দুর্যোধনের হঠাৎ আক্রমণেও চমকেছিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে কুন্তী যা বললেন, এর জন্য কোনও পাণ্ডবই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। মায়ের যে কথা এক সময়ে তাঁদের চরম সুখ দিতে পারত, সেই কর্ণের কথা শুনে পাণ্ডবেরা যেন আকুল হয়ে পড়লেন। যে যুধিষ্ঠির সারা যুদ্ধপর্বেও স্থির থেকে গেলেন, তাঁরও চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, আক্রোশে তাঁর নিঃশ্বাস পড়তে লাগল সাপের মত—নিঃশ্বসন্নিব পন্নগঃ। ক্ষুব্ধ যুধিষ্ঠির মাকে বললেন—সেই বিরাট মানুষটি, যাঁর শরঘাত একমাত্র অর্জুন ছাড়া আর কেউ সইতে পারত না, যাঁর প্রতাপে আমরা সব সময় ত্রস্ত ছিলাম, সেই তোমার দেবপ্রতিম পুত্রকে এতকাল আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখলে কেমন করে? তুমি যেন তোমার কাপড়ের আঁচল দিয়ে আগুন ঢেকে রাখতে চেয়েছ—তমগ্নিমিব বস্ত্ৰেণ কথং ছাদিতবতসি। তাই কি হয়, সে আগুন তোমার লজ্জাবস্ত্র ফুটো করে এখন আমাদেরই পোড়াচ্ছে। যুধিষ্ঠির বললেন—আমরা যেমন অর্জুনের বাহুবল আশ্রয় করেছি, তেমনি সমস্ত কুরুকুল আশ্রয় নিয়েছিল কর্ণের বাহুছত্রের অন্তরালে। সমস্ত রাজাদের মধ্যে, সমস্ত শক্তিমান বীরদের মধ্যে যার নাম একমাত্র অর্জুনের সঙ্গে করতে হয়, সে নাকি আমাদের বড় ভাই, সে নাকি তোমার প্রথম ছেলে? ওহ্! এমন করেও কথা চেপে রাখতে পার তুমি! তোমার মন্ত্রগুপ্তির জন্য আজ যে সবাই আমরা মরলাম—অহো ভবত্যা মন্ত্রস্য গ্রহণেন বয়ং হতাঃ।।
যুধিষ্ঠির মনে সত্যিই দুঃখ পেয়েছেন। যে কর্ণের শক্তিসামর্থ্য পাণ্ডবরা শ্রধ্যা করতেন মনে মনে এবং শক্তি আছে বলেই যাঁর কথাগুলি বেশি করে মনে লাগত, সেই কর্ণ তাঁদের ভাই। এই আবিষ্কারের আকস্মিকতা এতটাই যে, কর্ণ পাণ্ডবদের দলে থাকলে কতো সুবিধে হত তাঁদের, তারও একটা ছোট্ট অঙ্ক কষে নিয়েছেন যুধিষ্ঠির। তিনি বলেছেন-–কর্ণ পাশে থাকলে কোন জিনিস পাণ্ডবদের না-পাওয়া থাকত না, চাই কি সে জিনিস স্বর্গেই থাকুক না কেন—নেহ স্ম কিঞ্ছিদ্ অপ্রাপ্যং ভবেদপি দিবি স্থিতম্। এমনকী কৌরবদের সঙ্গে এই সংঘাতও হয়ত এড়ানো যেত কর্ন পাশে থাকলে। এই ঐহিক লাভের কথা ছেড়ে দিলেও যেটা সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে যুধিষ্ঠিরের কাছে, সেটা হল একটি উপযুক্ত দাদা না পাওয়ার দুঃখ। পিতা না থাকায় তিনিই ছিলেন পাণ্ডবদের পুরুষ অভিভাবক। কিন্তু অতিরিক্ত ধর্মপ্রবণতার জনাই হোক কিংবা তাঁর ‘নরম স্বভাবের জন্য অনেক সিদ্ধান্তই তাঁকে নিহত হয়েছে, যা বেশিরভাগ সময়েই অভিভাবকোচিত হয়নি, প্রাণপ্রিয় ভাইদেরও তা মনঃপূত হয়নি। কর্ণের মৃত্যুর পর আজকে যুধিষ্ঠিরকে তাই নিশ্চয় ভাবতে হয়েছে যে, কর্ণ যদি মাথার ওপরে দাদা হয়ে থাকতেন, তা হলে তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে কাউকে আর ট্যাঁ-ফোঁ করতে হত না। ভীম পর্যন্ত মুখচোরা হয়ে যেত। তা ছাড়া দ্যূতক্রীড়া, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরন, বনবাস—এসব আদৌ ঘটত কিনা সন্দেহ। কর্ণের মৃত্যুতে নয়, সময়-মতো তাঁকে দাদা হিসেবে না পেয়ে যুধিষ্ঠির যে এতদিন কত বড় একজন অভিভাবক হারিয়েছেন, এই গ্লানিতেই তিনি জননি কুন্তিকে ক্ষমা করতে পারছেন না, খালি বলছেন—মাগো! তোমার মন্ত্রগুপ্তির জন্যই আজ আমাদের সকলের এমন সর্বনাশ-পীড়িতাঃ স্মঃ সবান্ধবাঃ।
তবু মৃত্যু বোধহয় মানুষের বয়স কমিয়ে দেয়। বিশেষত সারা জীবন ধরে অনেক ব্যবহারই, এমন কী দুর্ব্যবহারও এমন সরল শিশুর মত করেছেন কর্ণ যে, আজকে এই অন্তিম মুহূর্তে যুধিষ্ঠির তাঁকে স্নেহ করতে শুরু করেছেন! দ্রুপদ, বিরাট, ধৃষ্টদ্যুম্ন, দুর্যোধন—এইসব বৃদ্ধ কিংবা অন্য যুবক যোদ্ধাদের সঙ্গে তিনি কর্ণকে একাসনে বসাতে পারছেন না, পারছেন না ভীষ্ম, দ্রোণ—এঁদের সঙ্গে কর্ণকে একাকার করতে। মাকে বলছেন—মাগো! সাত রাজার ধন এক মাণিক সুভদ্রার কোল-ছেঁচা অভিমন্যু মারা যেতে আমার যত না দুঃখ হয়েছে, আমাদের অন্যান্য, আত্মীয়-স্বজন মারা যেতে যত না কষ্ট হয়েছে—এখন তার শতগুণ বেশি কষ্ট হচ্ছে কর্ণের কথা মনে করে—ততঃ শতগুণং দুঃখমিদং মাম্ অস্পৃশদ্ ভৃশম। যুধিষ্ঠির এবার সসম্রমে কর্ণের তিন বউকে ডেকে আনলেন নিজের কাছে, যে তিনজনের ওপর জননী কুত্তী নজর রেখেছিলেন। তারপর তাদেরই সঙ্গে গঙ্গার জলে বড়দাদার প্রেততর্পণ করলেন। কর্ণের সারা জীবনের পাণ্ডব-বিদ্বেষ যুধিষ্ঠিরের ভালবাসায় আর গঙ্গার জলে ধুয়ে গেল। মন ভার করে যুধিষ্ঠির গঙ্গার জল ছেড়ে উঠলেন।
যে শ্লোকগুলি উপজীব্য করে আমরা কর্ণের শ্রাদ্ধ-তর্পণের ব্যবস্থা করেছি, এই শ্লোকগুলি ছাড়াও আরও দু-একটি শ্লোক মহাভারতের অন্যান্য মুদ্রিত গ্রন্থে দেখা যায়। তাতে লেখা আছে—যুধিষ্ঠির নাকি তর্পণ সেরে গঙ্গার মধ্যেই বিড়বিড় করে বললেন—স্ত্রীলোকের পাপেই আমাদের হাতে আমাদের বড় ভাই মারা পড়েছে, অতএব এর পর থেকে মেয়েরা আর কখনও মনের কথা চেপে রাখতে পারবে না—অতঃ মনসি যদ্গুহ্যং স্ত্রীণাং তন্ন ভবিষ্যতি! কথাটা প্রায় অভিশাপের মতো শোনায়। একা কুন্তী কর্নের কথা চেপে রেখে যে অন্যায় করেছিলেন, যুধিষ্ঠিরের অভিশাপে তাবত স্ত্রীলোকের মনে আর কোনও কথাই চাপা না থাকার ফলে আরও গভীর কোন বিপদ ঘটল কিনা, সে কথা যুধিষ্ঠির ভাবেননি; তবে আমরা বেশ জানি মহাভারতের যে সংস্করণেই এই শ্লোক মুদ্রিত থাকুক না কেন, সেটি পরবর্তী কোনও মরমী কবির সংস্কার মাত্র। নইলে যুধিষ্ঠির অত সহজে অভিশাপ দেবার লোক নন। শত বঞ্চনায়, শত প্ররোচনায়ও যাঁর ভূকুটি কুঞ্চিত হয় না, তিনি মায়ের কথা, অবস্থা এবং তাঁর বিকল্প না বুঝে হঠাৎ সমগ্র স্ত্রী-জাতির ওপর অভিশাপ বর্ষণ করবেন, তা সহজ মনে হয় না এবং তা তাঁর চিরকেলে স্বভাব-চরিত্রের সঙ্গে মেলে না।
আসলে কর্ণের কথা বলতে গিয়ে আমরা যে এই শেষ কে শুরু করলাম, তার কারণ একটাই। কোনও কোনও মানুষ বুঝি মারা যাবার জন্যেই জন্মায়। কর্ণের জন্মলগ্নে জননী যেদিন তাঁকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, সেদিন ক্ষুদ্র পেটিকার মধ্যে তাঁর মৃত্যুশয্যাই বিছানো হয়েছিল, অন্তত জননীর হৃদয় তাই জানত ; আজকে গঙ্গা নদীর তীরভূমিতে দাঁড়িয়ে জননী কুন্তী একই ভাবে কাঁদছেন, ঠিক যেমনটি কেঁদেছিলেন প্রথমদিনে কর্ণকে নদীতে ভাসিয়ে দেবার পর। কর্ণের জন্ম এবং মৃত্যু—দুইই বিসর্জনের সুরে বাঁধা। কিন্তু যে সব ছেলে এইরকম মরবার জন্যই জন্মায়, তাদের সবই বৃথা যায় না, তাদের জীবনের অংশটুকু নানা রঙে রাঙিয়ে দেন প্রজাপতি বিধাতা, ঠিক যেমন রাঙান প্রজাপতি কবি। কর্ণের ওপরে জনক-জননীর অধিকার ছিল না বলেই মহাকবি নিঃশেষে তাঁর ভার নিয়েছেন, সমস্ত জীবন ধরে তাঁকে দিয়ে এমন সব কাজকর্ম করিয়েছেন, যাতে জননী-হৃদয় আরও তাপিত হয়, যেন জননী তাঁর কুমারীত্বের বিলাস, অশ্রুর অক্ষরে স্মরণ করেন। কুন্তী কোনওদিন কর্ণকে ভুলতে পারেননি, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কর্ণ নিঃশব্দে কুন্তীকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরেছেন ; আজকে শান্তিপর্বের আরম্ভে, আদিপর্ব থেকে সৌপ্তিক পর্ব পর্যন্ত দশ পর্বের গর্ভদশা শেষ করে স্ত্রীপর্বের শেষ অধ্যায়ে কুন্তী কর্ণের মাতৃত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। আজ তিনি স্বামী পাণ্ডুর কাছে দায়মুক্ত সম্পূর্ণ এক স্ত্রী, সমস্ত পাণ্ডবদের কাছে আজ তিনি সম্পূর্ণ মা। সবাই, এমনকী ছেলেরাও যে সব জেনে গেল—এই শাস্তিই যেন তাঁকে আজ শান্তি দিয়েছে। মহাভারতেও তাই শান্তিপর্ব আরম্ভ হয়েছে, কেন না মিথ্যা, ছলনা কিংবা অন্যায়ের শেষ না হওয়া পর্যন্ত কি শান্তিপর্ব আরম্ভ হতে পারে?
স্বীকারোক্তির মাধ্যমে, অনুতাপের মাধ্যমে শাস্তি হয় কিনা জানি না, কিন্তু আগেই বলেছি কর্ণ মারা যাবার জন্যই জন্মেছিলেন। পৃথিবীর সমস্ত পণ্ডিত, যাঁরা পুরাণজ্ঞ বলে পরিচিত, তাঁরা দেবতাদের স্বভাবচরিত্র দেখে তাঁদের কিছু জাতবিচার করেছেন। তাতে দেখা গেছে—সেরকুলের দেবতা (Solar gods) যাঁরা কিংবা সৌর অংশে যাঁদের জন্ম, সেই দেবতাদের বৈশিষ্ট্য হল—তাঁরা অনেকে জন্মলগ্নেই এক বিরাট বিপদের মধ্যে পড়েন, কখনও বা জন্মলগ্নেই তাঁদের ত্যাগ করা হয়। শিশু কৃষ্ণ রাতের আঁধারে পরিত্যক্ত হয়েছিলেন গোকুলে। কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মকে গঙ্গা পরিত্যাগ করেছিলেন জন্মলগ্নেই। ওদেশে মোজেসকেও জুনের সঙ্গে সঙ্গে ফেলে রাখা হয়েছে নল-খাগড়ার বনে। সর্যপুত্র কর্ণকেও ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে গঙ্গায়। পুরাণবিদদের মতে—জন্মানোর পর পরই সৌরবংশজের এই যে বিপদ, এ বিপদ নাকি পাঠকের মনে এক ধরনের করুণার উদ্রেক করে এবং করুণাই নাকি তাঁদের জীবনের পরবর্তী শৌর্য-বীর্য, কীর্তিকলাপকে প্রতিতুলনার মাধ্যমে ভাস্বর করে তোলে। কবি-বিধাতা তাঁদের এইভাবেই গড়ে তোলেন, কর্ণকেও সেইভাবেই গড়েছেন।
কুন্তীর সঙ্গে যেদিন পাণ্ডুর বিয়ে হয়, সেদিনটা কুন্তীর পক্ষে বিশেষ করে স্মরণীয়। শতেক রাজার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে স্বয়ম্বরা কুন্তী যে পাণ্ডকে দেখে মোহিত হলেন, একেবারে যে সবার সামনে আকুল হলেন নববধূর কামনায়—কামপরীতাঙ্গী—তার কারণ এই নয় যে, পাণ্ডুর চেহারাটা ছিল মহাবল সিংহের মতো কিংবা তাঁর বুকের ছাতিটা ছিল বিরাট। তার কারণ এই যে, পাণ্ডুকে দেখে কুন্তীর যেন কার কথা মনে হল। ব্যাস উপমার অঙ্গুলীসংকেতে ব্যাপারটাকে গৌণ করে দেখিয়ে আসল ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছেন বটে, তবু তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, পাণ্ডুকে সেদিন সমস্ত রাজমণ্ডলীর মধ্যে যেন সূর্যের মতো দেখাচ্ছিল। কুন্তীর কাছে মনে হচ্ছিল পাণ্ডু যেন সমস্ত রাজার দীপ্তি ম্লান-করা সূর্য বুঝি-আদিত্যমিব সর্বেষাং রাজ্ঞং প্রচ্ছদ্য বৈ প্রভাঃ। কুন্তী যে এই তেজঃপুঞ্জ আরও একবার দেখেছেন ; সে তাঁর অনিচ্ছাসত্ত্বেও জোর করে আলিঙ্গন করেছিল তাঁকে। বালিকা হৃদয়ের সেই আলোড়ন তিনি ভুলবেন কী করে? বিশেষত প্রথম প্রেম কিংবা জীবনের প্রথম রমণীটির কথা পুরুষ মানুষ যদি আরও গভীরতর প্রেমে ভুলেও যায়, মেয়েরা ভোলে না তাদের প্রথম প্রেম কিংবা প্রথম পুরুষটিকে। পাণ্ডুর সূয্যিপানা মুখ দেখে সূর্য-স্মরণের চকিত লজ্জা কুন্তী মিশিয়ে দিলেন নববধূর লজ্জার সঙ্গে—সে যে অনেকদিনের ঘটনা। তবে সেই যে পড়েছি-“বাল্যকালের ভালবাসায় বুঝি কিছু অভিসম্পাত আছে। যাহাদের বাল্যকালে ভালবাসিয়াছ, তাহাদের কয়জনের সঙ্গে যোবানে দেখা সাক্ষাৎ হয়? কয়জন বাঁচিয়া থাকে? কয়জন ভালবাসার যোগ্য থাকে? বার্ধক্যে বল্যপ্রণয়ের স্মৃতিমাত্র থাকে, আর সব বিলুপ্ত হয়। কিন্তু সেই স্মৃতি কত মধুর। আমরা জানি, বিয়ের সময় কুন্তী বার্ধক্য-দশায় পোঁছননি। তিনি তাই মধুর স্মৃতিতে বুঝি লজ্জা পেলেন, যে লজ্জা মিশে গেল নববধূর লজ্জায়—ব্রীড়মানা।