উপন্যাস
গল্প

কবন্ধ বিগ্রহের কাহিনি – ৭

পারিজাত বক্সী বাইরে এসে দেখলেন একটু দূরে একটা চালাঘর, তার সামনে খাটিয়ার ওপর একটা লোক শুয়ে।

অস্পষ্ট কুয়াশার জন্য পরিষ্কার কিছু দেখা গেল না।

পারিজাত বক্সী আবার ঘরের মধ্যে ঢুকলেন।

লোকটা মেঝের ওপর পড়ে রয়েছে। তখনও অজ্ঞান।

পারিজাত বক্সী নিজের পোশাক খুলে লোকটাকে পরালেন। শক্ত করে মুখ বাঁধলেন। লোকটার ধুতি আর গেঞ্জি নিজে পরলেন। ধুতির কিছুটা খুলে নিজের মাথা ঢাকলেন, তারপর থালা-গ্লাস নিয়ে আবার বের হলেন। বেরিয়ে দরজায় তালা বন্ধ করে দিলেন।

তারপর সন্তর্পণে পা ফেলে চালাঘরের মধ্যে ঢুকলেন। যখন খাটিয়ার পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, তখন খাটিয়ার ওপর শোয়া লোকটা জড়ানো হিন্দিতে বলল, নে বাবা তাড়াতাড়ি নে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। আজ সিদ্ধির নেশাটা খুব জব্বর হয়েছে।

পারিজাত বক্সী কোনও উত্তর দেবার চেষ্টা না করে চালাঘরে ঢুকলেন। আর-একটা থালায় ভাত, তরকারি আর গ্লাসে জল তৈরি ছিল, সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে এলেন।

প্রথমে মাঝখানের ঘরটা খুললেন। চোখ কুঁচকে দেখলেন তিনটে বস্তু প্যাক করা। এগুলো মূর্তি হওয়াও বিচিত্র নয়।

এরপর কোণের ঘরটা খুলেই দেখলেন, একটি ছেলে খাটিয়ার ওপর শুয়ে।

এই হয়তো কুমুদ। কিন্তু একে জাগাতে গেলেই যদি চিৎকার করে ওঠে?

পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে পারিজাত বক্সী দেখলেন। কুমুদের ফোটো তিনি আগেই দেখেছেন। কাজেই চিনতে অসুবিধা হল না।

পারিজাত বক্সী কুমুদের কাছে গিয়ে কুমুদের মুখটা সজোরে চেপে ধরলেন।

কুমুদ আঁ করে চিৎকার করেই চুপ হয়ে গেল।

পারিজাত বক্সী কুমুদের কানে কানে বললেন, কুমুদ, কোনও ভয় নেই, আমি তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি। কোনওরকম শব্দ করো না।

কুমুদ মাথা নাড়ল, অর্থাৎ সে বুঝেছে।

পারিজাত বক্সী তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন, তারপর ইঙ্গিতে তাঁর অনুসরণ করতে বললেন।

দুজনে মাঝখানের ঘরে এসে দাঁড়াল। তিনটি প্যাক করা বস্তু একটার পর একটা ধরে বাইরে আনা হল।

ঠিক নীচেই গোটা চারেক নৌকা বাঁধা। মাঝিরা পাটাতনের ওপর ঘুমাচ্ছে।

পারিজাত বক্সী কাদা ভেঙে একটা মাঝিকে ওঠালেন।

প্রথমেই তার হাতে দশ টাকার একটা নোট দিয়ে প্যাক করা জিনিসগুলো নৌকায় তোলালেন। দুর্বৃত্তরা তাঁকে আঘাত করে অজ্ঞান অবস্থায় তাঁর রিভলভারটা সরিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু সেলাই করা আস্তরণের মধ্যে লুকানো টাকার বোধহয় সন্ধান পায়নি।

কুমুদও এসে নৌকায় উঠল।

নৌকার মাঝি জিজ্ঞাসা করল, এত রাতে কোথায় যাবেন বাবু?

এখানে বড়ো থানা কতদূরে?

হরিহরপুর থানা এখান থেকে পাঁচ মাইল।

তাড়াতাড়ি সেখানেই চলো। ভোরের আগে পৌঁছে দিতে পারলে আরও দশ টাকা দেব।

মাঝি প্রাণপণ শক্তিতে নৌকা বাইতে লাগল।

এতক্ষণ কুমুদ কোনও কথা বলেনি। চুপচাপ ছইয়ের মধ্যে বসে ছিল। এবার ক্লান্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে?

আমার পরিচয় পরে জানতে পারবে, এখন এইটুকু জেনে রাখো, তোমার বাবা তোমাকে উদ্ধার করার জন্য আমাকে নিয়োগ করেছেন।

তুলসী, তুলসীর খবর জানেন?

তুলসী দুর্বৃত্তদের হাত থেকে একবার পালিয়ে এসেছিল, কিন্তু আবার ধরা পড়েছে।

সে কী! আবার কী করে ধরা পড়ল?

সেসব কথা পরে শুনবে, এখন একটু ঘুমিয়ে নাও। জানি, তুমি খুবই ক্ষুধার্ত। তোমাকে আমি ভাত খাবার সময়টুকুও দিইনি, কিন্তু তুমি নিশ্চয় এটুকু বুঝতে পারবে, নষ্ট করার মতন একটু সময়ও আমাদের হাতে ছিল না। কোনওরকমে কেউ দেখে ফেললে, আমাদের দুজনেরই প্রাণ নিয়ে ফেরা সম্ভব হত না।

কুমুদ আর কিছু বলল না। হাত-পা মুড়ে শুয়ে পড়ল।

হরিহরপুর থানা পর্যন্ত নৌকাকে যেতে হল না। তার আগেই সাইরেন দিয়ে একটা স্টিমার নদীর মাঝবরাবর ছুটে এল।

মাঝি জিজ্ঞাসা করল, বাবু, আপনাদের ওই প্যাক করা জিনিসগুলো গোলমেলে কিছু নয় তো?

পারিজাত বক্সী এ প্রশ্নে বিস্মিত হলেন, কেন?

জল-পুলিশের স্টিমার আসছে। এত রাতে নৌকা চলতে দেখলে সন্দেহ করে হয়তো সার্চ করতে পারে।

জল-পুলিশের স্টিমার? তুমি এক কাজ করো তো। তোমার নৌকা স্টিমারের যত কাছাকাছি সম্ভব নিয়ে চলো।

মাঝি আশঙ্কা প্রকাশ করল, স্টিমারের যা ঢেউ বাবু, কাছে গেলে বিপদ আছে।

বেশি কাছে যাবার দরকার নেই। বললাম তো, যতটা সম্ভব ততটা কাছে নিয়ে চলো। ভয় নেই, জল-পুলিশ আমার জানা।

নৌকা স্টিমারের কাছ বরাবর যেতে পারিজাত বক্সী মাঝির গামছাটা নিয়ে পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে গামছাটা ঘোরাতে লাগলেন।

স্টিমারের সার্চলাইট নৌকার ওপর পড়তেই স্টিমারের গতি কমে এল।

স্টিমার থেকে একজন চোং মুখে দিয়ে চেঁচাল, কী ব্যাপার?

দুটো হাত মুখের দু-পাশে রেখে পারিজাত বক্সী চেঁচালেন, সাহায্য চাই।

আসছি।

আস্তে আস্তে স্টিমার একেবারে নৌকার গায়ে ভিড়ল।

স্টিমার থেকে সাদা পোশাক-পরা দুটি লোক লাফিয়ে নৌকার ওপর পড়ল।

একজন জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে বলুন তো?

পারিজাত বক্সী জামার ভিতর থেকে ছোটো একটা কার্ড বের করে লোকটার হাতে দিল।

কার্ডের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়েই লোকটা সম্ভ্রমের সুরে বলল, আপনি সেই বিখ্যাত গোয়েন্দা পারিজাত বক্সী! আপনার রহস্য সমাধানের অনেক কাহিনি খবরের কাগজে আমি পড়েছি। আপনাকে কী সাহায্য করতে পারি বলুন?

পারিজাত বক্সী সংক্ষেপে সব ঘটনাটা বললেন। তারপর প্যাক করা বস্তুগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, আন্দাজ করছি ওগুলো চোরাই মূর্তি। এ দেশের বাইরে চালান দেবার জন্য রেডি করে রাখা হয়েছে।

সাদা পোশাকপরা লোকটি বলল, দুঃখের বিষয়, এসব জল-পুলিশের এলাকার ব্যাপার নয়। আপনাকে অন্য কীভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন?

পারিজাত বক্সী উত্তর দিলেন, আর কোনও সাহায্য নয়। আপনি দয়া করে আমাদের দুজনকে আর এই জিনিসগুলো স্টিমারে তুলে নিন। আমাদের ভয় হচ্ছে বদমাইশগুলো টের পেয়ে হয়তো আমাদের অনুসরণ করতে পারে। মোটর বোটে যদি আসে তাহলে আমাদের নৌকার নাগাল পেতে মোটেই দেরি হবে না।

সঙ্গে সঙ্গে স্টিমারের লোকটি বলল, ঠিক আছে, আপনাকে আমরা হরিহরপুর থানায় পৌঁছে দেব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

তারপর লোকটা স্টিমারের দিকে ফিরে ইঙ্গিত করতেই স্টিমার থেকে একটা লম্বা কাঠের তক্তা নৌকার ওপর ফেলে দিল।

স্টিমার থেকে দুজন লোক তক্তার ওপর দিয়ে নৌকায় এসে দাঁড়াল, তারপর প্যাক করা তিনটে জিনিস স্টিমারে উঠিয়ে নিল।

এরপর কুমুদ আর পারিজাত বক্সী। সব শেষে সাদা পোশাক-পরা লোকটা।

নৌকা ছাড়বার আগে পারিজাত বক্সী মাঝির হাতে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বললেন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। এই নাও তোমার ভাড়া।

মাঝি মৃদু আপত্তি করল, আপনারা তো পুরো রাস্তা যাননি বাবু, তবে এ টাকা কেন?

পারিজাত বক্সী হাসলেন, ধরো নাও এ টাকা তোমার বকশিশ।

মাঝি টাকাটা নিয়ে সেলাম করল।

স্টিমার জল কেটে তিরবেগে ছুটল। তার মধ্যেই স্টিমারের লোকেরা কুমুদ আর পারিজাত বক্সীকে চা, রুটি, ডিম দিল।

স্টিমার যখন পাড়ে ভিড়ল, তখন মাঝরাত।

বড়ো একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় গোটা চারেক টাঙা দাঁড়িয়ে। চালকদের কোথাও দেখা গেল না।

স্টিমার থেকে একটা লোক সঙ্গে এসেছিল, সে বলল, একটু দাঁড়ান স্যার, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, থানা এখান থেকে কতদূর?

তা মাইল আড়াই হবে।

লোকটা আর দাঁড়াল না। জোরপায়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল।

কুমুদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নিজের মুক্তিতে তার যে আনন্দ হয়নি এমন নয়, কিন্তু তুলসীর কথা মনে হতেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছে।

আহা বেচারি, পালিয়েও আবার ধরা পড়ে গেল। বদমাইশগুলো আবার তাকে হাতে পেয়ে রাগের চোটে হয়তো খতমই করে ফেলেছে।

তুলসী তার ভাগনে হলে হবে কী, দুজনে একবারে বন্ধুর মতন। একজনকে ছাড়া আর-একজনের অস্তিত্বও যেন কল্পনা করা যায় না।

কুমুদ হাত দিয়ে নিজের চোখ দুটো মুছে নিল। স্টিমারের লোকটা আর-একজন লোককে প্রায় টানতে টানতে এনে হাজির হল।

এই যে স্যার, আবদুলকে ধরে এনেছি, টাঙাওয়ালা আব্দুল। নে, কোন টাঙাটা তোর? ঠিক কর, আমরা হরিহরপুর থানায় যাব।

আধ-ঘুমন্ত আবদুল তার টাঙায় উঠে বসল।

পারিজাত বক্সী কুমুদকে নিয়ে উঠলেন। তারপর স্টিমারের লোকটির সাহায্যে তিনটে প্যাকিং করা জিনিসও ওঠানো হল।

চারদিক একেবারে নিশুতি। মাঝে মাঝে দু-একটা কুকুরের চিৎকার। একটা ষাঁড়কে ঘুরতে দেখা গেল।

চৌরাস্তার মোড়ে একটা ঘড়িতে তিনটে বাজতে দশ।

টাঙা যখন থানায় পৌঁছাল, তখন ঠিক তিনটে।

দারোগা ওপরেই ছিল, সিপাইয়ের চেঁচামেচিতে নেমে এল।

সব শুনে হুংকার ছাড়ল, জায়গাটা কোথায় বলুন তো, আমি সবগুলোকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসছি।

পারিজাত বক্সী বললেন, আপনার সঙ্গে আমিও যাব, নইলে জায়গাটা আর মানুষগুলো আপনি ঠিক চিনতে পারবেন না।

কুমুদ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে পারিজাত বক্সীর একটা হাত আঁকড়ে ধরে বলল, না, না, আপনি যাবেন না। আপনাকে হাতের কাছে পেলে বদমাইশগুলো আবার বিপদে ফেলে দেবে।

পারিজাত বক্সী হেসে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, ভয় নেই, এবার আমরা তৈরি হয়ে যাব।

দারোগা সঙ্গে চারজন সশস্ত্র পুলিশ নিল।

তার আগে পারিজাত বক্সী বললেন, দয়া করে একবার এ তিনটে প্যাকিং খুলুন। ভিতরে কী আছে দেখা যাক। আপনার সামনে খুলব বলেই এতক্ষণ আমরা হাত দিইনি।

প্যাকিং খোলা হল।

দুটো মূর্তি খুলতেই কুমুদ চেঁচিয়ে উঠল। এই তো রতনগড়ের ধর্মরাজের মন্দিরের মূর্তি। দুটোরই মুণ্ড নেই। একটা মূর্তি পদ্মের ওপর বসে, আর-একটা অদ্ভুত এক জানোয়ারের ওপর। দুটো মূর্তির দেহ থেকে উজ্জ্বল সোনালি আলো বের হচ্ছে।

তৃতীয় মূর্তিটি কষ্টিপাথরের গণেশ। আকারে ছোটো।

পারিজাত বক্সী বললেন, চোরাই মূর্তি শনাক্ত করা হয়েছে, আর দেরি নয়, বেরিয়ে পড়া যাক, নইলে আসল মূর্তি পালাবে।

পুলিশের জিপ যখন গিয়ে পৌঁছাল, তখনও ভালো করে ভোর হয়নি। অন্ধকার সবে একটু তরল হচ্ছে।

পারিজাত বক্সী হতাশ হলেন। খাটিয়া খালি, কেউ শুয়ে নেই।

সকলে পাশের চালাঘরে ঢুকল।

ঘরের একেবারে কোণে একটা খাটিয়া। তার ওপর কে যেন আপাদমস্তক আবৃত করে শুয়ে আছে।

তার ওপর টর্চের আলো ফেলতেই লোকটা ধড়মড় করে জেগে উঠল। তারপরই বালিশের তলা থেকে রিভলভার বের করে ছোড়ার চেষ্টা করল।

কিন্তু কিছু করার আগেই, পুলিশ দুজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল।

তারপর পারিজাত বক্সী দারোগাকে নিয়ে যেখানে তিনি বন্দি ছিলেন, সেই ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

চাবি দিয়ে তালা খোলবার আগে সাবধান করে দিলেন, আপনারা তৈরি থাকবেন। আমি লোকটিকে ভালো করেই বেঁধে গিয়েছিলাম, বাঁধন খুলে ফেলেছে কি না জানি না।

দরজা খুলতে দেখা গেল লোকটা গড়িয়ে ঘরের আর-এককোণে চলে গেছে। পায়ের বাঁধন খোলা।

নিঝুম হয়ে পড়েছিল, একটা পুলিশ নিচু হয়ে তাকে দেখবার চেষ্টা করতেই লোকটা তাকে সবেগে লাথি মারল।

আরে বাপ! বলে পুলিশটা মুখে হাত দিয়ে ছিটকে পড়ল। তার হাতের পাশে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে দারোগা বাকি দুজন পুলিশ নিয়ে লোকটাকে বেদম প্রহার দিতে আরম্ভ করল।

দুজনকে হাতকড়া দিয়ে পুলিশ জিপে ওঠাল।

জিপ যখন বেশ কিছুটা গিয়েছে তখন পারিজাত বক্সী আঙুল দিয়ে দারোগাকে দেখালেন, ওই দেখুন, ওই সবুজ গাড়িটা অনেকক্ষণ ধরে অনুসরণ করছে। আমার মনে হয় ওরা বোধহয় এদের দুজনকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবে।

দারোগা বলল, ঠিক আছে। আসুক-না, আমরা তো দলে ভারী আছি।

পারিজাত বক্সী বললেন, এক কাজ করুন, সামনের বাঁকের মুখে জিপটা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে বলুন। আর একজন পুলিশকে বলুন, এ দুটো লোকের মুখে কাপড় গুঁজে দিতে, যাতে এরা চিৎকার না করতে পারে।

তা-ই করা হল। জিপটাকে ঘুরিয়ে একটা ঘন ঝোপের আড়ালে রাখা হল। পারিজাত বক্সীর নির্দেশে দারোগা আর পুলিশেরা রিভলভার হাতে কয়েকটা পাথরের পিছনে তৈরি হয়ে দাঁড়াল।

একটু পরেই সবুজ মোটরটা ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। মোটর থেকে দুজন লোক নামল। একজনের চোখে দূরবিন, আর-একজনের হাতে বোমা।

দূরবিন-চোখে লোকটা সামনের রাস্তার দিকে কিছুক্ষণ দেখল, তারপর অন্য লোকটার কানে কানে কী বলল।

তারপর দুজনেই পাশের জঙ্গলের দিকে মুখ ফেরাল।

বোঝা গেল, তারা সন্দেহ করছে পুলিশের জিপ পাশের জঙ্গলে ঘাপটি মেরে রয়েছে।

দূরবিন-চোখে লোকটা দূরবিন নামিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করল। দুজনেই সাবধানে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে লাগল।

একেবারে পাথরের সামনে আসতে পারিজাত বক্সী দারোগার গা টিপে ইশারা করলেন, সঙ্গে সঙ্গে দারোগার রিভলভার থেকে গুলি ছুটল।

অব্যর্থ লক্ষ্য। যে লোকটির হাতে বোমা ছিল, তার মণিবন্ধে গুলি লাগল।

লোকটা আর্তনাদ করে হাত চেপে বসে পড়ল। হাতের বোমা রাস্তার ওপর ছিটকে পড়ল। প্রচণ্ড শব্দ। ধুলোর বৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চারদিকে অন্ধকার। অন্ধকার কমতে দেখা গেল সবুজ গাড়িটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

অন্ধকার দূর হবার সঙ্গে সঙ্গে দারোগা আর পুলিশেরা লোক দুটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের বন্দি করে ফেলল। তারপর দড়ি দিয়ে ভালো করে বেঁধে জিপে তুলল।

দারোগা বলল, খুব জোরালো বোমা স্যার। আমাদের জিপের ওপর পড়লে কী হত বুঝতে পারছেন!

পারিজাত বক্সী কোনও উত্তর দিলেন না। শুধু মুচকি হাসলেন।

থানায় যখন সবাই গিয়ে পৌঁছাল, তখন বেশ রোদ উঠেছে।

লোক চারজনকে হাজতে রাখা হল। পুলিশের সতর্ক প্রহরায়।

খাওয়াদাওয়া করে পারিজাত বক্সী দারোগাকে বললেন, আমি একটা ট্রাঙ্ককল করব।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, করুন।

পারিজাত বক্সী মিস্টার বাসুকে ফোন করে সব জানালেন।

মিস্টার বাসু খুব খুশি। আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন। তারপর বললেন, আমি বিহারের পুলিশের বড়োকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করছি। তোমরা পুলিশের সঙ্গে ছাড়া আসবার চেষ্টা কোরো না। পথে বিপদ হতে পারে। মূর্তি চোরের দল সারা দেশে ছড়ানো। তোমাদের আবার আক্রমণ করাও বিচিত্র নয়।

পারিজাত বক্সী বললেন, ঠিক আছে, আমরা পুলিশ গার্ড ছাড়া বের হব না।

একেবারে রাজকীয় ব্যবস্থা। বিহার পুলিশের উচ্চপদস্থ এক অফিসার মোটর নিয়ে হাজির। সঙ্গে গোটা চারেক সশস্ত্র পুলিশ।

ওরা বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত যাবে, সেখান থেকে দায়িত্ব নেবে বাংলার পুলিশ।

খাওয়াদাওয়া দারোগার বাড়িতেই হল।

দারোগা পারিজাত বক্সীর পিঠ চাপড়ে বলল, মিস্টার বক্সী, আপনার কৃতিত্বের কথা আমরা চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব। আপনার জন্যই এই কুখ্যাত দলটিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলাম। এরা নিজেদের মাতৃভূমি থেকে পবিত্র দেব-দেবীর মূর্তি শুধু অর্থের জন্য দেশ-বিদেশে চালান দেয়। এমন ঘৃণ্য কাজ আর কী হতে পারে!

পারিজাত বক্সী বাধা দিয়ে বললেন, কৃতিত্ব আমার কিছুই নয়। আপনাদের সকলের সমবেত চেষ্টায় এ কাজ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আসল কৃতিত্ব কাদের জানেন?

কাদের?

এই কুমুদ আর তার ভাগনে তুলসীর। এদের অসম-সাহসিকতার তুলনা নেই। একজনকে আমার সঙ্গে নিয়ে চলেছি, কিন্তু তুলসী কোথায় আমাদের জানা নেই।

দারোগা হুংকার ছাড়ল, তুলসীর বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। যখন এরা ধরা পড়েছে তখন কী করে মুখ খোলাতে হয়, সে ওষুধ আমার জানা আছে।

যাবার সময়ে কুমুদ জিজ্ঞাসা করল, এই মূর্তিগুলো সঙ্গে নিয়ে যাবেন না? অন্তত রতনগড়ের মন্দিরের মূর্তি দুটো?

পারিজাত বক্সী হাসলেন, এ মূর্তি নিয়ে যাওয়া এখন সম্ভব নয়। বিহার কোর্টে কেস হবে। কেস শেষ হয়ে গেলে মূর্তি দুটো আবার রতনগড়ের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা হবে। চলো কুমুদ, এবার আমরা রওনা হই।

এদের যাত্রার খবর পশ্চিমবাংলার পুলিশ কর্তৃ,পক্ষকে আগেই জানানো হয়েছিল।

বাংলা-বিহার সীমান্তে পৌঁছে পারিজাত বক্সী নিজেই অবাক। পুলিশ নিয়ে মিস্টার বাসু নিজে এসেছেন নিয়ে যেতে।

কুমুদ, ওই দেখো, কারা এসেছেন।

কুমুদ দেখল, রাস্তার ধারে দাদুর মোটর। মোটরের সামনে বাবা, মা, দিদি, জামাইবাবু আর তুলসী।

তুলসী ছুটে এসে কুমুদকে জড়িয়ে ধরতেই কুমুদ জিজ্ঞাসা করল, আরে তুলসী, তুই!

তুলসী বলল, কুমুদমামা চলো, যেতে যেতে তোমাকে সব বলব, কী করে আমি পালিয়ে এসেছি।

সকলের চোখে জল, তবে এ জল আনন্দের। বাড়ির ছেলের বাড়ি ফিরে আসার জন্য।

***

‘শুকতারা’ মে ১৯৭৭ থেকে ধারাবাহিক