উপন্যাস
গল্প

কবন্ধ বিগ্রহের কাহিনি – ৬

কুমুদের বাবা তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোন ধরলেন।

খুব অল্পক্ষণ কথা হল। ফোন নামিয়ে কুমুদের বাবা যখন ফিরে এলেন, তখন তাঁর মুখ-চোখের চেহারা অনেকটা শান্ত।

ওদের কাছ থেকেই খবর এসেছিল।

তুলসীর বাবা প্রশ্ন করল, কী ব্যাপার?

কে একজন জানাল, আমার বাকি টাকা পেয়েছে। কুমুদকে এবার ছেড়ে দেব, তবে ওদের নিজেদের কিছু কাজ বাকি আছে, তাই কদিন দেরি হবে।

আর পারিজাত বক্সী?

কী জানি, তাঁর কথা তো কিছু বলল না।

তুলসীর বাবা বলল, যতক্ষণ না কুমুদ বাড়ি ফিরে আসে ততদিন বিশ্বাস নেই। তুলসীর কাছে যা শুনলাম তা তো ভীষণ ব্যাপার।

কীরকম?

তুলসীকে পাহাড়ের ওপর এক মন্দিরের মধ্যে ফেলে দিয়ে লোকটা চলে গিয়েছিল, বের হবার একমাত্র পথ পাথরচাপা দিয়ে। আমার তো মনে হয়, উদ্দেশ্যই ছিল তুলসীকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলা। তুলসী কোনওরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে।

এখন দেখছি ওদের অসাধ্য কোনও কাজ নেই।

তুলসীর বাবার ওঠবার মুখে তার শ্বশুর সাবধান করে দিল। তুমি নিজে একটু সাবধান হয়ে চলাফেরা করো।

আমি?

তুলসীর বাবা বিস্মিত হল।

কিছু বলা যায় না। তুলসীকে না পেলে তার রাগটা তোমার ওপর পড়াও বিচিত্র নয়। তুমি ফাঁকা জায়গায় একদম যাবে না, আর তুলসীকে বাড়ি থেকে কোথাও বের হতে দেবে না।

তুলসীর বাবা চলে যেতেই কুমুদের বাবা বেরিয়ে পড়লেন।

লালবাজারে গিয়ে সহকারী কমিশনার মিস্টার বাসুর কাছে নিজের কার্ড পাঠালেন।

মিনিট দশেক, তারপরই মিস্টার বাসু ডেকে পাঠালেন।

কী, বলুন?

কুমুদের বাবা সব বললেন। পারিজাত বক্সীর কথাও।

মিস্টার বাসু মাথা নাড়ালেন, মনে পড়ছে, পারিজাত বক্সী হাতের লেখার একটা ব্যাপারে এখানে এসেছিলেন। আমার তো মনে হয় আপনার ছেলে ফিরে আসবে। কয়েকদিন সময় নিয়েছে এইজন্য, এর মধ্যে তারা হয়তো মূর্তিগুলো বাইরে পাচার করবে। আপনি দিন পনেরো পর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। পারিজাত বক্সীর ওপর আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। তিনি নিশ্চয় একটা সুরাহা করতে পারবেন।

কুমুদের বাবা বেরিয়ে এলেন।

কোনও কাজে মন দিতে পারেন না। দারুণ একটা অস্বস্তি। কোথা থেকে যেন কী হয়ে গেল। ছেলে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনল।

ভাবলেন, একবার সরাসরি তুলসীর সঙ্গে কথা বলবেন। যদিও জামাইয়ের সঙ্গে সকালেই কথা হয়েছে, তবু তুলসী কী বলে সেটাও শোনা দরকার। মন্দিরটা ঠিক কোন জায়গায় সেটাও জানতে পারলে ভালো হত।

ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন সোজা জামাইয়ের বাড়ি যেতে।

ঘণ্টা আড়াই, তার মধ্যেই মোটর রতনগড়ে পৌঁছে গেল।

জামাইয়ের বাড়ির কাছ বরাবর গিয়েই কুমুদের বাবা চমকে উঠলেন। বহু লোকের জটলা বাড়ির সামনে। কুমুদের বাবা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।

কী হল, তুলসীকে কি আবার কোনওরকমে ধরে নিয়ে গেল!

কুমুদের বাবা মোটর থেকে নামতেই গাঁয়ের লোকেরা তাঁকে ঘিরে ধরল।

কী হয়েছে?

কুমুদের বাবার প্রশ্নের উত্তরে লোকেরা আঙুল দিয়ে দেখাল।

বাড়ির সামনে দিকের অনেকটা ধসে পড়েছে। জানলার দুটো পাল্লা ঝুলছে।

কী করে হল?

বোমা।

কুমুদের বাবা লোকের পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।

মাঝখানে ঘরে খাটের ওপর তুলসী। তার মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ। মাথার কাছে তুলসীর মা। একটু দূরে তুলসীর বাবা দাঁড়িয়ে।

বাবাকে ঢুকতে দেখেই মেয়ে ছুটে কাছে এল।

বাবা, এ সময়ে আপনি?

কেমন মনটা হল, ভাবলাম সবকিছু তুলসীর মুখ থেকে শুনে আসি। কিন্তু কী ব্যাপার?

তুলসীর বাবা বলল, তুলসীকে বারণ করে দেওয়া হয়েছে। সে বাড়ি থেকে বের হয় না। আজ বাইরের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে ছিল। রাস্তায় একটা বাউল কাঁধে ঝোলা, একতারা বাজিয়ে গান করছিল। হঠাৎ ঝোলা থেকে বোমা বের করে জানলার দিকে ছুড়ে দিল। কী প্রচণ্ড আওয়াজ। সারা বাড়িটা থরথর করে কেঁপে উঠল। দেখেছেন তো সামনের দিকটা কীভাবে ভেঙে পড়েছে।

কুমুদের বাবা একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুলসীর চোট কি খুব বেশি?

তুলসীর বাবা বলল, তুলসী খুব সময়ে জানলা থেকে সরে এসেছে, নইলে কী হত বুঝতেই পারছেন। দেয়াল ভেঙে ইঁটের টুকরো মাথায় আর হাতে লেগেছে। ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গেছে।

কুমুদের বাবা নাতির বিছানার ওপর বসলেন।

তুলসীর চোখ বন্ধ। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়ে থাকবে।

কপালে হাত দিয়ে দেখলেন। না জ্বর নেই, তবে পরে জ্বর হতে পারে।

জামাইয়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, বাউলটাকে কেউ ধরতে পারেনি?

ঠিক দুপুরবেলা, কোথাও কেউ ছিল না। আওয়াজ শুনে সবাই এসে জড়ো হয়েছে।

লোকটাকে তুলসী চিনতে পেরেছে?

না। বললে তো একে কখনো দেখেনি। তবে বোমার শব্দের একটু পরেই জঙ্গলের মধ্যে মোটরের শব্দ পেয়েছিল। লোকটা বোধহয় মোটরে এসেছিল।

উঃ, কী সাহস!

লোকটার পোশাক আর একতারা জঙ্গলের মধ্যে পড়ে ছিল। একটা লোক কুড়িয়ে এনেছে।

থানায় খবর দেওয়া হয়েছে?

দারোগা এসে সব লিখে নিয়ে গেছে। ভাবছি তুলসীকে কিছুদিন এখান থেকে সরিয়ে দেব। আপনাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেব। আবার ভাবছি নিয়ে যাবার সময় পথে গোলমাল না হয়।

কুমুদের বাবা একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, গোলমাল আর কী হবে। তোমরা যদি বলো, তাহলে আমি পুলিশ নিয়ে আসতে পারি।

দেখি, তুলসী সেরে উঠুক।

.

কুমুদের বাবা বাড়ি গিয়ে শুনলেন, লালবাজার থেকে ফোন এসেছিল।

লালবাজার থেকে ফোন। তবে কি পুলিশ কুমুদের কোনও খবর পেয়েছে? দুর্বৃত্তরা কুমুদকে ছেড়ে দেবে এ কথা ফোনে তাঁকে বলেছিল।

কে ফোন করেছিল কিছু বলেছেন?

হ্যাঁ, ডেপুটি কমিশনার মিস্টার বাসু ফোন করেছিলেন। বলেছেন আপনি এলেই যেন ফোন করেন।

কুমুদের বাবা তখনই ফোন তুললেন।

একটু পরেই মিস্টার বাসুকে পাওয়া গেল।

আপনি ফোন করেছিলেন?

হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে একবার দেখা হওয়া দরকার।

কখন বলুন?

কখন আপনার সুবিধা হবে?

সন্ধ্যার সময় যদি যাই।

ঠিক আছে। তা-ই আসুন।

কিছু খবর আছে?

আপনার সঙ্গে দেখা হলে বলব।

মিস্টার বাসু ফোন নামিয়ে রাখলেন।

কুমুদের বাবা রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কুমুদ ফিরে এসেছে এমন খবর তো মিস্টার বাসু অনায়াসেই দিতে পারতেন।

নিশ্চয় অশুভ খবর, তাই তাঁকে ডেকে পাঠালেন।

কুমুদের বাবা যখন গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে, তখন তাঁর স্ত্রী ঘরে ঢুকলেন।

ক্লান্ত বিষণ্ণ চেহারা। কোনওরকমে ঘরে ঢুকে ইজিচেয়ারে বসে পড়লেন। এই অল্প পরিশ্রমেই হাঁপাচ্ছেন।

তুলসী কেমন আছে?

কুমুদের বাবা ঠিক খবর বললেন না। বললে তাঁর স্ত্রী আরও চিন্তিত হতেন।

তাই তিনি শুধু বললেন, ভালো।

কুমুর কথা কিছু বলল?

না, কুমু আর তুলসী এক জায়গায় ছিল না, কাজেই কুমুর কথা তুলসী জানে না। কুমুর খবর তো পেয়েছি।

পেয়েছ? কই, আমাকে তো কিছু বলোনি।

উত্তেজনায় কুমুদের মা-র সারা মুখ আরক্ত হয়ে উঠল।

পুরো টাকা পাঠিয়েছি, এবার তাকে ছেড়ে দেবে।

কবে?

তা জানি না। আজ সন্ধ্যার পর তো লালবাজারে যাচ্ছি, দেখি যদি কোনও খবর পাই।

কুমুদের মা আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সন্ধ্যার আগেই কুমুদের বাবা লালবাজার রওনা হয়ে গেলেন।

মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পরই কুমুদের বাবার ডাক এল।

এবার মিস্টার বাসু যেন বেশ গম্ভীর।

একবার চোখ তুলে কুমুদের বাবাকে দেখে নিয়ে বললেন, আচ্ছা, আপনি যে কদিন আগে ফোন পেয়েছিলেন, তাতে আপনার ছেলে ছাড়া আর কারো কথা বলেছিল?

কুমুদের বাবা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, আর কার কথা বলবে?

পারিজাত বক্সীর কথা?

না।

মিস্টার বাসু ড্রয়ার খুলে একটা খাম বের করে কুমুদের বাবার সামনে ঠেলে দিয়ে বললেন, চিঠিটা পড়ে দেখুন।

খামের ওপর লেখা—মিসেস পারিজাত বক্সী। তলায় ঠিকানা।

কুমুদের বাবা খাম থেকে চিঠিটা বের করলেন।

চৌকো সাদা কাগজ। টাইপ করা চারটে লাইন। তলায় কোনও নাম নেই—

টিকটিকি ফাঁদে পড়েছে। সহজে ছাড়া পাবে না। আমাদের পিছনে লাগার উপযুক্ত ফল ভোগ করতে হবে।

লেখাটা ইংরেজিতে। তার মানে পারিজাত বক্সীও ধরা পড়েছে।

পারিজাত বক্সীকে কুমুদের বাবাই নিয়োগ করেছিলেন, কাজেই কুমুদকে যে ছেড়ে দেবে, এমন মনে হয় না। কুমুদের বাবার ওপর রাগটা ছেলের ওপর পড়বে।

কুমুদের বাবা চুপচাপ বসে রইলেন, কী বলবেন ভেবে পেলেন না।

কবে কখন আপনার কাছে ফোন এসেছিল জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই, কারণ খোঁজ নিলে দেখা যাবে ফোনটা কোনও পাবলিক ফোন থেকে করা হয়েছিল। লোকের পাত্তা পাওয়া যাবে না।

এবার কুমুদের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, কী করবেন ঠিক করেছেন?

ভাবছি আপনার নাতির সঙ্গে একবার কথা বলব।

কিন্তু সে তো কুমুদকে দেখেনি। মানে একসঙ্গে তারা ছিল না।

না দেখলেও, যারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের চেহারার বর্ণনা শুনতে চাই। আপনার নাতিকে কতকগুলো ফোটোর অ্যালবাম দেখাব, যদি চেহারা মিলে যায়। তাকে কবে আনতে পারবেন?

তাকে আনার ব্যাপারে কিছু অসুবিধা আছে।

অসুবিধা? কী অসুবিধা?

কুমুদের বাবা বোমার ঘটনাটা বললেন। বাউলবেশী দুর্বৃত্তের কথাও।

শুনতে শুনতে মিস্টার বাসু উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলের ওপর সক্রোধে ঘুসি মেরে বললেন, বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। এ আমাদের চ্যালেঞ্জ করা। ঠিক আছে, আমরাও এবার আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব। শুনুন, কাল আমি নিজে গিয়ে আপনার নাতিকে নিয়ে আসব। আমার সঙ্গে পুলিশ থাকবে। কোনও ভয় নেই। তবে আমি আপনার জামাইয়ের বাড়ি চিনি না, দয়া করে আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। কখন আপনার সুবিধা হবে, আপনাকে তুলে নিয়ে যাব। আপনার ঠিকানা আমার জানা।

আপনি যখন বলবেন।

সকাল দশটা।

মিস্টার বাসু তুলসীদের বাড়ি গিয়ে দেখলেন ফটকের দু-পাশে দুজন পুলিশ। থানার দারোগা এই বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন।

মিস্টার বাসুর সঙ্গে চারজন সশস্ত্র পুলিশ।

তুলসীর বাবা বাড়িতেই ছিল, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল।

মিস্টার বাসু, কুমুদের বাবা তুলসীর কাছে গিয়ে বসলেন। তার কাছে মিস্টার বাসু সব শুনলেন।

মিস্টার বাসুর আসার খবর পেয়ে থানার দারোগাও এসে হাজির। তাকে মিস্টার বাসু প্রয়োজনমতো নির্দেশ দিলেন।

তুলসীকে যেন চোখে চোখে রাখা হয়। এ বাড়ির ত্রিসীমানায় উটকো লোক না ঢোকে। গাঁয়ে নতুন কোনও সন্দেহজনক লোক এলেই যেন তাকে পাকড়াও করে জেরা করা হয়।

কিছুক্ষণ পর তিনি তুলসীকে মোটরে উঠিয়ে নিলেন। সঙ্গে তুলসীর বাবাও গেল।

লালবাজারে তুলসীর সামনে বিরাট একটা ফোটোর অ্যালবাম রেখে মিস্টার বাসু বললেন, এই ফোটোগুলো দেখে যাও। তোমাকে যে ধরে মন্দিরের মধ্যে রেখে দিয়েছিল, দেখো তো তার ফোটো আছে কি না।

তুলসী খুব মনোযোগ দিয়ে গোটা অ্যালবাম দেখে গেল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, না, তার ফোটো এখানে নেই।

লোকটাকে কেমন দেখতে?

খুব লম্বা, ফরসা, মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। লোকটার গায়েও অসীম শক্তি।

অসীম শক্তি?

হ্যাঁ, তা না হলে অবলীলাক্রমে আমাকে কাঁধে ফেলে চলতে পারে!

মিস্টার বাসু গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, লোকটার ফোটো যে থাকবে না, এটা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম, কারণ খোদ কর্তারা পিছনে থাকে। তাদের শাগরেদদের দিয়ে এসব কাজ করায়। যাহোক, তুমি কিন্তু বাড়ি থেকে একদম বের হবে না। যদিও আমরা পাহারা দেবার সবরকম চেষ্টা করছি, তবু সাবধান হওয়াই ভালো।

তুলসী সায় দিল। তার খুব শিক্ষা হয়েছে। সে কিছুদিন বাড়ির বাইরে যাবে না।

মিস্টার বাসু তুলসীর কাছ থেকে বাউলের চেহারার বর্ণনাও শুনলেন।

তুলসীদের ফেরার বন্দোবস্ত করে দিয়ে মিস্টার বাসু বিহারের পুলিশের বড়োকর্তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলেন।

তাঁর কাছে কুমুদ আর পারিজাত বক্সীর ফোটো পাঠিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলেন, অন্তত ভাগলপুরের কাছাকাছি থানায় এর কপি যেন পাঠিয়ে দিয়ে তল্লাশি করা হয়।

কুমুদের বাবা দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, সে কথাও জানিয়ে দিলেন।

এরপর মিস্টার বাসু সহকারীদের নিয়ে জরুরি মিটিংয়ে বসলেন।

পারিজাত বক্সী তাঁদের শুধু পরিচিতই নন, বিশেষ বন্ধুলোক। বহুবার পুলিশের অনেক জটিল কেসের সমাধান করেছেন। লোকটার একমাত্র দোষ, ভীষণরকম বেপরোয়া। নিরস্ত্র অবস্থায় কিংবা সামান্য অস্ত্র নিয়ে বিপজ্জনক এলাকায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে। এ দেশের অপরাধীমহলের তিনি এক নম্বরের শত্রু। যদি হাতের কাছে পায়, তাহলে সহজে ছাড়বে, এমন মনে হয় না।

দুজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার বিহার রওনা হয়ে গেল।

মিস্টার বাসু রাত দশটায় বাড়ি ফিরে শুনলেন তাঁর একটা ফোন এসেছিল।

কার ফোন?

তা কিছু বলেনি। বলেছে রাত এগারোটায় আবার ফোন করবে।

মিস্টার বাসু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। দুর্বৃত্তরা কি পারিজাত বক্সীকে খতম করে তাঁকে সেই সংবাদ জানাচ্ছে? এদের অসাধ্য কিছু নেই!

তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে মিস্টার বাসু ফোনের কাছে এসে বসলেন।

এগারোটায় নয়, ফোন বেজে উঠল এগারোটা দশে।

মিস্টার বাসু?

কথা বলছি।

ফোনের ওপারের কণ্ঠ শুনে মিস্টার বাসু অনেকটা আশ্বস্ত হলেন।

কুমুদের বাবা কথা বলছেন।

আপনার সঙ্গে বিশেষ দরকারি কথা আছে।

শুনুন, আপনাকে আমি একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি, সেই ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলুন।

মিস্টার বাসু একটা নম্বর দিয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।

একটু পরেই তাঁর প্রাইভেট ফোন বেজে উঠল।

মিস্টার বাসু ফোন তুলে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এবার বলুন।

আমি একটা চিঠি পেয়েছি।

কী চিঠি?

পড়ে শোনাচ্ছি আপনাকে।

কুমুদের বাবা পড়ে শোনালেন—

আপনাকে আগে জানানো হয়েছিল যে আপনার ছেলেকে মুক্তি দেওয়া হবে। তার মুক্তিপণের টাকা আমাদের হস্তগত হয়েছে, কিন্তু পুনরায় বিবেচনা করে ঠিক করা হয়েছে যে, যেহেতু আপনি মূর্খের মতন সমস্ত ব্যাপারটা পুলিশের গোচরে এনেছেন এবং একজন টিকটিকি নিয়োগ করেছেন, সেইজন্য দণ্ডস্বরূপ আপনাকে আরও দশ হাজার টাকা দিতে হবে।

পাঁচ দিনের মধ্যে এ টাকা না পেলে আপনাকে পার্সেলযোগে আপনার পুত্রের ছিন্ন মুণ্ড পাঠানো হবে।

এই দশ হাজার টাকা একশো টাকার নোটে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দক্ষিণ গেটের সামনে যে মূর্তি আছে তার পায়ের ফাঁকে দুপুরবেলা রেখে চলে যাবেন। সেখানে অপেক্ষা করবেন না।

যদি আপনি সঙ্গে পুলিশ আনেন তাহলে সেই বোকামির চূড়ান্ত দায়িত্ব আপনার। শুধু পুত্রের নয়, আপনারও প্রাণসংশয় জানবেন।

কুমুদের বাবার চিঠিটা পড়া দেখেই বোঝা গেল তিনি অত্যন্ত ভয় পেয়েছেন। শুধু ভয়ই নয়, আশাভঙ্গও। আশা করেছিলেন, কুমুদ ফিরে আসবে। সে আশা শেষ হয়ে গেল।

আপনার চিঠিটা কি ডাকে এসেছে?

না, আমার রোগীর মধ্যে কেউ বন্ধ খামটা কম্পাউন্ডারের হাতে দিয়ে গেছে। রোগী মানে, রোগী সেজে এসেছিল।

চিঠিটা নিয়ে কাল আপনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন।

খুব ভোরে কুমুদের বাবা আবার এক ফোন পেলেন। মিস্টার বাসুর গলা।

শুনুন, ভেবে দেখলাম আপনার এখানে আসা ঠিক হবে না। বদমায়েশগুলো নিশ্চয় আপনার ওপর নজর রাখবে। আপনি আসবেন না, আমি দিন দুয়েকের মধ্যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

পরের দিন কুমুদের বাবা বসে বসে রোগী দেখছেন, এমন সময়ে হাত-বাঁধা একজন এসে পিছনের বেঞ্চে বসল।

ইদানীং খুব জরুরি কেস ছাড়া কুমুদের বাবা দেখেন না। মনের এ চাঞ্চল্য নিয়ে বেশি পরিশ্রম করতেও পারেন না।

হাত-বাঁধা রোগী সব শেষে তাঁর কাছে এসে দাঁড়াল।

কী ব্যাপার? মারপিট নাকি?

লোকটা মুচকি হেসে বলল, আমি মিস্টার বাসুর কাছ থেকে আসছি।

পলকে কুমুদের বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন।

ভিতরে এসো।

রোগী দেখার ভিতরের চেম্বারে লোকটা ঢুকল। পিছন পিছন কুমুদের বাবা।

লোকটা বলল, মিস্টার বাসু আপনাকে জানাতে বলেছেন যে পরশু আপনি টাকাটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রেখে আসবেন।

কুমুদের বাপ রীতিমতো বিস্মিত হলেন।

সে কী, মিস্টার বাসু টাকাটা দিয়ে দিতে বলেছেন! কিছুদিন আগে তাঁর এগারো হাজার টাকা গেছে, আবার দশ হাজার যাবে! টাকার জন্য নয়, এ পর্যন্ত ছেলে ফিরে এল না। দুর্বৃত্তদের যা ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, এইভাবে কোনও না কোনও অছিলায় তারা কেবল টাকা চেয়েই যাবে। এই যদি পুলিশের কর্মতৎপরতা হয়, তাহলে লোকেরা এদের ওপর নির্ভর করবে কী করে!

লোকটা বোধহয় কুমুদের বাবার মনের অবস্থা বুঝতে পারল। আপনি বিচলিত হবেন না। টাকা আপনাকে দিতে হবে না।

টাকা দিতে হবে না?

না। টাকার মাপে কাগজ কেটে একটা খামে ভরে যেখানে রাখবার কথা সেখানে দুপুরবেলা রেখে আসবেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, বাকি যা করার মিস্টার বাসুই করবেন। তাহলে চলি। ওই কথা রইল। পরশু দুপুরবেলা।

লোকটা বেরিয়ে গেল।

কুমুদের বাবা চুপচাপ বসে রইলেন। শত্রু সামান্য তো নয়ই, রীতিমতো দুর্দান্ত এবং নিষ্ঠুর। ওদের সঙ্গে প্রতারণা করার ফল তাঁকেই ভোগ করতে হবে। হয়তো ছেলেকে চিরদিনের জন্য হারাবেন। নিজেরও বিপদ হতে পারে। কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে গিয়েও তো লাভ নেই।

অনেক ভেবেচিন্তে কুমুদের বাবা ঠিক করলেন পুলিশের কথামতো কাজ করাই ভালো। তারাই দেশের রক্ষক।

ঠিক দিনে কুমুদের বাবা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে হাজির হলেন। পকেটে খাম। তাতে নোটের সাইজের কাগজ।

দুপুরবেলা মেমোরিয়াল একেবারে ফাঁকা। ধারেকাছে কাউকে দেখা গেল না।

খামটা সন্তর্পণে মূর্তির পায়ের কাছে রেখে দিয়ে ফিরে একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়ালেন।

মিনিট পনেরো-কুড়ি, কেউ এল না।

হঠাৎ একটা মোটরের শব্দ। কুমুদের বাবা মুখ ফিরিয়ে দেখলেন সবুজ রঙের একটা মোটর গেটের একটু দূরে এসে থামল।

মোটর থেকে কালো বেঁটে একটি লোক নামল। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। মাথায় টিকি। দেহাত থেকে শহর দেখতে যে ধরনের লোক আসে, ঠিক তেমনই।

লোকটা এদিক-ওদিক দেখে আস্তে আস্তে এগিয়ে মূর্তির কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

আর-একবার এদিক-ওদিক দেখে খামটা তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যয়।

ঝোপের আড়ালে একটা লোক লুকিয়ে ছিল। তার পরনে ছেঁড়া গেঞ্জি আর প্যান্ট। মাথায় কাপড়ের ফেট্টি, তাতে নানা রঙের কাগজ ঝোলানো।

লোকটাকে কুমুদের বাবাও লক্ষ করেননি।

পাগলা সিংহবিক্রমে সেই দেহাতি লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে দেহাতি লোকটা পকেট থেকে রিভলভার বের করে পাগলাটাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ল। গুড়ুম।

পাগলাটা রক্তাক্ত দেহে ঘাসের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

দেহাতি লোকটা ছুটে গেটের দিকে পালাল।

কিন্তু গেট পর্যন্ত পালাতে পারল না, তার আগেই সাদা প্যান্ট-পরা চারজন লোক পিস্তল হাতে তাকে ঘিরে ফেলল।

গুড়ুম, গুড়ুম। এবার সবুজ মোটর থেকে গুলির শব্দ এল। মাত্র দুবার।

কুমুদের বাবা দেখলেন দুজন লোক যারা মাঠে আইসক্রিম বিক্রি করছিল, তারা মোটরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

দেহাতি লোকটাকে চারজন মিলে টানতে টানতে মোটরের দিকে নিয়ে গেল।

কুমুদের বাবা আর অপেক্ষা করতে সাহস করলেন না। ছুটে নিজের মোটরে গিয়ে উঠলেন।

বিকালের দিকে তিনি নিজের থেকেই লালবাজারে গেলেন।

মিস্টার বাসুর সঙ্গে দেখা হতে তিনি বললেন, সুখবর, দুজনকে ধরতে পেরেছি।

কুমুদের বাবা যে আড়াল থেকে সব দেখেছেন, সে কথা কিছু বললেন না।

তিনি শুধু বললেন, এতে আমার ছেলের কিছু অমঙ্গল হবে না?

মিস্টার বাসু মাথা নাড়লেন, কী হবে? এবার বরং ওরা ভয় পাবে। ওদের হাতে যেমন আপনার ছেলে আর পারিজাত বক্সী রয়েছে, তেমনই আমাদের হাতে ওদের দলের দুজন রয়েছে।

লোক দুটো স্বীকার করেছে?

এ পর্যন্ত নয়। একটা লোক তো বলছে সে দেহাত থেকে শহর দেখতে এসেছিল। মূর্তির পায়ের কাছে একটা খাম পড়ে থাকতে দেখে কৌতূহলবশত সেটা তুলে নিয়েছিল। যখন জিজ্ঞাসা করা হল, বাপু গুলি ছুড়লে কেন? বলল, নিজেকে রক্ষা করার জন্য। পাগলটা ওভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তারপর রিভলভারের লাইসেন্স দেখতে চাওয়া হল। তখন আর দেখাতে পারে না। সঙ্গীরও ওই এক অবস্থা। ছেলে চুরি কিংবা মূর্তি চুরির সম্বন্ধে একটি কথাও বের করা যাচ্ছে না। দেখা যাক, কতদিন মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে।

কুমুদের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের যে ছেলেটি পাগল সেজে আহত হয়েছিল, তার অবস্থা কেমন?

মিস্টার বাসু উত্তর দিলেন, ভালোই আছে। হাতে সামান্য চোট লেগেছিল। ভাগ্য ভালো গুলি চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।

কুমুদের বাবা চলে যেতে মিস্টার বাসু উঠে যে ঘরে টিকিধারী লোকটা আটক আছে সে ঘরে ঢুকলেন।

দুজনকে আলাদা ঘরে রাখা হয়েছে।

একেবারে কোণে একটা টুলের ওপর লোকটা বসে ছিল। ধস্তাধস্তির সময় মুখের দু-এক জায়গায় চোট লেগেছে।

মিস্টার বাসু ঘরে ঢুকতে লোকটা ভ্রূক্ষেপও করল না। একভাবে বসে রইল।

মিস্টার বাসু লোকটার একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

তোমার স্যাঙাত সবকিছু স্বীকার করেছে। দলের অন্য সকলের নামধামও বলে দিয়েছে। তোমার এ বিষয়ে কিছু বলার আছে?

লোকটি অবিচল।

কী হল?

লোকটি মুখ তুলে একবার মিস্টার বাসুর দিকে দেখল, তারপর বলল, এসব কথা আমাকে শুনিয়ে কোনও লাভ নেই। আপনাকে তো আগেই বলেছি এসব ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি এ শহরে নতুন। শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম।

এবার মিস্টার বাসু লোকটার দিকে আরও এক-পা এগিয়ে গেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, তাহলে আর-একটা খবর শোনো। তোমার পক্ষে খুব দরকারি খবর।

লোকটা কোনও চাঞ্চল্য প্রকাশ করল না। ফিরেও দেখল না।

যে পাগলটিকে তুমি গুলি করেছিলে, সে আজ সকালে হাসপাতালে মারা গেছে। এর কী ফল হতে পারে এবং হবে, আশা করি বুঝতে পারার মতন বুদ্ধি তোমার আছে।

এবার লোকটা একটু নড়েচড়ে বসল। অস্ফুটকণ্ঠে বলল, নিজেকে বাঁচাবার জন্য আমাকে গুলি ছুড়তে হয়েছিল।

বিনা লাইসেন্সের রিভলভার দিয়ে? বেশ, কোর্টে ওই কথাই বোলো। আমি তোমার জন্য খুব দুঃখিত।

মিস্টার বাসু সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

শেষের ঘরে অন্য লোকটি বন্দি ছিল। সে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

সেখানে একটি ইনস্পেকটর বসে ছিল। মিস্টার বাসু ঢুকতেই সে স্যালুট করে বেরিয়ে গেল।

এ লোকটার পরনে শার্ট আর ফুল প্যান্ট। বলিষ্ঠ গড়ন। চেহারা দেখে নেপালি বলেই মনে হয়।

তোমার কিছু বলবার আছে?

কী বিষয়ে?

ময়দানের ঘটনা সম্পর্কে?

যা বলার আমি কোর্টেই বলব। আপনারা অযথা বিরক্ত করতে আসবেন না।

মিস্টার বাসু বুঝতে পারলেন, একেবারে পাকা লোক। এর কাছ থেকে কথা বের করা বেশ শক্ত ব্যাপার।

তবু শেষ চেষ্টা হিসাবে বললেন, আপনার সঙ্গী সব কথাই আমাদের বলেছেন। আপনাকে জ্বালাতন করার আর আমাদের দরকার হবে না।

লোকটা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ধন্যবাদ।

মিস্টার বাসু নিজের কামরায় ফিরে এলেন।

সহকারীকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, আমাদের অ্যালবামে এদের ফোটো আছে?

না স্যার। মনে হচ্ছে এরা নতুন।

মিস্টার বাসু সায় দিলেন, এরা এক লোক বেশি দিন এক জায়গায় রাখে না। দেশে- বিদেশে চালান দেয়। আমি ভাবছি একবার তুলসীকে ডেকে পাঠাব, যদি সে ওদের কাউকে চিনতে পারে।

সেই ভালো স্যার। ঘণ্টা দুয়েক ধরে এদের জেরা করেছি, একটি দরকারি কথাও বের করতে পারিনি।

মিস্টার বাসু বললেন, কুমুদের বাবাকে একবার ফোনটা দাও তো।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কুমুদের বাবাকে ফোনে পাওয়া গেল।

ডাক্তার সায়েব, আপনার নাতি তুলসীকে একবার আমার দরকার।

কী ব্যাপার?

আর কিছু নয়, লোক দুটোকে যদি চিনতে পারে।

কিন্তু তুলসীকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়ার বিপদের কথা তো জানেন।

সে দায়িত্ব আমার। গতবারের মতন আমি নিয়ে আসার সব বন্দোবস্ত করব।

কবে দরকার?

দেরি করতে চাই না। কাল হলেই ভালো হয়। ধরুন, কাল সকাল এগারোটা। আগে আপনাকে তুলে নেব।

আগের বারের মতন সশস্ত্র পুলিশ পরিবৃত হয়ে তুলসী লালবাজারে এসে পৌঁছাল। সঙ্গে কুমুদের বাবা। প্রথমে তাকে নেপালির কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তুলসী তাকে চিনতে পারল না। তারপর তাকে আর-একটা ঘরে নিয়ে আসা হল। লোকটা পায়চারি করছিল। তাকে দেখেই তুলসী চে�চিয়ে উঠল, ওই সেই লোক। তুলসী একটা হাত দিয়ে তার দাদুর হাত আঁকড়ে ধরল।

মিস্টার বাসু পাশেই ছিলেন। তিনি একটা হাত তুলসীর কাঁধে রাখলেন। কোনও ভয় নেই, লোকটা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি বলো একে কোথায় দেখেছ।

এই লোকটাই আমাকে অজ্ঞান করে কাঁধে নিয়ে কিছুটা রাস্তা গিয়েছিল। এই লোকটাই আমাকে মন্দিরের মুখে ঠেলে দিয়ে পাথরচাপা দিয়ে এসেছিল।

মিস্টার বাসু জিজ্ঞাসা করলেন, ঠিক করে দেখছ তো? কোনও ভুল হয়নি?

তুলসী মাথা নাড়ল, ভুল হতেই পারে না। ও মুখ আমি জীবনে ভুলব না।

আশ্চর্য কাণ্ড, তুলসী যখন এসব কথা বলছে, তখন লোকটার চেহারাও যেন বদলে যাচ্ছে।

আরক্ত দুটি চোখ। কপালের, গালের শিরাগুলো স্পষ্ট, দাঁত কিড়মিড় করে কী যেন বলার চেষ্টা করছে।

একটু পরেই লোকটা রাগে ফেটে পড়ল, একবার যদি তোকে হাতের মধ্যে পাই, তাহলে খতম করে দেব। তুই বেঁচে আছিস, আমি ভেবেছিলাম বুনোজন্তুদের শিকার হয়েছিস।

মিস্টার বাসু হাসলেন, তোমার হাতে পড়বার এর আর কোনও অবকাশ হবে না, কারণ ফাঁসির পর আর মানুষ বাঁচে না। তোমার গুলিতে একজন প্রাণে মারা গেছে।

তুলসীকে নিয়ে মিস্টার বাসু সরে এলেন।

কুমুদের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, এদিকটা তো হল, কিন্তু কুমুদকে উদ্ধার করার কী হবে?

বোঝা গেল, এ বিষয়ে মিস্টার বাসুও যথেষ্ট চিন্তিত।

তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, দেখি কী করা যায়। আমার মনে হয় কুমুদ আর পারিজাত বক্সী একই জায়গায় আছে। সম্ভবত কুমুদকে বাঁচাতে গিয়েই পারিজাত বক্সী ধরা পড়েছেন। আপনি এক কাজ করুন, তুলসীকে আপনার কাছেই রাখুন। ওকে মাঝে মাঝে আমাদের দরকার হবে। অতদূর থেকে আনার অসুবিধা। এখন বাড়তি কোনও বিপদের ঝুঁকি অমি নিতে চাই না।

কিন্তু—

কোনও ভয় নেই। অষ্টপ্রহর যাতে পুলিশ প্রহরা থাকে সে ব্যবস্থা আমি করে দেব। আপনি ওকে একেবারে বাড়ির বাইরে যেতে দেবেন না।

কুমুদের বাবা নাতিকে নিয়ে চলে যাবার পাঁচ মিনিট পরই মিস্টার বাসুর কাছে একটা স্লিপ এল।

স্লিপে লেখা নামটা দেখে মিস্টার বাসু কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঞ্চিত করে রইলেন, তারপর হুকুম করলেন, পাঠিয়ে দাও।

একটু পরেই একটি সুন্দরী মহিলা এসে ঢুকল।

মিস্টার বাসু দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, বসুন মিসেস বক্সী।

মহিলা বসল।

পারিজাত বক্সীর কোনও খবর আছে?

মহিলা কোলের ওপর রাখা ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একটা কাগজ বের করে মিস্টার বাসুর হাতে দিল।

সাদা চৌকো কাগজ। তাতে টাইপ করা কয়েকটা লাইন।

মিস্টার বাসু পড়লেন।

.

মিসেস বক্সী,

আপনার স্বামী আমাদের বহু কাজ বিনষ্ট করেছে। তার জন্য অনেক কাজ আমরা নির্বিবাদে হাসিল করতে পারিনি। এবারেও তাকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে কর্ণপাত করা প্রয়োজন মনে করিনি। এবার তাকে আমরা মুঠোর মধ্যে পেয়েছি। তার নিস্তার নেই।

মিস্টার বাসু বার দুয়েক চিঠিটা পড়লেন।

মুক্তির বিনিময়ে কোনও টাকার উল্লেখ নেই। শুধু ভয়-দেখানো চিঠি। তবে এদের অসাধ্য কোনও কাজ নেই।

মিস্টার বাসু মিসেস বক্সীকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ চিঠি আপনি কবে পেয়েছেন?

আজ সকালে।

কীভাবে?

ডাকবাক্সের মধ্যে থেকে।

ডাকবাক্সের চাবি কার কাছে থাকে?

আমার কাছে আর মিস্টার বক্সীর কাছে। তবে সচরাচর ডাকবাক্স আমিই খুলি।

ঠিক আছে, চিঠিটা আমার কাছে রেখে যান। আর আপনাকে একটা সুখবর শোনাই। দলের দুটি লোক ধরা পড়েছে।

ধরা পড়েছে?

হ্যাঁ, আশা করছি তাদের কাছ থেকে কিছু খবর আমরা বের করতে পারব।

মহিলা উঠে দাঁড়াল।

মিস্টার বক্সীর কোনও খবর পেলে আমাকে জানাবেন।

নিশ্চয়, আপনি তো জানেন পারিজাত বক্সী আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে একজন।

মহিলা বেরিয়ে যেতে মিস্টার বাসু সহকারীকে ডাকলেন।

সে আসতে তার হাতে চিঠিটা দিয়ে বললেন, দেখো তো, অন্য যেসব চিঠি আমরা এই কেসে পেয়েছি, তার সঙ্গে মিলিয়ে। একই টাইপরাইটার থেকে টাইপ করা কি না আমাকে জানিয়ে যেয়ো।

সহকারী চলে যেতে মিস্টার বাসু পায়চারি করতে শুরু করলেন। যেখান দিয়ে বাইরে মূর্তি পাচার করা সম্ভব, জলপথে অথবা স্থলপথে, সেখানেই তিনি ওয়্যারলেস পাঠিয়ে দিয়েছেন। সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন। কোনওরকমে সন্দেহজনক প্যাকিং দেখলেই যেন আটক করা হয়।

কোনও জায়গা থেকে খবর আসেনি।

একটি লোককে শনাক্ত করা গেছে, কিন্তু মূর্তি চুরির সঙ্গে এই মুহূর্তে জড়ানো সম্ভব নয়। ছেলে চুরি এবং তাকে হত্যা করার চেষ্টার জন্য তাকে অভিযুক্ত করা চলে।

পারিজাত বক্সী আগেও এ ধরনের বিপদে পড়েছেন, কিন্তু সে বিপদ কাটিয়ে উঠেছেন। কিন্তু এবার ব্যাপার একটু আলাদা। দুর্বৃত্তদের দুজন ধরা পড়েছে সেই আক্রোশে পারিজাত বক্সী আর কুমুদের ওপর চরম আঘাত হানা বিচিত্র নয়। এরা ভীষণ নিষ্ঠুর, বিবেকহীন।

পারিজাত বক্সীর কিছু হলে পুলিশ মুখ দেখাতে পারবে না। দিল্লি থেকে অপদার্থতার কৈফিয়ত তলব করবে।

হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল।

মিস্টার বাসু ছুটে এসে ফোন ধরলেন।

লালবাজারের অপারেটর বলল, ট্রাঙ্ককল স্যার।

প্রথমে অস্পষ্ট কণ্ঠ। ঠিক কিছু শোনা গেল না।

জোরে, একটু জোরে বলুন।

কণ্ঠস্বর স্পষ্টতর হল।

খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে মিস্টার বাসু চিৎকার করে উঠলেন।