উপন্যাস
গল্প

কবন্ধ বিগ্রহের কাহিনি – ৫

আচ্ছন্ন অবস্থাতেই তুলসী বুঝতে পারল লোকটা তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে একটা মোটরে ওঠাল।

কিন্তু মোটর বেশি দূর গেল না। একটু গিয়েই দারুণ ঝাঁকানি দিয়ে থেমে গেল। লোকটা নেমে মোটরের বনেট খুলে কিছুক্ষণ কী দেখল, তারপর বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে তুলসীকে কাঁধে তুলে নিল।

রাস্তা ছেড়ে লোকটা জঙ্গলে নামল। ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে কালো পাথরের চাঙড়।

দু-একবার লোকটা হোঁচট খেল। নিজেকেই নিজে গালি দিল।

তুলসী চোখ পিটপিট করে দেখল। পাশেই একটা ঝরনা। লোকটা দুটো হাত জোড় করে জল নিচ্ছে। বোধহয় তৃষ্ণার্ত।

কিন্তু না, জল নিয়ে এসে লোকটা তুলসীর মুখে চোখে ছিটিয়ে দিল।

একটু পরেই তুলসীর আচ্ছন্নভাব কেটে গেল। সে উঠে বসল।

কী রে শয়তান, এবার কী হবে? লোকটা দাঁত চেপে বলল।

তুলসী কোনও উত্তর দিল না।

গিরিধারীকে বেকায়দায় পেয়ে ঘায়েল করে পালিয়েছিলি, এবার তোকে কে বাঁচায় দেখি। তার আগে আমার একটা কথার জবাব দে। তোরা দুটো পুলিশের চর। চারদিকে মূর্তি চুরি হচ্ছে বলে লুকিয়ে মন্দির পাহারা দিচ্ছিলি। তারপর আমাদের লরিতে লাফিয়ে পড়েছিস, ঠিক কি না?

তুলসী মাথা নাড়ল, না। আগেই তো বলেছি, পুলিশের সঙ্গে আমাদের কোনও যোগাযোগ নেই। আমরা এমনি বেড়াব বলে তোমাদের লরিতে উঠেছিলাম।

লোকটা মুখ বেঁকিয়ে হাসল। বলল, ভোররাত্রে বেড়াতে উঠেছিলি? কী করে তোর কাছ থেকে কথা বের করতে হয় সে ওষুধ আমার জানা আছে। মূর্তিগুলো নিরাপদে চালান হয়ে যাক, তারপর তোর সঙ্গে বোঝাপড়া করব। নে ওঠ।

লোকটা তুলসীর একটা হাত ধরে এমন জোরে টান দিল যে তুলসীর মনে হল, কাঁধের হাড়গুলো বুঝি খুলেই গেল।

তুলসীকে লোকটা টানতে টানতে নিয়ে চলল। বনবাদাড় পার হয়ে ছোটো একটা পাহাড়। ঘোরানো পায়ে-চলা পথ। দু-ধারে কাঁটাগাছের ঝোপ।

পাহাড়ের অর্ধেকটা উঠতেই দেখা গেল একেবারে ওপরে একটা মন্দির। জরাজীর্ণ। আকার থেকে মনে হল শিবের মন্দির।

লোকটা তুলসীকে সেই মন্দিরের সামনে নিয়ে এল।

মন্দিরের দরজা নেই। দরজার জায়গায় ছোটো একটা গর্ত। হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়।

এবার লোকটা তুলসীর ঘাড় ধরে গর্তের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, যা ভিতরে। এখানে দিন দুয়েক থাকলেই শায়েস্তা হবি। পরশু এসে তোর খোঁজ করব, অবশ্য যদি বেঁচে থাকিস।

লোকটা জোর করে তুলসীকে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল, তারপর বিরাট একটা পাথর নিয়ে এসে গর্তের মুখ আড়াল করে দিল।

তুলসী গড়িয়ে পড়ল। বেশ অন্ধকার। প্রথমটা কিছুই চোখে দেখতে পেল না। তারপর একটু একটু করে অন্ধকার চোখে সহ্য হয়ে আসতে দেখল, ঠিকই আন্দাজ করেছিল। শিব মন্দির। মাঝখানে ছোটো একটি শিবলিঙ্গ। কালো পাথরের। বোঝা যায়, এখানে সাত জন্মে কেউ পূজা দিতে আসে না। শান-বাঁধানো মেঝের চারদিকে ফাটল। দেওয়াল একেবারে চৌচির। সাপ লুকিয়ে থাকা মোটেই বিচিত্র নয়।

এখানে তুলসী কী করে কাটাবে ভেবে পেল না। একে তো এই পরিবেশ, তার ওপর খিদেয় পেটের মধ্যে দারুণ মোচড় দিচ্ছে। বসে থাকতে পারছে না।

লোকটা বলে গেল বটে পরশু আসবে, কিন্তু আসবে যে তার কোনও স্থিরতা নেই। তুলসীর মতন একটা ছেলে মরল কি বাঁচল, লোকটা কি তার পরোয়া করে!

তুলসী আস্তে আস্তে মেঝের ওপর শুয়ে পড়ল।

ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ঘুম আসতে মোটেই দেরি হল না।

প্রায় ঘণ্টা তিনেক পরে তুলসীর ঘুম ভাঙল। মুখে রোদ লেগে।

চমকে তুলসী উঠে বসল। চারদিক বন্ধ, অথচ রোদ আসছে কোথা থেকে?

এদিক-ওদিক দেখতেই চোখে পড়ল। পাশের দেওয়াল অনেক ফাটা। চোখ রাখলে বাইরের আকাশ, কিছু গাছ নজরে আসে। কিন্তু সেখান দিয়ে মানুষের পালানো অসম্ভব।

তবু তুলসীর মনে ক্ষীণ আশা ফুটে উঠল। বাইরের জগৎ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। এই ফাটল দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাবে। পাখির গান, জন্তুদের চিৎকার ভেসে আসবে।

তারপর এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চোখে পড়ে গেল। ঠিক শিবলিঙ্গের নীচে লোহার একটা পাইপ। সেই পাইপটা দেওয়াল ফুটো করে বাইরে গিয়ে পড়েছে।

বোঝা গেল একসময় এ মন্দিরে লোকসমাগম হত। লোকেরা শিবলিঙ্গে জল ঢালত। সেই জল যাতে মন্দিরে না জমে, তাই এই পাইপের ব্যবস্থা।

তুলসী নিচু হয়ে পাইপটা ধরে টান দিল। একবার, দুবার, তিনবার। সে শরীরে যথেষ্ট শক্তি রাখে।

কয়েকবার হ্যাঁচকা টানের পর পাইপটা বেঁকে গেল। এক জায়গা মরচে পড়েছিল। তুলসী পাইপটা কয়েকবার নাড়াতেই সেটা খুলে গেল। বেশ ভারী পাইপ। শাবলের কাজ করতে পারে।

তুলসী পাইপটা তুলে নিয়ে সবেগে ফাটলের ওপর আঘাত করতে লাগল। পাথরের দেওয়াল। অনেক দিনের পুরোনো হলেও শক্ত।

কিন্তু ফাটলের মধ্যে ঘা মারতে মারতে পাথরের টুকরো খসে খসে পড়ল। দারুণ উৎসাহে তুলসী আরও জোরে ঘা দিতে লাগল।

এক ঘণ্টা চেষ্টার পর একটা মানুষ যাবার মতন ফাঁক হল।

তুলসী আর অপেক্ষা করল না। কিছু বলা যায় না। লোকটা বলে গেছে পরশু আসবে। কথাটা হয়তো মিথ্যা। হঠাৎ যদি ফিরে আসে, তাহলে তুলসীর কাণ্ড দেখলে তাকে আর আস্ত রাখবে না।

তুলসী নিজের দেহটা সন্তর্পণে ফাঁকের মধ্য দিয়ে গলিয়ে দিল।

বেরোবার সময় পাথরের খোঁচা লেগে শরীরের দু-এক জায়গা কেটে গেল। তুলসী ভ্রূক্ষেপ করল না।

বাইরে লাফ দিয়ে পড়তেই ঢালু জায়গায় গড়াতে শুরু করল। টাল সামলাতে পারল না। গড়াতে গড়াতে এক গাছের গুঁড়িতে গিয়ে আটকাল।

প্রথমবার কোনওরকমে লরি থামিয়ে তুলসী তাতে উঠে পড়েছিল।

কিন্তু এখান থেকে রাস্তা অনেক দূরে। একটু পরেই অন্ধকার নামবে। অন্ধকারে অরণ্যের চেহারা বদলে যায়। মাটির তলা তো নিরাপদ নয়ই, গাছের ওপরেও ভয় নেই, এমন কথা বলা যায় না।

সাপ থাকতে পারে। চিতাবাঘ গাছে উঠতে অভ্যস্ত।

তবু এই মন্দিরের আওতা থেকে দূরে সরে যেতেই হবে।

তুলসী ছুটতে শুরু করল। দেহে একটুও শক্তি নেই। বার বার কাঁটাগাছে দুটো পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। তুলসী থামল না।

পাহাড় থেকে নেমে একটু দাঁড়াল। ঠিক কোন দিক দিয়ে এসেছিল, আধো-অন্ধকারে বুঝতে পারল না। পায়ে-চলা পথ তিন-চারদিকে গিয়েছে। তারই একটা ধরে তুলসী ছুটল।

আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে এল। ঝিঁঝি ডাকছে। ঝোপে জোনাকির ঝাঁক। হঠাৎ দূরে শেয়াল ডেকে উঠল।

তুলসী দাঁড়িয়ে পড়ল। আর এগোনো সম্ভব নয়। এগোনো নিরাপদও নয়। সামনে একটা গাছ। কী গাছ তুলসী নাম জানে না।

রাতটা গাছে কাটানো ছাড়া উপায় নেই। তুলসী ডাল ধরে গাছে উঠে পড়ল।

একটা ডাল থেকে আর-একটা ডালে পা রাখতে গিয়েই থেমে গেল। হিস হিস করে শব্দ।

ম্লান জ্যোৎস্না, কিন্তু তাতেই বেশ দেখা গেল।

কুচকুচে কালো শরীরের রং, চেরা জিভ, প্রসারিত ফণা সামনে যেন যমের দূত। আর-একটু হলেই তুলসীর মুখে ছোবল দিত।

তুলসী গ্রামের ছেলে। বিষাক্ত সাপও সে অনেক দেখেছে, কিন্তু এরকম ভয়ালদর্শন সাপ তার নজরে পড়েনি।

তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে তুলসী পা পিছলে নীচে পড়ল।

মন্দির থেকে বের হবার সময় আগেই তার শরীরে আঘাত লেগেছিল, এবার কাঁটাঝোপের ওপর গিয়ে পড়তে আবার সেসব জায়গায় রক্ত ঝরতে লাগল।

কিছুক্ষণ তুলসী দম বন্ধ করে রইল। দৃষ্টি অবশ্য সাপের দিকে।

কিন্তু এভাবে বসে থাকলেও বিপদ। পিছন থেকে হয়তো ধরবার জন্য লোকজন আসতে পারে।

তুলসী উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটতে আরম্ভ করল। কিন্তু এই অন্ধকারে বনের মধ্যে দিয়ে চলাও নিরাপদ নয়। গাছে রাত কাটানো ছাড়া কোনও উপায় নেই।

তুলসী দাঁড়িয়ে পড়ে গাছের সন্ধান করতে লাগল।

হঠাৎ জঙ্গল কাঁপিয়ে বিকট শব্দ গুডুম। বন্দুকের আওয়াজ।

তুলসী ছুটে একটু দূরের একটা ঝাঁকড়া গাছে উঠে পড়ল।

কোনও শিকারির বন্দুকের শব্দ হতে পারে, কিংবা হয়তো তুলসীর খোঁজেই লোকেরা বেরিয়ে পড়েছে। বন্যজন্তুকে তাড়াবার জন্য গুলির আওয়াজ করছে।

তুলসী পাতার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে বসল।

মোটরের গর্জন। তীব্র আলোয় সব আলোকিত হয়ে উঠল। সেই আলোয় তুলসী দেখল একটা রক্তাক্ত হরিণ ছুটতে ছুটতে এসে গাছের তলায় পড়ে গেল।

তারপরই গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা জিপ আসতে দেখা গেল। ফগ-লাইটের উজ্জ্বল আলো। জিপের ওপর দুজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। দুজনের হাতেই বন্দুক।

একটু দূরে জিপটা থেমে গেল। ভদ্রলোকরা লাফিয়ে নেমে সামনের দিকে ছুটে এল।

হরিণের কাছে এসে দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ল। হরিণের চারটে পা প্রসারিত। জিভটা বেরিয়ে পড়েছে।

একজন ভদ্রলোক আর-একজনকে বলল, দেখলি কল্যাণ, বললাম হরিণটা এদিকেই এসেছে। ওই দেখ, তোর গুলিটা গলায় লেগেছে। অব্যর্থ শট।

অন্য লোকটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগল।

বাংলা কথা শুনে তুলসীর বুকে সাহস এল। এঁরা তাহলে বাঙালি শিকারি। এঁদের কাছে সব কথা খুলে বললে এঁরা হয়তো উদ্ধার করতে সাহায্য করবেন।

এসো হরিণটাকে জিপে তোলা যাক।

দুজনে এগিয়ে এসে হরিণের পা ধরে তুলতে লাগল।

ঠিক সেই সময় তুলসী গাছের ওপর থেকে বলল, শুনুন, শুনছেন।

দুজনেই চমকে উঠল, হরিণের দেহটা ধপাস করে মাটির ওপর পড়ে গেল।

এই যে আমি ওপরে।

একজন শক্ত হাতে বন্দুক তাক করল। আর একজন প্যান্টের পিছনের পকেট থেকে টর্চ বের কর গাছের ওপর আলো ফেলল।

কে? কে ওখানে?

আমি নামছি। নেমে সব বলব।

তুলসী সাবধানে গাছ থেকে নেমে নীচে এসে দাঁড়াল।

লোক দুজন একদৃষ্টে তুলসীর দিকে দেখল।

তুলসী কাঁদো কাঁদো গলায় নিজের কাহিনি সব বলল। জামা তুলে নিজের দেহের রক্তাক্ত জায়গাগুলো দেখাল।

একজন ভদ্রলোক তুলসীর একটা হাত ধরে বলল, তুমি বাহাদুর ছেলে। কোনও ভয় নেই, এসো আমাদের সঙ্গে। জিপে ওষুধ আছে, লাগিয়ে দেব!

একরকম মলম তুলসীর ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেওয়া হল। ভদ্রলোকদের পরিচয় পাওয়া গেল।

একজনের নাম কল্যাণ ঘোষ। আর-একজন অনুপম সরকার। দুজনেই ভাগলপুরে থাকে। ওখানকার কোর্টের উকিল। শিকারের খুব নেশা, তাই মাঝে মাঝে বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে চলে আসে। এ জঙ্গলে বাঘ নেই, শুধু হরিণ আর ভালুক। মাঝে মাঝে অবশ্য পাহাড় থেকে বুনো হাতির দল নামে। যখন আখের চাষ হয়।

হরিণ আর তুলসীকে নিয়ে জিপ ছুটল।

ক্লান্ত তুলসী সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

জিপ থামতে ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে দেখল একটা একতলা বাড়ির সামনে জিপ থেমেছে।

অনুপম বলল, নামো তুলসী, এটা বনবিভাগের ডাকবাংলো।

তিনজনে নামল।

তুলসীকে হরলিকস আর পাঁউরুটি খেতে দেওয়া হল।

কল্যাণ আর অনুপম তুলসীকে সোজা ভাগলপুর নিয়ে গেল। সেখান থেকে ওদেরই নির্দেশে তুলসী বাবাকে একটা চিঠি লিখল। তুলসী ভালো আছে। শীঘ্রই বাড়ি ফিরছে।

কল্যাণ আর তুলসী দুজনেরই মত, যেমন করেই হোক এভাবে এ দেশ থেকে মূর্তি চুরি বন্ধ করতেই হবে। এজন্য প্রত্যেক দেশবাসীর সহযোগিতা দরকার। তুলসী আর কুমুদ খুব ভালো কাজই করেছে।

কল্যাণ নিজে সঙ্গে করে তুলসীকে বাড়ি পৌঁছে দিল।

তুলসীর বাবা উঠানে দাঁড়িয়ে ছিল, তুলসীকে দেখে ছুটে এসে তাকে বুকে জাপটে ধরল।

তুলসীর মা-ও এসে দাঁড়াল। কেঁদে কেঁদে তার দু-চোখ লাল।

তুলসীকে আদর করতে করতে বলল, তুলসী তো ফিরে এল, কিন্তু কুমুর কী হবে?

তুলসী জিজ্ঞাসা করল, কুমুমামার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি মা?

না বাবা। গোয়েন্দা লাগানো হয়েছে তবু কিছু হল না। বদমায়েশগুলো দশ হাজার টাকা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল। বাবা সে টাকা পাঠিয়েও দিয়েছিলেন, কিন্তু তবু কুমু ফিরে এল না।

গোয়েন্দার কথা কানে যেতে কল্যাণ তুলসীর বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, কোন গোয়েন্দাকে কাজের ভার দিয়েছেন?

পারিজাত বক্সী।

উনি তো বিখ্যাত গোয়েন্দা। অনেক বড়ো বড়ো কেসের সমাধান করেছেন।

হ্যাঁ, তা-ই তো শুনেছি। তবে এ কেসে একটু মুশকিল হয়েছে।

কী মুশকিল?

আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে শুনলাম, তাঁকেও নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।

পাওয়া যাচ্ছে না?

না। যেদিন আমার শ্বশুরমশাই টাকাটা ইডেন গার্ডেনে রাখতে গিয়েছিলেন, সেদিন পারিজাতবাবু সঙ্গে ছিলেন। যে লোকটা টাকা নিয়ে গেল, তাকে অনুসরণ করা হয়েছিল কিন্তু ধরা যায়নি। তার দু-দিন পর শ্বশুরমশাই পারিজাত বক্সীর বাড়ি গিয়ে শুনলেন, তিনি নেই।

সম্ভবত তিনি মূর্তি চোরদের সন্ধানেই গিয়েছেন।

তা হবে, কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের কাছে হাজার টাকা চেয়ে আবার একটা চিঠি এসেছে। সে টাকাও তিনি দিয়েছেন।

দশ হাজারের ওপর আবার এক হাজার?

হ্যাঁ, চিঠিতে লেখা ছিল, আগে পাঠানো টাকার হাজার টাকা নাকি টিকটিকি পারিজাত বক্সীর দোষেই হারিয়েছে। এবার শুধু কুমুদকে নয়, পারিজাত বক্সীকেও জামিন রাখা হয়েছে। টাকা না এলে দুজনকেই খতম করে দেওয়া হবে।

কল্যাণ মাথা নাড়ল। বলল, আমার মনে হয় এটা বাজে ধাপ্পা। শুধু ভয় দেখানো।

তা জানি না, তবে ওদের দাবি মেটানো সত্ত্বেও, পারিজাতবাবু আর কুমুদ কেউই এ পর্যন্ত ফিরে এল না।

কল্যাণ আর কিছু বলল না।

তুলসীর বাবা তাকে ছাড়ল না। খাইয়েদাইয়ে বিকালে যেতে দিল।

তুলসী বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তার বাবা বারণ করল।

না, তুমি বাড়ি থেকে এখন একদম বের হবে না। বদমায়েশগুলো তোমার সন্ধানে এখানে হানা দিতে পারে।

কল্যাণও তা-ই বলল।

তুলসীর বাবা সঙ্গে গেল।

যখন ফিরল তখন বেশ উত্তেজিত। আরক্ত মুখ, উত্তেজনায় বুকটা ওঠানামা করছে।

তুলসীর মা জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

বলছি, আগে এক গ্লাস জল দাও।

জল খেয়ে চেয়ারে কিছুক্ষণ বসল। ইতিমধ্যে তুলসীও মা-র পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

একটু সুস্থ হয়ে তুলসীর বাবা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল।

বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা লোক কাগজ বিলি করছিল। বলল, নতুন সাবান বেরিয়েছে। দামেও সস্তা, জিনিসও ভালো। একটা কাগজ আমাকেও দিল। কাগজটা পকেটেই রেখে দিয়েছিলাম। মাঝরাস্তায় কৌতূহল হল। কাগজটা খুললাম। দেখলাম ‘সুরূপ’ সাবানের বিজ্ঞাপন। তলায় লাল কালিতে লেখা। তুলসীকে খতম আমরা করবই, যদি তাকে সিন্দুকে বন্ধ করে রাখেন, তবুও।

তুলসীর মা চেঁচিয়ে উঠল। তুলসীও ভয় পেল না, এমন নয়।

তুলসীর বাবা বলল, তুলসীর এখন বাইরে বার হওয়া একদম বন্ধ। কোনও বন্ধুবান্ধব ডাকলেও যাবে না। কাউকে এখন বিশ্বাস নেই।

কাজেই তুলসী বাড়িতে প্রায় বন্দি হয়ে রইল।

তুলসীর বাবা কলকাতায় শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করল।

কুমুদের বাবার শরীর খুব ভেঙে পড়েছে। রোগী দেখা খুব কমিয়ে দিয়েছেন। কুমুদের মা শয্যাশায়ী।

জামাইয়ের কাছ থেকে সব শুনে কুমুদের বাবা শুধু বললেন, তাহলে কুমুদের কোনও খবর তুলসী রাখে না?

তুলসীর বাবা বলল, তুলসী তো মন্দিরের মধ্যে একাই ছিল। প্রথমবারে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে কুমুদের সঙ্গে তুলসীর আর দেখা হয়নি।

কুমুদের বাবা নিশ্বাস ফেললেন, কী জানি, যা টাকা চেয়েছে, সেটাই পাঠিয়ে দিলাম, তবু ছেলেকে ফেরত পেলাম না। কুমুদ আর ফিরে আসবে এ ভরসা আমার নেই। পারিজাত বক্সীর খুব নাম শুনেছিলাম। অনেক বড়ো বড়ো কেসের ফয়সালা করেছেন খবরের কাগজে পড়েছি। পুলিশমহলেও তাঁর ওপর অগাধ বিশ্বাস, কিন্তু আমার বেলাতেই তিনি কিছু করতে পারলেন না।

পারিজাতবাবুকেও শুনছি কদিন পাওয়া যাচ্ছে না?

হ্যাঁ, আমি বারকয়েক গিয়েছিলাম, বাড়ির লোকও কোনও খবর বলতে পারল না। অবশ্য বাড়ির লোক জানলেও ঠিক খবর হয়তো দেবে না। হতে পারে ভদ্রলোক হয়তো অন্য একটা কেসে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

বাড়তি হাজার টাকাও তো আপনি দিয়েছেন?

হ্যাঁ, দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে একটা গাছের ডালে ঝোলানো টিনের মধ্যে টাকাটা রাখার নির্দেশ ছিল। আমি ঝোপের আড়াল থেকে দেখলাম একটা লম্বা লোক টিনটা খুলে নিয়ে চলে গেল। আমি তার পিছন পিছন গিয়ে দেখি লোকটা একটা লরিতে উঠে উধাও।

কুমুদের বাবার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কোণের দিকে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠল, ঝন ঝন ঝন।