৪
কুমুদের বাবা চুপচাপ বাইরের ঘরে বসে ছিলেন। ইদানীং তাঁর কিছু ভালো লাগে না। হাসপাতালে, চেম্বারে যান, রোগীও দেখেন, কিন্তু সব সময়ে কেমন অন্যমনস্কভাবে।
সর্বদা ছেলে দুটোর কথা চিন্তা করেন। পারিজাত বক্সীর কথামতো কাগজেও বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, কোনওদিক থেকে আজ পর্যন্ত কোনও সাড়া পাননি।
কুমুদের মা শয্যাশায়ী। প্রায় অন্নজল ত্যাগ করেছেন।
বাবু, ও বাবু।
চিৎকারে কুমুদের বাবা মুখ তুলে দেখলেন।
জানলার বাইরে একটা লোক। সাজপোশাক রিকশাচালক বলেই যেন মনে হল। হাতে ছোটো একটা ঘটিও রয়েছে।
কী চাই?
একটা চিঠি।
চিঠি? কুমুদের বাবা উৎসাহে উঠে দাঁড়ালেন। তাহলে কি বিজ্ঞাপনের উত্তর নিয়ে কেউ এল?
লোকটা হয়তো রিকশায় বসে আছে। চালকের হাতে চিঠিটা পাঠিয়েছে।
ভিতরে এসো।
তাকে কুমুদের বাবা ঘরের মধ্যে আসতে বললেন। রিকশাচালক ভিতরে এসে চিঠিটা কুমুদের বাবার দিকে এগিয়ে দিল।
চিঠিটা যখন নিলেন তখন কুমুদের বাবা বুঝতে পারলেন তাঁর হাতের আঙুলগুলো থরথর করে কাঁপছে।
চিঠিটা পড়তে পড়তে তাঁর মুখ আরক্ত হয়ে উঠল।
পনেরো দিনের মধ্যে দশ হাজার টাকা ইডেন গার্ডেনের প্যাগোডার চাতালে রেখে আসতে হবে। না রাখলে কুমুদকে খতম করে ফেলা হবে। টাকাটা রাখতে হবে সকাল সাতটা থেকে দশটার মধ্যে।
এইসঙ্গে কুমুদের হাতের চিঠিও রয়েছে। সে-ও জানিয়েছে দশ হাজার টাকা না দিলে তার প্রাণসংশয়।
কুমুদের হাতের লেখা তিনি খুব চেনেন। তাঁর ভুল হবার নয়।
এ চিঠি তোমাকে কে দিয়েছে?
মোড়ে এক বাবু ট্যাক্সিতে বসে আছেন। আমার হাতে দুটো টাকা দিলেন, আর বললেন, চিঠিটা লাল বাড়িতে যে ডাক্তার থাকেন তাঁকে দিয়ে আসতে।
চলো তো দেখে আসি।
কুমুদের বাবার পরনে ছিল গেঞ্জি আর পাঞ্জাবি। পোশাক পালটাবার কথা তাঁর আর মনে হয় না। সেইভাবেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
রাস্তার ওপর রিকশা ছিল, চালক তাঁকে চড়তে বললেও তিনি রাজি হলেন না। গোটা ছয়েক বাড়ির পরেই চৌরাস্তা। এটুকু রাস্তা তিনি অনায়াসেই হেঁটে যেতে পারেন।
মোড়ের মাথায় কোনও ট্যাক্সি দেখা গেল না।
কোথায় ট্যাক্সি?
এইখানেই তো ছিল। বাবু অবশ্য থাকবেন এমন কথা বলেননি।
বাবুকে দেখতে কেমন?
খুব ফরসা, মোটাসোটা চেহারা।
বাঙালি?
সেইরকমই মনে হল।
কুমুদের বাবা আর দাঁড়ালেন না। হনহন করে বাড়িতে ফিরে এলেন।
এখন কী করবেন?
কুমুদের মা-কে জানালেই কান্নাকাটি শুরু হবে। তিনি বলবেন ছেলের জীবনের কাছে দশ হাজার টাকা কিছুই নয়। এখনই টাকাটা রেখে আসতে।
কুমুদের বাবার মনের ইচ্ছাও অবশ্য তা-ই। কিন্তু যা-ই করুন পারিজাত বক্সীকে একবার জানানো দরকার। জামাইয়ের সঙ্গেও পরামর্শ করতে হবে। তুলসী কোথায় সে কথা কুমুদ কিছু লেখেনি। হতে পারে এ বিষয়ে তুলসীর বাবাও আলাদা চিঠি পেয়েছে।
সব দিক বিবেচনা করে কুমুদের বাবা ফোন তুলে নিলেন।
ভাগ্য ভালো পারিজাত বক্সী বাড়িতেই ছিলেন।
সব শুনে তিনি বললেন, আপনি অপেক্ষা করুন, আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে আপনার কাছে যাচ্ছি।
আধ ঘণ্টার আগেই পারিজাত বক্সী এসে গেলেন।
অনেকক্ষণ ধরে চিঠি দুটো পরীক্ষা করে বললেন, এটা আপনার ছেলের হাতের লেখা তো?
হ্যাঁ, ওটা কুমুদের হাতের লেখা তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
পারিজাত বক্সী কিছুক্ষণ কী ভাবলেন, তারপর বললেন, মূর্তি চোরেরা সাধারণত এ ধরনের কাজ করে না, তবে কিছুই জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। চলুন, রিকশাচালককে একবার দেখাবেন।
দুজনে রাস্তার মোড়ে এলেন।
গোটা চারেক রিকশা সেখানে ছিল। সেই রিকশাচালক গ্লাসে চা খাচ্ছিল, এঁদের দেখে সেলাম করে এগিয়ে এল।
ডাক্তারবাবুকে এ চিঠি তুমি দিয়েছ?
হ্যাঁ বাবু।
যে তোমায় এ চিঠি দিয়েছে সে কী বলেছে?
আমি রিকশা নিয়ে এখানে বসে ছিলাম, এক বাবু ট্যাক্সি চেপে এসে হাত নেড়ে আমাকে ডাকলেন। আমি কাছে যেতে বললেন, লাল বাড়িতে যে ডাক্তারবাবু থাকেন, তাঁকে এই খামটা দিয়ে এসো, আর এই নাও তোমার দু-টাকা বকশিশ।
তুমি জিজ্ঞাসা করোনি নিজে না গিয়ে এভাবে তোমার হাতে চিঠি পাঠাচ্ছে কেন?
না বাবু, বকশিশ পেয়ে আমি খুশি হয়েছিলাম, ওসব কথা ভাবিনি।
পারিজাত বক্সী আর কিছু না বলে কুমুদের বাবাকে নিয়ে ফিরে এলেন। নিজের মোটরে উঠতে উঠতে বললেন, এ চিঠি দুটো আপাতত আমার কাছে থাক।
কুমুদের বাবা উদবিগ্নকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, টাকার ব্যাপারে আমি তাহলে কী করব?
এখন কিছু করার নেই। পনেরো দিন সময় আছে, তার মধ্যে আপনাকে জানিয়ে দেব।
পারিজাত বক্সী মোটর চালু করলেন, থামলেন এসে লালবাজারে।
সহকারী কমিশনারের ঘরে তাঁর অবারিত দ্বার।
মিস্টার বাসু, দেখুন তো এ হাতের লেখাটা আপনার রেকর্ডে আছে কি না।
মিস্টার বাসু চিঠিটা পড়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন, তার-ঘণ্টা বাজিয়ে মজুমদারকে ডাকলেন।
মজুমদার আসতে বললেন, এঁর সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে মজুমদার, ইনি স্বনামধন্য পারিজাত বক্সী।
মজুমদার দুটো হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, ওঁর নামের সঙ্গে আমার খুব পরিচয়।
দেখো তো রেকর্ড থেকে এটা কাদের লেখা হদিশ পাও কি না।
চিঠিটা হাতে নিয়ে মজুমদার বলল, এ তো এখনই হবে না। অনেক রেকর্ড ঘাঁটতে হবে। অন্তত দুটো দিন সময় চাই।
পারিজাত বক্সী দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ঠিক আছে, আমি পরশু বিকালে আসব।
পরশু বিকালে যেতেই খবর পেয়ে গেলেন। মজুমদারই দিল।
বলল, ও হাতের লেখাটা তোরাব আলির।
তোরাব আলি কে?
নামকরা ডাকাত। চিঠি লিখে লোকের বাড়ি ডাকাতি করতে যেত।
তার ফোটো যদি থাকে, দেখাতে পারেন?
তা পারি, কিন্তু একটা মুশকিল হয়েছে।
কী মুশকিল?
তোরাব আলি এখন দমদম জেলে। বছর তিনেক আগে তার সাত বছরের জন্য জেল হয়েছিল।
পারিজাত বক্সী হতাশ হলেন।
কীরকম হল? তোরাব আলি জেল থেকে নিশ্চয় এ চিঠি লেখেনি। সেটা সম্ভব নয়। অন্য কেউ লিখেছে।
মজুমদারকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বেরিয়ে এলেন।
মজুমদার মনে করিয়ে দিল, ফোটোটা দেখে যাবেন না?
দরকার নেই।
পারিজাত বক্সী কুমুদের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, কী করবেন, ঠিক করেছেন?
কুমুদের বাবা বললেন, আমি ঠিক করেছি, টাকাটা দিয়েই দেব, কারণ কুমুদের প্রাণের দাম আমাদের কাছে দশ হাজার টাকার অনেক বেশি।
বেশ, তাহলে একটা দিন ঠিক করুন। সেদিন আমিও আপনার সঙ্গে যাব।
দিন ঠিক আর কী। আমি কালই যেতে চাই।
আমি তাহলে ছ-টার মধ্যে আপনার কাছে চলে আসব।
কুমুদের বাবা প্রশ্ন করলেন, আমার নাতি তুলসীর কী হবে?
পারিজাত বক্সী কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন, আমার মনে হচ্ছে তুলসী আর কুমুদ এক জায়গায় নেই। থাকলে তুলসীর জন্যও টাকা দাবি করে এরকম চিঠি আসত।
কুমুদের বাবা স্বীকার করলেন, আমারও তা-ই মনে হচ্ছে।
তবুও আপনি একটা কাজ করুন।
কী বলুন?
আপনার জামাইয়ের কাছে একবার খোঁজ নিন।
তখনই কুমুদের বাবা পরিচিত একজনকে তুলসীর বাবার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বলে দিলেন, তুলসীর বাবা যেন লোকটির সঙ্গে চলে আসে।
বিকালেই তুলসীর বাবা এসে পৌঁছাল।
এই কদিনেই তুলসীর বাবা উদবেগে-দুশ্চিন্তায় আধখানা হয়ে গেছে।
তার ধারণা হয়েছিল শ্বশুরমশাই বুঝি কুমুদ আর তুলসী দুজনেরই খবর পেয়েছেন। কিন্তু তুলসীর কোনও খবর পাননি জেনে মর্মাহত হল।
কুমুদের বাবা জামাইকে চিঠিটা দেখালেন।
এই দেখো, আমি এরকম একটা চিঠি পেয়েছি। আমি ভেবেছিলাম তুলসীর ব্যাপারে তুমিও বুঝি কোনও চিঠি পেয়েছ।
তুলসীর বাবা মাথা নাড়ল, না, আমি কিছুই পাইনি। তুলসীর মা তো আহার-নিদ্রা ত্যাগ করেছে। আমার ভয় হচ্ছে, সে কোনওরকম শক্ত অসুখে না পড়ে যায়।
কুমুদের বাবা সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন।
শরীর খারাপ করে লাভ কী। বিপদের মুখে এভাবে ভেঙে পড়ে তো কোনও লাভ নেই। পারিজাতবাবুর ধারণা, কুমুদ আর তুলসী এক জায়গায় নেই। থাকলে তুলসীর জন্যও এরকম টাকা দাবি করে চিঠি আসত। তবে ঈশ্বরের ইচ্ছায় কুমুদকে যদি ফিরে পাই, তাহলে তার কাছে হয়তো তুলসীর খবর পেতে পারি।
তুলসীর বাবা কিছু বলল না। চুপ করে রইল।
তারপর বলল, আপনি কুমুদের ব্যাপারে কী করবেন ঠিক করেছেন?
আমি তো টাকাটা দেব বলেই ঠিক করেছি।
তাহলে কি কুমুদকে পেয়ে যাবেন?
কুমুদের বাবা আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
কেন, এ কথা বলছ কেন?
এ ধরনের কাহিনিতে পড়েছি দশ হাজার টাকা হাতে পেলে এদের লোভ বেড়ে যায়। আরও বেশি টাকা দাবি করে বসে।
অবশ্য কিছুই অসম্ভব নয়, তবে আমরা তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। মাত্র পনেরো দিন সময়। এর মধ্যে টাকা না দিতে পারলে ওরা কুমুদকে শেষ করে দেবে। একটা মানুষের প্রাণের দাম ওদের কাছে কানাকড়িও নয়।
ভোর পাঁচটায় কুমুদের বাবার বাইরের ঘরে কলিং বেল বেজে উঠল।
কুমুদের বাবা ওপর থেকেই শুনতে পেলেন, নীচে চাকর রঘু কার সঙ্গে চেঁচামেচি শুরু করেছে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে কুমুদের বাবা দেখলেন, রঘুর সামনে একটা ভিখারি দাঁড়িয়ে। পরনে ছেঁড়া গেঞ্জি, শতচ্ছিন্ন কাপড় হাঁটু পর্যন্ত। চুলে মাটি মাখা। গালের একদিকে দগদগে ঘা।
কে রে রঘু?
জানি না বাবু, বলছে আপনার সঙ্গে নাকি কী জরুরি দরকার আছে।
কুমুদের বাবার কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
কুমুদকে যারা আটকে রেখেছে, সেই দলের কেউ নয় তো? হয়তো টাকার ব্যাপারে কিছু বলতে এসেছে, ইডেন গার্ডেনে নয়, অন্য কোথাও টাকাটা রেখে আসতে হবে।
তাই কুমুদের বাবা রঘুকে বললেন, ঠিক আছে, তুই যা, আমি দেখছি।
রঘু চলে যেতে ভিখারিটা কয়েক পা এগিয়ে বলল। আমি পারিজাত বক্সী। আমি আগে রওনা হয়ে যাচ্ছি। আপনি সাতটা নাগাদ চলে আসুন। ওখানে আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করবেন না।
কুমুদের বাবা ঘাড় নাড়ল, ঠিক আছে।
কুমুদের বাবা যখন ইডেন গার্ডেনে গিয়ে পৌঁছালেন, তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় সাতটা। তিনি সঙ্গে ড্রাইভার নেননি। নিজেই মোটর চালিয়ে গিয়েছিলেন।
প্যাগোডার কাছাকাছি গিয়ে দেখলেন, ঘাসের ওপর পারিজাত বক্সী বসে। তাঁর সামনে একটা থালা। চেঁচিয়ে ভিক্ষা চাইছেন।
কুমুদের বাবা এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে বড়ো একটা খাম বের করে প্যাগোডার চাতালে রেখে দিলেন। আশপাশে দু-একজন লোক পায়চারি করছে। এত সকালে ভিড় নেই।
কুমুদের বাবা খামটা রেখে সরে গেলেন নিজের মোটরের কাছে।
একটু পরেই একটা জিপ এসে দাঁড়াল। তার মধ্যে থেকে পুলিশের পোশাক-পরা একদল লোক বেরিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে খামটা তুলে নিয়ে দ্রুতপায়ে ফিরে এল।
জিপে বোধহয় স্টার্ট দেওয়াই ছিল। লোকটা উঠে বসতেই জিপ ছুটতে শুরু করল।
পারিজাত বক্সী আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ছুটে রাস্তার ওপর চলে এলেন।
মিনিট দুই-তিন, তার মধ্যেই পারিজাত বক্সী কুমুদের বাবার মোটরে উঠে জিপটাকে অনুসরণ করলেন।
সোজা গঙ্গার কূল ঘেঁষে জিপ আর মোটর দৌড়াল। সন্ত্রস্ত পথচারী দু-পাশে ছিটকে গেল।
ঘোড়দৌড়ের মাঠের পাশে মোটর জিপের কাছাকাছি এসে গেল।
হঠাৎ গুড়ুম করে একটা শব্দ।
জিপ থেকে কে একজন নির্ভুল লক্ষ্যে মোটরের সামনের টায়ারে গুলি করল।
তীব্র আওয়াজ করে টায়ার ফাটল। মোটর ডানদিকে রাস্তা ছাড়িয়ে মাঠের মধ্যে গিয়ে পড়ল।
এদিকে ফাঁকা মাঠ। দূরে সেনাদের ছাউনি।
অনেক কসরত করে পারিজাত বক্সী মোটর থামালেন।
পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে কুমুদের বাবার দিকে ফিরে বললেন, তা-ই তো, ব্যাটারা পালাল। আপনার নোটগুলোর নম্বর সব লেখা আছে তো?
চিন্তায়, ভয়ে কুমুদের বাবা অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন।
তিনি কোনওরকমে মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, আছে।
সব ব্যাঙ্কে আগেই আমরা বেতারে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। সেসব জায়গায় নোট ভাঙাতে গেলেই মুশকিলে পড়বে।
কুমুদের বাবা শঙ্কিতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, এতে কুমুদের কোনও ক্ষতি হবে না তো?
ক্ষতি আর কী হবে? ওরা টাকা চেয়েছিল, টাকা আপনি দিয়েছেন। এবার চুক্তিমতো কুমুদকে ছেড়ে দেওয়া উচিত।
কথা বলতে বলতেই পারিজাত বক্সী জ্যাক দিয়ে মোটর তুলে টায়ার বদলি করে ফেললেন।
তারপর মোটরে উঠতে কুমুদের বাবা প্রশ্ন করলেন, এবার কোনদিকে যাবেন?
চলুন, একটু এগিয়ে দেখা যাক, যদি জিপটার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়। জিপটার নম্বর আমি দেখে নিয়েছি, কিন্তু জানি সে দেখা কোনও কাজে লাগবে না। কারণ নিশ্চয় ওটা ভুয়া নম্বর।
মোটর খিদিরপুর পৌঁছাল। কোথাও জিপের চিহ্ন নেই।
মোটর একপাশে রেখে পারিজাত বক্সী নেমে পড়লেন।
কুমুদের বাবাকে অপেক্ষা করতে বলে রাস্তার ওপারে একটা সরাইখানায় গিয়ে ঢুকলেন।
নোংরা পরিবেশ। জন চারেক লোক বসে চা খাচ্ছে। এদিকে কাউন্টারের পিছনে হৃষ্টপুষ্ট একটি লোক ক্যাশবাক্স সামনে নিয়ে বসে আছে। সে-ই বোধহয় মালিক।
তার কাছে গিয়ে পারিজাত বক্সী বললেন, ওসমানকে একটু দরকার।
লোকটা ভিতরে চলে গেল।
একটু পরেই লুঙ্গি-পরা বেঁটে একটি লোক সেলাম করে এসে দাঁড়াল। তার গলায় রুমাল বাঁধা, একটা চোখ কানা।
তাকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, এ রাস্তায় খুব জোরে কোনও জিপ যেতে দেখেছ ওসমান?
ওসমান মাথা নাড়ল, না।
তোমাদের এখানে অনেকেই তো হাজার টাকার নোট ভাঙাতে আসে?
আসে, সে তো আপনি জানেনই।
শোনো, এই নম্বরগুলো রেখে দাও, যদি এসব নম্বরের নোট কেউ ভাঙাতে আসে, আমাকে একটা খবর পাঠাতে পারো? খবর পাঠাবে আর লোকটাকে আধ ঘণ্টাখানেক আটকে রাখবে কোনও ছুতোয়। আমার ফোন নম্বর তো তোমার জানা।
তা জানা, তবে মালিককেও একবার বলে যান।
পারিজাত বক্সী মালিককে বলে মোটরে এসে উঠলেন।
মোটরের মধ্যে কুমুদের বাবা চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে।
তাঁর মনের অবস্থা পারিজাত বক্সী বুঝতে পারলেন।
তিনি ভাবছেন, গোয়েন্দা ব্যাপারটার কোনোই কূলকিনারা করতে পারলেন না। লোকগুলো টাকাও নিল, হয়তো তাঁর ছেলেকেও খতম করে দেবে।
পারিজাত বক্সী মোটর ঘুরিয়ে নিলেন।
রাত আটটা নাগাদ পারিজাত বক্সীর বাড়ির ফোন বেজে উঠল।
পারিজাত বক্সী বসে বসে একটা বই পড়ছিলেন, লাফিয়ে উঠে ফোন ধরলেন।
স্যার আমি ওসমান, শিগগির চলে আসুন। একটা নম্বরি নোট নিয়ে একজন এসেছে।
পারিজাত বক্সী যেমন পোশাকে ছিলেন, তেমনিভাবেই নেমে গেলেন।
মিনিট কুড়ির মধ্যে পৌঁছে গেলেন।
ওসমান দোকানের বাইরে পায়চারি করছিল, পারিজাত বক্সীকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, আসুন স্যার, ওই যে মালিকের পাশে বসে আছে।
পারিজাত বক্সী ভিতরে ঢুকলেন। আড়চোখে দেখলেন, কাউন্টারের পিছনে মালিকের পাশে কালো রোগা একটা লোক বসে আছে।
পারিজাত বক্সী সোজাসুজি লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
শোনো, এদিকে এসো।
লোকটা উঠে দাঁড়াল।
হাজার টাকার নোটটা তুমি কোথায় পেয়েছ?
লোকটা নির্বাক। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
বার দুয়েক প্রশ্নের পরই পারিজাত বক্সী হুংকার ছাড়লেন, চাবকে তোমার পিঠের ছাল তুলে দেব, আমাকে তুমি চেনো না। এখন টানতে টানতে থানায় নিয়ে যাব। বলো, নোটটা কোথায় পেয়েছ?
এবার লোকটা কাঁপতে কাঁপতে বলল, হুজুর মা-বাপ, নোটটা কুড়িয়ে পেয়েছি।
খিদিরপুরের পথেঘাটে নোট কুড়িয়ে পাওয়া যায় নাকি?
বিশ্বাস করুন হুজুর, ডকের কাছে কুড়িয়ে পেয়েছি।
বুঝতে পেরেছি, ভালো কথায় হবে না। ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি। একে ধরে রাখো তো, আমি আসছি।
পারিজাত বক্সী বেরিয়ে খান তিনেক বাড়ি পরে এক ডাক্তারখানায় ঢুকে খিদিরপুর থানায় ফোন করলেন, নিজের পরিচয় দিয়ে।
মিনিট পনেরো পর দারোগা দুজন কনস্টেবল নিয়ে এসে হাজির।
লোকটা দারোগার সামনেও এককথা বলল, ডকের কাছে কুড়িয়ে পেয়েছি।
দারোগা কড়া ধমক দিল। কুড়িয়ে পেয়েছিলে তো থানায় জমা দাওনি কেন?
বোবার শত্রু নেই। লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
দারোগা লোকটাকে টানতে টানতে জিপে নিয়ে তুলল। তাদের পিছনে পারিজাত বক্সী মোটর চালালেন।
লোকটাকে মোটেই নিরীহ মনে হচ্ছে না। থানায় ধমক দিলে হয়তো কিছু বের হতে পারে।
কিন্তু না, থানাতেও লোকটার মুখ থেকে একটা কথাও বের করা গেল না।
তখন পারিজাত বক্সী দারোগাকে একপাশে ডেকে ফিসফিস করে কী বললেন।
দারোগা লোকটাকে বলল, যা ব্যাটা, আজ তোকে ছেড়ে দিলাম। তোর নামধাম বলে যা। নোটটা আটকে রাখলাম, মালিককে দিয়ে দেব।
লোকটা নাম বলল, রতন পাঁড়ে। বর্তমান নিবাস মোমিনপুর। সবে ছাপরা থেকে এসেছে, এখনও কোথাও চাকরি পায়নি।
রতনকে ছেড়ে দিতে সে থানার বাইরে এসে এদিক-ওদিক দেখল, তারপর রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে আরম্ভ করল।
অনেক পিছনে মোটরে পারিজাত বক্সী তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন।
প্রায় মাইল দেড়েক। লোকালয় শেষ হয়ে একটা মাঠ। তার পাশে কয়েকটা টিনের ঘর।
রতন একটা টিনের ঘরের দরজায় তিনবার টোকা দিল।
টুক, টুক, টুক।
ভিতর থেকে গম্ভীর আওয়াজ শোনা গেল, এসো।
পারিজাত বক্সী একটা গাছের ছায়ায় অন্ধকারে মোটর রেখে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলেন।
রতন ভিতরে ঢুকতে পারিজাত বক্সী টিনের ফুটোর ওপর চোখ রাখলেন।
টেবিলের ওপর হ্যারিকেন জ্বলছে। চেয়ারে দীর্ঘকায় লোক। পরনে শার্ট আর প্যান্ট। কপালের একপাশে একটা কাটার দাগ।
তার সামনে রতন।
কী হল, নোটের খুচরো পাওয়া গেল না?
আজ্ঞে না, পারিজাত টিকটিকি পিছনে লেগে সব ভেস্তে দিয়েছে।
তাহলে ছেলেটার বাবা টিকটিকি লাগিয়েছে?
তা-ই তো মনে হচ্ছে।
পারিজাত বক্সী কোমরে হাত ছোঁয়ালেন। রিভলভারটা ঠিকই আছে।
ভাবলেন, রিভলভারটা হাতে নিয়ে ভিতরে ঢোকার এই উপযুক্ত সময়।
রিভলভারটা হাতে নিয়ে ঢুকতে যাবার মুখেই বাধা। পিছন থেকে কে তাঁর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত হানল। চোখের সামনে চাপ চাপ অন্ধকার। সমস্ত পৃথিবী যেন ঘুরে উঠল। পারিজাত বক্সী পড়ে গেলেন।
যখন জ্ঞান হল দেখলেন একটা খাটিয়ায় শুয়ে আছেন। সেই টিনের ঘর কিন্তু পাকা বাড়ি।
কাছেই একটা চেয়ারে সেই দীর্ঘকায় লোকটা।
পারিজাত বক্সী চোখ খুলতেই লোকটা বলল, কী পারিজাতবাবু, শরীর এখন কেমন?
কোনও উত্তর না দিয়ে পারিজাত বক্সী প্রথমে মাথায় হাত দিলেন। মাথায় ব্যান্ডেজ। এখন অল্প অল্প ব্যথা রয়েছে। কোমরে হাত দিয়ে দেখলেন রিভলভার নেই।
লোকটা হেসে বলল, যন্ত্রটা সরিয়ে রেখেছি। যদি হাত লেগে গুলি বেরিয়ে যায়।
পারিজাত বক্সী চুপ করে রইলেন।
কুমুদের বাবা কে? তারপর কুমুদের বাবা আপনাকে কত টাকা দিয়েছে? বোকা সাজবার চেষ্টা করবেন না, তাতে ফল হবে না। আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, সরে দাঁড়ান, নইলে খুব বিপদে পড়ে যাবেন।
খুব যে ভয় পেয়েছেন, পারিজাত বক্সীর মুখ-চোখে এমন কোনও ভাব ফুটল না। বরং তিনি বিস্মিতকণ্ঠে বললেন, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না, বিশ্বাস করুন। কিছু জাল নোট বাজারে কারা ছড়িয়েছে। সেই ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য আমাকে নিয়োগ করা হয়েছে।
এবার লোক ভ্রূটা কোঁচকাল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ কী ভাবল, তারপর বিড়বিড় করে বলল, জাল নোট?
হ্যাঁ, তারই একটা আপনার লোক ভাঙাতে গিয়েছিল।
লোকটা নিজেকে সামলে নিল। চাপা গলায় বলল, ঠিক আছে। নোটগুলো না হয় জাল, কিন্তু ছেলেটা তো আর জাল নয়। সে আমাদের হাতের মুঠোয় আছে। আপনাকেও কিছুদিন আমাদের আশ্রয়ে থাকতে হবে। নোট ভাঙাতে নানা দিকে লোক গেছে, তাদের রিপোর্ট শোনা যাক।
লোকটা উঠে দাঁড়াল।
শুয়ে শুয়ে পারিজাত বক্সী দেখলেন লোকটা দরজা বন্ধ করে তালা দিল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
আস্তে আস্তে পারিজাত বক্সী উঠে দাঁড়ালেন। জানলা নেই, অনেক উঁচুতে একটা ঘুলঘুলি। এত ছোটো যে তার মধ্য দিয়ে কোনও পূর্ণবয়স্ক লোকের যাওয়া সম্ভব নয়।
পারিজাত বক্সী দেওয়ালে কান পাতলেন। জলের শব্দ খুব স্পষ্ট। একেবারে পাশেই বোধহয় নদী।
দুটো হাত পিছনে রেখে পারিজাত বক্সী পায়চারি শুরু করলেন।
এখান থেকে পালানো অসম্ভব। কতদিন এভাবে বন্দি থাকতে হবে কে জানে! এরা কি কুমুদকে ছেড়ে দেবে? এক হাজার টাকা থানা আটকে রেখেছে। খুব সম্ভবত এই এক হাজার টাকার জন্য এরা কুমুদের বাবাকে আবার চিঠি দেবে।
কিন্তু পারিজাত বক্সী বন্দি। পরামর্শ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
খট করে শব্দ হতে পারিজাত বক্সী ঘুরে দাঁড়ালেন।
দরজা খুলে একটা লোক ভিতরে ঢুকল। এক হাতে এক মগ চা, অন্য হাতে দুখানা রুটি।
সে চেয়ারের ওপর সবকিছু নামিয়ে রেখে হিন্দিতে বলল, নিন, খেয়ে নিন। আমি বাসন নিয়ে যাব।
পারিজাত বক্সী খাটিয়ায় বসে বললেন, আচ্ছা ভাই, যমুনার ঢেউয়ের এত শব্দ তো আগে শুনিনি।
লোকটা নিজের দুটো চোখ বিস্ফারিত করে বলল, এখানে আবার যমুনা কোথায়? এ তো গঙ্গা। হরিহরপুরের গঙ্গার পার দেখা যায় না। আর কী ঢেউ!
পারিজাত বক্সী বুঝতে পারলেন, জায়গার নাম হরিহরপুর। পাশেই গঙ্গা নদী।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আবার বললেন, এখানে আর-একটা ঘরে যে ছেলেটা রয়েছে তাকে চা দেওয়া হয়েছে?
লোকটা কিছুক্ষণ পারিজাত বক্সীকে একদৃষ্টে দেখল, তারপর বলল, ভীষণ বদমাইশ ছেলে। রোজ খাবার সময় ঝামেলা করে। একদিন তো আমার ঘাড়ে আচমকা ঝাঁপিয়েই পড়েছিল, কিন্তু আমার সঙ্গে পারবে কেন? আমি তাকে—
এই পর্যন্ত বলে লোকটা হঠাৎ থেমে গেল। বোধহয় ভাবল, এতসব কথা এই বাবুকে বলা হয়তো উচিত হয়নি।
এর বেশি আর পারিজাত বক্সীর শোনারও দরকার ছিল না। তিনি বুঝতে পারলেন এখানেই কুমুদ কিংবা তুলসী বন্দি রয়েছে। তবে কুমুদ হবার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ এরা কুমুদের বাপের কাছেই টাকা চেয়ে পাঠিয়েছিল।
লোকটা বাইরে চলে গেল। দরজা বন্ধ হল।
পারিজাত বক্সী দু-হাতে নিজের চুল মুঠোয় ধরে চুপচাপ বসে রইলেন।
তাঁর এতদিনের গোয়েন্দা-জীবনে এরকমভাবে বিপদে আর পড়েছেন বলে মনে করতে পারলেন না।
এটুকু বুঝতে পারলেন, হয়তো এরা তাঁর প্রাণহানি করবে না। কুমুদের বাবার কাছ থেকে টাকাটা পেলেই তাঁকে ছেড়ে দেবে। বাকি এক হাজার টাকা।
কিন্তু পারিজাত বক্সীর যে হার হল সে বিষয়ে তো সন্দেহ নেই।
যেমন করে হোক উপায় একটা বের করতেই হবে।
পারিজাত বক্সী পায়চারি করতে আরম্ভ করলেন আর মাঝে মাঝে মুখ তুলে ঘুলঘুলির দিকে দেখতে লাগলেন।
ঘুলঘুলিটা কোনও কাজে লাগবে এমন মনে হল না। তবে বাইরের পৃথিবীর শব্দ ওই ঘুলঘুলিটা দিয়ে এ ঘরে ঢুকছে।
রাত হল। কোনও বাতির ব্যবস্থা নেই। ঘন অন্ধকার।
একসময়ে আবার দরজা খুলে গেল।
লোকটা একটা থালায় ভাত, কিছু তরকারি আর বাটিতে ডাল নিয়ে ভিতরে ঢুকল। সবগুলো চেয়ারে রেখে মেঝের ওপর বসে পড়ল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন, আমি বাসনগুলো নিয়ে যাব।
লোকটার আর-এক হাতে জ্বালানো হ্যারিকেন। হ্যারিকেনটাও সে চেয়ারের ওপর রাখল।
ভাত-তরকারির চেহারা দেখে পারিজাত বক্সীর সেসব ছুঁতে ইচ্ছা হল না কিন্তু না ছুঁয়েই বা উপায় কী। না খেলে নিজেই দুর্বল হয়ে পড়বেন।
কোনওরকমে খাওয়া শেষ করলেন।
লোকটার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখলেন, লোকটা বসে বসে ঢুলছে।
পলকের জন্য লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে কাবু করে তার কাছ থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে কুমুদকে উদ্ধারের চেষ্টা করলে হয় না!
একটু ভাবলেন। না, এত তাড়াতাড়ি ঝুঁকিটা নেওয়া ঠিক হবে না।
বাইরে আরও লোক পাহারায় আছে কি না বলা যায় না। ধরা পড়লে পারিজাত বক্সীকে আরও কড়া শাসনে রাখবে। কিংবা দূরে কোথাও সরিয়ে দেবে। দুর্গম জায়গায়।
খাওয়া শেষ হতে বাসনপত্র আর হ্যারিকেন নিয়ে লোকটা যাবার সময় পারিজাত বক্সী বললেন, ভাই, হ্যারিকেনটা রেখে যাও-না। অন্ধকারে থাকব।
লোকটা যেতে যেতে গম্ভীরকণ্ঠে বলল, হুকুম নেই।
পারিজাত বক্সী চুপচাপ বসে রইলেন। রাত বাড়ল। খাটিয়ার ওপর শুধু একটা বালিশ। বেশ জোলো বাতাস বইছে। একসময় পারিজাত বক্সী শুয়ে পড়লেন।
সকাল হতেই দীর্ঘকায় লোকটি ভিতরে ঢুকল।
তখনও পারিজাত বক্সী বিছানায় শুয়ে।
নমস্কার বক্সী সায়েব, ভালো আছেন?
পারিজাত বক্সী উঠে বসলেন।
বললেন, কী করে ভালো থাকব? স্নান করতে পারছি না। রাতে একটা আলো নেই।
লোকটা হাসল, আরে স্নান করার ব্যবস্থা করে দেব। আর আলো? আপনি এত সাহসী পুরুষ, আপনার আলো কী হবে?
পারিজাত বক্সী হেসে বললেন, আর কিছু নয়, আমার ছুঁচোর ভয় খুব বেশি। অন্ধকারে ছুঁচোর উপদ্রব বেশি হয় কিনা।
লোকটি কী বুঝল কে জানে, কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে তারপর বলল, কুমুদের বাবার কাছে চিঠি চলে গেছে। আশা করছি বাকি হাজার টাকা পেতে দেরি হবে না। বিশেষ করে যখন আপনার মতন পরামর্শদাতার সঙ্গে আলোচনা করতে পারে না।
পারিজাত বক্সী হাসলেন—চোটটা একটু কম। আপনার শাগরেদ তেমন জোরালো আঘাত করতে পারেনি।
জোরালো আঘাত করার নির্দেশ আমার ছিল না। আচ্ছা উঠি। আপনার স্নানের জল যথাসময়ে পাঠিয়ে দেব।
লোকটা বেরিয়ে গেল।
দুপুরের একটু আগে বড়ো এক বালতি জল আর গামছা এল। তারপর যথারীতি খাবারও! বিকালে চা।
তারপরই পারিজাত বক্সী কাজ শুরু করলেন।
চেয়ারটা বারকতক খাটিয়ার সঙ্গে ঠুকে ঠুকে একটা পায়া খসিয়ে ফেললেন।
ঘুলঘুলি দিয়ে ফিকে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে। আজ আর অন্ধকার নয়।
পারিজাত বক্সী ঠিক করে নিলেন, যা হবার হবে, এভাবে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকার কোনও মানে হয় না।
দরজায় খুট করে শব্দ হতেই চেয়ারের পায়াটা হাতে নিয়ে পারিজাত বক্সী দরজার পাশে দাঁড়ালেন।
দরজা খুলল। লোকটা হ্যারিকেন হাতে ঢুকে হ্যারিকেনটা মেঝের ওপর নামিয়ে রেখে আবার বাইরে গেল।
ভাতের থালা আর তরকারির বাটি বাইরে রেখেছিল, সেগুলো নিয়ে আবার ভিতরে ঢুকল।
সঙ্গে সঙ্গে পারিজাত বক্সী চেয়ারের পায়া দিয়ে তার মাথার পিছনের দিকে সজোরে আঘাত হানলেন। একটা হাত দিয়ে লোকটার মুখ চেপে ধরলেন, যাতে তার আর্তনাদ না বের হয়।
লোকটা মেঝের ওপর পড়ে গেল। হাত থেকে থালা আর বাটি ছিটকে পড়ল।
তারই পরনের ধুতির কিছুটা খুলে পারিজাত বক্সী লোকটার মুখ আর দুটো হাত বাঁধলেন, তারপর লোকটার কোমর হাতড়ে চাবির রিং খুলে নিলেন।
রিংয়ে তিনটে চাবি। চাবিগুলো নিয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে পারিজাত বক্সী বাইরে বেরিয়ে এলেন।