৩
কুমুদ চোখ খুলে দেখল বিরাট আকারের কালো পাথরের মাঝখানে তার দেহ আটকে রয়েছে।
চারদিকে প্রবল জলস্রোত। তীব্র বেগে জল এসে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে। আওয়াজে কান পাতা দায়।
কোনওরকমে পাথর আঁকড়ে ধরে কুমুদ তার ওপর উঠে বসল। এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়ে দেখল।
কাঠের পুলটা ভেঙে জলের মধ্যে পড়েছে। লরির চিহ্ন কোথাও নেই।
আর-একটা ব্যাপার কুমুদ সবিস্ময়ে লক্ষ করল। লরিটা ভেঙে পড়ার সময়ে ধাক্কায় তার হাত-পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে গেছে।
খুব সাবধানে কুমুদ পাথরের ওপর উঠে দাঁড়াল।
কোনওদিকে লোকালয়ের কোনও চিহ্ন নেই। কেবল মাঠ আর মাঠ। অনেক দূরে অস্পষ্ট পাহাড়ের শ্রেণি।
পাথরের ওপর পা দিয়ে দিয়ে ডাঙায় পৌঁছানো সম্ভব, কিন্তু পাথরের গায়ে যেমন শ্যাওলা পড়েছে, তাতে পা পিছলে যাবার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
কিন্তু এভাবে পাথরের ওপর তো বসে থাকা যায় না।
কুমুদ পা টিপে টিপে ডাঙার দিকে যেতে শুরু করল। দু-একবার জলের মধ্যে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। ডাঙায় লাফিয়ে পড়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইল। তার ওঠার ক্ষমতা নেই।
একসময়ে মনে হল যদি দলের লোকগুলোর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়!
লরি স্রোতের সঙ্গে যদি ভেসে গিয়ে থাকে তাহলে লরি আঁকড়ে লোকগুলোও হয়তো ভাসবে।
রাস্তা ধরে চলাও নিরাপদ নয়। আগের লরি ওই পথেই যাবে। পিছনে লরিটাকে অনুসরণ না করতে দেখলে তারা হয়তো সন্দেহবশে খোঁজ করতে পিছিয়ে আসবে।
তার চেয়ে কোনাকুনি মাঠ ধরে চলাই ভালো।
একটানা চলতে কুমুদের খুব কষ্ট হতে লাগল। খিদের জ্বালায় চোখে অন্ধকার দেখছে। তেষ্টায় তালু শুকিয়ে কাঠ। রোদ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। পথ চলাই দুষ্কর।
বেশ কিছুটা চলার পর একটা কুঁড়েঘর চোখে পড়ল।
কাছে গিয়ে দেখল এক বৃদ্ধ দাওয়ায় বসে হুঁকো টানছে।
কুমুদকে দেখেই হুঁকো একপাশে সরিয়ে রেখে বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি? এখানে কী চাই?
কুমুদ কোনও উত্তর দিতে পারল না। উঠানের ওপর বসে পড়ে ইঙ্গিতে জলের কথা জানাল।
বৃদ্ধ চিৎকার করল, এ পার্বতীয়া, এক লোটা জল নিয়ে আয়।
এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এসে কুমুদকে দেখে আবার ভিতরে চলে গেল।
একটু পরেই বেরিয়ে এল শালপাতার ওপর দুখানা রুটি আর গুড়, আর এক হাতে এক লোটা জল নিয়ে।
কুমুদ রুটি দুটো বৃদ্ধার হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে একনিমেষে শেষ করে ফেলল, তারপর ঢকঢক করে সব জল খেয়ে যেন একটু ধাতস্থ হল।
এবার বৃদ্ধ আবার জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি? এখানে এলে কী করে?
বৃদ্ধের দেহাতি হিন্দি বুঝতে কুমুদের খুব অসুবিধা হল না, কারণ তাদের বাড়ির চাকরবাকর প্রথম প্রথম এ ধরনের হিন্দিই বলত।
কুমুদ উত্তর দিল, আমি কলকাতায় যাব। এখানে বদমায়েশ লোকের পাল্লায় পড়েছিলাম।
বদমায়েশ লোক? মানে ডাকু?
হ্যাঁ, সেইরকমই।
বৃদ্ধ মাথা নাড়ল, এ এলাকাটা বড়ো খারাপ বাবু। ওদিকের জঙ্গল হচ্ছে ডাকুর আস্তানা। তা তোমার টাকাপয়সা সব কেড়ে নিয়েছে?
হ্যাঁ, সব।
কী করে কলকাতায় যাবে বাবু? সে শহর তো এখান থেকে অনেক দূর।
এ জায়গার নাম কী?
এর নাম চৌতারিয়া। স্টেশন এখান থেকে চব্বিশ মাইল। ছোটো স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেন বদলে পাটনা যেতে হবে। পাটনা থেকে কলকাতা। আমার ছেলেরা সব কলকাতা দরোয়ানি করে। তাদের মুখে শুনেছি ভারী শহর কলকাতা। সেখানে কল টিপলে আলো, মেশিন ঘোরালেই জল। তা-ই না বাবু?
এসব কথার উত্তর দিতে কুমুদের ভালো লাগছিল না।
তবু সে ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিক কথা।
এসব তো হল। কিন্তু যাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে? চব্বিশ মাইল রাস্তা কুমুদের পক্ষে পায়ে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। তার ওপর পকেটে একটি ফুটো পয়সাও নেই। রেলভাড়া দেবে কী করে?
কুমুদের অসুবিধার কথা বোধহয় বৃদ্ধ বুঝতে পারল।
একটা কাজ করো। আজকের দিনটা কোনওরকমে এখানে কাটাও। কাল সকালে কাঠ-বোঝাই লরি যাবে শহরের দিকে। ড্রাইভার আমার জানা। সে তোমাকে স্টেশনে পৌঁছে দেবে। তারপর কী করে তুমি কলকাতা যাবে বাপু তা তো জানি না।
কুমুদ বলল, অনেক ধন্যবাদ, তুমি আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দাও, তারপর আমার ব্যবস্থা আমি করে নেব।
কুমুদ মনে মনে ঠিক করল, একবার স্টেশনে পৌঁছাতে পারলে স্টেশন মাস্টারের হাতে-পায়ে ধরে রেলে যাবার ব্যবস্থা করবে। নিতান্ত যদি তা না সম্ভব হয় তাহলে স্টেশন থেকে বাবাকে টেলিগ্রাম করে দেবে, তাহলেই একটি উপায় হয়ে যাবে।
পরের দিন খুব ভোরে বৃদ্ধ কুমুদকে জাগিয়ে দিল। কুমুদ চোখ খুলে দেখল, হাতে লাঠি, মাথায় পাগড়ি, বৃদ্ধ তৈরি।
দুজনে হেঁটে হেঁটে রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়াল।
ইট-বোঝাই গোটা দুয়েক লরি গেল, বৃদ্ধ তাদের থামাল না।
তারপরই কাঠ-বোঝাই একটা লরি আসতে বৃদ্ধ পাগড়ি খুলে মাঝরাস্তায় দাঁড়াল। পাগড়িটা বাতাসে নাড়তে লাগল।
সশব্দে ব্রেক কষে লরি থামল।
ড্রাইভার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, রাম রাম ভাইয়া। কেয়া খবর?
বৃদ্ধ কুমুদকে দেখিয়ে কী বলতেই ড্রাইভার দরজা খুলে বলল, আইয়ে।
কুমুদ উঠতে গিয়েই বাধা পেল। বৃদ্ধ পিছন থেকে তার একটা হাত আঁকড়ে ধরেছে।
বাবু, আমি গরিব আদমি। আমার কিছু নেই। আপনি এটা রেখে দিন।
কুমুদ কিছু বলবার আগেই বৃদ্ধ তার হাতে একটি পাঁচ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে হনহন করে মাঠ ধরে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
কুমুদের চোখে জল এসে গেল।
বৃদ্ধ লোকটি হয়তো তার অনেক দিনের কষ্টে সঞ্চিত টাকাটা তার হাতে তুলে দিল।
ড্রাইভার হিন্দিতে কুমুদকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি যাবেন কোথায়?
কোনও একটা রেল স্টেশনে আমাকে নামিয়ে দাও।
ড্রাইভার আর কিছু বলল না। তিরবেগে লরি ছোটাল।
ঘণ্টা চারেক বাদে লরি থামল।
ইতিমধ্যে এক জায়গায় লরি থামিয়ে ড্রাইভার চা আর রুটি খেয়ে নিয়েছে।
কুমুদও বৃদ্ধের দেওয়া পাঁচ টাকা ভাঙিয়ে খেয়েছিল!
লরি থামতে ড্রাইভার বলল, এই রাস্তা ধরে চলে যান বাবু। মাইল দুয়েক গেলেই স্টেশন পেয়ে যাবেন।
কুমুদ চলতে আরম্ভ করল। দু-পাশে ছোটো ছোটো কুঁড়ে। শুয়োর আর মুরগির পাল ঘুরছে। পিছনে গমের খেত।
অনেকটা যাবার পর রেলের লাইন দেখা গেল। তারপর স্টেশন।
খুব ছোটো। বোধহয় এখান থেকে বেশি লোক ওঠানামা করে না, প্ল্যাটফর্ম জনশূন্য।
টিকিটঘরের সামনে গিয়ে দেখল দরজায় তালাবন্ধ।
এধারে নীল শার্ট গায়ে একটা লোক বসে ছিল। হাতে গোটানো লাল-নীল নিশান।
কুমুদ বুঝতে পারল লোকটা পোর্টার।
তার সামনে গিয়ে কুমুদ জিজ্ঞাসা করল, ভাই, ট্রেন কখন আসবে?
কোথায় যাবেন?
পাটনা।
আজ আর ট্রেন নেই। শেষ ট্রেন বেলা বারোটা পঞ্চাশে ছেড়ে গেছে।
কোনও ট্রেন নেই?
মালগাড়ি আছে। এখান থেকে কাঠ বোঝাই হয়ে ছাড়বে।
স্টেশন মাস্টার আসবে না?
না। সেই রাত্রে একবার আসবে। মালগাড়ি ছাড়বার সময়।
কুমুদ মহাসমস্যায় পড়ল।
স্টেশনের গায়ে ছোটো একটা চায়ের দোকান। অগত্যা এক পেয়ালা চায়ের আশায় সেখানে গিয়ে হাজির হল।
বাচ্চা একটা ছোকরা বেঞ্চের ওপর অকাতরে ঘুমোচ্ছে। ঠেলে ঠেলে কুমুদ তাকে উঠিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা বেঞ্চে বসল।
আপনাকে বাঙালি বলে মনে হচ্ছে।
এই বিদেশে বাংলা কথা শুনে কুমুদ চমকে মুখ ফেরাল।
পরনে খাকি শার্ট আর হাফ প্যান্ট। মাথায় শোলার টুপি। গায়ের রং কয়লার মতন। জবা ফুলের রং দুটি চোখের।
কুমুদ ফিরতেই লোকটা দুটো হাত বুকের কাছে জড়ো করে বলল, নমস্কার।
কুমুদ প্রতিনমস্কার করে বলল, হ্যাঁ, আমি বাঙালি।
নাম?
কুমুদ নাম বলল।
নিবাস?
নিবাসও কুমুদ বলল।
এখানে আগমনের হেতু?
লোকটার প্রশ্নের যেন আর শেষ নেই।
কুমুদ উত্তর দিতে ইতস্তত করছে দেখে লোকটাই বলল, বুঝতে পেরেছি। আমার কাছে লুকোতে পারবেন না। তা মনের মতন কিছু পেলেন?
কুমুদ বিপদে পড়ল। কী বুঝেছে লোকটা, কুমুদ একেবারেই বুঝতে পারল না।
জঙ্গল দেখতে এসেছিলেন তো? কাঠের ব্যাবসা? শুনুন মশাই, আমি বিশ বছর এ লাইনে আছি। এদিককার সব জঙ্গল আমার নখদর্পণে। আমি এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে পারি।
কুমুদ ঠিক করে ফেলল এ ধরনের কথাবার্তা বেশি দূর এগোবার আগে আসল কথাটা বলে ফেলাই ভালো।
ইতিমধ্যে কুমুদের চা এসে গেছে। সঙ্গে বিস্কুট।
ভদ্রতার খাতিরে কুমুদ জিজ্ঞাসা করল, আপনার?
ব্যস্ত হবেন না। আমাকে ওরা খুব চেনে। ঠিক দিয়ে যাবে।
সত্যি, একটু পরেই বড়ো পেয়ালায় চা এল।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে কুমুদ বলল, আমি খুব বিপদে পড়েছি।
বিপদ? কীরকম বিপদ বলুন তো?
আস্তে আস্তে কুমুদ সব বলল।
সব শুনে লোকটা বলল, আপনি প্রাণে বেঁচেছেন মশাই। খুব/বেঁচেছেন, ওই বদমায়েশরা আপনাকে খতম করে ফেলত।
কুমুদ বলল, আমাকে আপনি বলবেন না। আমার বয়স আঠারো।
আমার বয়স আটত্রিশ। ঠিক আছে, তুমিই বলব। তুমি কী করো?
এইবার হায়ার সেকেন্ডোরি পরীক্ষা দিয়েছি।
বাড়িতে কে আছে?
কুমুদ বলল।
বাবা কী করেন? তোমার জন্য নিশ্চয় তিনি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
বাবা খুব নামকরা ডাক্তার। আমার জন্য চিন্তিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
তোমাদের কলকাতায় কি নিজের বাড়ি? মোটর আছে?
কুমুদ ঘাড় নাড়ল। হ্যাঁ, বাড়ি-গাড়ি দুইই আছে।
তাহলে একটা কাজ করো। আজ রাতটা ধর্মশালায় কাটিয়ে কাল পাটনা চলে যাও। সেখান থেকে কলকাতা। আমি তোমাকে সঙ্গে করে একেবারে বাড়ি পৌঁছে দেব।
কিন্তু একটা মুশকিল হয়েছে যে।
কী আবার মুশকিল হল?
আমার সঙ্গে রেলভাড়ার টাকা নেই।
কুমুদের কথা শেষ হবার আগেই দু-হাতে পেট চেপে লোকটা হেসে প্রায় লুটিয়ে পড়ার জোগাড়।
কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, আরে, এ আবার একটা কথা হল। আমি সব খরচ দেব, তারপর কলকাতায় গিয়ে তোমার বাবার কাছ থেকে না হয় টাকাটা নিয়ে নেব। আর তারই বা দরকার কী। আমার পেটে একটা দারুণ ব্যথা হয়। দিন দুয়েক অজ্ঞানের মতন পড়ে থাকি। ডাক্তার দেখাবার ফুরসতই পাই না। তোমার বাবাকে দেখিয়ে একটা ব্যবস্থা করব। চলো, আমরা বেরিয়ে পড়ি।
লোকটা কুমুদকে চায়ের দাম কিছুতেই দিতে দিল না। তাকে প্রায় বগলদাবা করে রাস্তায় নামল।
প্রায় আধ মাইল যাবার পর ধর্মশালা মিলল।
জরাজীর্ণ একতলা। দেয়ালের ফাটলে ফাটলে বট-অশ্বত্থের চারা। বাইরের রং আগে কী ছিল, বোঝা মুশকিল।
কুমুদকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে লোকটা বলল, তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি ঘর খালি আছে কি না খোঁজ নিয়ে আসি।
কুমুদ একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়াল।
সে খুবই ভেঙে পড়েছিল। বাপের কাছে ফিরে যাবার কোনও উপায় পাচ্ছিল না। ভগবান সদয়। হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে এমন এক মহানুভব মানুষের উদয় হল।
তুলসীর কথা মনে হল। হয়তো এতদিনে তুলসী তার মা-বাপের কাছে ফিরে গেছে। কুমুদের জন্য নানা দিকে জোর তল্লাশি চলছে। পুলিশ তাকে খুঁজে বের করবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
লোকটা ফিরে এল।
এসো, এসো, তোমার ভাগ্য ভালো। ছোটো একটা ঘর পাওয়া গেছে। একটু বিশ্রাম করো, আমি তোমার বাবাকে একটা টেলিগ্রাম করে দিয়ে আসব।
লোকটার পিছন পিছন কুমুদ ধর্মশালায় ঢুকল।
সামনের ঘরে একটা টেবিল, একটা চেয়ার। চেয়ারে দশাসই চেহারার একটি লোক বসে। ফরসা গায়ের রং। কপালে লাল ফোঁটা। টিকিতে ফুল বাঁধা।
কুমুদ সামনে যেতেই লোকটা উঠে দাঁড়াল।
দুটো হাত বুকের ওপর জড়ো করে বলল, রাম রাম বাবুসায়েব। আসুন, আসুন। আপনার মতন লোকের জন্য এ ধর্মশালা নয়। চেহারাতেই মালুম হচ্ছে আপনি রইস আদমির ছেলে। কষ্ট করে থাকুন, আর কী করবেন।
কুমুদ লোকটার সঙ্গে আরও এগিয়ে গেল।
পিছনের আগাছার জঙ্গলের মধ্যে একটা একতলা বাড়ি।
দরজা খুলে লোকটা বলল, লালাজির কথা শুনলে তো। কোনওরকমে ক-টা দিন এখানে কাটাও, তোমার বাবা না-আসা পর্যন্ত। আমার মনে হয় খবর পেলেই তিনি নিজে ছুটে আসবেন।
কুমুদ ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখল, কোণের দিকে একটা দড়ির খাটিয়া।
এদিকে একটা কাঠের টেবিল আর চেয়ার। কোনও জানলা নেই, একেবারে ওপরে ছোটো একটা ঘুলঘুলি।
ঘরের চেহারা কুমুদের মোটেই ভালো ঠেকল না। এ ঘরও সেই আগের মতন, যে ঘরে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
কুমুদ বলেই ফেলল, এ কীরকম ঘর? আলো-বাতাস আসবে কোথা থেকে? জানলা নেই।
লোকটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল।
এ দেশে যেমন গরম, তেমনই ঠান্ডা। এখানে কোনও ঘরে জানলা থাকে না। ওপরের ওই ছোটো ঘুলঘুলি দিয়ে প্রচুর আলো-বাতাস আসবে। নাও, তুমি একটু বিশ্রাম করো। আমি লালাজির কাছ থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসি।
কুমুদ নিজের ক্লান্ত দেহ কোনওরকমে টেনে এনে খাটিয়ার ওপর বসল।
বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারল না। আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল।
গায়ে ঠেলা দিতে কুমুদ চমকে বিছানা থেকে উঠে বসল, অস্ফুট চিৎকার করে। সে স্বপ্ন দেখছিল। মূর্তি চোরের দল তাকে তাড়া করেছে। তাদের হাতে হাতে নানারকম অস্ত্র। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কুমুদ তিরবেগে ছুটছে। লোকগুলো তার নাগাল পাচ্ছে না।
হঠাৎ একটা গাছের শিকড়ে পা আটকে কুমুদ পড়ে যেতেই তারা তাকে ধরে ফেলল।
তাই কুমুদ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল।
কী হল?
কুমুদ চোখ খুলে দেখল লোকটা এক হাতে একটা শালপাতার ঠোঙা নিয়ে খাটিয়ার একপাশে বসে আছে।
দু-হাতে চোখ মুছে কুমুদ বলল, বিশ্রী একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।
নাও, খেয়ে নাও। ঠোঙাতে পুরি আর তরকারি আছে। আর এই লোটাতে গরম দুধ।
লোকটা মেঝের ওপর রেখে একটা লোটা তুলে খাটিয়ার ওপর রাখল।
কুমুদ আর তিলমাত্র দেরি করল না।
ঠোঙা আর তরকারি দুইই গরম। কুমুদ যেন অমৃতের স্বাদ পেল।
খাওয়া শেষ করে কুমুদ লোটাতে চুমুক দিল।
ঘন দুধ। বোঝা যায় একবিন্দু জল পড়েনি।
কুমুদ এবার বলল, একটু জল।
লোকটা তাড়াতাড়ি ছুটে বেরিয়ে গেল, একটু পরেই ভাঁড়ে জল নিয়ে ফিরল।
জল শেষ করে কুমুদ বলল, আপনার ঋণ জীবনে শোধ করতে পারব না।
লোকটা লজ্জায় মাথা নিচু করল। মৃদুকণ্ঠে বলল, ছি, ছি, ওসব কথা বলে আমাকে লজ্জা দিয়ো না। বাঙালির ছেলে বিদেশে বিপদে পড়েছ, তোমাকে দেখা আমার কর্তব্য। আমি সেইটুকুই করেছি। নাও, তোমার বাবার ঠিকানা বলো।
কুমুদ বলল।
লোকটা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে তাতে লিখে নিতে নিতে বলল, আমি ভেবে দেখলাম টেলিগ্রাম করে লাভ নেই। অজ পাড়াগাঁ, টেলিগ্রাম কখন গিয়ে পৌঁছায় তার ঠিক নেই, তার চেয়ে চিঠি লেখাই ভালো। তুমি লেখো চিঠিটা।
কথার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা পকেট থেকে একটা কাগজ আর কলম বের করে কুমুদের সামনে রেখে বলল, নাও, আমি যেমন বলছি, সেরকম লিখে দাও। ঠিক কাজ হবে।
কুমুদ কাগজ টেনে নিয়ে কলম হাতে তৈরি হয়ে বসল।
লোকটা বলে গেল।
শ্রীচরণেষু বাবা,
পত্রপাঠমাত্র বাহকের হাতে দশ হাজার টাকা দিবেন, নতুবা আমার জীবন-সংশয়।
কিছুটা লিখেই কুমুদ থেমে গেল। জিজ্ঞাসা করল, এর মানে?
লোকটা অমায়িক হাসল।
কোন জায়গার মানে বুঝতে পারছ না বাবাজি? এ তো একেবারে সহজ বাংলা ভাষা। এ চিঠি নিয়ে যে যাবে, তার হাতে তোমার বাবা দশ হাজার টাকা তুলে দেবেন, না হলে তোমার জীবন্ত ফেরার কোনও আশা নেই।
আপনি যে এত নীচ তা তো বুঝতে পারিনি।
বাইরে থেকে আমরা আর কতটুকু বুঝতে পারি বলো। তোমার চেহারা দেখেই কি আর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি এত বড়োলোকের ছেলে! যাক, যা বলছি, তা লেখো। দেরি কোরো না।
যদি না লিখি?
তাহলে যাতে লেখো, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কুমুদের প্রচণ্ড ঘুসি এসে পড়ল লোকটার কপালে।
লোকটা আর্তনাদ করে মেঝের ওপর পড়ে গেল।
কুমুদ আর কালবিলম্ব না করে খোলা দরজার দিকে ছুটে গেল।
কিন্তু বের হতে পারল না। দরজা আগলে লালাজি।
বেড়াল যেমন ইঁদুরকে তুলে নেয়, তেমনি করে সে কুমুদের ঘাড় ধরে তুলে ঘরের কোণে ছুড়ে ফেলে দিল।
টেবিলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে কুমুদ পড়ে গেল।
কুমুদের মনে হল তার হাড়গোড় যেন চূর্ণ হয়ে গেল। সে আর উঠতেই পারবে না।
অনেক কষ্টে টেবিল ধরে দাঁড়িয়ে দেখল লালাজি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাতে চকচকে ছোরা।
অন্য লোকটা তখনও মাটিতে পড়ে রয়েছে।
লালাজি হুংকার ছাড়ল, এই শয়তান, যা বলা হয়েছে তা-ই লেখ, নইলে একেবারে খতম করে দেব।
কুমুদের আপত্তি করতে আর সাহস হল না।
আপত্তি করলে এই তেপান্তর মাঠে তাকে মেরে ফেললে কাকপক্ষীতেও জানতে পারবে না।
কুমুদ লিখল। প্রথমে চিঠি, তারপর খামের ওপর ঠিকানা।
ঠিকানা লেখা শেষ হতে দেখল, লোকটা মেঝের ওপর উঠে বসল। কপালের একটা পাশ সুপুরির মতন ফুলে উঠেছে।
লোকটা কাতর গলায় বলল, উঃ, শয়তান ছেলেটার ঘুসির জোর আছে। এখনও চোখে অন্ধকার দেখছি।
লালাজি এগিয়ে এসে চিঠিটা তুলে নিয়ে লোকটার হাতে দিয়ে বলল, দত্ত, দেখ তো বদমায়েশটা আমরা যা চাই, তা-ই লিখেছে কি না।
কুমুদ বুঝতে পারল লোকটার পদবি দত্ত।
দত্ত চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পড়ে বলল, হ্যাঁ ঠিকই আছে।
লালাজি বলল, তাহলে চিঠিটা নিয়ে তোমার যা করবার করো। আমি ছেলেটার তদারক করি। যদি শুনি এর বাপ টাকা দিতে অস্বীকার করেছে, কিংবা পুলিশের সাহায্য নেবার চেষ্টা করে, তাহলে ছেলের বাপকে ছেলেটার মুণ্ড পার্সেল করে পাঠাব।
এমন ভঙ্গিতে লালাজি কথাগুলো বলল, শুনেই কুমুদ শিউরে উঠল।
একটু পরেই দত্ত আর লালাজি বের হয়ে গেল। বাইরের দরজায় তালা দেবার শব্দ কুমুদের কানে এল।
কুমুদের ব্যায়ামপুষ্ট শরীর। তার বয়সি ছেলেদের তুলনায় সে অনেক শক্তিশালী। কিন্তু লালাজির শক্তির কাছে সে যে কিছুই নয় সেটা বুঝতে তার বেশি সময় লাগল না।
অসহ্য একটা যন্ত্রণা সারা দেহে। সে খাটিয়ার ওপর শুয়ে পড়ল।
সম্ভবত এই দত্ত তার বাবার কাছে চিঠিটা নিয়ে যাবে। চিঠিটা পড়েই তার বাবা দত্তর হাতে দশ হাজার টাকা তুলে দেবেন, এমন মনে হয় না।
বাবা কড়া আর বিচক্ষণ লোক। কলকাতা শহরে গণ্যমান্য লোকের সঙ্গে প্রচুর জানাশোনা। পুলিশমহলেও খাতির আছে। দত্তকে কোনওরকমে আটকে ঠিক পুলিশে খবর দেবেন।
সে খবর যখন লালাজির কানে আসবে তখন তার কী অবস্থা হবে ভাবতেই তার সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠল।
যতবার কুমুদ বিপন্মুক্ত হবার চেষ্টা করছে, ততবার সে নতুন বিপদে জড়িয়ে পড়ছে।
তুলসীর কথা মনে পড়ল।
এতদিনে হয়তো নিজের মা-বাবার কাছে ফিরে গেছে। কুমুদ কোথায় রয়েছে সেটা জানা তুলসীর পক্ষে সম্ভব নয়। হয়তো সেই পুরোনো আস্তানায় সে পুলিশ নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেখানে তো কাউকেই পাবে না।
একটু তন্দ্রার মতন এসেছিল, হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে সে উঠে বসল। একটা ছোকরা একটা বাটিতে তরকারি আর একটা থালায় ভাত নিয়ে ঢুকল।
লাল রঙের ভাত। তাও মনে হল আধসেদ্ধ। ভাতের চেহারা দেখে কুমুদের খেতে ইচ্ছা করল না।
কুমুদ বলল, শরীর খারাপ। খাব না।
ছোকরাটাকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি দেখে নিয়ে ভাবতে লাগল, একে মোক্ষম এটা ঘুসি মেরে কাবু করা শক্ত নয়, তারপর যদি ছুটে বেরিয়ে গিয়ে কোনওরকমে স্টেশনে আশ্রয় নিতে পারে, তাহলে বোধহয় এ যাত্রা বেঁচে যেতে পারে।
কী করবে ঠিক করার আগেই দরজায় লালাজির বিরাট দেহ দেখা গেল। সেই সঙ্গে বাজখাঁই গলার স্বর ভেসে এল।
এ রঘুয়া, কী বলছে শয়তানটা?
রঘুয়া পিছনদিকে ফিরে বলল, বলছে তবিয়ত খারাপ। খাবে না।
লালাজি ঘরে ঢুকল। কুমুদের কাছে এসে খিঁচিয়ে উঠল, ওসব বেয়াদবি আমার কাছে চলবে না। নে, খেয়ে নে।
রাগে-অপমানে কুমুদের মুখ লাল হয়ে উঠল। এভাবে কেউ কোনওদিন তার সঙ্গে কথা বলেনি।
একবার ভাবল, যা হবার হবে, সে প্রাণপণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে লোকটার ওপর। কিন্তু কষ্টে সে নিজেকে সংযত করল। এখন এসব করতে গেলে তার ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। নিশ্চয় লালাজি একলা নয়। তার অনেক অনুচর আছে। তারা কুমুদকে ছাড়বে না। তা ছাড়া, লালাজির দৈহিক শক্তির পরিচয় সে আগেই পেয়েছে। কুমুদ মাথা হেঁট করে খেতে আরম্ভ করল।
ভাত শক্ত, তরকারি অসম্ভব ঝাল।
কুমুদের চোখ থেকে টপ টপ করে জলের ফোঁটা পড়তে লাগল।
খাওয়া শেষ হতে রঘুয়া থালাবাটি নিয়ে গেল। একটু পরে ফিরল জলের গ্লাস নিয়ে।
জল খেয়ে কুমুদ ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।
আশ্চর্যের ব্যাপার, দরজা বন্ধ হল না। খোলাই রইল।
কুমুদ পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
টুল খালি। কেউ নেই।
কুমুদ উঁকি দিয়েই পিছিয়ে এল।
দত্ত আসছে, তার কপালে ব্যান্ডেজ।
মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল, ও কুমুদ, তোমার ঘুসির জোর আছে বটে। এখনও আমার মাথাটা ঘুরছে।
কুমুদ কোনও উত্তর দিল না। খাটিয়ায় গিয়ে বসল।
দত্ত এগিয়ে এসে খাটিয়ার এককোণে বসল।
মাথা দুলিয়ে বলল, কলকাতা শহর একটা গোলকধাঁধা। গলি, উপগলি, চোরাগলির শেষ নেই। কী করে হাওড়া স্টেশন থেকে তোমাদের বাড়ি যাব, একবার তার হদিশ দিয়ে দাও তো। হাজার হোক আমরা পাড়াগেঁয়ে লোক।
কুমুদ এবারেও কোনও কথা বলল না। চুপ করে রইল।
দত্ত ঠোঁট টিপে হাসল।
কী, বাবুর গোসা হয়েছে? আরে চুপ করে থাকলে তোমার নিজেরই ক্ষতি। চিঠিটা নিয়ে যাব, টাকাটা হাতে এলেই তোমাকে একেবারে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে ট্রেনে চড়িয়ে দেব। বলে ফেলো, বলে ফেলো।
কুমুদও ভেবে দেখল, চুপ করে লাভ নেই। কথা বলাবার ওষুধ এদের কাছে আছে। তাই সে কত নম্বর বাসে হাওড়া থেকে উঠে কোথায় নামতে হবে সে কথা বুঝিয়ে বলল।
দত্ত একটা কাগজে সব লিখে নিল।