২
গিরিধারীকে তারই লাঠিতে ঘায়েল করেই তুলসী ছুটে দরজার দিকে গেল।
দরজা খোলাই ছিল। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে একবার চারদিক দেখে নিল। না, ধারেকাছে কেউ নেই।
তুলসী তিরবেগে পুকুরের পাড় দিয়ে ছুটতে আরম্ভ করল।
কতবার কাঁটাগাছে দুটো পা ক্ষতবিক্ষত হল। শক্ত বুনোলতায় পা আটকে মাটির ওপর ছিটকে পড়ল।
ধুলো ঝেড়ে উঠে আবার ছুটতে লাগল।
তুলসীর একমাত্র চিন্তা যেমন করে হোক এইসব দুশমনদের নাগালের বাইরে চলে যেতে হবে। একবার যদি ধরা পড়ে তাহলে তুলসীর কী অবস্থা হবে, তা ভাবতেই শিউরে উঠল।
অনেকটা চলার পর তুলসী পাকা রাস্তার ওপর এসে পড়ল।
বুঝতে পারল রাস্তার ওপর দিয়ে দৌড়ানো নিরাপদ হবে না। ওরা হয়তো লরিতে অনুসরণ করার চেষ্টা করবে।
তুলসী রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকল।
বিরাট গাছের সার। তলায় ছোটো ছোটো ঝোপ। নানা রঙের বুনোফুল ফুটে রয়েছে।
কিছুটা এগিয়ে তুলসী দেখল জঙ্গল প্রায় দুর্ভেদ্য। সাপখোপ কিংবা কোনওরকম জন্তুজানোয়ার থাকাও বিচিত্র নয়।
তুলসী ভাবল তার চেয়ে রাস্তায় ফিরে যাওয়াই ভালো।
একটু এগিয়ে তুলসী থেমে গেল।
পিছনে অনেকগুলো পায়ের শব্দ শোনা গেল। কারা যেন কথা বলতে বলতে দৌড়ে আসছে।
একটুও বিলম্ব না করে তুলসী কাছের গাছটায় চড়ে বসল।
উঁচু গাছ। হাতের কাছে কোনও ডালপালাও নেই।
কিন্তু পাড়াগাঁর ছেলে তুলসীর তাল-নারকেল গাছে চড়া খুব অভ্যাস আছে। অবলীলাক্রমে তুলসী প্রায় গাছের আগায় গিয়ে উঠল। বড়ো বড়ো পাতার আড়ালে একেবারে অদৃশ্য হয়ে রইল।
সেখানে বসে বসেই দেখল চারজন লোক, কারো হাতে বর্শা, কারো বল্লম, কারো লাঠি, দৌড়ে চলে গেল।
তুলসী বুঝতে পারল এরা তারই খোঁজে বেরিয়েছে।
জঙ্গলের মধ্যে না ঢুকে পড়ে যদি সে রাস্তা ধরে ছুটত, তাহলে এতক্ষণ তার কী হাল হত বেশ বুঝতে পারল।
একটু একটু করে সন্ধ্যা নামল। পাখিরা বাসায় ফিরতে আরম্ভ করল। এদিক-ওদিক জোনাকির আলো।
ডাল আঁকড়ে চুপচাপ বসে থেকে তুলসী দেখল লোকগুলো ফিরল না। হতে পারে ফেরবার অন্য রাস্তা আছে। কিংবা লোকগুলো অনেকটা পথ চলে গিয়েছে। রাতটা কোথাও কাটিয়ে কাল ভোরে ফিরবে।
তুলসী ঠিক করল গাছ থেকে নামাটা সমীচীন হবে না।
নিজের ধুতির কিছুটা খুলে সে গাছের ডালের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধল। যাতে ঘুমিয়ে পড়লে নীচে না পড়ে যায়।
একটু রাত হতেই জঙ্গল কাঁপিয়ে হা হা হাসির শব্দ উঠল।
তুলসী জেগেই ছিল। সেই বিকট শব্দে তার বুকের রক্ত শুকিয়ে জল হয়ে গেল।
সে প্রথমে মনে করল বুঝি লোকগুলো জঙ্গলে ঢুকে গাছের ওপর তাকে দেখতে পেয়েছে। তাই তাদের এই আনন্দের হাসি।
একটু পরেই তার ভুল ভাঙল। এ হাসি কোনও মানুষের নয়, বন্যজন্তুর।
ঠিক গাছের নীচে দিয়েই জন্তুটা ছুটে গেল। উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে তুলসীর মনে পড়ল। বইতে পড়েছে হায়নার হাসি। কলকাতায় মামার বাড়ি গিয়ে বারকয়েক চিড়িয়াখানায় জন্তুটা দেখেছে। খাঁচার কাছে যাবার উপায় নেই, এমন বিশ্রী গন্ধ।
কয়েকটা শেয়াল চেঁচামেচি ছাড়া রাত্রে আর কোনও উপদ্রব হল না।
একটু একটু করে অন্ধকার কেটে গেল। ঘন গাছপালার জন্য জঙ্গলের ভিতর রোদ আসা দুষ্কর।
পাখিদের কিচিরমিচির আরম্ভ হল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তুলসী গাছ থেকে নেমে পড়ল।
প্রায় সারারাত লরি চলেছে রাস্তা দিয়ে। লরির হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো অনেকবার তুলসীর মুখে এসে পড়েছে।
তুলসী প্রথমে ভেবেছিল লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে থানায় চলে যাবে। সেখান থেকে পুলিশ সঙ্গে করে কুমুমামাকে বাঁচাবে আর চোরাই মূর্তিগুলো উদ্ধার করবে। তারপর ভাবল বিদেশে পুলিশের খোঁজ করতে যাওয়ার বিপদ অনেক। যাকে জিজ্ঞাসা করবে সে এই দুশমনদের লোক কি না কে জানে। আবার হয়তো তুলসীকে ফাঁদে ফেলবে।
তার চেয়ে একটা লরি দাঁড় করিয়ে বাংলার দিকে চলে যাবে। লরি যদি কলকাতায় যায় তাহলে দিদিমা আর দাদুকে সব ব্যাপারটা জানাবে।
আর যদি লরি কলকাতা পর্যন্ত না যায়, তাহলে শক্তিগড়ে তুলসী নেমে পড়ে রতনগড়ে ফিরে যাব। বাবাকে সব কথা খুলে বলবে। পুলিশমহলে বাবারও যথেষ্ট জানাশোনা। কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।
গাছের ছোটো একটা ডাল ভেঙে নিয়ে তুলসী রাস্তার ধারে দাঁড়াল।
দু-একটা কাঠুরে হাতে কুড়ুল নিয়ে চলেছে। দু-একজনের মাথায় ঝুড়ি, বোধহয় হাটে যাচ্ছে।
দূরে একটা লরির শব্দ হতেই তুলসী এগিয়ে গেল।
বাঁকের মুখে লরিটা দেখা যেতেই তুলসী গাছের ডাল নাড়তে লাগল।
নক্ষত্রবেগে লরিটা পার হয়ে গেল। থামল না।
একটা লোক কাঁধে বোঝা নিয়ে ছুটছিল, তাকে তুলসী জিজ্ঞাসা করল, এ জায়গার নাম কী?
লোকটা বোধহয় বাংলা বুঝতে পারল না। একবার ঘাড় ফিরিয়ে তুলসীর দিকে দেখেই আবার সোজা চলতে আরম্ভ করল।
তুলসী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
বেশ কিছুক্ষণ পর আবার লরির আওয়াজ শোনা গেল।
এবার তুলসী মরিয়া হয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাছের ডালটা নাড়তে লাগল।
লরিটা একটানা হর্ন দিতে দিতে এসে তুলসীর খুব কাছে ঘচাং করে থামল।
ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে তুলসীকে গালাগাল দিল।
তুলসী ভ্রূক্ষেপ না করে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
কোথায় যাবে লরি?
ড্রাইভার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, বর্ধমান।
তুলসী করুণকণ্ঠে বলল, আমাকে বর্ধমান নিয়ে যাবে?
তোমাকে? কে তুমি? এখানে এলে কী করে?
এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে তুলসী মুশকিলে পড়ে গেল।
সে শুধু বলল, আমাকে গুন্ডারা ধরে নিয়ে এসেছিল। আমি বহু কষ্টে তাদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছি।
এবার ড্রাইভার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল।
তুমি অতদূর বর্ধমান যাবে কেন? সামনেই থানা আছে, সেখানে নেমে নালিশ করো না। পুলিশের তাহলে গুন্ডাদের ধরবার সুবিধা হবে।
তুলসী বলল, আমার বাড়ি শক্তিগড়ের কাছে। বাড়ির লোক আমার জন্য খুব চিন্তিত রয়েছে। আগে একবার বাড়ি যাব, তারপর সেখান থেকে পুলিশে খবর দেব।
উঠে এসো।
তুলসী উঠে ড্রাইভারের পাশে বসল।
লরি ছুটল।
সারারাত তুলসী একটু ঘুমায়নি। শরীর ভীষণ ক্লান্ত বোধ হচ্ছে।
তা ছাড়া প্রচণ্ড খিদেয় পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছে।
একবার ভাবল, ড্রাইভারকে খিদের কথা বলবে, কিন্তু লজ্জায় পারল না।
হেলান দিয়ে চোখ বুজল।
তুলসী ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ প্রবল ঝাঁকুনিতে চমকে উঠে বসল।
লরি থেমেছে। রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকান। সামনে আরও তিন-চারটে লরি দাঁড়িয়ে আছে। চায়ের দোকানের সামনে অনেকগুলো খাটিয়া পাতা। সেই খাটিয়াগুলোর ওপর কিছু লোক বসে আছে। হাতে মগ। তাতে চা।
ড্রাইভার তুলসীকে ডাকল, নেমে এসো খোকা।
তুলসী নেমে ড্রাইভারের পাশে একটা খাটিয়ায় বসল।
এক মগ চা আর একটা বড়ো সাইজের পাঁউরুটির টুকরো।
তুলসী কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চা-পাঁউরুটি শেষ করল।
ড্রাইভার তুলসীর দ্রুত খাওয়া লক্ষ করে জিজ্ঞাসা করল, আর চা-পাঁউরুটি খাবে?
তুলসী ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ, খাবে।
আর-এক মগ চা আর পাঁউরুটির টুকরো তুলসীকে দেওয়া হল।
ড্রাইভার প্রশ্ন করল, গুন্ডারা তোমাকে কিছু খেতে দেয়নি, না?
তুলসী উত্তর দিল, না।
তোমাকে কেন ধরেছিল?
কী করে জানব?
আমি জানি। তোমাকে আটকে রেখে তোমার গার্জেনকে চিঠি লিখতে বলত। পাঁচ-দশ হাজার টাকা না দিলে তোমাকে খতম করে ফেলত। তুমি খুব বাহাদুর ছেলে, তাই তাদের হাত থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছ।
তুলসী কোনও উত্তর দিল না।
একসময়ে দুজনে লরিতে গিয়ে উঠল।
এবার আর লরি বিদ্যুদগতিতে ছুটতে পারল না। সকাল হয়েছে। পথেঘাটে লোক চলাচল বাড়ছে।
প্রাইভেট মোটর, গোরুর গাড়ির ভিড়ও মন্দ নয়।
শক্তিগড় যখন পৌঁছুল, তখন সন্ধ্যা হয়েছে।
বেলা দুটোর সময়ে দুজন ভাত-তরকারি খেয়ে নিয়েছিল।
ড্রাইভার বলল, তুমি আর মিছামিছি কেন বর্ধমান যাবে। শক্তিগড়ের কাছে যখন তোমার বাড়ি, তখন এখানেই নেমে যাও। আমার কথা মনে থাকবে তো?
নিশ্চয় থাকবে। তোমার কথা কোনওদিন ভুলব না। তোমার নাম কী ভাই?
লরি চালু করে ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে বলল, প্রীতম সিং। চলি ভাই।
প্রচুর ধোঁয়া ছেড়ে লরি পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল।
তুলসী বাড়ি ঢুকতে বাড়িতে হইচই শুরু হয় গেল।
তার মা প্রায় অনাহারে ছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবল কান্না।
বাবা ইতিমধ্যেই থানায় খবর দিয়েছিল। পুলিশ নানা জায়গা খুঁজে হয়রান।
তাদের ধারণা মামা-ভাগনে কোথাও পালিয়েছে। কেউ তাদের ধরে নিয়ে যায়নি।
তুলসীকে দেখেই তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।
কোথায় গিয়েছিলি তোরা? কুমুদ কই!
তুলসী ধীরে ধীরে সব কাহিনি বলল।
কুমুদের খবর জানে না শুনে তার মা বুক চাপড়াতে লাগল।
কী সর্বনাশের কথা! আমি মা-বাবার কাছে কী করে মুখ দেখাব!
তুলসীর বাবা থানায় গিয়েছিল। পুলিশ কোনও খবর পেয়েছে কি না জানতে।
ফিরে তুলসীকে দেখতে পেয়ে যেমন খুশি হল, আবার কুমুদের কোনও খোঁজ নেই জেনে তেমনই চিন্তিত হয়ে পড়ল।
এ পর্যন্ত কুমুদের মা-বাবাকে কোনও খবর দেওয়া হয়নি।
মূর্তি চুরির ব্যাপারটা তুলসীর বাবা খুব মন দিয়ে শুনল।
এর মধ্যে মন্দিরের দিকে তুলসীর বাবা যায়নি। যাওয়া প্রয়োজন মনে করেনি, কাজেই জোড়া বিগ্রহ যে মন্দিরের মধ্যে নেই, তা জানতেই পারেনি।
তুলসীকে নিয়ে তার বাবা আবার থানায় গেল।
দারোগা মনোযোগ দিয়ে সব শুনল, মন্দিরে এসে সব দেখল, তারপর তুলসীর বাবাকে বলল, আপনি এক কাজ করুন। লালবাজারে গিয়ে সবকিছু জানান। আমাদের দেশে মূর্তি চুরির হিড়িক পড়ে গেছে। চোরাই মূর্তি বিদেশে চালান যাচ্ছে। এসব কেসের জন্য আলাদা একটা বিভাগ হয়েছে।
তুলসীকে নিয়ে তার বাবা বিকালের ট্রেনে রওনা হয়ে গেল।
প্রথমে কুমুদের বাড়ি গেল। তখনও কুমুদের বাবা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেননি। মা ছিলেন।
তুলসীর কাছে সব শুনে কুমুদের মা একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন।
অনেক বুঝিয়েও তাঁকে শান্ত করা গেল না।
কুমুদের বাবা বাড়ি ফিরে জামাইয়ের কাছে সব শুনে বিচলিত হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। শুধু বললেন, কুমুদ আর তুলসীর ওভাবে লরিতে উঠে বসাটা ঠিক হয়নি। মূর্তি চোরদের ধারণা হতে পারে ছেলে দুটো পুলিশের চর। ধরবার জন্য ওদের পিছু নিয়েছে। যা-ই হোক, চলো লালবাজারে সবকিছু জানিয়ে আসি। বাড়িতে বসে কপাল চাপড়ালে কোনও সুরাহা হবে না।
সহকারী কমিশনার অতুল বসুর সঙ্গে আগে থেকেই কুমুদের বাবার পরিচয় ছিল। তিনি মন দিয়ে শুনলেন, তারপর আলমারি খুলে একটা অ্যালবাম বের করে তুলসীর সামনে রেখে বললেন, দেখো তো, এই ফোটোগুলোর মধ্যে চিনতে পারো কি না। এসব হচ্ছে নামকরা মূর্তি চোরদের ফোটো।
তুলসী নিবিষ্টমনে একটার পর একটা ফোটো দেখে গেল। নানা জাতের লোক রয়েছে। শুধু পুরুষ নয়, কিছু মেয়েও।
কিন্তু যাদের দেখেছে তাদের কারো ফোটো আছে বলে মনে হল না।
সেই কথাই সে সহকারী কমিশনারকে বলল।
তিনি একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, মূর্তি চুরির ব্যাপারে ছোটোখাটো অনেক দল আছে। সকলের খোঁজ পাওয়া পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। ঠিক আছে, আপনার নাতিকে নিয়ে আমরা একবার ওই আস্তানাটা দেখে আসব। এ বিষয়ে বিহারের পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করব। তবে সে আস্তানায় কাউকে পাব বলে মনে হয় না। আর আপনার ছেলের গোটাকয়েক ফোটো আমাদের দিয়ে যাবেন। দেখি কতদূর কী করতে পারি।
দিন দুয়েক পরেই পুলিশ রওনা হল। সঙ্গে তুলসী আর তার বাবা।
সহকারী কমিশনার ঠিকই অনুমান করেছিলেন। গুদামঘর খালি। একটি লোকও নেই।
বিহারের পুলিশও সঙ্গে ছিল। তারা বলল, চিড়িয়া পালিয়েছে।
ধারেকাছে কোনও বসতি নেই যে পুলিশ কিছু জিজ্ঞাসা করবে। চারপাশে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। দিনের বেলাতেই অন্ধকার।
উঠানের ওপর লরির চাকার দাগ।
বিহারের পুলিশ বলল, আমরা জিপ নিয়ে একটু দেখি চাকার দাগ কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে।
তুলসী, তার বাবা আর কলকাতার দুজন পুলিশ বসে রইল।
তুলসী তার বাবাকে দেখাল, যে ঘরটায় তাকে আটকে রাখা হয়েছিল।
তুলসীর বাবা বলল, তাহলে পাশের গুদামঘরে হয়তো কুমুদকে বন্দি করে রেখেছিল। তাকে কি দুর্বৃত্তরা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে, না মেরেই ফেলল?
মেরে ফেললে, তার দেহ তো এখানে পাওয়া যেত।
কিংবা এমন হতে পারে, সঙ্গে নিয়ে গেছে, পথে মেরে ফেলে দেবে।
সেই সম্ভাবনার কথা ভেবে তুলসীর বাবা শিউরে উঠল।
পুলিশ দুজন ঘুরে ঘুরে হাতের কিংবা পায়ের ছাপের সন্ধান করতে লাগল।
উঠানে অনেকগুলো পায়ের ছাপ। একটার সঙ্গে আর-একটা মিশে গিয়েছে।
দরজায় হাতের ছাপ কয়েকটা পাওয়া গেল।
তুলসীর মনে হল, কুমুমামার কিছু হয়নি। নিশ্চয় সে পালিয়ে ওই ঘন জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করে আছে।
একটা গুদামঘরে প্রচুর খড় আর কাঠের ছোটো-বড়ো বাক্স পাওয়া গেল। বোঝা গেল মূর্তিগুলো এর ভিতর প্যাক করে বাইরে পাঠানো হত।
পুলিশের একজন ইনস্পেকটর তুলসীর বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, শুনলাম, মূর্তি নিয়ে আপনি কিছু পড়াশোনা করেছেন, এ মূর্তি দুটো সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা?
তুলসীর বাবা বলল, এই মন্দিরকে সবাই ধর্মরাজের মন্দির বলত। কেন বলত জানি না। দুটো মূর্তিই কবন্ধ। মাথা নেই। সম্ভবত কোনও অত্যাচারী শাসকদের রাজত্বকালে মূর্তি দুটো এভাবে নষ্ট করা হয়েছিল।
আচ্ছা, মূর্তি দুটো থেকে নাকি জ্যোতি বের হত?
জ্যোতি ঠিক নয়। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করত। যেমন জোনাকির শরীর থেকে আলো বের হয়।
হঠাৎ তুলসীর বাবা থেমে গেল।
পুলিশ দুজনও চমকে মুখ ফেরাল।
জঙ্গলের মধ্যে ঝপাঝপ শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কাঠুরেরা কাঠ কাটছে।
ইনস্পেকটর আর পুলিশ ছুটে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকল।
কাঠুরেরা রোজ যদি এখানে কাঠ কাটতে আসে, তাহলে এখানকার বাসিন্দাদের বিষয়ে কিছু জানতেও পারে।
দুজন কাঠুরে। দুজনের হাতে দুটো কুড়ুল।
তারা পুলিশ দেখেই হাতজোড় করল।
দোহাই হুজুর, এবারকার মতন আমাদের মাপ করুন। আমরা আর কোনওদিন এ জঙ্গলে আসব না।
এটা সংরক্ষিত বন নয়। এখানে গাছ কাটা অপরাধ নয়।
সে কথা ইনস্পেকটর এদের কিছু বলল না।
গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক আছে, যদি একটা খবর দিতে পারো তাহলে তোমাদের পাকড়াও করব না।
বলুন হুজুর।
এ জঙ্গলে তোমরা আগে এসেছ?
মাঝে মাঝে এসেছি হুজুর।
তাহলে ওই গুদামঘরের ওখানে কারা থাকত, জানো?
না, হুজুর, তবে অনেক লোককে লরি করে যাওয়া-আসা করতে দেখেছি।
তাদের সঙ্গে তোমাদের কথাবার্তা কখনো হয়েছিল?
না, আমরা কাঠ কেটে সন্ধ্যা হবার আগে এখান থেকে সরে পড়ি।
এদিকে তুলসী আর তার বাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত পুলিশরা না ফিরে আসাতে তুলসীর বাবা তুলসীকে বলল, তোর যাবার দরকার নেই, তুই এখানে দাঁড়া। আমি একবার জঙ্গলে ঢুকে দেখি পুলিশদের এত দেরি হচ্ছে কেন।
তুলসীর বাবা জঙ্গলের দিকে চলে গেল।
জঙ্গলে ঢোকবার তুলসীর একেবারেই ইচ্ছা ছিল না। বাবার ওই ঘন জঙ্গলের মধ্যে যাওয়াটাও তার মোটেই ভালো লাগল না।
সে চুপচাপ হিজল গাছের পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
কুমুমামার জন্য তার মন খুব খারাপ হয়েছে। সব ব্যাপারটার জন্য তার নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। এভাবে পদ্মদিঘিতে যাবার ব্যবস্থা না করলে এ দুর্ঘটনা হতই না।
হঠাৎ দুটো সবল বাহু পিছন থেকে তুলসীর মুখ চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে একটা রুমাল তার নাকের ওপর দিয়ে দিল।
কীরকম একটা গন্ধ। ধীরে ধীরে তুলসীর সারা দেহ অবশ হয়ে গেল। এইটুকু সে বুঝতে পারল, অসীম বলশালী একটা লোক তাকে কাঁধে তুলে নিয়েছে।
একটু পরে পুলিশরা ফিরে এল। তুলসীর বাবাও।
ইনস্পেকটর বলল, চলুন, এখানে অপেক্ষা করে আর লাভ নেই। আমার মনে হয়, বদমাইশগুলো মালপত্র নিয়ে পালিয়েছে।
তুলসীর বাবা চেঁচিয়ে তুলসীকে ডাকল, তুলসী, তুলসী।
কোনও সাড়া নেই।
তুলসীর বাবা ভাবল, সম্ভবত তুলসী ধারেকাছে কোথাও গেছে।
এদিক-ওদিক খুঁজেও তুলসীকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল।
ইনস্পেকটরের দিকে ফিরে বলল, তা-ই তো, ছেলেটা গেল কোথায়? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবার কথা।
ইনস্পেকটর বলল, যাবে আর কোথায়। এদিক-ওদিক গেছে নিশ্চয়। দাঁড়ান, আমি একজন পুলিশকে খুঁজতে পাঠাচ্ছি।
আধ ঘণ্টা ধরে আশপাশের জঙ্গল খুঁজেও তুলসীর সন্ধান মিলল না।
ইনস্পেকটর অবাক!
তা-ই তো, ছেলেটা চোখের সামনে থেকে ভোজবাজির মতন উড়ে গেল নাকি! আপনি ছেলেকে একলা ছেড়েই বা আমাদের কাছে জঙ্গলে ঢুকতে গেলেন কেন?
তুলসীর বাবা এ কথার কোনও উত্তর দিল না। তার মনের অবস্থা বর্ণনা করার মতন নয়। এত কষ্টে ছেলেকে ফিরে পেল, আবার সেই ছেলে হারিয়ে গেল এমনভাবে!
ইনস্পেকটর, তুলসীর বাবা আর পুলিশ এদিকে জঙ্গলে ঢুকল।
এপাশে শরবন। মানুষ-সমান উঁচু। মোটা মোটা বিরাট আকারের গাছ। দিনের বেলাতেই ঝিঁঝি ডাকছে।
বেশ কিছুটা ভিতরে গিয়ে ইনস্পেকটর দাঁড়িয়ে পড়ল।
তুলসীর বাবার দিকে ফিরে আঙুল দেখিয়ে বলল, এই দেখুন।
তুলসীর বাবা দেখল।
এখান থেকে শর গাছগুলো মাটির ওপর শুয়ে পড়েছে। বুঝলেন কিছু?
তুলসীর বাবা বললেন, এখান দিয়ে একটা গাড়ি গেছে।
ঠিক। মনে হয় কোনওরকমে আপনার ছেলেকে ধরে নিয়ে কেউ গাড়ি করে এখান দিয়ে গিয়েছে।
তুলসীর বাবা অবাক!
কিন্তু তুলসীকে এভাবে নিয়ে গেল, সে একটু চেঁচামেচিও করল না?
ইনস্পেকটর বলল, হয়তো চেঁচাবার সুযোগ সে পায়নি। তার মুখ চেপে ধরে তুলে নিয়ে গেছে।
এখন উপায়?
ইনস্পেকটর তুলসীর বাবার প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে পাশে দাঁড়ানো একজন পুলিশকে নির্দেশ দিল, যাও আমাদের জিপটা নিয়ে এসো।
জিপ আসতে সবাই উঠে বসল।
খুব দ্রুত চলা সম্ভব নয়। উঁচু-নিচু জমি। জিপ আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল।
অনেকটা যাবার পর জঙ্গল শেষ হল। পায়ে চলা আঁকাবাঁকা পথ। তার ওপর স্পষ্ট টায়ারের দাগ দেখা গেল।
এবার জিপ একটু দ্রুতগতিতে ছুটল।
দূরে নীলচে পাহাড়। আশপাশে বসতির চিহ্ন নেই। মাঝে মাঝে কাঁটাঝোপ, কালো কালো পাথরের স্তূপ।
জিপের মধ্যে কেউ কোনও কথা বলছে না।
তুলসীর বাবার কথা বলবার শক্তি নেই। তার মনের মধ্যে ঝড় বয়ে চলেছে। বাড়িতে গিয়ে কী বলবে। কুমুদের সন্ধানে এসে এত কষ্টে ফিরে-পাওয়া ছেলেকে আবার হারাতে হল!
ইনস্পেকটর হাত তুলে শুধু সামনের দিকে দেখাল।
বেশ কয়েক গজ আগে একটা বিরাট কালো পাথরের আড়ালে একটা মোটরের পিছনদিকের কিছুটা দেখা যাচ্ছে।
হালকা নীল রঙের মোটর। দেখে মনে হচ্ছে, পিছনে কে একজন বসে রয়েছে। হালদে রঙের শার্ট পরনে।
তুলসীর বাবা সব ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, ইনস্পেকটর, ওই তো আমার তুলসী রয়েছে গাড়িতে। যেমন করে পারুন, ওকে উদ্ধার করুন।
ইনস্পেকটর ভুরু কুঁচকে বলল, আঃ, চেঁচাবেন না। মোটরটা ওভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন বুঝতে পারছি না।
কথা শেষ করেই কোমর থেকে ইনস্পেকটর রিভলভার বের করে জিপ থেকে নেমে পড়ল, তারপর দু-এক পা এগিয়ে সামনের মোটর লক্ষ করে ট্রিগার টিপল।
গুড়ুম করে শব্দ।
গাছের ডালে বসা কয়েকটা পাখি চিৎকার করে আকাশে উড়ে গেল।
গুলি সামনের মোটরের পিছনের একটা টায়ারে গিয়ে লাগল।
আবার একটা শব্দ। টায়ার ফেটে হাওয়া বের হয়ে গেল।
মোটর কেঁপে উঠে একদিকে সামান্য কাত হয়ে গেল।
ইনস্পেকটর পুলিশের দিকে ফিরে বলল, আমার পিছন পিছন এসো।
তারা বন্দুক তুলে ধরে ইনস্পেকটরকে অনুসরণ করল।
তুলসীর বাবা চুপচাপ জিপে বসে রইল।
তার ধারণা হল পুলিশরা মোটরের কাছাকাছি গেলেই মোটর থেকে গুলিবৃষ্টি শুরু হবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হল না।
ইনস্পেকটর মোটরের পাশে গিয়ে উঁকি দিয়ে কী দেখল, তারপর হাত নেড়ে তুলসীর বাবাকে ডাকল।
তুলসীর বাবা জিপ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মোটরের দিকে গেল।
ইনস্পেকটর পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে নিয়ে বলল, শয়তানরা আমাদের আচ্ছা ঠকিয়েছে মশাই, এই দেখুন।
তুলসীর বাবা মোটরের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দেখল তুলসীর শার্টটা একটা কঞ্চির মধ্যে ঢুকিয়ে পিছনের সিটে বসিয়ে রাখা হয়েছে। একটু দূর থেকে মনে হয়, তুলসীই বসে আছে।
স্টিয়ারিংয়ের হাতলে একটা কাগজ আটকানো। তাতে হিন্দিতে এক লাইন লেখা।
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধু পুলিশ।
রাগে ইনস্পেকটরের মুখটা থমথম করতে লাগল।
দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শয়তানদের একবার ধরতে পারলে উচিত শিক্ষা দেব।
মোটরের সিট তুলে পিছনের ডালা খুলে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। কোথাও কিছু পাওয়া গেল না।
দুজন পুলিশ ঠেলে মোটরটা রাস্তার ওপর দাঁড় করাল।
ইনস্পেকটরের চালকের সামনে বসে চালাবার অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু সফল হল না।
ইনস্পেকটরের সন্দেহ হতে মোটর থেকে নেমে বনেট খুলেই মাথায় হাত দিয়ে বসল।
ইঞ্জিনটা ঘা মেরে অকেজো করে রেখে গেছে।
তাহলে এখান থেকে শয়তানগুলো গেল কোথায়!
চারপাশে একটু মাটি নেই, কেবল কালো কালো পাথরের স্তূপ। পাথরের ওপর পায়ের ছাপ পড়া সম্ভব নয়।
ইনস্পেকটরের পাথরের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলল। পিছনে আর সবাই।
তুলসীর বাবাও চলতে শুরু করল বটে, কিন্তু সে ভীষণ অন্যমনস্ক।
তার একমাত্র চিন্তা বাড়ি ফিরে সবাইকে কী বলবে।
তুলসীকে পেয়েও হারাল, এর জন্য তার নির্বুদ্ধিতাকেই সবাই দায়ী করবে। সে যদি তুলসীকে ছেড়ে না যেত, তাহলে এমন সর্বনাশ হত না।
একসময়ে পথ শেষ হল। পথ ঠিক নয়, পর পর কালো পাথরের স্তূপ।
তারপরই বিরাট এক নদী।
ওপার দেখা যায় না। গেরুয়া রঙের জল। দু-একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে।
ইনস্পেকটর তুলসীর বাবার দিকে ফিরে বলল। এখান দিয়ে আপনার ছেলেকে পাচার করেছে। বোধহয় ঘাটে ওদের নৌকা বাঁধা ছিল।
তুলসীর বাবা কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
ইনস্পেকটর বলল, চলুন ফিরে যাই। ওই মোটরটা নিয়ে থানায় গেলেই কার মোটর সে সম্বন্ধে পাত্তা পাওয়া যাবে।
সবাই ফিরে এল।
জিপের মধ্যে দড়ি ছিল, তা-ই দিয়ে জিপের সঙ্গে মোটরটা বাঁধা হল। একজন পুলিশ মোটরের স্টিয়ারিং ধরে বসল।
থানায় পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা লেগে গেল।
ও অঞ্চলের বেশ বড়ো থানা।
বড়ো দারোগা মন দিয়ে সব শুনল, তারপর বলল, এদিকে মূর্তি চোরের কথা তো বিশেষ শুনিনি। এমনিই চোর-ডাকাত আছে। মাঝে মাঝে ডাকাতির সঙ্গে মানুষ খুনের খবরও আসে।
ইনস্পেকটর বলল, এ মোটরটা কার নামে আছে, তার নাম-ঠিকানার খোঁজ করে দেখুন তো। আমরা তার আস্তানায় হানা দিই।
বড়ো দারোগা একটা কাগজে নম্বরটা লিখে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি ফোন করে দেখছি।
ইনস্পেকটর, পুলিশ আর তুলসীর বাবাকে নিয়ে এক হোটেলে গেল। সকাল থেকে খাওয়া নেই। শরীর খুব দুর্বল লাগছে।
তুলসীর বাবা খাবারের থালার সামনে নামমাত্র বসল। বিশেষ কিছুই মুখে তুলতে পারল না।
তুলসীর কথা মনে পড়তে লাগল। ছেলেটা যখন আবার শয়তানদের পাল্লায় পড়েছে, তখন তাকে সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না।
কে জানে হয়তো মেরেই ফেলবে, কারণ আগের বার পালাবার সময় তুলসী একজনকে ঘায়েল করেছিল।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই আবার থানায় ফিরে এল।
বড়ো দারোগা নেই। খেতে গেছে। একটু পরেই এসে হাজির হল।
কী, মোটরের মালিকের নাম-ঠিকানা পেলেন?
বড়ো দারোগা গম্ভীর মুখে বলল, লোকগুলো অত্যন্ত পাজি।
ইনস্পেকটর বলল, নামটা বলুন, লিখে নিই।
নামটা নিয়ে কী করবেন? মোটরে ঝুটা নম্বর লাগিয়েছে।
ঝুটা নম্বর?
হ্যাঁ, ও নম্বর এস. ডি. ও. সায়েবের মোটরের।
সবাই চুপ।
তুলসীর বাবা বুঝতে পারল, বেশ বুদ্ধিমান দলের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। এরা সাধারণ দল নয়।
আর কিছু করার নেই। সবাই ফিরে যাওয়াই ঠিক করল।
সারাটা পথ কেউ কোনও কথা বলল না।
তুলসীর বাবা বাড়ি ফিরে দেখল, কুমুদের বাবা অপেক্ষা করছেন।
তুলসীর বাবাকে একলা আসতে দেখে কুমুদের বাবা ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তুলসী কই?
তুলসীর বাবা মাথা নিচু করে বলল, ভিতরে চলুন, সব বলছি।
সব শুনে কুমুদের বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন।
একটু পরে বললেন, আমি তো ব্যাপারটা ভালো বুঝছি না। কুমুদ আর তুলসীকে জীবন্ত ফিরে পাব, এমন ভরসা খুবই কম।
খবর শুনে তুলসীর মা কাঁদতে শুরু করেছিল। কুমুদের বাবা মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, কেঁদে আর কী হবে। যাহোক একটা ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।
তারপর জামাইয়ের দিকে ফিরে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে কলকাতায় চলো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
ট্রেনেই তিনি কথাটা বললেন, তুমি পারিজাত বক্সীর নাম শুনেছ?
বিখ্যাত গোয়েন্দা?
হ্যাঁ, আমি ভাবছি, তাঁর কাছে একবার যাব। পুলিশ যেমন তল্লাশি চালাচ্ছে, চালাক। পারিজাত বক্সী যদি কেসটা হাতে নেন, বেঁচে যাই।
কিন্তু উনি তো শুনেছি খুব ব্যস্ত লোক।
ব্যস্ত তো বটেই, তবে ওঁর স্ত্রী-র আমি একবার চিকিৎসা করেছিলাম। খুব সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিলাম। সেই সময় পারিজাতবাবু বলেছিলেন, যদি কখনো আমাকে আপনার কোনও প্রয়োজন হয় জানাবেন।
বেশ তো তা-ই করুন। যা করবেন, একটু তাড়াতাড়ি করাই ভালো। দেরি হলে কী সর্বনাশ হয়ে যাবে, আমি ভাবতেই পারছি না।
কুমুদের বাবা বললেন, বাড়ি পৌঁছেই পারিজাতবাবুকে ফোন করব। যদি তাঁর অসুবিধা না থাকে তাহলে আজ বিকালেই তাঁর সঙ্গে দেখা করব। আমিও এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে একমত, দেরি করলে ক্ষতিই হবে।
সন্ধ্যা সাতটায় পারিজাত বক্সীর সঙ্গে দেখা করার কথা। কুমুদের বাবা জামাইকে সঙ্গে নিয়ে ছ-টার মধ্যেই তাঁর বাড়ি হাজির।
চাকর তাদের বাইরের ঘরে বসিয়ে বলল, একটু অপেক্ষা করুন, বাবু ঠিক সময়ে আসবেন।
ছোটো সাজানো বসবার ঘর। দেয়ালে অনেকগুলো ছবি। সবই প্রাকৃতিক দৃশ্যের। একটি ফোটো পারিজাত বক্সীর। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। তীক্ষ্ন দুটি চোখ।
তুলসীর বাবা টেবিলের ওপর রাখা একটা পত্রিকা নিয়ে পাতা ওলটাচ্ছিল। কুমুদের বাবা চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন।
দুজনেরই মনের অবস্থা দারুণ খারাপ। এক-এক মুহূর্তের দাম অনেক বেশি।
ঘড়িতে সাড়ে ছ-টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে পরদা ঠেলে একটা লোক ঘরের মধ্যে ঢুকল।
পরনে দামি সিল্কের লুঙ্গি, গায়ে কাজ করা ফিনফিনে পাঞ্জাবি, গলায় রঙিন রুমাল বাঁধা। অল্প দাড়ি রামছাগলের মতন। পানের রসে ঠোঁট রাঙা।
লোকটা ঢুকেই কুমুদের বাবার দিকে ফিরে বলল, সেলাম ওয়ালেকুম ডাক্তার সায়েব। আপনি সময়ের একটু আগেই এসে গেছেন।
কুমুদের বাবা তো অবাক। কে এই লোকটা? তাঁর এখানে আসবার কথা জানলই বা কী করে?
একটু বসুন, আমি আসছি। লোকটা ভিতরের দিকে চলে গেল।
তুলসীর বাবা প্রশ্ন করল, কে লোকটা?
কুমুদের বাবাও সেই কথাই চিন্তা করছিলেন। হঠাৎ তাঁর কী মনে হতে তিনি বললেন, ইনি পারিজাত বক্সী নন তো? শুনেছি পারিজাতবাবু অদ্ভুত ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারেন। তাঁর আত্মীয়স্বজনই তাঁকে চিনতে পারে না।
ঠিক সাতটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে পারিজাত বক্সী ঘরে ঢুকলেন। পরনে পাঞ্জাবি- পাজামা।
একটা কৌচে বসে বললেন, কী হয়েছে বলুন ডাক্তার সায়েব।
কুমুদের বাবা পারিজাতবাবুর সঙ্গে নিজের জামাইয়ের পরিচয় করে দিয়ে বললেন, বড়ো বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।
সব খুলে বলুন। দেখি কী করতে পারি।
কুমুদের বাবা সবিস্তারে সব বললেন।
পারিজাতবাবু দু-গালে দুটো হাত রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, যে মূর্তি দুটো চুরি গেছে তার বিশেষত্ব কী?
এবার তুলসীর বাবা বলল, দুটো মূর্তিই মুণ্ডহীন। সেটা সম্ভবত কোনও কালাপাহাড়ের কীর্তি, আর দুটো মূর্তিই কী ধাতুতে তৈরি জানি না, মনে হয় জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
পারিজাতবাবু কিছুক্ষণ কী ভাবলেন, তারপর প্রশ্ন করলেন, যে মন্দিরে মূর্তি দুটো ছিল, সেটা কি কোনও নদীর ধারে?
তুলসীর বাবা মাথা নাড়ল, না নদী নয়। মন্দিরটা পদ্মদিঘির ধারে। বিরাট দিঘি অবশ্য।
পারিজাতবাবু উঠে সামনের আলমারি খুলে কিছুক্ষণ খুঁজলেন, তারপর মোটা একটা বই বের করে পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় থেমে গেলেন। নিবিষ্টচিত্তে কিছু সময় পড়ে নিয়ে বললেন, এখন যেটা পদ্মদিঘি সেটার সঙ্গে একসময়ে সাগরের যোগাযোগ ছিল। পদ্মদিঘি ছিল বিদ্যাপতি নদী। বণিকরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে ওই পথে যাওয়া-আসা করত। কাজেই মূর্তি দুটো তাদের খুব কাজে লাগত।
পারিজাতবাবুর কথাবার্তা কুমুদের বাবা আর তুলসীর বাবা কারোই মোটে ভালো লাগল না।
কোথায় হারানো দুটো ছেলের অনুসন্ধান করার পথ বাতলাবে, তা নয়, দেশের ভৌগোলিক তথ্য নিয়ে ভদ্রলোক মাথা ঘামাচ্ছেন। মূর্তি দুটোর বিশেষত্ব শুনেই বা লাভ কী?
পকেট থেকে মূর্তি দুটোর ফোটো বের করে তুলসীর বাবা পারিজাতবাবুর হাতে দিয়ে বলল, এই দেখুন, মূর্তি দুটোর ফোটো।
সাগ্রহে পারিজাতবাবু হাত বাড়িয়ে ফোটোটা নিয়ে বললেন, ফোটো এনেছেন, অনেক ধন্যবাদ।
তুলসীর বাবা আর থাকতে পারলেন না। বলে ফেলল, ছেলে দুটির ফোটোও এনেছি। দেখবেন না?
পারিজাতবাবু মুখ না তুলেই বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দেখব। এখন আপনার কাছে রাখুন।
ফোটোটা মন দিয়ে দেখে পারিজাতবাবু বললেন, আমার মনে হয় মূর্তি দুটো গ্যালেনা পাথর দিয়ে তৈরি। এ পাথর সিংভূমের জঙ্গলে প্রচুর পাওয়া যায়। অনেকে একে সোনা বলে ভুল করে।
কুমুদের বাবা প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি লোকগুলো সোনার মূর্তি ভেবে ও দুটো চুরি করে নিয়ে গেল?
পারিজাতবাবু হেসে মাথা নাড়লেন, না। এইসব মূর্তি চোরদের জ্ঞান আপনার আমার চেয়ে অনেক বেশি, অন্তত এসব বিষয়ে। তারা মূর্তির জন্যই মূর্তি চুরি করে। এসব মূর্তি বেশির ভাগই আমেরিকা চালান যায়। সেখানকার কোটিপতিরা প্রচুর মূল্য দেয় এসবের জন্য।
তুলসীর বাবা আবার বলে ফেলল, তা তারা যা ইচ্ছা করুক, কিন্তু আমাদের ছেলে দুটোকে এভাবে ধরে নিয়ে গেল কেন?
পারিজাতবাবু ভ্রূ কুঁচকে কী ভাবলেন, তারপর বললেন, সম্ভবত তাদের ধারণা হয়েছে ছেলে দুটি পুলিশের চর। সেইজন্য তারা দুজনে লরিতে উঠেছিল। যাক মূর্তি সম্বন্ধে যা বলছিলাম শুনুন। এসব মূর্তি নদীতে আলোকসংকেতের কাজ করে। জাহাজকে সাবধান করে দেয়। এর জ্যোতি দেখে নাবিকরা বুঝতে পারে তীরভূমি কাছেই। সেখানে অল্প জল, মাঝদরিয়া দিয়ে যাওয়াই মঙ্গল। এরকম মূর্তির খোঁজ বিদেশেও দু-এক জায়গায় পাওয়া গেছে। সেগুলোও গ্যালেনা পাথরের তৈরি।
একটু থেমে পারিজাতবাবু হাত বাড়ালেন, দিন, ছেলেদের ফোটোটা দেখি।
তুলসীর বাবা ফোটোটা তাঁর হাতে তুলে দিল।
একই ফোটোতে পাশাপাশি দুজন দাঁড়িয়ে। কুমুদ আর তুলসী।
একবার চোখ বুলিয়েই পারিজাতবাবু বললেন, এরা তো খুব ছেলেমানুষ দেখছি। আপনারা একটা কাজ করুন।
কী বলুন?
এদের ফোটো দিয়ে খবরের কাগজে ছাপিয়ে দিন, এরা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে পরীক্ষায় ফেল করার জন্য। যে এদের খোঁজ দিতে পারবে তাকে দুশো টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
কুমুদের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, তাতে লাভ কী হবে?
লাভ এই হবে যে, মূর্তি চোরেরা অন্তত এটা বুঝতে পারবে যে এরা পুলিশের চর নয়, নেহাত কৌতূহলবশত লরির ওপর চড়েছিল।
এবার তুলসীর বাবা অশ্রু-জড়ানো গলায় বলল, কিন্তু ছেলে দুটো কি বেঁচে আছে?
উত্তর দেবার আগেই পাশের ঘর থেকে ফোনের ঝংকার শোনা গেল। পারিজাতবাবু উঠে গেলেন।
মিনিট তিন-চার পরে যখন ফিরে এলেন, তখন মুখটা থমথম করছে।
বসতে বসতে বললেন, এইমাত্র মূর্তি চোরের দলের একজন ফোনে আমাকে শাসাল। আমি যদি এ কেসে হাত দিই, তাহলে সাত দিনের মধ্যে আমাকে খতম করে দেবে।