উপন্যাস
গল্প

কবন্ধ বিগ্রহের কাহিনি – ১

পরীক্ষা শেষ। এতদিনের দুশ্চিন্তার অবসান।

পরীক্ষার হল থেকে কুমুদ বাড়ি ফিরল যেন হাওয়ায় ভেসে। কাল থেকে আর রাত থাকতে উঠে বইখাতার ওপর ঝুঁকে পড়তে হবে না। তারপর কোনওরকমে স্নান-খাওয়া সেরে আবার পড়তে বসা। বিকালে ঘণ্টাখানেকের ছুটি। ওই সময়টা কুমুদ পার্কে একটু বেড়িয়ে আসে। সন্ধ্যার একটু পরেই খেয়ে নিয়ে আবার গভীর রাত পর্যন্ত অধ্যয়ন।

বিছানায় শুলেই কি নিস্তার ছিল? চোখের পাতা বন্ধ করলেই প্রশ্নপত্রগুলো ভয়াবহ মূর্তিতে সঙিন খাড়া করে এসে দাঁড়াল। ইংরেজি, ইতিহাস আর জ্যামিতি এই তিনটেতেই কুমুদের একটু ভয় ছিল।

পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কেমন একটা ভীতি কুমুদকে আচ্ছন্ন করে রাখত। কাপড়ে ফুটে-থাকা চোরকাঁটার মুক্তি।

পরীক্ষার ফল বের হতে অনেক দেরি। কবে যে ঠিক বের হবে, এ কথা কেউ বলতে পারে না। এমনকী যাঁরা পরীক্ষা পরিচালনা করছেন, তাঁরাও নয়।

বাড়ি ফিরে কুমুদকে দরজা ঠেলতে হল না। দরজা খোলাই ছিল। কুমুদের ফেরার সময়টা তার মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন। বিশেষ করে পরীক্ষার কদিন। গলির মোড়ে কুমুদকে দেখে নীচে নেমে দরজা খুলে দেন।

আজও কুমুদ ঘরের মধ্যে ঢুকতে মা জিজ্ঞাসা করলেন, কী রে, কেমন হল?

ভালোই।

অন্যদিন কুমুদ এত হাসে না। পরের দিনের পরীক্ষার কথা চিন্তা করে। মা সেটা লক্ষ করেই বললেন, আজ এত হাসি যে?

বাঃ, আজ পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। কাল থেকে কী করি বলো তো মা?

মা-ও হাসলেন, কী আর করবি। এতদিন এত খাটলি, এবার কদিন চেপে ঘুমোবি।

উঁহু, তুমি বলতে পারলে না।

কুমুদ মাথা নাড়ল।

তবে কী করবি?

ছাদ থেকে নীচে লাফাব। বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়োব, হাওড়া ময়দানে যাব সার্কাস দেখতে।

বেশ, তোর যা ইচ্ছে করিস। এখন মুখ-হাত ধুয়ে খাবি আয়। তোর জন্য লুচি আর পায়েস করে রেখেছি।

আর বেশি বলতে হল না। এ দুটি কুমুদের প্রিয় খাদ্য।

কুমুদ লাফাতে লাফাতে নিজের ঘরে ঢুকল।

কুমুদ মা-বাপের একটি ছেলে। তার এক দিদি আছে কুমুদের চেয়ে বয়সে বছর কুড়ি বড়ো। কুমুদ জন্মাবার কিছুদিন পরেই তার দিদির বিয়ে হয়ে যায়।

দিদির ছেলে তুলসীই প্রায় কুমুদের বয়সি।

দিদির বিয়ে হয়েছে রতনগড়ে। পুরোনো প্রতিপত্তিশালী জমিদারের বাড়ি। এখন জমিদারদের আর বিশেষ কিছুই নেই। জমিজমা সবই গেছে।

আসল কথা, টাকার ঝংকার আর নেই, তবে হুংকার আছে।

নিরক্ষর প্রজারা এখনও হাতজোড় করে দাঁড়ায়। কোনও কিছু বললে তখনই হুকুম তামিল করে।

কুমুদ যখন পরীক্ষার এক সপ্তাহের মধ্যেই বিশ্রাম নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তখন রতনগড় থেকে চিঠি এল।

দিদি লিখেছে, কুমুদের তো পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখানে তুলসীরও স্কুলের বাৎসরিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। কুমুদ তো অনায়াসেই দিদির কাছে চলে আসতে পারে।

এই সাতটা দিন কুমুদ ছাদ থেকেও লাফায়নি, বাসের সঙ্গেও দৌড়োয়নি। আর শীতকাল ছাড়া তো হাওড়া ময়দানে সার্কাসের তাঁবু পড়েই না।

কুমুদ শুধু ঘুমিয়ে আর গল্পের বই পড়ে কাটাল।

কিন্তু সময় যেন আর কাটতেই চায় না।

কুমুদের বন্ধুবান্ধবদের সংখ্যা খুব কম। ছেলেবেলা থেকে তার ব্যায়ামের দিকে ঝোঁক। স্কুলে বক্সিং আর জুজুৎসুতে খুব নাম ছিল।

কিন্তু তার বেশির ভাগ সহপাঠীরই এসব ব্যাপারে কোনও আকর্ষণ নেই।

মায়ের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে কুমুদ পড়ে ফেলল।

তারপর বলল, ঠিক আছে। রতনগড়ে চলে যাই। সময়টা ভালোই কাটবে।

তা তো কাটবে, কিন্তু তোমায় যেতে দিতে আমার সাহস হচ্ছে না।

মায়ের মুখের দিকে দেখে কুমুদ প্রশ্ন করল, সাহস হচ্ছে না? কেন মা?

আর কেন? বিনুর বাড়ির দু-পাশে দুটো দিঘি। তুমি তো সেই দিঘি তোলপাড় করবে। জলে আমার ভয়।

জলে আমার কিন্তু কোনও ভয় নেই মা। পৃথিবীর তিন ভাগ যখন জল, তখন জলে মিছামিছি ভয় পেয়ে লাভ কী বলো? তা ছাড়া আমি তো ভালো সাঁতার জানি। রতনগড়ে শিখেছি।

শুধু কি জলের ভয়? দুটো দিঘিতে ঘন পদ্মবন। আর পদ্মবনে যত বিষাক্ত সাপের বাসা।

কুমুদ হেসে উঠল।

কী ব্যাপার বলো তো মা? আমাকে রতনগড়ে না যেতে দেবার মতলব বুঝি? আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, আমি খুব সাবধানে থাকব।

রতনগড়ের দিঘির জলের চেয়েও কুমুদের অন্য আকর্ষণ ছিল অনেক বেশি।

যখন রতনগড়ের জমিদারদের প্রবল প্রতাপ ছিল, তখন একপাল লাঠিয়াল তাঁরা পুষেছিলেন। তারা হুকুম পেলেই প্রজাদের খেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ফসল কেটে আনত, দুর্বিনীত প্রজাদের ঘরে আগুন দিত, আবার নদীর বুকে কোথাও চর জাগলে, লাঠি ঘুরিয়ে সেই চর দখল করত।

এখন এদের এসব কাজ করতে হয় না। এরা নিজেদের মধ্যে লাঠি খেলে। বোধহয় অভ্যাস বজায় রাখবার জন্য।

অন্যবার রতনগড়ে গিয়ে অনেক খোশামোদ করে কুমুদ কয়েকটা প্যাঁচ শিখেছে। সর্দার লাঠিয়াল বলেছে, খোকাবাবু, এখন নয়, আরও বড় হও। তখন সব প্যাঁচ শিখিয়ে দেব।

এখন তো কুমুদ যথেষ্ট বড়ো হয়েছে। পরীক্ষার ফল বের হলেই কলেজে পড়বে। কাজেই প্যাঁচ শেখবার পক্ষে এখন কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়।

চিঠিটা কুমুদের হাত থেকে নিয়ে মা বললেন, তোমার বাবাকে কথাটা বলে দেখি।

কুমুদ খুশি হল। আর ভয় নেই। বাবা ভালো করে কথাটা শোনবার আগেই মত দিয়ে দেবেন। বাবা সর্বদাই অন্যমনস্ক। ব্যস্ত ডাক্তার। কেবল রোগীদের চিন্তা।

কুমুদের মনে আছে, মা একবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী মুশকিল দেখো, শোবার ঘরের জানালাটা কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। বর্ষায় বোধহয় কাঠ ফুলে উঠেছে।

বাবা বসে বসে মেডিক্যাল জার্নাল পড়ছিলেন। মুখ না তুলেই বলেছিলেন, অপারেশন করতে হবে। এ ছাড়া আর উপায় নেই।

মা খুব জোরে হেসে উঠতে বাবার খেয়াল হয়েছিল।

কুমুদ ঠিকই অনুমান করেছিল। মা বাবার কাছে কথাটা পাড়তেই বাবা রাজি হয়ে গেলেন।

বেশ তো, যাক-না। বিনুর ওখান থেকে ক-দিন ঘুরে আসুক। আজকাল তো আর পাড়াগাঁয়ে ম্যালেরিয়া নেই। তা ছাড়া এখন গরমও কমে এসেছে। অন্তত টাটকা ভিটামিন খেয়ে বাঁচবে। শহরে তো পয়সা দিলেও ভালো জিনিস পাবার উপায় নেই।

বাবা সচরাচর এত কথা বলেন না। সেদিন এত কথা বলতে মা বুঝতে পারলেন, বাবার হাতের রোগীদের অবস্থা ভালো। এ যাত্রা বোধহয় কুমুদ বেঁচে গেল।

কুমুদের রতনগড় যাওয়াই ঠিক হল।

মা বিনিকে যাবার তারিখ জানিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে এও জানালেন, কুমুদকে যেন চোখে চোখে রাখা হয়। দিঘির জলে বেশিক্ষণ পড়ে না থাকে, বনেজঙ্গলে না ঘোরে, কোনওরকম অনিয়ম না করে।

মায়ের গোছানো স্যুটকেস নিয়ে কুমুদ একদিন মোটরে উঠে বসল। এর আগেও কুমুদ বারকয়েক একলাই গিয়েছে।

রতনগড়ের পথ তার খুব চেনা।

মোটর চড়ে হাওড়া। সেখান থেকে ট্রেনে শক্তিগড় থেকে বাস। প্রায় আড়াই ঘণ্টা বাসে যাবার পর মদনমোহনতলা। সেখানে দিদির পাঠানো গোরুর গাড়ি মজুত থাকে। দুটো গোরুর শিঙে লাল রং করা, খড়-বিছানো বসবার জায়গা।

টানা এক ঘণ্টা। তারপরই রতনগড়।

রাস্তার পাশেই বিরাট দিঘি। কাকচক্ষু জল। ওপারে পদ্মবন। লাল লাল ফুল ফুটে থাকে। দিঘির পাড়েই জমিদারবাড়ি।

আর-একটা দিঘি খিড়কির দিকে। রাস্তা থেকে দেখা যায় না।

কুমুদ যখন মদনমোহনতলায় নামল, তখন সূর্যের তেজ কমে এসেছে। গাছের ছায়া বেশ দীর্ঘ।

বাস থেকে নামতেই চিৎকার কানে এল—কুমুমামা, এই যে, এদিকে।

কুমুদ চোখ ফিরিয়ে দেখল, একটা দেবদারু গাছের নীচে দাঁড়িয়ে তুলসী চেঁচাচ্ছে।

দিদি অনেকবার বলে দিয়েছে, মামা যখন একটাই, তখন নাম ধরে মামা ডাকবার কোনও দরকার নেই। শুধু মামা বলাই ভালো। কিন্তু তুলসী কথাটা কানে তোলেনি।

তুলসীর চেহারা অনেক বদলে গেছে। শার্টের তলায় তার পেশিপুষ্ট শরীরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মাথায় যেন একটু লম্বাও হয়েছে।

কুমুদ কাছে যেতেই তুলসী নিচু হয়ে পায়ের ধুলো নেবার চেষ্টা করল।

কুমুদ বাধা দিয়ে বলল, আরে, থাক থাক! গাড়ি কোথায়?

তুলসী হাত দিয়ে দেখাল।

একটু দূরে ঢালু জমিতে গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

গাড়োয়ান বোধহয় গোরু দুটোকে খুলে দিয়েছিল। বাস আসতেই সে দুটোকে বাঁধবার চেষ্টা করছে।

কুমুদ খুব পরিশ্রান্ত। সকালে রওনা হয়েছে। এখনও যাত্রার শেষ হয়নি। তুলসী তার হাত থেকে স্যুটকেসটা নিয়েছে।

ক্লান্ত পায়ে কুমুদ গোরুর গাড়ির দিকে এগোল।

গাড়োয়ান তিলকরাম কুমুদের চেনা। প্রত্যেকবার তিলকরামই গাড়ি নিয়ে আসে। বয়স ষাটের কোঠায়। এখনও বেশ শক্তসমর্থ চেহারা।

কুমুদ কাছে আসতেই তিলকরাম তার সামনে ঘাসের ওপর উপুড় হয়ে পড়ল। একেবারে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম।

ভালো আছেন খোকাবাবু? বাড়ির খবর সব ভালো?

এখানে এই এক মুশকিল। সবাই খোকাবাবু বলে ডাকে।

কেবল দিদি আর জামাইবাবু ডাকে—কুমুদ।

গোরুর গাড়ি চলতে শুরু করল।

তুলসী দু-একটা কথা বলেছিল, কিন্তু কুমুদের দিক থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে থেমে গেল।

মাঝে মাঝে শুধু তিলকরামের আওয়াজ শোনা গেল। গোরু দুটোকে ধমকাচ্ছে।

একসময় গোরুর গাড়ি রতনগড়ে পৌঁছাল।

দূর থেকে দেখা গেল দিঘির পাড়ে বিনতা আর তার স্বামী, মানে কুমুদের দিদি আর জামাইবাবু দাঁড়িয়ে আছেন।

কুমুদ নেমে তাঁদের প্রণাম করল।

সেদিন আর বেশি কথা হল না।

তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে কুমুদ শুতে গেল।

দোতলার এই কোণের ঘরেই বরাবর তার শোবার ব্যবস্থা হয়। বেশ বড়ো ঘর। উঁচু খাট। বিরাট আকারের কারুকার্য করা একটা আলমারি।

কুমুদ শোবামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল।

মাঝরাতে তক্ষকের আওয়াজে একবার শুধু তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কুমুদ জানে বাইরের বট গাছের তলায় একজোড়া তক্ষক থাকে।

প্রতিবারই সে এদের ডাক শোনে।

যখন কুমুদের ঘুম ভাঙল, তখন বেলা হয়েছে। জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে রোদ এসে পড়েছে।

বাইরে পাখির ডাক। গোরুর হাম্বারবও শোনা যাচ্ছে।

কুমুদ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল।

দরজার গোড়ায় দিদি দাঁড়িয়ে। কুমুদের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হাসল।

কী, বাবুর ঘুম ভাঙল? তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধুয়ে নাও। বেলা হয়েছে।

কুমুদের খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, নেমে দিঘির জলে মুখ-হাত ধোবে, কিন্তু বাইরে বেরিয়েই দেখল, বারান্দার এককোণে বালতিতে জল। তার পাশে সাবান আর তোয়ালে।

মুখ-হাত ধুয়ে কুমুদ নীচে নেমে এল।

মাঝখানে উঠান। উঠান পার হয়ে রান্নাঘর। তার পাশেই খাওয়ার ঘর। দুটোই সাইজে বিরাট।

কুমুদ দিদির কাছেই শুনেছে, আগে যখন জমিদারি ছিল, তখন খুব ঘটা করে অন্নপূর্ণাপূজা হত। গাঁয়ের লোক ঝেটিয়ে আসত নিমন্ত্রণ খেতে।

ওই রান্নাঘরে রান্না হত, আর উঠানে সবাই খেতে বসত। কেবল যাঁরা একটু কেষ্টবিষ্টু, গাঁয়ের মোড়ল, থানার দারোগা, ডাক্তার—তাঁরা বসতেন খাওয়ার ঘরে।

শহরে কুমুদ সকালে এক কাপ চা খেত। এখানে চায়ের বদলে এল গরম দুধ। তার সঙ্গে বাড়ির তৈরি সন্দেশ, নারকেলের নাড়ুআর গজা।

কুমুদ আর তুলসী পাশাপাশি খেতে বসেছিল।

কুমুদ তার দিকে ফিরে চাপা গলায় বলল, স্নান করব কিন্তু পদ্মবিলে। অনেকদিন জলে নামতে পারিনি।

তুলসী হাসল—ঠিক আছে, তার আগে চলো গ্রামটা একবার ঘুরে আসি।

দুজনে বের হল।

যাবার সময় দিদি বলল, তাড়াতাড়ি ফিরবে। কুমুদের ঠিক সময়ে স্নান-খাওয়া করতে হবে। মা চিঠিতে লিখে দিয়েছে।

দুজনের কারো সে কথা কানে গেল বলে মনে হল না।

একেবারে গেটের কাছে জামাইবাবুর সঙ্গে দেখা।

জামাইবাবু বেড়িয়ে ফিরছে। হাতে মোটা লাঠি।

কুমুদ জানে এটা তার বহুদিনের অভ্যাস। খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ে। মাইল তিন-চার ঘুরে বাড়ি ফেরে।

এখন আর জমিদারি নেই, কিন্তু যেটুকু জমি পেয়েছে, তাও নিতান্ত কম নয়। সে জমিতে চাষবাস হয়। জামাইবাবু নিজে দেখাশোনা করে।

বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে পায়ে-চলা পথ দিয়ে দুজনে এগোল। নিবিড় বাঁশবন। দিনের বেলাতেও অন্ধকার। ঝিঁঝি ডাকছে। দু-একটা অচেনা পাখির কিচিরমিচির।

বাঁশবন পার হয়ে কুমোরপাড়া। সার সার কুঁড়ে। মাটির দেয়াল। খড়ের চাল।

পূজার সময় এরা প্রতিমা তৈরি করে। হিন্দুদের বারোমাসে তেরো পার্বণ। গ্রামে বোধহয় আরও বেশি। বড়ো বড়ো পূজা ছাড়াও মনসা, ওলাইচণ্ডী নানা রকমের পূজা হয়।

অন্য সময়ে এই কুমোররা হাঁড়ি, কলসি, কুঁজো, সরা এইসব গড়ে।

কুমুদের খুব আশ্চর্য লাগল।

শহর রোজ বদলায়। নতুন বাড়ি, নতুন রাস্তা—এ ধরনের পরিবর্তন শহরে অন্তত সপ্তাহে একবার দেখা যায়।

গ্রাম কিন্তু বিশেষ বদলায় না। এর আগের বার এসে কুমুদ যেমন দেখেছে, ঠিক তেমনই আছে। এমনকী, কুঁড়েঘরগুলোর যেখানে যেখানে মাটি ধসে গেছে, যে জায়গায় খড় সরে গেছে, ঠিক একরকম রয়েছে। কোনও পরিবর্তন হয়নি।

কুমোরপাড়া ছাড়িয়ে আর কিছু দূর গিয়েই কুমুদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

অনেকটা জায়গা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বেড়ার ধারে ধারে রাংচিতার গাছ।

মাঝখানে সাদা রঙের একটা মন্দির।

কুমুদ জিজ্ঞাসা করল, হ্যাঁ রে তুলসী, এ মন্দির তো আগে দেখিনি। নতুন হয়েছে বুঝি?

তুলসী মাথা নাড়ল।

না, না। নতুন হবে কেন? কত বছরের পুরোনো মন্দির তার ঠিক আছে? আগে জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল, বিরাট একটা পাকুড় গাছের আড়ালে। চারদিকে ঘন জঙ্গল। লোকে ভয়ে কেউ এদিকে আসত না।

জামাইবাবু বুঝি এর সংস্কার করেছেন?

না, বাবা লেখালেখি করেছে। দেশের যত পুরোনো মন্দির, মসজিদ, স্মৃতিস্তম্ভ মানে সবরকম পুরাকীর্তির দেখাশোনা সরকার করে। সেরকম একটা আইনও আছে। খবর পেয়ে দু-তিনজন পণ্ডিত লোক এসে মন্দির ঘুরে ঘুরে দেখলেন। মূর্তি দুটোর ফোটো তুললেন, তারপর লোকজন এসে চারদিক পরিষ্কার করল। মন্দিরের সংস্কার করল।

দুটো মূর্তি আছে মন্দিরে? কীসের মূর্তি?

সেটা কেউ বলতে পারল না। পণ্ডিতেরা আমাদের বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁরা বললেন, ঠিক কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তাঁরা দুটো মূর্তিরই ফোটো তুলে নিয়েছেন। এ বিষয়ে গবেষণা করে জানাবেন। মুশকিল হয়েছে, দুটো মূর্তিরই মাথা নেই।

মাথা নেই?

না। দুটো মূর্তিই গলা থেকে শুরু হয়েছে। তবে দেখে মনে হয় কেউ ধারালো কোনও অস্ত্র দিয়ে মুণ্ড দুটো কেটে নিয়ে গেছে।

কুমুদ আর কৌতূহল দমন করতে পারল না। বলল, চল, একবার মন্দিরের ভিতরে যাই। অসুবিধা নেই তো?

না, না। অসুবিধা কীসের? চল।

দুজনে বাঁশের ফটক খুলে ভিতরে ঢুকল।

মন্দিরের গায়ে একটা পাথরের ফলক।

সরকার থেকে লাগিয়ে দিয়েছে। তাতে একটা নম্বর লেখা। তলায় মন্দিরের বয়স প্রায় এক হাজার বছর বলে অনুমান করা হয়েছে।

সিঁড়ি বেয়ে দুজনে ওপরে উঠল।

মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল। তুলসী হাত দিয়ে ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।

মন্দিরগর্ভ অন্ধকার। কিন্তু মুণ্ডহীন মূর্তি দুটো থেকে সোনালি আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তাতেই সবকিছু অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

একটা মূর্তি পদ্মের ওপর আসীন। অন্যটা অদ্ভুত এক জানোয়ারের ওপর বসে আছে। কুমুদ প্রথমে ভেবেছিল, বাহন প্যাঁচা, কিন্তু ভালো করে দেখে বুঝতে পারল, না প্যাঁচা নয়, চারটে পা রয়েছে। আবার ল্যাজের মতন কিছুটা দেখা যাচ্ছে। আবার বেড়ালও নয়। কারণ দু-পাশে ডানার অস্পষ্ট আভাস।

তুলসী বলল, দেখছ কুমুমামা, মূর্তি দুটো থেকে কীরকম জেল্লা বের হচ্ছে? পণ্ডিতরা বললেন, যেমন অষ্টধাতুর মূর্তি হয়, এ মূর্তি তেমনই দ্বাদশ ধাতু দিয়ে তৈরি। বাকি চারটে ধাতু যে কী, কেউ বলতে পারলেন না। সেই চারটে ধাতুর জন্যই এইরকম জ্যোতি বের হয়।

কুমুদ মন্দির থেকে নেমে এল।

দরজা ভেজিয়ে দিয়ে তুলসী পাশে এসে দাঁড়াল।

কুমুদ প্রশ্ন করল, এ মন্দিরে পূজা হয় না?

না। মুণ্ডহীন বিগ্রহের পূজা হবে কী করে? তবে দূর দূর গাঁ থেকে লোকেরা দেখতে আসে।

দুজনে বাঁশের ফটক পার হয়ে এপারে এল।

বিরাট দিঘিটা মন্দিরের পাশেই। পদ্মদিঘি। প্রায় নদীর মতন।

হঠাৎ তুলসী চিৎকার করে উঠল, কুমুমামা, সাবধান!

কুমুদ একটু অন্যমনস্ক ছিল। তুলসীর চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠল।

তার গোড়ায়, একেবারে কুমুদের পা ঘেঁষে একটা কুচকুচে কালো সাপ। ল্যাজে ভর দিয়ে প্রায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে। প্রসারিত ফণার ওপর যেন পদ্মের ছাপ।

তুলসী কুমুদকে ঠেলে একপাশে নিয়ে এল।

সাপটা মাটিতে বার দুয়েক ছোবল মেরে সরসর করে কেয়াঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল।

সাপটা চলে যেতে তুলসী বলল, তোমার খুব ফাঁড়া গেল কুমুমামা। পদ্মগোখরো সাপ। এক ছোবলেই সঙ্গে সঙ্গে শেষ।

কুমুদেরও বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছিল। ঘামের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল কপালে।

একটু শান্ত হতে বলল, এসব বিষাক্ত সাপ গাঁয়ের লোকে মেরে ফেলে না কেন?

তুলসী জিভ কামড়ে বলল, এসব বাস্তুসাপ। আগে এই পদ্মগোখরো আর তার জোড়া মন্দিরের মধ্যে ছিল। মন্দির পরিষ্কার হয়ে যেতে এই কেয়াঝোপে বাসা বেঁধেছে। গাঁয়ের লোকেরা কেউটে, শঙ্খচূড়, লাউডগা এসব সাপ মারে, কিন্তু গোখরো নয়। চলো, এবার বাড়ি ফেরা যাক।

দুজনে ফেরার পথ ধরল।

পথে কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে দেখা হল। তারা হাটে চলেছে।

তুলসীকে দেখে হাতজোড় করে বলল, নমস্কার দাদাবাবু। বেড়াতে বেরিয়েছিলেন?

কুমুদ বুঝতে পারল, জমিদারি গেছে বটে, কিন্তু সম্ভ্রমটুকু এখনও আছে।

বাড়ির কাছাকাছি এসে তুলসী বলল, কুমুমামা, একটা কথা।

কী রে?

পদ্মগোখরোর কথা যেন মা-কে বোলো না।

বলব না?

উঁহু, তাহলে বাইরে বেরোনো একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। তোমারও, আমারও।

তুলসীর বলার ভঙ্গি দেখে কুমুদ হেসে ফেলল—ঠিক আছে, বলব না।

দুপুরবেলা সবাই একসঙ্গে খেতে বসল। জামাইবাবু, কুমুদ আর তুলসী। পাশাপাশি। কেবল দিদি বাদ। দিদি পরিবেশন করল।

জামাইবাবু জিজ্ঞাসা করল, আজ সকালে কোথায় গিয়েছিলে কুমুদ?

কুমুদ মন্দিরের কথা বলল।

জামাইবাবু ধীর গলায় বললেন, আমরা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি ওটা ধর্মরাজের মন্দির। এত সাপের উপদ্রব, আর চারপাশে গভীর জঙ্গল ছিল যে আমরা মন্দিরের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারতাম না।

কুমুদ জিজ্ঞাসা করল, ধর্মরাজের মন্দির? কিন্তু একজোড়া বিগ্রহ রয়েছে যে?

জোড়া বিগ্রহের খবর তখন আমরা জানতাম না। ধর্মরাজ মানে যমরাজাও হয়, আবার যুধিষ্ঠিরও হতে পারে। পাণ্ডবদের মূর্তি কোথাও পূজা হয় বলে শুনিনি, তবে যমরাজের মন্দির বর্ধমানে অনেক জায়গায় আছে।

যাঁরা কলকাতা থেকে এসেছিলেন, তাঁরা কী বলেন?

তাঁরাও তো ঠিকমতো কিছু বলতে পারছেন না। এ বিষয়ে আমার সঙ্গে চিঠিপত্র লেখালিখি হয়েছে। তাঁদের ধারণা মন্দিরটি হাজার বছরের পুরোনো, কিন্তু আমার মনে হয় এর বয়স আরও বেশি। তাঁরা স্বীকার করেছেন, মূর্তি দুটির মধ্যে বৌদ্ধ যুগের ছাপ আছে।

এবার তুলসী প্রশ্ন করল, ওই যে মূর্তিগুলোর জেল্লা?

জামাইবাবু বলল, ও জেল্লার কারণ কেউ বার করতে পারেনি। মনে হয় মূর্তি দুটো কোনওরকম লুমিনাস মেটাল দিয়ে তৈরি।

কী দিয়ে তৈরি?

বুঝতে না পেরে তুলসী জিজ্ঞাসা করল।

মানে এমন ধাতু যা থেকে জেল্লা বের হয়, অবশ্য এ বিষয়ে ঠিক কিছুই বলা যায় না। গত বছর আমেরিকা থেকে কয়েকজন ট্যুরিস্ট এসেছিলেন, তাঁরা অনেক ফোটো নিয়ে গেছেন। ইচ্ছা ছিল, মূর্তির গা থেকে কিছুটা চেঁছে নিয়ে যাবেন, কী ধাতু গবেষণার জন্য, কিন্তু সেটা করতে আমি দিইনি।

এবার কুমুদ জিজ্ঞাসা করল, দুটো মূর্তিরই মাথা নেই কেন?

জামাইবাবু কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, ওটা অবশ্য বোঝা দায়। আমাদের দেশে মুসলমান আর বর্গিরা অত্যাচারের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল। মন্দির ভেঙে দিয়েছে, বিগ্রহ চূর্ণ করেছে মোগল আর পাঠান। আর দামি বিগ্রহ বর্গিরা আহরণ করে নিয়ে গেছে। সেই সময় হয়তো বিগ্রহের মুণ্ড দুটো গেছে।

এতক্ষণ দিদি বসে বসে শুনছিল। জামাইবাবু থামতেই বলল, তোমাদের মন্দির নিয়ে গবেষণাটা খাওয়ার পর করলে হয় না? সব যে পাতে পড়ে রয়েছে।

আলোচনা থামিয়ে সবাই আহারে মন দিল।

খাওয়াদাওয়ার পর কুমুদ আর তুলসী বাইরে ঝাঁকড়া বট গাছতলায় গিয়ে বসল। রোদ আছে, কিন্তু তেজ কম। বেশ হাওয়া দিচ্ছে।

কুমুদ বলল, তুলসী, জামাইবাবুর একটা লাইব্রেরি ছিল না?

ছিল বলছ কেন, এখনও তো আছে। নীচের কোণের ঘরটা বইয়ে ঠাসবোঝাই। বাবা ইদানীং আবার চাষবাসের সব বই কিনেছে।

কুমুদ উঠে দাঁড়াল।

জামাইবাবু একটু পরেই সাইকেলে বেরিয়ে যাবে, তা-ই না?

হ্যাঁ, মাঠে না গেলে চাষিরা বড্ড ফাঁকি দেয়।

জামাইবাবু বেরিয়ে গেলে একবার লাইব্রেরিতে ঢুকব।

কেন, সেখানে কী?

দিদির কাছে শুনলাম, রতনগড় গ্রামের ওপর একটা বই আছে। বইটা হাতড়ে দেখব যদি মন্দিরের রহস্য সম্বন্ধে কিছু থাকে।

তুলসী হাসল, নিশ্চয় কিছু নেই।

কেন?

থাকলে বাবা পড়ে ফেলত। বাবার কাছ থেকেই তুমি জানতে পারতে।

কুমুদ স্বীকার করল, তা অবশ্য সত্যি কথা। যাহোক, নিজে একবার পড়ে না হয় দেখি।

তুলসী বলল, কুমুমামা, মনে হচ্ছে স্কন্ধকাটা মূর্তি দুটোর ভূত তোমার ঘাড়ে ভীষণভাবে চেপেছে। তুমি কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছ না।

একেবারে কোণের ঘরে লাইব্রেরি। নীচের তলায়।

খুব যে সাজানো-গোছানো তা নয়। অনেক বই মেঝের ওপর স্তূপীকৃত।

সাদা রঙের ছোটো একটা কাঠের মই। ওপর থেকে বই পাড়বার সুবিধার জন্য। তুলসী আঙুল দিয়ে দেখাল।

ওই যে বাঁদিকে লাল রঙের বই। ওটা পাড়।

কুমুদ বইটা পাড়ল।

নতুন করে মলাট দেওয়া হয়েছে। ভিতরের পাতা কিন্তু জরাজীর্ণ।

খুব সন্তর্পণে কুমুদ পাতা ওলটাতে লাগল।

বইটার নাম, রত্নগড়ের ইতিহাস। রত্নগড় লোকের মুখে মুখে রতনগড় হয়েছে। রতনগড়ের পশ্চিমদিকে মাটি আর পাথরের তৈরি একটা গড় ছিল। সে গড় আজ নিশ্চিহ্ন।

বইতে লেখা, একসময়ে পদ্মবিলের সঙ্গে বিদ্যাপতি নদীর যোগাযোগ ছিল। পালতোলা নৌকা চলাচল করত। এখান থেকে নৌকা যেত তাম্রলিপ্ত বন্দরে।

সেই সময় এক শ্রেষ্ঠী একটি মন্দির নির্মাণ করেন।

নিবিষ্টচিত্তে পড়তে পড়তে কুমুদ চেঁচিয়ে উঠল, সর্বনাশ!

কী হল?

এরপরে আর কোনও পাতা নেই।

তুলসী হাসতে হাসতে বলল, তা তো জানি। পাতা থাকলে ওই মন্দির সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যেত। বাবা বইটা ওই অবস্থায় পেয়ে বাঁধিয়ে রেখেছে।

তাহলে কী হবে?

কী আর হবে। পুরোনো এক মন্দির সম্বন্ধে জেনেই বা কী হবে। সরকার থেকে তো গবেষণা করছে। ঠিক সময়ে তাদের গবেষণার ফল জানতেই পারব।

কুমুদ চুপ করে রইল। কিছু বলল না।

তুলসী বলল, কুমুমামা, মন্দিরের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও, আর-একটা জবর খবর তোমায় দেব।

কী?

দেখো, মা-কে আবার কিছু বোলো না।

বলব না, তুই বল।

চলো আমাদের ঘরে যাই। লাইব্রেরির ভ্যাপসা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে।

দুজনে শোবার ঘরে চলে এল।

কী বলবি, বল এইবার।

কুমুদ বিছানায় শুয়ে পড়ল। তুলসী তার পাশে বসল।

শোনো, ভোর সাড়ে তিনটে-চারটের সময় উঠতে পারবে?

কেন, অত ভোরে উঠে কী হবে?

পারবে কি না বলো না?

না-পারবার কী আছে। পরীক্ষার আগে আমি তো রাত দুটোর সময় উঠে পড়তাম।

ঠিক আছে। কাল ভোরে উঠে দুজনে বেরিয়ে পড়ব। পদ্মবিলের পশ্চিম পাড়ে চলে যাব। আমার কাছে ছোটো জাল আছে। কী বিরাট সব মাছ আছে তোমাকে কী বলব কুমুমামা। রুই, কাতলা, কালবোস।

কিন্তু বাড়িতে যে ভাববে?

আরে, বেলা সাতটার আগে বাড়ি ফিরে আসব। ভাগ্য যদি ভালো হয়, সঙ্গে মাছ আনতে পারি তাহলে কিছুই বলবে না।

ঠিক আছে। আমি রাজি।

দুজনে একঘরে শোয়, কাজেই কোনও অসুবিধা হল না।

পরের দিন অন্ধকার থাকতে দুজনে বেরিয়ে পড়ল।

কুমুদের পরনে হাফ শার্ট আর প্যান্ট। তুলসীরও হাফ শার্ট কিন্তু ধুতি মালকোঁচা দেওয়া। রাস্তা ছেড়ে দুজনে জঙ্গলের পথ ধরল।

তখনও ঝোপে ঝোপে জোনাকির ঝাঁক। গাছের তলা দিয়ে দুজনের যাবার সময় পাখিরা ভয় পেয়ে চিৎকার করে উড়তে লাগল।

একটু দূরে বেশ কয়েক জোড়া জ্বলন্ত চোখ কুমুদ আর তুলসীর সঙ্গে এগিয়ে চলেছে।

কুমুদ জিজ্ঞাসা করল, ওগুলো কী?

তুলসী বলল, শেয়াল আর কী। প্রহরে প্রহরে চেঁচায়। আমাদের দেখে বোধহয় আজ চেঁচাতে ভুলে গেছে।

রাংচিতা আর ভেরেন্ডা ঝোপের মাঝখান দিয়ে দুজনে পদ্মবিলের ধারে এসে দাঁড়াল।

পদ্মবিল যেন বিরাট নদীর মতন। কালো কুচকুচে জল। ছোটো ছোটো ঢেউ উঠেছে। মাঝে মাঝে শর গাছের আগা উঁচু হয়ে রয়েছে।

এতক্ষণ পরে কুমুদের খেয়াল হল।

তুলসী, আমরা বিলের পশ্চিম পাড়ে যাব কী করে?

তুলসী এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে নিচু হয়ে পাশের বাঁশঝাড়ের মধ্যে ঢুকে গেল, তারপর টানতে টানতে একটা তাল গাছের ডোঙা বের করে নিয়ে এল।

কী কুমুমামা, চড়তে পারবে? দেখো, ভয় করবে না তো?

অবশ্য তাল গাছের ডোঙা খুব নিরাপদ বাহন এমন মনে হল না, বিশেষ করে এই বিশাল জলরাশির পক্ষে।

তবু কুমুদ ভয় পাবার ছেলে নয়। সে যথেষ্ট ডানপিটে। গায়ে শক্তিও আছে।

হেসে বলল, নাও আর দেরি নয়। ডোঙা জলে ভাসাও।

ডোঙা নামিয়ে কুমুদ আগে উঠল, তারপর তুলসী।

ডোঙার খোলের মধ্যে গোটানো ছোটো একটা জাল। সেটা তুলে তুলসী কুমুদের হাতে দিয়ে বলল, এখন এটা ধরে থাকো কুমুমামা, আমি ঠিক সময়ে তোমার কাছ থেকে নিয়ে নেব।

একটা বাঁশের টুকরো দিয়ে জল কেটে কেটে তুলসী ডোঙা এগিয়ে নিয়ে চলল। কুমুদ শক্ত হাতে ডোঙার দুটো ধার আঁকড়ে রইল।

আকাশে মেঘ করেছে। অসময়ের কালো মেঘ। সেই কালো মেঘের ছায়া পদ্মবিলের ওপর। চারপাশের ঘন গাছপালার জন্য সব যেন ঝুপসি অন্ধকার।

তুলসী ডোঙাটা ধারে নিয়ে আসছে।

এখানে জলের মধ্যে প্রচুর পানা আর ঝাঁজি। সবুজ হয়ে আছে জল।

জালটা কুমুদের হাত থেকে নিয়ে তুলসী সোজা হয়ে দাঁড়াল।

কুমুদের দিকে ফিরে বলল, সাবধান কুমুমামা, ডোঙাটা এবার খুব দুলবে। তুমি শক্ত হয়ে বসে থাকো।

জালটা ছোড়ার মুখেই বাধা।

ঝোপের ফাঁক দিয়ে তীব্র আলো জলের ওপর এসে পড়ল। সেই সঙ্গে শোনা গেল ধক ধক শব্দ।

কুমুদ ভ্রূ কোঁচকাল।

কীসের আলো?

তুলসী কোনও উত্তর না দিয়ে জালটা গুটিয়ে ডোঙার খোলের মধ্যে আবার রেখে দিল।

কালো আকাশের গায়ে মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে। মনে হল তার নীচে থেকেই যেন আলোটা আসছে।

কী ব্যাপার কুমুমামা, দেখতে হচ্ছে।

তুলসী ডোঙাটা আস্তে আস্তে ডাঙার কাছ বরাবর নিয়ে এল।

পাড়ে কচুবন। বুনো সব লতা কচুঝোপের ওপর বিছানো রয়েছে।

তুলসী পাশ দিয়ে ডোঙা একেবারে ধারে এনে বলল, কুমুমামা লাফিয়ে নেমে পড়ো।

কুমুদ লাফাল।

তারপর তুলসী নেমে ডোঙাটা বাঁশবনের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে সাবধানে নামল।

একটু এগোতেই আলোটা নিভে গেল, কিন্তু ধক ধক শব্দ বেশ শোনা গেল।

দুজনে গাছের ফাঁক দিয়ে পা টিপে টিপে এগোতে লাগল। একেবারে কাছাকাছি গিয়ে কুমুদ বসে পড়ল। তার দেখাদেখি তুলসীও বসল।

এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার একটু তরল হয়ে আসছে। একটা লরি দাঁড়িয়ে। একেবারে মন্দিরের গা ঘেঁষে। সেই লরির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। লরির হেডলাইট দুটো আগে জ্বলছিল, এখন নিভিয়ে দিয়েছে।

তুলসী ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

কুমুদ এক হাত দিয়ে তুলসীর মুখ টিপে ধরল।

অর্থাৎ, এখন একদম কথা বলবি না।

হঠাৎ দেখা গেল মন্দিরের ভিতর থেকে দুটো লোক কী একটা বয়ে নিয়ে আসছে।

একটু আগে কুমুদের সাবধানবাণী ভুলে গিয়ে তুলসী চেঁচিয়ে উঠল। ওরা মূর্তি নিয়ে পালাচ্ছে!

ভাগ্য ভালো তুলসীর। ঠিক সেই সময় একটা হুতোম প্যাঁচা গাছের ওপর থেকে গম্ভীর গলায় চেঁচিয়ে উঠল, হুম, হুম, হুম।

তুলসীর গলার স্বর সেই আওয়াজে চাপা পড়ে গেল।

লোক দুটো বয়ে-আনা মূর্তিটা লরির ওপর চাপিয়ে দিল। তারপর দুজনে লরিতে উঠল। একজন চালকের আসনে। আর-একজন তার পাশে।

কুমুদ বুঝতে পারল এবার লরি ছাড়বে।

সে তুলসীর কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ওরা পালাচ্ছে। চল, আমরা লরিতে উঠে পড়ি।

প্রথমে কুমুদ, তারপর তুলসী লরির পিছন দিয়ে ওপরে উঠে পড়ল।

ততক্ষণে লরি চলতে শুরু করেছে।

রাস্তা নেই, কেবল সে ছোটো ছোটো ঝোপ, তাই লরিটা একটু আস্তে আস্তে চলছে।

কুমুদ আর তুলসী লরির ওপর উঠে দেখল, লরি ভরতি ডাব, তরিতরকারি আর ডালডার টিন।

বুঝতে পারল, মূর্তি দুটো এইসব জিনিসের তলায় কোথাও রাখা আছে।

একটা মূর্তি চুরি করতে তো কুমুদ আর তুলসী দেখেইছে। আর-একটা মূর্তিও নিশ্চয় আগে সরিয়েছে।

চুরি করতে যখন এসেছে তখন কি আর একটা মূর্তি ফেলে যাবে?

জঙ্গল ছেড়ে রাস্তার ওপর আসতেই লরির গতি বাড়ল।

একটু একটু করে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। ভোরের আলো ফুটছে।

রাস্তায় শাকসবজি মাথায় দু-একজন চাষিকে হাটের দিকে যেতে দেখা গেল। লরির চালক পিছনদিকে দেখলেই এদের দেখতে পাবে।

কুমুদ তুলসীকে ইশারা করল।

লরির ওপর একটা ত্রিপল ঢাকা দেওয়া ছিল। কুমুদ ত্রিপলের এককোণ তুলে তার তলায় চলে গেল। তুলসীও তা-ই করল।

এবার লরি তিরবেগে ছুটছে।

কুমুদ শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল। খবরের কাগজে সে অনেক পড়েছে। আজকাল মূর্তি চুরির হিড়িক পড়ে গেছে। অনেকেই মূর্তি চুরি করে বিদেশে চালান দিচ্ছে। বিরাট আন্তর্জাতিক দলও রয়েছে। ভগবান জানেন, এরাও সেরকম কোনও দলের লোক কি না। খুব সম্ভব এরা মূর্তিগুলো কোনওখানে রাখবে। তারপর অন্য কোথাও পাঠাবার ব্যবস্থা করবে। সেই জায়গাটা দেখে রাখতে পারলেই কাজ হবে। কাছাকাছি থানায় গিয়ে খবর দিয়ে দেবে। একটু পরেই লরি থামল। দু-পাশে খেত। বসতির কোনও লক্ষণ নেই। এখানে যে লরি থামল!

খুব বাজখাঁই একটা গলার স্বর শোনা গেল।

ভজু, নাম, কিছু খেয়ে নিই। এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে।

আর-একজন কোনও কথা বলল না। তবে বোঝা গেল, সে লাফিয়ে লরি থেকে নামল।

সম্ভবত রাস্তার এদিকে চায়ের দোকান কিংবা সরাইখানা আছে। ওদিকে সরে গিয়ে দেখতে কুমুদের সাহস হল না।

প্রায় আধ ঘণ্টা লরি দাঁড়িয়ে রইল।

বেলা বাড়ছে। অন্ধকার থাকতে কুমুদ আর তুলসী বেরিয়েছে। এত বেলা হল এখনও পেটে কিছু পড়ল না। কখন এ যাত্রার শেষ হবে কে জানে!

আবার চলা শুরু।

কুমুদ দেখল, অনেক দূরে দূরে পাহাড়ের অস্পষ্ট রেখা দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি লরি বাংলাদেশের সীমানা পার হয়ে যাচ্ছে?

বিকালের দিকে লরি থামল। ঘন জঙ্গলের মধ্যে বিরাট একটা গুদাম। ইটের দেয়াল। টিনের ছাদ।

সামনের দিক থেকে লোকেরা নামল।

আওয়াজে বোঝা গেল, ওরা গুদামের তালা খুলছে।

এই সুযোগ। কুমুদ আর তুলসী নিঃশব্দে নেমে দাঁড়াল। ভালো করে জায়গাটা চিনে নিয়ে পুলিশকে খবর দিতে হবে।

ওঃ। দুজনেই ভীষণ আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল। দুজনেই জ্ঞান হারাল।

কুমুদের জ্ঞান হতে দেখল, অন্ধকার একটা ঘরে খাটিয়ার ওপর সে শুয়ে আছে।

আশা করেছিল, ধারেকাছে তুলসীকে দেখতে পাবে, কিন্তু এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়ে তুলসীকে কোথাও দেখতে পেল না।

মাথা ঘোরাতে গিয়েই বুঝতে পারল মাথায় অসহ্য ব্যথা। মনে পড়ে গেল, কেউ ভারী কিছু দিয়ে তার মাথার পিছনে আঘাত করেছিল।

তুলসী পাশেই ছিল। তাকেও নিশ্চয় একইভাবে ঘায়েল করা হয়েছিল। কিন্তু তুলসী কোথায় গেল?

ভালো করে কুমুদ ঘরটা লক্ষ করল। আগাগোড়া পাকা গাঁথুনি। দেয়াল-ছাদ দু-ই ইটের। একটামাত্র দরজা। খুব মজবুত কাঠের ভারী পাল্লা। একটাও জানলা নেই। তাতেই মনে হল, এটা গুদামঘর। কিন্তু, এখন একেবারে খালি।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হতেই কুমুদ চমকে উঠল।

দীর্ঘ, সবল চেহারার একটা লোক ঢুকল। এক হাতে একটা রেকাবি, অন্য হাতে চাবুক।

খোলা দরজা দিয়ে বাইরের কিছুটা দেখা গেল। প্রচণ্ড রোদে সব কিছু ঝলমল করছে। সামনে একটা কাঁঠাল গাছ। তার গুঁড়িতে একটা ছাগল বাঁধা। ঘন জঙ্গল। জঙ্গল ভেদ করে পিছনের কিছু দেখা যাচ্ছে না।

খাটিয়ার তলা থেকে টুল বের করে লোকটা বসল।

কাছে আসতে লোকটার বীভৎস চেহারা আরও পরিষ্কার দেখা গেল। গালে কাস্তের মতন বাঁকা একটা কাটা দাগ। গালপাট্টা গালের অর্ধেকটা নেমেছে।

কী রে, নাম কী তোর?

কুমুদের মনে হল ঘরের মধ্যে যেন বাজ পড়ল।

কী, কথা কানে যাচ্ছে না? না, চাবুক পিঠে না পড়লে মুখ খুলবে না?

কথার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বাতাসে চাবুকটা আছড়াল।

সাপের মতন চাবুকটা হিস হিস শব্দ করে উঠল।

ক্ষীণকণ্ঠে কুমুদ বলল, কুমুদ লাহিড়ী।

হুঁ, লরির পিছনে উঠেছিলি কোন মতলবে?

কোনও মতলব নয়। দেখলাম তরকারি বোঝাই লরি দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দুজনে উঠে পড়লাম।

উঠে একেবারে এতটা পথে চলে এলি?

লরি না থামলে নামব কী করে? তা ছাড়া অন্য কারণও ছিল।

কী কারণ?

আমরা আর বাড়িতে ফিরতে চাইনি।

হঠাৎ বৈরাগ্য। কী ব্যাপার?

আমরা দুজনেই পরীক্ষায় ফেল করেছি, তাই বাড়িতে আমাদের খুব হেনস্থা চলেছে।

ও ছোকরা তোর কে হয়?

আমরা মামা-ভাগনে, আমি মামা।

বা, বা, মামা-ভাগনে, একেবারে মানিকজোড়।

লোকটা কিছুক্ষণ কঠিন দৃষ্টিতে কুমুদকে দেখল, তারপর রেকাবিটা খাটিয়ার ওপর রেখে দিয়ে বলল, নে, খেয়ে নে।

কুমুদ আড়চোখে চেয়ে দেখল। খান চারেক রুটি আর একটু ডাল। সকাল থেকে পেটে কিচ্ছু পড়েনি। এইই অমৃত। কিন্তু তার আগে একটু জল দরকার।

লোকটা দরজার কাছে গিয়ে চেঁচাল। লছমি, এ লছমি, এক লোটা জল নিয়ে আয়।

একটু পরে বছর দশেকের একটি মেয়ে এক ঘটি জল এনে মেঝের ওপর রাখল।

ঠিক আছে, যা।

লোকটা জলের ঘটিটা কুমুদের হাতের কাছে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে, খেয়ে নে। পরে আবার আসব।

লোকটা যখন দরজার কাছে গেছে, তখন কুমুদ বলল, শুনুন।

লোকটা ঘুরে দাঁড়াল।

আমার ভাগনে তুলসী কোথায়?

খতম হয়ে গেছে।

কথার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা দরজা বন্ধ করে দিল। বাইরে থেকে দরজায় তালা বন্ধ করার আওয়াজও কুমুদের কানে গেল।

রুটি ছিঁড়ে কুমুদ ডালে মাখিয়ে সবে মুখে দিতে যাচ্ছিল, লোকটার কথা কানে যেতেই হাত থেকে রুটির টুকরো মাটিতে পড়ে গেল।

তুলসী খতম!

যখন কুমুদকে আঘাত করে তখন নিশ্চয় তুলসীকেও আঘাত করেছিল। হয়তো তুলসীর আঘাতটা একটু জোরেই হয়েছিল। কিংবা এও হতে পারে, পরে তুলসীর কাছ থেকে কথা বের করার জন্য এরা সম্ভবত মারধর করেছে। নির্যাতনের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গিয়ে থাকবে।

তুলসীর যদি কিছু হয়ে থাকে, তার জন্য কুমুদ সম্পূর্ণভাবে দায়ী। মূর্তি চোরদের পিছনে যাবার জন্য কুমুদই তাকে উৎসাহিত করেছিল।

বসে বসে কুমুদ চিন্তা করতে লাগল। এমনও হতে পারে লোকটা মিথ্যা কথা বলে গেল। তুলসীর কিছুই হয়নি। তুলসী হয়তো আর-একটা ঘরে কুমুদের মতনই বন্দি।

কুমুদ লোকটাকে যে কথাগুলো বলেছে, সেগুলো সে তুলসীর কাছ থেকেও যাচাই করে নেবে। যদি দুজনে দুরকম কথা বলে, তাহলেই সর্বনাশ। দুজনের ওপর অত্যাচার শুরু হবে।

আবার খুট করে দরজায় শব্দ। এবার দরজা খুলে যেতে লছমি ঘরে ঢুকল।

খাটিয়ার কাছে এসে বিরক্তকণ্ঠে বলল, এ কী, এখনও নাস্তা হয়নি? তাড়াতাড়ি নাও, আমি লোটা আর থালা নিয়ে যাব।

রুক্ষ, কর্কশ কণ্ঠস্বর। লছমি হিন্দুস্থানি হলেও বাংলা ভাষা মন্দ বলে না।

কুমুদ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা লছমি, অন্য ঘরে যে ছেলেটাকে আটকে রাখা হয়েছে, তার দেখাশোনা কি তুমিই করছ?

না, চাচাজি তাকে দেখছে। বড়ো বদমাইশ লেড়কা। চাবুক না খেলে মুখ খোলে না।

কুমুদ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক, তাহলে তুলসী বেঁচে আছে। হয়তো নির্যাতিত হচ্ছে, কিন্তু প্রাণে মরেনি।

কুমুদ রুটি-ডাল শেষ করল। নিঃশেষ করল জলের লোটা।

লছমিকে বলল, আমাকে আর-এক ঘটি জল দিতে পারো?

লছমি খিঁচিয়ে উঠল, ও, নবাবপুত্তুর হুকুম করছে। আমি ওর কেনা বাঁদি, দশ লোটা জল এনে দেব।

কথা শেষ করেই লছমি ছোঁ মেরে থালা আর লোটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় তালা পড়ল।

কুমুদ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। ঘরের চারদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কোথাও একটু ফাঁক নেই। দরজায় কান পাতল।

মনে হল কে যেন কাঠ কাটছে। কোনও মানুষের কথার আওয়াজ পাওয়া গেল না। ছাগল ডাকছে। কাকের শব্দ।

কুমুদ আবার খাটিয়ায় ফিরে এল।

খড়ের বালিশ। তার ওপর মাথা রেখেই শুয়ে পড়ল।

একটু বোধহয় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ বাইরে অনেকগুলো লোকের সম্মিলিত চিৎকারে চমকে উঠে বসল।

বাইরে ভীষণ হইচই। অনেকগুলো লোক একসঙ্গে কথা বলছে বলে কথাগুলো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

দরজায় কান পেতে কুমুদ শোনবার চেষ্টা করল।

কতকগুলো লোক ছুটোছুটি করছে। কাকে যেন গালাগালও দিচ্ছে। দুজন লোক ঠিক দরজার ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের কথা কুমুদ স্পষ্ট শুনতে পেল।

শয়তান গিরিধারীকে ঘায়েল করে পালিয়েছে।

সে কী? কী করে?

গিরিধারী জল দিতে এসেছিল। তার হাতে ছিল লোহা-বাঁধানো লাঠি। শয়তানটা করেছে কী, আচমকা গিরিধারীর মুখের ওপর জল ছুড়ে দিয়ে, তার লাঠি দিয়েই তার মাথায় সজোরে মেরে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে খোলা দরজা দিয়ে পালিয়েছে।

আর কেউ পাহারায় ছিল না?

আর কে থাকবে। দরজা বন্ধ ছিল। শয়তানটা জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে গিরিধারী দরজা খুলে দেয়। তখন বলে খুব জলতেষ্টা পেয়েছে। জল আনতে এই বিপত্তি।

কিন্তু পালাবে কোথায়? চারপাশে তো ঘন জঙ্গল। আমাদের তিনজন লোক খুঁজতে বেরিয়েছে।

কুমুদ বুঝতে পারল তুলসী পালিয়েছে। তুলসী যদি কোনওরকমে পুলিশে খবর দিতে পারে, তাহলে পুরো দলটাই ধরা পড়ে যাবে।

কুমুদের নিশ্চিত ধারণা, ধারেকাছে অন্য গুদামে আরও অনেক চুরি করা মূর্তি আছে।

এ বিচ্ছুটা ঠিক আছে তো? তালাটা খোল। একবার দেখি।

কুমুদ বুঝতে পারল এখনই ওরা ঘরে ঢুকবে। সে তাড়াতাড়ি খাটিয়ায় উঠে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল ঘুমের ভান করে।

দরজা খোলার শব্দ হল। কুমুদ বুঝতে পারল লোক দুটো খাটিয়ার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

না, এটা ঘুমোচ্ছে।

সাবধানের মার নেই। আর লছমিকে জল নিয়ে পাঠাব না।

রাতে এ ব্যাটার খাওয়া বন্ধ। পেটে কিছু না পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে।

লোকদুটো বেরিয়ে যেতে কুমুদ আবার উঠে পড়ল।

দু-দিকের দেয়ালের খুব ওপরে ছোটো দুটো ফুটো। বোধহয় হাওয়া চলাচলের জন্য।

সে ফুটো দিয়ে পালানো তো দূরের কথা, কুমুদের একটা পা-ও গলবে না। পালাবার আশা দুরাশা।

কুমুদের ভয় হল, এরা যদি তুলসীকে ধরতে পারে, তাহলে তাকে খতম করে দেবে। অচেনা জায়গা, তার ওপর চারদিকে জঙ্গল। তুলসীর পক্ষে এদের হাত থেকে বাঁচা প্রায় অসম্ভব।

খিদেয় কুমুদের পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। সেই কতক্ষণ আগে কখানা রুটি আর ডাল খেয়েছিল। তারপর থেকে পেটে কিছু পড়েনি। এদের কথাবার্তায় যা মনে হল, আর কিছু খেতেও দেবে না।

এতক্ষণ পরে কুমুদ আপশোস করতে আরম্ভ করল।

পরীক্ষার পর দিদির বাড়ি কাটাতে এসেছিল। দিব্যি ভালো খেয়েদেয়ে এখানে-ওখানে বেড়িয়ে আনন্দে সময় কাটিয়ে দেবার কথা। কিন্তু ঘাড়ে যে কী ভূত চাপল। মূর্তি চোরের লরিতে উঠে বসার দুর্মতি কেন যে হল। এখন প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারলে হয়।

তুলসী আবার নতুন বিপদ ডেকে আনল।

দেয়ালে হেলান দিয়ে কুমুদ চুপচাপ বসে রইল।

বাইরে গোলমাল থেমে গেছে। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।

শেয়ালের ডাক শুনে বোঝা গেল বাইরে অন্ধকার নেমেছে।

টর্চের আলো খাটিয়ার ওপর ফেলেই লোকটা চেঁচিয়ে উঠল। আরে, এটা আবার গেল কোথায়?

কুমুদ বসে বসেই উত্তর দিল, এই যে আমি এখানে।

উঠে দাঁড়া।

বড্ড খিদে পেয়েছে। দাঁড়াবার শক্তি নেই।

একটা লোক এগিয়ে এসে কুমুদের চুল ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, একেবারে জন্মের শোধ খাওয়াব তোকে।

আর-একজন লোক দড়ি দিয়ে কুমুদকে পিছমোড়া করে বাঁধল, তারপর একটা রুমাল জোর করে তার মুখে গুঁজে দিল।

কুমুদের মনে হল তার মুখ বুঝি ফেটে যাবে। অসহ্য যন্ত্রণায় দুটো চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।

একটা লোক তাকে পাঁজাকোলা করে বাইরে নিয়ে এল।

উঠানের ওপর একটা লরি। কুমুদকে তার ওপর তুলে দিল।

এবারও লরি শাকসবজি বোঝাই। তলায় কী আছে অবশ্য বোঝবার উপায় নেই। একটা বড়ো ত্রিপল দিয়ে আগাগোড়া ঢেকে দিল।

কুমুদকে ঢাকা দেবার আগেই সে দেখতে পেয়েছিল, সামনে আর-একটা লরি দাঁড়িয়ে আছে।

গর্জন করে লরি দুটো ছাড়ল।

লরির ঝাঁকানিতে মনে হল খুব উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে চলছে। মাঝে মাঝে চড়াই-উৎরাইও রয়েছে।

লরির শব্দের ফাঁকে ফাঁকে কিছু কথার টুকরোও কুমুদের কানে এল।

শয়তানটা যেন পাখি হয়ে উড়ে পালাল। চারপাশের জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। কোথাও পাওয়া গেল না।

যদি সোজা কোনওরকমে ভগবতীপুর থানায় গিয়ে হাজির হতে পারে, তাহলেই সর্বনাশ। আমাদের আস্তানা দেখে গিয়েছে। দারোগাকে সঙ্গে করে এলেই একেবারে সব ক-টা বমাল গ্রেপ্তার।

আরে সেই ভয় করেই তো সর্দার এখান থেকে সরে যাবার হুকুম দিয়েছে। পুলিশ এলেও বোকা বনবে। উলটে ছোকরাটাকেই ধমক লাগাবে।

ত্রিপল ফাঁক করে কুমুদ দেখল, কালো আকাশ। দু-একটা তারা দেখা যাচ্ছে। মনে হল, একেবারে পাহাড়ের গা বেয়ে লরি চলছে।

একপাশে গাছপালা খুব উঁচুতে। কালো কালো পাথরের চাঙড়ও দেখা যাচ্ছে।

আবার কথাবার্তার আওয়াজ কানে এল।

এটাকে আমরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছি কেন?

এটাকে রেখে গেলে এ তো পুলিশের কাছে সব বলে দেবে। দুজনের কথা মিলে গেলে পুলিশের মনে সন্দেহ হবে। বুঝতে পারবে আমরা অন্য কোথাও সরে গেছি। চারদিক তোলপাড় করে খুঁজতে আরম্ভ করবে।

কিন্তু একে আমাদের নতুন আস্তানায় নিয়ে গিয়ে লাভ কী!

আরে দূর! সর্দার কি আর এত কাঁচা কাজ করবে? ছেলেটার হাত-পা বাঁধা, মুখও বন্ধ করা হয়েছে। এখন পথে কোনও নদীতে স্রেফ ছুড়ে ফেলে দেওয়া। ব্যাস ঝামেলা শেষ।

কথাগুলো কানে যেতেই কুমুদ শিউরে উঠল। তাহলে এই ওদের মতলব। মাঝপথে কোনও নদীতে তাকে বিসর্জন দেবে। বাঁচবার কি কোনও উপায় নেই!

হাত-পা বাঁধা। কুমুদ অতি কষ্টে গড়িয়ে গড়িয়ে লরির একপাশে চলে এল। লরির পাল্লা দুটো লোহা দিয়ে আটকানো।

কুমুদ হাতের বাঁধন তার ওপর রেখে ঘষতে লাগল। যদি দড়ি কেটে যায়। কিন্তু কিছুই হল না। দড়ি যথেষ্ট মজবুত।

নিরুপায় হয়ে কুমুদ গড়িয়ে গড়িয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এল।

ঝাঁকানি দিয়ে লরিটা থামতেই কুমুদের বুকের ভিতর গুরগুর করে উঠল।

বোধহয় কাছেই নদী। এবার তার ব্যবস্থা হবে।

এই প্রথম কুমুদের দু-চোখ জলে ভরে এল।

জীবনে খুব ইচ্ছা ছিল, হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে রসায়নে অনার্স নিয়ে কলেজে পড়বে। গতানুগতিক চাকরি করবে না। নামকরা কেমিস্ট হবে। মৃত্যুঞ্জয়ী ওষুধ আবিষ্কার করবে। সব বাসনার অবসান।

হাত-পা বাঁধা না থাকলে সাঁতার কাটবার চেষ্টা করত। এভাবে সাঁতার দেওয়া অসম্ভব। তার ওপর নিশ্চিন্ত হবার জন্য এরা হয়তো গলায় পাথর বেঁধে দেবে। জলে পড়ামাত্র টুপ করে ডুবে যাবে।

চোখ বুজে কুমুদ মৃত্যুর অপেক্ষা করতে লাগল। মা আর বাবার মুখ বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ কুমুদ অপেক্ষা করল।

সে ভেবেছিল দুটো লোক লরিতে উঠে তার অসহায় দেহটা তুলে ছুড়ে কোনও নদীতে ফেলে দেবে।

কিন্তু না, কেউ এল না।

একটু পরেই কুমুদের কানে হাসির শব্দ এল। মনে হল লোকগুলো কিছু চিবুতে চিবুতে হাসছে।

আন্দাজ করল বোধহয় লোকগুলো খাওয়ার জন্য নেমেছে। সম্ভবত কোনও দোকানে বসে খাচ্ছে, কিংবা হয়তো সঙ্গে খাবার নিয়ে এসেছিল।

কে একজন চেঁচাল, এই রাজু, বোতলে করে ওই নদী থেকে জল নিয়ে আয়, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে।

দে বোতল দে। এক বোতলে হবে না, দুটো বোতল দরকার।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। একটানা ঝিঁঝির শব্দ। দূরে বন্যজন্তুর গর্জনও শোনা যাচ্ছে। কী জন্তু কুমুদ বুঝতে পারল না।

খাওয়ার কথা কানে যেতেই কুমুদের পেটের মধ্যে আবার মোচড় দিয়ে উঠল। মুখে কাপড় গোঁজা না থাকলে সে চিৎকার করে কেঁদে উঠত।

একটু পরে লোকগুলো লরিতে এসে উঠল।

প্রথমে আগের লরিটা গর্জন করে ছাড়ল। তারপর পিছনেরটা।

কুমুদ যে লরিতে ছিল তার চালক আর সহকারী উচ্চকণ্ঠে গান শুরু করল। হিন্দুস্থানি গান। গানের একটা কথাও কুমুদ বুঝতে পারল না।

হঠাৎ গানের আওয়াজ ছাপিয়ে আর-একটা শব্দ শোনা গেল।

কুমুদ দু-বছর আগে মা-বাবার সঙ্গে রাঁচি গিয়েছিল। সেখান হুড্রু জলপ্রপাত দেখেছিল। অনেক ওপর থেকে পাথরের ধাপ বেয়ে বেয়ে জলের স্রোত নামছে। কী ভীষণ তার গর্জন।

এ শব্দও ঠিক সেইরকম। মনে হল প্রবল বেগে জলের ধারা নামছে।

সহকারীর চিৎকার কানে এল।

এই, সামলে সামলে। কী করছিস?

প্রচণ্ড একটা আওয়াজ। লরিটা ধাক্কা খেয়ে দুলে উঠল। তারপরই হেলে পড়ল একদিকে।

মুহূর্তে জলের স্রোত লরির মধ্যে ঢুকল। কী প্রবল শক্তি জলের। খড়ের কুটোর মতন লরিটাকে টেনে নিয়ে গেল।

কুমুদ বুঝতে পারল লরি নদীগর্ভে ঢুকছে।

আবার কান-ফাটানো শব্দ। লোহার রেলিংয়ের সঙ্গে লরিটার ধাক্কা লাগল। লরির পিছনের অংশ ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেল।