কচি-সংসদ

কচি-সংসদ

আলিপুরের সংবাদ—সাগর আইল্যাণ্ডে বায়ুমণ্ডলে যে গর্ত হইয়াছিল সেটা সম্প্রতি পাকারকম ভরাট হইয়া গিয়াছে, সুতরাং আর বৃষ্টি হইবে না। চৌরঙ্গিতে তিনটা সবুজ পোকার অগ্রদূত ধরা পড়িয়াছে। ঘোলা আকাশ ছিঁড়িয়া ক্রমশঃ নীল রং বাহির হইতেছে। রৌদ্রে কাঁসার রং ধরিয়াছে, গৃহিণী নির্ভয়ে লেপ—কাঁথা শুকাইতেছেন। শেষরাত্রে একটু ঘনীভূত হইয়া শুইতে হয়। টাকায় এক গণ্ডা রোগা—রোগা ফুলকপির বাচ্ছা বিকাইতেছে। পটোল চড়িতেছে, আলু নামিতেছে। স্থলে জলে মরুৎ—ব্যোমে দেহে মনে শরৎ আত্মপ্রকাশ করিতেছে। সেকালে রাজারা এই সময়ে দিগবিজয়ে যাইতেন।

আদালত বন্ধ, আমার গৃহ মক্কেলহীন। সার্কুলার রোডে ধাপা—মেলের বাঁশি পোঁ করিয়া বাজিল—চমকিত হইয়া দেখিলাম বড় ছেলেটা জিওমেটরি ত্যাগ করিয়া রেলের টাইম—টেবল অধ্যয়ন করিতেছে। ছোট ছেলেটার ঘাড়ে এঞ্জিনের ভূত চাপিয়াছে, সে ক্রমাগত দু—হাতের কনুই ঘুরাইয়া ছুঁচার মতন মুখ করিয়া বলিতেছে—ঝুক ঝুক ঝুক ঝুক। মন চঞ্চল হইয়া উঠিল।

এবার কোথা যাওয়া যায়? দু—একজন মহাপ্রাণ বন্ধু বলিলেন—পূজার ছুটিতে দেশে যাও, পল্লীসংঙ্কার কর। কিন্তু অতীব লজ্জার সহিত স্বীকার করিতেছি যে বহু বহু সৎকার্যের ন্যায় এটিও আমার দ্বারা হইবার নয়। জানামি ধর্মং—অন্ততঃ মোটামুটি জানি, কিন্তু ন চ মে প্রবৃত্তিঃ। ভ্রমণের নেশা আমার মাথা খাইয়াছে।

পদব্রজ, গোযান, মোটর, নৌকা, জাহাজ—এসব মাঝে মাঝে মুখ বদলাইবার জন্য মন্দ নয়। কিন্তু যানের রাজা রেলগাড়ি, রেলগাড়ির রাজা ই. আই. আর। বন্ধু বলেন—ইংরেজের জিনিসে তোমার অত উৎসাহ ভাল দেখায় না। আচ্ছা, রেল না—হয় ইংরেজ করিয়াছে কিন্তু খরচটা কে যোগাইতেছে? আজ না—হয় আমরা ইংরেজকে সহিংস বাহবা দিতেছি, কিন্তু এমন দিন ছিল যখন সেও আমাদের কীর্তি অবাক হইয়া দেখিত। আবার পাশা উলটাইবে, দু—শ বৎসর সবুর কর। তখন তারায় তারায় মেল চালাইব, ইংরেজ ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া দেখিবে, সঙ্গে লইব না,— পয়সা দিলেও না।

বাংলার নদ—নদী, ঝোপ—ঝাড়, পল্লীকুটীরের ঘুঁটের সুমিষ্ট ধোঁয়া, পানাপুকুর হইতে উত্থিত জুঁই ফুলের গন্ধ—এসব অতি স্নিগ্ধ জিনিস। কিন্তু এই দারুণ শরৎকালে মন চায় ধরিত্রীর বুক বিদীর্ণ করিয়া সগর্জনে ছুটিয়া যাইতে। পঞ্জাবমেল সন সন ছুটিতেছে, বড় বড় মাঠ, সারি সারি তালগাছ, ছোট ছোট পাহাড় নিমেষে নিমেষে পট—পরিবর্তন। মাঝে মাঝে বিরাম, পান—বিড়ি—সিগ্রেট, চা—গ্রাম, পুরী—কচৌড়ি, রোটি—কাবাব, dinner sir at shikohabad? তারপর আবার প্রবল বেগ, টেলিগ্রাফের খুঁটি ছুটিয়া পলাইতেছে। দু—পাশে আখের খেত স্রোতের মত বহিয়া যাইতেছে, ছোট ছোট নদী কুণ্ডলী পাকাইয়া অদৃশ্য হইতেছে, দূরে প্রকাণ্ড প্রান্তর অতিদূরের শ্যামায়মান অরণ্যানীকে ধীরে প্রদক্ষিণ করিতেছে। কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ, হঠাৎ জানালা দিয়া এক ঝলক উগ্রমধুর ছাতিম ফুলের গন্ধ। তারপর সন্ধ্যা—পশ্চিম আকাশে ওই বড় তারাটা গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়া চলিয়াছে। ওদিকের বেঞ্চে স্থূলোদর লালাজী এর মধ্যেই নাক ডাকাইতেছেন। মাথার উপর ফিরিঙ্গীটা বোতল হইতে কি খাইতেছে। এদিকের বেঞ্চে দুই কম্বল পাতা, তার উপর আরও দুই কম্বল, তার মধ্যে আমি, আমার মধ্যে ভর—পেট ভাল ভাল খাদ্যসামগ্রী—তা ছাড়া বেতের বাক্সে আরও অনেক আছে। গাড়ির অঙ্গে অঙ্গে লোহালক্কড়ে চাকার ঠোক্করে জিঞ্জিরডাণ্ডার ঝঞ্ঝনায় মৃদঙ্গ—মন্দিরা বাজিতেছে—আমি চিতপাত হইয়া তাণ্ডব নাচিতেছি। হমীন অস্ত, ওআ হমীন অস্ত!

এই পাশবিক পরিকল্পনা—এই অহেতুকী রেলওয়েপ্রীতি—ইহার পশ্চাতে মনস্তত্ত্বের কোন দুষ্ট সর্প লুক্কায়িত আছে? গিরীন বোসকে জিজ্ঞাসা করিতে সাহস হয় না। চট করিয়া স্থির করিয়া ফেলিলাম—ডালহাউসি যাইব, আমার এক পাঞ্জাবী বন্ধুর নিমন্ত্রণে। একাই যাইব, গৃহিণীকে একটা মোটা রকম ঘুষ এবং অজস্র থিয়েটার দেখার অনুমতি দিয়া ঠাণ্ডা করিয়া রাখিব। কিন্তু man proposes woman disposes।

আমার বড় সুটকেসটা ঝাড়িতেছি, হঠাৎ বিদ্যুল্লতার মত ছুটিয়া আসিয়া গৃহিণী বলিলেন—’হোআট—হোআট—হোআট?’

এইখানে একটা কথা চুপি চুপি বলিয়া রাখি। গৃহিণীর ইংরেজী বিদ্যা ফার্স্ট বুক পর্যন্ত। কিন্তু তিনি আমার ফাজিল শ্যালকবৃন্দের কল্যাণে গুটিকতক মুখরোচক ইংরেজী শব্দ শিখিয়াছেন এবং সুযোগ পাইলেই সেগুলি প্রয়োগ করিয়া থাকেন।

আমি আমতা আমতা করিয়া বলিলাম—’এই মনে করছি, ছুটির ক—দিন একটু পাহাড়ে কাটিয়ে আসি, শরীরটা একটু ইয়ে কিনা।’

গৃহিণী বলিলেন—’হোআট ইয়ে? হুঁ, একাই যাবার মতলব দেখছি—আমি বুঝি একটা মস্ত ভারী বোঝা হয়ে পড়েছি? পাহাড়ে গিয়ে তপস্যা হবে নাকি?’

সভয়ে দেখিলাম শ্রীমুখ ধূমায়মান, বুঝিলাম পর্বতো বহ্ণিমান। ধাঁ করিয়া মতলব বদলাইয়া ফেলিয়া বলিলাম—’রাম বল, একা কখনও তপস্যা হয়? আমি হব না হব না হব না তাপস যদি না মিলে তপস্বিনী।’

মন্ত্রবলে স্মোক নুইসান্স কাটিয়া গেল, গৃহিণী সহাস্যে বলিলেন—’হোআট পাহাড়?’

আমি। ডালহাউসি। অনেক দূর।

গৃহিণী। হ্যাং ডালহাউসি। দার্জিলিং চল। আমার ত্রিশ ছড়া পাথরের মালা না কিনলেই নয়, আর চার ডজন ঝাঁটা। আর অত দাম দিয়ে গলায় দেবার শুঁয়োপোকা কেনা হ’ল—সেই যে বোআ না কি বলে—আর হীরে—বসানো চরকা—ব্রোচ—তা তো এ পর্যন্ত পরতেই পেলুম না। তোমার সেই ডালকুত্তো পাহাড়ে সেসব দেখবে কে? দার্জিলিং—এ বরঞ্চ কত চেনাশোনা লোকের সঙ্গে দেখা হবে। টুনি—দিদি, তার ননদ, এরা সব সেখানে আছে। সরোজিনীরা, সুকু—মাসী, এরাও গেছে। মংকি মিত্তিরের বউ তার তেরোটা এঁড়িগেঁড়ি ছানাপোনা নিয়ে গেছে।

যুক্তি অকাট্য, সুতরাং দার্জিলিং যাওয়াই স্থির হইল।

দার্জিলিং—এ গিয়া দেখিলাম, মেঘে বৃষ্টিতে দশদিক আচ্ছন্ন। ঘরের বাহির হইতে ইচ্ছা হয় না, ঘরের মধ্যে থাকিতে আরও অনিচ্ছা জন্মে। প্রাতঃকালের আহার সমাধা করিয়া পায়ে মোটা বুট এবং আপাদমস্তক ম্যাকিনটশ পরিয়া বেড়াইতে বাহির হইয়াছি।….জনশূন্য ক্যালকাটা রোডে একাকী পদচারণ করিতে করিতে ভাবিতেছিলাম—অবলম্বনহীন মেঘরাজ্যে আর তো ভাল লাগে না…এমন সময় অনতিদূরে—

এই পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথে সহিত আশ্চর্য রকম মিল আছে। কিন্তু আমার অদৃষ্ট অন্যপ্রকার—বদ্রাওনের নবাব গোলাম কাদের খাঁর পুত্রীর সাক্ষাৎ পাইলাম না। দেখা হইল ডুমরাওনের মোক্তার নকুড় চৌধুরীর সঙ্গে, যিনি সম্পর্কনির্বিশেষে আত্মীয়—অনাত্মীয় সকলেরই সরকারী মামা।

নকুড়—মামা পথের পার্শ্বস্থিত খাদের ধারে একটা বেঞ্চে বসিয়া আছেন। তাঁর মাথায় ছাতা, গলায় কম্ফর্টার, গায়ে ওভারকোট, চক্ষুতে ভ্রূকুটি, মুখে বিরক্তি। আমাকে দেখিয়া কহিলেন—’ব্রজেন নাকি?’

বলিলাম—’আজ্ঞে হ্যাঁ। তারপর, আপনি হঠাৎ দার্জিলিং—এ? বাড়ির সব ভাল তো? কেষ্টার খবর কি—বেনারসেই আছে নাকি? কি করছে সে আজকাল?’—কেষ্ট নকুড়—মামার আপন ভাগিনেয়, বেনারসের বিখ্যাত যাদব ডাক্তারের একমাত্র পুত্র, পিতৃমাতৃহীন, বয়স চব্বিশ—পঁচিশ। সে একটু পাগলাটে লোক, নকুড়—মামাকে বড় একটা গ্রাহ্যই করে না, তবে আমাকে কিছু খাতির করে।

নকুড়—মামা কহিলেন—’সব বলছি। তুমি আগে একটা কথার জবাব দাও দিকি। এই দার্জিলিং—এ লোকে আসে কি করতে হ্যাঁ? ঠাণ্ডা চাই? কলকাতায় তো আজকাল টাকায় এক মন বরফ মেলে, তারই গোটাকতক টালির ওপর অয়েলক্লথ পেতে শুলেই চুকে যায়, সস্তায় শীতভোগ হয়। উঁচু চাই—তা না হ’লে শৌখিন বাবুদের বেড়ানো হয় না? কেন রে বাপু, দু—বেলা তালগাছে চড়লেই তো হয়। যত—সব হতভাগা—।’

এই পৃথিবীটা যখন কাঁচা ছিল তখন বিশ্বকর্মা তাহাকে লইয়া একবার আচ্ছা করিয়া ময়দা—ঠাসা করিয়াছিলেন। তাঁর দশ আঙুলের গাঁট্টার ছাপ এখনও রহিয়া গিয়া স্থানে স্থানে পর্বত উপত্যকা নদী জলধি সৃষ্টি করিয়াছে। বিশ্বকর্মার একটি বিরাট চিমটির ফল এই হিমালয় পর্বত। নাই দিলে কুকুর মাথায় ওঠে,—ভগবানের আশকারা পাইয়া মানুষ হিমালয়ের বুকে চড়িয়া দার্জিলিং—এ বাসা বাঁধিয়াছে। নকুড়—মামা ধর্মভীরু লোক, অতটা বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না।

আমি বলিলাম—’কি জানেন নকুড়—মামা, কষ্ট পাবার যে আনন্দ, তাই লোকে আজকাল পয়সা খরচ করে কেনে। অমৃত বোস লিখেছে—

ভাগ্যিস আছিল নদী জগৎ সংসারে

তাই লোকে যেতে পারে পয়সা দিয়ে ওপারে।

দার্জিলিং আছে তাই লোকের পয়সা খরচ ক’রে পাহাড় ডিঙোবার বদখেয়াল হয়েছে। তবে এইটুকু আশার কথা—’এখানে মাঝে মাঝে ধস নাবে।’

মামা ত্রস্ত হইয়া খাদের কিনারা হইতে সরিয়া রাস্তার অপেক্ষাকৃত নিরাপদ প্রান্তে আসিয়া বলিলেন—’উচ্ছন্ন যাবে। এটা কি ভদ্দর লোকের থাকবার দেশ? যখন—তখন বৃষ্টি, বাসা থেকে বেরুলে তো দশ তলার ধাক্কা, দু—পা হাঁটো আর দম নাও। তাও সিঁড়ি নেই, হোঁচট খেলে তো হাড়গোড় চূর্ণ। চললে হাঁপানি, থামলে কাঁপুনি—কেন রে বাপু?’

নকুড়—মামা চারিদিকে একবার ভীষণ দৃষ্টিতে চাহিলেন। সময়টা যদি সত্য ত্রেতা অথবা দ্বাপর যুগ হইত এবং মামা যদি মুনি ঋষি বা ভস্মলোচন হইতেন, তবে এতক্ষণে সমস্ত দার্জিলিং শহর সাহারা মরুভূমি অথবা ছাইগাদা হইয়া যাইত। আমি বলিলাম—’তবে এলেন কেন?’

নকুড়। আরে এসেছি কি সাধে। কেষ্টার স্বভাব জানো তো? লেখাপড়া শিখলি, বে—থা কর, বিষয় আশয় দেখ—রোজগার তো আর করতে হবে না। সে সব নয়। দিনকতক খেয়াল হ’ল, ছবি আঁকলে। তার পর আমসত্ত্বর কল ক’রে কিছু টাকা ওড়ালে। তার পর কলকাতায় গিয়ে কতকগুলো ছোঁড়ার সর্দার হ’য়ে একটা সমিতি করলে। তারপর বম্বে গেল, সেখান থেকে আমাকে এক আর্জেন্ট টেলিগ্রাম। কি হুকুম? না এক্ষুনি দার্জিলিং যাও, মুন—শাইন ভিলায় ওঠ, আমিও যাচ্ছি, বিবাহ করতে চাই। কি করি, বড়লোক ভাগনে, সকল আবদার শুনতে হয়। এসে দেখি—মুন—শাইন ভিলায় নরক গুলজার। বরযাত্রীর দল আগে থেকে এসে ব’সে আছে। সেই কচি—সংসদ,—কেষ্টা যার প্রেসিডেণ্ট।

আমি। পাত্রী ঠিক হয়েছে?

নকুড়। আরে কোথায় পাত্রী! এখানে এসে হয়তো একটা লেপচানী কি ভুটানী বিয়ে করবে।

আমি। কচি—সংসদের সদস্যরা কিছু জানে না?

নকুড়। কিচ্ছু না। আর জানলেই বা কি, তাদের কথাবার্তা আমি মোটেই বুঝতে পারি না, সব যেন হেঁয়ালি। তবে তারা খায়—দায় ভাল, আমার সঙ্গে তাদের ঐটুকুই সম্বন্ধ। কেষ্টবাবাজী আজ বিকেলে পৌঁছবেন। সন্ধ্যেবেলা যদি এস, তবে সবটা টের পাবে, সংসদের সঙেদের সঙ্গেও আলাপ পরিচয় হবে।

কচি—সংসদের কথা পূর্বে শুনিয়াছি। এদের সেক্রেটারি পেলব রায় আমাদের পাড়ার ছেলে, তার পিতৃদত্ত নাম পেলারাম। বি.এ. পাস করিয়া ছোকরার কচি এবং মোলায়েম হইবার বাসনা হইল। সে গোঁফ কামাইল, চুল বাড়াইল এবং লেডি—টাইপিস্টের খোঁপার মতন মাথার দু—পাশ ফাঁপাইয়া দিল। তারপর মুগার পাঞ্জাবি গরদের চাদর, সবুজ নাগরা ও লাল ফাউণ্টেন পেন পরিয়া মধুপুরে গিয়া আশু মুখুজ্যেকে ধরিল—ইউনিভার্সিটির খাতাপত্রে পেলারাম রায় কাটিয়া যেন পেলব রায় করা হয়। স্যার আশুতোষ এক ভলুম এনসাইক্লোপিডিয়া লইয়া তাড়া করিলেন। পেলারাম পলাইয়া আসিল এবং বি.এ ডিপ্লোমা বাক্সে বন্ধ করিয়া নিরুপাধিক পেলব রায় হইল। তারই উদ্যমে কচি—সংসদ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তবে যতদূর জানি কেষ্টই সমস্ত খরচপত্র যোগায়। এই কচি—সংসদের উদ্দেশ্য কি আমার ঠিক জানা নাই। শুনিয়াছি এরা যাকে তাকে মেম্বার করে না এবং নূতন মেম্বারের দীক্ষাপ্রণালীও এক ভয়াবহ ব্যাপার। গভীর পূর্ণিমা নিশীথে সমবেত সদস্যমণ্ডলীর করস্পর্শ করিয়া দীক্ষার্থী ষোলটি ভীষণ শপথ গ্রহণ করে। সঙ্গে সঙ্গে ষোল টিন সিগারেট পোড়ে এবং এনতার চা খরচ হয়।

অনেক বেলা হইয়াছে, মেঘও কাটিয়া গিয়াছে। সন্ধ্যার সময় নিশ্চয়ই মুন—শাইন ভিলায় যাইব বলিয়া নকুড়—মামার নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম।

গৃহিণী তিন ছড়া পাঁচ সিকা দামের চুনি—পান্নার মালা উপর্যুপরি গলায় পরিয়া বলিলেন— ‘দেখ তো, কেমন মানাচ্ছে।’

আমি বলিলাম—’চমৎকার। যেন পরস্ত্রী।’

গৃহিণী। তুমি একটি ক্যাড। পরস্ত্রী না হ’লে বুঝি মনে ধরে না?’

আমি। আরে চট কেন। পরকীয়াতত্ত্ব অতি উঁচুদরের জিনিস। তার মহিমা বোঝা যার তার কম্ম নয়, তবে যে নিজের স্ত্রীকে পরস্ত্রীর মতন নিত্য—নূতন ধরি ধরি ধরিতে না পারি— দেখে, সে অনেকটা এগিয়েছে। রাধাকৃষ্ণই হচ্ছেন মডেল প্রেমিক। ফ্রয়েড বলেছেন—

গৃহিণী। ড্যাম ফ্রয়েড—অ্যাণ্ড রাধাকৃষ্ণ মাথায় থাকুন। আমাদের মতন মুখখু লোকের সীতারামই ভাল।

আমি। কিন্তু রাম যে সীতাকে দু—দুবার পোড়াতে চাইলেন তার কি?

গৃহিণী। সে ত লোকনিন্দেয় বাধ্য হ’য়ে। ত্রেতাযুগের লোকগুলো ছিল কুচুণ্ডে রাসকেল।

আমি। তা—তিনি ভরতকে রাজ্য দিয়ে সীতাকে নিয়ে আবার বনে গেলেই পারতেন।

গৃহিণী। সেই আহ্লাদে প্রজারা যে রামকে ছাড়তে চাইলে না।

আমি। বাঃ, তুমি আমার চাইতে ঢের বড় উকিল। আমি তোমাকে রামচন্দ্রের তরফ থেকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। কিন্তু ভাগ্যিস তিনি সীতার মতন বউ পেয়েছিলেন তাই নিস্তার পেয়ে গেলেন। তোমার পাল্লায় পড়লে অযোধ্যা শহরটাকেই ফাঁসি দিতে হ’ত।

গৃহিণী। কেন, আমি কি শূর্পনখা না তাড়কা রাক্ষসী?

আমি। সীতা ছিলেন গোবেচারী লক্ষ্মীমেয়ে। তোমার মতন আবদেরে নয়।

গৃহিণী। সোনার হরিণ কে চেয়েছিল মশায়? কত ওজন তার খোঁজ রাখ? যদি ফাঁপা হয়, তবু পাঁচ হাজার ভরি।

আমি। আচ্ছা, আচ্ছা, তোমারই জিত। আর শুনেছ, কেষ্ট যে এখানে বিয়ে করতে আসছে। সেই কাশীর কেষ্ট।

গৃহিণী। হুরে! ভাগ্যিস খানকতক গহনা এনেছি। কিন্তু আশ্বিন মাসে লগ্ন কই?

আমি। প্রেমের তেজ থাকলে লগ্নে কি আসে যায়। তবে পাত্রীটি কে তা কেউ জানে না। হয়তো এখনও পাত্রীই স্থির হয় নি, যদিও বরযাত্রীর দল হাজির।

গৃহিণী। গ্যাড! শুনেছিলুম কেষ্টর বাপের ইচ্ছে ছিল টুনি—দিদির ননদের সঙ্গে কেষ্টর বিয়ে দিতে। সে মেয়ে তো এখানেই আছে বড়—সড়ও হয়েছে। তারও বাপ—মা নেই, তার দাদা—টুনি—দির বর ভুবনবাবু—তিনিই এখন অভিভাবক।

আমি। তা বলতে পারি না। কেষ্টর মতিগতি বোঝা শিবের অসাধ্য। যাই হ’ক, সন্ধ্যার সময় একবার কেষ্টর বাসায় যাব।

মনোহারিণী সন্ধ্যা। জনবিরল পথ দিয়া চলিয়াছি। শহরের সর্বত্র—উপরে, আরও উপরে, নীচে, আরও নীচে— স্তরে স্তরে অগণিত দীপমালা ফুটিয়া উঠিয়াছে। রাস্তার দু—ধারে ঝোপে জঙ্গলে পাহাড়ী ঝিঁঝির অলৌকিক মূর্ছনা ষড়জ হইতে নিষাদে লাফাইয়া উঠিতেছে। পরিষ্কার আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে, কুয়াশার চিহ্নমাত্র নাই। ঐ মুন—সাইন ভিলা।

কিসের শব্দ? দার্জিলিং শহরে পূর্বে শিয়াল ছিল না। বর্ধমানের মহারাজা যে কটা আনিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলেন তারা কি মুন—সাইন ভিলায় উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছে? না, শিয়াল নয়, কচি—সংসদ গান গাহিতেছে। গানের কথা ঠিক বোঝা যাইতেছে না, তবে আন্দাজে উপলব্ধি করলাম, এক অচেনা অজানা অচিন্ত্যনীয় অরক্ষণীয়া বিশ্ব—তরুণীর উদ্দেশ্যে কচি—গণ হৃদয়ের ব্যথা নিবেদন করিতেছে। হা নকুড়—মামা, তোমার কপালে এই ছিল?

আমাকে দেখিয়া সংসদ গান বন্ধ করিল। মামা ও কেষ্টকে দেখিলাম না। কেষ্ট আজ বিকালে পৌঁছিয়াছে, কিন্তু কোথায় উঠিয়াছে কেহ জানে না। শীঘ্রই সে মুন—শাইন ভিলায় আসিবে এরূপ সংবাদ পাওয়া গিয়াছে।

পেলব রায় আমাকে খাতির করিয়া বসাইল এবং সংসদের অন্যান্য সভ্যগণের সহিত পরিচয় করাইয়া দিল, যথা—

শিহরণ সেন

বিগলিত ব্যানার্জি

অকিঞ্চিৎ কর

হুতাশ হালদার

দোদুল দে

লালিমা পাল (পুং)

এদের নাম কি অন্নপ্রাশনলব্ধ না সজ্ঞানে স্বনির্বাচিত? ভাবিলাম জিজ্ঞাসা করি; কিন্তু চক্ষুলজ্জা বাধা দিল। লালিমা পাল মেয়ে নয়। নাম শুনিয়া অনেকে ভুল করে, সেজন্য সে আজকাল নামের পর ‘পুং’ লিখিয়া থাকে।

হঠাৎ দরজা ঠেলিয়া নকুড়—মামা ঘরে প্রবেশ করিলেন। তাঁর পিছনে ও কে? এই কি কেষ্ট? আমি একাই চমকিত হই নাই, সমগ্র কচি—সংসদ অবাক হইয়া দেখিতে লাগিল। হুতাশ বেচারা নিতান্ত ছেলেমানুষ, সবে সিগারেট খাইতে শিখিয়াছে,—সে আঁতকাইয়া উঠিল।

কেষ্টর আপাদমস্তক বাঙালীর আধুনিক বেশবিন্যাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিতেছে। তার মাথার চুল কদম্বকেশরের মতন ছাঁটা, গোঁফ নাই কিন্তু ঠোঁটের নীচে ছোট একগোছা দাড়ি আছে, গায়ে সবুজ রঙের খাটো জামা—তাতে বড় বড় সাদা ছিট, কোমরে বেল্ট, মালকোঁচা—মারা বেগনী রঙের ধুতি, পায়ে পট্টি ও বুট, হাতে একটি মোটা লাঠি বা কোঁতকা, পিঠে ক্যাম্বিসের ন্যাপস্যাক স্ট্রাপ দিয়া বাঁধা।

আমিই প্রথমে কথা কহিলাম—’কেষ্ট, একি বিভীষিকা?’

কেষ্ট বলিল—’প্রথমটা তাই মনে হবে, কিন্তু যখন বুঝিয়ে দেব তখন বলবেন হ্যাঁ কেষ্ট ঠিক করেছে। ব্রজেন—দা, জীবনটা ছেলেখেলা নয়, আর্ট অ্যাণ্ড এফিশেন্সি।’

আমি। কিন্তু চেহারাটা অমন ধরলে কেন?

কেষ্ট। শুনুন! মানুষের চুলটা অনাবশ্যক, শীততাপ নিবারণের জন্য যেটুকু দরকার ঠিক ততটুকু রেখেছি। এই যে দেখছেন দাড়ি, একে বলে ইম্পিরিয়াল, এর উদ্দেশ্য নাকটা ব্যালান্স করা। আপনারা সাদা ধুতির ওপর ঘোর রঙের জামা পরেন—অ—ফুল। তাতে চেহারাটা টপ—হেভি দেখায়। আমার পোশাক দেখুন—প্লাম ভায়োলেট অ্যাণ্ড সেজ গ্রীন, হোয়াইট স্পটস—কলার কনট্রাস্ট অ্যাণ্ড হারমনি। এইবার পাছাপাড় হাফপ্যাণ্ট ফরমাশ দিয়েছি, তাতে ওয়েস্ট—লাইন আরও ইমপ্রুভ করবে। এই যে দেখছেন লাঠি, এতে বাঘ মারা যায়। এই যে দেখছেন পিঠের ওপর বোঁচকা, এতে পাবেন না এমন জিনিস নেই। আমি স্বাবলম্বী, স্বয়ংসিদ্ধ, বেপরোয়া।

এই পর্যন্ত বলিয়া কেষ্ট দুই পকেট হইতে দুই প্রকার সিগারেট বাহির করিল এবং যুগপৎ টানিতে টানিতে বলিল—’পারেন এ রকম? একটা ভার্জিনিয়া একটা টার্কিশ। মুখে গিয়ে ব্লেণ্ড হচ্ছে।’

নকুড়—মামা চক্ষু মুদিয়া অগ্নিগর্ভ শমীবৃক্ষবৎ বসিয়া রহিলেন। তাঁহার অভ্যন্তরে বিস্ময় ও ক্রোধ ধিকিধিকি জ্বলিতেছে।

পেলব রায় বলিল—’কেষ্টবাবু, আপনি না কচি—সংসদের সভাপতি? আপনি শেষটায় এমন হলেন?’

কেষ্ট। কচি ছিলুম বটে, কিন্তু এখন পাকবার সময় হয়েছে।

আমি। নিশ্চয়ই, নইলে দরকচা মেরে যাবে। যাক ওসব কথা,—কেষ্ট, তুমি নাকি বে করবে?’

কেষ্ট। সেই পরামর্শ করতেই তো আসা। আপনিও এসেছেন, খুব ভালই হয়েছে। প্রথমে আমি প্রেম সম্বন্ধে দু—চার কথা বলতে চাই।

আমি। নকুড়—মামা, আপনি ওপরে গিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ুন—আর ঠাণ্ডা লাগাবেন না। যা স্থির হয় পরে জানাব এখন। তার পর কেষ্ট, প্রেম কি প্রকার?—একটু চা হ’লে যে হ’ত।

পেলব হাঁকিল—’বোদা—বোদা—।’ বোদা বলিল—’জু।’

বোদা কেষ্টর চাকর, নেপালী ক্ষত্রিয়। তাহার মুখ দেখিলেই বোঝা যায় যে সে চন্দ্রবংশাবতংস। পেলব তাহাকে দশ পেয়ালা চা আনিতে বলিল।

কেষ্ট বলিতে লাগিল—’প্রেম সম্বন্ধে লোকের অনেক বড় বড় ধারণা আছে। চণ্ডীদাস বলেছেন—নিমে দুধ দিয়া একত্র করিয়া ঐছন কানুর প্রেম। রাশিয়ান কবি ভডকাউইস্কি বলেন—প্রেম একটা নিকৃষ্ট নেশা। মেটস্নিকফ বলেন—প্রেমে পরমায়ু বৃদ্ধি হয়, কিন্তু ঘোল আরও উপকারী। মাদাম দে সেইয়াঁ বলেন—প্রেমই নারীর একমাত্র অস্ত্র যার দ্বারা পুরুষের যথাসর্বস্ব কেড়ে নেওয়া যায়। ওমর খায়য়াম লিখেছেন—প্রেম চাঁদের শরবত, কিন্তু তাতে একটু শিরাজী মিশুতে হয়। হেনরি—দি—এইটথ বলেছিলেন—প্রেম অবিনশ্বর, একটি প্রেমপাত্রী বধ করলে পর পর আর দশটি এসে জোটে। ফ্রয়েড বলেন—প্রেম হচ্ছে পশু—ধর্মের ওপর সভ্যতার পলেস্তারা। হ্যাভেলক এলিস বলেন—’

আমি। ঢের হয়েছে। তুমি নিজে কি বল তাই শুনতে চাই।

কেষ্ট। আমি বলি—প্রেম একটা ধাপ্পাবাজি, যার দ্বারা স্ত্রী পুরুষ পরস্পরকে ঠকায়।

কচি—সংসদ একটা অস্ফুট আর্তনাদ করিল। হুতাশ বুকে হাত দিয়া ক্ষীণ স্বরে বলিল—’ব্যথা, ব্যথা।’

কেষ্ট বলিল—’হুতো, অমন করছিস কেন রে? বেশী সিগারেট খেয়েছিস বুঝি? আর খাস নি?’

লালিমা পালের গলা হইতে একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ নির্গত হইল—জাপানী ঘড়ি বাজিবার পূর্বে যে—রকম করে সেই প্রকার। তার গলাটা স্বভাবতঃ একটু শ্লেষ্মাজড়িত। কলিকাতায় থাকিতে সে কোকিলের ডিমের সঙ্গে মকরধ্বজ মাড়িয়া খাইত, কিন্তু এখানে অনুপান অভাবে ঔষধ বন্ধ আছে। কেষ্ট তাহাকে উৎসাহিত করিয়া বলিল—’নেলো, তোর যদি প্রেম সম্বন্ধে কিছু বলবার থাকে তো বল না।’

লালিমা বলিল—’আমার মতে প্রেম হচ্ছে একটা—একটা—একটা—’

আমি সজেস্ট করিলাম—’ভূমিকম্প।’

কেষ্ট। এগস্যাক্টলি। প্রেম একটা ভূমিকম্প, ঝঞ্ঝাবাত, নায়াগ্রা—প্রপাত, আকস্মিক বিপদ—যাতে বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়।

লালিমা আর একবার বাজিবার উপক্রম করিল, কিন্তু তার প্রতিবাদ নিষ্ফল জানিয়া অবশেষে নিরস্ত হইল।

আমি বলিলাম—’তবে তুমি বিয়ে করতে চাও কেন? কত টাকা পাবে হে?’

কেষ্ট। এক পয়সাও নেব না। আমি বিবাহ করতে চাই জগতকে একটা আদর্শ দেখাবার জন্য। জগতে দু—রকম বিবাহ চলিত আছে। এক হচ্ছে—আগে বিবাহ, তার পরে প্রেম, যেমন সেকেলে হিঁদুর। আর এক রকম হচ্ছে—আগে প্রেম, তার পর বিবাহ, অর্থাৎ কোর্টশিপের পর বিবাহ। আমি বলি—দু—ইভুল। আগে বিবাহ হ’লে যদি বনিবনা না হয়, তখন কোথা থেকে প্রেম আসবে? আর—আগে প্রেম, পরে বিবাহ, এও সমান খারাপ; কারণ কোর্টশিপের সময় দু—পক্ষই প্রেমের লোভে নিজের দোষ ঢেকে রাখে। তার পর বিবাহ হয়ে গেলে যখন গলদ বেরিয়ে পড়ে তখন টু—লেট।

আমি। ওসব তো পুরনো কথা বলছ। তুমি কি ব্যবস্থা করতে চাও তাই বল!

কেষ্ট। আমার সিস্টেম হচ্ছে—প্রেমকে একদম বাদ দিয়ে কোর্টশিপ চালাতে হবে, কারণ প্রেমের গন্ধ থাকলেই লুকোচুরি আসবে। চাই—দু’জন নির্লিপ্ত সুশিক্ষিত নরনারী, আর একজন বিচক্ষণ ভুক্তভোগী মধ্যস্থ ব্যক্তি—যিনি নানা বিষয়ে উভয় পক্ষের মতামত বেশ করে মিলিয়ে দেখবেন। আমি একটা লিস্ট করেছি। এতে আছে—বেশভূষা, আহার্য, শয্যা, পাঠ্য, কলাচর্চা, বন্ধু—নির্বাচন, আমোদ—প্রমোদ, ইত্যাদি তিরানব্বইটি অত্যন্ত দরকারী বিষয়, যা নিয়ে স্বামী—স্ত্রীর হরদম মতভেদ হয়ে থাকে। প্রথমেই যদি এইসব মোকাবিলা হ’য়ে যায় এবং অধিকাংশ বিষয়ে দু—পক্ষের এক মত হয়, আর বাকী অল্পস্বল্প বিষয়ে একটা রফা করা চলে, তা হ’লে পরে গোলযোগের ভয় থাকবে না। কিন্তু খবরদার, গোড়াতেই প্রেম এসে না জোটে, তা হ’লেই সব ভণ্ডল হবে। শেষে যত খুশি প্রেম হ’ক তাতে আপত্তি নেই। এতদিন চলছিল—কোর্টশিপ, আর আমার সিস্টেম হচ্ছে—হাইকোর্টশিপ।

আমি। কোর্ট—মার্শাল বললে আরও ঠিক হয়। সিস্টেম তো বুঝলুম, কিন্তু এমন পাত্রী কে আছে যে তোমার এই এক্সপেরিমেন্টে রাজী হবে? তবে তুমি যে প্রেমের ভয় করছ সেটা মিথ্যে। তোমার ঐ মূর্তি দেখলে প্রেম বাপ বাপ ক’রে পালাবে।

কেষ্ট। পাত্রী আমি আজ ঠিক ক’রে এসেছি।

আমি। কে সেই হতভাগিনী?

কেষ্ট। ভুবন বোসের ভগ্নী, পদ্মমধু বোস।

আমি। আরে! আমাদের টুনি—দিদির ননদ? তাই বল। গিন্নী তা হ’লে ঠিক আন্দাজ করেছিলেন। কিন্তু শুনলুম তোমাদের বিয়ের কথা নাকি আগেই একবার হয়েছিল। এতে কেস প্রেজুডিসড হবে না?

কেষ্ট। মোটেই না। আমরা দু—পক্ষই নির্বিকার। ব্রজেন—দা, আপনাকেই মধ্যস্থ হ’তে হবে কিন্তু। আপনার লিগাল ম্যাট্রিমনিয়াল দু—রকম অভিজ্ঞতাই আছে, ভাল ক’রে জেরা করতে পারবেন।

আমি। রাজী আছি, কিন্তু মেয়েটা আমার ওপর না চটে।

কেষ্ট। কোন ভয় নেই, পদ্ম অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক।

আমি। লোকটি তো বুদ্ধিমান, কিন্তু মেয়েটি কেমন?

কেষ্ট। মজবুত ব’লেই তো বোধহয়। সাত মাইল হাঁটতে পারে, দু—ঘণ্টা টেনিস খেলতে পারে, মাস্কুলার ইনডেক্স খুব হাই, ফেটিগ—কোয়েফিশেণ্ট বেশ লো। সেলাই জানে, রান্না জানে, লজিক জানে, বাজে তর্ক করে না, ইকনমিক্স জানে, গান গাইবার সময় বেশী চেঁচায় না। তা হ’লে কাল সন্ধ্যেবেলা ভুবনবাবুর বাড়ি ঠিক যাবেন—লাভলক রোড, মডলিন কটেজ।

আমি প্রতিশ্রুতি দিয়া গৃহাভিমুখ হইলাম। মুন—শাইন ভিলার গেট পার হইতেই একটা কোলাহল কানে আসিল। আন্দাজে বুঝিলাম কচি—সংসদের রুদ্ধ বেদনা মুখরিত হইয়া কেষ্টকে গঞ্জনা দিতেছে। আমি আর দাঁড়াইলাম না।

সমস্ত শুনিয়া গৃহিণী মত প্রকাশ করিলেন—’রিপিং! পারসী থিয়েটারের চাইতেও ভাল। আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। যদি পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হয় তাতেও রাজী আছি।’

আমি বলিলাম—’কিন্তু তোমাকে তো শুনতে দেবে না। হাইকোর্টশিপ গোপনে হয়, ওইটুকুই সাধারণ কোর্টশিপের সঙ্গে মেলে। ঘরে থাকব শুধু আমি, কেষ্ট আর পদ্ম।’

গৃহিণী। আড়ি পাতব।

আমি। তার দরকার হবে না। সব কথাই প’রে শুনতে পাবে। আমার যে কান তাহা তোমার হউক।

গৃহিণী। যাই হ’ক আমিও যাব।

আমি। কিন্তু পরের ব্যাপারে তোমার ওরকম কৌতূহল তো ভাল নয়। ফ্রয়েড এর কি ব্যাখা করেন জান?

গৃহিণী। খবরদার, ও মুখপোড়ার নাম ক’রো না বলছি।

অগত্যা দুজনেই টুনি—দিদির বাসায় চলিলাম।

ভুবনবাবু ও টুনি—দিদি—এঁরা যেন সাংখ্যদর্শনের পুরুষ—প্রকৃতি। কর্তাটি কুঁড়ের সম্রাট, সমস্তক্ষণ ড্রেসিং গাউন পরিয়া ইজিচেয়ারে বসিয়া বই পড়েন ও চুরুট ফোঁকেন। গিন্নীটি ঠিক উলটো অসীম শক্তিময়ী, অঘটনঘটনপটিয়সী, মাছকোটা হইতে গাড়ি রিজার্ভ করা পর্যন্ত সব কাজ নিজেই করিয়া থাকেন, কথা কহিবার ফুরসত নাই। তাড়াতাড়ি অভ্যর্থনা শেষ করিয়াই অতিথিসৎকারের বিপুল আয়োজন করিতে রান্নাঘরে ছুটিলেন। পদ্ম আসিয়া প্রণাম করিল।

খাসা মেয়ে। কেষ্টা হতভাগা বলে কিনা মজবুত! একি হাতুড়ি না হামানদিস্তা? কচি—সংসদের মধ্যে বাস্তবিক যদি কেউ নিরেট কচি থাকে, তবে সে কেষ্ট—যতই প্রেমের বক্তৃতা দিক। ঋষ্যশৃঙ্গের একটা শিং ছিল, কেষ্টর দুটো শিং। কিন্তু এই সুশ্রী বুদ্ধিমতী সপ্রতিভ মেয়েটি কেন এই গর্দভের খেয়ালে রাজী হইল? স্ত্রীজাতি বাঁদর—নাচ দেখিতে ভালবাসে। পদ্মর উদ্দেশ্য কি শুধু তাই? স্ত্রীচরিত্র বোঝা শক্ত। না, মনস্তত্ত্বের বইগুলো ভাল করিয়া পড়িতে হইবে।

হাইকোর্টশিপ আরম্ভ হইল। ঘরের পর্দা ভেদ করিয়া সুদূর রান্নাঘর হইতে টুনি—দিদি ও আমার গৃহিণীর উচ্চ হাসি এবং কাটলেট ভাজার গন্ধ আসিতেছে। আমি যথাসাধ্য গাম্ভীর্য সঞ্চয় করিয়া শুভকার্য আরম্ভ করিলাম—

‘এই মকদ্দমায় বাদী, প্রতিবাদী, অনুবাদী, সংবাদী, বিসংবাদী কে কে তা এখনও স্থির হয় নি। কিন্তু সেজন্য বিচার আটকাবে না, কারণ দুই সাক্ষী হাজির,—শ্রীমান কেষ্ট ও শ্রীমতী পদ্ম।—’

কেষ্ট বলিল—’ব্রজেন—দা, আপনি এই গুরু বিষয় নিয়ে আর তামাশা করবেন না—কাজ শুরু করুন।’

আমি। ব্যস্ত হও কেন—, আগে যথারীতি সত্যপাঠ করাই।—শ্রীমান কেষ্ট, তুমি শপথ ক’রে বল যে তোমার মধ্যে পূর্বরাগের কোন কমপ্লেক্স নেই। যদি থাকে তবে মকদ্দমা এখনই ডিসমিস হবে।

কেষ্ট। একদম নেই। পদ্ম যখন পাঁচ বছরের আর আমি যখন দশ বছরের, তখন ওকে যে—রকম দেখতুম এখনও ঠিক তাই দেখি। তবে আগে ওকে ঠেঙাতুম, এখন আর ঠেঙাই না।

আমি। শ্রীমতী পদ্ম, কেষ্টর প্রতি তোমার মনোভাব কি রকম তা জিজ্ঞেস ক’রে তোমায় অপমান করতে চাই না। কেষ্টর মূর্তিই হচ্ছে পূর্বরাগের অ্যাণ্টি—ডোট। কেষ্ট, এইবার তোমার সেই ফিরিস্তিটা দাও। বাপ! তিরানব্বইটা আইটেম! বেশভূষা— আহার্য—শয্যা—পাঠ্য—এ তো দেখছি পাক্কা পনেরো দিন লাগবে। দেখ, আজ বরঞ্চ আমি গোটাকতক বাছা বাছা প্রশ্ন করি, যদি অবস্থা আশাজনক বোধ হয় তবে কাল থেকে সিস্টেম্যাটিক টেস্ট শুরু হবে। আচ্ছা, প্রথমে আহার্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি—কারণ ওইটেই সবচেয়ে দরকারী, ফ্রয়েড যা—ই বলুন। কেষ্ট তুমি লঙ্কা খাও?

কেষ্ট। ঝাল আমার মোটেই সহ্য হয় না।

আমি। পদ্ম কি বল?

পদ্ম। লঙ্কা না হ’লে আমি খেতেই পারি না।

আমি। ব্যাড। প্রথমেই ঢেরা পড়ল। স্বামী—স্ত্রীর তো ভিন্ন হেঁশেল হ’তে পারে না। রফা করা চলে কিনা পরে স্থির করা যাবে। জলে লঙ্কা সেদ্ধ ক’রে দুজনকে খাইয়ে দেখে এমন একটা পার্সেণ্টেজ ঠিক করতে হবে যা দু—পক্ষেরই বরদাস্ত হয়। আচ্ছা—তোমরা চায়ে কে ক চামচ চিনি খাও?

কেষ্ট। এক।

পদ্ম। সাত।

আমি। ভেরি ব্যাড। আবার ঢেরা পড়ল।

কেষ্ট। আমি মেরে কেটে তিন চামচ অবধি উঠতে পারি। পদ্ম, তুমি একটু নাবো না।

আমি। খবরদার, সাক্ষী ভাঙাবার চেষ্টা ক’রো না। যা জিজ্ঞাসা করবার আমিই করব। আচ্ছা—কেষ্ট, তুমি কি—রকম বিছানা পছন্দ কর? নরম না শক্ত?

কেষ্ট। একটু শক্ত রকম, ধরুন দু—ইঞ্চি গদি। বেশী নরম হ’লে আমার ঘুমই হয় না।

পদ্ম। আমি চাই তুলতুলে।

আমি। ভেরি ভেরি ব্যাড। এই ফের ঢেরা দিলুম। আচ্ছা—কেষ্ট, পদ্মর চেহারাটা তোমার কি—রকম পছন্দ হয়?

কেষ্ট। তা মন্দ কি।

আমি সাক্ষীবিহ্বলকারী ধমক দিয়া বলিলাম—’ওসব ভাসা ভাসা জবাব চলবে না, ভাল ক’রে দেখ তারপর বল।’

পদ্ম লাল হইল। কেষ্ট অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া একটু বোকা—হাসি হাসিয়া বলিল—’খাখ—খাসা চেহারা। এঃ, পদ্ম আর সে পদ্ম নেই, একেবারে—’

আমি। বস বস—বাজে কথা ব’লো না। পদ্ম, এবারে তুমি কেষ্টকে দেখে বল।

পদ্ম ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া কেষ্টর প্রতি চকিত দৃষ্টি হানিয়া বলিল—’যেন একটি সঙ!’

কেষ্ট। তা—তা আমিই না—হয় মাথার চুলটা এক ইঞ্চি বাড়িয়ে ফেলব, আর দাড়িটাও না—হয় ফেলে দেব। আচ্ছা, এই হাত দিয়ে দাড়িটা চেপে রাখলাম—এইবার দেখ তো পদ্ম।

পদ্ম হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল।

আমি বলিলাম—’হোপলেস। আপত্তির প্রতিকার হ’তে পারে, কিন্তু বিদ্রূপের ওষুধ নেই।’

কেষ্ট একটু নরম হইয়া বলিল—’আপনিই তো যা—তা রিমার্ক ক’রে সব গুলিয়ে দিচ্ছেন।’

আমি। আচ্ছা বাপু, তুমি নিজেই না—হয় জেরা কর।

কেষ্ট প্রত্যালীঢ়পদে বসিয়া আস্তিন গুটাইয়া বলিল—’পদ্ম, এই দেখ আমার হাত। একে বলে বাইসেপ্স—এই দেখ ট্রাইসেপ্স। এইরকম জবরদস্ত গড়ন তোমার পছন্দ হয়, না ব্রজেন—দার মতন গোলগাল নাদুস—নুদুস চাও? তোমার মতামত জানতে পারলে আমি না—হয় আমার আদর্শ সম্বন্ধে ফের বিবেচনা করব।’

পদ্ম। তোমার চেহারা তুমি বুঝবে—আমার তাতে কি। আমি তো আর তোমায় দারোয়ান রাখছি না।

কেষ্ট। আচ্ছা, তোমার হাতটা দেখি একবার—কি রকম পাঞ্জার জোর—

কেষ্ট খপ করিয়া পদ্মার পদ্মহস্ত ধরিল। আমি বলিলাম—’হাঁ হাঁ—ও কি! সাক্ষীর ওপর হামলা! ওসব চলবে না—আমার ওপর যখন বিচারের ভার তখন যা করবার আমিই করব। তুমি ওই ওখানে গিয়ে বস।’

কেষ্ট অপ্রতিভ হইয়া বলিল—’বেশ তো, আপনিই ফের কোশচেন করুন।’

আমি। আর দরকার নেই। তোমাদের মোটেই মতে মিলবে না, রফা করাও চলবে না। আমি এই হুকুম লিখলুম—napoo, nothing doing। কেস এখন মুলতবী রইল। এক বৎসর নিজের নিজের মতামত বেশ ক’রে রিভাইজ কর, তারপর আবার অত্র আদালতে হাজির হইবা।

কেষ্ট এবার চটিয়া উঠিল। বলিল—’আপনি আমার সিস্টেম কিচ্ছু বুঝতে পারেন নি। আপনি যা করলেন সে কি একটা টেস্ট হ’ল?—শুধু ইয়ারকি। আপনাকে মধ্যস্থ মানাই ঝকমারি হয়েছে।’

আমিও খাপপা হইয়া বলিলাম—’দেখ কেষ্ট, বেশী চালাকি ক’রো না। আমি একজন উকিল, বার বৎসর প্র্যাকটিস করেছি, পনর বৎসর হ’ল বিবাহ করেছি, ঝাড়া একটি মাস সাইকলজি পড়েছি। কার সঙ্গে কার মতে মেলে তা আমার বিলক্ষণ জানা আছে। আর—তুমি তো নির্বিকার, তোমার অত রাগ কেন? দেখ দিকি, পদ্ম কেমন লক্ষ্মীমেয়ে, চুপটি ক’রে বসে আছে।’

কেষ্ট গজগজ করিতে লাগিল। এই সময় হঠাৎ ঘরের পর্দা ঠেলিয়া টুনি—দিদির ছোট খুকী প্রবেশ করিল।

আমি গম্ভীর স্বরে বলিলাম—’নারী তুমি কি চাও?’

খুকীর নারীত্বের দাবি অতি মহৎ এবং সমস্ত নারীসমাজের অনুধাবনযোগ্য। বলিল—’খাবেন চলুন, লুচি জুড়িয়ে যাচ্ছে।’

কেষ্ট কাহারও সহিত আর বাক্যালাপ করিল না, ভাল করিয়া খাইলও না। আহারান্তে আমি একাই নিজের বাসায় ফিরিলাম। গৃহিণী আজ এখানেই রাত্রি যাপন করিবেন।

পরদিন বেলা দশটার সময় গৃহিণী ফিরিয়া আসিয়া আপাদমস্তক মুড়ি দিয়া শুইয়া পড়িলেন। সভয়ে দেখিলাম তিনি কম্বলের ভিতর ক্ষণে ক্ষণে নড়িয়া উঠিতেছেন এবং অস্ফুট শব্দ করিতেছেন।

বলিলাম—’ফিক ব্যথাটা আবার ধরেছে বুঝি? ডাক্তার দাসকে ডাকব?’

গৃহিণী অতি কষ্টে বলিলেন—’না, কিছু দরকার নেই, ও আপনিই সেরে যাবে। হুঃ হুঃ হিঃ।’

হিস্টিরিয়া নাকি? ও উৎপাত তো ছিল না, নিশ্চয় বেচারা কল্যকার ব্যাপারে মনঃক্ষুণ্ণ হইয়াছে। আমার মতলব তো জানে না। মেয়েরা চায় রাতারাতি বিবাহটা স্থির হইয়া যাক। আরে অত ব্যস্ত হইলে কি চলে! কেষ্ট সবে বঁড়শি গিলিয়াছে, এখন তাকে আরও দিনকতক খেলাইতে হইবে।

বৈকালে মুন—শাইন ভিলায় যাইলাম—উদ্দেশ্য কেষ্টকে একটু ঠাণ্ডা করা। কিন্তু কেষ্টর দেখা পাইলাম না, মামাও নাই। কচি—সংসদের সভ্যগণ নিজ নিজ খাটে শুইয়া আছে, ডাকিলে সাড়া দিল না। তাহাদের দৃষ্টি উদাস,—নিশ্চয় একটা বড়—রকম ব্যথা পাইয়াছে।

বোদাকে জিজ্ঞাসা করিলাম—’বাবু কাঁহা?’

বোদার বদনচক্রে দর্শন, নিঃশ্বাস ও বাক্যনিঃসরণের জন্য যে কয়টি ছোট ছোট ছিদ্র আছে তাহা বিস্ফারিত হইল। বলিল—’বাবু বাগা।’

আঁ? কেষ্টবাবু ভাগা! কাঁহা ভাগা? নিশ্চয় ভুবনবাবুর বাড়িতে গিয়া হোগা।

‘বুবনবাবু, বাগ গিয়া! উনকি বিবি বাগ গিয়া। উনকি কোকী বাগ গিয়া। কোকীকা গোড়া বাগ গিয়া। গোরে—সি মিসিবাবা যো থি সো বি বাগ গিয়া।’ কেষ্ট পালাইয়াছে। ভুবনবাবু, তাঁহার বিবি, তাঁহার খুকী, খুকীর ঘোড়া এবং ফরসা—মতন মিসিবাবা—অর্থাৎ পদ্ম—সকলেই পালাইয়াছে। নকুড় মামা বোধ হয় খোঁজে বাহির হইয়াছেন। কচি সংসদ কিছুই জানে না, জিজ্ঞাসা করা বৃথা।

গৃহিণীর কাণ্ড মনে পড়িল। ফিক ব্যথাও নয়, হিস্টিরিয়াও নয়—শুধু হাসি চাপিবার চেষ্টা। তৎক্ষণাৎ বাসায় ফিরিলাম।

বলিলাম—’তুমিই যত নষ্টের গোড়া।’

গৃহিণী। আহা, কি আমার কাজের লোক! নিজে কিছুই করতে পারলেন না, এখন আমার দোষ।

আমি। তারপর ব্যাপারটা কি বল দিকি?

গৃহিণী প্রথমে একচোট হাসিয়া গড়াইয়া লইলেন। শেষে বলিলেন—’তুমি তো রাত সাড়ে দশটায় ফিরে গেলে। টুনি—দিদি আর আমি গল্প করতে লাগলুম— সে কত সুখ—দুঃখের কথা। রাত বারটার সময় দেখি— কেষ্ট টিপিটিপি আসছে। তার মুখ কাঁদো—কাঁদো, চাউনি পাগলের মতন। টুনিদি বললে—কেষ্ট, কি হয়েছে? কেষ্ট বললে, পদ্মর সঙ্গে বে না হ’লে সে আর এ প্রাণ রাখবে না, তার আর তর সইছে না। হয় পদ্ম—নয় কি একটা অ্যাসিড। আমি বললুম—তার আর চিন্তা কি, অ্যাসিড ডাক্তারখানায় পাওয়া যায়, আর পদ্ম তো মজুতই আছে। আগে সকাল হ’ক তারপর যা—হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে। কেষ্ট বলল—সে এক্ষুনি তার সঙের সাজ ফেলে দিয়ে ভদ্দর লোক সাজবে, কিন্তু অত লাফালাফির পর পাঁচ জনের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে? টুনি—দি বললে—কুছ পরোয়া নেই, কালকের মেলেই কলকাতায় পালিয়ে চল, গিয়েই বে দেব। পদ্ম বিগড়ে বসল। টুনি—দি বললে নে, নেঃ—নেকী। টুনি—দিকে জান তো, তার অসাধ্য কাজ নেই। সেই রাত্রেই মশাই মোট বাঁধা হয়ে গেল—এক—শ তেষট্টিটা লাগেজ। তারপর আজ সকালে তাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে এখানে চ’লে এলুম।’

বিবাহের পর দেড় মাস কেষ্ট আমার সঙ্গে লজ্জায় দেখা করে নাই—সবে কাল আসিয়া ক্ষমা চাহিয়া গিয়াছে। আমি তাহাকে সর্বান্তঃকরণে মার্জনা করিয়াছি এবং মনস্তত্ত্ব হইতে নজির দেখাইয়া বুঝাইয়া দিয়াছি যে তাহার লজ্জিত হইবার কোনও কারণ নাই। কেষ্টর মনের আড়ালে যে আর একটা উপমন এতদিন ছাই—চাপা ছিল তাহারই ভূমিকম্পের ফলে সে বাঁদর নাচিয়াছে।

কচি—সংসদ ছত্রভঙ্গ হইয়া গিয়াছে। কেষ্ট আবার একটা নূতন ক্লাব স্থাপন করিয়াছে—হৈহয় সংঘ। ইতিহাস—প্রসিদ্ধ হৈহয় ক্ষত্রিয়গণের সঙ্গে ইহার কোনও সম্বন্ধ নাই। ইহার মেম্বার—সস্ত্রীক আমি ও কেষ্ট। এই বড়দিনের বন্ধে আমরা হাওড়া হইতে পেশাওআর পর্যন্ত হইহই করিতে যাইব।