ওঙ্কারধামের যাত্রী
ধান খেতের পর ধান খেত, তারপর আবার ধান খেত! সবুজের পর সবুজ আর সবুজ! যতদূর চোখ চলে খালি দেখা যায় সমতল ক্ষেত্র! মাঝে মাঝে নারিকেল গাছ, কলা গাছ আর বাঁশ বনের ভিড়৷ তারই ভিতর দিয়ে সোজা চলে গিয়েছে একটি সুদীর্ঘ রাঙা রাস্তা৷ এত সোজা ও লম্বা রাস্তা সহজে নজরে পড়ে না!
মাঝে মাঝে দেখা দেয় নদী৷ কোথাও আছে সাঁকো, কোথাও খেয়া ঘাটে নৌকোয় চড়ে পার হতে হয়৷
মাঝে মাঝে দেখা দেয় ছোটো ছোটো গ্রাম৷ সরাইখানার সামনে রয়েছে খাবার সাজানো৷ পথের ধারে উবু হয়ে বসে আনামি স্ত্রীলোকেরা চিংড়িমাছ, কমলালেবু ও নারিকেল প্রভৃতি বিক্রি করছে৷ ধুলোর স্তূপে খেলা করছে নগ্ন বা নেংটি-পরা শিশুরা৷
সেই সিধে রাঙা রাস্তার উপর দিয়ে ছুটছে তিনখানা মোটর৷ একখানা গাড়িতে আছে জয়ন্ত ও মানিক, পরের গাড়িতে অমলবাবু ও সুন্দরবাবু, তার পরের গাড়িতে দরকারি জিনিসপত্র এবং চাকরবাকর৷
সুন্দরবাবু বলছিলেন, ‘এ যে দেখছি অন্নপূর্ণার স্বদেশ! পাশাপাশি একটানা এত বেশি ধানের খেত কেউ কি কখনো চোখে দেখেছে? হুম!’
অমলবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ৷ এ দেশ এমনি উর্বর বলেই একদল ভারতবাসী সমুদ্র পার হয়ে এখানে এসে নূতন এক রাজ্যস্থাপন করে ছিলেন, নতুন এক সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন৷’
-‘হুম, ওসব বাজে উপকথা! আমি বিশ্বাস করি না৷’
-‘না সুন্দরবাবু, সেই লুপ্ত সভ্যতার শেষ চিহ্ন যখন স্বচক্ষে দেখবেন, তখন আর অবিশ্বাসের কথাই তুলতে পারবেন না৷ আচ্ছা, সেই সভ্যতার কিছু কিছু কথা আগেই আপনাকে শুনিয়ে রাখছি৷ এ দেশটা আসলে শ্যামদেশেরই অঙ্গ, খুব অল্পদিনই ফরাসিদের অধিকারে এসেছে৷ আজ ফরাসিরা এখানে পথঘাট বানিয়েছে, নিবিড় বন কেটে সাফ করেছে বটে, কিন্তু সেদিন পর্যন্ত এটা ছিল বাঘ আর হাতির নিজস্ব মুল্লুক, এখানকার দুর্ভেদ্য অরণ্যের গভীর রহস্যের মধ্যে অতি সাহসী মানুষও পদার্পণ করতে ভয়ে শিউরে উঠত! সত্তর বছর আগেও পৃথিবী ওঙ্কারধামের নাম শোনেনি৷
‘সতেরো শতাব্দীতে পর্তুগিজ মিশনারিরা শ্যামদেশে এসেছিলেন ধর্ম প্রচার করতে৷ তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অরণ্যে ভ্রমণ করতে করতে পাহাড়ের মতো প্রকাণ্ড মন্দিরের গগনস্পর্শী চূড়া ও বিপুল এক নগরের ধ্বংসাবশেষ দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন৷ ইউরোপ ফিরে তাঁরা অনেকের কাছে এই বিস্ময়কর কাহিনী প্রচার করেন৷ মিশরের পিরামিডের মতন বড়ো আশ্চর্য মন্দির! বাবিলনের মতন বিরাট জনপদ! সবাই গল্প শুনলে বটে, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করলে না৷ পরে সে গল্পও লোকে ভুলে গেল৷ বড়ো বড়ো বট গাছ, বাঁশ বন, নারিকেল গাছ ও নানাজাতীয় লতাগুল্ম এই লুপ্ত হিন্দুসভ্যতার শেষ চিহ্নগুলিকে এমন ভাবে ঢেকে রইল যে, বাইরের কোনো কৌতূহলী চক্ষু আর তাদের কোনো খোঁজই পেল না৷
‘দিনের পর দিন যায়-বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ! ফরাসিরা প্রথমে ব্যাবসাসূত্রে ইন্দো-চীনে পদার্পণ করলে৷ লোকের মুখে জনপ্রবাদ শোনা গেল, অরণ্যের অন্ধকারে যেখানে সূর্যালোক সোনা ছড়ায় না সেখানে অজ্ঞাতবাস করছে এক অদৃশ্য রাজ্যের অদ্ভুত রাজধানী, মাইলের পর মাইলব্যাপী নগরের পর নগর৷ অপূর্ব মন্দির, বিচিত্র প্রাসাদ! কোনো কোনো পুরাতত্ত্ববিদ পণ্ডিতও সেই সব প্রবাদ শুনলেন৷ অনেকেই বললেন, এই প্রবাদ যদি সত্য হয় তাহলে বলতে হবে, ওখানে আগে কোনো বিপুল সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল৷ মন্দির, প্রাসাদ, নগর নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, কিন্তু এমন এক বিস্ময়কর সভ্যতার পিছনে কোনো চিহ্ন না রেখে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে না! বনবাসে লুকিয়ে থাকতে পারে কেবল অসভ্যতাই৷
‘কিন্তু চীনদেশের পুরাতন ঐতিহাসিক পুথিপত্রেও কাম্বোজের এক আশ্চর্য সভ্যতার কাহিনি পাওয়া যায়! Mouhot একজন ফরাসি ভদ্রলোকের নাম৷ তাঁর কৌতূহল জাগল৷ পলাতক এই সভ্যতাকে গ্রেপ্তার করার জন্যে গোয়েন্দার মতন তিনি বাঘ আর হাতির মুল্লুকে প্রবেশ করলেন৷ বাঘেরা জঙ্গলের ছায়ায় বসে, হাতিরা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে এবং অজগরেরা গাছের ডালে ডালে ঝুলে পড়ে সবিস্ময়ে দেখলে, ওঙ্কারধামের অরণ্যে আধুনিক মানুষের মুখ৷ ওঙ্কারধামের দক্ষিণ প্রবেশ পথের উপরে জেগে ছিল কালজয়ী প্রলয়দেবতা শিবের চারিটি বিপুল মুখমণ্ডল, তাদের পাষাণ নেত্রের সামনে বহুযুগ পরে আবার ক্ষুদ্র মানুষের আবির্ভাব হল! বোবা পাথরের উপরে বিস্ময়ের শব্দরেখা ফুটল না বটে, কিন্তু যে অভাবিত কাহিনি বহন করে Mouhot আবার আধুনিক সভ্য জগতে ফিরে এলেন দিকে দিকে তা চমকপ্রদ উত্তেজনার সৃষ্টি করলে!
‘সেকালের পৃথিবীতে এক জাতি যখন আর এক জাতিকে আক্রমণ করত, পরাজিত জাতিকে তখন প্রায়ই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হত৷ তারা আবার কোনো নতুন দেশে গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের তাড়িয়ে বা বশ করে নতুন রাজ্যস্থাপন করত৷ এইভাবে সেকালকার পৃথিবীতে অনেক নতুন রাজ্য গড়ে উঠেছে এবং তাদের মধ্যে কোনো কোনো রাজ্য এখনও টিকে আছে৷
‘সম্ভবত এইভাবেই একদল হিন্দু ভারতবর্ষ ত্যাগ করে সাগর পেরিয়ে শ্যামদেশে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন৷ কত শতাব্দী আগে এখনও সেটা স্থির হয়নি৷ তবে তেরো-চৌদ্দ শতাব্দী পর্যন্ত তাদের হাতে গড়া নূতন সভ্যতার অস্তিত্ব যে নষ্ট হয়নি, এমন কথা বলা যায়৷ এবং এই সভ্যতার আশ্রয়ে যে একসময়ে তিন কোটি মানুষ নিরাপদে বাস করত, সেটা অনুমান করবার মতো প্রমাণেরও অভাব নেই৷ ওঙ্কারধাম ছিল তাদের রাজধানী৷ সে এত বড়ো নগর এবং তার ধ্বংশাবশেষ এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত যে সেখানেও বোধ হয় বাস করত দশ লক্ষ হিন্দু! আজ তাদের একজনও নেই, তাদের বংশধরদেরও সন্ধান মেলে না!
‘কিন্তু তাদের মেঘছোঁয়া মন্দির মহাকালকে পরিহাস করে আজও বেঁচে আছে-যেমন বেঁচে আছে মৃত মিশরিদের পিরামিড! ওঙ্কারধামের এই অদ্ভুত মন্দির শিল্পের দিক দিয়ে পিরামিডেরও চেয়ে ঢের বড়ো, ঢের বিচিত্র, ঢের আশ্চর্য! মানুষের হাত পৃথিবীর আর কোথাও এমন মন্দির গড়তে পারেনি৷ ভাবতে গর্ব হয় যে, এই মন্দির যারা গড়েছে তারা হচ্ছে দিগবিজয়ী হিন্দু-আমাদেরই পূর্বপুরুষ!
‘সুন্দরবাবু, আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই চিরস্মরণীয় কীর্তি স্বচক্ষে দেখলে আপনাকে স্তম্ভিত হতে হবে! মানুষের হাত যে এমন মন্দির গড়তে পারে এ কথা আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না,-মনে করবেন আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন মর্তে অবতীর্ণ দেবতা!’
সুন্দরবাবু উত্তরে মনের মতো কথা খুঁজে না পেয়ে কেবল বললেন, ‘হুম!’
প্রথম গাড়িতে তখন মানিক বলছিল, ‘জয়, কলকাতার অলিগলিতে চ্যান আর ইন হয়তো এখনও আমাদের খুঁজে মরছে!’
জয়ন্ত ঘাড় নেড়ে বললে, ‘শত্রুদের যারা নিজেদের চেয়ে বোকা মনে করে, পদে পদে ঠকে মরে তারাই! খুব সম্ভব আমরা তাদের ফাঁকি দিয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে পারিনি৷’
-‘কিন্তু জয়, যে জাহাজে আমরা এসেছি তার মধ্যে যে চ্যান আর ইন ছিল না, এটা আমি হলপ করে বলতে পারি৷ অমলবাবু তাদের চেনেন, জাহাজের আরোহীদের দলে তারা ছিল না৷’
জয়ন্ত অন্যমনস্কের মতো বললে, ‘হতে পারে৷ না হতেও পারে৷’
ঠিক সেই সময়ে পিছন থেকে শোনা গেল একখানা মোটরের ভেঁপুর শব্দ!
জয়ন্ত সচমকে গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে দেখলে৷ সোজা রাস্তা-অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে৷ জয়ন্তের তিনখানা গাড়ি ঠিক পরে পরেই ছুটেছে৷ কিন্তু আরও খানিকটা পিছনে দেখা দিয়েছে আরও দু-খানা নতুন মোটরগাড়ি! রাস্তার উপরে ধুলোর মেঘ সৃষ্টি করে গাড়ি দু-খানা ছুটে আসছে যেন বিদ্যুৎবেগে!
মানিক সবিস্ময়ে বললে, ‘এত বেগে ওরা কারা গাড়ি চালায়! ক্রমাগত হর্নের পর হর্ন দিয়ে ওরা আমাদের পথ ছেড়ে সরে যেতে বলছে! ওদের এত তাড়াতাড়িই বা কীসের?’
পিছনের গাড়ি থেকে ব্যস্ত স্বরে চেঁচিয়ে সুন্দরবাবু বলে উঠলেন, ‘পথ ছাড়ো, পথ ছাড়ো! নইলে এখনি অ্যাক্সিডেন্ট হবে!’
জয়ন্ত নিজেদের ড্রাইভারকে বললে, ‘গাড়ি নিয়ে একপাশে সরে যাও৷ গাড়ি একেবারে থামিয়ে ফেলো৷’
ড্রাইভার তার কথামতো কাজ করলে৷ তাদের অন্য গাড়ি দু-খানাও পথের একপাশে গিয়ে থেমে দাঁড়াল৷
গাড়ির দরজা খুলে জয়ন্ত পথের উপর নেমে পড়ল৷ তারপর নিজের কোমরবন্ধে সংলগ্ন রিভলভারের উপর হাত রেখে পিছন দিকে দৃষ্টিপাত করলে, তার দুই চক্ষু প্রদীপ্ত, মুখে দৃঢ়প্রতিজ্ঞার ভাব!
ধুলোর মেঘে-ঢাকা দু-খানা গাড়ি তার অজ্ঞাত আরোহীদের নিয়ে প্রচণ্ড বেগে খুব কাছে এসে পড়েছে!