‘এ তো মেয়ে মেয়ে নয়–’
সংবাদপত্রের পাঁজে যারা পোড় খেয়ে ঝামা হয়ে গিয়েছেন, তারা অত্যন্ত আত্মজনের মৃত্যুতেও বিচলিত হন না। হবার উপায়ও নেই। কারণ, যদি সে আত্মজন প্রখ্যাতনামা পুরুষ হন, তবে সাংবাদিককে অশ্রুসংবরণ করে সে মহাপুরুষ সম্বন্ধে রচনা লিখতে বসতে হয়। এ অধম পাজাতে ঢুকেছে বটে, পোড়ও খেয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ ঝামা হয়ে যায়নি বলে তার চোখের জল মুছতে অনেকখানি সময় কেটে গিয়েছে।
বহু সাহিত্যিক, বহু কবি, বহু ঔপন্যাসিকের সঙ্গে দেশবিদেশে আমার আলাপ হয়েছে কিন্তু সরোজিনী নাইডুর মতো কলহাস্যমুখরিত, রঙ্গরসে পরিপূর্ণ অথচ জীবনের তথা দেশের সুখ-দুঃখ, আশা-নৈরাশ্য সম্বন্ধে সচেতন দ্বিতীয় পুরুষ বা রমণী আমি দেখিনি। কতবার দেখেছি দেশের গভীরতম দৈন্য-দুর্দশা নিয়ে গম্ভীরভাবে, তেজীয়ান ভাষায় কথা বলতে বলতে হঠাৎ কথার মোড় ঘুরিয়ে তিনি রঙ্গরসে চলে গিয়েছেন। লক্ষ করে তখন দেখেছি যে, রসিকতার কথা বলেছেন বটে, কিন্তু তখনও চোখের জল ছলছল করছে। আমার মনে হয়েছে, দুঃখ-বেদনার কথা বলতে বলতে পাছে তিনি সকলের সামনে হঠাৎ কেঁদে ফেলেন। সেই ভয়ে কথার বাঁক ফিরিয়ে হাসি-তামাসায় নেমে পড়েছেন।
চটুল রসিকতাই হোক আর গুরুগম্ভীর রাজনীতি নিয়েই কথা হোক সরোজিনী যে ভাষা-শৈলী ব্যবহার করতেন তার সঙ্গে তুলনা দিতে পারি, এমন কোনও সাহিত্যিক বা কবির নাম মনে পড়ছে না। রবীন্দ্রনাথ গল্প বলতে অদ্বিতীয় ছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু সরোজিনীর মতো কখনও শতধা উচ্ছ্বসিত হতেন না। সরোজিনী আপনভোলা হয়ে দেশকালপাত্র সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে যে গল্পগুজব করে যেতেন, তাতে মজলিস জমত ঢের বেশি। রবীন্দ্রনাথ যেমন কখনও কাউকে খুব কাছে আসতে দিতেন না, সরোজিনীর মজলিসে কারও পক্ষে দূরে বসা ছিল অসম্ভব।
এরকম প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন অল্প লোক। অথচ সরোজিনীর চেয়ে অল্প প্রতিভা নিয়ে অনেকেই সরোজিনীর চেয়ে সফলতর সৃষ্টিকার্য করতে সক্ষম হয়েছেন। সরোজিনীর ভাব গম্ভীর ছিল, ভাষা মিষ্ট ছিল। তৎসত্ত্বেও তার কাব্যসৃষ্টি তার ক্ষমতার পিছনে পড়ে রইল কেন?
আমার মনে হয় সরোজিনীকে যারা বক্তৃতা দিতে শুনেছেন, তার মজলিসে আসন পাবার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে, তারাই স্বীকার করবেন বিদেশি মায়ামৃগের সন্ধানে বেরিয়ে সরোজিনী স্থায়ী যশের সতী সীতাকে হারালেন। এতে অবশ্য সরোজিনীর দোষ নেই। অল্প বয়সে তিনি যে ভাষা শিখেছিলেন, পরিণত বয়সে সেই ভাষাতেই তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন। কিন্তু মাতৃস্তন্য না খেয়ে তিনি হরলিকস খেয়েছিলেন বলে তার কবিতা কখনও মাতৃরসের স্নিগ্ধতা পেল না। আমি জানি, পৃথিবীতে আজ ইংরেজ ছাড়া কোনও বিদেশি সরোজিনীর মতো ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখতে পারবেন না। এ বড় কম কথা নয়, কিন্তু এ কৃতিত্বও আমাদিগকে সান্ত্বনা দিতে পারে না। কারণ নিশ্চয় জানি, উর্দু, বাংলা, ইংরেজি দ্বন্দ্বের বাতাবরণে যদি সরোজিনী বাল্যকাল না কাটাতেন, বাংলা মায়ের কোলে বসে যদি তিনি শুধু বাংলাই শুনতেন, তা হলে কৈশোরে বিদেশি ভাষা তার কবিত্ব প্রতিভাকে ভস্মাচ্ছাদিত করতে পারত না– মাইকেলের প্রতিভা যেরকম বিদেশি ভস্মকে অনায়াসে সরিয়ে ফেলতে পেরেছিল।
তাই সরোজিনী আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন। সরোজিনী প্রমাণ করে দিলেন, বিদেশি ভাষায় কখনও স্থায়ী সৃষ্টিকর্ম সম্ভবপর হয় না। আর কোনও ভারতবাসী ভবিষ্যতে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষাতে কবিতা লিখবে না। পূর্ব পাকিস্তান উর্দু গ্রহণ না করে বিচক্ষণের কার্য করেছে। পশ্চিমবঙ্গ যেন হিন্দি-মৃগের সন্ধানে না বেরোয়।
পাঠক যেন না ভাবেন, আমি সরোজিনীর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হইনি। আমি শুধু বলতে চাই, সরোজিনীর কবিতার চেয়ে তার ব্যক্তিত্ব বহুগুণে বৃহত্তর ছিল। তিনি আর পাঁচজন কবির মতো অবসর সময়ে কবিতা লিখে বাদবাকি সময় সাধারণ লোকের মতন কাটাতেন না। তার কথা, তার হাসি, তার গালগল্প, তার রাগ, আর অসহিষ্ণুতা, তার ধৈর্যচ্যুতি, তার আহার বিহার ভ্রমণ বিলাস সবকিছুই ছিল কবিজনোচিত। রাজনৈতিক সরোজিনী, জনপদকল্যাণী সরোজিনী, বাকনিপুণা সরোজিনী–এই তিন এবং অন্য বহুরূপে যখন তিনি দেখা দিতেন তখন সেসব রূপই তার কবিরূপের নিচে চাপা পড়ে যেত। কবিতা রচয়িত্ৰী সরোজিনীর চেয়েও কবি সরোজিনী বহু বহু গুণে মহত্তর।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে বাংলার এক কবি লিখেছিলেন বাংলার কুঁড়েঘরে রবির উদয় হল, এ বিস্ময় আমাদের কখনও যাবে না। ঠিক তেমনি ভারত এমন কী পুণ্য করেছিল তার বুকে ফুটে উঠল সরোজিনী?