উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

এগারো । সূর্যাস্ত

এগারো । সূর্যাস্ত

এলবা থেকে ফিরে এসে নেপোলিয়নের একশো দিনের রাজত্ব শেষ হল। নেপোলিয়ন আবার বাধ্য হলেন সিংহাসন ত্যাগ করতে (২৩ জুন, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে)।

কিন্তু মিত্রপক্ষ এবারে আর তাঁর সঙ্গে কোনওরকম সদয় ব্যবহার করতে রাজি হলেন না। এজন্যে মিত্রপক্ষের দোষ নেই। ইউরোপের রাজারা তাঁর কাছে বহুবার নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁর অসীম উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইউরোপকে বারে বারে করে তুলেছে রক্তপিচ্ছিল। রাজাদের কাছে তিনি ছিলেন বাস্তব দুঃস্বপ্নের মতন। গতবারে তাঁকে স্বাধীনভাবে এলবা দ্বীপে বাস করবার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তিনি আবার এসে সব ওলটপালট করে দিলেন।

নেপোলিয়ন বললেন, আমাকে আমেরিকায় যেতে দাও।

ইউরোপ বললে, না। তুমি আবার ফিরে আসতে পারো।

নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডগামী জাহাজে চড়ে বললেন, আমি ইংরেজদের আতিথ্য স্বীকার করলুম।

ইংলন্ড বললে, না, তুমি যুদ্ধে বন্দি। তোমার নিজের মতামতের মূল্য নেই। তোমাকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দির মতন থাকতে হবে। আজ থেকে তুমি আর সম্রাট নও, জেনারেল বোনাপার্ট মাত্র।

ছেলেবেলায় ‘কপি-বুকে’র শেষ পাতায় তিনি লিখে রেখেছিলেন—’সেন্ট হেলেনা, আটলান্টিক মহাসাগরের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। ইংরেজদের উপনিবেশ।’

আজ সেইখানেই তাঁকে যেতে হল, জীবনের শেষ-অঙ্কের উপরে যবনিকাপাত করতে (১৭ অক্টোবর, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে)।

দ্বীপ-কারাগারের পর্বত। নেপোলিয়ন বসে আছেন একখানি পাথরের উপরে। সুমুখ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অশান্ত মহাসাগর।…মানুষ-নেপোলিয়নকে সমুদ্রের সামনে দেখাচ্ছে কত ছোট! কিন্তু মানুষ-নেপোলিয়নের হৃদয়-সাগরে যে অনন্তের প্রকাশ, আটলান্টিক কি তার চেয়েও বৃহৎ?

স্বাধীন হলে মানুষ-নেপোলিয়ন যে আরও কত বড় হতে পারতেন, তা আমরা কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু তিনি যতটা বৃহৎ হতে পেরেছেন, তাও ছিল কল্পনার অতীত। জার্মান কবি গ্যেটে বলেছেন!

‘যাহা কিছু তুচ্ছ হেথা, দৃষ্টি হতে যায় যে মিলায়ে,

গণনীয় হয় শুধু মহাদেশ, বিপুল সাগর!’

মানুষ হলেও নেপোলিয়নের সঙ্গে মহাদেশ বা মহাসাগরেরই তুলনা করা চলে।

সেন্ট হেলেনায় বড় কষ্টে যে নেপোলিয়নের দিন কাটতে লাগল, সে কথা বলাই বাহুল্য। তিনি ছিলেন মুক্ত পৃথিবীর স্বাধীন জীব। দুই মহাদেশ—ইউরোপ ও আফ্রিকা ছিল তাঁর বিচরণ-ক্ষেত্র, কর্মের প্রচণ্ড স্রোতে অশ্রান্ত ভাবে সাঁতার দেওয়াই তাঁর একমাত্র আনন্দ ছিল। শিলাময় ক্ষুদ্র সেন্ট হেলেনার সংকীর্ণতার মধ্যে অলসভাবে বসে বসে কেবল অতীত-গৌরবের স্বপ্ন দেখা তাঁর সহ্য হবে কেন? তার উপরে এ দ্বীপটি ছিল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। তাঁকে এখানে বন্দি রেখে ইংরেজরা মানবতার পরিচয় দেননি। দেখতে দেখতে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ল।

প্রথম প্রথম তিনি বাড়ির বাইরে বহুদূর পর্যন্ত ভ্রমণ করে আসতেন। কিন্তু সর্বদাই তাঁর সঙ্গে সঙ্গে থাকত ইংরেজ সেপাই—পাছে তিনি আবার ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান।

এই নির্দয় বাড়াবাড়ি দেখে তিনি যার-পর-নাই অপমান জ্ঞান করলেন এবং বাইরে বেড়ানো একেবারেই ছেড়ে দিলেন। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে কাটাতে লাগলেন দিন-রাত। ফলে স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হল। এমনকী অঙ্গ-সঞ্চালনের অভাবে তাঁর দুই পা ফুলে উঠল।

দ্বীপের গভর্নর স্যার হাডসন লো যে তাঁর উপরে অত্যাচার ও তাঁকে অপমান করে আনন্দলাভ করতেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অকারণেই তিনি বন্দিকে অন্বেষণ করতে আসতেন। একদিন নেপোলিয়ন কফির পেয়ালা হাতে করেছেন, এমন সময় লো এসে হাজির। তিনি বিদায় হলে পর নেপোলিয়ন বললেন, ‘কফির পেয়ালা ছুড়ে ফেলে দাও। ওই নোংরা লোকটা এর কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল।’

নেপোলিয়নের মুখের উপরে তাঁকে ‘জেনারেল’ বলে ডেকে গভর্নর তাঁকে আহত করবার চেষ্টা করতেন। সম্রাট নেপোলিয়নের পক্ষে এ সম্বোধন ছিল অসহনীয়!

একদিন লো এসে অভিযোগ করলেন, ‘আপনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। খরচ কমাবার চেষ্টা করুন।’

নেপোলিয়নের দুই চক্ষে জ্বলে উঠল অগ্নিশিখা। মহাক্রোধে বললেন, ‘এ সব বিষয় নিয়ে তুমি কোন সাহসে আমার সঙ্গে কথা কইতে আসো? তুমি সামান্য জেল-দারোগা ছাড়া আর কিছুই নও!’

গভর্নর বিনাবাক্যব্যয়ে সরে পড়লেন।

তারপর থেকে গভর্নর আর কোনওদিন নেপোলিয়নের দেখা পাননি। তিনি এলেই শুনতেন, দেখা হবে না।’ তবু একদিন তিনি জোর করে দেখা করবার চেষ্টা করলেন।

ঘরের ভিতর থেকে চাকরকে সম্বোধন করে নেপোলিয়ন চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওকে বলে দাও ঘাতকের কুঠার আনতে। ও লোকটাকে এ ঘরে ঢুকতে হবে আমার মৃতদেহ মাড়িয়ে। শীঘ্র আমার পিস্তল নিয়ে এসো!’

গভর্নর আর ভিতরে ঢুকতে ভরসা করলেন না। তারপর তিনি আর একদিন মাত্র বন্দির দেখা পেয়েছিলেন—নেপোলিয়ন যখন মৃত।

সেন্ট হেলেনায় নেপোলিয়নের সঙ্গে কয়েকজন ফরাসি সঙ্গী ছিলেন, একজন সস্ত্রীক। তাঁদের নিয়েই অতীত ও বর্তমানের গল্প করে তাঁর দিন কোনওরকমে কাটত। কিন্তু এভাবে দিনকাটানো যে অত্যন্ত কষ্টকর, এটা তাঁর হাব-ভাব-ব্যবহারে বোঝা যেত সর্বদাই। নির্বাসিত জীবনে প্রতিদিন খুব বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে তিনি ঘরের বাইরে আসতেন—জাগ্রত অবস্থায় দিনের দীর্ঘতা কমে যাবে বলে। কোনও কোনও দিন রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার সময়ে বলতেন, ‘আঃ, জীবনের আর-একটা দিন কমে গেল!’

এলবা যাত্রার সময়ে ইম্পিরিয়াল গার্ডদের কাছে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন, তাদের কীর্তিকাহিনি রচনা করবেন। কিন্তু এতদিন সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। সেন্ট হেলেনায় হাতে প্রচুর সময় পেয়ে নেপোলিয়ন নিজের জীবনস্মৃতি রচনায় প্রবৃত্ত হলেন। ঘরের ভিতর পায়চারি করতে করতে তিনি বলে যেতেন, অন্য কেউ লিখে নিত। কিছুমাত্র বিশ্রাম না নিয়ে পুরো চোদ্দো ঘণ্টা তিনি নানা বর্ণনা করে যাচ্ছেন, যে লিখছে একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়ছে এবং তার স্থানগ্রহণ করছে নতুন কোনও লোক, এই সামান্য পরিশ্রমে শ্রান্তি দেখে নেপোলিয়নের মুখে ফুটে ওঠে অবজ্ঞার হাসি!

কোনও কোনও দিন অতীতের কথা স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আমার মরা উচিত ছিল মস্কো শহরে গিয়ে। তখনও পর্যন্ত আমার যশোগৌরব ম্লান হয়নি!…ভগবান তখন যদি একটি বুলেট পাঠিয়ে দিতেন! তাহলে ফ্রান্সের সিংহাসনে বিরাজ করত আমার বংশই; আলেকজান্ডার আর সিজারের সঙ্গে ইতিহাস আমার তুলনা করত। ব্যাপার যা দাঁড়িয়েছে, এখন আমি প্রায় কিছুই নই।’

আর একদিন বলেন, ‘বোরোডিনো যুদ্ধক্ষেত্রে মরলে আমার মৃত্যু হত আলেকজান্ডারের মতন। ওয়াটার্লুতে মরাও ছিল ভালো। বোধহয় ড্রেসডেনের যুদ্ধে মরলে ভালো হত আরও। না, না, ওয়াটার্লুর মৃত্যুই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। লোকের ভালোবাসা পেতুম, তারা আমার জন্যে কাঁদত।’

এমনিভাবে ভেবে ভেবে দিন যায়। দেহের ভিতরে ব্যাধির অত্যাচার ক্রমেই বেড়ে উঠতে লাগল। তিনি বলেন, ‘আমার পেটের ভিতরটা জ্বলছে যেন আগুনের মতন।’ কখনও কখনও দারুণ যন্ত্রণায় মেঝের উপরে পড়ে ছটফট করতে থাকেন।

তাঁর জীবনের শেষ বৎসর এসে উপস্থিত হয়েছে। প্রথম সাত মাস ধরে তিনি নিজের বাড়ি-সংলগ্ন জমির উপরে করলেন চমৎকার বাগান রচনা। যাঁরা সে বাগান দেখলেন, বললেন—’বিস্ময়কর কীর্তি!’ এটি হচ্ছে নেপোলিয়নের নিজের হাতের শেষ-দান। যুদ্ধ নয়, রাজনীতি নয়, শেষের কবিতা!

জন্মদিন। নেপোলিয়ন সকলকে খাওয়ালেন, শিশুদের উপহার দিলেন। বললেন, ‘এই আমার শেষ জন্মদিন।’

শরৎকাল। চার বৎসর পরে নেপোলিয়ন প্রথম বাড়ির বাইরে গেলেন। ঘোড়ায় চড়ে অনেকটা পথ বেড়িয়ে এলেন। এই তাঁর শেষ ভ্রমণ।

ভক্তরা গোপনে তাঁকে দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চাইলেন! এমন প্রস্তাব দুই দুই বার হয়। নেপোলিয়ন নারাজ হয়ে বললেন, ‘নিয়তির লিখন হচ্ছে, আমি এইখানেই মরব। আমেরিকায় গেলে হয় আমাকে হত্যা করা হবে, নয় লোকে আমাকে ভুলে যাবে। আমি আত্মোৎসর্গ না করলে ফ্রান্সের সিংহাসনে আমার বংশের প্রতিষ্ঠা হবে না। তাই আমি থাকতে চাই সেন্ট হেলেনায়।’

রোগের লক্ষণ অধিকতর প্রকট। নেপোলিয়ন দুঃখিত স্বরে বলেন, ‘বিছানা আজ আমার এত প্রিয় হয়ে উঠেছে যে, এর বদলে আমি আর সিংহাসনও গ্রহণ করব না। আমি কি করুণাপাত্র জীব হয়ে উঠেছি! আমি—যার কখনও ঘুমোবার প্রায় দরকারই হত না—এখন কিনা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েই দিনের পর দিন কাটাই। আগে আমি বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে বলে যেতুম, আর তা লিখে নেওয়ার জন্যে আবশ্যক হত একসঙ্গে চার-চারজন সেক্রেটারির! সেদিন গিয়েছে, যেদিন আমি ছিলুম নেপোলিয়ন।’

নেপোলিয়নের এই উক্তির মধ্যে নেই অত্যুক্তি। কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি জীবনে একদিনের জন্যেও ছুটি নেননি। কাজ, কাজ, কাজ! তিনি স্ফূর্তিলাভ করতেন কর্মস্রোতে ঝম্প দিয়েই। এতবড় কর্মবীর পৃথিবীতে আর কখনও জন্মেছেন কিনা সন্দেহ!

মৃত্যুর তিন সপ্তাহ আগে তাঁর অবশিষ্ট শক্তির শেষ-বিকাশ দেখা গেল। একাসনে একটানা পুরো পাঁচঘণ্টা ধরে বসে তিনি নিজের উইল রচনা করলেন। সে উইল এক অপূর্ব জিনিস এবং প্রমাণিত করে যে, শেষপর্যন্ত তাঁর মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণতা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি।

নেপোলিয়নের নিজের মত হচ্ছে, ‘আমার মৃত্যুর কারণ, এই অস্বাস্থ্যকর দ্বীপ। তার উপরে এক বৎসরকাল আমাকে চিকিৎসকের সাহায্য থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল।…ইংরেজ রাজমন্ত্রীদের চক্রান্তে ওই নগণ্য পাহারাওয়ালা হাডসন লো আমাকে তিলে তিলে হত্যা করবার চেষ্টা করছে।… ইংল্যান্ডেরও ধ্বংস হবে ভিনিসের গর্বিত প্রজাতন্ত্রের মতন। আমার মৃত্যুর জন্যে যা-কিছু লজ্জা আর নৃশংসতা, ইংল্যান্ডের রাজপরিবারকে আমি দান করে গেলুম।’

বন্দি দশায় যে কয়েকজন সহচর বা অনুচর নেপোলিয়নের সেবা-পরিচর্যায় নিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের সম্বোধন করে তিনি বললেন, ‘আমার মৃত্যুর পর তোমরা লাভ করবে স্বদেশ প্রত্যাগমনের মিষ্ট শান্তি। তোমরা আবার দেখতে পাবে তোমাদের আত্মীয়-বন্ধুগণকে। আর আমি? স্বর্গধামে গিয়ে আবার দেখতে পাব আমার নির্ভীক যোদ্ধাবৃন্দকে।’—বলতে বলতে কণ্ঠস্বর উচ্চতর হয়ে উঠল—’হ্যাঁ, ক্লেবার, দেসেক্স বিসিয়ার্স, দুরক, নে, মুরাট, মেসেনা, বার্দিয়ার,—তারা সবাই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে, আমরা সবাই মিলে যে কীর্তি স্থাপন করেছি, তারা সেই গল্পই করবে। আমিও তাদের কাছে বলব আমার শেষজীবন-কাহিনি। যখন তারা আমাকে দেখবে, তারা আবার সেই পুরোনো উৎসাহে, যশোগৌরবের জন্যে সেই পুরোনো আবেগে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠবে। মহাবীর স্কিপিয়ো, হানিবল, সিজার আর ফ্রেডারিকের সঙ্গে আমরা আমাদের যুদ্ধ নিয়ে কথাবার্তা কইব! সে কী আনন্দ!’

মৃত্যুর দিনকয় আগে তিনি এই পত্রখানি নিজেই রচনা করলেন এবং বললেন, তাঁর মৃত্যুর পরে পত্রখানি যেন যথাস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়! :

‘মিঃ গভর্নর,

গত—তারিখে, দীর্ঘকালব্যাপী যন্ত্রণাদায়ক রোগে ভুগে সম্রাট নেপোলিয়ন পরলোকগমন করেছেন। মহাশয়কে এই সংবাদ জানানো হল। আপনাদের গভর্মেন্ট তাঁর দেহকে ইউরোপে পাঠাবার কী ব্যবস্থা করেছেন, অনুগ্রহ করে তা জানাবেন।’

যথাসময়ে সবদিক গুছিয়ে-গাছিয়ে তিনি আসন্ন মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে রইলেন।

মৃত্যুর পদশব্দ শুনতে পেয়ে আর এক বিষয়ের জন্যে সকলকে সাবধান করলেন : ‘যখন আমি জ্ঞান হারাব, তখন তোমরা কিছুতেই কোনও ইংরেজ ডাক্তারকে আমার ছায়া মাড়াতে দিও না।’

তিনি জ্ঞান হারালেন—জ্ঞানোদয়য়ের পর এই প্রথম এবং শেষ বার!

ঘোর বিকার! মাঝে মাঝে উচ্চৈঃস্বরে প্রলাপ বকছেন : ‘দেসেক্স! মেসেনা! আমরাই বিজয়লাভ করব! জলদি! অগ্রসর হও! ওরা আমাদের পাল্লায় এসে পড়েছে…’

ভয়াবহ শেষ রাত্রি। ভোরের কিছু আগে তাঁর মুখে শোনা গেল, ‘ফ্রান্স!…সৈন্যদল!… জোসেফাইন!’

পৃথিবীতে এই তাঁর শেষ উক্তি।

সারাদিন চুপ করে শান্তভাবে শুয়ে রইলেন—অন্তিম শ্বাস আরম্ভ হয়েছে! অস্টারলিটজের যুদ্ধক্ষেত্রে যে খাট ব্যবহার করেছিলেন, তাঁর শেষ-শয্যা বিছানো হয়েছে সেই খাটেই।

বাড়ির বাইরে আকাশ ফুঁড়ে পড়ছে ঝম-ঝম বৃষ্টি—ঝোড়ো বাতাসে ছটফট করছে কুয়াশা।

বৈকাল পাঁচটা। ঝড়-বৃষ্টির হুঙ্কার বেড়ে উঠল—বাগানের দুটো গাছ শিকড়শুদ্ধ উপড়ে পড়ল!

মৃত্যু আক্রান্ত নেপোলিয়ন! দেহের কোথাও যাতনার কোনও চিহ্ন নেই। দুই চক্ষু বিস্ফারিত—শূন্য দৃষ্টি। কণ্ঠে ঘড়-ঘড় শব্দ।

সমুদ্রে মগ্ন হল সূর্য। সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল নেপোলিয়নের হৃৎপিণ্ড! (৫ মে, ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে)।

শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করে জানা গেল, নেপোলিয়নের মৃত্যুর কারণ উদরের ক্যান্সার।

মৃত্যু এসে নেপোলিয়নকে দিয়ে গিয়েছে তরুণ সৌন্দর্য! সিংহাসনে আরোহণ করবার পর থেকেই তার মুখ ও দেহ অত্যন্ত স্থূল হয়ে উঠেছিল, কিন্তু এখন তাঁকে দেখাচ্ছে এক সুন্দর যুবকের মতন!

ইংরেজরা বললেন, মৃতদেহ ইউরোপে পাঠানো হতে পারে না।

মরা নেপোলিয়নও বিপদজ্জনক! দেহ দেখে ফরাসিরা যদি শোকে ও ক্রোধে ক্ষেপে উঠে আবার অস্ত্র ধারণ করে!

পাহাড়ের এক নির্জন উপত্যকা। সেইখানেই মহাবীরের শেষ শয়ন পাতা হল। সমাধির উপরে নত হয়ে ছায়া ছড়িয়ে দিলে দুটি উইলো গাছ। যুদ্ধক্ষেত্রে বারংবার যিনি মহাকাব্য রচনা করেছিলেন, তাঁর জন্যে গীতি-কবিতার সুরসৃষ্টি করতে লাগল ছোট একটি নির্ঝর।

ইংল্যান্ড মৃতের জন্যে একটি সম্মানের ব্যবস্থা করলেন। তাঁর সমাধিকে সর্বদাই পাহারা দিয়েছিল একজন করে সৈনিক। একে একে কেটে গেল উনিশ বৎসর। তারপরে আর পাহারার দরকার হল না, কারণ ফ্রান্স দাবি করলে মৃতদেহ ফিরে পাওয়ার জন্যে। নেপোলিয়ন আবার প্রত্যাগমন করলেন বিজয়ীর মতন।

সম্রাটের মৃত্যুর পরেও ফ্রান্সের নতুন বুর্বন রাজা নেপোলিয়নের নাম শুনলেই ভয়ে চমকে উঠতেন। রাজধানীতে নেপোলিয়নের এক অশ্বারোহী মূর্তি ছিল, রাজার হুকুমে তা স্থানান্তরিত হয়েছিল।

ফরাসিরা আবার বুর্বন রাজাকে তাড়িয়ে দিলে। ভিন্ন বংশের নতুন রাজা সিংহাসনে বসে জনসাধারণের অনুরোধে নেপোলিয়নের প্রস্তর-মূর্তি আবার ফিরিয়ে আনলেন—পনেরো বৎসর পর।

ছোট ছেলে জেরোম এসে মা লেটিজিয়াকে এই খবর দিলেন।

জরায় ও রোগে মা তখন বিছানা আশ্রয় করেছেন। চলতে পারেন না, চোখ অন্ধ। কিন্তু খবর শুনেই মায়ের দেহে এল নতুন শক্তি।

বহুকাল পরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বৈঠকখানায় নেমে এলেন।

নেপোলিয়নের একটি প্রস্তরমূর্তির দিকে অন্ধ চোখদুটি ফিরিয়ে মা লেটিজিয়া বললেন, ‘সম্রাট আবার প্যারিতে এসেছেন!’