॥৯॥
অনভ্যস্ত হাত, তবু নিশানা ভুল করেনি শ্যাডো, দুটো বুলেট উল্কার মতো আলোর রেখা টেনে গিয়ে কালুদাদাকে ভেদ করে দিয়েছিল। লোকটা কোনও আওয়াজ না-করে লুটিয়ে পড়ে গেল তার দীন-দরিদ্র শয্যার উপর। কোনও শব্দও করল না। শুধু লাফিয়ে উঠেছিল কুকুরটা। শ্যাডো জানে যে, প্রভুভক্ত কুকুর তার প্রভুর হত্যাকারীকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। তাই সে শিসে গেয়ে উঠল ‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে…’ কুকুরটা চুপ করে বসে পড়ল। আস্তে আস্তে পিছু হটে দরজার দিকে সরে যাচ্ছিল সে। একটু একটু করে। ঠিক এই সময়ে বাইরে থেকে কে যেন চাপা গলায় বলে উঠল, “প্লিজ শ্যাডো, কিপ অন হুইস্লিং, কিপ অন হুইস্লিং, ডোন্ট স্টপ, প্লিজ…”
কিন্তু এক উত্তেজক হত্যাকাণ্ডের পর শ্যাডোর দম আটকে আসছিল, বুকে তবলার দ্রুত বোল। চোখ ফেটে জলও আসছিল তার। লোকটা কত ভদ্র ভাবে মরে গেল, একটুও প্রতিরোধ করল না! এত নরম ভাবে কেউ মরে নাকি! এত বিনয়ের সঙ্গে কেউ কি তার খুনিকে ক্ষমা করে যায়! জীবনে কখনও কেঁদেছে বলে তার মনে পড়ে না। আজ বুক ভেঙে কান্না আসছে। কী করে শিস দেবে সে?
পারল না শ্যাডো, শিস থেমে হেঁচকি উঠে এল তার গলায়। আর সঙ্গে-সঙ্গে গোলো বাঘের মতো একটা লাফ দিয়ে ঘরের দরজাটা ভেদ করে বাইরে ছুটে গেল। বাইরে একটা আর্তনাদ শুনতে পেল শ্যাডো। তার পর আরও দুটো আর্তনাদ, পর পর। তার পর নিস্তব্ধতা। শ্যাডোর কিছু করার নেই। ঘরের একটা বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে সে কেঁদেই যাচ্ছিল অঝোরে।
অনেক ক্ষণ বাদে কে যেন খুব নরম গলায় বলে উঠল, “আপনি কাঁদবেন না বাবু, আপনার সত্যরক্ষা তো হয়েছে!”
ভূত বা ভগবানে বিন্দু মাত্র বিশ্বাস নেই শ্যাডোর, কিন্তু জলভরা চোখের অস্পষ্টতায় সে দেখতে পেল কালুদাদা তার দীন বিছানায় উঠে বসেছে, তার দিকেই চেয়ে আছে করুণ চোখে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না শ্যাডো। হাঁ করে চেয়ে থেকে সে অনেক ক্ষণ পরে বলতে পারল, “আপনি মরেননি?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কালুদাদা বলে, “আমার কি মরণ আছে বাবু? আমি হলুম সময়চারণ। একশো হাজার বছর আগেও ছিলাম, একশো হাজার বছর পরেও থাকব।”
শ্যাডোর মুখে কথা সরল না। কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
নিঃশব্দে কালো গরিলার মতো গোলো এসে ঘরে ঢুকল, যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে কালুদাদার পাশটিতে বসে হ্যা হ্যা করে হাঁপাতে লাগল। তার মুখ রক্তে মাখামাখি।
একটা বড় করে শ্বাস ফেলে কালুদাদা বলে, “আপনারা যেমন ডাঙায় বিচরণ করেন, আমি তেমনি বিচরণ করি সময়ের উজান ভাঁটেনে। আজ এখানে তো কাল একশো, দুশো বা তিনশো বছরের তফাতে। মরলে কি আমার চলে বাবু!”
“আপনি কে কালুদাদা? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“আমি এক ফেরিওয়ালা বাবু। নানা দ্রব্য নানা সময়ের মানুষের কাছে রেখে আসাই আমার কাজ, যদি তাতে মানুষের উপকার হয়। এই যে দেখছেন একটা লাট্টু, একটা টর্চবাতি আর একটা বাঁশি, তুচ্ছ জিনিস ভাববেন না বাবু, এর জন্য কোটি-কোটি টাকা দর দিয়েছিল ওরা। আর এর জন্যই আমাকে খুন করতে এসেছিলেন আপনি, আর এর জন্যই বাইরে তিন-তিনটে মানুষ লাশ হয়ে পড়ে আছে এখন।
শ্যাডো শুধু হাঁ করে চেয়ে রইল একটা গোলমেলে মাথা নিয়ে। কী হচ্ছে এ সব?
লোকটা উঠল, বলল, “আসুন বাবু, বাইরে আসুন। শেষ রাতে জ্যোছনা ফুটেছে খুব। দেখবেন আসুন।”
বাইরে বেরিয়েই কালুদাদা তার হাতের টর্চবাতিটা নাড়তেই চার দিকের কুয়াশা কেটে যেতে লাগল। ফটফটে জ্যোৎঙ্গায় বালিয়াড়ির উপর খানিকটা তফাতে তিন-তিনটে মানুষের দেহ পড়ে আছে নানা ভঙ্গিমায়।
কালুদাদা নিজের কপালে হাত বুলিয়ে বিষণ্ণ গলায় বলে, “আমার কী করার ছিল বলুন তো! কেউ মরতে এলে আমি কী করতে পারি!”
“এরা কারা?”
“আসুন দেখে নিই।”
দু’জনকে দেখা মাত্র চিনতে পারল শ্যাডো। হরিশ আর আবু। তৃতীয় জন আধচেনা, গাড়ির সেই বেঁটে সহযাত্রীটি। প্রত্যেকের গলার নলি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে গোলো।
“আপনার সত্যরক্ষা হয়েছে বাবু, আপনি তো আমাকে গুলি করেছেন। আমি যদি না-মরি সে তো আর আপনার দোষ নয়। আপনার আর কারও কাছে কোনও দেনা নেই। সব শোধবোধ। নিশ্চিন্তে বাড়ি যান বাবু।”
“তিন তিনটে মৃতদেহ, গোলোর রক্তাক্ত মুখ আর এই ভয়ঙ্কর জ্যোৎস্নায় শ্যাডোর বমি পাচ্ছিল। সে টলতে টলতে হাঁটার চেষ্টা করছিল। কালুদাদা এসে তাকে সঙ্গেহে ধরে ডাঙা-জমি পর্যন্ত পৌঁছে দিল। বলল, “আপনি শিস দিতে জানেন বলেই ওরা আপনাকে ভাড়া করেছিল বাবু। আপনি বড় সুন্দর শিস দেন আর যেন শিস বিক্রি করতে যাবেন না বাবু। সুর বড় শুদ্ধ জিনিস।”
“এই পিস্তলটা নিয়ে আমি এখন কী করব কালুদাদা?”
কালীচরণ হাত বাড়িয়ে বলল, “আমাকে দেন। আজ থেকে বহু বছর পরে যখন মানুষ আর অস্ত্রের ব্যবহার করবে না তখনকার সময়ে এটা পুরনো জিনিস হয়ে যাবে। আমি তখনকার মানুষকে এটা বিক্রি করব। তারা এটা ঘরের শো-কেসে সাজিয়ে রাখবে আর দেখে ভাববে, এক সময়ে মানুষ কত হিংস্র ছিল!”
অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোল শ্যাডো। উঠতে প্রায় দুপুর। ঘুম থেকে জেগে তার বিশ্বাস হচ্ছিল না, কাল যা ঘটেছিল তা সত্যি। হিম ঠান্ডা জলে স্নান করল সে অনেক ক্ষণ। তার পর একটু ধাতস্থ হল। অনেক ক্ষণ ভেবেও সে ব্যাপারটার মাথা-মুন্ডু কিছু বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু মনে হচ্ছে এই দুটো দিনে তার বয়স অনেক বেড়ে গেছে।
ফোন করে জানল, বাবাকে করিডরে অনেকটা হাঁটানো হয়েছে আজ। বাবা ভাল আছে। সন্ধেয় নিজের পিঠ-ব্যাগখানা গুছোতে গুছোতে সে শিস দিচ্ছিল, ‘কান্ট্রিরোডস, টেক মি হোম।’
আর রাতে উপরের বার্থে কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখছিল, ছোট্ট শ্যাডো, অর্থাৎ সে, তার বাবার হাত ধরে গুটগুট করে হেঁটে যাচ্ছে।
কে যেন জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছ শ্যাডো?”
শ্যাডো খুব অহঙ্কারের সঙ্গে বলল, “রথের মেলায়। আমার বাবার সঙ্গে।”
(সমাপ্ত)