।।৮।।
না, গজপতির মন ভাল নেই। আজকাল ঘুম ভাল হতে চায় না, এ-পাশ ও-পাশ করতে করতেই রাত ফুরিয়ে আসে। খুব ভোর ভোর উঠে পড়েন তিনি। বাগানে এসে বসে থাকেন বারান্দার সিঁড়িতে। অপেক্ষা করেন, যদি ফেরিওয়ালাটা তার আশ্চর্য জিনিসপত্তর নিয়ে আবার কোনও দিন আসে! কিন্তু আসে কই!
ফেরিওয়ালাটার তিন-তিনটে জব্বর জিনিস হাতে পেয়ে গিয়েছিলেন। দুনিয়ার ভোলই পাল্টে দিতে পারতেন গজপতি। কিন্তু আদ্যনাথ সর্বাধিকারীর মতো একটা ছিঁচকে লোকের জন্যই হল না। গজপতি থানায় আদ্যনাথের নামে একটা চুরির কেস দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু থানা থেকে বলা হয়েছে, এ রকম কোনও লোকই নাকি এলাকায় নেই! এক জন আদিনাথ সরকারকে পাওয়া যাচ্ছে, এক জন অনাদিনাথ সর্বাধিকারীকেও পাওয়া গেছে, আদ্যনাথ অধিকারী বলেও এক জন নাকি অল্পবয়সি মানুষ আছেন, কিন্তু কালপ্রিট আদ্যনাথ স্রেফ হাওয়া। লোকটার কথা মনে হলেই গজপতি দাঁত কিড়মিড় করেন, হাতের মুঠো আপনা থেকেই ঘুষি পাকিয়ে যায়, রক্ত গরম হয়ে ওঠে। হাতের কাছে পেলে আদ্যনাথকে তিনি উত্তমকুস্তম করে ছাড়তেন। এই সব ভাবেন বলে আজকাল তাঁর প্রেশার বেড়েছে, অরুচি বেড়েছে, অন্যমনস্কতা বেড়ে এমন হয়েছে যে, গোপাল আজকাল পুকুরচুরি ছেড়ে সমুদ্দুর চুরি করতে লেগে পড়েছে।
তবে উপায় আছে। রাজু মাঝে-মাঝে তাঁকে আমলকী দিতে আসে। সে কালীচরণের ঘর চেনে। ভারী ভাবসাব নাকি তার সঙ্গে। কিন্তু অসময়ে বাড়ি থেকে বেরোলে সুচরিতা দেবী কৈফিয়ত চাইবেন। গজপতি আবার লাগসই মিথ্যে কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না। নার্ভাস হয়ে পড়েন, তোতলামি আসে, চোখ-মুখে আর্ত ভাব ফুটে ওঠে এবং ধরা পড়ে যান। সুতরাং বুদ্ধি খাটাতে হবে, কিন্তু দুঃখের বিষয়, ওই জিনিসটা তাঁর বিশেষ নেই। বুদ্ধি থাকলে পদে-পদে এত নাকাল হতে হত না তাঁকে।
একটু বেলা হলে তিনি সুরেশের বাড়িতে হানা দিলেন।
সুরেশ এই সময় বারান্দায় বসে চা খান আর প্রকৃতি দেখেন। গজপতিকে দেখে সবিস্ময়ে বললেন, “কী ব্যাপার হে গজপতি! এত সকাল-সকাল যে!”
গজপতি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “আচ্ছা ধরো, আজ দুপুরে তোমার বাড়িতে আমার মধ্যাহ্নভোজনের নেমন্তন্ন!”
সুরেশ অবাক হয়ে বলেন, “তাই নাকি! কিন্তু কবে তোমাকে আজকের মধ্যাহ্নভোজনের নেমন্তন্ন করলাম বলো তো! আর উপলক্ষই বা কী! আজ কারও জন্মদিন নয়, বিবাহবার্ষিকী নয়, অন্নপ্রাশন নয়, তা হলে কিসের নেমন্তন্ন হে!”
“না সুরেশ, আসলে ঠিক নেমন্তন্ন নয়, তবে অনেকটা ও রকমই আর কী! বুঝতে পারলে না?”
“বিন্দু মাত্র না। অনেকটা ও রকমই বলতে তুমি কি বোঝাতে চাইছ? তোমাকে কি আমি ছাড়া আর কেউ আমার হয়ে নেমন্তন্ন করে এসেছে? কিন্তু নেমন্তন্ন করলেই তো হবে না। তার একটা আয়োজন আছে, বাজার করা আছে, পাঁচটা পদ রান্না করার আছে!”
“আরে না! একটা সহজ জিনিস কেন বুঝতে পারছ না বলো তো!”
“বুঝিয়ে বললে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। বাই দি বাই, তোমার কি বৌঠানের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে? নাকি তোমার রাঁধুনি আজকাল খুব খারাপ রান্না করছে! নাকি আমার বাড়ির সর্ষে-ইলিশের গন্ধ তোমার নাকে যাওয়ায় তুমি উচাটন হয়ে পড়েছ!”
তিতিবিরক্ত হয়ে গজপতি বললেন, “আরে না হে বাপু, ও সব কিছুই নয়। গিন্নির সঙ্গে আমার বোঝাপড়া চমৎকার, আমাদের রাঁধুনি ফার্স্ট ক্লাস রান্না করছে, অ্যান্ড ফর ইয়োর ইনফরমেশন, আমাদের বাড়িতেও আজ সর্ষে-ইলিশ হচ্ছে।”
“তা হলে আমার বাড়িতে পাত পাড়তে চাইছ কেন
“মোটেই চাইছি না। শুধু নেমন্তন্নটা চাইছি।”
“তার মানে কী, একটু বুঝিয়ে বলবে? পাত পাড়বে না অথচ নেমন্তন্ন খাবে, এটা কী করে হয়!”
“সোজা কথা হল, আজ যে তোমার বাড়িতে আমার নেমন্তন্ন সেটা আমার গিন্নিকে তোমার জানাতে হবে। ভয় নেই, তোমাকে সত্যি সত্যিই খাওয়াতে হবে না।”
“সেটা কী করে হয়?”
“হয় হে, হয়। বন্ধু হয়ে এই সামান্য উপকারটা করতে পারবে না?”
“তোমার মতলবটা কী খুলে বে তো!”
গজপতি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “আসলে আজ দুপুরে আমি এক জায়গায় যাব। কিন্তু আমার গৃহিণীকে তো তুমি জানো, হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত বেঁকে বসবেন।”
“তা যাবেটা কোথায়?”
“সে আছে এক জায়গায়।”
“বিবাগী হয়ে যাওয়ার মতলব নেই তো!”
“কেউ কি বলেকয়ে বিবাগী হয়, শুনেছ কখনও!”
“তা-ও তো বটে! তা আজকের অ্যাডভেঞ্চারটা কোথায় বলো তো!”
‘‘ডুংলি নদীর দিকটায়। কালীচরণের ঠেকটা একটু দেখে আসব ভাই। লোকটা অনেক দিন আসছে না।”
“তোমার কি মাথা খারাপ হল! ওই অত দূর ঠেঙিয়ে তুমি এক জন ফেরিওয়ালার খোঁজে যাবে!”
“কেন যাচ্ছি তা তুমি বুঝবে না। আমি একটা রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছি।”
“তুমি কি গোয়েন্দা না পুলিশ যে, রহস্য ভেদ করবে!”
“আপত্তি কোরো না ভাই, এক বার তার সঙ্গে দেখা না-করলে আমি শান্তি পাচ্ছি না।”
বিস্তর গাঁইগুঁই করে অগত্যা রাজি হলেন সুরেশ। তবে বললেন, “তা হলে ফিরে এসে আমার বাড়িতেই যা হোক দু’টি ডালভাত খেয়ো।”
গজপতি রাজি হলেন। একটু বেলার দিকেই রাজু আমলকী নিয়ে এল। তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন গজপতি। প্রথম খানিকটা রিকশায়, তার পর শাল-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অনেকটা হাঁটা পথ। হাঁসফাঁস করতে-করতে যখন পৌঁছলেন তখন খাড়া দুপুর।
রাজু দুঃখ করে বলল, “কালুদাদা এক জন ভাল লোক ছিল বাবু, কিন্তু টিকতে পারল না। কোথায় যে চলে গেল কে জানে।”
গজপতিরও মনটা ভারী খারাপ। প্লাস্টিকের ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরও মনটা হু হু করছিল। বললেন, “চল তো একটু ভিতরে ঢুকে দেখি কোনও ক্লু পাই কি না।”
“চলুন।”
দু’জনে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। আবছা অন্ধকারে দেখা গেল, ঘরে ইটের উনুন আর কয়েকটা ঠোঙা, একটা প্লাস্টিকের শিট, অ্যালুমিনিয়ামের একটা থালা আর হাঁড়ি ছাড়া কিছুই নেই। ভারী হতাশ হলেন গজপতি।
ঘরের এক কোণে একটা হলুদ রঙের বল পেয়ে সেটা কুড়িয়ে এনে গজপতির হাতে দিল রাজু, “এইটে পড়ে ছিল বাবু।’ “
গজপতি বলটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন। রবারের বল বলেই মনে হচ্ছে। বলের উপর একটা হাসিমুখের ছবি আঁকা। তিনি বলটা পকেটস্থ করলেন।
দুটো ছোট জিনিস মাটি থেকে তুলে দেখাল রাজু, “বাবু, দেখুন তো এ দুটো কী।”
গজপতি হাতে নিয়ে দেখলেন দুটো কার্তুজের খোল। এ দুটো এখানে এল কী করে তা ভেবে পেলেন না গজপতি। তবে পকেটে রেখে দিলেন যত্ন করে, সুরেশকে দেখাবেন।
সুরেশ বিকেলে কার্তুজের খোল দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন, “এ তো নাইন মিলিমিটার পিস্তলের কার্তুজ! সর্বনাশ! তোমার কালীচরণ কি ফায়ার আর্মসের কারবারও করে নাকি? এ তো বিপদের কথা! তাকে তো এক্ষুনি পাকড়াও করা দরকার!”
গজপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আর পাকড়াও! থানার লকআপে ছিল, বেশ ছিল। তুমিই তো তাকে বলে-কয়ে ছাড়িয়ে আনলে! কাজটা কি ভাল করলে তুমি!”
“আহা, আমি কি তখন জানতাম যে সে অস্ত্রের কারবারি!”
দুটো কার্তুজের খোল দেখে অত বড় সন্দেহ করাটা কি ঠিক হচ্ছে হে! সে পুরনো জাঙ্ক জিনিসের কারবারি, হয়তো কোথাও খোলদুটো কুড়িয়ে পেয়েছিল। সে হয়তো জানেও না এগুলো আসলে কী!”
“তোমার মতো আহাম্মকের হাতে যদি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থাকত তা হলে দেশ উচ্ছন্নে যেত।”
গজপতি দ্বিতীয় দীর্ঘশ্বাসটা ফেলে চুপ করে বসে রইলেন। মনটা বড্ড খারাপ।
আজকাল গজপতি মাঝে-মাঝে তাঁর ঘরের দরজা ভাল করে বন্ধ করে আলমারি খুলে তাঁর চারটে জিনিস বের করে দেখেন। কখনও লাট্টু ঘোরান, টর্চ জ্বেলে দেখেন, বল নিয়ে একটু মেঝেয় ধাপান। হুইসল বাজাতে হলে তাঁকে অবশ্য পালপাড়ার মাঠে যেতে হয়। তাও যান মাঝে-মাঝে। সময়টা তাঁর খারাপ কাটছে না। তবে তাঁর মনে-মনে আশা, ফেরিওয়ালাটা আবার কোনওদিন ঠিক ফিরে আসবে!