।।৬।।
কালো কুকুরটা আসলে ইবলিশের চর, অন্তত রাজুর তাই ধারণা। সকালে কোতলপুরের জঙ্গল থেকে আমলকী পেড়ে আনতে যখনই বেতবনের পাশ দিয়ে সে নদীর দিকটায় যায় তখনই কুকুরটা কোথা থেকে তেড়ে আসে। আর ডাকটাও গমগমে রাশভারী, শুনলে আঁত শুকিয়ে যায়। এ রকম ভয়ঙ্কর বাঘা কুকুর জীবনে দেখেনি সে, হাঁ করে যখন চেঁচায় তখন মুখের টকটকে লাল অভ্যন্তরে ওর আলজিভ পর্যন্ত দেখা যায়। আর কী বড়-বড় দাঁত, বাবা গো! ভাগ্যিস লম্বা আর সরু একটা শিকলে বাঁধা থাকে, নইলে কুকুরটা তার গলার নলি ছিঁড়ে ফেলত ওই দাঁত দিয়ে।
নদীর চরে নানা রঙের প্লাস্টিক শিট দিয়ে তৈরি ভারী গরিব চেহারার একখানা ঘর, বাঁশের মাচানের কাঠামোয় নড়বড়ে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোনওক্রমে। না-আছে ছিরি, না আছে ছাঁদ। কোনওরকমে মাথা গোঁজা যায় আর কী। ঘরের পাশেই একখানা হাড় জিরজিরে ভ্যানগাড়ি। তা ওইখানাই হচ্ছে কালুদাদার ঠেক। লক্ষ্মীছাড়া মানুষ। চালচুলোর যা অবস্থা তাতে দিন কাটে বলে মনে হয় না। তবু কালুদাদা দিব্যি হাদিসেই আছে। ওই বাঘা, মারাক্কু কুকুরটা তারই। যার নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সে কোন আক্কেলে যে অমন কুকুর পোষে কে জানে! ঘরে যাদের মেলা সোনাদানা আছে তারা পুষলে মানায়। কানুদাদার আছেটা কী! পুরনো, বাতিল সব জিনিসপত্র ফিরি করে বেড়ায়, তাও আবার ধার বাকিতে। তবে মানুষটা বড় ভাল, সব সময় মুখে একখানা সাদাসিধে হাসি, যেন এক জন ভারী বোকাসোকা লোক। দুনিয়ার বেশির ভাগ ভালমানুষই একটু বোকাসোকা লোক। এটা কেমন নিয়ম কে জানে বাবা!
রাজু দূর থেকেই হাঁক মারল, “কালুদাদা! ও কালুদাদা! ঘরে আছ নাকি?”
কালুদাদার ঘরে ঢোকার জন্য একখানা ফুটামতো দরজা আছে, কুঁজো হয়ে ঢুকতে বা বেরোতে হয়, তাতে আবার প্লাস্টিকেরই একখানা ঢাকনা আছে। বাহার দেখলে হাসি পায়।
হাঁক শুনে কোলকুঁজো হয়ে লোকটা বেরিয়ে এল, সেই কাঁকড় মাকড় একরাশ চুল, গায়ে একটা ময়লা নীল রঙের জামা, পরনে লটরপটর একখানা পাতলুন। তবে মুখে সেই সাদাসিধে হাসিটি। কালুদাদার আর কিছু না-হোক, দাঁতগুলো বড্ড ঝকঝকে। তাকে দেখে কুকুরটা চুপ মেরে গুটিসুটি হয়ে বসে পড়ল। কালীচরণ ভারী খুশি হয়ে বলল, “রাজুবাবু যে! আমলকী পাড়তে চললে বুঝি?”
“তা তো চললুম। কিন্তু তোমার কুকুরটা আমাকে দেখলে রোজ অমন চেঁচায় কেন বলো তো! রোজ দেখছে, তবু চেঁচায়। এত দিনেও চেনা হল না?”
কালীচরণ কাঁচুমাচু হয়ে মাথা চুলকে বলে, “চেঁচায় বটে, তবে গোলো কিন্তু লোক খারাপ নয়।”
“আহা, লোক তো আমিও খারাপ নই। চোরছ্যাঁচড় দেখলে চেঁচায় সে ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে দেখে চেঁচায় কেন বলো তো!”
“আসলে ওই রকমই প্রোগ্রাম করা আছে তো, তাই চেঁচায়।”
রাজু হাঁ করে চেয়ে থেকে বলে, “কী করা আছে বললে!”
কালীচরণ একগাল হেসে বলে, “কাল থেকে আর তোমাকে দেখে চেঁচাবে না। দেখে নিয়ো।”
“মন্তর পড়ে দেবে নাকি!”
“ওই রকমই আছে কিছু।”
“ও রকম রাগী একটা কুকুর পুষেছ কেন বলো তো! ঘরে গুপ্তধন আছে নাকি?”
কথা শুনে হেসে একেবারে ঢলাঢল হয়ে গেল কালীচরণ, তার পর বলল, “তা গুপ্তধনও বলা যায়। ছিল কিছু জিনিসপত্তর, কিন্তু লোকে তার মর্মই বুঝল না কিনা!”
“ও সব পুরনো অচল জিনিসপত্তর কী চলে! কে কিনবে বলো তো।”
কালীচরণ কথাটা শুনে খুব গম্ভীর মুখে ঘাড় নাড়ল, তার পর বলল, “ঠিকই বলেছ রাজুবাবু, আমার ব্যবসাটা চলল না। এবার দেখছি পাততাড়ি গুটোতে হবে।”
“পাততাড়ি গুটোবে! পাততাড়ি গুটোবে কেন? তার চেয়ে খেলনা বা কলপাকড়, কিংবা বাসনপত্র কিরি করলেও তো হয়।”
কালীচরণ মাথা চুলকে বলে, “ও সব ব্যবসা কি আমি জানি! ফেলাছড়া জিনিস নিয়েই আমার কারবার।”
“তুমি এক জন কিম্ভুত লোক আছ বাপু! লোকে পয়সা কামানোর জন্য কত অন্ধিসন্ধি খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু তোমার তো সেই সব ধান্ধাই নেই দেখছি!”
কালীচরণ খুব হাসল, যেন মজার কথা, তার পর বলল, “দেখি অন্য কোথাও গিয়ে ব্যবসা ফাঁদতে পারি কি না! এই জায়গায় আমার আর পোষাচ্ছে না রাজুবাবু।”
“বটে! তা যাবে কোথায়?”
“আমার মতো ভবঘুরের কি যাওয়ার জায়গার অভাব আছে? বেরিয়ে পড়লেই হয়।”
“তুমি চলে গেলে বড্ড ফাঁকা লাগবে, বুঝলে কালুদাদা!”
কালীচরণ খুব হাসল কথাটা শুনে। অথচ হাসির কথা কিছু বলেনি রাজু। তাই তার ফের মনে হল, দুনিয়ার বেশির ভাগ ভালমানুষই একটু বোকাসোকা হয়।
হাঁটুজলের নদী পেরিয়ে কোতলপুরের জঙ্গলে ঢুকে আমলকী পেড়ে দু’ঘণ্টা বাদে যখন ফিরল রাজু, তখন কালুদাদার বাঘা কুকুরটা ঝিমিয়ে পড়েছে, তাকে আড়চোখে দেখেও চেঁচাল না। কয়েকটা আমলকী দিয়ে যাবে বলে মায়াভরে “কালুদাদা, কালুদাদা” বলে কিছু ক্ষণ হাঁক মারল রাজু, কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
আমলকীর বেশ কয়েক জন ‘গাহেক’ আছে তার। নন্দবাবু, পরেশবাবু, সুরেশবাবু, গজপতিবাবু, আরও কয়েক জনা। রওনা হতে গিয়ে দেখতে পেল, কাতু পাগলা নদীতে নেমে গামছা দিয়ে মাছ ধরছে।
সে হেঁকে বলল, “কী রে কাতু, মাছ পেলি?”
কাতু বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুল তুলে দেখাল। পায়নি। তার পর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “কালুদাদাকে খুঁজছ? তাকে তো একটু আগে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল।”
“বলিস কী! পুলিশ ধরে নিয়ে গেল! কেন ধরে নিয়ে গেল জানিস?”
“কে জানে বাপু, চুরি-ডাকাতি কিছু করেছে নিশ্চয়ই। তা চুরিডাকাতি কি আর কিছু খারাপ কাজ! সবাই তো করে। পুলিশের দোষ কী জানো, বড্ড পেছনে লাগে মানুষের! ভাবছি গভর্নরকে একটা চিঠি লিখব পুলিশের নামে নালিশ করে।”
“লিখবি কী করে? তুই তো লিখতে-পড়তে জানিস না
“ও সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। গণপতি হাই স্কুলের জীবন মাস্টারের সঙ্গে কড়ার হয়েছে, গাছ থেকে সুপুরি পেড়ে দিলে বর্ণপরিচয় শিখিয়ে দেবে।”
“যাক, তা হলে তাড়াতাড়ি লেখাপড়াটা শিখে গভর্নরকে চিঠিটা লিখে ফেলো। পুলিশের উচিত শিক্ষে হোক। তা পুলিশ কালুদাদাকে মারধর করেনি তো!”
কাতু বড় বড় দাঁত দেখিয়ে একগাল হেসে বলে, “ওহ, তা হলে তো খুব জমে যেত! তাদের হাতে মোটা-মোটা লাঠি ছিল, বন্দুকও ছিল। পেটাই দেখতে আমার ভারী ভাল লাগে। তাই মাছধরা ছেড়ে কালুদাদার পেটাই দেখতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলুম।”
“তা পেটাতে পারল না বুঝি?”
“কী করে পেটাবে বলো! কালুদাদা তো দিব্যি ভালমানুষের মতো সুড়সুড় করে হাসি-হাসি মুখে ওদের সঙ্গে চলে গেল! এমন ম্যান্দামারা লোক যে, একটু ফাইটও দিতে পারল না। ফাইট দিলে কিন্তু পুলিশ খুব পেটাত! শুধু কুকুরটা পুলিশ দেখে ঘেউঘেউ করছিল। পুলিশগুলো রেগে গিয়ে কুকুরটাকে খুব লাঠিপেটা করেছে। কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি। ও তো আর চুরি-ডাকাতি করেনি, শুধু ঘেউঘেউ করেছে।”
কালুদাদাকে আগেও বার কয়েক পুলিশে ধরেছে, চোরাই জিনিস বিক্রি করে বলে সন্দেহে। তার পর ছেড়েও দিয়েছে। তাই বিশেষ উদ্বিগ্ন হল না রাজু। একটু বেলায় সুরেশবাবুর বাড়িতে বসে চা আর বিস্কুট খাচ্ছিল সে। তার খদ্দেরদের মধ্যে সুরেশবাবুর বেশ মায়াদয়া আছে। রোজই চা-বিস্কুট বা কিছু না-কিছু খাওয়াবেনই। কথায়-কথায় রাজু বলল, “বাবু, আজ কালুদাদাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা জানি কালুদাদা ভাল লোক, কোনও দু’নম্বরি করে না। আপনি যদি পুলিশকে একটু বলে দেন তা হলে কালুদাদাকে ওরা ছেড়ে দেবে।”
সুরেশবাবু বারান্দায় ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন, হাতে খবরের কাগজ। ভ্রু কুঁচকে বললেন, “দেখ রাজু, আমি চল্লিশ বছরের ওপর পুলিশে চাকরি করেছি, বহু আসামি ঘেঁটেছি। ভালমানুষ রূপী শয়তান বড় কম দেখিনি। আমার সন্দেহ কালীচরণ এক জন স্মাগলার। আর ওর জিনিসগুলোও সন্দেহজনক। হাইলি সাসপিশাস! ওকে অ্যারেস্ট করে পুলিশ ঠিক কাজই করেছে।”
“কিন্তু কালুদাদাকে যদি আটকে রাখে তা হলে তো ওর কুকুরটা না-খেয়ে মরে যাবে বাবু!”
“কুকুর! কালীচরণের আবার কুকুরও আছে নাকি?”
“যে আজ্ঞে। এই অ্যাত্তো বড় কালো একটা তেজি কুকুর! খুব রোখাচোখা!”
সুরেশবাবু কুকুরপ্রেমী মানুষ, তাই কুকুরের কথায় বিচলিত বোধ করলেন। বললেন, “আমি পুলিশকে বলে দিচ্ছি যাতে কুকুরটাকে খাবার দিয়ে আসে।”
রাজু মাথা নেড়ে বলে, “তাতে লাভ নেই। কালুদাদার কুকুর মনিবকে না পেলে অনশন করেই মরে যাবে। গোলো খুব প্রভুভক্ত কুকুর।”
সুরেশবাবু চিন্তিত হয়ে বলেন, “বলছিস! তা হলে দেখছি কী করা যায়। কালীচরণের যে কুকুর আছে সেটাই তো জানা ছিল না। কী নাম বললি কুকুরটার?”
“আজ্ঞে, গোলো।”
“ও বাবা, নামের তো বেশ বাহার আছে দেখছি! ঠিক আছে, আমি পুলিশকে বলে দিচ্ছি, তেমন কোনও কগনিজেবল অফেন্স না-থাকলে ছেড়ে দেয় যেন।”
রাত্রিবেলা দাবা খেলতে এসে গজপতি গম্ভীর মুখে বললেন, “কাজটা তুমি ঠিক করোনি।”
সুরেশ অবাক হয়ে বলেন, “কোন কাজটার কথা বলছ?”
“পুলিশকে বলে যে কালীচরণকে বড় ছাড়িয়ে আনলে! কাজটা কি ঠিক হয়েছে তোমার?”
“বলো কী হে! ‘এ কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে!’ এ তো উলটপুরাণ! তুমিই তো এত দিন কালীচরণের অ্যারেস্ট চাওনি!”
গজপতি গোমড়া মুখ করে বললেন, “এত কাল চাইনি, কিন্তু এখন চাই।”
“কেন বলো তো!”
‘‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কালীচরণ বিপদের মধ্যে আছে। বাইরে থাকার চেয়ে এখন কাস্টডিতে থাকলে নিরাপদে থাকবে।”
“বিপদ! কী রকম বিপদ বলে মনে হচ্ছে তোমার?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গজপতি বলেন, “আমি জানি আমার কথার কোনও গুরুত্ব তোমার কাছে নেই। আমি ইমপ্র্যাক্টিক্যাল। তবু বলছি, আমার মন বলছে, কালীচরণের একটা বিপদ ঘটতে পারে।”
সুরেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, “দেখো গজপতি, কালীচরণ এক জন যৎসামান্য ফেরিওয়ালা, দিন আনে দিন খায়। দু’-একটা ম্যাজিক্যাল আইটেম তোমাকে গছিয়ে গেছে বলেই সে তো আর সায়েন্টিস্ট বনে যায়নি! তুমি তিলকে তাল করছ।”
গজপতি তাঁর দ্বিতীয় দীর্ঘশ্বাসটি ফেলে বললেন, “তুমি যা-ই বলো, আমার কিন্তু কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে হে সুরেশ, আর সেই জন্যই আমি একটা ফল্স চার্জে ওকে অ্যারেস্ট করিয়েছিলাম।”
সুরেশবাবু চোখ কপালে তুলে বলেন, “তুমি! শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করতে হবে যে এ কাজ তোমার?”
গজপতি খুবই লজ্জিত বোধ করছিলেন। কাজটা যে আহাম্মকের মতো হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, তার উপর একটা মিথ্যাচারও তো বটে। মুখখানা নামিয়ে বললেন, “ভেবেছিলাম এ সব জিনিসের সন্ধান যদি বদমাশ লোকেরা পায় তা হলে তারা কালীচরণের ওপর চড়াও হবে। বিশেষ করে লাট্টুর ঘটনার পর ব্যাপারটা খানিকটা লোক জানাজানি হয়েছে তো! তাই।”
“তোমার মাথায় বিজ্ঞান নয়, সায়েন্স ফিকশন আর থ্রিলার ঘুরছে। একটা টর্চ, একটা হুইসল আর একটা লাট্টুর কেরামতি দেখে তোমার কল্পনাশক্তি একেবারে ডানা মেলে দিয়েছে। আরে, আজকাল বাচ্চাদের এমন সব ইলেকট্রনিক খেলনা বেরিয়েছে যা দেখলে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। এগুলো সেই রকমই কয়েকটা খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়। চিনে জাপানে এ সব আকছার তৈরি হচ্ছে।”
গজপতি বুঝতে পারছিলেন যে, তিনি হেরে গেছেন। দুঃখের কিছু নেই, কারণ তিনি সব সময়ে এবং সবার কাছেই হারেন। হেরে যাওয়াই তাঁর অভ্যাস। একমাত্র হরিধন ছাড়া তিনি আজ পর্যন্ত আর কাউকে হারাতে পেরেছেন বলে স্মরণ করতে পারলেন না। তাই গজপতি নিশ্চিন্তে তাঁর তৃতীয় দীর্ঘশ্বাসটি ফেললেন। দীর্ঘশ্বাস অতি উপকারী জিনিস, তাতে অক্সিজেন ইনটেক বাড়ে। ওই অনুলোম, বিলোম, কপালভাতি এ সবও তো নানা রকম দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়!
দাবা খেলায় সুরেশবাবুর কাছে হেরে যাওয়ার পর তাঁর চতুর্থ দীর্ঘশ্বাসটি পড়ল। গজ দিয়ে সুরেশের রাজা আর মন্ত্রীকে এক লাইনে পেয়ে গিয়ে ভারী আহ্লাদ হয়েছিল তাঁর। সুরেশের মন্ত্রী নির্ঘাত মারা পড়ে। কিন্তু গজটা যে সুরেশের ঘোড়ার পাল্লায় ছিল সেটা একেবারে চোখে পড়েনি। গজটা কাটা পড়তেই খেলাটা নেতিয়ে একপেশে হয়ে গেল, রোজই যেমন হয়। আর এই ভাবেই রোজ গজপতির আত্মবিশ্বাস এক ধাপ করে নীচে নামতে থাকে।
হেরে যাওয়ার পর রোজই তিনি তাঁর কোথায় কোথায় ভুল হল তা ভাবতে-ভাবতে এবং বিড়বিড় করে পর্যালোচনা করতে-করতে বাড়ি ফেরেন। আজও ফেরার সময় তিনি বিড়বিড় করে বলছিলেন, “না, আগের চালটায় বোড়েটা টিপে দিলেই ওর ঘোড়াটা চাপা পড়ে সরে যেত, তা হলে মন্ত্রীটা বাঁচাতে পারত না। বরং গজের চালটা আর একটু সামাল দিয়ে নিয়ে তবে দেওয়া উচিত ছিল। নাহ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে তো…”
ঠিক এই সময়ে ঘন কুয়াশার মধ্যেই একটা কোট, মাফলার, টুপিতে ঢাকা লোক তাঁর পথ আটকে ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠল, “আচ্ছা, এখানে গজপতিবাবুর বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?”
গজপতিবাবু একটু বিরক্ত হলেন, চিন্তায় ব্যাঘাত হওয়ার ফলে। তারপর ঘোর অন্যমনস্কতার ভিতরেই আওড়ালেন, “গজপতিবাবু!গজপতিবাবু!নামটা চেনা-চেনা লাগছে বটে, কিন্তু মনে পড়ছে না তো! আপনি বরং মোড়ের গদাধর স্টোর্সে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন তো। ওরা বোধ হয় বলতে
এর পর কৃতিত্বের সঙ্গেই তিনি বাড়ি ফিরে এলেন, তবে দাবার চালগুলো তখনও তাঁর মাথায় ঘুরছে। বাথরুমে গিয়ে ঠান্ডা জলের ঝাপটা চোখে-মুখে দিতেই ঝড়াক করে তাঁর মনে পড়ে গেল যে, ‘আরে! তিনিই তো গজপতি! গজপতি যে তিনিই!’
গজপতিবাবু বাথরুম থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গোপালকে ডেকে বললেন, “ওরে, যা তো, দেখে আয় রাস্তায় কে যেন আমাকে খুঁজছে!”
গোপাল অবাক হয়ে বলল, “রাস্তায় কে আপনাকে খুঁজছে তা আপনি ঘর থেকে টের পেলেন কী করে?”
“ওরে না না, রাস্তায় লোকটা যে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, গজপতিবাবুর বাড়িটা কোথায়!”
গোপাল আরও অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলে, “তা হলে তাকে নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে এলেন না কেন?”
এই প্রশ্নের সদুত্তর গজপতির জানা নেই। তিনি টালুমালু করে চার দিকে চেয়ে বললেন, “আচ্ছা, তোর কি মায়াদয়া নেই! লোকটা এই ঠান্ডায়, অন্ধকারে পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তুই মুখে-মুখে তর্ক করছিস! একটু সাহায্য করতে পারছিস না লোকটাকে?”
গোপাল অবাক হয়ে বলে, “ঠান্ডায় অন্ধকারে পথে তো মেলা লোকই যাতায়াত করছে, তার মধ্যে আপনার লোকটাকে আমি খুঁজে পাবো কেমন করে?”
গজপতির মাথায় একটা চমৎকার আইডিয়া এল। তিনি একগাল হেসে বললেন, “তা হলে এক কাজ কর, গেটের কাছে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বেশ হেঁকে কয়েক বার বল, এটাই গজপতিবাবুর বাড়ি! এটাই গজপতিবাবুর বাড়ি!”
“তা হলে কথাটা মাসিমাকে গিয়ে বলি, কারণ এখন আমার রাতের রুটির জন্য আটা মাখতে বসার কথা। এখন বাইরে গিয়ে হাঁকাহাঁকি করলে মাসিমা আমাকে আস্ত রাখবেন না।”
গজপতি সতর্ক হয়ে গেলেন, কাজটা বোধ হয় খুব একটা বিবেচকের মতো হবে না। বললেন, “তবে থাক।”
একটা গলাখাঁকারি দিয়ে গোপাল বলল, “তা হলে মাসিমাকে গিয়ে কথাটা বলি?”
গজপতি সভয়ে বলেন, “কী বলবি?”
“এই যে আপনি আমাকে ফটকের কাছে গিয়ে ‘এটাই গজপতিবাবুর বাড়ি! এটাই গজপতিবাবুর বাড়ি!’ বলে চেঁচাতে বললেন!”
গজপতি হাঁ করে কিছু ক্ষণ চেয়ে রইলেন গোপালের দিকে। ছোকরার বদমাইশি বুদ্ধির সঙ্গে এঁটে ওঠা তাঁর কম্মো নয়। তিনি অত্যন্ত কাতর গলায় বললেন, “কত?”
“শতখানেক হলে হয়। ঘরে পরার হাওয়াই চটি জোড়া ছিঁড়েছে তো, নতুন এক জোড়া দরকার।”
গেল একশো টাকা। কী আর করবেন, এই ভাবেই চিরকাল তাঁকে নানা লোকের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে আসতে হয়েছে। তাই এবার তাঁর পঞ্চম দীর্ঘশ্বাসটি আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল।
ভদ্রলোক কিন্তু এলেন। রাত সোয়া আটটা নাগাদ। শীতে কাতর, জড়সড়, কম্পমান এক জন বুড়ো মানুষ। গায়ে সেই ঝুব্বুস একটা কোট, গলায় মাফলার, মাথায় গল্ফ ক্যাপ। বাইরে জুতো ছেড়ে বৈঠকখানায় ঢুকে ভারী বিনয়ের সঙ্গে মাথা নুইয়ে নমস্কার করলেন গজপতিকে। ঘড়ঘড়ে গলাতেই বললেন, “আমার নাম আদ্যনাথ সর্বাধিকারী। শুনেছি আপনি একজন বিজ্ঞানী, তার উপর আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, গুরুজন, তাই আপনাকে আমার সম্মান জানাতে এলাম। আপনি যদি আমার আগমনে বিরক্ত না-হয়ে থাকেন তা হলে আমার একটু নিবেদন আছে।”
গজপতি নতুন মানুষের সামনে বরাবরই একটু অপ্রস্তুত। তার উপর এই মানুষটা তাঁকে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং গুরুজন বলায় তিনি একটু অবাকও হয়েছেন, কারণ এই বুড়ো মানুষটি তাঁর চেয়ে অন্তত বছর দশেকের বড়। তাই আমতা-আমতা করে বললেন, “আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, বসুন।”
ভদ্রলোক জড়সড় হয়েই একটা সোফায় বসলেন। তার পর দস্তানা পরা হাত দিয়ে সোফাটা একটু চেপেচুপে দেখে নিলেন এবং চার দিকে খুব কৌতূহল নিয়ে চোখ বোলালেন। তার পর বললেন, “আপনাদের এই বসার আসনগুলো খুবই আরামদায়ক। এমনকি আপনাদের বাসস্থানটিও বেশ চমৎকার।”
গজপতি একটু অবাক হলেন, তাঁর বাড়ির সোফাসেট আর পাঁচটা বাড়ির মতোই সাধারণ, বাড়িরও কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, তা হলে লোকটা সোফা বা বাড়ির প্রশংসা করছে কেন? তিনি শুধু বললেন, “আপনার ভাল লাগলেই ভাল। একটু চা খাবেন?”
লোকটা হঠাৎ যেন ভয় পেয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল, “না মহাশয়, না! আমি খাদ্য-পানীয় কিছুই গ্রহণ করতে অপারগ।”
লোকটা যেন একটু কেমনধারা সাধুঘেঁষা ভাষায় কথা কইছে দেখে অবাক হলেন গজপতি। ‘মহাশয়’, ‘অপারগ’ এ সব কথা তো কেউ মুখের কথায় ব্যবহার করে না! তবে এমন হতেই পারে যে, লোকটা বাঙালি নয়, হালে বাংলা শেখার চেষ্টা করছে!
গজপতি তবু আন্তরিক গলাতেই বললেন, “আপনি তো শীতে বেশ কাতর হয়ে পড়েছেন দেখছি! একটু চা খেলে শরীরটা তো গরম হত।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “না মহাশয়, আমাদের অনেক বিধিনিষেধ আছে। বিশেষত এখানকার জীবাণু বহন করে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।”
গজপতির মাথায় কিছুই ঢুকল না। তিনি ফের আমতা-আমতা করে বললেন, “জীবাণু! ফুটন্ত জলে তো জীবাণু থাকার কথা নয়!”
লোকটা বলল, “আপ্যায়নের কোনও দরকার নেই। আমি বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি।”
“কী প্রয়োজন বলুন!”
“আমি এসেছি একটি ভুল সংশোধন করতে।”
গজপতির মাথার ভিতরে এখনও দাবার ঘোড়া লাফাচ্ছে, বোড়ে এগোচ্ছে, মন্ত্রী পজিশন নিচ্ছে, গজ শ্যেনদৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, “ভুল! কী ভুল বলুন তো! বাই এনি চান্স আপনি আমার দাবা খেলার ভুল ধরতে আসেননি তো! এটা ঠিক কথাই যে আমার বাঁ-দিকের তিন নম্বর ঘরের বোড়েটা এগিয়ে রাখা উচিত ছিল। তাতে ঘোড়াটা না-সরিয়ে সুরেশের উপায় থাকত না। সামান্য একটা ক্যালকুলেশনের গন্ডগোল। তবে কিনা…”
ভদ্রলোক মাথাটা ঘন ঘন নাড়া দিয়ে বললেন, “না মহাশয়, আমি দাবা ক্রীড়া জানি না। ওইটি কালহরণকারী ক্রীড়া। দাবায় আমার কৌতূহল নাই। আমি অন্য একটি প্রমাদের কথা বলতে এসেছি।”
গজপতি বলেন, “প্রমাদ! প্রমাদ মানে তো ভুল! আবার কী ভুল করলাম রে বাবা যে, বাড়ি বয়ে লোকে ভুল ধরতে আসে!”
“হ্যাঁ মহাশয়, একটি ভুল ধরতেই আমার এত দূর থেকে আসা।” “আপনি কত দূর থেকে আমার ভুল ধরতে এসেছেন শুনি! আমেরিকা না হাওয়াই?”
“এটা সেই দূরত্ব নয়। আপনাদের সঙ্গে আমাদের নানাবিধ দূরত্ব আছে। সব উন্মোচন করে বলা যাবে না।”
“দেখুন মশাই, আমি একটু অন্যমনস্ক লোক সেটা স্বীকার করছি। আর তাই নানা রকম ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি হয়ে যায়। কিন্তু তার জন্য আপনি এই বুড়ো বয়সে এত দূর থেকে হন্তদন্ত হয়ে চলে এলেন কেন, সেটাই বুঝতে পারছি না। কী এমন ভুল করেছি বলুন তো!”
“আপনার কাছে তিনটি দ্রব্য আছে। তিনটি খেলনা জাতীয় জিনিস। আপনি এক জন বিজ্ঞানী এবং বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, ওগুলি খেলনা নয়!”
গজপতি লোকটার দিকে চেয়ে লোকটা কতখানি ধূর্ত এবং মতলব কী তা বোঝার বৃথা চেষ্টা করে বলেই ফেললেন, “জানি।”
“কিন্তু আপনি এটা জানেন না যে, ওগুলি আপনাদের স্থান ও কালানুযায়ী কতখানি বিপজ্জনক।”
গজপতি অবাক হয়ে বলেন, “বিপজ্জনক! বলেন কী মশাই, বিপজ্জনক হতে যাবে কেন? ওগুলো তো খুব উপকারী জিনিস।”
লোকটি মাথা নেড়ে বললেন, “না মহাশয়, আপাতদৃষ্টিতে উপকারী বলে মনে হলেও আপনাদের আপেক্ষিক স্থান ও কালের পক্ষে ওই প্রযুক্তি উপযুক্ত নয়। ওগুলি ভ্রমক্রমে এই স্থান ও এই কালে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু এটা প্রকৃষ্ট সময় বা প্রকৃষ্ট স্থান নয়। আপনি দয়া করে ওগুলি ব্যবহার করবেন না। তাতে আপনাদের ক্ষতি হতে পারে।”
গজপতি উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন, “কী ক্ষতি হতে পারে বলুন তো!”
“আপনি যদি প্রস্তর যুগে গিয়ে বন্দুক দিয়ে পাখি বা জীবজন্তু শিকার করেন তা হলে আবহের নকশায় একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা। বিবর্তনের বিরুদ্ধাচরণ বা প্রকৃতির নিয়মকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করা কি ভাল?”
গজপতি আরও একটু উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি টাইম ট্র্যাভেলের গপ্পো ফাঁদছেন নাকি মশাই?”
“ওই রকমই কিছু ধরে নিন।
“তার মানে আপনি এক জন টাইম ট্র্যাভেলার!”
“আপনাদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব স্থানিক, কালিক, তারঙ্গিক এবং ভৌতিক। কিছু বুঝলেন?”
“না মশাই, আমার বাংলা জ্ঞান ভাল নয়। তবে মনে হচ্ছে আপনি এক জন গোলমেলে লোক। আপনার মতলবটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।”
ভদ্রলোকের গোমড়া মুখে এবার একটা তির্যক হাসি ফুটল। ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, “বোঝার কথাও নয়। শুধু দয়া করে ওই খেলনাগুলোয় আর হাত দেবেন না। ওগুলো আমরা নিয়ে নেব।”
“আপনি কি ওগুলো চাইতেই এসেছেন নাকি? যদি তা-ই এসে থাকেন তা হলে আগেই বলে দিচ্ছি, আমি কিন্তু ওগুলো হাতছাড়া করতে পারব না। লাখ টাকা দিলেও না।”
লোকটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “না মহাশয়, আমি দ্রব্যগুলি স্পর্শও করব না। তাতে বিপদ হতে পারে। তাই নিষেধ আছে। আপনি দ্রব্যগুলিকে রক্ষা করুন, কোনও আপত্তি নেই। যখন সময় হবে তখন ওগুলি আমরা নিয়ে নেব।”
“মগের মুলুক নাকি! নিয়ে নেবেন মানে! ওগুলো আমি কালীচরণের কাছ থেকে কিনেছি।”
“কালীচরণ কে মহাশয়?”
“সে এক জন ফেরিওয়ালা এবং এক জন ভাল লোক।”
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, “আমি কোনও কালীচরণকে চিনি না। তবে জাবালিকে চিনি। সে এক জন সময়চারণ। নানা কালখণ্ডে সে বিচরণ করে এবং স্থান ও কালের উপযোগী প্রযুক্ত দ্রব্যাদি সরবরাহ করে, যাতে পৃথিবী ও মনুষ্যকুল নিরাপদে থাকতে পারে। আপনার কাছে অনুরোধ, দয়া করে ভ্রমক্রমেও আর দ্রব্যগুলো স্পর্শ করবেন না বা কাউকে স্পর্শ করতে দেবেন না। যথা সময়ে আমাদের দূত ওগুলো আপনার কাছ থেকে সংগ্রহ করবে।”
“তার মানে কি চুরি করবেন?”
“পরস্বাপহরণকে চুরি বলে, কিন্তু দ্রব্যগুলো তো আপনার নয়।”
গজপতি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বললেন, “আলবাত আমার।”
ভদ্রলোক কথা বাড়ালেন না, তর্ক করলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে বিনীত ভাবে নত হয়ে নমস্কার করলেন। ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, “আজ আমি আসি। আর কখনও আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে না।”
ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর গজপতি নিজের ঘরে গিয়ে তাঁর একটা মজবুত আলমারির মধ্যে হুইসল, টর্চ আর লাট্টুটা লুকিয়ে রাখলেন। চাবি রইল তাঁর কোমরের ঘুনশিতে। লোকটা যে এক জন মতলববাজ এবং ইম্পস্টার তাতে সন্দেহ নেই। আবোলতাবোল বুঝিয়ে জিনিসগুলো হাতানোর তালে ছিল। দরকার হলে তিনি বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসাবেন, গুন্ডা পুষবেন, বাউন্সার রাখবেন, তবু জিনিসগুলো হাতছাড়া করা যাবে না।
পর দিন দাবা খেলতে বসে গজপতি বললেন, “খুব যে জিনিসগুলোকে খেলনা বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিলে, এই তো গত কালই ওগুলো হাতানোর জন্য এক জন বুড়ো লোক এসে হাজির। বলে কিনা সে এক জন টাইম ট্র্যাভেলার। আমি অবশ্য তার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছি, লোকটা গুলবাজ। পাত্তাই দিইনি।”
সুরেশ সিরিয়াস মুখ করে বললেন, “তোমার উচিত ছিল লোকটাকে পুলিশে দেওয়া। ছেড়ে দেওয়াটা উচিত হয়নি।”
“আরে লোকটা বেশ বুড়ো, আমার চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড়, পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর তো হবেই। পুলিশের রুলের গুঁতো খেলে যে অক্কা পাবে হে!”
“পুলিশ বুঝি যাকে পায় তাকেই পেটায়? ওটা তোমার ভুল ধারণা। তবে মাঝে-মাঝে থার্ড ডিগ্রির দরকার হয় কথা আদায়ের জন্য। তোমার উচিত ছিল পুলিশকে ফোন করে ধরিয়ে দেওয়া।”
“আরে বাবা, লোকটা গুলগপ্পো ঝেড়েছে মাত্র, তার বেশি তো কিছু করেনি! গুল মারা ভাল নয় ঠিকই, কিন্তু ক্রাইমের মধ্যেও পড়ে না। ঠিক কিনা!”
সুরেশ গম্ভীর গলায় বললেন, “হুঁ, তা বটে। তবে পুলিশে একটা ইনফরমেশন দিয়ে রাখা ভাল।”
“তোমার যেমন পুলিশের ওপর অগাধ বিশ্বাস আমার কিন্তু তেমন নেই। পুলিশ অনেক ভুলভাল করে।”
“তার চেয়ে অনেক বেশি ভুল তুমি করো। কী করে যে তুমি সায়েন্টিস্ট হলে সেটাই রহস্য। অবশ্য শুনেছি, আইনস্টাইনও নাকি বাজারে গিয়ে পয়সার হিসেব মেলাতে পারতেন না।”
“তা হলেই বুঝে দেখো, কারও কারও মাথা ছোটখাটো ব্যাপারের জন্য নয়।”
“তা বলে নিজেকে আইনস্টাইন ভেবে ফেলো না যেন! তাঁর দোষগুলো পেলেই তো হবে না, গুণগুলোও তো পেতে হবে!”
“তা বটে।”
“কখনওসখনও গজপতি যে দাবায় সুরেশবাবুকে হারিয়ে দেন না তা কিন্তু নয়। কালেভদ্রে তেমন ঘটনাও ঘটে। আজ যেমন। একটা নৌকো এবং দুটো গজের আচমকা কম্বিনেশনে আজ সুরেশবাবুকে এমন চেপে ধরলেন গজপতি যে, সুরেশবাবু সারেন্ডার করে বললেন, “না হে গজপতি, আজ দেখছি তুমি দুর্ধর্ষ খেলেছ! আমার আর দেওয়ার মতো চালই নেই।”
গজপতি আজ ভারী ডগমগ হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। আজও যথারীতি ঘন এবং জমাট কুয়াশা। চার দিকে হিম শীতলতা। রাস্তা অন্ধকার। কিন্তু গজপতির ভিতরটায় আজ আলো জ্বলছে। আজ তিনি সুরেশকে হারিয়ে দিয়েছেন। সুরেশ কিছু গ্যারি কাসপারভ বা বিশ্বনাথন আনন্দ নন, তবু গজপতির আজ নিজের পিঠ চাপড়ে দেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল। নিজেকেই মালা পরানোর ইচ্ছে হচ্ছিল। নিজের হাতে বিশ্বকাপ তুলে দেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল। তিনি মনশ্চক্ষুতে দেখতে পাচ্ছেন, হাজার হাজার লোক উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর জয়ে হাততালি দিচ্ছে, চিৎকার করে অভিনন্দন জানাচ্ছে। গা বেশ গরম লাগতে লাগল গজপতির। তেমন শীতও যেন করছে না। ওহ, আজ জব্বর চাল দিয়েছেন তিনি। অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে, আগুপিছু ইগলের মতো পর্যবেক্ষণ এবং চমৎকার ক্যালকুলেশন করে। বাহবা! বাহবা!
কিন্তু এই জয়টা তো সেলিব্রেট করা দরকার! কিন্তু কী করে সেলিব্রেট করা যায়? রাতে লুচি আর পাঁঠার মাংস হলে কেমন হয়? কিংবা মুরগি আর পরোটা? সঙ্গে একটু রাবড়ি!
মুশকিল হল মনে-মনে ভাবলেও কথাগুলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে বেরিয়ে আসে এবং আশপাশের লোক শুনতেও পায়। কে এক জন পাশ কাটিয়ে যেতে-যেতে বলে গেল, “তা হলে তো তোফা হয় মশাই! বলেন তো আমারাও জনা কয়েক চলে আসতে পারি আপনার বাড়ি। কত কাল মুরগি আর পরোটা খাওয়া হয়নি!”
গজপতি অপ্রস্তুত হলেন। নাহ, তিনি মনে মনে ভাবলেও লোকে যদি তা টের পেয়ে যায় তা হলে তো বেজায় সঙ্কট! তার চেয়ে এ সব বরং না-ভাবাই ভাল। তার উপর লুচি-মাংস বা মুরগি-পরোটা, এ সব প্রস্তাবে সুচরিতা দেবীকে রাজি করাবে কে? কার এমন বুকের পাটা? এক ঘটি জল ঢেলে দেবেন। মনটা বড্ড দমে গেল তাঁর। না, আজকের স্মরণীয় জয়টাকে উপভোগ করার কোনও কৌশলই তাঁর মাথায় আসছে না।
বেজার মুখে এবং বিষণ্ন মনে তিনি ঘরে এসে চুপচাপ কিছু ক্ষণ বসে রইলেন। তিনি যে আজ একটা বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন সেটা যে কাকে জানানো যায় সেটাই ভেবে পেলেন না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি উঠে নিয়মমাফিক তাঁর আলমারিটা খুলে তিনটি জিনিস ঠিকঠাক আছে কি না তা খতিয়ে দেখলেন। আছে। টর্চ, হুইস্ল আর লাট্টু সব ঠিকঠাকই আছে।
আলমারিটা বন্ধ করতে গিয়েও হঠাৎ তাঁর একটা খটকা লাগল। তিনটে জিনিস আছে বটে, তবে তার সঙ্গে একটা বাড়তি জিনিসও আছে বলে মনে হচ্ছে যেন! হ্যাঁ তো! লাট্টুটার পাশেই সযত্নে ভাঁজ করা একটা লেত্তি! আশ্চর্য! লেত্তিটা এল কোত্থেকে? এই লাট্টুর সঙ্গে তো লেত্তি ছিল না! থাকার কথাও নয়! এই লাট্টু ঘোরাতে লেত্তির তো কোনও প্রয়োজনই হয় না! তা হলে?
মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছিলেন না গজপতি। তিনি সন্দিহান হয়ে লাট্টুটা নিয়ে দু’আঙুলের ফুরকি দিয়ে ঘোরানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু লাট্টুটা মোটেই ঘুরল না, নেতিয়ে পড়ে গেল। গজপতি অবাক! এসব কী হচ্ছে! লাট্টুটার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তিনি। তার পর লেত্তিটা নিয়ে যত্ন করে লাটুটায় পেঁচিয়ে হাত ঘুরিয়ে ছুড়ে মারতেই লাট্টুটা মেঝেয় পড়ে বনবন করে ঘুরতে লাগল এবং কিছু ক্ষণ পরেই দম ফুরিয়ে ঘাড় লটকে নেতিয়ে ছিটকে গিয়ে চেয়ারের পায়ায় লেগে থামল। গজপতি অবাক, লাটুটা কি স্বধর্মচ্যুত হয়েছে, নাকি কেউ পাল্টে দিয়ে গেছে!
দরজার কাছে ছোট্ট একটা গলাখাঁকারি শোনা গেল, গোপাল ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “মেসোমশাই কি এত রাতে লাট্টু ঘোরাচ্ছেন নাকি?”
গজপতি আঁতকে উঠে বলেন, “কে বলেছে যে, আমি লাট্টু ঘোরাচ্ছি!”
গোপাল আহ্লাদের গলায় বলে, “বলতে নেই, লাট্টু কিন্তু আপনি ভালই ঘোরান! আড়াল থেকে দেখছিলাম তো! দিব্যি লেত্তি প্যাঁচালেন, তার পর ওস্তাদের মতো হাত উল্টে লাট্টুটা ছুড়লেন, ঘুরলও চমৎকার। মাসিমা যে বলেন আপনি কোনও কাজের নন, সে কথাটা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। আমি এখুনি মাসিমাকে ব্যাপারটা গিয়ে জানাচ্ছি।”
গজপতি আতান্তরে পড়ে বললেন, “ওরে দাঁড়া, ও সব বললে হিতে বিপরীত হবে যে! এই নে বাবা কুড়িটা টাকা রাখ। কিছু বলতে হবে না মাসিমাকে।”
গোপাল বিদায় হলে তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে খানিক ক্ষণ ভাবলেন! তার পর সন্দেহের বশে তিনি তাড়াতাড়ি টর্চটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন, একই টর্চ বলেই তো মনে হচ্ছে। কম্পিত বক্ষে তিনি সাবধানে সুইচটা টিপতেই দিব্যি ফটফটে আলো জ্বলে উঠল যে! কী সর্বনাশ, এ রকম তো হওয়ার কথা নয়! এই টর্চে আলো জ্বলছে কেন? অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তিনি টর্চটার দিকে চেয়ে রইলেন। দুঃখে, শোকে তাঁর বুক ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। এগুলো কি সেই জিনিসগুলো নয়!
এ বার তিনি কাঁপা হাতে হুইসলটা নিয়ে ভাল করে দেখলেন, হুবহু সেই একই হুইসল। তাঁর বুক কাঁপছে, হাত-পা বশে নেই, একটু ভেবে নিয়ে তিনি হুইসলটা ঠোঁটে চেপে ধরে খুব জোরে একটা ফুঁ দিলেন। আর আশ্চর্যের বিষয়, নিঝুম নিস্তব্ধতা ভেঙে হুইস্লটা পঞ্চম স্বরে কুহু কুহু রবে বেজে উঠে সারা বাড়ি এবং পাড়া কাঁপিয়ে তুলল। আর তার ফলে সারা বাড়িতে একটা শোরগোল এবং হুলস্থুল পড়ে গেল। বাড়ির সবাই ছুটে এসে দরজায় ধাক্কাধাক্কি!
গজপতি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে হুইসলটার দিকে চেয়ে রইলেন, বিশ্বাসঘাতক হুইসলটার তো বাজার কথাই নয়! এর পর আর সন্দেহের অবকাশই নেই যে, আদ্যনাথ সর্বাধিকারীর লোকজন এসে আসল জিনিসগুলো চুরি করে নকল জিনিস রেখে গেছে। মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি।
দরজায় ধাক্কাধাক্কি আর চেঁচামেচি শুনতে তাঁর অনেক সময় লাগল। দরজা খুলে দিয়ে তিনি দেখলেন হুইস্লের আওয়াজে বাড়ি এবং পাড়ার লোকও জড়ো হয়ে গেছে। লজ্জার শেষ নেই। অথচ আজ তাঁর জীবনের একটা গৌরবেরই দিন ছিল। আজ তিনি সুরেশকে দাবায় হারিয়ে দিয়েছেন!