এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা – ৫

॥ ৫॥

হিমশীতল, নিস্তব্ধ, অন্ধকার এক শেষ রাত্তিরে এক আশ্চর্য স্টেশনে নামল শ্যাডো। খোলা প্ল্যাটফর্ম ঘন কুয়াশায় ডুবে আছে। আবছা আলোয় চার দিকটা কেমন ভূতুড়ে! যেন পরাবাস্তব, যেন স্বপ্নদৃশ্য, যেন রূপকথার দেশ। আর অনেক দিন পর বাতাসে উদ্ভিদের গন্ধ পেল সে, যে গন্ধ কলকাতায় পাওয়াই যায় না। ছায়া-ছায়া, কোলকুঁজো দু’এক জন মানুষকে আবছা দেখতে পাওয়া গেল। একটু দূরে গরম চা ফিরি করছে চাওয়ালা। তাকে দেখা যাচ্ছে না। আর প্রবল শীত টের পেল সে। কাঁপুনি ওঠার মতো শীত। শ্যাডোর গায়ে মাত্র একটা পুরনো পুলওভার। লাগেজ ভারী হবে বলে বেশি গরম জামা আনেওনি সে। তবে একটা জ্যাকেট থাকলে ভাল হত।

কোন দিকে যেতে হবে তা বুঝতে পারছিল না শ্যাডো। থমকে দাঁড়িয়ে নিরেট কুয়াশা ভেদ করে চার দিকটা অনুমান করার চেষ্টা করছিল। এমন সময়ে হঠাৎ আবছা মতো এক জন তার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মৃদু স্বরে বলে গেল, “বাঁ দিকে ওভারব্রিজ।”

শ্যাডো চমকায় না। তার বিস্ময় খুব কম।

তাড়া নেই। ধীরে-সুস্থে গন্তব্যের সন্ধান করা যাবে। তার চা বা কফির নেশা নেই। কিন্তু এই প্রচণ্ড শীতে গরম কিছু হলে ভাল লাগবে হয়তো। বাঁ দিকেই এগিয়ে গেল সে এবং একটু এগিয়েই প্ল্যাটফর্মের মাঝমধ্যিখানে একটা চায়ের দোকান পেয়ে গেল। চায়ের মাঝবয়সি দোকানির শীতবস্ত্রের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। একটা ঝ্যালঝ্যালে ফুলহাতা সোয়েটার, কানঢাকা একটা টুপি, গলায় জড়ানো একটা গামছা।

“চা পাওয়া যাবে

“জরুর!”

“ভাঁড়ে হবে তো?

“হোবে। লিকার, না দুধ চিনি?”

“দুধ চিনি।”

লোকটা বেশ যত্ন করে চা বানিয়ে দিল। দু’হাতে গরম ভাঁড়টা ধরেই একটু আরাম পেল শ্যাডো। ফাঁকা একটা বেঞ্চে বসতেই টের পেল ঠান্ডা এবং হিমে বেঞ্চটা সপসপে ভেজা। প্যান্টটা ভিজে গেল। কী আর করা যাবে। তবে চা-টা খেতে বেশ ভালই লাগছিল তার। এই শীতে গরম যা-কিছুই উপাদেয়। যে লোকটা তাকে ওভারব্রিজ কোন দিকে জানিয়ে দিয়ে চলে গেল সে কে হতে পারে তা আন্দাজ করতে অসুবিধে নেই। কামরার সেই বেঁটেমতো লোকটাই হবে। এবং সে অবশ্যই আবু এবং হরিশের লোক। অবজার্ভার। পিছনে এই স্পাই লাগানোয় সে এখন বেশ অসন্তুষ্ট বোধ করছে। এটা বাড়াবাড়ি।

আজকের দিনটা তার কাছে ভয়াবহ। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যেই তার বাবার অপারেশনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যাবে। তার বাবা বিনয় সেনগুপ্তর বেশ মোটা, সযত্নে চৰ্চিত গোঁফ আছে। আজ সেই গোঁফ, সামান্য কাঁচা-পাকা দাড়ি, মাথার কোঁকড়া চুল, কানের লোম সব চেঁছে ফেলা হবে। হয়তো ভুরু দুটোও। অন্তত সেই রকমই তাকে বলেছিলেন নার্স। তার পর ওটি। অ্যান্টিসেপ্টিকের প্রলেপ। তার পর অ্যানাস্থেসিয়া। তার পর? ভাবতে এখনই নার্ভাস লাগছে। বাবা বেঁচে যাবে তো!

ট্রেনটা নিঃশব্দে কখন চলে গেছে, টের পায়নি শ্যাডো। হাতের শূন্য ভাঁড়টা ফাঁকা রেললাইনে ছুড়ে ফেলল সে।

ওভারব্রিজ পেরিয়ে ধীর পায়ে স্টেশনের বাইরে এল শ্যাডো। ঘন কুয়াশার ভিতর দিয়ে এক অলৌকিক ভোরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিছু দোকানপাট, কিছু মানুষজন, রিকশা, উনুনের ধোঁয়া, পোড়া কয়লার গন্ধ। একটা শান্ত, নিরুদ্বেগ, নিরীহ শহর। এ সব জায়গায় ঘটনা ঘটে খুব কম। সানসেট নামে একটা হোটেলের কথা তাকে বলে দেওয়া আছে। এ সব একটা সেটিংয়েরই অংশ, জিগ শ পাজলের একটা খণ্ড। সে নিজেও তাই। কিন্তু তাতে তার কোনও উদ্বেগ বা ভয় নেই। যা হওয়ার হবে।

যা হওয়ার হবে, এই কথাটা সে যদি নিজের বাবার সম্পর্কেও ভাবতে পারত তা হলে হয়তো ভাল হত। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। বাবাকে বাঁচাতেই হবে। শুধু বাবাকে বাঁচানোর জন্যই তো সে এত দূর এসেছে! আরও বহু দূর যেতে প্রস্তুত।

একটা রিকশায় উঠতে গিয়েও থমকাল শ্যাডো। রাস্তার ধারে একটা মলিন, ছোটখাটো মন্দির, উপরে একটা বিবর্ণ ধ্বজা উত্তুরে হাওয়ায় ফরফর করে উড়ছে। মন্দিরে দরজা হাট করে খোলা, ভিতরে একটা পাথরের আসনে মলিন একটা বিগ্রহ, তাতে বিস্তর সিঁদুরটিদুর মাখানো। কিন্তু কোন দেবতার বিগ্রহ তা বোঝার উপায় নেই। সে ঘোর নাস্তিক বটে, কিন্তু হঠাৎ বাবার জন্য ভগবানকে ডাকার একটা ক্ষণস্থায়ী ইচ্ছে হল। পর মুহূর্তেই অবশ্য নিজেকে সংবরণ করে নিল সে। রিকশায় উঠতে যেতেই রোগা চেহারার ছোকরা রিকশাওয়ালা বলল, “খুব জাগ্রত দেবতা স্যর, মহাবীর বজরঙ্গবলী।”

“তাই নাকি?” বলে একটু আনমনা হয়ে গেল সে। বাবার অপারেশনের সময় এগিয়ে আসছে। কী হবে কে জানে।

সানসেট হোটেলটা বেশ সাদামাটা, একেবারে রাস্তার উপর তিন তলা হলুদ রঙের বাড়ি। জাঁকজমক নেই। রিসেপশনে তাকে আইডেন্টিটি হিসেবে আধার কার্ড দেখাতে হল। অর্থাৎ সে একটা ক্লু রেখে যাচ্ছে। খুনটা হলে পুলিশ তাকে খুঁজে পেতে অসুবিধেয় পড়বে না। কিন্তু তাতে শ্যাডোর মাথাব্যথা নেই। যাবজ্জীবন বা ফাঁসি, যাই হোক, তার কিছু আসে যায় না।

দোতলায় একটা কোণের ঘর পেয়ে গেল সে। আর ঠিক সাতটায় আবুর ফোন এল।

“আর ইউ ওকে?”

“আই অ্যাম ফাইন।”

“আজ তোমার বাবার অপারেশন, আমরা জানি। টেক রেস্ট টুডে। আর যার ছবি আর রেজুমে তোমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয়েছে তাকে ভাল করে স্টাডি করো। প্লিজ়, নো মিস্টেক।”

“তোমরা কি আমার পিছনে কাউকে লাগিয়েছ আবু!”

“হ্যাঁ। ইট ইজ দ্য গোল্ডেন রুল। বাট হি উইল নট বদার ইউ, খুব ইমার্জেন্সি কিছু হলে হি উইল কাম টু ইয়োর হেল্প। নইলে ও আড়ালে থাকবে। জাস্ট ফরগেট হিম।”

শ্যাডো নির্বিকার গলায় বলে, “ঠিক আছে। তবে গায়ে পড়া লোক আমি পছন্দ করি না, এটা তাকে বলে দিয়ো।”

“ও আর তোমার কাছে ঘেঁষবে না। নিশ্চিন্ত থাকো।”

বেলা আটটায় মাকে ফোন করল শ্যাডো, “কী খবর মা?”

“এই তো, আমরা এখন হাসপাতালে। তোর বাবাকে নিয়ে গেছে,

অপারেশনের আগে কি সব প্রিপারেশন আছে বলল।”

“বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে?”

“হয়েছে। ঠিকঠাক আছে। তুই এখানে নেই বলে একটু মন খারাপ মনে হল।”

“জানি। কাজটাও যে জরুরি।

“সাবধানে থাকিস।”

যাকে মারতে হবে তার মোট দুটো ফটো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে আবু। কোনওটাই খুব স্পষ্ট নয়। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, রোগা, নাকটা বেশ তীক্ষ্ণ। গালে একটু দাড়ি আছ। কিন্তু ছবিতে ঝাপসা ভাব আছে। মনে হয় চলন্ত অবস্থায়, আনাড়ি হাতে, বাজে ক্যামেরায় তোলা। কোনও ঠিকানা নেই। বলা হয়েছে, পারহ্যাপস আ স্লাম ডুয়েলার, অর্থাৎ সম্ভবত কোনও বস্তিতে থাকে। আরও লেখা আছে, আ হকার অফ সানড্রি থিংস। অর্থাৎ নানাবিধ জিনিসের ফেরিওয়ালা! রেজুমেটা দেখে হতাশ হল শ্যাডো। এক জন ফেরিওয়ালাকে কেন মারতে চাইছে ওরা? এত খরচ করে শেষ পর্যন্ত এক জন ফেরিওয়ালা? তবে এমন হতে পারে যে ফেরিওয়ালাটা লোকটার ছদ্মবেশ! আসলে লোকটা হয়তো কোনও ডন বা গুপ্তচর বা রাইভ্যাল! কিন্তু এত অস্পষ্ট ফটো এবং গরঠিকানায় লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে কী করে, সেটাই বুঝতে পারছিল না শ্যাডো। শহরটা ছোট হলেই বা কী, কয়েক হাজার লোকের তো বাস! ফেরিওয়ালাটা যে বস্তিতেই থাকে তা-ও তো নিশ্চিত নয়! এই শহরে কতগুলো বস্তি আছে তা-ও তো জানা নেই।

দশটার সময় ফোন করে জানতে পারল, বিনয় সেনগুপ্তকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। টেনশনটা কাটানোর জন্য পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ল শ্যাডো। সে ছ’ফুট এক ইঞ্চি লম্বা। মুশকিল হল, লম্বা লোক দেখলেই লোকে তাকায়। এটাই একটু অস্বস্তিকর, অন্তত গা ঢাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে।

কুয়াশা কেটে গিয়ে রোদ্দুর উঠেছে। চমৎকার আবহাওয়া। গাছপালা আছে, সবুজ মাঠ আছে, পার্ক আছে, আবার গরিব-গরিব ভাবও আছে। বাজার ছাড়িয়ে রাস্তাটা যেখানে দু’ভাগ হয়েছে সেখানে একটা ছোট্ট তিনকোনা পার্ক। দুটো বেঞ্চি, একটা বাচ্চাদের স্লিপ আর একটা দোলনাও আছে। শ্যাডো রেলিংটা টপকে ভিতরে ঢুকে একটা বেঞ্চে বসল। চোখ বুজে কিছু ক্ষণ বাবাকে চিন্তা করল সে। বাবাকে কি অজ্ঞান করা হয়ে গেছে! স্কাল কি ওপেন করা হয়েছে? বাবা কি বাঁচবে?

ভাবতে গিয়ে একটু ঝুম হয়ে পড়েছিল সে, হঠাৎ কাঁধে একটা হাতের মৃদু স্পর্শ। কে যেন খুব নিচু গলায় বলল, “স্যর, এটা বাচ্চাদের পার্ক, বড়দের জন্য নয়।”

আস্তে চোখ চেয়ে মুখ ফিরিয়ে সে যাকে দেখল, সে এক জন আধবুড়ো মানুষ। পাকা এবং পুরুষ্টু এক জোড়া ছুঁড়ো গোঁফ, গালে খসখসে দাড়ি, মুখখানা গোমড়া। গায়ে খাকি রঙের একটা জামা, তার উপর হাফ সোয়েটার, মাথায় একটা কানঢাকা কাপড়ের ফেট্টি। মালিই হবে বোধ হয়।

শ্যাডো উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “ভুল হয়ে গেছে দাদা, কিছু মনে করবেন না। আমি চলে যাচ্ছি।”

যেতে গিয়েও হঠাৎ কী মনে হওয়ায় সে মোবাইলটা বের করে লোকটাকে ফেরিওয়ালার ফটোটা দেখিয়ে বলল, “একে চেনেন?”

লোকটা সময় নিয়ে ভাল করে ছবিটা দেখল, তার পর মাথা নেড়ে

বলে, “না, দেখেছি বলে মনে হয় না। আপনি একে কেন খুঁজছেন?”

“দরকার আছে।”

“কী দরকার?”

“এ লোকটা আমার কাছে টাকা পায়। সেটা শোধ দিতে হবে।”

“ও,” বলে লোকটা কৌতূহল হারিয়ে ফেলে বলল, “আমি চিনি না, তবে কেউ হয়তো চিনতেও পারে। দেখুন খুঁজে,” একটু চুপ করে থেকে বলে, “কী নাম বলুন তো!”

শ্যাডো লোকটার নাম জানে না। বলল, “নাম জেনে আপনি কী করবেন! আপনি তো লোকটাকে চেনেনই না!”

“আমি আজকাল অনেক কিছুই ভুলে যাই, আবার অনেক কিছু মনেও পড়ে যায়। তাই মনে হল, নামটা শুনলে যদি লোকটাকে মনে পড়ে।”

“তার দরকার নেই, আমি খুঁজে নেব।”

“আপনি একটা কাজ করবেন? গিরিধারীকে জিজ্ঞেস করুন, সে সবাইকে চেনে।”

“গিরিধারীকে কোথায় পাওয়া যাবে?”

“গিরিধারীকে?” বলেই লোকটা যেন অকূলপাথারে পড়ে গেল। চার দিকে টালুমালু করে চেয়ে কপালে হাত বুলোতে-বুলোতে বলল, “তাই তো! গিরিধারীকে এখন কোথায় যে পাওয়া যাবে!”

শ্যাডো বুঝে গেল, লোকটাকে ডিমেনশিয়ায় ধরেছে। কিছু মনে করতে পারছে না। সে একটু হেসে বলে, “ঠিক আছে, আমি লোকটাকে ঠিক খুঁজে বের করব। গিরিধারীকে লাগবে না।”

লোকটা তার দিকে জুলজুলে চোখে চেয়ে ফের বলে উঠল, “বাজারের মধ্যে যে তেলের ঘানি আছে, গিরিধারীকে ওইখানে পাবেন,” বলেই লোকটা যেতে গিয়ে ফের ঘুরে তাকিয়ে বলল, “না, গিরিধারীকে এখন পাবেন পপুলার স্টোর্সে। সামনে যে চৌপথী আছে, ওখান থেকে ডান দিকে।”

শ্যাডোর একটু মায়া হল লোকটার প্রতি। একটু পরেই তার বাবার ব্রেন অপারেশন। তার বাবার স্মৃতি চলে যাবে না তো! বাবাও এরকম ভুলভাল বলবে না তো! সে গলায় অনুকম্পা মিশিয়ে বলল, “আপনি বাড়ি যান দাদা, আমি খুঁজে নেব।”

লোকটা আবার কপালে হাত বুলোতে বুলোতে বলে উঠল, “গুড্ডুকে খুঁজে পাওয়া কি অতই সোজা? গিরিধারী জানে। আগে গিরিধারীকে খুঁজে বের করুন।”

শ্যাডো অবাক হয়ে বলে, “গুড্ডু! গুড্ডু কে?”

“ওই তো, যার ছবি দেখালেন! ও তো গুড্ডু।”

হঠাৎ পিছন থেকে একটা বাচ্চার গলা বলে উঠল, “আপনি দাদুর সঙ্গে কী কথা বলছেন?”

শ্যাডো ফিরে তাকিয়ে দেখল, স্কুলড্রেস পরা একটা বারো-তেরো বছরের ছেলে। পিঠে ব্যাগ। ছোট করে ছাঁটা চুল আর স্মার্ট চেহারা।

শ্যাডো একটু হেসে বলে, “হাই! এই তো, তোমার দাদুর সঙ্গে একটু গল্প করছিলাম।”

“লাভ নেই, দাদুর কিছুই মনে থাকে না, উল্টোপাল্টা বলে। আমাকেও মাঝে মাঝে ভুলে যায়।”

“তাই বুঝি!”

“হ্যাঁ। দাদু তো বুড়ো হয়ে গেছে, তাই ও রকম! আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?”

শ্যাডো ছেলেটাকে মোবাইলের ফটোটা দেখিয়ে বলল, “একে কোথায় পাব বলতে পারো?”

“ওহ, ও তো কালুদাদা!”

“কালুদাদা কোথায় থাকে?”

“তা তো জানি না। তবে মাঝে-মাঝে অনেক মজার জিনিস ফিরি করতে আসে। কালুদাদা খুব ভাল লোক। কালুদাদাকে খুঁজছেন কেন? কিছু কিনবেন বুঝি!”

“হ্যাঁ, কিনব। কালুদাদাকে কোথায় গেলে পাওয়া যাবে বলতে পারো?”

“না তো! কালুদাদা কোথায় থাকে তা জানি না। খুব ভোরবেলা আসে। তাও রোজ নয়, মাঝে-মাঝে। কালুদাদা আমাকে একটা পেনসিল দিয়েছে, যেটা জীবনেও ক্ষয় হবে না। পেনসিল কাটারে কাটতেও হবে না। আমি গত দুই মাস ধরে পেনসিলটায় লিখেই যাচ্ছি, শিষ একই রকম আছে, একটুও ক্ষয় হয়নি।”

শ্যাডো অবাক হয়ে বলে, “এ রকমও হয় নাকি?”

“হ্যাঁ তো!” কালুদাদার কাছে অনেক মজার জিনিস পাওয়া যায়। শ্যাডো গম্ভীর মুখে বলে, “কিন্তু কালুদাদাকে পাওয়া যাবে কোথায়!”

ছেলেটা মাথা নেড়ে বলে, “কেউ জানে না। কালুদাদা তো ম্যাজিশিয়ান কিনা, তাই ভ্যানিশ হয়ে যায়! আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাই…”

“বাই,” বলে শ্যাডোও হাত নাড়ল।

দাদুর হাত ধরে ছেলেটা বোধ হয় তার স্কুলের দিকেই চলে গেল। ‘কালুদাদা ম্যাজিশিয়ান কিনা, তাই ভ্যানিশ হয়ে যায়’ কথাটা শ্যাডোর মাথায় চক্কর কাটতে লাগল। বাচ্চা ছেলেরা অনেক কিছু কল্পনা করে নেয়, এটাও কি তাই? নাকি লোকটা গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পছন্দ করে! ফেরারি আসামি নয়তো! লোকটা কি ম্যাজিকও দেখায় নাকি? অনেক প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর নেই!

সামনের চৌপথীটা পেরিয়ে কোন দিকে যাবে তা ঠিক করতে পারছিল না শ্যাডো। নোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে একটু ভাবছিল। লোকজন যাতায়াত করছে, সবারই বেশ তাড়া। রাস্তায় রিকশার ঢল নেমেছে, বিস্তর মোটরগাড়ি, বাস আর অর্টো চলছে। রোদের তেজ বেড়েছে এবং শ্যাডোর এখন গরম লাগছে। অনেকেই তার দিকে তাকাচ্ছে, সে নতুন লোক বলেই বোধ হয়, কিংবা লম্বা বলেও হতে পারে। আর এটা মোটেই পছন্দ করছে না সে।

লোকটা পপুলার স্টোর্সের কথা বলেছিল, চৌপথী থেকে ডান দিকের রাস্তায়। ওইখানে গিরিধারী নামে কাউকে পাওয়া যেতে পারে। রাস্তাটা ধীর পায়ে পেরোল শ্যাডো। ডান দিকের রাস্তা ধরে খানিক হাঁটল। মিনিট খানেক হাঁটার পর পপুলার স্টোর্সের সাইনবোর্ড দেখতে পেল সে। কাউন্টারে এক জন বুড়ো মানুষ বসে আছেন, মুখে রাজ্যের বিরক্তি।

দুটো সিঁড়ি ভেঙে উঠে বুড়োমানুষটির মুখোমুখি হয়ে শ্যাডো জিজ্ঞেস করল, “স্যর, গিরিধারীবাবু কি আছেন?”

লোকটা তেতো গলায় বললেন, “গিরিধারী! ক্যা গিরিধারী! কোথাকার গিরিধারী! কেমন গিরিধারী!”

শ্যাডো একটু হেসে বলল, “মাপ করবেন, আমার ভুল হয়ে গেছে! শুনেছিলাম, এখানেই গিরিধারীবাবুকে পাওয়া যাবে।”

“না মশাই, এখানে গিরিধারী বলে কাউকে পাওয়া যাবে না। অন্য জায়গায় দেখুন।”

ডিমেনশিয়াওয়ালা বুড়োটা ভুল খবর দিয়েছে। তবু দেখা যাক, বাজারের তেলের ঘানিতে পাওয়া যায় কি না। এক-আধটা সূত্র না-পেলে আজব লোকটাকে খুঁজেই বা পাওয়া যাবে কী করে!

বাজারটা ছোটই। বেশি ভিড় নেই। তেলের ঘানিটা খুঁজে পেতে দেরি হল না তার। নাদুসনুদুস আর ফরসা চেহারার মধ্যবয়সি এক জন লোক বসেছিলেন, মুখে পান।

“এখানে গিরিধারী বলে কেউ আছেন?”

লোকটা তাকে মন দিয়ে দেখল, তার পর পানের পিক ফেলে বলল, “কালেভদ্রে আসে। তবে সে এখন বাইরে কোথায় যেন গেছে। কী দরকার বলুন তো, আপনি কি তার পাওনাদার নাকি?”

“না, আমি পাওনাদার নই। এমনি একটু দরকার ছিল।”

লোকটা একটু যেন দুঃখের গলায় বলে, “গিরিধারীর অনেক পাওনাদার। পালিয়ে পালিয়েই জীবন কাটিয়ে দিল।”

এ ভাবে যে হবে না সেটা বুঝে গেল সে। হঠাৎ তার মনে হল, ফেরিওয়ালার খবর ভাল জানার কথা অন্য কোনও ফেরিওয়ালার। বাজারের বাইরে একটা ঠেলাগাড়িতে আপেল, কমলালেবু, মুসুম্বি, আঙুর এ সব সাজিয়ে বসেছিল একটি অল্পবয়সি ছেলে। চোখা চালাক চেহারা। শ্যাডো তার কাছে গিয়ে বলল, “ভাই, আমি এক জনকে খুঁজছি, বলতে পারবে তাকে কোথায় পাওয়া যাবে!”

ছবিটা এক ঝলক দেখেই ছেলেটা বলল, “এ তো কালুদাদা!” “কালুদাদা কোথায় থাকে বলতে পারো?”

ছেলেটা মাথা নেড়ে বলে, “না। কালুদাদা তো এই শহরে নতুন এসেছে কি না। ঠিক জানি না, তবে নদীর ধারের নয়া বস্তিতে থাকতে পারে।”

“কালুদাদা এই শহরে কবে এসেছে?”

“মাস দুই হবে।”

প্যান্টের পকেটে ফোনটা বাজতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল শ্যাডোর, বাবার কোনও খবর নয় তো! ফোনটা বের করে দেখল, না, প্রাইভেট নম্বর। ফোনটা কানে তুলতেই একটি গম্ভীর গলা বলল, “আপনি কি বুদ্ধু? এ ভাবে জনে-জনে জিজ্ঞেস করে বেড়ালে যে বেলা বারোটার মধ্যেই গোটা শহর জেনে যাবে আপনি কে! মফসসল শহরে ইনফর্মেশন তাড়াতাড়ি ছড়ায়।”

শ্যাডো ঝাঁঝালো গলায় বলে, “আপনি কে মশাই?”

“সেটা জানার কোনও দরকার নেই আপনার। বি কেয়ারফুল। নিজেই লোকটাকে খুঁজে বের করুন, সারা শহরকে জানান দিয়ে নয়। ইট ইজ্ আ কভার্ট অপারেশন, অ্যান্ড ইউ হ্যাভ টু বি সিক্রেটিভ, ম্যান।”

বলেই ফোনটা কেটে দিল লোকটা। প্রাইভেট নম্বর, তার মানে কলব্যাক করারও উপায় নেই।