এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা – ৪

॥৪॥

না, বগার দিনকাল মোটেই ভাল যাচ্ছে না। নইলে কুমোরপাড়ার নন্দবাবুর বাড়ির বাগানে মাটি কোপানোর কাজ করতে হয়! বিশ্বসংসারের কে না জানে যে, সকালে নন্দবাবুর মুখ দেখলে হাঁড়ি ফাটে, যাত্রাভঙ্গ হয়, লোকে শুকনো ডাঙায় আছাড় খায়! ত্রিভুবনে এমন হাড়কঞ্জুস, তিরিক্ষে, বদমেজাজি মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

পুরনো বাজারের সস্তা জ্যোতিষী রামভজন মিশিরকে পাঁচ টাকায় হাত দেখিয়েছিল বগা, গত মাসেই। রামভজন একখানা আতসকাচ বাগিয়ে ধরে ভাল করে উল্টেপাল্টে তার কররেখা বিচার করে দুঃখের গলায় বলেছিল, “না রে, তোর সময়টা খারাপই যাচ্ছে! আর এক বছর তিন মাস একটু চেপেচুপে থাক, তার পর তোকে আর পায় কে!”

রামভজনের চেতাবনি বেশির ভাগই মেলে না, দু-একটা কখনও সখনও মিলেও যায়। কেউই রামভজনের উপর ভরসা করে না, তবে হাত দেখাতেও ছাড়ে না। বগার অভিজ্ঞতা হল, রামভজনের খারাপ কথাগুলো বেশ ফলে যায়, ভালগুলোই ফলে না।

তবে বগার ভাল সময়ও এসেছিল বইকি। তখন বৈজুলালের ফাইফরমাশ খাটত বগা। বৈজুলাল একা-বোকা মানুষ। ছেলে জিতেনের সঙ্গে তার উদুম ঝগড়া। জিতেন আলাদা থাকে, বাপমুখো হয় না। তাতে বৈজুলালের বয়েই গেল। বৈজুলালের ছেলে বলো, বৌ বলো, বন্ধু বলো, মা-বাপ বলো, সবই হল টাকা। বৈজুলাল বলতও তাই, “ওরে টাকার ওপর বাপ নেই!”

তা তার ফাইফরমাশ খাটত বগা, আর আড়ে আড়ে দেখে নিত, বৈজু টাকা রাখে একখানা মজবুত লোহার আলমারিতে, আর চাবি তার ট্যাঁকে। এ সব দেখে রাখা ভাল, কবে কোন জানাটা কোন কাজে লেগে যায় তার কি কোনও ঠিক আছে? খবর রাখা বড় জবর জিনিস। খবরের জন্য চোখ, কান, নাক, মাথা সবই সজাগ রাখতে হয়। আর সুযোগের সুলুকসন্ধানে থাকতে হয়। তা বগার সে সব গুণ আছেও। বৈজুলাল বুড়ো মানুষ, আর বুড়ো মানুষদের কবে কী হয়ে বসে, তার কি কিছু ঠিক আছে! এই ভাল তো এই খারাপ। তবে বৈজুলাল মজবুত মানুষ, দুপুরে আধ সের ছাতু খায় আর রাতে দশখানা রুটি। তাই খুব একটা আশাভরসা ছিল না বগার। কিন্তু কপাল এমনই জিনিস, কার কখন খোলে তার কিছু ঠিক নেই। তা বগারও খুলল। বৈজুলাল, কোথাও কিছু না, দুপুরবেলা ছাতু খেতে-খেতেই হঠাৎ ‘আঁ আঁ’ করে ঢলে পড়ল। বগা বুদ্ধি রাখে, লোকজন ডাকার আগেই সে বৈজুলালের ট্যাঁকের ঘুনশি থেকে অতি তৎপরতায় চাবির গোছাটা খুলে নিয়ে চটপট আলমারি থেকে টাকার একটা বান্ডিল হাতছিপ্পু করে নিল। চাবিটা আবার ঘুনশিতে বেঁধে তার পর লোকজন ডাকাডাকি। খবর পেয়ে ছেলে জিতেনও এল। বৈজুলালকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।

বৈজু হাসপাতাল থেকে ফিরল দিন দশেক বাদে। বগার বরাতজোর বটে। যে বৈজুলাল হাসপাতালে গিয়েছিল সেই বৈজুলাল কিন্তু ফিরল না। কেমন যেন জবুথবু, বোকাটে, থপথপে, স্মৃতিভ্রষ্ট বৈজুলাল। যে টাকা ছিল তার শ্বাসপ্রশ্বাস, সেই টাকাও যেন ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারছে না। নইলে বগার কপালে দুঃখ ছিল। সে ঠিক করেই রেখেছিল, বৈজু টাকার হিসেব নিয়ে হাল্লা মাচালে সে পিঠটান দেবে। তবে বৈজুলাল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করেনি। হাতছিগ্গর দশ হাজার টাকা পেয়ে বগা আহ্লাদে একখানা নতুন সাইকেল পর্যন্ত কিনে ফেলল। সাইকেলে চেপে পাড়ায়-পাড়ায় টহল মারার মতো কেতার জিনিস আর কী আছে? তা ছাড়া মদন ঘোষের দোকানে সকালে শিঙাড়া জিলিপি আর বিকেলে হিংয়ের কচুরি আর আলুর দম।

তবে ওই আর কী, তার কপালে সুখ সয় না। তার নতুন সাইকেল দেখে জিতেন কিসের যেন গন্ধ পেল, খানিক হম্বিতম্বি করল, চোরছ্যাঁচড় বলে গালাগাল দিল, তার পর তাড়াল। বৈজুলালের গদিতে এখন জিতেন বসছে, কাজেই বগার কিছু করার ছিল না। এই মাগি গন্ডার বাজারে দশ হাজার টাকার আয়ু আর কদ্দিন! মাসখানেক ভাল সময়টা ছিল। তার পর থেকেই খারাপ সময়টা ধরে ফেলল তাকে। সাইকেলটা পর্যন্ত পটল মল্লিকের কাছে হাফ দামে বিক্রি করে দিতে হল।

তা এই হল বগার বৃত্তান্ত। বগার শরীরটা হল পাকানো দড়ির মতো, রোগা হলেও শক্তপোক্ত। সকালে সে হাপুসহুপুস করে নন্দবাবুর বাগান কোপাচ্ছিল। নন্দবাবু হুঁশিয়ার লোক, চতুর্দিকে নজর। তাঁকে ফাঁকি দিতে পারে এমন বাপের ব্যাটা জন্মায়নি। তাই মন দিয়েই কোদাল চালাচ্ছিল বগা। ঢিলে দিলেই পয়সা কাটবেন নন্দবাবু। তা মেহনত বড় কম হচ্ছে না। এই বাঘা শীতেও বগার রীতিমতো ঘাম হচ্ছে। বগা মোটেই সুখে নেই।

নন্দবাবু বারান্দায় মোড়া পেতে বসে আছেন। তাঁর গায়ে মোটা আলোয়ান, মাথায় টুপি, হাতে দস্তানা, পায়ে মোজা, দুটো চোখ টর্চলাইটের মতো বগার উপর নজর রাখছে। শুধু কাজের ফাঁকি ধরার জন্য নয়, বগার যে হাতটানের স্বভাব আছে তা-ও সবাই জানে কিনা। চোখের পলকে কী সরিয়ে ফেলবে তার কি কোনও ঠিক আছে!

সাতটার সময় জলখাবার এল। আর জলখাবারের কী ছিরি! কলাইকরা পিরিচে তিনটে বাসি, ঠান্ডা রুটি আর খানিকটা ঘ্যাঁট মতো কিছু।

বগা বারান্দার সিঁড়িতে খেতে বসে বলল, “নন্দকর্তা, এক ডেলা গুড় পাওয়া যাবে?”

নন্দবাবু খ্যাঁক করে উঠলেন, “গুড়ের দাম জানিস? চিনিকে বলে ওদিক থাক।”

“তা হলে বরং এক থাবা চিনিই হয়ে যাক।”

একটু গাঁইগুঁই করার পর অবশ্য একটু চিনি জুটল। খুব যত্ন করে খাচ্ছিল বগা। চিনির মতো জিনিস নেই। মুখে কেউ যেন মধু ঢেলে দিয়েছে। চিবোতে-চিবোতে আরামে ঘুম এসে যাচ্ছিল বগার। ঘুমিয়েই পড়ত যদি না এমন সময়ে হাড়হাভাতে ফেরিওয়ালাটা ‘আ পান, আ পান’ করে হাঁক মারতে মারতে এসে হাজির হত।

নন্দবাবু বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, “ওই এসেছে আবার জোচ্চোরটা!”

এক ঘটি জল গলায় ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে বগা বলে, “কার কথা বলছেন আজ্ঞে?”

“ওই তো, ওই বদমাশ ফেরিওয়ালাটা! দিন তিনেক আগে জোর করে একটা ঢাউস লাট্টু গছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। দশ টাকা চেয়েছিল, আমি অবশ্য দাম এখনও দিইনি। তা নাতি বলল, সেই লাট্টু নাকি ঘোরেই না! লাট্টুটা এনে দিচ্ছি, যা তো জোচ্চোরটাকে ফেরত দিয়ে আয়।”

ফেরিওয়ালাটাকে চেনে বগা। রাজ্যের অকাজের জিনিস ফিরি করে বেড়ায়। নিরখ পরখ করে দেখেছে বগা, ও সব পুরনো অচল জিনিস চোরবাজারেও বিক্রি হওয়ার নয়। সে এক গাল হেসে বলল, “আর বলবেন না, দেশটা চোর বাটপাড়ে একেবারে ভরে গেছে।”

নন্দবাবু উঠে ভিতরবাড়িতে গেলেন। একটু বাদে একটা বেশ বড়সড় লাট্টু এনে বগার হাতে দিয়ে বললেন, “যা, লোকটাকে দিয়ে আয়গে!”

হয়। এমন সুযোগ তো বড় একটা আসে না! সে মুরুব্বির চালে গিয়ে লোকটার উপর চড়াও হয়ে বলল, “এটা কি চিটিংবাজির জায়গা পেয়েছ নাকি হে বাপু! তুমি তো মোটেই সুবিধের লোক নও! এই অ্যাত্তো বড় লাট্টুটা কোন আক্কেলে গছিয়ে গেছ শুনি! অ্যাতো বড় লাটু কখনও ঘোরে! আচ্ছা বেআক্কেল লোক বটে হে তুমি!”

কারও উপর হম্বিতম্বি করার সুযোগ পেলে বগা ভারী খুশি

লোকটা ভারী কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “ঘোরেনি বুঝি!”

“আর ভালমানুষ সেজো না তো বাপু, তুমি ভালই জানো যে, এ লাট্টু ঘোরার জিনিসই নয়। লোক ঠকানোর আর জায়গা পেলে না! জুটলে এসে নন্দ চাকলাদারের বাড়িতে!”

লোকটা লাট্টুটা হাতে নিয়ে, খুব যেন মজার কথা হচ্ছে, এ রকম ভাবে হাসল। তার পর হাসিমুখ করেই বলল, “ঘোরাতে জানলে এই লাট্টুটাও ঘোরে কিন্তু। তবে এক বার ঘুরলে আর থামে না কিনা! ঘুরতেই থাকে, ঘুরতেই থাকে।”

বগা অবাক হয়ে বলে, “তুমি পাগল না পান্তাভাত বলো তো! লাট্টু কখনও অনন্ত কাল ধরে ঘোরে শুনেছ? দম ফুরোলে লটকে পড়বে না!”

লোকটা একটুও রাগল না দেখে বগারই রাগ হচ্ছিল। ওরে বাপু, এত অপমানের কথা বললুম, তুইও দু’-একটা চোটপাটের কথা বলবি তো! নইলে কাজিয়াটা জমবে কী করে! কিন্তু ম্যান্ডামারাটা সেই দিক দিয়েই গেল না! কেবল বোকার মতো হেসেই যাচ্ছে দেখ!

লোকটা গ্যালগ্যালে হাসি হাসতে-হাসতেই বলে, “এটা ঠিক লাট্টু নয় কিনা!”

“তবে ওটা কী? স্কন্ধকাটার মুণ্ডু?”

“ঠিক জানি না, তবে শুনেছি, এটা যত ঘোরে তত বাতাসে অক্সিজেন বেড়ে যায়।”

এই কথাটা বগা ঠিক বুঝতে পারল না। ভ্রু কুঁচকে বলে, “কী বেড়ে যায়?”

লোকটা জবাব না-দিয়ে, লাট্টুটার তলার পেরেকের সরু দিকটা দু’আঙুলে ধরে ফুরুক করে ঘুরিয়ে দিয়ে ডান হাতের তেলোর উপর লুফে নিল, আর লাট্টুটা হাতের তেলোর উপর দিব্যি ঘুরতে লাগল বনবন করে। ঘুরছে তো ঘুরছেই, থামার নাম নেই। অনেক ক্ষণ কাণ্ডটা হাঁ করে দেখল বগা। তাজ্জব ব্যাপার তো! লোকটার স্থির হাতের উপর ঘুরন্ত লাট্টু!

চটকা ভাঙল নন্দবাবুর হাঁকে, “বলি দিনমানটা কি ওই ফেরিওয়ালার সঙ্গে আড্ডা মেরেই কাটাবি ভেবেছিস! পয়সা চাওয়ার সময় মজা দেখাব, মনে রাখিস!”

হাঁকটাকে পাত্তা দিল না বগা। ফেরিওয়ালাটাকে বলল, “লাট্টুটা আমায় দেবে? আমি তোমাকে দুটো টাকা দেব’খন।”

ফেরিওয়ালা এক গাল হেসে বলে, “নেবে? তা নাও। টাকা পরে দিলেও হবে।”

বগা তো তা-ই চায়। হাড়হাভাতেটাকে পয়সা দিতে বয়েই গেছে তার। ওর ওই সব পুরনো জিনিসপত্তর কেউ কেনে নাকি! সবই বাতিল জিনিস। তবে লাট্টুটা কিন্তু জব্বর!

লাট্টুটা পেয়ে বগার মাথাটাই যেন কেমনধারা হয়ে গেল। মাটি কোপাবে কী, কামিনী ঝোপটার আড়ালে বসে একমনে লাট্টুটা ঘোরানোর চেষ্টা করতে লাগল সে। কিন্তু জুত করতে পারছিল না। ফেরিওয়ালাটা যেমন ফুরুক করে ঘুরিয়ে দিল তেমনটা বগার হাতে হচ্ছে না কিছুতেই। আর যতই হচ্ছে না ততই রোখ চেপে যাচ্ছে বগার। কোদাল চালানো তার মাথায় উঠেছে।

ও দিকে বারান্দায় বসা নন্দবাবু চেঁচামেচি জুড়েছেন, “যত সব চোর-জোচ্চোর-চিটিংবাজ-কামচোর এসে জোটে এখানে! কোথায় গেল বদমাশটা! নিশ্চয়ই ঘাপটি মেরে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছে হাতসাফাই করবে বলে। আজ তোরই এক দিন কি আমারই এক দিন! পুলিশে দিয়ে ছাড়ব, এই বলে রাখলাম!”

অবশেষে অনেক বারের চেষ্টায় লাট্টুটা ঘোরাতে পারল বগা। তলার সরু দিকটা দু’আঙুলে চেপে ধরে হালকা একটা টুসকি মারতেই লাট্টু হঠাৎ বোঁ শব্দ করে তার হাতের তেলোর উপর বাঁইবাঁই করে ঘুরতে শুরু করায় বগার চোখ রসগোল্লার মতো বড়-বড় হয়ে গেল। নন্দবাবুর চেঁচামেচিকে গ্রাহ্যই করল না সে। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। তার পর ধীরে সুস্থে হাতের তেলোর উপর ঘুরন্ত লাট্টুটা নিয়েই সে উঠে নন্দবাবুর সামনে গিয়ে বুক চিতিয়ে বলল, “খুব তো বলেছিলেন যে, লাট্টুটা নাকি ঘোরে না! এই বার স্বচক্ষেই দেখুন লাটু ঘুরছে কি না!”

নন্দ চাকলাদার বিস্ময়ে খানিক ক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “তার মানে তুই এত ক্ষণ ধরে কাজ ফেলে রেখে লাট্টু ঘোরাচ্ছিলি! এটা কি লাট্টু ঘোরানোর সময়? নাকি তোর সেই বয়স আছে! তুই লাট্টু ঘোরালে কি বাগানের মাটি ভূতে কোপাবে!”

বগা বিরক্ত হয়ে বলে, “আজ্ঞে চটছেন কেন! মাটি কোপানো তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না! তার আগে লাট্টুর কেরামতিটাও একটু দেখুন। ভূভারতে এ রকম লাট্টু কখনও দেখেছেন! সেই কখন থেকে ঘুরেই চলেছে, থামার নামই নেই মশাই!”

নন্দবাবু রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “লাট্টুর কেরামতি দেখানোর জন্য কি তোকে এককাঁড়ি টাকা দিয়ে রেখেছি? এটা কি ইয়ার্কি পেয়েছিস নাকি?”

বগা তেতো গলায় বলে, “আপনার দোষ কি জানেন নন্দকর্তা, বিষয়চিন্তা ছাড়া আপনি আর কিছু ভাবতে পারেন না। বিষয়ের বাইরেও দুনিয়ায় অনেক কিছু আছে কিন্তু।”

নন্দ চাকলাদার মোড়া থেকে উত্তেজনায় প্রায় লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে বললেন, “আমাকে জ্ঞান দিতে এসেছিস! তোর সাহস তো কম নয়! বেরো, বেরো বলছি আমার বাড়ি থেকে! দূর হয়ে যা বেয়াদব কোথাকার!”

বগার মোটেই রাগ হল না। সে নির্বিকার গলায় বলল, “ঠিক আছে মশাই, যাচ্ছি। যে ঘণ্টা খানেক কাজ করেছি তার পয়সাটা হিসেব করে দিয়ে দিন।”

নন্দবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “কিসের পয়সা? মামাবাড়ির আবদার পেয়েছিস নাকি! তোর সঙ্গে কড়ার হয়েছিল গোটা বাগান কুপিয়ে দিলে তিনশো টাকা পাবি। আধখেঁচড়া কাজের জন্য কোনও পয়সা নেই।”

হাতের তেলোর উপর লাট্টুটা এখনও বাঁইবাঁই করে ঘুরছে। দৃশ্যটা মুগ্ধ চোখে দেখতে-দেখতে বগা তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, “ঠিক আছে মশাই, ও পয়সা আপনাকে আর দিতে হবে না।”

নন্দবাবু তেড়ে উঠে বললেন, “দয়া করছিস নাকি রে ব্যাটা! এই যে গান্ডেপিন্ডে রুটি-তরকারিগুলো গিললি, সঙ্গে আবার দেড়শো গ্রাম চিনি, তার কি হিসেব নেই নাকি?”

অন্য সময় হলে এ সব কথার জবাবে বগাও উল্টে দু’-চার কথা শুনিয়ে দিত। কিন্তু লাট্টুটা পেয়ে বগার মনটা এতই ভাল হয়ে গেছে যে, তার মোটে রাগই হচ্ছে না। সে বেশ খোশ মেজাজেই বলল, “ঠিক আছে নন্দবাবু, ওই রুটি-তরকারিতে আজকের পয়সা উসুল হয়ে গেল।”

এই বলে বেরিয়ে পড়ল বগা। এই জিনিস দশ জনকে দেখিয়ে বাহাদুরি না-পেলে আর লাভ কী হল! আর দশ জনকে দেখাতে হলে বাজারের মতো আর কোনও জায়গা আছে! কেনারামের দোকান থেকে একটা পিরিচ কিনে বাজারে ঢোকার মুখটাতেই একটা প্লাস্টিক পেতে বসে গেল সে। তার পর একটু কসরত করে লাট্টুটা ফের ঘুরিয়ে পিরিচটার উপর ছেড়ে দিল বগা। আর বশংবদ লাট্টুটাও লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুরে যেতে লাগল। লোক জড়ো করতে বগা নাটুকে ভঙ্গিতে গলা তুলে চেঁচাতে লাগল, “মার কাটারি! মার কাটারি! জাদুই লাট্টু! জাদুই লাটু! মঙ্গলগ্রহ থেকে ইমপোর্টেড! ওয়ান পিস, ওনলি ওয়ান পিস! দেখে যাও সবাই…”

দ্যাখ না দ্যাখ কাণ্ড দেখতে লোক জমে গেল মেলাই। লাটু নিতান্তই একটা এলেবেলে জিনিস। কিন্তু এত দমওয়ালা লাট্টু কেউ কখনও দেখেনি। নেতাই বাগ জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে বগা, এর ভিতরে কি মেশিন আছে? নইলে ঘুরছে কিসে?”

মনোতোষ গায়েন বলে, “আরে না-না, ব্যাটারি ভরা আছে নিশ্চয়ই! ব্যাটারি ফুরোলেই নেতিয়ে পড়বে।”

গণেশ পাল সায়েন্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিল। অনেক ক্ষণ দেখেটেখে বলল, “না হে, এটা সোলার এনার্জিতে চলছে বলে মনে হচ্ছে।”

বিষ্ণুপদ কাউ সন্দিহান ভঙ্গিতে বলে, “এ চিনে জিনিস না-হয়ে যায় না! কিছু ক্ষণ চলেই একেবারে ঠান্ডা মেরে যাবে, এই বলে দিলুম!”

অভয়পদবাবু খুব ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বগাভাই, লাট্টুটা কি বিক্রি করবে? আমার ছেলেটা একটা লাটুর জন্য ক’দিন হল বায়না করছিল। তা না হয় দশটা টাকাই দিচ্ছি।”

বগা উচ্চাঙ্গের একটা হাসি হেসে বলে, “আর হাসাবেন না মাস্টারমশাই, যান না, পকেটে লাখ টাকা নিয়ে সব বাজার ঘুরে আসুন, দেখুন এমন জিনিস পান কি না! তবে ভাই বলে ডেকেছেন, তাতে আমি ভারী খুশি হয়েছি, দশটি হাজার টাকা পেলে আমি লাট্টু দিয়ে দেব।”

দশ হাজার শুনে অভয়পদবাবু বুকে হাত চেপে হার্টটা সামাল দিলেন। তার পর মলিন মুখে ভিড়ের মধ্যে ডুব দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

গজপতির আজকাল বাজার করতে বড্ড হাঁসফাঁস হয়। কারণ বাজারে জিনিস পছন্দ করা থেকে দরদস্তুর সব গোপালই করে, তাঁর কাজ হল গোপালকে টাকা সাপ্লাই করা। আর উদ্বেগের ব্যাপার হল, গোপালের খাঁই দিন-দিন বাড়ছে। আর তার কায়দারও উন্নতি হচ্ছে। নতুন কায়দাটা হল, গজপতি জিনিস কেনার জন্য যে টাকাটা দেন সেটা চোখের পলকে ভ্যানিশ হয়ে যায়, গোপাল ফের হাত পেতে বলে, “কী হল, টাকাটা দিলেন না যে!”

গজপতি সঙ্কোচের সঙ্গেই বলেন, “এই মাত্র তো দিলুম!”

তখন গোপাল অত্যন্ত অভিমানের সঙ্গে বলে, “দিলে তো আমার হাতেই থাকত মেসোমশাই! আমার হাতে কিছু আছে কি?”

এর জবাবে কী বলতে হয় সেটা গজপতি জানেন না। কারণ সেটা স্কুল-কলেজে শেখায়নি। অগত্যা তিনি মনমরা হয়ে ফের টাকা দেন। আর এই জন্যই তাঁকে আজকাল মোটা টাকা নিয়ে বাজারে আসতে হয়। তিনি এক বার সঙ্কোচের সঙ্গেই সুচরিতা দেবীকে বলেছিলেন, “তা গোপাল যখন ভালই বাজার করছে তখন আর আমার বাজারে যাওয়ার দরকার কী?”

তাতে সুচরিতা দেবী চমকে উঠে চোখ বড়-বড় করে বললেন, “বলো কী! কাজের লোকের হাতে বাজারের দায়িত্ব দিতে আছে? চুরি করে ফাঁক করে দেবে যে! বাড়ির কর্তা সঙ্গে থাকলে সেই সাহস পাবে না।”

এ কথা শুনে গজপতি গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। আজও যখন কাতলা মাছের একটা টুকরো কিনতে গোপাল মাছওয়ালার সঙ্গে দরদাম নিয়ে ধস্তাধস্তি করছিল, সেই সময়ে পাশের দোকানেই সুধন্য বকসি চিংড়ি মাছ কিনছিল, তাঁকে দেখে বলল, “আরে গজপতি যে! আজকের অবাক কাণ্ডটা দেখলে নাকি!”

“কী কাণ্ড বলো তো!”

“আরে ওই যে হাড়হাভাতে বগাটা কোত্থেকে একটা ঢাউস লাট্টু নিয়ে এসেছে, সেটা ঘুরছে তো ঘুরছেই। থামছেই না। বাজারের মুখটায় লোকে ভিড় করে দেখছে। আশ্চর্য ব্যাপার কিন্তু।”

“অ্যাঁ!” বলে গজপতি হাঁ হয়ে গেলেন। কারণ, কালীচরণ কয়েক দিন আগে লাট্টুটা তাঁকে বিক্রি করতে চেয়েছিল বটে! বলেছিল, লাট্টুটা এক বার ঘুরলে নাকি আর থামে না। আর ওটা নাকি অক্সিজেন জেনারেট করে। গজপতির খুব লোভ হয়েছিল বটে, মাত্র দশ টাকা দাম, কিন্তু সুচরিতার কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে নেননি। ইস, মস্ত ভুল হয়ে গেছে তো! নিশ্চয়ই বগা লাট্টুটা চুরি বা ছিনতাই করেছে, নয়তো বাগিয়ে নিয়েছে!

তিনি আর দাঁড়ালেন না। হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে ভিড় ঠেলে এক বার সামনে হাজির হয়ে বাজখাঁই গলায় বললেন, “তোকে পুলিশে দেব। এটা তো কালীচরণের লাট্টু, তুই চুরি করেছিস!”

বগা আকাশ থেকে পড়ে বলে, “কী যে বলেন গজুবাবু, আমার সঙ্গে কি চুরি কথাটা যায়, না মানায়! এই আপনিই প্রথম বললেন, নইলে আজ অবধি কেউ বলতে পারেনি কখনও পরদ্রব্য গস্ত করেছি।”

“তা হলে তুই ওটা পেলি কোথায়?”

বগা জানে গজপতিবাবু আসলে একটি ন্যাদোস, যা বোঝানো যাবে তাই বুঝে যাবেন। তবে লোকটার এক জন খিটকেলে বন্ধু আছে, সুরেশবাবু, পুলিশের লোক। তাঁর কানে কথা উঠলে বগার কপালে কষ্ট আছে। তাই সে এক গাল হেসে বলল, “সে আর করেন না। কালীচরণের সঙ্গে তো আমার গলায় গলায় ভাব কিনা। বহু কালের পুরনো দোস্তি। তাই কালীচরণ বলল, জিনিসটা বিক্রি করে কিছু টাকা তুলে দিতে, তার নাকি ঠেকা পড়েছে।”

“কালীচরণ তো আমাকে দশ টাকায় এটা বিক্রি করতে চেয়েছিল!” বগা সঙ্গে সঙ্গে কানে হাত দিয়ে বলল, “আজ্ঞে অমন কথা কবেন না, শুনলেও পাপ হবে। দাম একেবারে বাঁধা, দশ হাজার। তবে আপনি নিলে কিছু কমসম করতে পারি, শত হলেও আপনি এক জন মান্যগণ্য লোক!”

চোখ কপালে তুলে গজপতি বলেন, “বলিস কী! তো দিনে ডাকাতি!”

বগা গলা নামিয়ে বলে, “গজুবাবু, এই বেলা যদি নিতে হয় তো নিয়ে নিন, নইলে নগেন হালদার সাত হাজার টাকা কবুল করে গেছেন, বাজার সেরে ফেরার পথে নেবেন, আর তিনি এলেন বলে। সময় হয়ে গেছে।”

গজপতি মহা ফাঁপরে পড়ে খানিক ক্ষণ হাঁসফাঁস করলেন। এই অত্যাশ্চর্য জিনিসটা হাতছাড়া হলেও আফসোসের জায়গা থাকবে না। তাঁর হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল, কেন যে জিনিসটা তখনই নেননি! তাড়াতাড়ি পকেট হাতড়ে দেখে হিসেব করে বললেন, “আমার কাছে সাড়ে চার হাজার টাকা আছে। তার বেশি দিতে পারব না।”

বগা খুবই দুঃখী মুখ করে বলল, “তাতে তো মজুরি পোষাচ্ছে না মশাই! কালীচরণকেই বা কী জবাবদিহি করব বলুন!”

“দিয়ে দে বাবা!” আর হয়রান করিস না।

বগা এক মিনিট ভাবল, এই গঞ্জ জায়গায় ফস করে এত টাকা বের করে দেওয়ার মতো লোক নেই। আর পাগল ছাড়া এত দাম দিয়ে লাটুই বা কে কিনবে, তা সে যতই জাদুই লাট্টু হোক না কেন! তাই সে একটা নকল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনার মতো একজন মান্যগণ্য লোককে তো আর মুখের ওপর না করতে পারি না! দিন, ওই সাড়ে চার হাজারই দিন। মেলা লোকসান হয়ে গেল, তা কী আর করা যাবে!”

গজপতি লাট্টুটা নিয়ে মহানন্দে ভিড় কেটে বেরিয়ে আসতেই মুখোমুখি গোপাল। একটু তেরছা হাসি হেসে বলল, “মেসোমশাই যে বাজারে একেবারে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন! লোকে তো আপনাকে দেখার জন্য ছুটে-ছুটে আসছে!”

গজপতি অবাক হয়ে বলেন, “কেন বল তো!”

“আরে আপনি যে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটা লাট্টু কিনেছেন সেটা রটে গেছে কিনা!”

গজপতি যেটা একেবারেই পারেন না সেটা হল অভিনয়, কিন্তু বিপাকে পড়ে সেটাই করার প্রাণপণ চেষ্টা করে খুব বিস্ময়ের গলায় বললেন, “লাট্টু! লাট্টু কিনতে যাব কোন দুঃখে! তাও আবার পাঁচ হাজার টাকায়! আমার কি মাথার গন্ডগোল হয়েছে নাকি? আর লাট্টুর কথা উঠছেই বা কেন বল তো! আমার কি এখন লাট্টু ঘোরানোর বয়স!”

“আজ্ঞে, কথাটা আমি তুলিনি, মানুষজন বলাবলি করছে আর কী!”

 “লোকের কথা বাদ দে তো। লোকে গুজব ছড়াতে বেজায় ভালবাসে কিনা। কিসের লাট্টু, কোথাকার লাট্টু, কেমন লাট্টু কে জানে বাপু!”

“তা হলে মাসিমাকে কী বলা যাবে বলুন তো! পাঁচ জনে যখন বলছে তখন কথাটা তো আর চাপা থাকবে না, মাসিমার কানেও তো উঠবে নিশ্চয়ই!”

বেজার মুখে গজপতি একখানা পঞ্চাশ টাকার নোট গোপালের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, “একটু সামলে নিস বাবা!”

“সে আর বলতে! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

“আর একটা কথা।”

“কী মেসোমশাই?”

“ওটা পাঁচ নয় কিন্তু, সাড়ে চার। আমাকে ঠকানো অত সহজ নয়, বুঝলি!”

“যে আজ্ঞে, তা হলে মাসিমাকে কি ওই সাড়ে চারই বলব? পাঁচের জায়গায় সাড়ে চার তো বেশ সস্তাই হয়েছে মনে হয়, বলতে গেলে জলের দর, মাসিমা শুনলে বোধ হয় খুশিই হবেন।”

“ওরে না না, ও কাজও করিসনি!”

“ঠিক আছে মেসোমশাই, আপনি ও সব নিয়ে ভাববেন না। তবে আমার মাথার চুলগুলো দেখছেন তো! তিন মাস কাটা হয়নি। মাথায় যেন পাখির বাসা! গোটা তিরিশেক টাকা হলে নেপালের সেলুন থেকে একটা ছাঁট দিয়ে আসতুম।”

গেল আরও তিরিশ টাকা। আজকাল গজপতির দীর্ঘশ্বাসের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। তবে হ্যাঁ, স্বীকার করতে হবে যে, লাট্টুটা বরাতজোরে হস্তগত করতে পেরেছেন। কিছু টাকা গেল অবশ্য, সেটা খুব কম টাকাও নয়, কিন্তু লাট্টুটা তো উদ্ধার হয়েছে! সাড়ে চার হাজার টাকায় লাট্টু কেনাটা পাগলের কাণ্ড বলে মনে হবে ঠিকই, কিন্তু লোকে কি আর এই জিনিসের মর্ম বুঝবে!

সুচরিতা দেবী তৈরিই ছিলেন। পাঁচ হাজার টাকায় লাট্টু কেনার গল্পটা লতায়-পাতায় পল্লবিত হয়ে দশ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর শহরে এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে সুচরিতা দেবীর কানে পৌঁছে দেওয়ার লোকের অভাব হয়নি। বনবিহারী দত্তর বাড়ির কাজের মেয়ে বাতাসী এসে বলে গেল, “কী কাণ্ড রে বাবা, কী কাণ্ড! চার দিকে যে হুলস্থুল পড়ে গেছে! ও মাসিমা, এই বাড়ির কর্তাকে শিগগির মাথার ডাক্তার দেখাও! উনি যে আজ দশ হাজার টাকা দিয়ে একটা লাট্টু কিনেছেন!”

‘দশ হাজার টাকার লাট্টু’ শুনে সুচরিতা দেবীর মূর্ছামতো হয়েছিল। চোখে অন্ধকার দেখছিলেন। তবে গজপতিকে হাড়ে হাড়ে চেনেন বলে কোনও রকমে সামলেও উঠেছেন।

সুচরিতা দেবী বুঝে গেছেন, গজপতির সঙ্গে ঘর করতে হলে তাঁর নিজেরও মাথার ডাক্তার দেখানো উচিত। পাগল হতে তাঁরও বেশি বাকি নেই। তিনি কোমরে হাত দিয়ে রণং দেহি মূর্তিতে বাগানেই পায়চারি করছিলেন। এক বার আসুক লোকটা, ঝেড়ে কাপড় পরাবেন!

দূর থেকে সুচরিতা দেবীকে দেখতে পেয়েই গজপতি সুট করে গোপালের পিছনে গা-ঢাকা দিয়ে ফেললেন। ফিসফিস করে বললেন, “তুই এগিয়ে যা, কী কী বলবি সব ঠিক করে রেখেছিস তো!”

গোপাল নির্বিকার গলায় বলে, “ও সব তো আমার নামতার মতো মুখস্থ।”

দূর থেকে গোপালকে দেখেই সুচরিতা দেবী চেঁচিয়ে উঠলেন, “তোর গুণধর মেসোমশাইটি কোথায় শুনি!”

গোপাল এক গাল হেসে বলে, “না মাসিমা, আপনি যা ভাবছেন তা কিন্তু নয়।”

“কী ভাবছি তা তোর কাছ থেকে জানতে হবে নাকি! তুই কি অন্তর্যামী?”

“আপনি ভাবছেন তো যে, মেসোমশাই লাট্টুটা দশ হাজার টাকায় কিনেছেন! কিন্তু শুনলে আপনি খুশিই হবেন যে, মেসোমশাই মোটেই দশ হাজার টাকায় লাটুটা কেনেননি। লোকটা ঝুলোঝুলি করছিল বটে কিন্তু মেসোমশাই জলের দরে মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকায় কিনেছেন।”

“মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা! সেটা তোর কাছে জলের দর বলে মনে হচ্ছে? একটা লাট্টুর দাম সাড়ে চার হাজার টাকা তোর কাছে মাত্র বলে মনে হচ্ছে? টাকা কি খোলামকুচি?”

“আহা মাসিমা, দশ হাজার টাকার সঙ্গে তুলনা করে দেখুন সস্তা হচ্ছে কি না।”

“আমি কিছু শুনতে চাই না, লোকটা কোথায় গা-ঢাকা দিয়েছে বল!”

গোপাল দু’হাতে বাজারের ব্যাগসমেত বেশ একটা আড়াল করে রেখেছিল গজপতিকে, এ বার সে চট করে সরে দাঁড়ানোয় গজপতি প্রকট হয়ে পড়লেন। সরে দাঁড়িয়ে গোপাল অবাক ভাব করে বলে, “গা ঢাকা দেবেন কেন মাসিমা? এই তো মেসোমশাই! উনিই তো আমাকে পিছন থেকে পাহারা দিতে-দিতে নিয়ে এলেন বাড়ি পর্যন্ত! যা-ই বলুন, খুব হুঁশিয়ার মানুষ কিন্তু।”

সুচরিতা দেবী চোখ কপালে তুলে বললেন, “হুঁশিয়ার মানুষ! দেখাচ্ছি মজা হুঁশিয়ার মানুষকে তোর!”

এর পরের আধ ঘণ্টা গজপতির কেমন কেটেছিল, তা সবাই সহজেই অনুমান করতে পারবেন ভেবে আমরা আর ইতিবৃত্তান্তে গেলাম না। তবে আধ ঘণ্টা বাদে আমরা এক জন বিধ্বস্ত, অপমানিত, পরাজিত, পর্যুদস্ত, অবিন্যস্ত, অপ্রতিভ, ম্লান ও মলিন গজপতিকে তাঁর ঘরে চেয়ার বসে থাকতে দেখতে পাচ্ছি। হাতে সেই বিখ্যাত লাট্টু, যা সাড়ে চার হাজার টাকায় বগার কাছ থেকে কিনেছেন তিনি। সুচরিতা দেবী লাট্টুটা উনুনে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাড়িতে এখন আর কয়লার উনুন নেই বলে দিতে পারেননি। লাট্টুটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে গজপতি বিড়বিড় করে শেক্সপিয়র আওড়াচ্ছিলেন, “ইট ইজ দ্য কজ, ইট ইজ দ্য কজ়, মাই সোল…”

তবে হ্যাঁ, এই সব ছোটখাটো অপমান, বিদ্রুপ, তিরস্কার, লাভলোকসান তাঁকে খুব একটা বিচলিত করছিল না। এ সব গায়ে না-মাখলেও চলে। এরা তো জানে না যে, তিনি একটা অদ্ভুত রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করছেন! আর এই সামান্য জিনিসগুলো মোটেই সামান্য বা তুচ্ছ নয়। প্রত্যেকটাই বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার! জানাজানি হলে এ সব জিনিসের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। চাই কী লোভী লোকেরা পিছনে লোকও লাগাতে পারে। আর সেই জন্যই তিনি উত্তেজনা এবং আশঙ্কা বোধ করছেন। এগুলো কার আবিষ্কার তিনি জানেন না, কী করে এক জন গরিব আর মুখ্যুসুখ্যু ফেরিওয়ালার কাছে এল সেটাও রহস্য। ব্যাপারটা সামান্য ঘটনা নয়, রীতিমতো রোমহর্ষক! কারও সঙ্গে কথাটা শেয়ার করা দরকার, কিন্তু তেমন বিশ্বাসযোগ্য লোক কোথায়! বিশ্বাসযোগ্য হয়তো আছেও, কিন্তু সে বিজ্ঞানী না হলে হবে না। জিনিসগুলো খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখতে হবে, লোক জানাজানি হতে দেওয়া যাবে না।

উত্তেজনা বোধ করায় তিনি উঠে কিছু ক্ষণ ঘরে পায়চারি করে দেখলেন। না, এই শীতেও তাঁর বেশ ঘাম হচ্ছে, অর্থাৎ উত্তেজনাটা প্রশমিত হচ্ছে না। গোপন করার এই টেনশন তাঁর সহ্য হচ্ছে না।

সন্ধেবেলা দাবা খেলতে বসে সুরেশবাবু বললেন, “তোমার বৌ তো তোমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে চাইছেন হে!”

শুনে গজপতি নির্বিকার মুখে বললেন, “সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে আমার আপত্তি নেই। যদি তিনি আমার কয়েকটা প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেন।”

“তার মানে?”

“নিউটনের থার্ড ল কি তুমি ডিফাই করতে পারো!”

“না, পারি না। কিন্তু তার সঙ্গে সাইকিয়াট্রিস্টের সম্পর্ক কী?”

“সাইকিয়াট্রিস্ট কি পারবেন?”

“তা কী করে পারবেন!”

“তা হলে তাঁর কাছে গিয়ে লাভ নেই।”

“কী মাথামুন্ডু বলতে চাইছ তা একটু খোলসা করে বলো তো!”

“বললেও তুমি বুঝবে না। চিরকাল পুলিশের চাকরি করে এসেছ, বিজ্ঞানের বিষয় তুমি কি বুঝবে?”

“বিজ্ঞানের বিষয়! তুমি কি বলতে চাও, সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে একটা লাট্টু কেনা কোনও বৈজ্ঞানিক বিষয়?”

“ঠিক তাই বলতে চাইছি। সাড়ে চার হাজার তো কিছুই না। আসলে ওর কোনও দামই যথেষ্ট নয়।”

‘দেখো গজপতি, বেকুবের মতো একটা কাজ করে ফেলেছ, সে না হয় হল। যা গেছে তা গেছে। কিন্তু সেটাকে জাস্টিফাই করার জন্য এখন আবোলতাবোল বললে তো হবে না! আমি বগাকে অ্যারেস্ট করার কথা ওসিকে বলেছি। টাকাটা উদ্ধার হওয়া দরকার।”

“বগাকে অ্যারেস্ট করা হলে আমার আপত্তি নেই। কারণ সে চোর। জিনিসটা তার নয়। তবে জিনিসটার মহিমা বুঝলে সে আরও অনেক বেশি টাকা রোজগার করতে পারত। ভাগ্যিস সে মহিমাটা বুঝতে পারেনি, পারলে আমি লাট্টুটা এত সহজে হাত করতে পারতাম না।”

সুরেশ চোখ কপালে তুলে বলেন, “এটাকে সহজে হাত করা বলে নাকি! সাড়ে চার হাজার টাকা গুনাগার দিয়ে একটা সামান্য লাট্টু কেনা কি সহজে হাত করা হল?”

গজপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “একটা কথা বলবে সুরেশ?”

“কী কথা!”

“তোমাকে বিশ্বাস করা চলে কি?”

“তার মানে! তুমি আমাকে না হোক তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর ধরে চেনো, কখনও অবিশ্বাস করার মতো কিছু দেখেছ কি!”

“তা দেখিনি। কিন্তু আমাকে পাগলা গারদে পাঠানোর ব্যাপারে তোমার এত উৎসাহ দেখে ভয় হচ্ছে, আমার ওপর তোমার হয়তো কোনও আস্থাই নেই। একটু আগেই তুমি বললে, আমি নাকি আবোলতাবোল বকছি!”

সুরেশবাবু একটু গুম হয়ে রইলেন, তার পর হঠাৎ সহজ হয়ে বললেন, “কোনও আষাঢ়ে গল্প যদি না হয় তা হলে আমাকে বলতে পারো।”

“এটা কোনও গল্পটল্প নয়, তবে আষাঢ়ে কি না তা ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভর করে। তোমাকে বলে লাভ নেই, কারণ তুমি বিজ্ঞান জানো না। প্রত্যেক মানুষেরই বেসিক বিজ্ঞান খানিকটা জানা উচিত।”

“সেটা কি আমি জানি না বলে তোমার মনে হয়?”

“জানলে আমার বৌয়ের কথায় নেচে উঠতে না, আর আমাকে পাগল বলেও সন্দেহ করতে না!”

“আহা, চটে যাচ্ছ কেন? সবটা খুলে না-বললে সন্দেহ তো হতেই পারে।”

“মুখে বলে কোনও লাভ নেই। তোমাকে একটা ডেমো দেখাতে চাই। কিন্তু তার আগে তোমাকে কথা দিতে হবে যে, যা দেখেছ তা কারও কাছে প্রকাশ করতে পারবে না! আর সেটা তোমার এবং আমার ভালর জন্যই। তবে লাট্টুটার কথা মানুষ খানিকটা জেনে গেছে এবং তাতে অনেকটাই ড্যামেজ হয়েছে। এ সব কথা ছড়িয়ে পড়লে শকুনেরা চঞ্চল হয়ে ওঠে কিনা!”

“ঠিক আছে। কথা দিলাম।”

“তা হলে টেবিল থেকে দাবার বোর্ড সরাও, আর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসো।”

সুরেশবাবু তা-ই করলেন। গজপতি গম্ভীর মুখে পকেট থেকে বড়সড় লাট্টুটা বের করে অত্যন্ত তৎপরতায় সেটা টেবিলের উপর দু’আঙুলে টুসকি মেরে ঘুরিয়ে দিলেন। লাট্টুটা এক বার একটু কাত হয়েই সোজা দাঁড়িয়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে ঘুরতে লাগল। দুরন্ত গতি, হেলদোল নেই, প্রতিসরণ নেই। যেন একটা নির্দিষ্ট বিন্দুর উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। ঘুরছে তো ঘুরছেই।

একটু পরে গজপতি বলেন, “লক্ষ করে দেখো, লাট্টুটা নিউটনের থার্ড ল ভায়োলেট করছে। বস্তুর যে-কোনও মোশনই নিয়ন্ত্রণ করে সারফেস এবং অ্যাটমস্ফিয়ারের বায়ু। তারা মোশনকে ইকুয়াল অ্যান্টিফোর্সে আটকায়। তাই স্বাভাবিক নিয়মে লাট্টুটার দম এত ক্ষণে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না।”

“ভিতরে কোনও মেকানিজম নেই তো! ধরো ব্যাটারি বা ডায়নামো কিংবা মাইক্রোচিপ। এমনকি রিমোট কন্ট্রোলও তো হতে পারে!”

“পারে এবং সেই রকম কিছু আছেও। তবে তুমি যে নামগুলো বললে সে রকম কিছু নয়। অন্য কিছু, মার জানার মধ্যে নয়।” “আহা, এক্স রে করে দেখলেই তো হয়।”

“ঠিক বলেছ। আজ দুপুরবেলা আমি মোহনদাস এক্স রে ক্লিনিকে গিয়েও ছিলাম। লাট্টুর এক্স রে করাতে চাই শুনে লোকটা ঠিক তোমার মতোই, আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা বিষয়ে সন্দিহান হয়ে অনেক ক্ষণ আমাকে নিরীক্ষণ করেছিল। তার পর অবশ্য ন্যায্য পয়সা পেয়ে এক্স রে করেও দেয়। কিন্তু ওখানেই রহস্য। এক্স রে লাট্টুটার বডি পেনিট্রেট করতে পারেনি।”

“তার মানে!”

“যা বলছি ঠিক তাই। এক্স রে-র সারফেস থেকে বাউন্স করেছে, ভিতরে ঢুকতে পারেনি। মোহনদাসের রেডিয়োলজিস্ট নিজেও ভারী অবাক হয়ে বলল, এ রকম হওয়ার কথাই নয়। সে নিজের কৌতূহল মেটাতে আরও বার চারেক চেষ্টা করে দেখেছে। হয়নি। এই দেখো, এক্স রে প্লেট আমি সঙ্গে করেই এনেছি,” বলে চাদরের তলা থেকে একটা বড়সড় চৌকো খাম, যে রকম খামে সাধারণত এক্স রে প্লেট থাকে, বের করে দিলেন গজপতি।

সুরেশ মন দিয়ে প্লেটগুলো দেখলেন। রিপোর্টেও এই কথাটাই লেখা আছে যে, এক্স রে ফেল করেছে।

সুরেশ ভ্রু কুঁচকে বললেন, “এর মানে কী গজপতি?”

“এর মানে জানলে আর পাগলের বদনাম নিয়ে বেঁচে থাকতে হত নাকি আমাকে! তবে এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, এগুলো কোনও এক জন বিজ্ঞানবিদের আবিষ্কার। তবে এলেবেলে বিজ্ঞানী নয়। সাংঘাতিক কেউ। এবং সেই বিজ্ঞানী হয়তো আমাদের কিছু জানাতে চায়।”

“কী করে বুঝলে?”

 “তার আগে লাট্টুটাকে ভাল করে দেখো। তোমার টেবিলে টেবিলক্লথ পাতা আছে, ফলে লাট্টুটাকে অনেক বেশি ফ্রিকশন সহ্য করতে হচ্ছে, তবু স্পিড এতটুকু কমছে না। তার ওপর বাতাসের ফ্রিকশন তো আছেই। ফেরিওয়ালাটা আমাকে বলেছিল, লাট্টুটা অক্সিজেন জেনারেট করে।”

“ফেরিওয়ালাটা তো ফেরেববাজ!”

“ওই অ্যাটিচুডের জন্যই তুমি ডিফিকাল্ট! যখন-তখন তোমার ভিতরকার পুলিশটা মাথাচাড়া দেয়। ফেরিওয়ালাটা মোটেই ফেরেববাজ নয়। হলেও সে আমার সঙ্গে অন্তত কোনও ফেরেব্বাজি করেনি। বরং তার কিছু আচরণ দেখে আমার মনে হয়েছে, সে খুব সাধারণ বা এলেবেলে লোক নয়। আবার বলছি, সে ভাল লোক না-ও হতে পারে, কিন্তু এলেবেলে লোক নয়। প্রমাণ চেয়ো না, ওটা এখনই আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।”

 “কিন্তু সে তোমার কাছে এই যে জিনিসটা দিয়ে গেছে, এটা সে পেল কোথায়? সে এটা আবিষ্কার করেনি নিশ্চয়ই! তা হলে এটা অবশ্যই চুরির মাল!”

“সুরেশ, একটু মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখো, এই লাট্টুটা ছাড়াও সে আমাকে আরও দুটো জিনিস দিয়ে গেছে। একটা হুইস্‌ল…”

“যেটা বাজে না?”

‘‘আর একটা টর্চ…”

“যেটা জ্বলে না?”

“ঠিক তাই। কারণ ওগুলো আসলে হুইস্‌লও নয়, টর্চও নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজের জিনিস।”

“কী কাজ বলো তো!”

“হুইস্‌লটা কীট-পতঙ্গ, মশা-মাছিকে রিপাল্স করতে পারে বলে আমার ধারণা হয়েছে। আর টর্চটা পৃথিবীর দূষণ কমিয়ে দিতে পারে।”

“বলো কী? এত বড় আবিষ্কার হয়ে গেল, আর আমরা টেরও পেলাম না!”

গজপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাকে বলে ফেলে ভাল করলাম কি না জানি না, তুমি হয়তো ঘটনাটা সিরিয়াসলি নিলেও না। তোমার মুখে-চোখে একটা ঠাট্টা-তামাশার ভাবই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি তোমাকে তো ভূতের গল্প বলছি না, সায়েন্সের কথাই বলছি। এই জিনিসগুলো আমার কাছে থাকায় আমি খুব টেনশনে আছি বলেই তোমাকে বলে ফেললাম, কারও সঙ্গে শেয়ার করলে একটু হালকা লাগবে বলে। কিন্তু তুমি তো দেখছি এখনও তোমার লঘুচিত্ততা থেকেই বেরোতে পারোনি!”

সুরেশ একটু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বললেন, “শোনো গজপতি, তোমার লাট্টুটা দেখে আমি যথেষ্ট ইমপ্রেস্ড হয়েছি। তবে কথা আছে। ইন ফ্যাক্ট, আমার এখনও ধারণা, ওটা রিমোট কন্ট্রোলে চালানো হচ্ছে, আর ওটার পিছনে কোনও দুষ্টচক্র কাজ করছে। আজকাল অ্যান্টিসোশ্যালদের কাছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সবার আগে পৌঁছে যায়। আর আমার এমনও মনে হচ্ছে যে, এই লাট্টুটা হয়তো আমাদের কথা চুরি করে অন্য কারও কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এর মধ্যে যে মাইক্রোফোন নেই তা কি তুমি হলফ করে বলতে পারো?”

“না, তা পারি না। তবে আমি এক জন রিটায়ার্ড সায়েন্টিস্ট, আর তুমি এক জন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার, আমাদের কাছে চুরি করার মতো কী তথ্য থাকতে পারে বলো তো! আমরা তো এখন নিতান্তই নিরীহ এবং গোবেচারা দুই নাগরিক! আমাদের মতো অকাজের লোকের পিছনে কেন কেউ এত মেহনত করতে যাবে? ওই যা বললাম, তোমার মুশকিল হল, তুমি যে একদা পুলিশ ছিলে সেটা ভুলতে পারছ না।”

“পুলিশের ওপর তোমার এত রাগ কেন?

“বিন্দুমাত্র রাগ নেই। বরং এখন আমার এক জন বিচক্ষণ, গোয়েন্দার মতো মস্তিষ্কওয়ালা মানুষেরই সাহায্য বিশেষ ভাবে দরকার, যে ঠান্ডা মাথায় লজিক্যাল ডিডাকশন করতে পারবে। কিন্তু তুমি চিন্তাভাবনার চেয়ে এক লাফে কনক্লুশনে পৌঁছনোয় বেশি আগ্রহী। তুমি অ্যাকশন চাও, ধরপাকড় চাও, এক্ষুনি কিছু একটা সমাধান করে ফেলতে চাও। উত্তেজিত মস্তিষ্ক এবং বৃথা আড়ম্বরযুক্ত চিন্তা— দু’টিই অসিদ্ধির লক্ষণ। তোমার আর একটা দোষ হল, তুমি আমার বৌ বা পাড়াপড়শির কথাকে যতটা গুরুত্ব দিচ্ছ তার কণামাত্র গুরুত্ব আমার কথাকে দিচ্ছ না। তাই ভাবছি, তোমাকে এ সব কথা বলা ঠিক হল কি না।”

সুরেশবাবু একটু অবাক হয়ে বলেন, “গজপতি, তুমি যে আমাকে রীতিমতো হুমকি দিচ্ছ হে! আমার বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর কি তোমার একেবারেই আস্থা নেই? আমার তো মনে হয়, ফেরিওয়ালাটাকে অ্যারেস্ট করলেই সব দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। এ সব চিনে জিনিস ও-ই স্মাগল করে এনেছে।”

“তাই তো বলছি, তোমার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে কোনও লাভ নেই, তুমি বুঝবে না। কারণ বিজ্ঞান বিষয়ে তোমার জ্ঞান খুব সীমাবদ্ধ। তার চেয়েও সীমাবদ্ধ তোমার বোধ-বিবেচনা।”

সুরেশবাবু রাগলেন না, তবে একটু গুম হয়ে থেকে বললেন, “তুমি কি বলতে চাও যে, এই লাট্টুটা বিজ্ঞানের কোনও বিস্ময়কর আবিষ্কার?”

“শুধু বিস্ময়কর বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। আসলে এ রকম কিছু তৈরি করা আমাদের বিজ্ঞানে সম্ভবই নয়।”

“তা হলে এটা তৈরি হয়েছে কী করে?”

“সেইটেই রহস্য। এবং গভীর চিন্তার বিষয়। এটা চিনে তৈরি কোনও খেলনা নয়, কোনও ম্যাজিক আইটেম নয়। এ রকম জিনিস যে আবিষ্কার করেছে তার উচিত ছিল জিনিসগুলোর পেটেন্ট নেওয়া, এবং আবিষ্কারটা ঘোষণা করা। তাতে সে কোটি-কোটি টাকা রোজগার করতে পারে এমনকি, নোবেল প্রাইজ পেতে পারে। কিন্তু তা সে করছে না।”

সুরেশ অবাক হয়ে বলেন, “বলো কী হে! হুইস্‌ল, টর্চ আর লাট্টু আবিষ্কারের জন্য নোবেল প্রাইজ়!”

“আমার মনে হয় তার চেয়েও বড় সম্মান তার প্রাপ্য।”

“কী বলতে চাইছ বলো তো!”

“আমার কথা তোমার বোধগম্য হবে না। আমি খুব উদ্বিগ্ন। শুধু দোহাই তোমার, দয়া করে ফেরিওয়ালাটাকে অ্যারেস্ট করাতে যেয়ো না।”

“অ্যারেস্ট করালে ক্ষতি কী?”

“ফেরিওয়ালাটা কোনও অপরাধ করেনি। বরং মনে হয়, লোকটা কারও বার্তাবহ।”

‘অপরাধ করেনি মানে? আমার তো মনে হচ্ছে জিনিসগুলো ও চুরি করে এনেছে।”

“যদি চুরিই করে থাকে তা হলেও কোনও প্রমাণ নেই, কেউ তো ওর নামে নালিশ করেনি! আর যারটা চুরি করেছে তার কাছে ফরমুলা এবং নো হাউ দুটোই আছে, সে দরকার মতো আবার এ রকম সব জিনিস তৈরি করতে পারবে।”

“তুমি যে আমাকে ভাবিয়ে তুললে হে!”

“যদি সেটা পেরে থাকি তবে সেটা আমার সৌভাগ্য। ধুমধাড়াক্কা অ্যাকশনের চেয়ে চুপ করে বসে নিবিষ্ট হয়ে পূর্বাপর ভাবা এবং চিন্তার সূত্র ধরে এগোনোটাই এখন দরকার। ভাবো সুরেশ, ভাবো। ভাবতে শেখো। অ্যাকশন শুধু হাত-পায়ের কাজ নয়, মগজেরও কিন্তু অ্যাকশন আছে, আর সেটা অনেক বেশি ফলপ্রসূ।”

সুরেশ নিবিষ্ট হয়ে লাট্টুটাকে দেখছিলেন। মৃদু একটা বোঁ বোঁ শব্দ করে লাট্টুটা ঠিক একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে একই দমে ঘুরে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। দম ফুরোনোর কোনও লক্ষণই নেই। বিস্ময়কর বটে, তবে আজকাল তো নানা ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বেরিয়েছে, সুরেশ তাই খুব বেশি বিস্মিত হতেও পারছেন না। একটু বেজার মুখ করে বললেন, “এসব কি সায়েন্স ফিকশনের জিনিস?”

“যা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছ তাকে ফিকশন বলি কেমন করে! তবে হ্যাঁ, মিস্টিরিয়াস অবশ্যই। আমি রিটায়ার করেছি বটে, কিন্তু নিয়মিত সায়েন্স জার্নালগুলো পড়ি। ইন্টারনেট থেকে পয়সা খরচ করে ডাউনলোড করি, হালফিল বিজ্ঞানের খবর রাখার জন্য। আমি জানি এ রকম কোনও জিনিস আবিষ্কার হয়নি। তাই আমি তোমার সাহায্য চাই সুরেশ।”

“কী রকম সাহায্য?”

“আমার মনে হয়, কালীচরণ কোনও কারণে আমার হেফাজতেই জিনিসগুলো রাখতে চেয়েছিল। হুইস্‌ল আর টর্চটা আমি রেখেওছিলাম। কিন্তু লাট্টুটা নিইনি। গিন্নির ভয়ে। কিন্তু তা বলে সে বগার মতো একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন লোককে লাট্টুটা কেন দিয়ে গেল সেটাই বুঝতে পারছি না। আমার মন বলছে, ফেরিওয়ালাটা কোনও দায়ে পড়ে বা বিপদের গন্ধ পেয়ে তাড়াহুড়ো করে জিনিসটা সরিয়ে ফেলতে এ কাজ করেছে, তবে তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। লাটুটার কথা অনেক লোক জেনে গেছে।”

“শোনো, বগাকে আমি ইতিমধ্যেই অ্যারেস্ট করিয়েছিলাম। জেরা করে জেনেছি যে, ফেরিওয়ালাটা কুমোরপাড়ার নন্দবাবুকে ওটা গছিয়ে গিয়েছিল। নন্দবাবু ওটা ফেরত দেন। তার পর ফেরিওয়ালা ওটা বগাকে দিয়ে যায়।”

“কিন্তু কেন? এ রকম অমূল্য একটা জিনিস সে নন্দবাবুকেই বা কেন গছাতে গেল কিংবা বগাকেই বা কেন দিয়ে গেল!”

“এর জবাব খুব সোজা। চোরাই জিনিস সহ ধরা পড়লে বিপদ হবে জেনে সে ওগুলো যাকে হাতের কাছে পেয়েছে তার কাছেই পাচার করেছে।”

“হয়তো অনেকটা ও রকমই। কালীচরণ ভয় পেয়েছে বলেই এই কাণ্ড করেছে।”