এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা – ২

॥২॥

গজপতি ঘোষ এক জন লাজুক, মুখচোরা, আনস্মার্ট এবং ভিতু মানুষ। মফস্সল শহরের এক প্রান্তে নিরিবিলি জায়গায় তার একটা একটেরে বাড়ি আর তৎসংলগ্ন ছোট মতো একখানা বাগান আছে। গজপতি এক সময়ে বিজ্ঞান গবেষণা করতেন। এখন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে শুধু বাগান নিয়ে পড়ে আছেন। বাগানই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তাঁর মাথায় যে একটু গোলমাল আছে, এটা তিনিও জানেন এবং লোকেও টের পায়। এক রকম বীজের সঙ্গে আর এক রকমের বীজ মিশিয়ে তিনি নতুন-নতুন গাছ তৈরির চেষ্টা করেন। বেশির ভাগ চেষ্টাই বিফলে যায়। দু’-একটা গাছ হলেও তাতে ফুল বা ফল প্রত্যাশামতো ফলে না।

এখন সকাল সাড়ে ছ’টা। প্রচণ্ড শীত। চার দিকটা ঘন কুয়াশায়। এখনও অন্ধকার হয়ে আছে। এই শহরে শীতকালে রোদ অনেক বেলায় দেখা দেয়। গজপতির গায়ে মোটা পুলওভার, গলায় কমফর্টার, মাথায় বাঁদুরে টুপি, পায়ে মোজা। আজ সকালে তিনি অত্যন্ত কৌতূহলের সঙ্গে তাঁর হাইব্রিড জবা গাছটা দেখছিলেন। কিন্তু না, আজও জবা গাছটায় কোনও কুঁড়ি আসেনি। আর আসবে বলে মনেও হয় না। অথচ তাঁর বিশ্বাস ছিল, এই গাছটায় কালো রঙের জবা ফুল ফুটবে।

এই সাতসকালে সেই খ্যাপা ফেরিওয়ালাটা ঠেলাগাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে, তার আজব সব জিনিস ফিরি করতে। তার ঠেলাগাড়িতে পুরনো লোহালক্কড়, ভাঙাচোরা জিনিস, অকেজো বেহালা, ফেঁসে যাওয়া তবলাডুগি, ফাটা বাঁশি, জংধরা হাতুড়ি, বাতিল যন্ত্রপাতি, এই সবই থাকে। কেউ কিছু কেনে বলে তো মনে হয় না, তবু সকালবেলায় সে “আ পান, আ পান” বলে হাঁক মেরে তার সওদা ফিরি করতে বেরোয়।

এই ‘আ পান, আ পান’ কথাটার মানে কী, তা গজপতি জানেন না। বেশির ভাগ ফেরিওয়ালার ডাকই বোধগম্য নয়। কিন্তু এই লোকটার সঙ্গে গজপতির বেশ পট খায়। কেন পট খায় সেটাও গজপতি বেশ বুঝতে পারেন। তিনিও যেমন একটু পাগল, ফেরিওয়ালাটাও তেমনি একটু খ্যাপা।

এই পথে এলে ফেরিওয়ালাটা গজপতির ফটকের সামনে একটু দাঁড়িয়ে যায়। আজও দাঁড়িয়েছে। এমনিতে গজপতি মুখচোরা হলেও পাগল গোছের লোক পেলে কথা কয়ে সুখ পান। গজপতি ফটকের কাছে গিয়ে দেখলেন, লোকটার গায়ে আজও সেই গেরুয়া রঙের একটা ময়লা ফতুয়া, পরনে সেই খাকি রঙের নোংরা পাতলুন, পায়ে সেই হাওয়াই চটি।

গজপতি আজ একটু মায়াভরে জিজ্ঞেস করলেন, “ওহে বাপু, তোমার কি গরম জামাটামা নেই?”

লোকটা বেশ লম্বা, রোগাটে চেহারা, রং তামাটে, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গালে রুখু দাড়ি এবং গোঁফ। বয়স তিরিশ-পঁয়তিরিশ হবে। এক গাল হেসে বলে, “গরম জামা! গরম জামা দিয়ে কী হবে বাবু! আমার কি শীতগিরিষ্মি বলে কিছু আছে?”

গজপতি অবাক হয়ে বলেন, “বলো কী হে! এই পাথুরে শীতেও তোমার ঠান্ডা লাগছে না! আমার তো ঠান্ডায় হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে!”

লোকটা বড়-বড় দাঁত দেখিয়ে চওড়া হাসি হেসে বলে, “মাইনাস কুড়ি বা তিরিশ হলে তখন হয়তো একটু শীত-শীত করবে। এই শীতকে তো শীত বলেই মনে হচ্ছে না!”

পাগল আর কাকে বলে! এই শীতেও লোকটা নাকি শীত টের পাচ্ছে না! গজপতিবাবুর মনটা বড্ড নরম, তিনি বললেন, “তোমার যদি আপত্তি না থাকে তা হলে তোমাকে আমি আমার একটা পুরনো পুলওভার দিতে পারি।”

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “না বাবু, ওই সব জিনিস গায়ে চাপালে আমার ফোস্কা পড়ে যাবে!”

“তুমি খুব অদ্ভুত লোক বাপু! এই সাতসকালে কী সব ছাইভস্ম জিনিস ফিরি করতে বেরিয়ে পড়েছ! তার ওপর গায়ে একটা গরম জামা অবধি নেই!”

লোকটার কাঁধে একটা লাল রঙের ময়লা গামছা ঝুলছিল, সেটা টেনে নামিয়ে মুখটা মুছে বলে, “আজ কিছু নেবেন না বাবু? একটা টর্চবাতি আছে, দিয়ে যাই?”

“না বাপু, তুমি সেই যে একটা হুইস্‌ল আমাকে গছিয়ে দিয়ে গিয়েছিলে, সেটা আমি আমার নাতিকে দিয়েছিলাম, কিন্তু সেটাতে তো কোনও শব্দই হয় না!”

লোকটা মাথা চুলকে একটু লজ্জার হাসি হেসে বলে, “আমারই ভুল, আপনাকে বলা হয়নি, ওটা আসলে শব্দের হুইস্‌ল নয়। ওটা গন্ধের হুইস্‌ল। ওটা বাজালে একটা সুন্দর গন্ধ বেরোয় আর বাড়িতে মশা-মাছি থাকে না।”

গজপতি বিজ্ঞানী হলেও লোকের যে কোনও কথা চট করে বিশ্বাস করে ফেলার বদ অভ্যাস তাঁর আছে। অবাক হয়ে বলেন, “বলো কী হে! এ রকম হুইস্‌লও পাওয়া যায় নাকি!”

“আজ্ঞে দুনিয়ায় কত আজব জিনিস আছে বাবু, তার কি কোনও লেখাজোখা আছে!”

গজপতি একটু ভাবিত হলেন। তাঁর মনে পড়ল, কয়েক দিন আগে তাঁর গিন্নি বলছিলেন বটে, বাড়িতে একটা ধূপকাঠির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু কোথাও কোনও ধূপকাঠির সন্ধান পাওয়া যায়নি। তা হলে কি সেটা ওই হুইস্‌লেরই গন্ধ? কে জানে বাবা, হতেও পারে। তবে মশামাছির ব্যাপারটা তাঁর জানা নেই। হলেও হতে পারে। আসলে গজপতি আজগুবিতে বিশ্বাস করতে ভালবাসেন। আমতা-আমতা করে বললেন, “ভেবেছিলাম হুইসলটা তোমাকে ফেরত দেব। তা হলে আরও কয়েকটা দিন দেখি। তুমি অবশ্য দাম এখনও নাওনি।”

লোকটা ভারী আহ্লাদের হাসি হেসে বলে, “দাম কি আর পালিয়ে যাচ্ছে বাবু? দেবেন যখন খুশি। আজ বরং টর্চবাতিটা রেখে দিন।”

“না হে বাপু, আমার তো টর্চ আছে।”

“এটা সেই টৰ্চ নয় বাবু, এ অন্য জিনিস!”

“কী রকম হে?”

লোকটা ভারী লজ্জা-লজ্জা ভাব করে বলল, “এটা আলো জ্বালবার টর্চ নয় বাবু।”

“তা হলে কি টর্চ থেকে অন্ধকার বেরোয়?”

খুব যেন মজার কথা বলা হয়েছে এমন ভাবে হি হি করে হাসল লোকটা, তার পর মাথা নাড়া দিয়ে বলল, “আজ্ঞে, তা বলতে পারি না। তবে শুনেছি এই টর্চ থেকে একটা রশ্মি বেরোয়। তাতে অনেক কাজ হওয়ার কথা।”

“রে গান’ নাকি হে বাপু? কিন্তু সে জিনিস তো তোমার কাছে থাকার কথা নয়!”

“আমি কি আর সায়েন্স জানি? নানা জায়গা থেকে নানা জিনিস কুড়িয়ে বাড়িয়ে আনি, কোনটা কী কাজে লেগে যায় তা কে বলতে পারে! তবে মনে হয় টর্চটা নিলে আপনি ঠকবেন না।”

গজপতি মাথা নেড়ে বলেন, “না হে বাপু, রে জিনিসটা বিপজ্জনক, শেষে কী থেকে কী হয়ে যায় কে বলতে পারে!”

লোকটা গম্ভীর হয়ে বলে, “তা অবিশ্যি ঠিক। রশ্মি বা বিকিরণ থেকে হুঁশিয়ার থাকাই ভাল। তবে কিনা আপনার জবা গাছটায় এক বার পরীক্ষা করে দেখলেও পারতেন। খানিকটা বিকিরণ ঢুকিয়ে দিলে ফুল ফুটতেও পারে তো! কী বলেন?”

গজপতি বেজায় অবাক হয়ে বলেন, “তুমি আমার জবা গাছটার কথা জানলে কী করে হে!”

লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “গত বিষ্যুৎবারে আপনিই যেন দুঃখ করে বলছিলেন, ‘ওহে কালীচরণ, এত মেহনত বুঝি বৃথাই গেল হে, আমার জবা গাছটায় আর বুঝি কুঁড়িই এল না!””

গজপতি তাজ্জব। তিনি কিছু ক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “এ সব কথা আমি তোমাকে কবে বললুম বলো তো! আর আমি তো জানতামই না যে, তোমার নাম কালীচরণ!”

লোকটা ঘ্যাঁসঘ্যাঁস করে মাথা চুলকে কুণ্ঠিত গলায় বলে, “তা হলে বোধ হয় আমার ভুলই হয়েছে বাবু। মনে হচ্ছে সেই লোক বোধ হয় আপনি নন। কী জানি, বোধ হয় কুমোরপাড়ার নন্দবাবুই হবেন। বরং তাকেই দেব’খন জিনিসটা।”

কুমোরপাড়ার নন্দবাবুকে খুব চেনেন গজপতি। লোকটা কিপটের হদ্দ, দুর্মুখ এবং রগচটা। নন্দবাবুর নাম শুনেই গজপতির পিত্তি জ্বলে গেল। তিনি বেশ জোরালো গলায় বললেন, “না-না, ওই টর্চ আমিই নেব হে! তা দামটা কত যেন!”

“আজ্ঞে, দাম তো অনেক, পঞ্চাশ টাকা! তবে আপনাকে অত দিতে হবে না, পঁচিশটা টাকা ফেলে দিলেই হবে। তাড়াহুড়ো নেই, মাসপয়লা আপনি যখন পেনশন পাবেন, তখন দিলেই চলবে।”

লোকটা ঠেলাগাড়ি থেকে একটা কালো রঙের টর্চ বের করে গজপতির হাতে দিল। টর্চটা হাতে নিয়ে গজপতি দেখলেন টর্চটা বেশ ভারী। সুইচ টিপে দেখলেন, কোনও আলো জ্বলল না বটে, তবে একটু যেন গরম হল। হয়তো কোনও কাজই করবে না! না করুক, খুব বেশি ঠকাও তো হচ্ছে না! সত্যিকারের কোনও রে গান হলে তার দাম অনেক বেশি হওয়ার কথা! আর কাজ না হলে ফেরত তো দেওয়াই যাবে। কালীচরণের এই একটা গুণ আছে, জিনিস ফেরত দিলে নির্বিকার মুখে নিয়ে নেয়। গছানোর জন্য ঝোলাঝুলি করে না।”

কালীচরণ “আ পান, আ পান” বলে হাঁক মারতে মারতে অনেক দূর চলে যাওয়ার পরও গজপতির থম-ধরা ভাবটা যাচ্ছিল না। লোকটা জবা গাছটার কথা জানল কী করে? শুধু তাই নয়, জবা গাছটায় ফুল আসছে না বলে গজপতির টেনশনের কথাটাও জানে! অন্তর্যামী বলে একটা কথা আছে, সেটা অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিন্তু লোকটা তো দেখা যাচ্ছে ওরকমই কিছু! নাহ, লোকটা তো বেশ ভাবিয়ে তুলল তাকে! হাতের টর্চটার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছু ক্ষণ চেয়ে রইলেন গজপতি। তার পর জবা গাছটার কাছে গিয়ে গাছটা তাক করে টর্চটার সুইচ টিপে ধরে রইলেন কিছু ক্ষণ। কিছুই হল না অবিশ্যি। লোকটার আজগুবি এবং অবিজ্ঞানসম্মত কথায় নির্ভর করছেন বলে তাঁর নিজের জন্য একটু লজ্জাও হল।

একটু বেলায় যখন ডাইনিং টেবিলে সকালের জলখাবার খেতে বসেছেন, তখন মনের ভুলে টর্চটা টেবিলের উপর উপুড় করে খাড়া ভাবে রেখেছিলেন। গিন্নি দেখলে যে রাগ করবেন, সেটা খেয়াল ছিল না। তাঁর গিন্নি সুচরিতা দেবী অত্যন্ত মিতব্যয়ী মানুষ, বাজে খরচ একদম বরদাস্ত করেন না। টৰ্চটা চোখে পড়তেই এমন চেঁচালেন যেন বাড়িতে আগুন লেগেছে, “বলি ওই কেলেকুষ্টি টর্চটা কোথা থেকে এল শুনি! নিশ্চয়ই ওই হাড়হাভাতে ফেরিওয়ালাটা আগড়মবাগড়ম বুঝিয়ে তোমাকে গছিয়ে দিয়ে গেছে! সক্কালবেলায় ওই হতভাগাটার হাঁকডাক শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম, তোমাকে আহাম্মক পেয়ে নিশ্চয়ই কোনও অচল মাল গছিয়ে দিয়ে যাবে! এখন দেখছি ঠিক তাই! বলি তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি আর কবে হবে বলো তো! বাড়িতে দু’-দুটো টর্চ থাকতে আবার একটা টর্চ কোন আক্কেলে কিনতে গেলে!”

গিন্নির সামনে তিনি বরাবরই ভারী অসহায় হয়ে পড়েন। কথাগুলোর উপযুক্ত জবাবও আছে বটে, কিন্তু সময়মতো সেগুলো তাঁর মনেই পড়ে না। মাখনমাখানো পাউরুটির টোস্ট তাঁর মুখে নারকেলের ছোবড়ার মতো বিস্বাদ লাগছে, পাকা মর্তমান কলাকে মনে হচ্ছে পেঁপেসেদ্ধ। তবে ঝড়ের মুখে কুটো গাছের মতো উড়ে যেতে-যেতেও তিনি শুধু বলতে পারলেন, “আহা, ওটা আসলে টর্চ নয়।”

“তবে ওটা কী? অ্যাটম বোমা না ডুবোজাহাজ? তোমাকে কি বুঝিয়ে গছিয়ে দিয়ে গেছে শুনি! তোমার মতো বোকা লোক কোন বুদ্ধিতে যে ফিজ়িক্স নিয়ে রিসার্চ করত তা বুঝি না বাবা! ওটা আমি আজই যদি আঁস্তাকুড়ে না ফেলেছি তবে আমার নামই সুচরিতা নয়। বলি কত টাকা গচ্চা দিয়েছ?”

“টাকা দিইনি এখনও। ফেরত দিয়ে দেওয়া যাবে।

সুচরিতা অত্যন্ত কঠিন গলায় বললেন, “তাই যেন দেওয়া হয়। ফেরত নিতে গাঁইগুঁই করলে আমাকে ডেকো, আমি হতভাগাটার বিষ ঝেড়ে দেব।”

গজপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টর্চটা হাতে নিয়ে উঠে পড়লেন।

হুইস্‌লটায় শব্দ হয় না বলে তাঁর নাতি সেটা তাঁকে ফেরত দিয়ে গেছে। নিজের ঘরে এসে গজপতি হুইসলটাকে তাঁর টেবিলে অনাদরে পড়ে থাকতে দেখলেন। চার দিকে তাকিয়ে দেখলেন কেউ দেখছে কিনা। তার পর হুইসলটা মুখে নিয়ে একটা হালকা করে ফুঁ দিয়েই তাড়াতাড়ি রেখে দিলেন। তার পর বাতাস শুঁকে দেখলেন, একটা হালকা সুগন্ধ যেন পাওয়া যাচ্ছে! তবে বলা যায় না, সেটা মনের ভুলও হতে পারে। নিজের বুদ্ধিশুদ্ধি বা অনুভূতি কিংবা বিচার-বিশ্লেষণের উপর তাঁর খুব একটা বিশ্বাস নেই। এবার তিনি ঘরের মধ্যে মশা-মাছি খুঁজে দেখতে লাগলেন। কোনও মশা-মাছি তাঁর চোখে পড়ল না। কিন্তু সেটাও তাঁর দেখার দোষ হতে পারে। মশা-মাছি যে সব সময়ে চোখের সামনে নাচানাচি করবে এমন তো কথা নয়! মশামাছিদেরও তো নানা বিষয়কর্ম থাকতেই পারে।

টর্চটা টেবিলের ড্রয়ারে সাবধানে রেখে দিলেন গজপতি। এ কথা সত্যি যে বিজ্ঞানের মানুষ হয়েও এখনও তাঁর নানা কুসংস্কার আছে, নইলে তিনি কালীচরণের মতো একটা বিটকেল লোককে ফস করে এতটা বিশ্বাস করে ফেললেন কী করে?

কিন্তু পর দিন সকালে যা ঘটল তাতে তাজ্জব না হয়ে উপায় নেই। রোজকার মতোই সকাল সাড়ে ছ’টায় বাঁদুরে টুপি, কমফর্টার, পুলওভার আর মোজায় নিজেকে ঢেকেঢুকে তিনি বাগানের পরিচর্যায় নেমেছিলেন। জবা গাছটার কাছে আচমকা এসে হাঁ হয়ে গেলেন তিনি এবং বেশ কিছু ক্ষণ হাঁ করেই রইলেন। হাঁ হওয়ারই কথা কিনা! কাল পর্যন্ত জবা গাছটায় একটাও কুঁড়ি ছিল না, কিন্তু আজ সেই গাছে তিনতিনটে কালো— না, ঠিক কালো নয়, ঘন কালচে নীল রঙের জবা ফুল ফুটে আছে! এটা কী করে সম্ভব! বিস্ময়ে তাঁর মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার দশা! কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিলেন। তা হলে কি টর্চেরই কেরামতি! তবে কি কালীচরণ জালি জিনিস গছিয়ে যায়নি? গিন্নিকে ডেকে দেখাবেন কি? না, সেটা বোধ হয় ঠিক হবে না। আহাম্মকি হবে। কিন্তু তিনি কি ঠিক দেখছেন? চোখের ভুল নয় তো!

উত্তেজনায় বুক ঢিপঢিপ করছে বলে তিনি বারান্দার সিঁড়িতে বসে একটু দম নিলেন ভাল করে। এই বয়সে যে কোনও রকম উত্তেজনাই বিপজ্জনক। বসে-বসেই অনুলোম, বিলোম, আর কপালভাতি করে নিজেকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁর এক বার দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে, এই কাণ্ড ওই টর্চের জন্যই হয়েছে। আবার দুর্বল মন ফিসফিস করে বলছে, এটা কাকতালীয়ও তো হতে পারে হে! তুমি না এক জন যুক্তিবাদী বিজ্ঞানী! এই রকম কোনও টর্চবাতি আবিষ্কার হয়ে থাকলে তা কি আর তোমার অজানা থাকত!

এই দোটানাই তাঁর নিয়তি। তাঁর এক হাত ধরে ‘হেঁইয়ো মারি’ বলে টান লাগাচ্ছে বিশ্বাস, আর অন্য হাত ধরে ‘জোর লাগাকে হ্যাঁইসা’ বলে টান মারছে যুক্তি ও বিজ্ঞান। তাই এই সকালবেলায় তাঁর দমসম অবস্থা। এমন সময়ে কে যেন খুব কাছ থেকে বলে উঠল, “মেসোমশাইয়ের কি শরীরটা খারাপ?”

গজপতি আঁতকে উঠে বললেন, “কে? কে আপনি?”

“আমি গোপাল। বড্ড লাতন হয়ে পড়েছেন যে!”

গোপাল তাঁদের বাড়ির কাজের লোক, হালে কাজে লেগেছে। ছোকরা খুবই চালাক। গজপতি আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেননি, গোপাল কার পক্ষে, তাঁর না তাঁর গিন্নির!

একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ছেড়ে গজপতি বললেন, “অ, গোপাল! তা বাপু রে, আমি ভুল দেখেছি কি না তা বুঝতে পারছি না, তুই একটু দ্যাখ তো, ওই জবা গাছটায় কি কোনও ফুল ফুটেছে? নাকি আমারই চোখের ভুল!”

জবা গাছটার কথা বাড়ির সবাই জানে। গোপাল গিয়ে জবা গাছটা খুব মন দিয়ে নিরীক্ষণ করে বলে, “না মেসোমশাই, ভুল দেখবেন কেন? এ তো ফুল বলেই মনে হচ্ছে! তিন-তিনটে কেলেকুষ্টি অলক্ষুনে জবাফুল! এরকম কুচ্ছিত জবাফুল জন্মে দেখিনি মশাই! এই ফুল দিয়ে মা কালীর পুজো করলে ঘোর অকল্যাণ হবে যে!”

গজপতি ফের আঁতকে উঠলেন। তাঁর স্ত্রী সুচরিতা দেবী বেজায় কালীভক্ত, রোজই মা কালীর পটে জবা ফুল দিয়ে পুজোটুজো করেন। গজপতি বাঘা গলায় বললেন, “খবরদার! ওই ফুল পুজোর জন্য নয়! ফুল ছিঁড়লে কিন্তু কেটে ফেলব!”

গোপাল খুব অমায়িক গলায় বলে, “না মেসোমশাই, নিশ্চিন্তে থাকুন, এই ফুল কেউ পুজোর জন্য তুলবে না। শুধু কুচ্ছিতই নয়, কালো ফুলগুলো থেকে কেমন যেন পচা গোবরের গন্ধও আসছে। এই ফুল দিয়ে কি মা কালীর পুজো হয়? হলে দেশে মহামারি লাগবে, আকাল আসবে, দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে এমনকি, ভূমিকম্পও হতে পারে। মা কালী যা রাগী মানুষ, অনাসৃষ্টি একদম সইতে পারেন না।”

গজপতি একটা সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, “ওই ফুলের মর্ম বুঝবার মতো বিদ্যে তোর পেটে নেই। এখন নিজের কাজে যা তো বাপু!”

“তা না হয় যাচ্ছি। কিন্তু মেসোমশাই, একটা কথা তো মানবেন।”

“কী কথা?”

“জবা গাছে লাল জবা ফুল ফোটাই ভগবানের নিয়ম, আপনি খোঁচাখুঁচি করে ওই কেনেকুটি ফুলগুলো আমদানি করে কি ভাল করলেন। আমার ওপর খোদকারি করা ব্যাপারটা মাসিমাকে বলতেই হচ্ছে। তিনি শুনলে বোধ হয় গাছটাই শেক উপড়ে ফেলবেন।

কথাটা কানে যেতেই গজপতি বেরে উঠে বললেন, “ওরে, ত কাজও করিসনি, আমার এত সাধনা, এত চেষ্টা, এত তিতিক্ষা, গবেষণা সব যে বিফলে যাবে।”

গোপাল একটু গা ঝাড়া দিয়ে নির্বিকার গলায় বলে, “তা কী কর বলুন, মাসিমাকে না বললে যে নেমকহারামি হবে। মাসি বলে ডাকলেও তিনি আমার মায়ের মতো। মাসিমা আমাকে চার দিকে নজর রাখতে বলেছেন। বিশেষ করে বলেছেন, আপনি কী করেন না করেন তা যেন খেয়াল রাখি।”

গজপতি ভারী অমায়িক হয়ে গদগদ গলায় বললেন, “ওরে, তোর মাসিমা তো আর সায়েন্স জানেন না, এই ফুলের মর্ম তো তাঁর বুঝাবার কথা নয়।”

“তা হলে সেই কথাটাই তাঁকে গিয়ে বলি। মাসিমা, আপনি তো আর সায়েন্স জানেন না, লেখাপড়া তো আর করেননি, কী করেই বা বুঝবেন। তাই মেসোমশাই বলছিলেন…”

“ওরে বাপু, তুই তো বেজায় ঘড়েল লোক দেখছি। তা তোকে বরং কুড়িটা টাকা দিচ্ছি, খবরদার, জবাফুলের কথা তোর মাসিমার সামনে উচ্চারণও করবি না।”

গোপাল মাথা চুলকে বলে, “কুড়ি টাকায় আজকাল কী হয় বলুন। হরিপদর দোকানে একটা ফাউল কাটলেটের দামই পঁচিশ টাকা।”

“ঠিক আছে, না হয় তিরিশ টাকাই পাবি।”

“সে না হয় আজকের দিনটার জন্য হল, কিন্তু কালকের জন্য কি ব্যবস্থা করছেন?”

গজপতি মহা মুশকিলে পড়ে বললেন, “তোকে যা ভেবেছিলাম, তুই তো দেখছি তার চেয়েও বেশি ঘড়েলা”

“মেসোমশাই, টাকা-পয়সার কথা তো আপনিই তুললেন, আমি তো টাকার ট-ও উচ্চারণও করিনি। আর সত্যি কথা বলতে কী, ঘুষ দেওয়াটা কিন্তু ঘুষ নেওয়ার মতোই অন্যায়।”

গজপতি টালমালু হয়ে গোপালের দিকে চেয়ে বললেন, “একে কী বলে জানিস? একে বলে ব্ল্যাকমেল। আর ব্ল্যাকমেল করলে পুলিশে ধরে।”

গোপাল কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “তা হলে ঝুটঝামেলার দরকার নেই মেসোমশাই, আমি বরং মাসিমার কাছে কথাটা নিবেদন করে আসি। আপনি যে টাকা দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন সে কথাটাও বলব কি?”

গজপতি আঁতকে উঠে বললেন, “দাঁড়া বাপু, দাঁড়া। আমি কি বলেছি যে তোকে সত্যি সত্যিই পুলিশে দেব?”

“তাই তো বললেন মেসোমশাই।”

“ওরে না রে, না! ঠাট্টা করে বলছিলাম আর কী। সব কথা অত সিরিয়াসলি নিলে কি হয়? তা হলে ওই কথাই রইল।”

“যে আজ্ঞে। দিনপ্রতি তিরিশ টাকা।”

গোপাল বিদেয় হলে গজপতি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন, চার দিকে এত বিপদ, এত বাদা, এত বিরুদ্ধতা যে, জীবনটার উপর ঘেন্না ধরে যাচ্ছে। তাঁর উপর নজর রাখার জন্য যে গোপালকে লাগানো হয়েছে এটাই তো তাঁর জানা ছিল না। কী সব্বোনেশে ব্যাপারা নিজের বাড়িতে যে আপন মনে ইচ্ছে মতো বসবাস করবেন, তারও উপায় রইল না! মুশকিল হল, তাঁর নানা রকম মুদ্রাদোষ আছে, যেমন তিনি ভাববার সময় হাঁ করে ভাবেন, বিড়বিড় করে আপন মনে কথা কন, নানা অঙ্গভঙ্গি করে হরিধনের সঙ্গে ঝগড়াও করেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই হরিধন লোকটা কে! কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব গজপতির জানা নেই। কারণ হরিধন বলে গজপতির জীবনে বাস্তবে কেউ নেই বটে, কিন্তু নানা বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং ঝগড়া করার জন্য তিনি হরিধন নামে একজন মানুষকে মাঝে-মাঝে মনে-মনে খাড়া করে নেন। হরিধন একজন রোখাচোখা, সবজান্তা,জাঁদরেল লোক। সে প্রায়েই গজপতির নানা ভুল ধরতে আসে এবং দু’জনে ধুন্ধুমার ঝগড়া লেগে যায়। তবে শেষ পর্য্যন্ত হরিধনকে রোজই গজপতির কাছে হার স্বীকার করতে হয়। আর এই ঝগড়াটা গজপতির কাছে খুবই উপভোগ্য ব্যাপার। কারণ বাস্তব জীবনে তিনি প্রায় কারও সঙ্গেই বা বিতর্কে এঁটে উঠতে পারেন না, লেজেগোবরে হয়ে হেরে যান। তাই নিরাকার হরিধনকে হারিয়ে তার শোধ তোলেন। এখন এসব তো গোপালের মারফত প্রকাশ হয়ে পড়বে! সুচরিতা দেবী এমনিতেই সন্দেহ করেন যে, গজপতির মাথার দোষ আছে, এখন তো সেই ধারনায় সিলমোহর পড়ে যাবে।

তা হলে কি গোপালের টাকাটা আরও একটু বাড়িয়ে দেবেন, যাতে তাঁর উপর তেমন কড়া নজর না রাখে! তাতে খরচাটা অনেক বেড়ে যাবে! আর গোপাল যা ঘড়েল, সুযোগ বুঝে দর বাড়িয়ে না ফেলে! নাহ, বেঁচে থাকাটায় আর কোনও সুখ নেই। গজপতি ঘনঘন কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

গজপতির ধারণা, পৃথিবীতে যে কয়েকটা নরক আছে তার মধ্যে একটা হল বাজার। বাজারের মতো খারাপ জায়গা কমই আছে। বাজারে যাওয়ার নামেই গজপতির গায়ে জ্বর আসে। ভালমানুষ পেয়ে দোকানিরা তাঁকে চিলুবিলু করে হেঁকে ধরে। হাত ধরে টানাটানি, হাঁকাহাঁকি, সাধাসাদি, তার পর খুব আদর করে, স্নেহের সঙ্গে পোকা বেগুন, পাকা ঢেঁড়স, বুড়ো লাউ, পচা মাছ গছিয়েই ছাড়ে। এবং প্রায়ই শোনা যায় যে, পাশের বাড়ির মন্মথবাবু অনেক সরেস জিনিস তাঁর চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে কিনে এনেছেন। ফলে বাজার করে আসার পর অন্তত ঘণ্টাখানেক তাঁকে সুচরিতা দেবীর কটুকাটব্য শুনতে হয়। শুনে শুনে তাঁর আত্মধিক্কার আসে, কান্না পায় এবং কোনও কোনও দিন আত্মহত্যা করার ইচ্ছেও জাগে।

তবে ইদানীং সুচরিতা দেবীর হুকুমে তাঁর সঙ্গে বাজার করতে গোপালকেও লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুচরিতা দেবীর ধারণা, গোপাল গজপতির চেয়ে অনেক চালাকচতুর, চারচোখো, হিসেবি, দরাদরি করতে পারে এবং ভাল-মন্দ চেনে। গোপালের এসব গুণ যে নির্যস আছে তাতে গজপতির সন্দেহ নেই। এই তো সেদিন ফুলকপি কেনার সময় দুটো ফুলকপির দাম পঞ্চাশ টাকা থেকে লহমায় তিরিশ টাকায় নামিয়ে আনল গোপাল। আশ্চর্য তার বাকপটুত্ব, বিস্ময়কর তার মানুষকে পটিয়ে ফেলার ক্ষমতা, গভীর তার মনুষ্যচরিত্র স্টাডি করার অভিজ্ঞতা। গজপতি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন, আর তাঁর এই সব গুণ নেই বলে মনে মনে আফসোস করছিলেন। দুনিয়ায় কত চালাকচতুর মানুষ আছে ভেবে আনন্দে চোখে জল এসে গিয়েছিল গজপতির। তাই রুমালে চোখ মুছতে মুছতে। দেওয়ার জন্য একশো টাকার একখানা নোট বের করে দিলেন। গোপাল দাম মিটিয়ে বিনীত ভাবে তাঁকে কুড়িটা টাকা ফেরত দিল। তিনি অবাক হয়ে বললেন, “তোকে একশো টাকার নোট দিলুম যে! হিসেব মতো তোর তো সত্তর টাকা ফেরত দেওয়ার কথা।”

গোপাল আকাশ থেকে পড়ে বলল, “সে কী মেসোমশাই, আপনার কি ভীমরতি হল? আপনি তো জলজ্যান্ত একখানা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছেন। বিশ্বাস না হয় দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।”

গজপতির মুশকিল হল, তাঁর আত্মবিশ্বাস নেই। তাঁর মাথা বলছে, তিনি একশো টাকার নোটই গোপালকে দিয়েছেন, আবার বিবেক বলছে, কী জানি বাবা, আমারই হয়তো মনের ভুল! বিবেক এবং বুদ্ধির এই টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে পড়ে তাঁর মাথা গুলিয়ে গেল। সুতরাং হার স্বীকার না করে উপায় কী। কিন্তু এভাবেই মাছের বাজারে পাঁচশো টাকার নোট, রুমাল থেকে বেড়াল হয়ে যাওয়ার মতো, একশো টাকার নোটে পরিণত হল। কড়াইশুঁটি কেনার সময় পঞ্চাশ টাকার নোট জাদুমন্ত্রবলে চোখের পলক না ফেলতেই ফস করে হয়ে গেল দশ টাকা। লঙ্কা কেনার সময় দশ টাকার কয়েন হয়ে গেল পাঁচ টাকার মুদ্রা। বাড়িতে এলে অবশ্য শোরগোল পড়ে গেল সরেস বাজার হয়েছে বলে। সুচরিতা দেবী তো ধন্যি-ধন্যি করতে লাগলেন, তার পর তাঁকে লক্ষ করে আঁশটে মুখে বললেন, “গোপালকে দেখে তোমার শেখা উচিত! দেখো কী টাটকা সব সব্জি, আর কী ভাল তরতাজা মাছ, আর দামেও কত সস্তা! তুমি তো বাজারে যাও টাকার হরির লুট করতে!”

কিন্তু গজপতির পকেট থেকে যে ডবল টাকা খসে গেছে সেটা সুচরিতা দেবীকে যে বলবেন, তা তাঁর মুরোদে কুলোল না।

সেই থেকে আজ পর্যন্ত একই ব্যবস্থা চলছে, গজপতিকে গোপালের সঙ্গেই বাজারে যেতে হয়, গোপালের হাতসাফাই সয়ে নিতে হয় এবং লোকসান না মেনে নিয়ে উপায়ও থাকে না। না, জীবনে সুখ বলে আর কিছুই নেই গজপতির। কারও সঙ্গেই তিনি এঁটে উঠতে পারছেন না। এখন বন্ধু বলতে তাঁর বাগানের গাছপালা।

ভোর ছ’টায় উঠে গজপতি দেখলেন আজ ঘন কুয়াশায় বড্ড অন্ধকার হয়ে আছে চার দিক। আজ তাঁর কলমের গোলাপ গাছের উপর এক্সপেরিমেন্ট করার কথা। কালীচরণের দেওয়া টর্চটা বাগিয়ে তিনি সন্তর্পণে বেরোলেন। গায়ে যথারীতি মোটা পুলওভার, মাথায় বাঁদুরে টুপি, গলায় কমফর্টার, পায়ে উলের মোজা এবং জুতো। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে ঘন কুয়াশায় কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। জন্মে এমন ঘন আর নিরেট কুয়াশা দেখেননি তিনি। অভ্যাসবশে এক বার হাতের টর্চটার সুইচ টিপলেন। কোনও আলো হল না, কিন্তু খচ করে হঠাৎ কুয়াশার গায়ে যেন একটা ছ্যাঁদা হয়ে গেল। লম্বা আর সরু একটা সুড়ঙ্গ যেন। গজপতি প্রথমটায় চমকে উঠলেন, তার পর ভারী অবাক হয়ে সুড়ঙ্গটা দেখতে লাগলেন! তা হলে কি টর্চটা কুয়াশা কাটিয়ে দিতে পারে? তিনি টর্চটা ফের জ্বেলে এ-দিক ও-দিক ফেলতেই কুয়াশায় নানা রকম নকশা তৈরি হতে লাগল। যেন টর্চের রশ্মি যেখানে-যেখানে পড়ছে সেই সব জায়গার কুয়াশা কেউ ইরেজ়ার দিয়ে মুছে দিচ্ছে। গজপতির বুক ফের ধড়ফড় করতে লাগল, মাথা ঝিমঝিম, হাত-পায়ে যেন বশ নেই! কিছু ক্ষণ বজ্রাহত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর তাঁর ভিতরকার বিজ্ঞানী যেন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘যা দেখছ তা বিশ্বাস কোরো না হে! এগুলো কিছুই কিন্তু ঘটছে না। তুমি স্বপ্ন দেখছ।’

ভিতরের গজপতির কথায় বাইরের গজপতি একটু সাহস পেয়ে অন্য দিকে টর্চের মুখ ঘুরিয়ে কুয়াশার গায়ে একটা ইকুয়েশন কষলেন। ইকুয়েশনটা দিব্যি ভেসে রইল। তার পর বাংলায় নিজের নাম লিখলেন, ‘গজপতি’, সেটাও দিব্যি কুয়াশার গায়ে সেঁটে রইল। এবারে একটু কাটাকুটিও খেলে নিলেন, কোনও অসুবিধে হল না। কাণ্ড দেখে গজপতি যেমন হতবাক, তেমনি হতবুদ্ধি! তিনি যত দূর জানেন, কুয়াশা কাটিয়ে দিতে পারে এমন যন্ত্র এখনও আবিষ্কার হয়নি। তা হলে এই যন্ত্রটা এল কোথা থেকে? তবে কি কালীচরণ এক জন ছদ্মবেশী বিজ্ঞানী! তা-ই বা হয় কী করে? গজপতি এবার পুব দিকে তাক করে টর্চটা টিপে একটু ধরে রইলেন। তার পর যা কাণ্ড হল কহতব্য নয়। পুব দিগন্ত থেকে একটা টানেলের মতো সুড়ঙ্গপথ বেয়ে সোনালি রোদ এসে পড়ল তাঁর বাগানে। অথচ বাকি জায়গাটায় জমাট কুয়াশা আর অন্ধকার। রোদটাকে মনে হচ্ছে যেন অন্ধকারে একটা সার্চলাইটের আলো এসে পড়েছে।

সবিস্ময়ে টর্চটার দিকে চেয়ে রইলেন গজপতি। এ তো সাংঘাতিক জিনিস! তিনি স্বপ্ন দেখছেন কি না তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না, কিন্তু তিনি বোধ হয় আলাদিনের পিদিমের মতোই কিছু একটা পেয়ে গেছেন। লোক জানাজানি হলে ঘোর বিপদ। তিনি টক করে টর্চটা পুলওভারের ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন। তার পর তাড়াতাড়ি উঠে কুয়াশার গায়ে যেসব আঁকিবুকি কেটেছিলেন সেগুলো হাত দিয়ে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কেউ দেখে ফেললে সন্দিহান হয়ে উঠতে কত ক্ষণ? তা হলে তো সর্বনাশ!

কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। হঠাৎ কে যেন খুব কাছ থেকে, প্রায় তাঁর কানে কানে বলে উঠল, “মেসোমশাইয়ের কি মৃগী রোগ আছে নাকি! নাকি সিরাজদ্দৌলার ভূমিকা প্লে করছেন! অমন পাগলের মতো হাত পা ছুড়ছেন কেন?”

গজপতি ফাঁপরে পড়ে বললেন, “ওরে না না, এই মশা তাড়াচ্ছি আর কী!”

গোপাল নরম গলাতেই বলে, “গায়ে যা গন্ধমাদন চাপিয়েছেন তাতে মশা কী করে হুল দেবে বলুন তো! আর এ বাড়িতে তেমন মশামাছি আজকাল কোথায়! কয়েক দিন হল কেউ তো মশারিই টাঙিয়ে শুচ্ছে না। মাসিমাও সেদিন দুঃখ করে বলছিলেন, ‘গেরস্থবাড়িতে মশা-মাছি থাকাটাই রেওয়াজ, কিন্তু কী অলক্ষুনে কাণ্ড বাপু, আজকাল একটাও মশা বা মাছি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না!”

গজপতি অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে উঠে মনের ভুলে বলে ফেললেন, “হুইসল! হুইস্‌ল! এ হল হুইস্‌লের কাণ্ড!”

গোপাল হাঁ করে কিছু ক্ষণ তাঁর দিকে চেয়ে থেকে বলে, “মেসোমশাইয়ের কি মাথার দোষ হল, নাকি বায়ু চড়েছে! হঠাৎ হুইস্‌লের কথা আসছে কোত্থেকে!”

গজপতি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “না রে, ওই একটা পুরনো কথা মনে পড়ল কিনা!”

“কী পুরনো কথা, শুনি।”

গজপতি মহা ফাঁপরে পড়লেন। বানিয়েছানিয়ে যে একটা গপ্পো ফাঁদবেন তেমন এলেমও তাঁর নেই। আমতা-আমতা করে বললেন, “আমার ঘোতনমামার একটা হুইস্‌স্ল ছিল, সেটা বাজিয়ে তিনি মশামাছি তাড়াতেন, সেই কথাটা মনে পড়ে গেল কিনা!”

“আপনার ঘোতনমামার কি মাথার দোষ ছিল?” “ও কথা কেন বলছিস?”

“মনে হয় আপনি আপনার মাথার গন্ডগোলটা নির্যস ওই ঘোতনমামার কাছ থেকেই পেয়েছেন। নরানাং মাতুলক্রম।”

গজপতি অপমানটা গায়ে মাখলেন না। হুইস্‌লের কথাটা যে ফাঁস হয়নি এটাই যথেষ্ট। তার বদলে একটু অপমান তো আর বেশি কিছু নয়! তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন। তা ছাড়া তাঁর নিজেরও ধারণা যে, তাঁর মাথায় একটু গন্ডগোল আছে।

সন্ধেবেলা প্রায় রোজই গজপতি সুরেশ নন্দীর বাড়িতে একটু দাবা খেলতে যান। দাবা যে তিনি ভাল খেলেন তা মোটেই নয়। গভীর অন্যমনস্কতার দরুন প্রায়ই ভুল চাল দিয়ে ফেলেন এবং গোহারা হারেন। আজও সুরেশবাবুর একটা বোড়ে ঘোড়া দিয়ে খেয়ে ফেলায় তাঁর মন্ত্রী সুরেশের গজের মুখে পড়ে গেছে। মন্ত্রী বাঁচাতে গেলে তাঁর একটা ঘোড়া বেমালুম মারা পড়ে। গজপতি বেরোনোর রাস্তা পাচ্ছেন না।

সুরেশবাবু তাচ্ছিল্যের গলায় বলেন, “অত ভাবছ কী? ওই ঘোড়াটা তোমার গেছে বলেই নাও।”

কাঁচুমাচু হয়ে গজপতি বলেন, “তোমার বোড়েটা পাকা ফলের মতো এমন টুসটুসে দেখাচ্ছিল যে আমি লোভ সামলাতে পারিনি!”

“লোভ দেখানোর জন্যেই তো চালটা দিয়েছিলাম হে! তুমি ফাঁদে পা দিলে কেন?”

গজপতি বুঝলেন, আর আশা নেই, চার-পাঁচ চালের মধ্যেই তিনি মাত হবেন। হাল ছেড়ে দিয়ে তিনি বললেন, “দাবা আবার একটা খেলা! অকারণে মাথার ট্যাক্সেশন। তার চেয়ে বরং লুডো খেলা ভাল।”

সুরেশবাবু প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, লম্বা-চওড়া চেহারা, দারুণ ফুর্তিবাজ, প্রচণ্ড খাইয়ে মানুষ, আর খুব বুদ্ধিমান। তাঁর দিকে একটু তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে বললেন, “লুডো হল চান্স অ্যান্ড প্রবাবিলিটির খেলা, দান পড়লে ভাল নইলে ফক্কা। আর দাবা খেলতে বুদ্ধি লাগে, দূরদৃষ্টির দরকার হয়, ক্যালকুলেশন আর ইম্যাজিনেশন দুটোরই প্রয়োজন, যেগুলো তোমার নেই। আর একটা কথা…”

গজপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “কী কথা?”

“আমার বিশ্বাস লুডোতেও তোমার মতো দিনকানা-রাতকানা লোক একটা বাচ্চা মেয়ের কাছেও হেরে যাবে।”

গজপতি কথাটা শুনে খুবই অবাক হলেন। কারণ মাত্র দু’দিন আগে সত্যিই তিনি তাঁর নাতনি মিতুলের কাছে লুডোয় পর পর দু’দান হেরেছেন। আমতা আমতা করে বললেন, “তুমি কী করে জানলে!”

“সিম্পল ডিডাকশন হে গজপতি।”

গজপতি একটু লজ্জিত হয়ে বললেন, “আমি একটু অন্যমনস্ক লোক বলে একটুআধটু ভুলচুক হয়ে যায় ঠিকই, তা বলে আমি তো আর বোকা নই!”

“শুধু বোকাই নও, তোমার গিন্নির তো ধারণা, তুমি একটু পাগলও। নইলে একটা ফেরেববাজ ফেরিওয়ালা তোমাকে আবোলতাবোল জিনিস গছিয়ে দিয়ে যায়! শুনলুম তার কাছ থেকে তুমি নাকি একটা হুইল কিনেছ যাতে কোনও শব্দ হয় না, আবার একটা টর্চও নাকি গছিয়ে গেছে যেটায় আলো জ্বলে না! তোমার গিন্নি আমার গিন্নির কাছে দুঃখ করে সব বলে গেছেন।”

গজপতি এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, “দেখো সুরেশ, মানছি তুমি দাবাটা ভালই খেলো, হয়তো লুডোটাও তুমি খারাপ খেলবে না, কিন্তু তা বলে তুমি তো আর সবজান্তা নও!”

“এতে জানাজানির আছেটা কী? তোমাকে আহাম্মক পেয়ে লোকটা দুটো জালি জিনিস গছিয়ে গেছে, এই তো ব্যাপার! আমি লোকাল থানার ওসিকে বলে দিয়েছি, লোকটাকে দেখতে পেলেই যেন পাকড়াও করে লকআপে ভরে দেয়।”

“সর্বনাশ! করেছ কী! লোকটা আমাকে মোটেই ঠকায়নি! ওগুলো খুবই কাজের জিনিস।”

সুরেশ ব্যঙ্গের গলায় বলেন, “আমরা যারা সাধারণ বুদ্ধির মানুষ তারা জানি যে হুইস্‌ল বাজালে শব্দ হয় আর টর্চ জ্বালালে আলো হয়। আর তাই যদি না হয় তা হলে ওগুলো কাজের জিনিস হল কী করে?”

“ও তুমি ঠিক বুঝবে না। অনেক ব্যাপার আছে।”

“কী ব্যাপার আছে বলো তো! তোমাকে কি আরও বড়সড় কোনও ধাপ্পা দিয়ে জিনিসগুলো গছিয়ে গেছে?”

“আরে গজপতি খুব আহ্লাদী একটা হাসি হেসে মাথা নেড়ে বলেন, না না, একটু মিস্টিরিয়াস হলেও সে লোক খারাপ নয়।”

সুরেশ টান হয়ে বসে কঠিন স্বরে বলেন, “মিস্টিরিয়াস! তা হলে তো ডেঞ্জারাস ব্যাপার। তুমি কোনও স্মাগলার বা টেররিস্টের পাল্লায় পড়োনি তো!”

গজপতি মাথা নেড়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, “আরে না! তোমাদের পুলিশের লোকরা বড্ড সন্দেহবাতিক! কালীচরণ সেরকম মিস্টিরিয়াস নয়। তাকে মিস্টিরিয়াস কেন বলছি জানো?”

“কেন বলছ?”

“বলছি, কারণ এই বাঘা শীতেও সে একটা ফতুয়া পরে ঘুরে বেড়ায়, গায়ে গরম জামা দেয় না।”

“এদেশে অনেকের গরম জামা জোটে না বলে দেয় না, এতে মিস্টিরিয়াস কী আছে?”

“মিস্টিরিয়াস এই কারণে যে, আমি তাকে একটা পুলওভার দিতে চেয়েছিলাম, সে নেয়নি।”

সুরেশবাবু ভুরু কুঁচকে গজপতির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, “আমার সন্দেহ হচ্ছে, তুমি কিছু চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছ কিংবা কথা ঘোরাচ্ছ! কিন্তু পেরে উঠছ না। তোমাকে বেশ নার্ভাসও দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা কী, তা খুলে বলবে! মনে রেখো আমি কিন্তু পুলিশের লোক, রিটায়ার করলেও পুলিশের ট্রেনিং তো আর যায়নি।”

গজপতির হঠাৎ বেশ হাঁসফাঁস লাগছিল। এই প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও তাঁর যেন একটু ঘাম হচ্ছে! কোনও পরিস্থিতিই তিনি ঠিক সামে উঠতে পারেন না। সেই লেজেগোবরেই হতে হয়। একটু কপালভাতি বা অনুলোম বিলোম করতে পারলেও হত, কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূল নয়। কী করবেন বুঝতে না পেরে তিনি গলাটা নামিয়ে খুব চাপা গলায় বললেন, “একটা কথা বলবে? তুমি তো আমার পাশের বাড়িতেই থাকো। গত দু’দিন তুমি তোমার বাড়িতে কোনও মশা বা মাছি দেখতে পেয়েছ?”

সুরেশবাবু কিছু ক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “মশা-মাছি হঠাৎ মশা-মাছির কথা কেন?”

“না, এই বলছিলাম আর কী। আশ্চর্যের বিষয় কী জানো, আমাদের বাড়িতে গত দু’-তিন দিন কোনও মশা-মাছি দেখা যাচ্ছে না।”

সুরেশবাবু গম্ভীর এবং চিন্তিত হয়ে গজপতির দিকে অনেক ক্ষণ চেয়ে রইলেন, তার পর অত্যন্ত সমবেদনার গলায় বললেন, “শুনেছি তোমার বাড়িতে আজ ফুলকপি আর কড়াইশুঁটি দিয়ে সোনামুগ ডালের খিচুড়ি হয়েছে, সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা। তুমি বরং এখন বাড়ি যাও, গিয়ে মাথায় আর চোখে-মুখে ভাল করে ঠান্ডা জল থাবড়াও, তার পর পেট ভরে গরম-গরম খিচুড়ি খেয়ে টেনে ঘুম লাগাও। তোমার বায়ু চড়েছে।”

গজপতি তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললেন, “ওই দ্যাখো, আমার বাড়িতে খিচুড়ি হয়েছে আর সে খবর আমিই জানি না! কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!”

রাস্তায় বেরিয়ে গজপতি দেখলেন, নিরেট দেওয়ালের মতো ঘন কুয়াশা, সামনে বা আশপাশে কিছু দেখার উপায় নেই। তবে চেনা রাস্তা বলে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। কয়েক পা হাঁটতেই তাঁর সঙ্গ নিল হরিধন।

ফ্যাঁচ করে একটু হেসে বলল, “আর একটু হলেই তো সুরেশের কাছে নাস্তানাবুদ হতে বাপু! কপাল ভাল যে সুরেশ দয়া করে তোমাকে রেহাই দিয়েছে। নইলে নাকের জলে চোখের জলে করে ছাড়ত! বহু আহাম্মক দেখেছি, কিন্তু তোমার মতো আর এক পিসও বোধ হয় নেই!”

“বেশি বোকো না, পৃথিবীতে অন্যমনস্ক মানুষের অভাব নেই।”

“তা নেই, তবে তোমার মতো আহাম্মক, বুদ্ধিভ্রষ্ট, অপ্রতিভ এবং ডরপোক আর আছে কিনা সন্দেহ। মশা-মাছির কথাটা বলতে গেলে কেন?”

“মুখ ফস্কে বেরিয়ে গিয়েছিল।”

হরিধন আজ তর্কের মুডে নেই। হঠাৎ খুব সহানুভূতির সঙ্গে বলল, “শোনো গজপতি, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। সুরেশ কিছু আন্দাজ করতে পারেনি। তবু তোমাকে বলি, এখন থেকে একটু সাবালক হও। জিনিয়াসদের মাথা আর পাঁচটা মানুষের মতো নয়, অ্যাভারেজ মানুষ যে রকম ভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তারা সেই ভাবে করে না, তাই তারা একটু অন্য রকম। সেই জন্যই অনেক সময় মানুষ তাদের পাগল বা ছিটিয়াল বলে মনে করে।”

“তার মানে, তুমি কি বলতে চাও যে আমি এক জন জিনিয়াস?”

“হয়তো বড় মাপের জিনিয়াস নও, কিন্তু তোমার একটা ডেডিকেশন ছিল। যারা বেশি চিন্তা-ভাবনা করে এবং নতুন কিছু ভাবে, তাদের বাস্তব আচরণ অনেক সময় স্বাভাবিক মানুষের মতো না-ও হতে পারে। তার মানেই তো আর সে পাগল নয়! আমি যত দূর জানি তুমি পাগলটাগল নও। তা হলে আর্কিমিডিস, নিউটন, গ্যালিলিও, শেক্সপিয়র, কার্ল মার্ক্স, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ সবাই পাগল।”

গজপতি হতাশ হয়ে বলেন, “ওরে বাবা! আমি তো ওঁদের ধারেকাছেও নই!”

‘‘তা নও, তবে তুমি তোমার মতো করে দুনিয়ার একটা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিলে। পলিউশন ম্যানেজমেন্ট। কাজ অনেকটা এগিয়েওছিল। কিন্তু কিছু লোক আগেভাগে পেটেন্ট কিনে নেওয়ার জন্য তোমার ওপর চড়াও হয়েছিল বলে তুমি ভয় পেয়ে কাজটা থেকে সরে এসেছিলে। ঠিক বলছি তো!”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গজপতি বলেন, “কী করব বলো! আমি যে বেজায় ভিতু মানুষ! তিন-তিনটে পার্টি পেটেন্ট কিনতে চেয়েছিল। প্রত্যেকেই হুমকি দিত, অন্য দু’জনের কাউকে দিলে জানে মেরে দেবে। অনেক টাকার অফার ছিল। কিন্তু প্রাণেই যদি না বাঁচি তা হলে টাকা দিয়ে কী করব বলো।”

“ঠিক কথা। তবে সুরেশ নন্দী তখন তোমাকে পুলিশ প্রোটেকশন দিতে চেয়েছিল, তুমি নাওনি। ওই তিনটে পার্টিকে অ্যারেস্ট করতেও চেয়েছিল, তুমিই ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলে।”

গজপতি একটু লজ্জিত মুখে বলেন, ওরা যে ষণ্ডাগুন্ডা মানুষ! সুপারি কিলার লাগিয়ে মেরে দিলে পুলিশ কী করবে বলো! পুলিশ তো আর সর্বশক্তিমান নয়!”

হরিধন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, “কিন্তু তার ফলে তোমার কাজটা তো শেষ হল না! শেষ হলে হয়তো পৃথিবীর একটা মস্ত উপকার হত!”

গজপতি করুণ মুখ করে বলেন, “তা জানি না। আমি পারিনি বটে, কিন্তু পলিউশন নিয়ে গবেষ তো গোটা পৃথিবী জুড়েই চলছে। এক দিন না এক দিন কেউ না কেউ কোনও না কোনও একটা সমাধান নিশ্চয়ই বের করে ফেলবে।”

হরিধন গম্ভীর গলায় বলে, “এখন ওটাই যা তোমার সান্ত্বনা।”

গজপতি গোমড়া মুখে হাঁটতে লাগলেন। নিজেকে নিয়ে তাঁর যে কত মুশকিল!