এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা – ১

।।১।।

সন্ধে ঠিক সাতটা পনেরো মিনিটে জিম থেকে বেরোল শ্যাডো। শ্যাডো সেনগুপ্ত। পরনে ফেডেড জিন্‌স, গায়ে একটা হ্যান্ডলুমের ধূসররঙা হাতকাটা কুর্তা, পায়ে সাদা এবং ময়লা স্নিকার্স, কাঁধ থেকে একটা কিটব্যাগ ঝুলছে। সে বেশ অনেকটাই লম্বা, ছমছমে শরীর, মেদহীন। ডান দিকে ঘুরে সে একটু উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটছিল। আসলে এখন তার বিশেষ কোথাও যাওয়ার নেই, তেমন কিছু করারও নেই। এরকম অবস্থায় তার সবচেয়ে প্রিয় পাসটাইম হল চেনা-অচেনা রাস্তায় হেঁটে-হেঁটে বেড়ানো। তার এখন একটু খিদে পেয়েছে, পকেটে যা পয়সা আছে তাতে ফুটপাতের জাঙ্ক ফুড হয়ে যেতে পারে, কিন্তু সে জাঙ্ক ফুড কদাচ খায় না। সুতরাং খিদেটাকে উপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। আর এটা সে ভালই পারে।

সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায় রোড থেকে সে নিউ মার্কেটের দিকে ঘুরল। নিউ মার্কেটে ঘুরে বেড়াতে তার খারাপ লাগে না। কিছু কেনাকাটা করার নেই তার, কোনও জিনিসের প্রতিই তার তেমন কোনও আগ্রহও নেই। কিন্তু দেখে বেড়াতে তার মন্দ লাগে না। সময়টাও কেটে যায়। লোকে কেনাকাটা করে এবং তা থেকে আনন্দও পায়, এটা দেখতে তার ভালই লাগে।

জিম করার পর প্রচুর ঘাম হয়। তোয়ালে দিয়ে মুছলেও ঘামের চটচটে ভাবটা যায় না। একটু স্নান করতে পারলে হত, কিন্তু এই জিমটায় স্নানের ব্যবস্থা নেই। তবে এখন শীতের মরসুম বলে ততটা অসুবিধে হচ্ছে না।

ফুটপাতে হাঁটার উপায় নেই, দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসে গেছে। তাদের মধ্যে একটা লোক প্লাস্টিক শিটের উপর কিছু টুলস সাজিয়ে বসেছে। স্ক্রু ড্রাইভার, প্লাস, রেঞ্চ, টেস্টার, প্লায়ার, হাতুড়ি ইত্যাদি। তার বাবা ক’দিন যাবৎ একটা হাতুড়ির কথা বলছে। সস্তায় একটা হাতুড়ি কেনা যায় কিনা দেখার জন্য দোকানটার সামনে একটু দাঁড়িয়ে মন দিয়ে জিনিসগুলো দেখছিল শ্যাডো, এমন সময় হঠাৎ একটা মোটরবাইক সবেগে এসে তার গাঁ ঘেঁষে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। হেলমেটে ঢাকা মুখ লোকটা খুব জরুরি গলায় বলল, “হপ আপ ম্যান।”

শ্যাডো সহজে চমকায় না, বিস্মিতও হয় না। তার নার্ভ খুব শক্ত। সে ফিরে তাকিয়ে ঠান্ডা গলাতেই বলল, “হোয়াই?”

“দেয়ার ইজ্ আ জব ফর ইউ ম্যান। হপ আপ! উই হ্যাভ টু টক।”

বিকেলটা ম্যাড়ম্যাড়ে কাটছিল, তার চেয়ে বরং একটা অ্যাডভেঞ্চার ভাল। অ্যাডভেঞ্চার তো কপালে খুব একটা জোটে না! শ্যাডো আর কথা না বাড়িয়ে মোটরবাইকের পিছনে উঠে পড়ল। তার বিশ্বায় নেই, এমন নয়। কিন্তু সেটার কোনও প্রতিক্রিয়া তার মুখে বা আচরণে দেখা যায় না।

ভিড়ের রাস্তায় লোকটা দিব্যি ওস্তাদের মতো বাইকটা চালাতে লাগল। খুব পাকা হাত। শ্যাডোর কখনও ভয় বা দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ হয় না। জন্মসূত্রেই সে এক ধরনের নির্বিকারত্ব নিয়ে জন্মেছে। তার জীবনদর্শন হল, যা হওয়ার হবে। আমার তো কিছু করার নেই। দেশ কাল-পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষ চালিত হয়, তার নিজের ইচ্ছেয় কিছুই হয় না। তা হলে আমি ভেবে মরি কেন? লোকটা মন দিয়ে বাইক চালাচ্ছে, আর শ্যাডো চুপচাপ বসে লক্ষ করছে, লোকটা কোন পথ দিয়ে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।

ময়দান পেরিয়ে খিদিরপুর। ফ্যান্সি মার্কেট ছাড়িয়ে আরও একটু গিয়ে একটা রেস্তরাঁর সামনে বাইক দাঁড় করাল লোকটা। ইশারায় নেমে পড়তে বলল তাকে। শ্যাডো নেমে দাঁড়ালে লোকটাও নামল এবং হেলমেট খুলে ফেলল। শ্যাডো দেখল, লোকটা মাঝবয়সি, চোয়াড়ে মুখ, গালে অল্প দাড়ি আছে, আর মোটা পাকানো গোঁফ। গম্ভীর মুখেই বলল, “লেট আস গো ইন।”

বিরাট রেস্তরাঁর ভিতরটায় গিজগিজে ভিড়, আর প্রচুর কথাবার্তা, এবং শোরগোল। হয়তো এদের খাবারদাবার ভাল এবং সন্তা। তাই এত ভিড়। ভিতরটা হলঘরের মতো বড় এবং দেখে মনে হয়, বেশ পুরনো রেস্তরাঁ। লোকটা তাকে টেবিল-চেয়ারের ফাঁক দিয়ে একটু ভিতরের দিকে একটা টেবিলে নিয়ে এল। টেবিলে চার জন কাস্টমার বসে ছিল, তারা কাছে যেতেই চার জন চটপট উঠে হাওয়া হয়ে গেল। শ্যাডোর বুঝতে অসুবিধে হল না যে, ওই চার জন তাদের জন্যই টেবিলটা দখল করে বসে ছিল।

লোকটা তাকে ইশারায় বসতে বলে নিজেও উল্টো দিকে বসে ভাঙা বাংলায় বলে, “বস এখনই চলে আসবে। তুমি কী খাবে বলো তো! এনিথিং ইউ লাইক।”

শ্যাডোর খিদে পেয়েছে, সে অকপটে বলল, “খাবার খাওয়ার মতো পয়সা কিন্তু আমার কাছে নেই। লোকটা একটা তাচ্ছিল্যের হাতনাড়া দিয়ে বলল, “ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। তুমি যা খুশি খেতে পারো।” টেবিলের উপর একটা ময়লা প্লাস্টিকের কভারে মেনুটা পড়ে ছিল। শ্যাডো সেটা তুলে নিয়ে মন দিয়ে দেখে বলল, “আমি কি একটা মুরগির স্টু নিতে পারি?”

“এনিথিং ইয়ংম্যান।”

লোকটা এখানে বেশ পরিচিত, কারণ তার একটা ইশারাতেই একজন ওয়েটার হাজির হয়ে গেল। গম্ভীর ভাবে অর্ডার নিল। শ্যাডোর স্টু আর গ্রিন স্যালাড, লোকটার জন্য ব্ল্যাক কফি।

শ্যাডোর অনুমান নির্ভুল। এদের খাবার খুবই ভাল। আর পরিমাণেও বেশ বেশি। খাবার খেতে ব্যস্ত থাকায় টের পায়নি, তার অলক্ষ্যে আর এক জন লোক এসে তার বাঁ দিকের চেয়ারটায় নিঃশব্দে বসেছে। খেতে খেতে হঠাৎ মুখ তুলে সে খুব ফরসা, টাক মাথা, ছিপছিপে মাঝবয়সি লোকটাকে দেখতে পেল। তার দিকেই চেয়ে আছে এবং খুব মন দিয়ে দেখছে তাকে। লোকটা যে অভিজাত পরিবারের এবং পয়সাওয়ালা তা যেন এর সর্বাঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে। সে তাকাতেই লোকটা খুব সামান্য একটু হাসল এবং একটু অবাঙালি টানে বাংলায় বলল, “আর কিছু খাবে শ্যাডো?”

লোকটা তার নাম জানে দেখে সে অবাক হল না, কারণ এরা তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েই তাকে পাকড়াও করে এনেছে। সুতরাং নাম ছাড়াও এরা আরও অনেক কিছুই জানতে পারে। সে বলল, “না, আর কিছু লাগবে না।”

লোকটা অত্যন্ত তার গলায় বলে, “জিম করার পর খুব খিদে পায়, আমি জানি। এখানকার ডাম্পলিং খুব ভাল। খেয়ে দেখো।”

শ্যাডো আপত্তি করল না!

ডাম্পলিং শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল লোকটা। তার পর বলল, “এবার আমরা কি একটু কথা বলতে পারি?”

শ্যাডো ঠান্ডা গলায় বলে, “হ্যাঁ। আপনারা আমাকে একটা কাজ দিতে চান বলে শুনেছি।”

“হ্যাঁ। তার আগে বলি, আমরা তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানি, কিন্তু সব কিছু নয়। যেমন আমরা জানি, তোমার নাম শ্যাডো সেনগুপ্ত, বয়স তেইশ, বিএ পাশ, এক জন স্পোর্টসম্যান। তুমি ফুটবল, ক্রিকেট খেলেছ, ক্যারাটে শিখেছ, এবং একজন বক্সার। অ্যাম আই কারেন্ট?”

“হুঁ, কিন্তু আমি কোনওটাতেই এক্সেল করিনি। আই অ্যাম বর্ন মিডিয়োকার।”

লোকটা হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল, “আমরা কোনও স্টার স্পোর্টসম্যান খুঁজছি না। আমরা জানি, তুমি এক জন অত্যন্ত সাহসী মানুষ, এবং এও জানি, তোমার বাবার বিনাইন ব্রেন টিউমার হয়েছে এবং সেটা অপারেশন করা দরকার। কিন্তু তুমি বেকার এবং ইউ নিড মানি। অ্যাম আই রাইট?”

“হ্যাঁ”

“আমরা এও অনুমান করেছি যে, তুমি খুব একটা মরালিস্ট নও, কিংবা তোমার কর্মফল, পরকাল, পাপপুণ্য নিয়ে কোনও অবসেশনও নেই। আমি ঠিক বলছি কি?”

“আমি নাস্তিক, এটা ঠিক কথা।”

“ভেরি গুড। আমরা তোমাকে একটা কাজ দিতে চাই।”

“কী রকম কাজ? সেটা কি ইমমরাল?”

“হলে কি তোমার আপত্তি আছে? আগেই জানিয়ে রাখি যে, এই কাজটার জন্য তোমাকে আমরা পাঁচ লাখ টাকা দিতে রাজি। আর হ্যাঁ, কাজটা অনেকের চোখে ইমমরাল মনে হতেও পারে। যদি তোমার তাতে আপত্তি থাকে তা হলে আমরা আমাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে নেব।”

“আগে শোনা যাক, কাজটা কী!”

“ইউ হ্যাভ টু কিল আ ম্যান।”