এক । পটভূমিকা
ইতিহাস যখন লিখিত হয়নি, জলদস্যু বা বোম্বেটের অত্যাচার আরম্ভ হয়েছে তখন থেকেই। খ্রিস্টপূর্ব যুগেও দেখা যায় প্রাচীন মিশর, গ্রিস ও রোমের সমুদ্রযাত্রী জাহাজ বোম্বেটেদের পাল্লা থেকে রেহাই পায়নি। এমনকী, বিশ্ববিখ্যাত রোমান দিগবিজয়ী জুলিয়াস সিজারকে পর্যন্ত একবার বোম্বেটেরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ইংরেজিতে Piratc বলতে বুঝায় বোম্বেটে এবং গ্রিক Peirates থেকে ওই শব্দটির উৎপত্তি। উপরন্তু পোর্তুগিজ Bombardier শব্দটি ভেঙে গড়া হয়েছে বাংলায় চলতি ‘বোম্বেটে’ শব্দটি।
প্রাচীন ভারতবাসীরাও সাগরযাত্রায় বেরিয়ে যখন তখন ধরা পড়ত বোম্বেটেদের ফাঁদে। তারপর অষ্টম শতাব্দীতে ভারতের মাটিতে মুসলমানরা যে প্রথম ইসলামের পতাকা রোপণ করবার সুযোগ পায়, তারও মূলে ছিল ভারত সাগরের বোম্বেটেরাই। কিন্তু সে হচ্ছে ভিন্ন কাহিনি, এখানে বলবার জায়গা নেই।
তারপর মধ্যযুগের ইউরোপে ইংরেজ, ফরাসি, স্পেনীয়, পোর্তুগিজ ও উত্তর-আফ্রিকার মুসলমান বোম্বেটেদের ভয়াবহ অত্যাচারে সমুদ্রযাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল এবং জলদস্যুতা পরিণত হয়েছিল একটি রীতিমতো লাভজনক ব্যবসায়ে। ক্রমে ক্রমে পাশ্চাত্য বোম্বেটেদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর অন্যান্য সমুদ্রেও। আফ্রিকা ও আমেরিকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে বোম্বেটেদের প্রাধান্য এতটা বেড়ে ওঠে যে, তারা জল ছেড়ে ডাঙায় নেমেও দেশের পর দেশে হানা দিতে ভয় পেত না।
বোম্বেটেদের সাহস বাড়বে না কেন? বড় বড় ইংরেজ বোম্বেটে ইংল্যান্ডের রাজাদের কাছ থেকেও আশকারা পেয়েছে। অনেক বোম্বেটের জন্ম আবার সম্ভ্রান্ত পরিবারে। স্পেন বা ফ্রান্সের সঙ্গে যখন লড়াই চলত, ইংল্যান্ডের রাজারা তখন বোম্বেটেদেরও লেলিয়ে দিতে লজ্জিত হতেন না এবং তারাও প্রশ্রয় পেয়ে স্পেন বা ফ্রান্সের যে-কোনও জাহাজের উপরে হামলা দিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করত। হেনরি মর্গ্যান ছিল সতেরো শতাব্দীর এক কুখ্যাত ইংরেজ বোম্বেটে। সে কেবল জলপথে নয়, স্থলপথেও শত শত নরহত্যা করেছে এবং নির্বিচার লুণ্ঠনের পর বহু জনপদকে করেছে অগ্নিমুখে সমর্পণ। তাকে বন্দি করে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু রাজা দ্বিতীয় চার্লস তার সঙ্গে আলাপ করে এমন মুগ্ধ হলেন যে, শাস্তি দেওয়া দূরের কথা, মর্গ্যানকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করে জামাইকা দ্বীপের শাসনকর্তার আসনে বসিয়ে দিলেন।
জনৈক ইংরেজ বোম্বেটে একবার ভারত সাগরে এসে মোগলদের জাহাজের উপরে চড়াও হয়ে বাদশাহ আলমগিরের পরিবারভুক্ত দুজন রাজকন্যাকেও বন্দিনী করতে ভয় পায়নি।
সুন্দরবন ছিল আগে বর্ধিষ্ণু লোকালয়, পরে পরিণত হয়েছে বিজন জলা-জঙ্গলে, মানুষের বিচরণ-ভূমি-দখল করেছে হিংস্র পশুর দল। কারণ? পোর্তুগিজ ও মগ বোম্বোটেদের অত্যাচার।
দুজন মেয়ে-বোম্বেটেরও নাম বিখ্যাত—আন রোনি ও মেরি রিড। জাতে ইংরেজ। তাদেরও গল্প অতিশয় চিত্তাকর্ষক, কিন্তু আমরা বোম্বেটেদের ইতিহাস লিখতে বসিনি। ভূমিকার জন্যে যতটুকু চাই, ততটুকু ইঙ্গিতই দিলুম, আপাতত এ সম্বন্ধে আর বেশি বাক্যব্যয় করবার দরকার নেই। এইবার মূল কাহিনি শুরু করা যাক।
যার কথা বলব তার আসল নাম হচ্ছে এডওয়ার্ড টিচ, কিন্তু ‘কালোদেড়’ ডাকনামেই সে সর্বত্র পরিচিত (যেমন কুখ্যাত মুসলমান বোম্বেটে উরুজ পরিচিত ছিল ‘লালদেড়ে’ ডাকনামে)। সে কেবল স্পেন ও ফ্রান্সের শত্রুই ছিল না, নিজের জাতভাই ইংরেজদেরও সুবিধা পেলে ছেড়ে দিত না এবং সমগ্র ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ তার নাম শুনলেই ভয়ে কেঁপে সারা হত। আঠারো শতাব্দীর প্রথম দিকেই তার উত্থান এবং পতন। আমেরিকায় তখন ইংরেজদেরই রাজত্ব।