একেনবাবু ও বর্মণ বাড়ি রহস্য – ৫

একেনবাবু এসে পৌঁছোলেন রোববার দুপুর বারোটা নাগাদ। তখনও ঝড় আসেনি 

আসছে আসছে রব চারদিকে। মনে হয় মঙ্গলবার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না। 

অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গেটের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াতেই একেনবাবু রিনিতাকে ফোন করলেন। 

“আমি কি অপেক্ষা করব স্যার?” পুলিশের জুনিয়র অফিসারটি জিজ্ঞেস করল। 

“আরে না ভাই, ওরা এক্ষুনি আসছে,” ছোটো ব্যাগটা হাতে নিয়ে নেমে ছাতা খুলতে খুলতে একেনবাবু বললেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রিনিতা আর শিখা দু-জনেই নেমে এল। 

“আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল রে! মাঝরাস্তায় হঠাৎ স্টার্টার সমস্যা…!”

“যাক, এসে পৌঁছেছ ঠিকঠাক।” শিখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল রিনিতা।

একেনবাবু ওঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “গুড আফটারনুন ম্যাডাম… সরি, প্রিন্সেস।”

শিখা চোখ কপালে তুলল, “এমা! ম্যাডাম আর প্রিন্সেস কেন? আমি শিখা।”

“ঠিক আছে, তাহলে মিস শিখা বলি?”

“না, শুধু শিখা। আমি তো আপনার ছোটো বোনের বন্ধু। বোনকেও মিস রিনিতা ডাকেন নাকি?”

“না, না, তা কেন! আসলে হঠাৎ এভাবে এত দেরি করে এলাম, তারপর এক দিন থেকে যেতে হবে… খুব বাজে লাগছে।”

“কেন কানুদা, থেকে গেলে তো বোনেদেরও ভালো লাগতে পারে! আমি তো আশাই করছিলাম, আপনি ক’দিন এখানে থাকবেন। তারপর আমিও আপনাদের সঙ্গে কলকাতা ফিরব।”

“বাঃ, তাহলে তো খুব ভালো হয়। এই ঝড়-বৃষ্টি তো বড়োজোর দু-এক দিনের ব্যাপার।”

“ব্যস, তাহলে এই নিয়ে আর কোনো কথা নয়। বাবার অনেক ধুতি আছে, দু-একটা বের করে দেব। পুরোনো পাঞ্জাবিও আছে।”

“সেসব লাগবে না, ম্যাডাম… মানে মিস… শিখা। আমি বাইরে এলে এক সেট জামাকাপড় নিয়েই ঘুরি, কখন কোথায় কাজে লাগে… এই যে হাতে ব্যাগ।”

“তাহলে আবার কী!”

একেনবাবুকে ঘর দেখিয়ে শিখা খাবার ঘরে গেল। 

.

লাঞ্চের জন্য বাড়ির সবাই টেবিলে বসে গেছে। কল্পনামাসি আর মাকে শিখা আগেই বলে রেখেছিল কানুদা, মানে একেনবাবুর কথা। টেবিলে এক্সট্রা চেয়ারের বন্দোবস্ত হয়েছে দেখে ঋদ্ধি প্রশ্ন করল, “আবার কাকে এনেছিস?”

শিখা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল, “তোর জানার দরকার কী?”

বোনকে না ঘাঁটিয়ে ঋদ্ধি বাবার দিকে তাকাল। তুঙ্গনাথবাবু মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে আসছে?”

“রিনিতার দাদা, ওকে নিয়ে যেতে।” ও নিজেও যে ফিরে যাচ্ছে, সেটা বলল না। 

তুঙ্গনাথ বললেন, “এই ঝড়-বৃষ্টিতে যেতে পারবে?”

“তেমন হলে থেকে যাবে। কল্পনামাসিকে বলে দিয়েছি।”

তুঙ্গনাথ আর কিছু বললেন না। শিখা ঠিকই বলেছে, বাড়িতে যত দাপট দেখান না কেন, কন্যাকে উনি বেশি ঘাঁটান না। 

.

একেনবাবু আর রিনিতা ঘরে ঢুকতেই শিখা সবার সঙ্গে কানুদার পরিচয় করিয়ে দিল। সত্যর পরিচয় দিল ‘অতিথি’ বলে। একেনবাবু প্রথমেই তুঙ্গনাথকে বললেন, “আপনার এই প্রাসাদটা স্যার আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। এর কথা আগে এত শুনেছি, দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।”

তুঙ্গনাথের মুখে সন্তুষ্টি ফুটে উঠল। “পরে ভালো করে ঘুরে দেখো, এখনও নীচটার সারাই শেষ হয়নি। কবে হবে কে জানে! বাগানটাও নতুন করে বসাতে হবে।” তারপর স্বগতোক্তি করলেন, “আমি ছাড়া কারোর চাড় আছে! কত যে খরচ আর পরিশ্রম…”

“সে কী স্যার, কাজ তো চলছে নীচে।”

“তা চলছে, তবে খুবই আস্তে আস্তে, লোকগুলো মর্জিমাফিক আসে, হঠাৎ হঠাৎ অদৃশ্য হয়। এদিককার মিস্তিরিরা ফাঁকিবাজ! “

“এত বড়ো বাড়ি, ঠিকঠাক করা তো কঠিন ব্যাপার। পুরোনো বাড়ির সৌন্দর্য আর ঐতিহ্য… এখনকার মিস্তিরিরা তো বুঝতেই পারবে না।”

উত্তরে কিছু বললেন না তুঙ্গনাথবাবু, কিন্তু কথাটায় যে পূর্ণ সম্মতি আছে মাথা নাড়িয়ে প্রকাশ করলেন। 

কল্পনাকে জিজ্ঞেস করলেন অরুন্ধতী, “বাবুর থাকার বন্দোবস্ত করেছ?” একেনবাবু বলে উঠলেন, “একটা গাড়ি পেলে আজকেই রিনিতাকে নিয়ে চলে যেতাম ম্যাডাম। কিন্তু গাড়িটা সোমবারের আগে পাচ্ছি না।”

ঋদ্ধি বলে উঠল, “ট্রেন অনেকগুলোই পাবেন খন্যান থেকে। রিকশা ধরে স্টেশনে চলে যেতে পারেন।”

দাদার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে শিখা বলল, “ওঁদের যাওয়া নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।”

“না না, এই বৃষ্টিতে কেন যাবে।” অরুন্ধতী দেবী আবেগহীন ভদ্রতা করলেন। 

ঋদ্ধি বিরক্ত মুখে বসে রইল। এমনিতে এতগুলো বাইনের লোক, তার ওপর আরেক জন এসে হাজির! খন্যান থেকে প্রমোটারের বাড়ি দেখতে আসার কথা ছিল আজ- বন্ধু সেজে কিছুক্ষণের জন্য। এদের জন্য বাড়ি দেখানো নিয়ে ঝামেলা না হয়! 

আর একজন অতিথির আগমনে কল্পনাও খুশি হয়নি। তার কাজ বাড়ল। 

তার ওপর বাড়ি ফেরা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা! 

একেনবাবু অ্যাজ ইউজুয়াল রান্নার অজস্র প্রশংসা করলেন। “কলাইয়ের ডালটা একেবারে অপূর্ব!” কল্পনাকে বললেন, “ঝুরিভাজা, পোস্তবড়া, চচ্চড়ি… কোনটে ছেড়ে কোনটে খাই।”

এতেও চিঁড়ে ভিজল বলে মনে হল না। একমাত্র সত্যর কোনো বৈকল্য নেই।  চুপচাপ খেয়ে গেলেন। 

একেনবাবুর কথায় মজা পাচ্ছিল শিখা। রিনিতার কাছে ওঁর চরিত্র সম্পর্কে অ্যাডভান্স ওয়ার্নিং পেয়েছে, মিলিয়ে দেখছিল। 

খাওয়া-দাওয়ার পর তুঙ্গনাথবাবু নিজের ঘরে চলে গেলেন—সত্যকেও ডেকে নিলেন সঙ্গে। 

.

ওঃ, একটা কথা একেবারেই মনে ছিল না। তুঙ্গনাথবাবুর ওপর মার্ডার অ্যাটেম্পট-এর কথা রিনিতা ফোনেই একেনবাবুকে জানিয়েছিল। ওর ইচ্ছে কী ঘটেছে কানুদা যদি একটু খুঁটিয়ে দেখে। সেটা শুনে একেনবাবুর অ্যান্টেনা খাড়া। সবার সঙ্গে কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন সাসপেক্ট বাড়ির ভেতরকার কেউ হতে পারে কিনা। বাইরে থেকে লোক ঢুকে থাকলে বাড়িটা ঘুরে দেখা দরকার। সেই সুযোগ অবশ্য তুঙ্গনাথবাবুই করে দিয়েছেন ‘বাড়িটা ভালো করে দেখো’ বলে। 

একেনবাবু শিখাকে ধরলেন, “স্যার বললেন, বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে, ওপরটা তো প্রায় দেখাই হল। নীচ আর বাড়ির পেছনটা একটু দেখি?”

“নীচে ধুলোবালি ছাড়া কিছুই নেই, পেছনে একটা পুকুর আর কিছু ঝোপজঙ্গল-গাছপালা, কোনোটাই ভালো অবস্থাতে নেই।”

ঋদ্ধি শুনতে পেয়ে বলল, “বাড়ি দেখবেন? আমি নিয়ে যাচ্ছি, চলুন।”

“আপনি সময় নষ্ট করবেন কেন, স্যার। আমি তো নিজেই যেতে পারি।”

“কিচ্ছু না, চলুন।” ঋদ্ধির সন্দেহ হল একেনবাবু নিশ্চয়ই প্রোমোটিং-এর সঙ্গে যুক্ত, নইলে বাড়ি দেখতে এত আগ্রহ কেন? তা ছাড়া লোকটাকে একটু বাজিয়ে দেখা যাবে মতিগতি কী। রিনিতা মেয়েটাকে ঋদ্ধি আগে দেখেনি। তার ক্যারেক্টারও জানা নেই। রাতে যে খুনের চেষ্টা করছিল সে ছেলে না মেয়ে বাবা বোঝেনি। বাবা এখন আর শক্ত-সমর্থ নয়, অতর্কিতে রাত্রে আক্রমণ করলে রিনিতার মতো একটা মেয়েও তাঁকে অবশ্যই কাবু করে ফেলতে পারে। হয়তো এখন সঙ্গীকে এনেছে কাজ ফিনিশ করতে! 

ঋদ্ধির সঙ্গে একেনবাবু নীচে গেলেন। ওঁকে একা পেয়ে ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী করেন?”

“একসময়ে কাজ করতাম এখন স্যার খুচখাচ কনসাল্টেন্সি। কেন, স্যার?”

“বাড়ি দেখতে এত ইন্টারেস্টেড বলে ভাবলাম হয়তো প্রোমোটিং-এর সঙ্গে যুক্ত।”

“আপনারা কি প্রোমোটার খুঁজছেন, স্যার?”

“না, ঠিক তা নয়। এটা বিক্রির কোনো প্ল্যান বাবার আপাতত নেই, তবে দারুণ অফার পেলে কী করবেন সেটা কি বলা যায়?”

“একদিন তো, স্যার, আপনারাই এটার মালিক হবেন। খোঁজখবর করে রাখা তো ভালোই, স্যার। … আচ্ছা, স্যার, এটাই কি পেছন থেকে ঢোকার একমাত্র দরজা?” সিঁড়ির নীচে খিল লাগানো একটা বড়ো দরজা দেখিয়ে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। 

“হ্যাঁ, এই একটাই। এটা খুললে একদিকে একটা আউট হাউস, সেখানে গোপাল মানে আমাদের কাজের লোকটি থাকে। অন্যদিকে একটা ছোটোখাটো পুকুরের মতো… ঝোপঝাড়ে জংলা।”

“গোপাল একা থাকে স্যার?”

“হ্যাঁ, ও বিয়ে-টিয়ে করেনি।”

“নীচের ঘরগুলো তো রিপেয়ার হচ্ছে, কী করবেন রিপেয়ার হয়ে গেলে?”

“বাবার খেয়াল, আমাদের কোনো ইচ্ছে খাটবে না।”

“হোম-স্টে বানাতে পারেন স্যার, এই রাজবাড়িতে থাকার জন্যে অনেকেই আসবেন। মেনটেনেন্সের খরচা উঠে আসবে।”

“বাবার মাথায় এটা ঢোকান না আপনি, আমার কথা তো কানেই তোলেন না। শিখা বা মা এসব নিয়ে ভাবেও না।”

“ওঁদের কোনো ইন্টারেস্ট নেই, স্যার? 

“মা”র কোনো কিছুতেই নেই, বোন নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত।”

“এসব বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে, আপনি কিন্তু স্যার, ছেলের কর্তব্য করছেন।”

“আমার নিজের ইচ্ছে এটাকে বেচে দেওয়া, এই গেঁয়ো জায়গায় পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সিলি! কাছাকাছি কোনো হাসপাতাল নেই, বিপদে- আপদে খবর দিলেও পুলিশ আসে না। বাবার বয়স হচ্ছে, কিন্তু সেটা মানতে চান না।”

“তা তো বটেই স্যার, তবে ওঁকে তো বেশ স্বাস্থ্যবান লাগল।”

“স্বাস্থ্যবান হতে পারেন, কিন্তু কালকেই তো বাবার ওপর মার্ডার অ্যাটেম্পট হল! এর আগেও বাবা মাঝেমধ্যে বলেছেন, রাতে খুটখাট আওয়াজ শুনতে পান। “ একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে ঋদ্ধি বোধহয় কথাগুলোর রিয়্যাকশন বোঝার চেষ্টা করল। 

“সে কী, স্যার! এ তো সব্বোনেশে কথা!” একেনবাবু অবাক হয়ে বললেন। “হ্যাঁ, লাকিলি বেঁচে গেছেন, কিন্তু পুলিশে খবর দেবেন না। আমি দিতে চেয়েছি বলে সবাইকে গালাগাল দিলেন। 

“আপনি কিন্তু স্যার, একটা ডায়েরি করলে পারতেন। এত ভয়ংকর ব্যাপার!”

“খেপেছেন! দিলেই আমাকে বাড়ি-ছাড়া করতেন।”

“আপনি যা বললেন, তাতে তো আমারই ভয় করছে স্যার, এখানে রাতে করল।”

“আমার ধারণা বাবাই টার্গেট।”

“এটা কেন ভাবছেন স্যার?”

“আপনি বাবার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। একসময় খুব দুদে উকিল ছিলেন – অনেককে ঘোল খাইয়েছেন। শত্রু কম ছিল না। তা ছাড়া সারাজীবন শুধু চিন্তা কী করে আরও টাকা করে বাড়িটা পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নেবেন। যাচ্ছেতাই! তাও, ঠিকই বলেছেন, আমাদের সাবধান থাকতে হবে।”

“যদি তেমন মনে হয় স্যার, তাহলে আপনি বরং বাবাকে অন্য কোনো ঘরে ক’দিন শুতে বলুন। আপনি বাবার ঘরে ঘুমোন— অন্তত যদ্দিন না বাড়ির সিকিউরিটির ব্যাপারটা জোরদার হয়। আর সবাইকে ব্যাপারটা জানাবার দরকার নেই। আপনাদের মধ্যেই রেখে দিন।”

“এটা মন্দ বলেননি। দেখি, আজ ডিনারের পরে কথাটা বলি। …আর কিছু দেখতে চান নীচে?”

“না, না, স্যার, এই যথেষ্ট। থ্যাংক ইউ। চলুন, ওপরে যাই।”

.

ওপরে উঠে একেনবাবু দেখলেন বারান্দায় বেশ ক’টা চেয়ার রাখা। শিখা আর রিনিতা বসে গল্প করছে। ঋদ্ধি ওর মায়ের ঘরে গেল। একেনবাবু আরেকটা চেয়ার টেনে বারান্দায় শিখাদের কাছে বসলেন। 

“কেমন দেখলেন বাড়ি?”

“দারুণ!”

“আজকে রাতে শুধু খিচুড়ি।”

“এই ঝড়-বৃষ্টিতে সেটাই তো জমবে।”

“ওটা আনপ্ল্যানড, গোপাল এসে খবর দিল খন্যান স্টেশনের বাজার আজ বন্ধ। ওটাই এদিককার বড়ো বাজার।”

“ওখান থেকেই বাজার আসে?”

“এমনিতে না, এদিকের বাজার সপ্তাহে তিন দিন বসে। সত্যর কী একটা চিঠি পাঠাবার দরকার ছিল। সেটা ক্যুরিয়ারে পাঠাবার জন্য বাবা ডিএইচএল-এর অফিসে গোপালকে পাঠিয়েছিল। ওটা বাজারের পাশেই।”

“উনি কি আপনাদের বহুদিনের পরিচিত… মানে এই সত্যবাবু?”

“না, এবার এসে প্রথম দেখলাম। তবে বাবার খুবই পরিচিত মনে হল।”

.

বাইরে যাবার উপায় নেই, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। গেটের বাতি বার দুই ফ্লিকার করল। 

“এখানে লোডশেডিং হয়?” একেনবাবুর গলা আতঙ্কিত। 

“আগে খুবই হত। আমাদের জেনারেটর আছে তাই সমস্যা হয় না। কিন্তু ওটাও মাঝে মাঝে গোলমাল করে, তখন ঝামেলা— বাতি, ফ্যান, পাম্প কিছুই কাজ করে না।”

.

আকাশ অন্ধকার, ঝোড়ো হাওয়া আরম্ভ হয়েছে। বাড়ির ভেতরে বিশেষ কিছু দেখার বা করার নেই। পাছে আলো চলে যায়, জেনারেটর কাজ না করে… একেনবাবু ঘরে গিয়ে ফোন চার্জ করতে দিলেন। বাইরে গেলে ব্যাগে একটা টর্চ থাকে, সেটা আছে কিনা দেখলেন। গভীর রাতে বাতি নিভলে কেউ নিশ্চয় গিয়ে জেনারেটর চালাবে না, তখন অন্ধকারে বাথরুম বা অন্য কোথাও যেতে হলে সমস্যা হবে। নিউ ইয়র্ক ছেড়ে কলকাতায় এসে আবার আধ ঘণ্টার মতো দিবানিদ্রার অভ্যাস হয়েছে। চোখ ঢুলে ঢুলে আসছে। ভাবছিলেন একটু ঘুমিয়ে নেবেন, এমন সময়ে রিনিতা এসে হাজির। 

“কি রে তোদের গল্প হয়ে গেল?”

“শিখার কী একটা কাজ ছিল। আমারও অনেক কাজ আছে, কিন্তু এই ঝড়ে নেট থাকবে বলে মনে হয় না।”

“তাহলে বোস। এবারে কলকাতায় এসে তো তোর সঙ্গে গল্পই করা হয়নি। ভালোকথা, আমার গোয়েন্দা পরিচয়টা কেউ এখানে জানে না তো?”

“না, তুমি বলতে বারণ করলে না?”

“হ্যাঁ, আসলে তুই মার্ডার অ্যাটেম্পটের কথা বলার পর থেকে আমি একটু বোঝার চেষ্টা করছি কী হয়ে থাকতে পারে!”

“আমার কিন্তু পুরো ব্যাপারটাতে ভয় করছে। শিখাও ভয় পেয়েছে। কিন্তু ওর বাবা অদ্ভুত মানুষ। কারোর কথা কানে তোলেন না, শুধু নিজের বাড়ি আর নিজের জগৎ নিয়েই আছেন।”

একেনবাবু মুচকি হাসলেন, “ওই সত্যবাবু লোকটির সঙ্গে তো বেশ ভালো সম্পর্ক।”

“তাতেই তো সবাই অবাক! শিখার দাদা, আর মায়ের ইচ্ছে ছেলেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি থেকে বিদায় হোক। এখন দেখছি শিখাও ওদের দলে যোগ দিয়েছে।”

“হঠাৎ?”

“এমনিতে সত্যকে বেশ ভদ্র-সভ্য লাগছিল। আমাদের দু-জনেরই ভালো লেগেছিল ওর সঙ্গে গল্প করতে। এখন মনে হচ্ছে তুঙ্গনাথবাবুকে ছেলেটি তুর্ক করেছে।”

“মানে?”

“হঠাৎ তুঙ্গনাথবাবু আর সত্য হরিহর আত্মা হয়ে গেছেন… ঘরে বসে দরজা বন্ধ করে দু-জনে নানান আলোচনা করছেন। শিখা একসময় ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন আবছা দু-একটা কথা ওর কানে গেছে… ‘দলিল’, ‘উইল’… টুকরো টুকরো শব্দ। শিখার মনে হয়েছে কথা চলছে সম্পত্তি নিয়ে। ওর মাকে সেটা জানাতে উনি প্রচণ্ড চটেছেন, যদিও এমনি কিছুতে থাকেন না! আর শিখার দাদা তো প্রথম থেকেই সত্যর ওপর খচা— কোনো কারণ ছাড়াই। শিখার এই কথা শুনলে আগুন হয়ে যাবে।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!” বলে একেনবাবু পা নাড়াতে শুরু করলেন। কিছু মাথায় এলে উনি এটা করে থাকেন।