একেনবাবু ও বর্মণ বাড়ি রহস্য – ৩

সকালের ঘুম ভাঙতে না ভাঙতে আঁ আঁ আঁ চিৎকারে বাড়ি সচকিত। 

কান ফাটানো শব্দে রিনিতা তড়াং করে বিছানায় উঠে বসল। কাঁচা ঘুম ভেঙে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আছে! গোটা বৰ্মণ বাড়িতে কেউ বোধহয় তখনও বিছানা ছাড়েনি। 

অরুন্ধতী উঠেছেন, কিন্তু অভ্যেসমতো ঘর থেকে বেরোননি। সকালে উঠে ঘণ্টা খানেক বই পড়া ওঁর নিত্যকার রুটিন। তারই মধ্যে দু-কাপ চা খান। সবাই ব্রেকফাস্ট করে দেরিতে। ওঁর হাত থেকে টেনিসনের কবিতা সংকলন খসে পড়ল। বুঝতে সময় লাগল না এই প্রাণঘাতী চিৎকারের উৎস কে। হঠাৎ কী হল! এই তো ট্রে হাতে চায়ের কাপ নামিয়ে গেল। বেশ তো ছিল তখন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা অবধি পৌঁছোতে পারলেন না! 

উলুর-ঝুলুর কাপড়, ভয়ে চোখ বিস্ফারিত, তুঙ্গনাথের ঘর থেকে বেরিয়ে এল কল্পনা। তখনও গলা থেকে একটা বিশ্রী কর্কশ শব্দ বেরোচ্ছে। অরুন্ধতী বারান্দায় বেরিয়ে ওকে টেনে আনলেন ঘরে। 

“কী হয়েছে? কল্পনা, চেঁচানো বন্ধ করো। কী হয়েছে?”

“মেইরে ফেইলছে, মেইরে ফেইলছে। বাবু মইরে গেছে এক্কেরে! ও বাবা গো!”

“কী আজেবাজে বকছ!”

কল্পনাকে ফেলে অরুন্ধতী দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন স্বামীর কামরার দিকে। ইতিমধ্যে অন্যান্যরাও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। 

ঋদ্ধি মায়ের পাশে এসে উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে মা? কী ব্যাপার! কল্পনামাসি, কী হল?”

অরুন্ধতী উত্তর দিলেন না। এগিয়ে চললেন হ্যামেলিনের পাইড পাইপারের মতো। ওঁর পেছনে ঋদ্ধি, শিখা, আর রিনিতা। উলটো দিক থেকে এগিয়ে এলেন রাতের নবাগত। 

অরুন্ধতী ঘরে ঢুকলেন, অন্যেরা ভিড় করে দাঁড়াল তুঙ্গনাথের ঘরের দরজার সামনে। রিনিতা উঁকি মেরে দেখল চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে আছেন তুঙ্গনাথ। কী হয়েছে, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক? মারা গেছেন, না এখনও প্রাণ আছে? 

টেবিলে রাখা জলের গ্লাস তুলে চোখে-মুখে জল ছিটোতে লাগলেন অরুন্ধতী। শিখা কোত্থেকে একটা পাখা জোগাড় করে মাথায় হাওয়া দিতে থাকল। ঋদ্ধি চেঁচিয়ে উঠল, “বাবা, বাবা!” কোনো সাড়া নেই। রিনিতা যখন প্রায় নিশ্চিত সব শেষ, একটা বড়ো নিঃশ্বাসের শব্দ এল কানে। তুঙ্গনাথবাবু নড়ে উঠলেন। সামান্য আশ্বাস! একটুক্ষণের মধ্যেই চোখের পাতা কেঁপে উঠল ওঁর। কিছুক্ষণ পরে চোখ মেললেন তুঙ্গনাথ বৰ্মণ। 

“কী হয়েছিল তোমার?” এই প্রথম অরুন্ধতীর গলায় আবেগের রেশ শুনতে পেল রিনিতা। 

শিখা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “শরীর কি খুব খারাপ লাগছে, বাবা? দাদা, একজন ডাক্তার ডাক! 

হাত নেড়ে তুঙ্গনাথ অপেক্ষা করতে বললেন সবাইকে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, “জল।” সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের কাছে জলের গ্লাস তুলে দিলেন অরুন্ধতী। দু-ঢোঁক খেয়ে তুঙ্গনাথ বললেন, “ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। অনেকটা ভালো লাগছে। একটু সময় দাও, বলছি।”

কয়েক মিনিট সময় গেল। তারই মধ্যে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন উনি। ধীরে ধীরে যা বললেন, তা শুনে রিনিতার গা হিম! 

ভোররাতে হঠাৎ একটা শব্দে তুঙ্গনাথের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। এমনিতে উনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে শোন, তাই ঘুমের ঘোরে কী ব্যাপার বুঝতে সময় লাগল। আবছা দেখলেন একটা ছায়াশরীর ঘরে ঢুকেছে। চেঁচিয়ে ওঠার আগেই গলায় দড়ি পেঁচিয়ে কেউ চাপ দিতে লাগল। দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়! ঝাপটা ঝাপটিতে দড়ি ছিঁড়ে ফুসফুসে হাওয়া ঢুকে প্রাণ বেঁচেছে। কিন্তু সেই সময়েই ভারী কিছু দিয়ে কেউ মাথায় আঘাত করে। তারপর আর কিছু মনে নেই। তুঙ্গনাথ শুধু একটা অবয়ব দেখেছেন, কাউকে চিনতে পারেননি। এমনকী লোকটা ছেলে না মেয়ে তাও বলতে পারলেন না। রিনিতা দেখল মাটিতে পড়ে আছে মশারি বাঁধার দড়ির ছেঁড়া টুকরো। পুরোনো পলকা দড়ি। একটু চাপ দিলে ছিঁড়তে বাধ্য। ভাগ্যিস! শক্ত রশি হলে ব্যাপারটা ভয়াবহ আকার নিত। 

কল্পনা এতক্ষণ বারান্দায় পা ছড়িয়ে, মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। গোপাল স্থবিরের মতো পাশে দাঁড়িয়ে। মনিব মারা যাননি বুঝে দু-জনেই দরজায় এসে দাঁড়াল। কী সর্বনাশ! রাতে চোর-ডাকাত এসেছিল? এমন তো আগে হয়নি! বিশাল বাড়ি হলেও চট করে লোক ঢুকতে পারে না। বাড়িতে রং-টং হচ্ছে, তাদের মধ্যে কেউ চুরি করতে এসেছিল? গ্রামের চেনা লোক সব, এত সাহস হবে! অন্যরাও তো কিছু টের পায়নি! 

ঋদ্ধি দৌড়ে নীচে গেল। সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। গোপাল জানাল, রাতে নতুনবাবু আসার পর ও নিজের হাতে চাবি দিয়ে দরজা বন্ধ করেছে। কল্পনা তার আগেই বাড়ি চলে গিয়েছিল। অন্য দিনের মতো চাবি ওর গেঁজেই সারারাত গোঁজা ছিল। সকালে কল্পনাকে দরজা খুলে দিয়ে আবার বন্ধ করেছে। সেই থেকে চাবি বাড়ির ভেতরেই রয়েছে। 

বাইরে থেকে কারোর ঢোকার চিহ্ন না থাকলেও লোক ঢোকার সম্ভাবনা একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। উদ্দেশ্য চুরিই হবে। খুন করতে এলে মশারির দড়ি গলায় পেঁচাবে কেন! মানে ধরা পড়ার ভয়ে হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই ব্যবহার করেছে। 

ঋদ্ধিই প্রথম বলল, “মা, দেখো তো ঘর থেকে কিছু গেছে কিনা! তুইও দেখ শিখা।”

অরুন্ধতীর নির্লিপ্ততা আবার জাঁকিয়ে বসেছে। উনি নড়লেন না। খাটের মাথার দিকে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। শিখাই একটু ঘুরে-ফিরে দেখল। না, কিছুই খোয়া যায়নি, অন্তত ও দেখতে পেল না। এর মধ্যে তুঙ্গনাথও মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। উনিও ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বললেন, “না, তেমন কিছু গেছে বলে মনে হচ্ছে না। হয়তো সময় পায়নি। গোলমালে যদি অন্যেরা জেগে যায় ভয়ে পালিয়েছে।” ততক্ষণে তুঙ্গনাথকে বেশ তাজাই দেখাচ্ছে। 

“আমি ডাক্তার ডেকে আনি,” ঋদ্ধি বলল। 

“কোনো দরকার নেই।” তুঙ্গনাথ একটু বিরক্ত হয়ে আপত্তি করলেন। “এখন ভালোবোধ করছি, আর কিছু খোয়া যায়নি। ওসব ঝামেলার প্রয়োজন নেই।”

“তাও এক বার হাসপাতালে যাওয়া উচিত। মাথা স্ক্যান করে দেখতে হয় রক্ত জমাট বাঁধল কিনা। মাথাটা একটু টেস্ট করা দরকার।”

“তোর নিজের মাথা টেস্ট করা, যা! সেটার জরুরি দরকার আছে।” ঘোর ঘোর ভাব কাটিয়ে তুঙ্গনাথ স্বমূর্তি ধরলেন। 

ওঁকে আর বেশি না ঘাঁটিয়ে শিখা বলল, “বেশ, পুলিশে অন্তত রিপোর্ট করি, বাবা। মার্ডার অ্যাটেম্পট বলে কথা!”

“পুলিশ আমাকে উদ্ধার করবে! বেরো সব আমার ঘর থেকে।”

একটি কথা না বলে অরুন্ধতী বেরিয়ে গেলেন। মুখ ব্যাজার করে ওঁর পেছন পেছন হাঁটা দিল ঋদ্ধি। রিনিতার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শিখা বলল, “কিছু দরকার হলে ডেকো, বাবা। শরীর খারাপ লাগলে ইগনোর কোরো না।” ওদের পেছন পেছন নতুন আসা অতিথিও বেরোচ্ছিলেন, দাঁড়িয়ে গেলেন তুঙ্গনাথের কথায়। “তুমি একটু বসো, সত্য। দরকার আছে।”

তুঙ্গনাথের ঘরে রয়ে গেলেন সত্য। 

.

ঘর থেকে বেরিয়ে রিনিতা দেখল ঋদ্ধি বারান্দার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে কল্পনার সঙ্গে কথা বলছে। শিখার সঙ্গে নিজের ঘরের দিকে এগোতে গিয়ে দু-একটা কথা কানে এল। 

“লোকটা কখন উঠেছে, কল্পনামাসি? তুমি চা দেবার সময় কী করছিল?”

ঋদ্ধির মুখে সন্দেহের ছাপ। 

“বেট্টি যকন দিনু ঘরে চেল না। আমি রেকে এলুম টেবুলে। আর তো যাইনি গো!”

শিখাকে দেখে এবারে তাকে নিয়ে পড়ল ঋদ্ধি, “তুই এই লোকটার সম্পর্কে কিছু জানিস?”

“তুই যা জানিস, আমিও তাই। কিচ্ছু না।”

“কে লোকটা? বাবার সঙ্গে কী এত গোপন কথা? উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, মতলব কী? এদিকে তো বাবার ওয়ান পাইস ফাদার-মাদার, কেন থাকতে দিচ্ছে কে জানে!”

“তোর কি ওকে সন্দেহ হচ্ছে?”

“কী বলিস, হবে না? ও যে রাতে এল, সেই রাত পোয়াতে না পোয়াতে বাড়িতে ডাকাতি হল? বাইরের আর কে আছে?”

“বাড়িতে তো রিনিতাও আছে। তুই কি আমার বন্ধুকেও সন্দেহ করছিস?” রিনিতার সামনেই জিজ্ঞেস করল শিখা। 

“না, তা করব কেন?” ঋদ্ধি ডিফেন্সিভ হয়ে রিনিতার দিকে কাঁচুমাচু হয়ে তাকাল। “রিনিতা তো তোর পরিচিত। ওই লোকটাকে কেউ চিনি না- অজ্ঞাতকুলশীল!”

“অবভিয়াসলি বাবা চেনে। বাবাই তো এনেছে। অজ্ঞাত হোক আর যাই হোক, হঠাৎ বাবাকে মারতে যাবে কেন? দুম করে উলটোপালটা অভিযোগ আনিস না! তার চেয়ে পুলিশে খবর দে, তারা ইনভেস্টিগেট করুক।”

শিখা কথাটা বলল বটে, তবে সত্যকে সত্যিই কেউ চেনে না। মানুষের মনের মধ্যে কী থাকে, সেটা বাইরে থেকে বোঝা দুষ্কর! কিন্তু দাদার খামখেয়ালিপনাকেও ও প্রশ্রয় দিতে চাইল না। 

ঋদ্ধি গজগজ করতে করতে চলে গেল। বারান্দায় শিখার পাশে দাঁড়িয়ে রিনিতা ভাবতে লাগল পুলিশকে একেবারে না জানানো কি ঠিক হল! 

তুঙ্গনাথের ঘর থেকে বেরিয়ে সত্য ওদের দিকে এলেন। 

“কী সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে গেল, না?”

রিনিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল। লোকটা কি খুনি হতে পারে? 

“আপনার মনে হয় না মেসোমশাইয়ের ওপর একটা মার্ডার অ্যাটেম্পট হয়েছে? কী বললেন উনি?”

প্রশ্নটা শুনিনি শুনিনি ভাব করে এড়িয়ে গেলেন সত্য। 

“কী হল সেটা বুঝতে পারছি না।”

শিখা তীব্র সুরে বলল, “আপনার মনে হয় না পুলিশে খবর দেওয়া উচিত?”

“মনে তো হয়। কিন্তু উনি…”

“হ্যাঁ, বাবা চাইছেন না।”

“বুঝতে পারছি না কেন। এটা তো নেগলেক্ট করার ব্যাপার নয়! 

শিখা চাপ দিল, “আপনি একটু বলে দেখুন। এ নিয়ে আমরা কিছু বলতে গেলে বিরক্ত হচ্ছেন।”

“আমি বাইরের লোক, আমার কথা কি শুনবেন?” সত্য বারান্দা দিয়ে আবার তুঙ্গনাথের ঘরের দিকে এগোলেন।