একেনবাবু ও বর্মণ বাড়ি রহস্য – ১

হুগলির খন্যান স্টেশনের কাছে ছোট্ট একটা আধা গ্রাম টালিগড়। শুক্রবার শিখাই গাড়ি চালিয়ে রিনিতাকে নিয়ে এল। হাইওয়ে ধরে ঘণ্টা দুয়ের পথ। শেষ এক মাইলটাক হাইওয়ে থেকে নেমে ভাঙাচোরা মেঠো রাস্তা ধরে গেলে শিখাদের বাড়ি। চারিদিকে উঁচু দেয়াল দেওয়া কম্পাউন্ড। ভেতরে ঢোকা আর বেরোনোর জন্য গ্রিল দেওয়া দুটো আলাদা গেট। দুটোই বন্ধ, কিন্তু তালা দেওয়া নেই। গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হর্ন দিয়েও কোনো লাভ হল না। শেষমেশ শিখা নিজেই মেইন গেট খুলতে গেল। রিনিতাও নামল গাড়ি থেকে। 

লাল রঙের ইউ-শেপের বিশাল দোতলা বাড়ি, বলতে গেলে প্রাসাদ। এক তলার দুটো উইং-এ বোধহয় রিপেয়ারিং আর রঙের কাজ চলছে। ভেতরের প্রধান অংশের কাজ মোটামুটি শেষ। সেখানে বারান্দায় ওঠার চওড়া সিঁড়ি। সাইড বারান্দায়ও সিঁড়ি আছে, তবে সাইজে ছোটো। বাড়ির সামনে চত্বরের মাঝখানে একটা ফোয়ারা, জল পড়ছে না। দু-দিকে দুটো ভাস্কর্য। এককালে হয়তো মোহিনী নারীমূর্তি ছিল, এখন খুঁটিয়ে না দেখলে লিঙ্গ বোঝা দুষ্কর। দুটোতেই সংরক্ষণের অভাব প্রকট। চত্বরটা সবুজহীন। ঘাস থাকলে জায়গাটা খুবই সুন্দর লাগত। কিন্তু এত বড়ো কম্পাউন্ড আর বাড়ি ঠিকঠাক রাখা কম খরচার ব্যাপার নয়! 

এ অঞ্চলে পরাই বোধহয় বাড়িটাকে টালিগড়ের রাজবাড়ি বলে। কাঁচা রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে মেয়ে ড্রাইভার গেট খুলছে দেখে কৌতূহলী জনতা ভিড় করল। তাদের মধ্যে একজন বয়স্ক লোক শিখাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এল। 

“দিদিমণি বাড়ি এয়েচেন? যান, সোজ্জা যান গে! গেট আমি বন্দ করে দেব।” সেই অন্যদের ধমক লাগাল তেড়ে। 

“সর দিকি, যেতে দে দিদিমণিদের। ভিড় কচ্চিস কেন, ইল্লুতে সব গাড়ি রাজবাড়ি ঢুকবে। সর, সর, সরলি!”

বকুনিতে কাজ হল। ওদের কাটিয়ে গাড়ি কম্পাউন্ডে ঢুকিয়ে দু-জনে নামল। রিনিতা বলল, “তোর বাবা যে রাজা ছিলেন বলিসনি তো?”

শিখা লজ্জা পেল। 

“আরে না, না, ওসব বাজে কথা। তবে শুনেছি উত্তরবঙ্গে নাকি ঠাকুরদার ঠাকুরদা বিশাল জমিদারি করেছিলেন। তিনিই বাড়িটা বানিয়েছেন। মানে অধস্তন চোদ্দো না হলেও তিন পুরুষকে উচ্ছন্নে দিয়ে গেছেন। ঠাকুরদার বাবা-কাকারা সারাজীবন কিচ্ছু করেনি, ঠাকুরদা আর ওঁর ভাইয়েরাও তাই। দু-পুরুষ শুধু টাকা উড়িয়েছেন! ফলে বাবাকে রোজগার করে খেতে হয়েছে— সারাজীবন ওকালতি করেছেন। তবে কী জানিস, রোজগারের বেশিরভাগই ঢেলেছেন এই বাড়ির পেছনে। টোটাল ওয়েস্ট, কিন্তু বাবার অবসেশন!”

“তা বলছিস কেন, এরকম দারুণ একটা বাড়ি। মেনটেন তো করতেই হবে। আমার তো মনে হয় হোটেল হিসেবে দারুণ হবে বাড়িটা!”

“কে আসবে এই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে ছুটি কাটাতে? গঙ্গার পাশে-টাশে হলে তবু একটা কথা ছিল!”

“কেন রে, সিনেমা-টিভির শুটিং-এর জন্যেও তো দারুণ লোকেশন!”

“দাদাকে বলিস, খুশি হবে। দাদা তো সব ময়েই সুযোগ খুঁজছে প্রোমোটারদের হাতে বাড়ি তুলে দেওয়ার। তবে বাবাকে ক্ষুাক্ষরে বলতে যাস না, সঙ্গে সঙ্গে তোড়ে গালাগাল দিয়ে তাড়িয়ে দেবে! প্রাণ থাকতে এই বাড়ি হাতছাড়া করবে না বাবা। কত যে অশান্তি হয় এ নিয়ে!”

কথা বলতে বলতে ওরা সামনের বারান্দায় পৌঁছোল। রিনিতা এই প্রথম এমন একটা পুরোনো বাড়িতে এল। 

“কত বয়স হবে রে এটার?”

“দেড়শোর বেশি।”

“ওরেব্বাস!”

তবে বাইরে থেকে বাড়িটা রিনিতার যত সুন্দর লাগছিল, বারান্দায় উঠে মোহভঙ্গ হল। পুরো বারান্দা চুন আর সিমেন্টের ধুলোয় ভরতি। রিপেয়ারের পর ভালো করে ঝাঁট পড়েনি। উঁচু ছাদের নীচে ঘুলঘুলির ফাঁকে ফাঁকে পায়রার বাসা, 

তারাও যত্রতত্র নোংরা করেছে। 

ওর মনোভাব আন্দাজ করে শিখা গজগজ করল, “নীচের তলায় কেউ থাকে না, সবাই দোতলায়। তাও এত রংচং কেন করতে হবে জানি না!”

রিনিতার মনে হল এই বিশাল অঙ্কের ব্যয় নিয়ে শিখার নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ওর বাবা নাকি আর সব দিকে কৃপণতা করে টাকা ঢালেন বাড়ি সংরক্ষণে।

রিপেয়ার চলছে, তবে মিস্ত্রি কাউকে দেখা গেল না। বোধহয় ছুটি এখন। সামনে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি। দোতলার বারান্দাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বারান্দার পাশে সার দিয়ে অজস্র ঘর, গোটা আট-দশ তো হবেই। পাশের দুটো উইং মিলিয়ে আরও গোটা বারো। 

ওদের আসার কথা শিখা বলে রেখেছিল। দিদিমণিকে দেখে কাজের লোক গোপাল ছুটল নীচে গাড়ি থেকে সুটকেস আনতে। এমনিতে গাড়িটা টালিগড়ের বাড়িতেই থাকে, শুধু শিখা কলকাতায় এলে ওর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শিখার বাবা তুঙ্গনাথ বর্মণ গাড়ি চালান না। দাদা ঋদ্ধি আগে গাড়ি খুব ব্যবহার করত। কিন্তু একবার বড়োসড়ো অ্যাক্সিডেন্ট করার পর থেকে তুঙ্গনাথবাবু তার গাড়ি চালানোর অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। এক জন পার্ট-টাইম লোকাল ড্রাইভার আছে, দরকার হলে তুঙ্গনাথ তাকে ডাকেন। ড্রাইভার কাছেই থাকে। 

বাড়িতে কাজের লোক বলতে গোপাল আর এক মাঝবয়সি রাঁধুনি-কল্পনা। এ বাড়িতে গোপাল কাজ করছে অনেকদিন। বাড়ির পেছনে ছোটো আউট হাউসে থাকে। বাড়ির মধ্যে কল্পনার একটা থাকার জায়গা আছে, কিন্তু সাধারণত সেখানে ও থাকে না। সকাল সকাল আসে, আর আটটা নাগাদ পাশের গ্রামে নিজের বাড়ি চলে যায়। এরা ছাড়া এই বিশাল বাড়িতে রয়েছে মাত্র তিনটি প্রাণী-শিখার মা-বাবা আর দাদা ঋদ্ধি। 

শিখার চেয়ে ওর দাদা বছর তিনেকের বড়ো। রিনিতা ভাবল কলকাতা ছেড়ে ঋদ্ধি এই পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছে কেন? শেষে শিখাই সে রহস্য উদ্ঘাটন করল। 

“ঠাকুরদার রক্ত দাদা পেয়েছে। দেদার খরচ করে। ফলে বুঝেছিস তো, অজস্র পাওনাদার। তাদের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছে। তুই আবার টাকা ধার দিতে যাস না ওকে।”

বন্ধুকে এই অদ্ভুত সতর্কবাণী দেওয়ার যৌক্তিকতা শিখার আছে। এর আগে ওর দু-এক জন বন্ধুর কাছে ঋদ্ধি টাকা ধার করেছিল। লজ্জায় পড়ে শিখাকেই পরে সেই দেনা শোধ করতে হয়েছে! এতে বোনের কাছে ঋদ্ধি এতটুকুও লজ্জা প্রকাশ করেনি।

“এর মধ্যে আরও একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে দাদা। বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে বসে আছে।” ফিক করে হেসে শিখা বলল, “হয়তো তার ধার শোধ করতে পারেনি বলেই!”

বিয়ে করেছে! সে তো আনন্দের কথা। শিখা অমন চেপে চেপে বলছে কেন!

“তুই দেখেছিস বউদিকে?”

“না, দেখতে চাইও না। এ বাড়ির কোনো কিছুর সঙ্গেই বেশি জড়াতে নেই। কিছু মনে করিস না, তুই এত বন্ধু বলেই পরিবারের ডার্টি লন্ড্রি খুলে দেখালাম। এখন বুঝতে পারছিস তো, কেন বাড়ি আসতে চাই না! তুই থাকলে জায়গাটা একটু সহনীয় হবে।”

কী বলবে ভেবে না পেয়ে বন্ধুকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করল রিনিতা, “শোন, অনেক সময় ভাই-বোনদের বনে না। কিন্তু তোর বাবা-মা তো আছেন।”

“মা ঠিক আছে, তবে সংসারে থেকেও নেই। একদম নির্লিপ্ত। আর বাবা ইম্পসিবল! শুধু বাড়ি, বাড়ি, আর বাড়ি। মাথায় খালি টাকা জোগাড়ের চিন্তা- সংসারের জন্য নয়, এই বাড়ি কী করে রক্ষা করবেন সেজন্যে! আমরা সব ফালতু। “ ফোঁস করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল শিখা। 

বন্ধুকে তার মা-বাবার ঝামেলা নিয়ে কি মন্তব্য করা যায়! রিনিতা চুপ করে রইল, এ ব্যাপার নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করল না।