উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

একাদশ পরিচ্ছেদ । যুদ্ধ

একাদশ পরিচ্ছেদ । যুদ্ধ

আবার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ!

মৃত্যু-উৎসবে আজ বাজছে ভেরি, বাজছে তুরী, বাজছে শিঙা, বাজছে কত শঙ্খ! রণোন্মত্ত অশ্বদলের হ্রেষা, মদমত্ত হস্তীযূথের বৃংহতি এবং সেইসঙ্গে মহাঘর্ঘর রব তুলে ও রক্তসিক্ত রাঙা কর্দমে দীর্ঘ রেখা টেনে বেগে ছুটছে যুদ্ধরথের পর যুদ্ধরথ! নীলাকাশের বুকে মূর্তিমান অমঙ্গলের ইঙ্গিতের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে শকুনি উড়তে উড়তে পৃথিবীর দিকে ক্ষুধিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখছে, কুরুক্ষেত্রের ধূ-ধূ-ধূ-প্রান্তর জুড়ে সূর্যকরের বিদ্যুৎ সৃষ্টি করেছে হাজার হাজার শাণিত তরবারি, ভল্ল, কুঠার, খড়গ ও লক্ষ লক্ষ তিরের ফলা! থরথর কাঁপছে ধরণীর প্রাণ প্রায় লক্ষ যোদ্ধার প্রচণ্ড পদ-ভারে। ধনুক-টঙ্কারের তালে তালে জাগছে খড়েগ খড়েগ চুম্বন-রব, বীরের হুংকার, সাহসীর জয়ধনি, ক্রুদ্ধের চিৎকার, সেনাধ্যক্ষদের উচ্চ আদেশবাণী, আহতের আর্তনাদ, কাপুরুষের ক্রন্দন! সেই দুই বিপুল বাহিনীর কোনও অংশ ফিরছে বামদিকে, কোনও অংশ ফিরছে ডানদিকে,—অনন্ত জনতাসাগরে যেন তরঙ্গের দল উচ্ছ্বসিত আবেগে জেগে উঠছে ও ভেঙে পড়ছে!

সেদিনের যুদ্ধের সঙ্গে আজকে যুদ্ধের কিছুই মেলে না। আজকের যুদ্ধ হচ্ছে যন্ত্রের যুদ্ধ এবং মানুষের ব্যক্তিগত বীরত্বকে ধর্তব্যেরই মধ্যে গণ্য করে না! আজকের সৈন্যরা লড়াই করে যেন বাতাসের সঙ্গে! নানা যন্ত্র কর্ণভেদী নানা কোলাহল তুলে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় মানুষের দৃষ্টি দিলে অন্ধ করে,—প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেউ কারুকে চোখেও দেখলে না, কিন্তু আহত ও হত দেহের রক্তে রণস্থল গেল আচ্ছন্ন হয়ে এবং যুদ্ধ হল শেষ। মানুষের বীরত্বের উপর স্থান পেয়েছে আজ যন্ত্রের শক্তি। যে পক্ষের যন্ত্র দুর্বল, হাজার হাজার মহাবীর আত্মদান করেও বাঁচাতে পারবে না সে-পক্ষকে।

নিজের পঁয়ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে উচ্চভূমির উপরে চন্দ্রগুপ্ত যে অর্ধচন্দ্র ব্যূহ রচনা করেছিলেন, আজ প্রায় সারাদিন ধরে অর্ধলক্ষ ভারতের শত্রু তা ভেদ করবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। ব্যূহের সামনে হাজার হাজার মৃতদেহের উপরে মৃতদেহ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছে,—সেখানে শত্রু-মিত্র একাকার হয়ে গিয়ে সৃষ্ট হয়েছে যেন মৃত নরদেহ দিয়ে গড়া অপূর্ব ও ভীষণ এক দুর্গপ্রাচীর।

গ্রিক সেনাপতি ও শশীগুপ্ত পাশাপাশি দুই ঘোড়ার উপরে বসে যুদ্ধের গতি নিরীক্ষণ করছিলেন।

গ্রিক সেনাপতি ঊর্ধ্বদিকে তাকিয়ে দেখলেন, সূর্য জ্বলছে পশ্চিম আকাশে।

শশীগুপ্তকে নিজের ভাষায় ডেকে তিনি বললেন, ‘সিসিকোটাস! বেলা পড়ে এল। যুদ্ধ আজ বোধহয় শেষ হবে না।’

শশীগুপ্ত বললেন, ‘সংখ্যায় আমাদের চেয়ে অনেক কম বলে শত্রুরা প্রতি আক্রমণ না করে কেবল আত্মরক্ষাই করছে। ওরা উঁচু জমির উপরে না থাকলে এতক্ষণে যুদ্ধ শেষ হয়ে যেত।’

সেনাপতি দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘কিন্তু এ যুদ্ধ আজকেই শেষ করতে চাই।’

‘কী করে সেনাপতি?’

‘আমাদের ডানপাশে আর বাঁ-পাশে যত গজারোহী অশ্বারোহী আর রথারোহী সৈন্য আছে, সবাইকে মাঝখানে এনে এইবারে আমরা শত্রুব্যূহের মধ্যভাগ আক্রমণ করব।’

‘কিন্তু সেনাপতি, তাহলে আমাদের দুই পাশ যে দুর্বল হয়ে পড়বে!’

‘পড়ুক। বীর গ্রিকদের কাপুরুষ ভারতবাসীরা ভয় করে। ওরা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতি আক্রমণ করবে না।’

উচ্চভূমির উপরে হাতির পিঠে চাণক্য স্থির হয়ে বসেছিলেন পাথরের মূর্তির মতো। তাঁর মুখও স্থির মুখোশের মতো, মনের কোনও ভাবই তা প্রকাশ করে না!

হঠাৎ সুবন্ধু বেগে ঘোড়া চালিয়ে চাণক্যের হাতির পাশে এসে ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘গুরুদেব! গুরুদেব!’

‘বৎস?’

‘শত্রুদের সমস্ত গজারোহী আর অশ্বারোহী, রথারোহী সৈন্য মাঝখানে এসে আমাদের আক্রমণ করবার উদ্যোগ করছে।’

‘সেটা আমি দেখতেই পাচ্ছি!’

‘শত্রুদের ব্যূহের দুইপাশ এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন যদি আমাদের রথ, গজ আর অশ্ব শত্রুদের ব্যূহের দুই পাশ আক্রমণ করে, তাহলে—’

বাধা দিয়ে চাণক্য বললেন, ‘তাহলে আমাদের সুবিধা হতেও পারে, না হতেও পারে। সংখ্যায় আমরা কম—শত্রুদের ঘিরে ফেলবার বা সহজে কাবু করবার শক্তি আমাদের নেই। এ সময়ে আমাদের ব্যূহ বিশৃঙ্খল হলে ভালো হবে না। আমরা কেবল এইখানে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষাই করব।’

‘তবে কি শত্রুদের ঠেকাবার জন্যে আমরাও সমস্ত রথ, গজ আর অশ্বকে মাঝখানে এনে হাজির করব?’

চাণক্যের ওষ্ঠাধরে ফুটল অল্প-হাসির আভাস! বললেন, ‘সুবন্ধু, তুমি বীর বটে, কিন্তু যুদ্ধরীতিতে নিতান্ত কাঁচা! তোমার কথামতো কাজ করলে আমাদেরও দুই পাশ দুর্বল হয়ে পড়বে আর সংখ্যায় বলিষ্ঠ শত্রুরা আমাদের ঘিরে ফেলবে চারিদিক থেকে!’

‘কিন্তু গুরুদেব, শত্রুদের অত রথ, গজ আর অশ্ব যদি আমাদের ব্যূহের মাঝখানে একত্রে আক্রমণ করে, তাহলে আর কি আমরা আত্মরক্ষা করতে পারব?’

‘পারব সুবন্ধু, পারব,—অন্তত আজকের জন্যে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারব। ওই শোনো, রণকুশল চন্দ্রগুপ্তের শঙ্খসঙ্কেত! ওই দেখো, আমাদের যে পাঁচ-হাজার সর্বশ্রেষ্ঠ সৈন্য এতক্ষণ যুদ্ধে যোগ না দিয়ে পিছনে অপেক্ষা করছিল, এইবার তারাও ব্যূহের মধ্যভাগ রক্ষা করতে এগিয়ে আসছে! আরও দেখো, চন্দ্রগুপ্তের আদেশে আমাদের ধনুকধারী সৈন্যেরা ইতিমধ্যেই মাঝখানে এসে প্রস্তুত হয়েছে! সাধু চন্দ্রগুপ্ত, সাধু! তুমি মিথ্যা আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করোনি!’

তবু সুবন্ধুর সন্দেহ ঘুচল না। দ্বিধাভরে সে বললে, ‘কিন্তু—’

‘মূর্খ, এর মধ্যে আর কোনও ‘কিন্তু’ নেই! আমরা আছি উচ্চভূমির উপরে। শত্রুদের রথ, গজ আর অশ্ব এর উপরে দ্রুতগতিতে উঠতে পারবে না। আমাদের ধনুকধারীরা সহজেই দূর থেকে তাদের প্রতি লক্ষ্য স্থির রাখতে পারবে। তির এড়িয়ে যারা কাছে এসে পড়বে, তাদের বাধা দেবে আমাদের নতুন, অক্লান্ত, শ্রেষ্ঠ সৈন্যদল। সুবন্ধু, আকাশের দিকে চেয়ে দেখো! বেলা আছে আর অর্ধপ্রহর মাত্র! এই সময়টুকু কাটিয়ে দিতে পারলেই সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিক ছেয়ে যাবে—আমরাও সময় পাব আর একরাত্রি! তারপর ভরসা তোমাদের রাজা পর্বতক!’ (একাধিক সংস্কৃত বিবরণীতে প্রকাশ, রাজা পর্বতকের সাহায্যেই চন্দ্রগুপ্ত গ্রিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। বৌদ্ধ বিবরণীতেও ওইরকম কথা আছে। Cambridge History of India-র মতে গ্রিকদের ‘পুরু’ই হচ্ছেন ‘পর্বতক’। আধুনিক ঐতিহাসিকরাও এই মত গ্রহণ করেছেন।—লেখক।)

গ্রিক-সেনাপতি বিরক্ত মুখে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলেন, সাগরশৈলের তলদেশে গিয়ে অনন্ত সাগরের প্রচণ্ড তরঙ্গদল যেমন বিষম আবেগে ভেঙে পড়ে আবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে বারংবার, তাঁর গজারোহী রথারোহী ও অশ্বারোহীর দল তেমনি ভাবেই উচ্চভূমির উপরে উঠতে গিয়ে প্রতি বারেই মারাত্মক বাধা পেয়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে! সারথি, যোদ্ধা ও অশ্বহীন কত রথ নিশ্চল হয়ে গ্রিক সৈন্যদলের সামনে বাধা সৃষ্টি করছে, হিন্দুদের অব্যর্থ তিরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে কত হস্তী পাগলের মতো পালিয়ে এসে স্বপক্ষেরই মধ্যে ছুটাছুটি করে শত শত গ্রিক সৈন্যকে পায়ের তলায় থেতলে মেরে ফেলছে! হিন্দু ব্যূহ দুর্ভেদ্য!

পশ্চিম গগনের অস্তাচলগামী সূর্যের পানে তাকিয়ে শশীগুপ্ত হতাশভাবে বললেন, ‘সেনাপতি, আজ যুদ্ধ শেষ হওয়া অসম্ভব!’

মাথা নেড়ে তিক্ত কণ্ঠে গ্রিক সেনাপতি বললেন, ‘না সিসিকোটাস, আজ আমি অসম্ভবকেও সম্ভব করতে চাই! বর্বর ভারত আজও ভালো করে গ্রিক বীরত্বের পরিচয় পায়নি! তুমি এখনই আমার আদেশ চারিদিকে প্রচার করে দাও! আমার ফৌজের ডানপাশ আর বাঁ-পাশও একসঙ্গে অগ্রসর হোক! সর্বদিক দিয়ে আক্রমণ করো, শত্রুদের একেবারে ঘিরে ফ্যালো!’

সেনাপতির মুখের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল, একজন গ্রিক সেনানী ঘোড়ায় চড়ে বেগে কাছে এসে দাঁড়াল।

সেনাপতি বললেন, ‘কী আরিস্টোনটেস? তোমার মুখ মাছের তলপেটের মতো সাদা কেন? তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভয়ানক ভয় পেয়েছ! গ্রিক সেনানীর চোখে ভয়! ব্যাপার কী?’

সেনানী চিৎকার করে বললে, ‘নতুন শত্রু। নতুন শত্রু!’

সেনাপতি কর্কশ স্বরে বললেন, ‘আরিস্টোনটেস, আমি অন্ধ নই! হিন্দু বর্বরেরা যে নতুন সৈন্যদল নিয়ে আমাদের বাধা দিচ্ছে, সেটা আমি দেখতেই পাচ্ছি!’

সেনানী আবার চিৎকার করে বললে, ‘ওদিকে নয়—ওদিকে নয়! আমাদের পিছন দিকে তাকিয়ে দেখুন।’

সচমকে ঘোড়া ফিরিয়ে সেনাপতি মহা বিস্ময়ে দেখলেন, কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে যেখানে গ্রিক সৈন্যরেখা শেষ হয়েছে সেখান থেকে আরও খানিক দূরে আত্মপ্রকাশ করেছে মস্ত একদল পল্টন। দেখতে দেখতে প্রান্তরের শূন্যতা অধিকতর পূর্ণ হয়ে উঠছে এবং সেই বিপুল বাহিনীর আকার হয়ে উঠছে বৃহত্তর! সেই বহুদূরব্যাপী সৈন্যস্রোতের যেন শেষ নেই!

রুদ্ধশ্বাসে সেনাপতি বললেন, ‘সিসিকোটাস, ওরা কারা?—শত্রু না মিত্র?’

শশীগুপ্ত স্তম্ভিত কণ্ঠে বললেন, ‘সেনাপতি, ওরা আমাদের মিত্র নয়! দেখছেন না, ওদের মাথার উপরে উড়ছে মহারাজা পুরুর পতাকা?’

দাঁতে দাঁত ঘষে তীব্রস্বরে সেনাপতি বললেন, ‘বিশ্বাসঘাতক পোরাস!’

শশীগুপ্ত সভয়ে বললেন, ‘দেখুন সেনাপতি! আমাদের পিছনের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করেছে! আবার এদিকেও দেখুন, চন্দ্রগুপ্তের ব্যূহের দুই পাশ থেকে রথারোহী গজারোহী আর অশ্বারোহীর দলও অগ্রসর হয়ে আমাদের দুই পাশ আক্রমণ করতে আসছে। আমরা ফাঁদে ধরা পড়েছি—আর আমাদের বাঁচোয়া নেই!’

নিষ্ফল আক্রোশে কপালে করাঘাত করে গ্রিক সেনাপতি বললেন, ‘মূর্খ, আমরা হচ্ছি মূর্খ! এইবারে বুঝলুম, ওই ভারতীয় বর্বররা কেন এতক্ষণ ধরে কেবল আমাদের আক্রমণ সহ্য করছিল। ওরা এতক্ষণ ধরে পোরাসেরই অপেক্ষায় ছিল। ওরা জানত পোরাস আসছে আমাদের পিছনদিক আক্রমণ করতে! এর জন্যে তুমিই দায়ী সিসিকোটাস! কেন তুমি পোরাসের গতিবিধির উপরে দৃষ্টি রাখবার জন্যে গুপ্তচর নিযুক্ত করে আসনি?’

শশীগুপ্ত বললেন, ‘সেনাপতি, আমার গুপ্তচর আছে অসংখ্য! কিন্তু মহারাজা পুরু যদি তাদেরও চেয়ে চতুর ও দ্রুতগামী হন, তাহলে আমি কী করতে পারি বলুন?’

সেনানী আরিস্টোনটেস ব্যাকুল স্বরে বললেন, ‘সেনাপতি, আমাদের সামনের সৈন্যরাও পালিয়ে যাচ্ছে যে!’

সেনাপতি শূন্যে তরবারি তুলে উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও গ্রিক সৈন্যগণ! শৃগালের ভয়ে সিংহ কোনওদিন পালিয়ে যায় না! ভুলে যেয়ো না, তোমরা গ্রিক! যদি মরতে হয়, গ্রিকদের মতো লড়তে লড়তেই প্রাণ দাও!’

শশীগুপ্ত বললেন, ‘কেউ আর আপনার কথা শুনবে না সেনাপতি, বৃথাই চিৎকার করছেন! আসুন, আমরাও রণক্ষেত্র ত্যাগ করি!’

ভীষণ গর্জন করে গ্রিক সেনাপতি বললেন, ‘স্তব্ধ হও! আমি তোমার মতো দেশদ্রোহী দুরাত্মা নই, তুচ্ছ প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গিয়ে গ্রিসের নাম কলঙ্কিত করব না!’

নীরস হাসি হেসে শশীগুপ্ত বললেন, ‘তাহলে আপনি তাড়াতাড়ি স্বর্গে যাওয়ার চেষ্টা করুন, কিন্তু আমি আরও কিছুদিন পৃথিবীর সুখ ভোগ করতে চাই’—এই বলেই তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে অন্যান্য পলাতকদের দলের ভিতরে মিলিয়ে গেলেন।

আর গ্রিক সেনাপতি? তিনি সদর্পে, উন্নত শিরে, অটলভাবে অশ্বচালনা করলেন চন্দ্রগুপ্তের পতাকার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে।

সূর্য তখন নেমে গিয়েছে দিকচক্রবালরেখার নীচে। তখনও আকাশ আরক্ত এবং তেমনই আরক্ত কুরুক্ষেত্রের মহাপ্রান্তর। পলাতক গ্রিকরা এবং তাদের সঙ্গী দেশদ্রোহী ভারতীয় সৈনিকরা পালিয়েও কিন্তু আত্মরক্ষা করতে পারলে না! এদিক থেকে চন্দ্রগুপ্তের অর্ধচন্দ্রব্যূহের মতো, ওদিক থেকেও পুরুর অর্ধচন্দ্রব্যূহের দুই প্রান্ত যখন মিলিত হয়ে প্রকাণ্ড এক পূর্ণমণ্ডল রচনা করলে, তখন তার মধ্যে যেন বেড়াজালে ধরা পড়ল ভারতের অধিকাংশ শত্রু! তারপরে আরম্ভ হল যে বিরাট হত্যাকাণ্ড, যে বীভৎস বিজয়গর্জন, যে ভয়াবহ মৃত্যুক্রন্দন, পৃথিবীর কোনও ভাষাই তা বর্ণনা করতে পারবে না! কুরুক্ষেত্রের প্রান্তর হয়ে উঠল যেন ছিন্ন হস্ত, ছিন্ন পদ, মুণ্ডহীন দেহ এবং দেহহীন মুণ্ডের বিপুল ডালা!

বহুকালের বিশুষ্ক কুরুক্ষেত্রের তৃষ্ণার্ত বুক আজ অবার রক্তসমুদ্রে অবগাহন করবার সুযোগ পেলে।

পরদিনের জন্যে ভোজসভা প্রস্তুত রইল জেনে আসন্ন অন্ধকারে শকুনির দল বাসার দিকে ফিরে গেল!

মৃত্যু-আহত দিনের ম্লান শেষ আলোকে মৌর্য রাজবংশের ময়ূরচিহ্নিত পতাকা বিজয় পুলকে যেন জীবন্ত হয়ে উঠল।

পতাকার তলায় চাণক্যের চরণে নত হয়ে প্রণাম করলেন যুবক চন্দ্রগুপ্ত!

চাণক্য প্রসন্নমুখে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘বৎস, এ যুদ্ধ চরম যুদ্ধ! নদীর মতো আজ তুমি পাহাড় কেটে বাইরে বেরুলে, এখনও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে বটে, কিন্তু আর কেউ তোমাকে বাধা দিতে পারবে না। অদূর ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করে আজ আমি স্পষ্ট দেখছি, ভারতসাম্রাজ্যের একমাত্র সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে!’