উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

একাদশ পরিচ্ছেদ । একটিমাত্র তিরে কেল্লা ফতে!

একাদশ পরিচ্ছেদ । একটিমাত্র তিরে কেল্লা ফতে!

যেমন হয়, এবারেও তেমনই হল! জুয়াখেলা, মাতলামি, বদমাইশি! নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে, শত শত সাধুর জীবনদীপ নিবিয়ে দিয়ে, দুনিয়ার অভিশাপ কুড়িয়ে বোম্বেটেরা যে টাকা রোজগার করলে, জামাইকা দ্বীপে ফিরে এসে তা দু-হাতে বদখেয়ালিতে উড়িয়ে দিতে তারা কিছুমাত্র বিলম্ব করলে না!

অল্পদিন পরেই দেখা গেল, বোম্বেটেদের পকেট আর বাজে না, তা একেবারেই ফক্কা!

কাপ্তেন মর্গ্যান ছিল চালাক মানুষ। উড়নচন্ডীর পুজো সে করেনি কোনওদিন, খরচ করত বুঝেসুঝে। কাজেই এর মধ্যেই সে এমন দু-পয়সা জমিয়ে ফেলেছিল যে ইচ্ছে করলেই বাকি জীবনটা পায়ের উপরে পা দিয়ে গদিয়ান হয়ে বসে বসে খেতে পারত।

কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা সামান্য ছিল না। সে চায় এমন যশের শিখরে উঠে দাঁড়াতে, যার নাগাল কেউ পাবে না! দুনিয়ায় অনেক ছোট ডাকাত পরে রাজা মহারাজা হয়েছে, সাগরবাসী বোম্বেটেই বা কেন দেশমান্য মহাপুরুষ হতে পারবে না? হয়তো এমনই সব কথাই ভেবে মনটা তার উশখুশ করছিল আবার সাগরে আর সাগরের তীরে তীরে কালবৈশাখীর মতো ছুটে যেতে!

এমন সময়ে এসে ধরনা দিলে তার লক্ষ্মীছাড়া চ্যালাচামুণ্ডার দল!

‘কীহে, খবর কী? মুখ অত শুকনো কেন?’

‘সরদার! আমরা খেতে পাচ্ছি না!’

‘বেশ তো, সেজন্য ভাবনা কী? টাকা রোজগার করো!’

‘আমরা তো সেইজন্যেই তোমার কাছে এসেছি সরদার! আমরা খেতে পাচ্ছি না। আমরা টাকা রোজগার করতে চাই। আমরা আবার সমুদ্রে ভাসতে চাই!’

মর্গ্যান হাসিমুখে বললে, ‘আচ্ছা, তাই হবে। তোমরা প্রস্তুত হও।’

‘আমরা প্রস্তুত। পাওনাদার হতভাগারা ভারি ছোটলোক, তারা এখানে আমাদের আর তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না!’

মর্গ্যান যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল। এবার সে যে-আয়োজনে নিযুক্ত হল, তার আগে পৃথিবীতে আর কোনও পেশাদার বোম্বেটে স্বপ্নেও তা করেছে কিনা সন্দেহ! তার আয়োজনের বিপুলতা দেখলে তাকে আর বোম্বেটে বলেও মনে হবে না। ছোটখাটো লুটপাট বা রাহাজানি যারা করে, পৃথিবী তাদের ডাকাত বলে ডাকে। কিন্তু চেঙ্গিজ খাঁ, তৈমুর লং, আলেকজান্ডার, সিজার, নাদির শা বা নেপোলিয়নকে ডাকাত বলতে সাহস করে না কেউ। এই হিসাবে, মর্গ্যানও আজ বেঁচে থাকলে, তাকে বোম্বেটে বলে ডাকলে হয়তো মানহানির মামলা আনতে পারত!

মর্গ্যানের এবারকার নৌবাহিনীতে জাহাজের সংখ্যা হল সাঁইত্রিশখানা! অ্যাডমিরালের—অর্থাৎ মর্গ্যানের—জাহাজে ছিল বাইশটা প্রকাণ্ড কামান ও ছয়টা ছোট পিতলের কামান। বাকি কোনওখানাতে বিশটা, কোনওখানাতে আঠারোটা, কোনওখানাতে ষোলোটা, এবং সবচেয়ে ছোট জাহাজেও কামানের সংখ্যা ছিল অন্তত চারটে। লোকও গেল অনেক। তাদের নাবিক ও চাকরবাকর ছিল ঢের, কিন্তু তাদের বাদ দিলেও সৈনিক বা বোম্বেটেরা গুণতিতে দাঁড়াল পুরোপুরি দুই হাজার! এবারে মর্গ্যান নিজের দলকে আর বোম্বেটের দল বলতেও রাজি হল না, তার মতে তারা হচ্ছে ইংলন্ডপতির কর্মচারী! যারা ইংলন্ডের রাজার মিত্র নয়, তাদের সঙ্গেই সে নাকি লড়াই করতে যাচ্ছে! ইংলন্ডের রাজার বিনা হুকুমের ও বিনা মাহিনার ভৃত্য হয়ে তারা নিজেদের পাপকার্য অর্থাৎ নরহত্যা, দস্যুতা ও লুণ্ঠনকেও বৈধ বলে প্রমাণিত করতে চলল।

তারপর আরম্ভ হল আগেকার দৃশ্যেরই পুনরাভিনয়—জলে স্পানিয়ার্ড জাহাজ দেখলেই তারা দখল করে, স্থলে স্পানিয়ার্ডদের শহর বা গ্রাম পেলেই লুণ্ঠন করে, বন্দিদের মেরে ফেলে বা মারাত্মক শাস্তি দেয়। সেন্ট কাথারাইন দ্বীপও তারা অধিকার করলে। কিন্তু এসব কথা আর খুঁটিয়ে না বললেও চলবে।

আমরা এখানে বোম্বেটে মর্গ্যানের জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল ঘটনার কথাই বলব—অর্থাৎ পানামা অধিকার।

পানামার নাম জানে না, সভ্য পৃথিবীতে এখন এমন লোক বোধহয় নেই। সকলেই জানেন, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সংযোগস্থলে আছে এই নগরটি। পানামায় তখন ছিল স্পানিয়ার্ডদের প্রভুত্ব, এখন তা স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। পানামা নগরের বর্তমান লোকসংখ্যা ৫৯,৪৫৮।

কিন্তু পানামার পথঘাট বোম্বেটেদের ভালো করে জানা ছিল না। কাপ্তেন মর্গ্যান তখন পানামা অঞ্চলের কোনও ডাকাতকে খুঁজতে লাগল। পৃথিবীতে সাধু খুঁজে পাওয়াই প্রায়ই অসম্ভব ব্যাপার, অসাধুর সন্ধান পাওয়া তো অত্যন্ত সহজ! অবিলম্বেই পানামার তিন ডাকাতকে পাওয়া গেল—নৃশংস ও নিম্নশ্রেণির ডাকাত। লুটের লোভে তারা এক কথাতেই মর্গ্যানের পথপ্রদর্শক হওয়ার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করলে।

পানামায় যেতে হলে চাগ্রে নদীর ধারে একটা দুর্ভেদ্য কেল্লা পার হয়ে যেতে হয়। মর্গ্যান আগে সেই কেল্লাটা দখল করবার জন্যে সৈন্য ও সেনাপতি পাঠিয়ে দিলে। যেমন নেতা, তেমনই সেনাপতি। তার নাম কাপ্তেন ব্রোডলি, এ অঞ্চলে অগুণতি ডাকাতি করে সে দুর্নাম কিনতে পেরেছে যথেষ্ট। তিনদিন পরে সে চাগ্রে দুর্গের কাছে গিয়ে হাজির হল—স্পানিয়ার্ডরা তাকে সেন্ট লরেন্স দুর্গ বলে ডাকত। এই দুর্গটি উঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত—তার চারিদিকে শক্ত পাথরের মতো পাঁচিল। পাহাড়ের শিখরদেশ দুই ভাগে বিভক্ত, মাঝখানে তিরিশফুট গভীর এক খাল। সেই খালের উপরকার টানা সাঁকোর সাহায্যে দুর্গের একমাত্র প্রবেশপথের ভিতরে ঢোকা যায়। বড় দুর্গের তলায় আছে আবার একটা ছোট কিন্তু রীতিমতো মজবুত কেল্লা,—আগে সে কেল্লা ফতে না করে নদীর মুখে প্রবেশ করাই অসম্ভব।

গুণধর বোম্বেটেদের সঙ্গে চোখের দেখা হতেই স্পানিয়ার্ডরা মুষলধারে গোলাগুলি বৃষ্টি শুরু করলে। কেল্লা তখনও মাইল তিনেক তফাতে। পথঘাট ধুলোকাদায় ভরা, চলতে বড় কষ্ট। তবু বোম্বেটেরা দাঁড়াল না, তারা যত এগোয় স্পানিয়ার্ডরা ততই পিছিয়ে যায়। এইভাবে অগ্রসর হয়ে বোম্বেটের দল দুর্গের কাছে খোলা জমিতে এসে পড়ল।

ইতিমধ্যেই তাদের লোকক্ষয় হয়নি বড় কম। কিন্তু এখন তাদের বিপদ আরও বেড়ে উঠল। খোলা জমি, শত্রুপক্ষের গুলির ধারা সিধে তাদের দিকে ছুটে আসছে, কোথাও এমন ঠাঁই নেই যে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করা যায়। সামনেই কামানের সারের পর সার সাজিয়ে খাড়া হয়ে আছে বিরাট ওই দুর্গ, দেখলেই মনে হয় ওকে দখল করা অসম্ভব। এবং এই মুক্ত স্থানে আর অপেক্ষা করাও সম্ভবপর বা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এখন হয় পালানো, নয় আক্রমণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। পালালে অপমান, এগুলেও পরাজয় বা মৃত্যু!

হতাশভাবে গোলোকধাঁধায় পড়ে বোম্বেটেরা অনেকক্ষণ পরামর্শের পর স্থির করল—দুর্গ আক্রমণ করতেই হবে—মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন!…এক হাতে তরবারি ও আর এক হাতে বোমা নিয়ে তারা অগ্রসর হতে লাগল অকুতোভয়ে!

স্পানিয়ার্ডরা দুর্গপ্রাকার থেকে কামান ছুড়ছে, ছুড়ছে আর ছুড়ছেই! বোম্বেটেরা হতাহতের ভিতর দিয়ে পথ করে যখন আরও কাছে এগিয়ে এল, স্পানিয়ার্ডরা তখন চিৎকার করে বললে, ‘ওরে ইংরেজ কুত্তার দল! তোরা হচ্ছিস ভগবান আর আমাদের রাজার শত্রু! আয়, এগিয়ে আয়, তোদের পিছনে যারা আছে তারাও এগিয়ে আসুক! তোদের আর এ যাত্রা পানামায় যেতে হচ্ছে না।’

বোম্বেটেরা কেল্লার পাঁচিলের উপরে ওঠবার চেষ্টা করলে—কিন্তু বৃথা! গরম গরম গোলার ঝড়ে ও গুলির বৃষ্টিতে জীবন্ত সব দেহ মুহূর্তে মৃতদেহে পরিণত হল! তখন সে রাত্রের মতো তারা যুদ্ধে ক্ষান্তি দিয়ে পালিয়ে এল।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার যুদ্ধ আরম্ভ! বোম্বেটেরা বোমা ছুড়ে যখন কেল্লার পাঁচিলকে কাবু করবার চেষ্টা করছে, তখন আশ্চর্য এক কাণ্ড হল! তখন বন্দুকের ব্যবহার আরম্ভ হলেও ধনুকের ব্যবহার একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। স্পানিয়ার্ডরা বন্দুকের সঙ্গে ধনুকও ছুড়ছিল। হঠাৎ একটা তির এসে একজন বোম্বেটের দেহকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলে। কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করেই সে সেই তিরটা নিজের বুকের উপর থেকে একটানে আবার উপড়ে ফেললে। তারপর তার কী খেয়াল হল, খানিকটা তুলো নিয়ে তিরের গায়ে জড়িয়ে সেটা নিজের বন্দুকের নলচের ভিতরে পুরে দুর্গ লক্ষ করে সে গুলি ছুড়লে! গুলির সঙ্গে তিরটাও বন্দুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে দুর্গের ভিরে গিয়ে পড়ল। দুর্গের ভিতরে যেসব বাড়ি ছিল সেগুলোর ছাদ হচ্ছে তালপাতায় ছাওয়া। তিরসংলগ্ন জ্বলন্ত তুলোর গুণে দুই-তিনখানা বাড়ির ছাদে আগুনের শিখা দেখা দিলে। যুদ্ধে ব্যস্ত স্পানিয়ার্ডরা সেদিকে নজর দেওয়ার সময় পেলে না। সকলের অজ্ঞাতসারেই সেই অদ্ভুত উপায়ে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি একরাশ বারুদের স্তূপকে স্পর্শ করলে,—সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ অগ্ন্যুৎপাত, বিষম বারুদ-গর্জন, বহুকণ্ঠের সচকিত চিৎকার ও স্পানিয়ার্ডদের সভয়ে ছুটোছুটি! যুদ্ধ ভুলে সকলেই তাড়াতাড়ি আগুন নেবাবার চেষ্টা করতে লাগল।

বোম্বেটেরা এমন মহা সুযোগ ত্যাগ করলে না, দৈবের অনুগ্রহে আবিষ্কৃত পূর্বকথিত উপায়ে তারা দুর্গের আরও নানা জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি করলে। স্পানিয়ার্ডদের ভয়, কাতরতা ও ব্যস্ততা বেড়ে উঠল—একটা আগুন নেবায় তো আরও দু-জায়গায় দপদপ করে নতুন আগুন জ্বলে ওঠে!

সেই আগুনে অবশেষে অনেক জায়গায় দুর্গের বেড়া উড়েপুড়ে গেল এবং প্রাচীরের বিরাট মৃত্তিকাস্তূপ ধসে নীচেকার খাল ভরাট করে ফেললে! বোম্বেটেরা তার সাহায্যে অনায়াসে খাল পার হয়ে দুর্গের প্রথম প্রাচীরের ভিতরে গিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল।

তবু যুদ্ধ থামল না—গভীর রাত্রে মানুষেরা স্বজাতিকে ধ্বংস করবার জন্যে বন্য পশুর মতো যুঝতে লাগল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোম্বেটেদের কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারলে না। সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হল দেখে বীর স্পানিয়ার্ডরা আত্মসমর্পণের চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় ভেবে দলে দলে জলে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিলে। দুর্গের গভর্নরও জীবন থাকতে আত্মদান করলেন না, বোম্বেটেরা যখন তাঁর দেহ স্পর্শ করতে পারলে তখন তাঁর আত্মা পরলোকে। দুর্গের তিনশো চোদ্দোজন লোকের মধ্যে জ্যান্ত অবস্থায় পাওয়া গেল মাত্র তিরিশজন লোক—তাদের মধ্যেও কুড়িজন আহত। কেবল নয়জন লোক পানামার গভর্নরের কাছে খবর দিতে গেছে—বাকি সবাই মৃত! বোম্বেটেদেরও ক্ষতি বড় সামান্য নয়। তাদের একশোজন হত ও সত্তরজন আহত হয়েছে।

জীবিত স্পানিয়ার্ডরা শারীরিক যন্ত্রণার চোটে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, পানামার গভর্নর বোম্বেটেদের আগমনের সব খবরই আগে থাকতেই পেয়েছেন এবং আগে থাকতেই তাদের ভালো করে অভ্যর্থনা করবার জন্যে দস্তুরমতো প্রস্তুত হয়ে আছেন। চাগ্রে নদীর ধারে সর্বত্রই তাঁর সৈন্যরা অপেক্ষা করছে এবং সর্বশেষে তিনিও অপেক্ষা করছেন তিন হাজার ছয়শো সৈন্য নিয়ে।

অতঃপর বোম্বেটেদের উচ্চ জয়ধ্বনির মধ্যে কাপ্তেন মর্গ্যান তার বাকি বারোশত সৈন্য নিয়ে দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করলে। পানামা বিজয়ের পথের কাঁটা দূর হয়েছে। সকলের মুখেই হাসি আর ধরে না।

যে একশো বোম্বেটে অর্থলোভে সেখানে প্রাণ দিলে, জীবিত সঙ্গীদের মুখের হাসি দেখবার সুযোগ তাদের দেহহীন আত্মারা সেদিন পেয়েছিল কিনা কে জানে!