একাদশ অধ্যায় । যবনিকা
পারস্যে উপস্থিত হয়েই আলেকজান্ডার খবর পেলেন, ভারতের গ্রিকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ আরম্ভ হয়েছে এবং তাঁর নিযুক্ত শাসনকর্তা ফিলিপস নিহত! কিন্তু যে সাংঘাতিক অগ্নিপরীক্ষার ভিতর দিয়ে তাকে ভারত ত্যাগ করতে হয়েছে, তার ফলে তিনি এখন শক্তিহীন, সৈন্য পাঠিয়ে বিদ্রোহ দমন করবার কোনওই উপায় নাই। এর পরেও আর তিনি ভারতের দিকে দৃষ্টি ফেরাবার অবসর পাননি। এর অল্পদিন পরেই চন্দ্রগুপ্তের শৌর্যবীর্যের মহিমায় ভারত আবার গ্রিকদের হাতছাড়া হয়। আলেকজান্ডার জীবিত থাকলে খুব সম্ভব চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে তাঁর একবার শক্তি পরীক্ষা হত এবং পৃথিবীর ইতিহাসে সেটা হত একটা চিরস্মরণীয় ঘটনা! দুই প্রতিভার সংঘর্ষ!
পারস্যে ফিরে আলেকজান্ডার আবার তাঁর পরিকল্পনাকে মূর্তি দেবার চেষ্টা করলেন। কতক কথা আগে বলা হয়েছে।
ভারতে তিনি যেমন মহারাজা পুরুর হস্তে নিজের জয় করা রাজ্যগুলি সমর্পণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি, পারস্যের অভিজাত ব্যক্তিগণকেও তেমনি নানা দেশের কর্তৃত্বভার দান করলেন—এমনকী, গ্রিক শাসনকর্তাদেরও পদচ্যুত করে!
এবং যে নতুন ও উন্নত যুদ্ধবিদ্যার জন্যে আজ তিনি পৃথিবীতে অজেয়, প্রায় তিরিশ হাজার পারসি যুবককে নির্বাচন করে অসঙ্কোচে নিয়মিত ভাবে সেই সামরিক শিক্ষা প্রদান করতে লাগলেন। নিজের দেহরক্ষী অশ্বারোহী সৈন্যদলের মধ্যেও তিনি পারসি রাজকুমারদের গ্রহণ করতে ভীত হলেন না।
চিরশত্রু পারসিদের সম্বন্ধে আলেকজান্ডারের এই আশ্চর্য মত পরিবর্তন দেখে গ্রিক সেনাপতি ও তাঁর পুরাতন বন্ধুগণ বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলেন। বলা বাহুল্য, তাঁরা খুশিও হলেন না। এমনকী, তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত হল।
গ্রিকরা আলেকজান্ডারের উদার আদর্শের মর্ম গ্রহণ করতে পারলে না। তিনি সেই প্রাচীন যুগেই চেয়েছিলেন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের পার্থক্য ঘুচিয়ে দিতে—আজকের এই মৌখিক সাম্যবাদের যুগেও ইউরোপ যা করতে পারছে না। তাঁর এই চেষ্টার জন্ম নিশ্চয়ই বহু চিন্তার ফলে। তাঁর স্বল্পস্থায়ী জীবন শেষের দিকে যত এগিয়ে গিয়েছিল, এদিকে তাঁর ঝোঁক উঠেছিল ততই স্পষ্টতর হয়ে। তিনি আরও কিছুকাল বেঁচে থাকলে তাঁর চেষ্টার শেষ ফল কোন আকার ধারণ করত, আজও আমরা তা অনুমান করতে পারি না। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র বুদ্ধি যেখানে পঙ্গু, প্রতিভা সেখানে কী না করতে পারে!
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দের বসন্তকালে আলেকজান্ডার পারস্য থেকে গেলেন বাবিলনে। সেখানে বসেও তাঁর চিত্ত ব্যস্ত হয়ে রইল আবার স্থলপথে ও জলপথে নব নব অভিযানের স্বপ্ন নিয়ে। তখনকার অন্যতম প্রধান সভ্যদেশ ছিল কার্থেজ, হয়তো সেখানে যাবার ইচ্ছাও তাঁর ছিল। আপাতত—অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে—তাঁর দৃষ্টি পড়ল আরব দেশের উপরে।
কিন্তু পৃথিবীর কোনও দিগবিজয়ীই যাকে জয় করতে পারেনি, সেই মৃত্যুর দৃষ্টি পড়ল তাঁর উপরে। আরব-অভিযানের আয়োজন যখন প্রায় শেষ হয়েছে, আলেকজান্ডার হঠাৎ জ্বরে শয্যাগ্রহণ করলেন। এই শয্যাই তাঁর শেষ শয্যা।
একটি ভোজসভায় যোগ দেবার পরই তিনি শয্যাশায়ী হন। সেকালে এমন আচম্বিতে কেউ পীড়িত হয়ে পড়লেই লোকে সন্দেহ করত, বিষপানের ফল। তাই আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরেও গুজব রটেছিল, বিষের দ্বারা তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি, পুত্রভক্ত জননী ওলিম্পিয়াসও শোকে পাগলের মতো হয়ে কল্পিত হত্যাকারীদের উপরে নিয়েছিলেন ভীষণ প্রতিশোধ। কিন্তু আসলে তাঁর মৃত্যু হয় ম্যালেরিয়া বা ওই জাতীয় কোনও জ্বরে।
মৃত্যুর আগেকার একটি দৃশ্যে দেখি, আলেকজান্ডার জ্বরের ঘোরে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন। নৌসেনাপতি নিয়ার্চাস শয্যার পাশে বসে প্রভুর মনকে প্রফুল্ল করবার জন্যে নানা সমুদ্রের ও দেশ-বিদেশের গল্প শোনাচ্ছেন—কিন্তু বৃথা! আলেকজান্ডার প্রলাপ বকতে আরম্ভ করলেন।
মাঝে মাঝে প্রলাপ থামে। রোগীর জ্ঞান হয়।
এমনি এক সময়ে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘আপনার সন্তান নেই। সাম্রাজ্যের ভার কাকে দিয়ে যাবেন?’
আলেকজান্ডার উত্তর দিলেন। ‘সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে।’
তারপর দেখি, দিগবিজয়ী বীর শয্যায় স্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর বাঁচবার আশা নেই, কথা কইবারও শক্তি নেই। তাঁর বহু অভিযানের সেনাপতিরা ঘরের ভিতরে ঢুকছেন একে একে। আবেগ ভরে একবার করে তাঁর হাত চেপে ধরছেন, একবার তাঁর চোখে চোখ রেখে দৃষ্টি বিনিময় করছেন, তারপর আবার যাচ্ছেন বিষণ্ণ মুখে বাইরে বেরিয়ে।
…প্রাচীন বাবিলনের প্রান্তরে সূর্য নামল অস্তাচলে—সঙ্গে সঙ্গে আলেকজান্ডারেরও জীবন-সূর্য হল অস্তমিত (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দের ১৩ই জুন তারিখে)। তেরো বৎসর আগে তিনি মাসিডন ত্যাগ করে বেরিয়েছিলেন পৃথিবী জয়ের অভিযানে। তারপর তিনি আর স্বদেশে ফেরেননি এবং দেশে ফেরবার জন্যে কখনও যে কাতর হয়েছিলেন এমন কোনও প্রমাণও নেই। হয়তো তাঁর মতন মহামানুষের পক্ষে সমস্ত পৃথিবীই ছিল স্বদেশ।
মাত্র তেত্রিশ বৎসর বয়সে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়।
অনেক দিন পরেকার কথা। গ্রিস তখন পতিত; রোম তখন উন্নতির উচ্চশিখরে। রোমের জুলিয়াস সিজারের বয়স তখন তেত্রিশ!
একদিন সিজার বসে বসে একখানি বই পড়ছেন। বইখানি হচ্ছে দিগবিজয়ী আলেকজান্ডারের জীবনচরিত।
হঠাৎ দেখা গেল, সিজার বইখানি মুড়ে রেখে কাতর ভাবে কেঁদে ফেললেন।
জিজ্ঞাসা করা হল, ‘আপনি কাঁদছেন কেন?’
সিজার বললেন, ‘তেত্রিশ বৎসর বয়সে আলেকজান্ডার যা কিছু করবার, সব করে ফেলেছেন। আমি কিন্তু আজ পর্যন্ত কিছুই করতে পারিনি। তেত্রিশ বৎসর নয়, তেরো বৎসর। আলেকজেন্ডার যা কিছু করবার, তেরো বছরের ভিতরেই করেছিলেন।
আমরা মাঝে মাঝে আলেকজান্ডারের চরিত্রের রহস্য ব্যাখ্যা করে বোঝবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যাখ্যার দ্বারা এমন মানুষকে ঠিক ভাবে বোঝানো অসম্ভব।
অমর দার্শনিক আরিস্টটল, শিষ্য আলেকজান্ডারকে দিয়েছিলেন দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষা। কিন্তু দার্শনিক শিক্ষার পরিণাম কি যুদ্ধক্ষেত্রে দিগবিজয়? আলেকজান্ডারের কীর্তির কথা শুনে সে যুগে আরিস্টটলের চেয়ে অবাক বোধহয় আর কেউ হননি। তিনি বুঝতে পারেননি নিজের শিষ্যকেও।
আলেকজান্ডার যখন বালক, তখন ফিলিপের রাজসভায় এসেছিলেন এক পারসি রাজদূত।
কী দেখে জানি না, সেই সময়ে তিনি ভবিষ্যদবাণী করেছিলেন, ‘রাজা ফিলিপের চাতুর্যের কথা সকলেই জানে। কিন্তু আলেকজান্ডারের প্রতিভা তাঁর পিতার চাতুর্যকেও নিষ্প্রভ করে দেবে।’
কিন্তু ওই পারসি রাজদূতও কি আলেকজান্ডারকে বুঝতে পেরেছিলেন?
এবং আলেকজান্ডার নিজেও কি নিজেকে বুঝতে পেরেছিলেন?
এইটেই হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন!