একাদশ । দিল্লি
সমরখন্দের আমির তৈমুর,—যাঁর রক্তাক্ত তরবারির সামনে হৈম সংঘ, পারস্য, আফগানিস্তান ও মেসোপটেমিয়ার পতন হয়েছে, তিনিই আসছেন আজ একতাহীন, শৃঙ্খলাহীন, শক্তিহীন, প্রায় অরাজক ভারতবর্ষের রত্নভাণ্ডার লুণ্ঠন করতে!
দুর্বল দিল্লিশ্বর নাসিরুদ্দিনের সিংহাসনই কেবল কেঁপে উঠল না, উত্তর-পশ্চিম ভারতের সমস্ত হিন্দু-মুসলমানের প্রাণও কেঁপে উঠল দুরু দুরু করে। কারণ তৈমুরের কীর্তি-কাহিনি কারুরই অজানা ছিল না। তৈমুর—তৈমুর! ভগবানের চাবুক তিনি, প্রহার করেন নির্বিচারে, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিশ্চান সকলকেই বলি দিয়ে দেশে দেশে তিনি নরমুণ্ডের পিরামিড রচনা করেছেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নৃশংসেরও চেয়ে নৃশংস! গজনির মামুদের সংহার মূর্তি ভারতবর্ষ তখনও ভুলতে পারেনি, সুতরাং তৈমুরের নামে লোকের হৃৎকম্প হওয়া আশ্চর্য নয়।
পৌত্র পির মহম্মদ মুলতান দখল করলেন। কিছুদিন পরে তৈমুরও করলেন তাঁর সঙ্গে যোগদান। তারপর নব্বই হাজার তাতার অশ্বারোহী নিয়ে অগ্রসর হতে লাগলেন—লক্ষ্য তাঁর দিল্লি।
কিন্তু ভারতবর্ষ দুর্বল হলেও দিল্লির পথ নিষ্কন্টক হল না। মুসলমান, রাজপুত ও জাট-নায়করা নানাস্থানে এই বিদেশি দিগবিজয়ীকে বাধা দেওয়ার জন্যে দলবদ্ধ হলেন, কিন্তু তাঁরা কেউই আত্মরক্ষা করতে পারলেন না। পাক-পাটান, দীপালপুর, শিরা, ফতেবাদ ও তোহানা প্রভৃতি স্থানে যেখানেই অস্ত্রে অস্ত্রে সংঘাত বাধল, ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের রক্তধারায় মাটি হয়ে উঠল পিচ্ছিল। কত শহর ও গ্রাম পরিণত হল সমতল ক্ষেত্রে, বাসিন্দাদের নিক্ষেপ করা হল নগ্ন অস্ত্রের মুখে, চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে গেল আগুন ও ধোঁয়ায়! হাজারে হাজারে কাতারে কাতারে লোক ছুটে চলল দিল্লির দিকে—হতভাগ্যরা ভাবলে, পালিয়ে তারা ভগবানের চাবুককে ফাঁকি দিতে পারবে!
যুদ্ধ যা হল তা নামেমাত্র যুদ্ধ, তৈমুরের সামনে কেউ দাঁড়াতেও পারলে না, সুতরাং এসব যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েও লাভ নেই। অধঃপতিত ভারতবর্ষের পঙ্গু পুরুষত্বের গগনভেদী আর্তনাদ ক্রমে দিল্লির কাছ পর্যন্ত গিয়ে হাজির হল।
দিল্লীশ্বরের ডান হাতের মতন ছিলেন তখন মাল্লু খাঁ। কিছু সৈন্য সংগ্রহ করে তিনি দিল্লি থেকে বেরিয়ে তৈমুরকে বাধা দিতে এলেন।
এর পর যে বিয়োগান্ত দৃশ্যের অভিনয় হল তা বড়ই মর্মন্তুদ। তৈমুরের সঙ্গে ছিল একলক্ষ হিন্দু বন্দি। দিল্লির সৈন্যেরা আসছে শুনে নির্বোধরা আনন্দ প্রকাশ না করে থাকতে পারলে না।
তৈমুর ভাবলেন, এক লক্ষ সক্ষম বন্দি বিদ্রোহী হলে বিশেষ বিপদের সম্ভাবনা। তিনি তখনই হুকুম দিলেন, ‘ওদের সকলকে হত্যা করো।’
সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত অস্ত্রে অস্ত্রে হল ঝকমক বিদ্যুৎ সঞ্চার এবং দেখতে দেখতে এক লক্ষ মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল রক্তরাঙা মাটির উপরে। তাদের কাতর কান্না আজও জেগে আছে ভারতের প্রাণে।
ইতিমধ্যে মাল্লু খাঁ আবার পশ্চাৎপদ হয়ে দিল্লির ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।
এর পর দুই পক্ষই চরম যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল।
তাতার সৈন্যরা আবার ভয় পেলে, কারণ তারা দেখলে তাদের বিরুদ্ধে দলে দলে হাতি প্রস্তুত হচ্ছে। সেইসব অদ্ভুত, বিরাটদেহ জীবের শুঁড়ে শুঁড়ে বাঁধা নগ্ন তরবারি এবং তাদের পৃষ্ঠদেশে ছোটখাটো দুর্গের মতন সৈনিকে পরিপূর্ণ হাওদা। তাদের বিশ্বাস হল, এদের সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব।
সঙ্গের জ্যোতিষীরা গ্রহ-নক্ষত্র বিচার করে বললেন, ‘হুজুর, মানুষ কখনও এমন আজগুবি জানোয়ারের সামনে দাঁড়াতে পারে না।’
তৈমুর অটল। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর তারিখে তিনি সসৈন্যে যমুনা নদী পার হয়ে ব্যূহ সাজাতে লাগলেন। হাতিদের বাধা দেওয়ার জন্যে ব্যূহের সামনে স্থাপন করলেন পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা দলে দলে মহিষ।
দিল্লিশ্বর নাসিরুদ্দিন ও তাঁর যোদ্ধা মন্ত্রী মাল্লু খাঁয়ের সঙ্গে ছিল মাত্র চল্লিশ হাজার পদাতিক ও দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য।
তাতাররা বুঝলে সংখ্যায় তারা দ্বিগুণ। সুতরাং তাদের উৎসাহ বেড়ে উঠল।
ভারতীয় সৈনিকরা আক্রমণ করলে। নিপুণ সেনাপতি তৈমুরের আদেশে তাতারদের দক্ষিণ পাশের সেনাদল ভারতীয়দের বামপাশ ক্রমে ক্রমে ঘিরে ফেলে পিছন দিকে গিয়ে হাজির হল। তখন ভারতীয়রা আক্রান্ত হল একসঙ্গে সম্মুখ ও পিছন থেকে।
ভারতের পক্ষে ফল হল মারাত্মক। দিল্লীশ্বরের সমস্ত সৈন্য প্রাণভয়ে পৃষ্ঠভঙ্গ দিতে দেরি করলে না। এমনকি যাদের জন্যে এত দুর্ভাবনা, সেই হাতির দলও পালিয়ে গেল ভীত গোরুর মতন।
পরদিনই তৈমুর দিল্লি নগর অধিকার করলেন।
যুদ্ধ থেমে গেল বটে, কিন্তু দিল্লির বিষের পাত্র তখনও পূর্ণ হল না।
বিজয়ী ও দাম্ভিক তাতারদের দুর্ব্যবহারে উত্যক্ত ও মরিয়া হয়ে দিল্লির হিন্দু বাসিন্দারা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে। বহু পরিবারের হিন্দু নারীরা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে দিলেন আত্মাহুতি এবং পুরুষরা মৃত্যুপণ করে তরবারি হাতে নিয়ে তাতারদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দিল্লির পথে পথে জাগল যোদ্ধাদের সিংহনাদ ও আর্তনাদ। কিন্তু অসংখ্য তাতারি সৈনিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নাগরিকরা প্রাণদান ছাড়া আর কিছুই করতে পারলে না। দিল্লির পথে পথে সাজানো হল নরমুণ্ডের পিরামিড। বাকি হিন্দুরা হল বন্দি। কথিত আছে, এমন তাতারি ছিল না, যে অন্তত বিশজন হিন্দু গোলাম সংগ্রহ করেনি।
পনেরো দিন ধরে দিল্লি লুট করে অগাধ ঐশ্বর্যের মালিক হয়ে তৈমুর স্বদেশের দিকে যাত্রা করলেন। যাত্রাপথে তৈমুরকে প্রায় প্রতিদিনই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতে হল। মীরাট, হরিদ্বার, কাংগ্রা ও জামু প্রভৃতি স্থানে তিনি যে কত হিন্দু সংহার করলেন, তার হিসাব থাকলে পৃথিবী আজও শিউরে উঠত। বেশ বোঝা যাচ্ছে, মুসলমানের চেয়ে হিন্দুরাই তৈমুরকে বেশি বাধা দিয়েছিল। তৈমুর অসংখ্য ভারতীয় শিল্পী ও কারিগরকেও বন্দি করে নিয়ে গেলেন—সমরখন্দে উচ্চশ্রেণির শিল্পীর অভাব ছিল বলে।
ঐতিহাসিকরা বলেন, একবারমাত্র যুদ্ধযাত্রা করে তৈমুর ভারতবর্ষকে যতটা দুর্দশাগ্রস্ত করে গিয়েছিলেন, ততটা আর কেউ পারেনি; এদিক দিয়ে গজনির কুবিখ্যাত দস্যু ও হত্যাকারী মামুদ পর্যন্ত তাঁর কাছে ম্লান হয়ে পড়বেন।
তৈমুরের পিছনে পড়ে রইল মরুভূমির মতন দীন উত্তর ভারতবর্ষ। সমস্ত দেশ জুড়ে জাগল দুর্ভিক্ষ ও মড়কের হাহাকার, পথ-ঘাট-মাঠ ছেয়ে রইল লক্ষ লক্ষ কাঙালে, নগরের পর নগর হয়ে গেল ভারতের বুক থেকে অদৃশ্য। এমনকী দিল্লি নগরও পড়ে রইল বিরাট এক ধ্বংসস্তূপের মতন—শহরের ভিতরে মানুষের বসবাস রইল না বললেও চলে। ইতিহাসে পড়ি, তৈমুরের প্রস্থানের পর দীর্ঘ দুই মাসের ভিতরে দিল্লি নগরে একটিমাত্র পাখিকেও উড়তে দেখা যায়নি!
কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মত হচ্ছে, সমগ্র এশিয়ার একেশ্বর হওয়ার জন্যে তৈমুরের বাসনা ছিল যে, তখনকার প্রাচ্যদেশের সর্বপ্রধান সাম্রাজ্য চিনকেও তিনি অধিকার বা বশীভূত করবেন। চিনে যাওয়ার পথের পাশেই পড়ে উত্তর ভারতবর্ষ। পিছনে বা পাশে শত্রু রেখে পাছে তাঁকে বিপদগ্রস্ত হতে হয়, সেই ভয়েই আগে থাকতে ভারতকে তিনি পঙ্গু করে রাখলেন। এবং জয়ী হয়েও ভারতের অন্যান্য প্রদেশের দিকে দৃষ্টিপাত না করে স্বদেশে ফিরে গেলেন। কারণ যা-ই হোক, তৈমুরের ভারত আক্রমণ যে তাঁর যোদ্ধা-জীবনের একটি সংক্ষিপ্ত অধ্যায় মাত্র, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২০মে তারিখে আমির তৈমুর সমরখন্দে ফিরে এলেন এবং তার এক হপ্তা পরেই দেখি, ভারত-বিজয়কে স্মরণীয় করবার জন্যে তিনি এক বিরাট মসজিদ প্রতিষ্ঠায় নিযুক্ত হয়েছেন। অন্তত দুই লক্ষ নরহত্যা করে তিনি যে দেশে ফিরে এসেছেন, এজন্যে তাঁর মনে একটিও দুঃখের রেখা পড়ল না, সমস্ত যুদ্ধবিগ্রহ ও রক্তপাতের কথা ভুলে তিনি তাঁর মসজিদকে অপূর্ব করে তোলবার উপায় চিন্তা করতে লাগলেন।
মসজিদের বাইরের দেওয়াল যখন সম্পূর্ণ হল, ভিতরের সূক্ষ্ম কারুকার্যের জন্যে তখন নিযুক্ত করা হল ভারত থেকে বন্দি করে আনা দুই শত শিল্পীকে। মাত্র তিন মাসের মধ্যেই তারা গড়ে ফেললে চারি শত আশিটি পাথরের থাম, ভিতরদিককার ছাদ ও অলংকৃত পিতলের দরজাগুলি। মসজিদ নির্মাণ সমাপ্ত!
হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল, সমরখন্দের ক্ষুদ্র বাজার রাজধানীর উপযুক্ত নয় এবং বাজারে আনাগোনা করবার পথটিও বড়ো সংকীর্ণ। তখনই তিনি হুকুম দিলেন—’বড় করে তোলো বাজারকে, তৈরি করো দীর্ঘ ও চওড়া একটি রাজপথ! সময় দিলুম বিশ দিন।’
যথাসময়ে হুকুম তামিল করবার লোকের অভাব হল না। তৈমুরের হুকুম—যমের হুকুম।
আমির তৈমুরের বয়স এখন চৌষট্টি বৎসর। যদিও তাঁর দেহ আগেকার মতোই বলিষ্ঠ আছে, তবু মাঝে মাঝে এখন তিনি পীড়িত হয়ে পড়েন। এখন তাঁর বিশ্রাম করবার সময়, কিন্তু বিশ্রাম সহ্য হয় না তাঁর ধাতে। আজও তিনি সেই দৃপ্ত তৈমুর—একা যিনি শত্রু-দুর্গের সিংহদ্বারের সামনে ছুটে গিয়েছিলেন দ্বন্দ্বযুদ্ধ করবার জন্যে। কেউ যুদ্ধে আহ্বান করলে এখনও তিনি শান্ত ও নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকতে পারেন না।
এশিয়া মাইনর থেকে তাঁর সামন্ত রাজাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর পুত্রদের অধীনস্থ দেশে নতুন নতুন শত্রুর আবির্ভাব হয়েছে। বোগদাদ নগর শত্রুর করতলগত হয়েছে। এসব হচ্ছে নতুন যুদ্ধের আহ্বান!
তৈমুর সাড়া দিতে কালবিলম্ব করলেন না। দেশে ফেরবার চার মাস পরেই আবার তিনি করলেন যুদ্ধযাত্রা। সমরখন্দ তিন বছর তাঁর মুখ দেখতে পেলে না।