একাদশ। দিগ্বিজয়
হর্ষ যদিও রাজ-উপাধি গ্রহণ করে রাজপুত্র শিলাদিত্য নামে পরিচিত হলেন, তবু তাঁর রাজ্যকাল গণনা করা হয় রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর থেকেই (৬০৬ খ্রিঃ)।
রাজশ্রীদেবীর উপরে প্রতিনিধি-নৃপের কর্তব্যভার অর্পণ করে হর্ষ হলেন অনেকটা নিশ্চিন্ত। রাজশ্রী ললিতকলার ও শাস্ত্রালোচনার যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বৌদ্ধধর্মেও বিশেষরূপে শিক্ষিতা। তাঁর এই বৌদ্ধধর্মানুরাগ হর্ষকেও বড় কম প্রভাবান্বিত করেনি। তিনি নিজে শৈব ও সূর্যোপাসক ছিলেন। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত না হয়েও তিনি হিন্দুর চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন বৌদ্ধদেরই।
দিদির হাতে রাজদণ্ড দিয়ে হর্ষ স্বহস্তে ধারণ করলেন শাণিত তরবারি। কেবল শশাঙ্ককে পরাজিত ও বিতাড়িত করেই তিনি তুষ্ট হতে পারলেন না, মুক্তকণ্ঠে চারিদিকে প্রচারিত করে দিলেন, ‘সমগ্র আর্যাবর্তকে আমি আনব বিপুল একচ্ছত্রের ছায়ায়। আমার আদর্শ নেবেন মহারাজাধিরাজ চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত ও যশোবন্তদেব। বহু খণ্ডে খণ্ডিত উত্তরাপথ ধাপে ধাপে নেমে যাচ্ছে চরম অধঃপতনের দিকে, শিয়রে তার সর্বদা জাগ্রত হয়ে রয়েছে যবন ও হুন দস্যুদের শনির দৃষ্টি! ছোট ছোট রাজারা পরস্পরের সঙ্গে আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধে নিযুক্ত হয়ে আর্যদের ক্ষাত্রবীর্যকে ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছেন ধ্বংসের মুখে! আর্যাবর্তকে আবার অখণ্ড করে তুলতে হলে তথাকথিত রাজাদের নির্মমভাবে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে তুচ্ছ আগাছার মতো। যত দিন না এই মহান ব্রত উদযাপন করতে পারি, তত দিন আমার তরবারিকে করব না কোশবদ্ধ। স্বদেশের জন্যে যাঁর এতটুকু প্রাণের টান আছে, তাঁকেই আমি সাদরে আমন্ত্রণ করছি আমার পতাকার তলায়।’
হর্ষবর্ধনের এই দৃপ্ত আহ্বানবাণী শ্রবণ করে আর্যবীরদের বুকের ভিতর আবার নতুন করে জেগে উঠল দেশাত্মবোধের উত্তপ্ত মত্ততা। দেশ-দেশান্তর থেকে একে একে নয়—দলে দলে যোদ্ধারা এসে যোগ দিতে লাগল তাঁর বাহিনীতে! যশোধর্মদেবের বহুকাল পর আবার এক তরুণ আর্যবীর দিগবিজয়ের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন, তা তাঁর সঙ্গীর অভাব হল না।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, কীরকম সৈন্য নিয়ে হর্ষবর্ধন যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর অন্যত্র আর একবার দিয়েছি, এখানে তারই দ্বিরুক্তি না করে উপায় নেই।
৩২৭ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে গ্রিক আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেছিলেন, তখন থেকে ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় রাজাদের ফৌজ গঠনের পদ্ধতি ছিল প্রায় অপরিবর্তিত।
মৌর্য চন্দ্রগুপ্ত তাঁর বাহিনীকে ছয় ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। পরিচালনার জন্যে তিনি প্রধান কর্মচারী রেখেছিলেন তিরিশ জন—অর্থাৎ প্রত্যেক বিভাগে পাঁচজন করে। বিভাগগুলি এই :
১। নৌ-বিভাগ। ২। রসদ-বিভাগ (মাল চালান দেবার, দামামা বাদক, সহিস, কারিগর ও ঘেসেড়া প্রভৃতিরও খোরাকের জন্য ভালো বন্দোবস্ত ছিল)। ৩। পদাতিক বিভাগ। ৪। অশ্বারোহী বিভাগ। ৫। গজারোহী বিভাগ। ৬। রথারোহী বিভাগ।
ভারতীয় ফৌজ চিরকালই পদাতিক, অশ্বারোহী, রথারোহী ও গজারোহী—এই চার অঙ্গ নিয়ে গঠিত হত। চন্দ্রগুপ্তের প্রতিভা এই সঙ্গে অতিরিক্ত আরও দুটি অঙ্গ জুড়ে দিয়েছিল—নৌ ও রসদ বিভাগ। হয়তো গ্রিক ফৌজ পর্যবেক্ষণ করে এই দুইটি অঙ্গের প্রয়োজনীয়তা তিনি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।
গ্রিক ঐতিহাসিক প্লিনি বলেন, ভারতীয় ফৌজের প্রত্যেক রথে থাকত সারথি ও দুজন করে যোদ্ধা এবং প্রত্যেক হাতির উপর থাকত মাহুত ও তিনজন করে ধনুকধারী!
চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী চাণক্যের মত ছিল, ফৌজের পক্ষে সব চেয়ে দরকারি হচ্ছে, রণহস্তীরা। কারণ, শত্রু-সৈন্য ধ্বংস করা যায় তাদের দ্বারাই (মধ্যযুগের দিগবিজয়ী তৈমুর লং যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন, ভারতীয় রাজা-বাদশাহরা তখনও রণহস্তী ব্যবহার করতেন। কিন্তু তিনি এক নতুন কৌশল অবলম্বন করে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন হাতিদের সার্থকতা। তার ফলে ভারতীয় ফৌজের রণহস্তীরা হয়ে উঠত ভারতীয়দের পক্ষেই অধিকতর বিপজ্জনক)।
চন্দ্রগুপ্তের প্রত্যেক অশ্বারোহীর কাছে থাকত একখানা করে ঢাল ও দুটি করে বল্লম। পদাতিকদের প্রধান অস্ত্র ছিল চওড়া ফলকওয়ালা তরবারি এবং অতিরিক্ত অস্ত্ররূপে তারা সঙ্গে নিত শূল বা ধনুকবাণ। আমরা এখন যেভাবে বাণ ছুড়ি, তারা সেভাবে ছুড়ত না। গ্রিক ঐতিহাসিক এরিয়্যান বলেন, ভারতীয় সৈনিকরা ধনুকের এক প্রান্ত মাটির উপরে রেখে, বাম পায়ের চাপ দিয়ে এমন ভয়ানক জোরে বাণ ত্যাগ করত যে, শত্রুদের ঢাল ও লৌহবর্ম পর্যন্ত কোনও কাজে লাগত না। বোঝা যাচ্ছে, সেকালের ভারতীয় ধনুক হত আকারে রীতিমতো বৃহৎ।
হর্ষবর্ধনের যুগেও ভারতীয় বাহিনী যে প্রায় ওই ভাগেই গঠন করা হত, এটুকু অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু তিনি ভারতীয় বাহিনীর চতুরঙ্গ থেকে বাদ দিয়েছিলেন প্রধান একটি অঙ্গ। যে কারণেই হোক, তিনি রথারোহী সৈন্য পছন্দ করতেন না, তাঁর সঙ্গে রথ থাকত না। তিনি যখন প্রথম দিগবিজয়ে যাত্রা করেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিল পাঁচ হাজার রণহস্তী, বিশ হাজার অশ্বারোহী ও পঞ্চাশ হাজার পদাতিক।
আরম্ভ হল রাজপুত্র শিলাদিত্যের দিগবিজয়যাত্রা। পরিপূর্ণ হয়ে গেল আকাশ-বাতাস বিজয়ী বীরবৃন্দের জয়নাদ ও শত শত দামামার গম্ভীর মেঘ-গর্জনে, হাজার হাজার গজ ও অশ্বের পদভারে থরথর কাঁপতে লাগল পৃথিবীর বুক। চিনা পরিব্রাজক হিউ-এন সাঙের বর্ণনায় দেখি, সসৈন্য হর্ষবর্ধন ছুটে চলেছেন কখনও পশ্চিম দিকে এবং কখনও পূর্বাঞ্চলে, অবাধ্যদের দমন করতে করতে দিনের পর দিন যায়। হাতিদের পিঠ থেকে নামানো হয় না হাওদা, সৈনিকরা খোলবার অবকাশ পায় না শিরস্ত্রাণ।