একটি রাইফেল ও চারটি রিভলভার
গৃহযুদ্ধের আগে আমেরিকা মহাদেশের সীমানা বিস্তৃত হয়েছিল মিসিসিপি ছাড়িয়ে দূরদূরান্তরে এবং সেই সীমান্ত বিস্তারে সাহায্য করেছিল যে-অস্ত্রটি, তার নাম রাইফেল। কিন্তু গৃহযুদ্ধের পরবর্তীকালে পশ্চিম আমেরিকার পার্বত্য অঞ্চল ও সমভূমিতে সীমানা বিস্তারের কার্যে রাইফেলের স্থান অধিকার করল ক্ষুদ্রাকৃতি আগ্নেয়াস্ত্র রিভলভার।
আমেরিকার পূর্বাঞ্চলের মানুষ অবশ্য রাইফেলকেই প্রাধান্য দিয়েছিল, কিন্তু পশ্চিম আমেরিকার অধিবাসীরা রাইফেলের পরিবর্তে রিভলভারকে জানাল সাদর অভ্যর্থনা।
পূর্বাঞ্চলের অরণ্যচারী পদাতিকের মতো পশ্চিম আমেরিকার অশ্বারোহী অধিবাসীরাও ছিল যাযাবর। প্রতি মুহূর্তে বিপদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত ছিল দুই অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু পরিবেশ ভিন্ন হওয়ার জন্যে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ছিল একেবারেই আলাদা, তাই অস্ত্র হিসাবে একদল গ্রহণ করল দূরপাল্লার রাইফেল–আর একদল বেছে নিল কাছের থেকে বার বার আঘাত হানার মারাত্মক অস্ত্র, রিভলভার।
পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীরা কাঠ কেটে আর শিকার করে জীবিকানির্বাহ করত। তারা পায়ে হেঁটে চলত, দুহাত দিয়ে রাইফেল বাগিয়ে ধরতে তাদের অসুবিধা ছিল না। অধিকাংশ সময়েই দূর থেকে গুলি চালিয়ে তারা বন্য পশুকে বধ করত, তাই দূরপাল্লার শক্তিশালী রাইফেল ছিল তাদের প্রিয় অস্ত্র।
অপরপক্ষে পশ্চিমের সমভূমির মানুষ পশুপালনকেই জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিল এবং গৃহপালিত গোরুর পালের রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য তারা সর্বদাই ঘোড়ার পিঠে চেপে চলাচল করত। একহাতে লাগাম ধরে আর একহাত দিয়ে রাইফেল চালাতে অসুবিধা হয় বলেই পশ্চিম আমেরিকার মানুষ রাইফেলের চাইতে রিভলভারকেই প্রাধান্য দিয়েছিল।
শিকারের পক্ষে রাইফেল অবশ্য প্রয়োজনীয়। রিভলভার মানুষ খুনের অস্ত্র, খুনির আদর্শ আয়ুধ! পশ্চিম আমেরিকার অধিবাসীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে বুঝে নিল ঘোড়ার পিঠেই হোক আর মাটিতে দাঁড়িয়েই হোক, মানুষ মারার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হাতিয়ার হচ্ছে রিভলভার। পশ্চিম আমেরিকার বাসিন্দাদের মধ্যে খুনোখুনি ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। কলহরত যোদ্ধাদের মধ্যে দূরত্ব থাকত বারো থেকে চবিশ হাতের মধ্যে অত কাছ থেকে বন্দুকবাজ মানুষের পক্ষে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া অসম্ভব, কাজেই যে-ব্যক্তি প্রতিপক্ষের আগেই খাপ থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে গুলি চালাতে পারত সে-ই হত জয়ী। অর্থাৎ আঙুল এবং কবজির ক্ষিপ্র সঞ্চালনের উপরই জয়-পরাজয় নির্ভর করত অধিকাংশ সময়ে।
ক্রমাগত অভ্যাসের ফলে কয়েকটি মানুষ ওই ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রে এমন সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিল যে, পলকের মধ্যে রিভলভার কোষমুক্ত করে তারা লক্ষ্য ভেদ করতে পারত অব্যর্থ সন্ধানে ক্রুদ্ধ কেউটের ছোবল মারার মতোই ছিল তাদের হাত চালানোর কায়দা; যেমন ক্ষিপ্র, প্রাণঘাতী নিশানায় তেমনই নির্ভুল নিষ্ঠুর।
সুতরাং গৃহযুদ্ধের পরে পশ্চিম আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে শুরু হল রিভলভারের জয়যাত্রা–ভোজনশালায়, খনি শ্রমিকের তাবুতে তাঁবুতে, পশুপালনের কেন্দ্রস্থলে এবং শহরে শহরে জাগল রিভলভারের কর্কশ গর্জনধ্বনি–দুর্ধর্ষ রেড ইন্ডিয়ানদের বার বার হটিয়ে দিয়ে সাদা মানুষের অধিকারভুক্ত সীমারেখা বাড়িয়ে দিল মৃত্যুবর্ষী রিভলভার, কিন্তু ওই ক্ষুদ্র অস্ত্রটির মহিমায় আইনশৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল পশ্চিম আমেরিকার বুকে।
দাঙ্গাকারী ও আইন রক্ষকদের সেই সময়ে রিভলভারের আদর ছিল রাইফেলের চাইতে অনেক বেশি। রাইফেল দ্রুতবেগে অগ্নিবর্ষণে, অসমর্থ, মন্থর। রিভলভার ক্ষিপ্রগামী মৃত্যুর যন্ত্রদূত, হত্যাকারীর হাতে অমোঘ হাতিয়ার।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, পশ্চিম আমেরাির ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত আগ্নেয়াস্ত্রের লড়াইতে চার-চারটি রিভলভারের গর্জিত মহিমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল একটি মাত্র রাইফেল।
১৮৮৭ সালে, সেপ্টেম্বর মাসে ৪ তারিখে আরিজোনার হলব্রুক শহরে যে রক্তাক্ত যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, তার বিবরণ দেওয়ার আগে পূর্বোক্ত হলব্রুক শহর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা দরকার।
চারদিকে বালি আর বালি, দক্ষিণে বালুকাসমুদ্রের বুকে সারিবদ্ধ পাহাড়। পাহাড়ের সারির মধ্যে অবস্থান করছে অ্যাপাচি নামক দুর্ধর্ষ রেড-ইন্ডিয়ান জাতি–ওই মরু ও পর্বতবেষ্টিত হলব্রুক এক ক্ষুদ্র শহর। কিন্তু আকারে ছোটো হলেও একটি কারণে হলব্রুক শহরের কিছু গুরুত্ব ছিল শহরের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছিল সান্টা ফি রেল এবং ওই রেলপথ ছিল ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বড়ো বড়ো র্যাঞ্চ বা গোশালা থেকে গোরুর পাল আসত হলব্রুক শহরে এবং সেখানেই বেচাকেনা চলত।
হলব্রুক আকারে ক্ষুদ্র, প্রকৃতিতে ভয়ংকর। শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোকদের পক্ষে ওই শহরটি মোটেই আদর্শ স্থান ছিল না। ওই শহরে যারা ঘেরাফেরা করত তাদের কোমরে চামড়ার খাপে ঝুলত গুলিভরা রিভলভার এবং দেয়ালের মতো নিরেট কোনো বস্তুতে পিঠ না-লাগিয়ে তারা কেউ বসত না। কারণ, অতর্কিতে পিছন থেকে গুলি খাওয়ার ভয়ানক সম্ভাবনা সম্পর্কে তারা সকলেই ছিল বিলক্ষণ সচেতন। কিন্তু পূর্বোক্ত ভয়ানক ভদ্রলোকরাও একটি মানুষকে সভয়ে এড়িয়ে চলত মানুষটির নাম অ্যান্ডি কুপার।
লোকটির নাম অ্যান্ডি কুপার কি অ্যান্ড ব্লেভান্স সে-বিষয়ে কিছু মতবিরোধ ছিল। অনেকের মতে অ্যান্ডি হচ্ছে ব্লেভান্স গোষ্ঠীর মানুষ, তবে ব্লেভান্স ভাইদের সভাই। অনেকের মত আবার অন্যরকম। তবে এ-বিষয়ে যে-গল্পটা সবচেয়ে প্রচলিত, সেটি হচ্ছে অ্যান্ডি ব্লেভান্স নামক মানুষটিকে টেক্সাস অঞ্চলের এক দুর্দান্ত শেরিফ খুনের অপরাধে গ্রেপ্তার করতে সচেষ্ট হয়– পূর্বোক্ত শেরিফ নাকি লক্ষ্য ভেদে সিদ্ধহস্ত এবং অপরাধীর সাক্ষাৎ পেলেই সে প্রথমে গুলি চালায়, পরে প্রশ্ন করে। এহেন শেরিফের কবল থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই টেক্সাস থেকে পলাতক অ্যান্ডি ব্লেভান্স নাকি নাম বদলে অ্যান্ডি কুপার হয়ে গেছে।
সে যাই হোক, অ্যান্ডি কুপার বা অ্যান্ডি ব্লেভান্স ছিল ভয়ানক ব্যক্তি। কুখ্যাত ব্লেভান্স পরিবারের সে ছিল নেতা। ওই পরিবারের সব মানুষই ছিল রিভলভার চালনায় সিদ্ধহস্ত। ভয়ংকর ঘটনার পর ঘটনার স্রোতে রচিত হয়েছিল ব্লেভান্স পরিবারের রক্তাক্ত ইতিহাস।
মার্ক ব্লেভান্স ছিল বাপ, তার পাঁচটি পুত্র সন্তান–অ্যান্ডি, হ্যাঁম্পটন, চার্লস, জন এবং স্যাম। স্যামের বয়স ছিল মাত্র ষোলো, কিন্তু ওই বয়সেই সে রিভলভার ছুড়ত পাকা বন্দুকবাজের মতো।
ম্যাগেল্লান পর্বতমালার বিস্তৃত তৃণ-আচ্ছাদিত উপত্যকা ছিল পশুচারণের পক্ষে চমৎকার জায়গা। প্রথমে ওখানে গোরুর পাল নিয়ে এল রাখালের দল, তারপরই হল সেখানে মেষপালকের আবির্ভাব। ফলে প্রচণ্ড কলহ। গোপালকদের সঙ্গে মেষপালকদের যুদ্ধ বাধল।
গোপালকদের নেতৃত্ব দিয়েছিল গ্রাহাম পরিবার, বিরোধী মেষপালকদের নেতা ছিল টিউকসবেরি নামক আর একটি গোষ্ঠী। ওই যুদ্ধকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়–প্লেজেন্ট ভ্যালি ওয়ার, গ্রাহাম-টিউকসবেরি দাঙ্গা, ম্যাগেল্লান যুদ্ধ প্রভৃতি। আরিজোনা প্রদেশে সংঘটিত যাবতীয় দাঙ্গাহাঙ্গামার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল পূর্বোক্ত যুদ্ধ।
ওই লড়াইতে অন্তত বিশ জন লোক মারা গিয়েছিল। ব্লেভান্স পরিবার ছিল গোপালকদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী। ১৮৮৭ সালে জুলাই মাসে পরিবারের কর্তা মার্ক ব্লেভান্স হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সেই সময় তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। সাত বছর পরে একটি ফাঁপা গাছের গুঁড়ির মধ্যে এক অস্থিময় নরমুণ্ডের সঙ্গে যে-রাইফেলটা পাওয়া গিয়েছিল, সেই রাইফেলটিকে মার্ক ব্লেভান্সের নিজস্ব অস্ত্র বলে শনাক্ত করা হয়েছিল। মুণ্ডহীন দেহটিকে উদ্ধার করা যায়নি, মার্কের হত্যাকারীরও সন্ধান করতে পারেনি কেউ।
জুলাই মাসে মার্ক ব্লেভান্স মারা গেল, অগাস্টে দাঙ্গার বলি হল ব্লেভান্স পরিবারের দ্বিতীয় ব্যক্তি—মার্কের মেজো ছেলে হ্যাম্পটন ব্লেভান্স অতর্কিতে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করল।
টিউকসবেরি দলের লোকরাই নিশ্চয় গুলি করে মেরেছিল হ্যাঁম্পটনকে। বাপ এবং পাঁচ ছেলের মধ্যে দুজন মারা পড়ল, রইল বাকি চার। মার্কের চারটি ছেলেই ছিল রিভলভার চালাতে ওস্তাদ। ষোলো বছরের কিশোর স্যামও লক্ষ্য ভেদ করতে পারত অব্যর্থ সন্ধানে। ওই চারটি ছেলেই প্রতিশোধ গ্রহণে কৃতসংকল্প, তারা টিউকসবেরির দলকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সুযোগের প্রতীক্ষা করছিল সাগ্রহে।
সুযোগ এল। টিউকসবেরিদের গোশালার কাছেই গুলির আঘাতে মারা পড়ল জন টিউকসবেরি এবং তার অংশীদার বিল জ্যাকব। দুজনকেই পিছন থেকে গুলি করা হয়েছিল। ব্লেভান্স পরিবারের এক বা একাধিক ব্যক্তি যে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সে-বিষয়ে শহরবাসীর সন্দেহ ছিল না একটুও কিন্তু, প্রমাণ কোথায়?
অ্যান্ডি কুপারের একটি দোষ ছিল। খুনখারাপি করে সে চুপচাপ থাকতে পারত না, নিজের বীরত্বের কাহিনি সে বলে বেড়াত বুক ফুলিয়ে। জোড়া খুনের ব্যাপারটাও সে চেপে রাখতে পারল না বা চাইল না–সগর্বে সে জানিয়ে দিল জন টিউকসবেরি ও বিল জ্যাকবকে সে নিজের হাতে গুলি করে মেরেছে।
হলব্রুক শহরের মার্শাল লোকমুখে ব্যাপারটা জানতে পারলেন। মার্শাল মহাশয় জানতেন অ্যান্ডিকে গ্রেপ্তার করতে গেলে সে সুবোধ বালকের মতো ধরা দিতে রাজি হবে না এবং তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসবে উদ্যত রিভলভার নিয়ে ব্লেন্স পরিবারের চার ভাই–গরম গরম গুলির ঝড়ে প্রাণ বিপন্ন করে আইনরক্ষার আগ্রহ দেখালেন না মার্শাল, সব জেনেশুনেও তিনি চুপ করে রইলেন।
সকলেই ভাবল ব্যাপারটা এখানেই চুকে গেল। কিন্তু তা হল না, আইন রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে শহরে প্রবেশ করল অশ্বারোহী নূতন শেরিফ–কমোডোর ওয়েন্স।
নবাগত শেরিফের কয়েকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল। তার কোমরের বাঁ-দিকে খাপে-আটকানো রিভলভারের বাঁট ছিল সামনের দিকে ফেরানো অর্থাৎ অস্ত্রটা হস্তগত করতে হলে তাকে নিজের শরীরের ওপর দিয়ে হাত চালাতে হবে। ওইভাবে খাপের রিভলভার বার করতে গেলে যথেষ্ট দেরি হয়, সকলেই জানে সঙিন মুহূর্তে বিদ্যুৎবেগে রিভলভার হস্তগত করে গুলি চালাতে না-পারলে প্রতিপক্ষের গুলিতে রিভলভারধারীর মৃত্যু অনিবার্য অতএব, বন্দুকবাজ মানুষ মাত্রেই কোমরের ডান দিকে রিভলভার রাখে এবং অস্ত্রের বাঁট থাকে পিছনদিকে ফেরানো, কারণ, ওই অবস্থায় রিভলভারটাকে চটপট টেনে খাপ থেকে বার করা যায়।
সুতরাং কোমরের বাঁ দিকে সামনের-দিকে-ফেরানো রিভলভারের বাঁট নিয়ে কমোেডোর ওয়েন্স নামে নূতন শেরিফ যখন গুন্ডার রাজত্ব হলব্রুক শহরে প্রবেশ করল, তখন তাকে দেখে শহরবাসীর মুখে মুখে ফুটল বিদ্রুপের হাসি।
ওয়েন্সের চেহারাও আদর্শ আইনরক্ষকের মতো ছিল না। দাঙ্গাহাঙ্গামায় অভ্যস্ত পাকা বন্দুকবাজ মানুষের মুখে-চোখে যে রুক্ষ কাঠিন্যের আভাস থাকে, গোঁফ-দাড়ি-কামানো ওয়েন্সের পরিচ্ছন্ন মুখে সেই ধরনের অভিব্যক্তি অনুপস্থিত। উপরন্তু মস্ত বড়ো টুপির তলা থেকে লম্বা লম্বা সোনালি চুল ঘাড় অবধি নেমে এসে তার চেহারাটাকে করে তুলেছে শৌখিন ভদ্রলোকের মতো।
তবে হ্যাঁ, তার ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল লোকটি পাকা ঘোড়সওয়ার। ঘোড়ার পিঠে জিনের সঙ্গে ওয়েন্সের পায়ের ফাঁকে ঝুলছিল একটি উইনচেস্টার রাইফেল।
হঠাৎ হলব্রুক শহরে শেরিফ হয়ে এই মানুষটি কেন প্রবেশ করল সে-কথা জানতে হলে কমোডোর ওয়েন্স সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা দরকার। কমোডোর ওয়েন্স এসেছিল টেক্সাস অঞ্চলে একপাল গোরুর রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য। একটি র্যাঞ্চ বা গোশালার বেতনভোগী পরিচালক ছিল সে। সেই সময় তার বয়স ছিল ৩৫, নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ওয়েন্স ছিল সম্মানিত ব্যক্তি।
একদিন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার টাকা লুঠ করার চেষ্টা করল তিনটি চোর। তাদের চেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি, কিন্তু চোরদের তো গ্রেপ্তার করা দরকার?–তবে বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধে কে? প্রত্যেকটি অপরাধী যেখানে খুন করতে অভ্যস্ত, সেখানে চোরের পিছনে তাড়া করা আর আত্মহত্যার চেষ্টা করায় তফাত কিছু নেই–অতএব শেরিফের দায়িত্ব নিয়ে শান্তিরক্ষার কর্তব্যপালন করার আগ্রহ কেউ দেখাল না।
কিন্তু কমোডার ওয়েন্সকে যখন আত্মহত্যার সহজ পথ দেখানো হলো, অর্থাৎ শেরিফের পদে নিয়োগ করার প্রস্তাব দেওয়া হল, সে রাজি হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। বিভিন্ন অঞ্চলের অপরাধীদের পাকড়াও করে সেন্ট জন নামক ছোটো শহরের বিচারালয়ে উপস্থিত করার দায়িত্ব নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হলব্রুক শহরে এসে পৌঁছোল কমোডোর ওয়েন্স।
তাবৎ হলব্রুক শহর ওয়েন্সকে দেখে হাসাহাসি করতে লাগল–লম্বা সোনালি চুল আর উলটোদিকে ফেরানো রিভলভার নিয়ে এই মেয়েমুখো শেরিফটা যে অতি শীঘ্রই গুলি খেয়ে মরবে, সে-বিষয়ে শহরবাসীর সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র।
নূতন শেরিফ শান্তভাবে তার বাহিনীকে দাঁড় করাল ব্রাউন অ্যান্ড কাইন্ডার নামে ভাড়াটে আস্তাবলের কাছে, তারপর ঘোড়াটাকে যথাস্থানে রেখে অফিসের ভিতর প্রবেশ করল।
একটি ছোকরা এতক্ষণ অফিসে বসে ভাঙা বেহালা মেরামত করছিল। সে ওয়েন্সকে দেখে উঠে দাঁড়াল, তারপর বাইরে বেরিয়ে গেল ধীর পদক্ষেপে।
ওই ছোকরা হচ্ছে জন ভোন্স, ব্রেভান্স ভাইদের চতুর্থ ভ্রাতা। সে আগে কখনো ওয়েন্সকে দেখেনি, কিন্তু লোকের মুখে মুখে লম্বা চুলওয়ালা নূতন শেরিফের বর্ণনা তার শ্রুতিগোচর হয়েছিল। এখন ওয়েন্সকে দেখেই সে তার পরিচয় আন্দাজ করে নিল এবং ওইসঙ্গে এ-কথাও ভেবে নিল যে, নূতন শেরিফের হঠাৎ উপস্থিতির সঙ্গে তার বড়ো ভাই অ্যান্ডি কুপারের একটা অশুভ যোগসূত্রের কার্যকারণ সম্বন্ধ থাকা বিচিত্র নয়–হয়তো অ্যান্ডিকে গ্রেপ্তার করার জন্যই আবির্ভূত হয়েছে শেরিফ ওয়েন্স। অতএব কনিষ্ঠের কর্তব্য হিসাবে সে চটপট যাত্রা করল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অ্যান্ডির সন্ধানে, তাকে এখনই সাবধান করে দিতে হবে যে!
সত্যি কথা বলতে কী, ওয়েন্সের কাছে অ্যান্ডি কুপারের নামে একটা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। কিন্তু পরোয়ানায় তাকে খুনি বলে অভিযুক্ত করা হয়নি, সেটা ছিল ঘোড়া চুরির অভিযোগ। ওয়েন্স আর অ্যান্ডি ছিল পূর্বপরিচিত। ওই ঘোড়া চুরির ব্যাপারটা নিয়ে আগেও তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। এর মধ্যে চুরির অভিযোগ আদালতে উঠেছে, আর অভিযুক্ত অ্যান্ডি কুপারকে গ্রেপ্তার করার ভার নিয়ে হলব্রুক শহরে উপস্থিত হয়েছে কমোডোর ওয়েন্স। কিন্তু আসল ব্যাপারটা ছিল সকলের কাছেই অজ্ঞাত। তাই জন ব্লেভান্স যখন ভ্রাতৃবর অ্যান্ডিকে শেরিফের আগমন-সংবাদ পরিবেশন করতে ছুটল, সেও ভেবে নিল যে, সদ্য-সংঘটিত জোড়া খুনের তদন্ত করার জন্যই এই অঞ্চলে শেরিফ ওয়েন্সের শুভাগমন–অতএব অ্যান্ডি কুপারের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন।
হলব্রুক পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটি বন্ধুর সঙ্গে খোশমেজাজে আড্ডা দিচ্ছিল অ্যান্ডি কুপার। অকস্মাৎ হন্তদন্ত হয়ে সেখানে জন ব্লেন্সের আবির্ভাব!
ওহে অ্যান্ডি, শহরে ওয়েন্স এসেছে।
জানি। অ্যান্ডি বলল।
অ্যান্ডি আগেই অশ্বারোহী ওয়েন্সকে দেখতে পেয়েছিল। তখন সে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু এখন ভাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সে হঠাৎ অনুভব করল, আবহাওয়া মোটেই সুবিধের নয়।
অ্যান্ডি কুপার ছিল চোর এবং খুনি। অনেকবারই সে গোরু ঘোড়া চুরি করেছে। বহু চৌর্যবৃত্তির মধ্যে যেকোনো একটি চুরির অভিযোগ তার নামে থাকতে পারে, তার চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে সদ্য সদ্য দুটি মানুষ খুন করে সে শহরময় তার কীর্তির কথা প্রচার করেছে নিজমুখে এখন সেই খুনের অভিযোগে যদি ওয়েন্স তাকে গ্রেপ্তার করতে এসে থাকে তাহলে তো সময় থাকতে সাবধান হওয়া দরকার।
মুহূর্তের মধ্যে সংকল্প স্থির করল অ্যান্ডি কুপার।
আমি র্যঞ্চে যাচ্ছি, জনকে উদ্দেশ করে বলল অ্যান্ডি।
ক্যানিয়ন ক্রিক নামক স্থানে ব্লেভান্স পরিবারের একটি গোশালা ছিল। কয়েকটা গোরু ওখানে থাকত। অনেকে বলে, গোরু ঘোড়া চুরি করে পাচার করার জন্য লোকের চোখে ধুলো দিতে ওই গোশালাটি রেখেছে ব্লেন্স পরিবার। ওই জায়গাটিরই উল্লেখ করেছিল অ্যান্ডি বন্ধুদের সামনে।
ভাইকে তার পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে অ্যান্ডি তার ঘোড়াটাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলল। যে-বাড়িতে ব্লেভান্সরা থাকত, সেই বাড়িটা ছিল পূর্বে উল্লিখিত ব্রাউন অ্যান্ড কাইন্ডার নামে আস্তাবলটির কাছে। বন্ধুদের শুনিয়ে সে বলল বটে র্যাঞ্চই হচ্ছে তার গন্তব্যস্থল, কিন্তু ভাইকে আস্তাবল থেকে ঘোড়াটাকে নিয়ে যেতে বলে সে রওনা দিল বাড়ির দিকে কমোডোর ওয়েন্সকে সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল।
আগেই বলেছি অ্যান্ডি এবং ওয়েন্স পরস্পরের পরিচিত ছিল। কাজেই হলব্রুক শহরের লোক ওয়েন্সের চেহারা ও হাবভাব দেখে যতই হাসাহাসি করুক, অ্যান্ডি ভালো করেই জানত কমোডোর ওয়েন্স কোন ধরনের মানুষ অতএব তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মোটেই ইচ্ছুক ছিল না অ্যান্ডি।
এদিকে ওয়েন্স তার ঘোড়াটাকে আস্তাবলে রেখে দাঙ্গাবাজিতে অভ্যস্ত বন্দুকবাজ মানুষ যা করে তাই করছিল, অর্থাৎ রাইফেল ও রিভলভারের কলকবজা পরীক্ষা করে দেখছিল। রাইফেল সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে সে যখন রিভলভার পরিষ্কার করছে, সেই সময় হঠাৎ দুই ব্যক্তির আবির্ভাব স্যাম ব্রাউন ও ডি. জি. হার্ভে। দুজনেই ছিল ওয়েন্সের বন্ধু। তাদের দেখামাত্রই ওয়েন্স প্রশ্ন করল, অ্যান্ডি কুপারকে দেখেছ?
উত্তর এল, হ্যাঁ, সে এখন এই শহরেই আছে।
ঠিক তখনই প্রবেশ করল জন ব্লেভান্স, তারপর অ্যাণ্ডির ঘোড়াটাকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করল।
তিনটি মানুষ নীরবে জনের কার্যকলাপ দেখল, তারপর মৌনভঙ্গ করল স্যাম ব্রাউন, ওই ছোকরা হচ্ছে ব্লেভান্স ভাইদের এক ভাই। আর ওটা হচ্ছে অ্যান্ডি কুপারের ঘোড়া। অ্যান্ডি এখন শহর থেকে সরে পড়তে চাইছে।
কনোডোর ওয়েন্স একটিও কথা বলল না। হাতের রিভলভার উলট করে বাঁ দিকের খাপে ঢুকিয়ে দিল, তারপর উইনচেস্টার রাইফেলটা হস্তগত করে আস্তাবলের বাইরে পদার্পণ করল। আস্তাবলের কাছেই একটু দূরে রাস্তার উপরে অবস্থান করছিল ব্লেভান্স পরিবারের বাড়ি আঙুল তুলে ওয়েন্সের বন্ধুরা তাকে বাড়িটা দেখিয়ে দিল।
বাড়িটা ছিল কাঠের তৈরি, একতলা। রাস্তা থেকে ১৫ ফুট দূরে অবস্থিত ওই বাড়ির সামনের দিকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, তারপরই সমান্তরালভাবে চলে গেছে সান্টা ফি রেললাইন। পূর্বে উল্লিখিত আস্তাবলের পুব দিকেই ছিল ব্লেভান্স পরিবারের বাড়ি। ব্লেভান্সদের বাড়ির কাছাকাছি আরও কয়েকটা ছোটো ছোটো বাড়ি ছিল। ব্লেভান্সদের বাড়ির ঠিক আগেই যে কামারশালাটা ছিল, সেখানে এসে দাঁড়াল কমোডোর ওয়েন্স হাতে তার গুলি ভরা রাইফেল।
বাড়ির সামনের দিকে দুটো জানালা, ভিতরে সম্ভবত দুটো ঘর। ওয়েন্সের বাঁ-দিকে খানিকটা ঢাকা জায়গা, বোধ হয় সেখানেও একটা ঘর রয়েছে এবং ওই জায়গাটার সংলগ্ন বারান্দাটা ঘুরে বাড়ির সামনের অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দুটি দরজার একটি রয়েছে ঢাকা জায়গাটার দিকে, আর একটি দরজা অবস্থান করছে বাড়ির প্রধান অংশের সম্মুখে।
বাড়ির ভিতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিল না ওয়েন্স। তার অজ্ঞাতে বাড়ির মধ্যে জমায়েত হয়েছিল কয়েকটি নারী ও পুরুষ।
পুরুষদের মধ্যে ছিল স্বয়ং অ্যান্ডি কুপার, জন ব্লেভান্স, পরিবারের অন্যতম বন্ধু ও ওই বাড়ির অধিবাসী মোস রবার্টস এবং স্যাম হোস্টন ব্লেভান্স।
মেয়েরা ছিল সংখ্যায় তিনজন–ব্লেভান্স ভাইদের বিধবা মাতা মিসেস মেরি ব্লেভান্স, ইভা ব্লেভান্স নামে একটি ভাই-বউ, এবং মিসেস অ্যামান্ডা গ্ল্যাডেন নামে পরিবারের এক বান্ধবী।
শেরিফ ওয়েন্স যখন বাড়ির সামনে উঠানের উপর এসে দাঁড়াল, দরজাগুলি তখন বন্ধ ছিল। ওয়েন্স উঠান থেকে বারান্দায় উঠে এল, সঙ্গেসঙ্গে বাড়ির সংলগ্ন ঢাকা জায়গাটার মধ্যে চারটি মনুষ্যমূর্তি তার চোখে পড়ল।
ওয়েন্স চিৎকার করে উঠল, অ্যান্ডি কুপার, বাইরে এসো।
ছোটো ঘরের ভিতর থেকে বড়ো ঘরে প্রবেশ করল অ্যান্ডি, পরক্ষণেই দরজা খুলে গেল ওয়েন্স দেখল তার সামনে দণ্ডায়মান অ্যান্ডি কুপার, হাতে খোলা রিভলভার।
প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ঢাকা জায়গাটার সংলগ্ন দরজায় শব্দ উঠল, অর্ধমুক্ত দ্বারপথে ওয়েন্সের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একটি পরিচিত মানুষকে আবিষ্কার করল–উদ্যত রিভলভার হাতে জন ব্লেভান্স।
কমোডোর ওয়েন্স তখন দুই ভাইয়ের মাঝখানে, তার অবস্থা রীতিমতো সংকটজনক। কিন্তু ওয়েন্সের চোখে-মুখে ভীতি বা উত্তেজনার চিহ্ন দেখা গেল না, রাইফেলটা যেমন কোমরের কাছে ধরা ছিল তেমনই রইল–শুধু তার দুই চোখের প্রখর দৃষ্টি নিশ্চল হয়ে রইল অ্যান্ডির ওপর, পিছনে জন ব্লেভান্সের গতিবিধি লক্ষ করার সুযোগ বা সময় ছিল না।
শান্তস্বরে ওয়েন্স বলল, কুপার, আমি তোমাকে চাই।
গর্জে উঠল খুনি, কেন? আমাকে কী দরকার?
তোমার নামে পরোয়ানা আছে।
কীসের পরোয়ানা?
অনর্থক কথাবার্তা বলে কালক্ষেপ করতে চাইছিল অ্যান্ডি কুপার। ওই সময়ের মধ্যে বাড়ির ভিতর রিভলভারধারী তিন ব্যক্তি পছন্দমতো জায়গায় দাঁড়িয়ে ওয়েন্সের উপর নিশানা স্থির করার সুযোগ পাবে বলেই অ্যান্ডি সময় নষ্ট করছিল। ওয়েন্স হয়তো অ্যান্ডির উদ্দেশ্যে বুঝেছিল, কিন্তু কর্তব্য অনুসারে সে পরোয়ানার অভিযোগ ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হল।
ঘোড়া চুরির যে ব্যাপারটা আগে তোমাকে বলেছিলাম, সেই অভিযোগই রয়েছে এই পরোয়ানাতে।
অপেক্ষা করো, এ-বিষয়ে আমি পরে ভেবে দেখব।
আমি অপেক্ষা করতে পারব না। এই মুহূর্তে তোমাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে।
অকস্মাৎ চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল অ্যান্ডি কুপার, আমি যাব না।
প্রায় একইসঙ্গে গর্জে উঠল রিভলভার ও রাইফেল।
ওয়েন্স তার রাইফেল তুলে ধরার সময় পায়নি, কোমরের কাছে ধরা অবস্থাতেই সে ট্রিগার টিপেছিল। ওয়েন্স অনুভব করল তার দেহের পাশ দিয়ে ছুটে গেল লক্ষ্যভ্রষ্ট রিভলভারের তপ্ত বুলেট, কিন্তু অ্যান্ডি কুপার প্রতিদ্বন্দ্বীর রাইফেলকে ফাঁকি দিতে পারল না–অসহ্য যাতনায় অ্যান্ডির শরীর দুমড়ে গেল দু-ভাজ হয়ে, উইনচেস্টার রাইফেলের ভারী গুলির আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তার পাকস্থলী।
সমস্ত ঘটনাটা ঘটল মুহূর্তের মধ্যে। দু-দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জনধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই প্রায় প্রতিধ্বনির মতো আর একটি গুলির আওয়াজ শোনা গেল। খিড়কির দরজা থেকে গুলি চালিয়েছে জন ব্লেভান্স।
অত কাছ থেকে জনের মতো পাকা বন্দুকবাজ কী করে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল বলা মুশকিল, খুব সম্ভব ওয়েন্স চটপট সরে গিয়েছিল–তবে গুলিটা যে ফসকে গিয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। একটু দূরেই বাঁধা ছিল অ্যান্ডির ঘোড়া–ওয়েন্সের উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত বুলেট এসে লাগল তার গায়ে। জন্তুটা মারা পড়ল তৎক্ষণাৎ।
ওয়েন্সের রাইফেল তখনও কোমরের কাছেই নীচু করে ধরা ছিল। অস্ত্রটাকে না-তুলে সেই অবস্থাতেই সে সাঁৎ করে জনের দিকে ঘুরে গেল এবং পরক্ষণেই অভ্যস্ত আঙুলের চাপে রাইফেল করল অগ্নি-উদগিরণ।
পিছন দিকে ঘুরে পড়ে গেল জন ব্লেভান্স। গুলির আঘাতে তার একদিকের কাঁধ চূর্ণবিচূর্ণ।
একলাফে বারান্দা থেকে নেমে রাস্তার উপর এসে দাঁড়াল ওয়েন্স, এর মধ্যেই সে রাইফেলের লিভার টেনে শূন্য গুলির খোল ফেলে নূতন টোটা ভরে ফেলেছে। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে দু-দিকের দরজার উপরই সে নজর রাখতে পারছিল। পলকের জন্য খোলা জানালা দিয়ে অ্যান্ডির দেহ তার চোখে পড়ল টলতে টলতে ঘরের ভিতর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আহত খুনি। আবার গর্জে উঠল উইনচেস্টার রাইফেল, কিন্তু এবার ওয়েন্সের লক্ষ্য ব্যর্থ হল।
ঠিক সময়েই সরে গিয়েছিল ওয়েন্স, কারণ সে রাস্তায় নেমে পড়ার সঙ্গেসঙ্গেই বাড়ির পুবদিকে ঘুরে সামনে এসে দাঁড়াল মোস রবার্টস, পরক্ষণেই সশব্দে অগ্নিবৃষ্টি করল তার হাতের রিভলভার।
এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম ওয়েন্স গা-ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করল। বাড়ির সামনে একটা ওয়াগন দাঁড়িয়ে ছিল, সেই গাড়িটার পিছনে সরে এসে ওয়েন্স রাইফেল চালাল।
প্রচণ্ড আঘাতে এক পাক ঘুরে পিছিয়ে গেল রবার্টস, তারপর টলতে টলতে আত্মগোপন করল বাড়ির পিছন দিকে।
কিন্তু লড়াই তখনও শেষ হয়নি। অ্যান্ডির পরিত্যক্ত রিভলভারটা তুলে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল প্রতিশোধ গ্রহণে কৃতসংকল্প কিশোর স্যাম হোস্টন ব্লেভান্স। সে রিভলভার তুলে ওয়েন্সের দিকে লক্ষ্য স্থির করতে লাগল। কিন্তু স্যামের রিভলভার অগ্নিবর্ষণ করার সুযোগ পেল না, তার আগেই ওয়েন্সের রাইফেলের গুলি অব্যর্থ সন্ধানে প্রতিবন্দ্বীর বক্ষ ভেদ করল। স্যামের মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ। তার প্রাণহীন দেহ দরজা দিয়ে এসে পড়ল মায়ের প্রসারিত বাহুবন্ধনের মধ্যে।
কয়েক মিনিট পরে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল শেরিফ কমোডার ওয়েন্স। তার সঙ্গে এল আশেপাশে দণ্ডায়মান দর্শকের দল। মেয়েরা তখন চিৎকার করে কাঁদছে আর সাহায্য ভিক্ষা করছে।
বাড়ির ভিতরের অবস্থা তখন বিধ্বস্ত রণক্ষেত্রের মতো। দেয়াল, মেঝে, আসবাবপত্র রক্তে রক্তময়। বিছানার উপর পড়ে আছে রবার্টসের দেহ, ওইখানেই এসে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। সে। দরজার কাছে স্যামের প্রাণহীন শরীর মেঝের উপর লম্ববান; আর একটু দূরেই মায়ের ঘরে মেঝের উপর পড়ে অসহ্য যাতনায় ছটফট করছে অ্যান্ডি কুপার, তার উদর বিদীর্ণ করে দিয়েছে রাইফেলের বুলেট।.আর্তস্বরে অ্যান্ডি বার বার অনুরোধ করছে তাকে যেন এই মুহূর্তে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, এই যন্ত্রণা সে আর সহ্য করতে পারছে না।
অ্যান্ডির মৃত্যু হল পরের দিন। চারজনের মধ্যে প্রাণে বেঁচেছিল শুধু জন ব্লেভান্স। অর্ধমূৰ্ছিত অবস্থায় সে বসেছিল একটা চেয়ারের উপর, তার সর্বাঙ্গ রক্তসিক্ত। সে আরোগ্যলাভ করেছিল। পরবর্তীকালে বিচারে তার কারাদণ্ডের আদেশ হয়।
কিন্তু ওই ভয়ংকর রক্তাক্ত যুদ্ধে কমোডোর ওয়েন্স ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত। সে রাইফেল ছুঁড়েছিল পাঁচবার তার মধ্যে একবারই সে ব্যর্থ হয়েছিল, বাকি চারটি গুলি লক্ষ্য ভেদ করেছিল অব্যর্থ সন্ধানে।