একটি ঐতিহাসিক চিত্র

একটি ঐতিহাসিক চিত্র

তাঁতীপাড়ায় পেছন দিকে নাবাল জমি
তার ওপাশে মুসলমানী গ্রাম
ওদের দিকে আকাশটাও অনেকখানি গাঢ়
ওদের ভোর মোরগঝুঁটি, এদিকে ভোর
হাঁসের মতন সাদা
একেক দিন কুয়াশালীন, একেক দিন বৃষ্টি সারাবেলা
এখানে সব নিথর চুপ, ঘাসফড়িং-এর মুখের মতন
কাঁচা-সবুজ শান্ত
এখানে শীত-গ্রীষ্ম আসেন, যেমন আসেন জন্ম এবং মৃত্যু
এবং মাইল পনেরো দূরে আছেন সভ্যতা।

পাট ক্ষেতের সীমানা ঘিরে ছিলেন এক
কূল ভাঙানো নদী
তিনি এখন দেশান্তরে গেছেন
শুকনো খাদ যেন একটা বাঁকা রাস্তা
এখনো তার বুকে মাখানো ছেলেবেলার ধুলো
বুড়ো একটা তেঁতুল গাছ, ঠাকুদার মতন যার আঙুল, যার
নিচে দাঁড়ালে সকাল-সন্ধ্যা
লাগে চিরুনি-হাওয়া
প্রাইমারির মাস্টারমশাই ওখানে রোজ ভাঙা-আলোয়
বাড়ি ফেরার পথে থমকে
সাইকেলের বেল বাজিয়ে গুনগুনোন
রামপ্রসাদী গান
রাত্রিবেলা ওখানে কেউ যায় না
রাত্রিবেলা ওখানে তারা আসে
এখানে রাত ইঁদুর-জাগা, এখানে রাত সাত শিয়ালের রা
এখানে ঘুম পরিশ্রমী, ঘুমের বয়েস জাগার চেয়ে বেশি
এখানে সব জন্মবীজ অন্ধকারে এক প্রহরে
নারীরা লুফে নেয়
শেষ রাতের হলুদ চাঁদ দিঘির জলে একলা খেলা করে।

আমাদের এখানে কোনো বিখ্যাত ভাঙা মন্দির নেই
আমাদের ছোট কালীবাড়িটির ছবি তুলতে কোনো সাহেব
এদিকে আসেননি কখনো
এখানে নেই কোনো বিধ্বস্ত নীলকুঠির অস্তিত্ব
তবু আমাদের এই গ্রামটি ঐতিহাসিক
এক লপ্তের ধান জমিতে রোজ চাষে যান পরাণের দাদামশাই
তাঁর বয়েস তিন হাজার বছরের চেয়ে কিছু বেশি
গৌতম বুদ্ধেরও জন্মের আগে থেকে তিনি
ঐ একই হাল গোরু নিয়ে
মাঠে নামছেন
দুপুরের খাঁ-খাঁ রোদে তিনি আকাশের দিকে তুলে ধরেন
তাঁর ঐতিহ্যময় মুখ
সম্রাট আকবর খাজনা নিয়েছেন ওঁর কাছ থেকে
পৌষের রাতে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে পরাণের দাদামশাই
এখনো ঘুম ভেঙে মাঠে ছুটে গিয়ে
আনন্দে নৃত্য করেন দু’হাত তুলে
আমাদের এখানে সব কিছুই অতি রহস্যময়ভাবে সরল
আমরা কয়লা দেখেছি রামজীবনপুরের হাটে
আমরা সোনা দেখেছি অশ্বিনী মণ্ডলের মেজো মেয়ের
বিয়ের সময়
আমরা মুক্তো দেখেছি ভোরবেলা ঘাসের ডগায়
আমরা হীরে-কুচি দেখেছি শ্যালো টিউবওয়েলের
জলে
রোদের ঝিলিকে
আমরা মরকত মণি দেখেছি আকাশে সূর্য-বিদায়ের
শেষ দৃশ্যে
আমরা ইস্পাত দেখেছি দাঙ্গায়
আমরা বারুদ দেখেছি জমি দখলের লড়াইয়ে।

দিঘিটির জল কুচকুচে কালো, কেউ এর নাম
রাখেনি কাজলা দিঘি
আমরা এখানে বছরের পাট পচাই
আমরা এ-জলে স্নান করি, রাঁধি, খাই
এই জলে ভাসে আমাদের প্রিয় নাম দেওয়া হাঁসগুলো
দিঘিটি বড়ই গম্ভীর, ওর হৃদয়ে রয়েছে সাতটি
আঁধার কুঠুরি
ও এমনই নারী, যারা শুধু নেয় ভালোবাসা, তার
প্রতিদানে কিছু দেয় না
(যেমন কেষ্ট বাড়ুরীর বউ), আমাদের কালো দিঘিটি
বড় বেশি এই জীবনে জড়ানো, এমন তত দিন যায় না যে ওকে
একবারও চোখে দেখি না
শুধু চোখে দেখা, কোনোদিন তবু দেখা তো দিলো না স্বপ্নে!
আমরা স্বপ্নে দেখেছি মাজরা পোকা
আমরা স্বপ্নে দেখেছি খরা ও বন্যা
আমরা স্বপ্নে দেখেছি স্বপন এবং স্বপ্ন
কুমার-কুমারী যাত্রায় হাসে কাঁদে
আমরা স্বপ্নে দেখেছি চোরেরা কেটে নিয়ে যায় ধান
স্বপ্নে আমরা চমকে উঠেছি বুঝিবা দাম পড়ে গেল
আলুর!
হে নিকষ কালো জলভরা দিঘি, এত কাছে তুমি এত নিষ্ঠুর
কখনো স্বপ্নে এলে না?
মাঠের মধ্যে এক ঢ্যাঙা তালগাছ দম্পতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে
ওখানেই ঘুচুড়ে আর
জিওলকাঠির সীমানা
ঐখানে একদিন এক মনসার জীব দংশেছিল।
সনাতন দাসের ছেলে বলাইকে
ঘুচুড়ের দিকটা তখন ফাঁকা, জিওলকাঠির চাষীরা
ছুটে এলো আর্ত রব শুনে
তারা চটপট আঁটন দিয়েছিল তার পায়ে
বলাই জল জল বলে চ্যাঁচালে আজু শেখ ঢেলে দিয়েছিল
তার মুখে পানি
নদাই ঘোষের রায়ত গিয়াসুদ্দিন ছুটে গিয়েছিল
খবর রটাতে
কেউ কেউ বলেছিল, ওঝা
কেউ কেউ বলেছিল, টোটকা
ঝিমিয়ে পড়া চোখ কোনো রকমে খুলে
ইস্কুল ফাইনাল বলাই বলেছিল,
ইঞ্জেকশন!
পীর জাঙ্গাল পেরিয়ে শ্যামনগর, তারপর মানিকচকের খাল
গত বর্ষায় উড়ে গেছে যার সাঁকো
এখন অবশ্য সেখানে হাঁটু জল
তার ওপারে হিঙ্গুলের হেলথ্‌ সেন্টার
হিঁদু পাড়ার পালকি মেরামত হয়নি এক মাস।
মোছলমান পাড়ার ড়ুলিতে চাপানো হলো
বলাইকে

ও বলাই, বলাই রে, ফিরে আয় বাপ
ও মা মনসা, তোমার পায়ে পড়ি
তোমায় গড়িয়ে দেবো রুপোর মাকড়ি
ওরে বলাই, তুই যে সাত বোনের এক ভাই
তুই ছাড়া আমার আর কেউ নাই
বলাইকে সাপে কাটলো, তার বৌটা যে পাঁচ মাসের পোয়াতী
ওরে বলাই, ফিরে আয়, সত্যপীরের সিন্নি দেব,
ফিরে আয়, ফিরে আয়…
ঘুম থেকে তুলে ডাক্তারবাবুকে টেনে আনা হলো
আধো ঘুমন্ত বলাইয়ের সামনে
ডাক্তারবাবু প্রথমে চিৎকার করে বাপ মা তুলে
গালাগালি দিলেন যে কাকে
(বোধহয় ভগবানকে) তারপর ডাক্তারবাবু বুকের জামা খুলে বললেন, মার,
তোরা মেরে আমার হাড়গোড়
ছাতু কর
এই সেন্টারের দরজা-জানলা, টেবিল-চেয়ার সব ভেঙেচুরে
সর্বনাশ করে দিয়ে যা
হারামজাদারা, এতদূর দিয়ে এসেছিস, চাষাভুষোর কখনো
ওষুধে রোগ সারে?
আড়াই মাস কোনো ওষুধ চক্ষেই দেখিনি, যা, এখনো সময় থাকতে
যা
যজপুরের হেরম্ব গুনিনের কাছে ছুটে যা

এমন কড়া জান বলাইয়ের, তবু সে বেঁচে গেল সে যাত্রায়
তিন বছরে সাতজন মরেছে আল কেউটের বিষে
বলাই মরলো না
এক মাস পর মুন্সীগঞ্জের হাটে আজু শেখের পিঠে
এক প্রকাণ্ড কিল মেরে
বলাই বললো, শালা
মোছলমানের হাতের জল খাইয়ে আমার
জাত মেরে দিইচিস?
আজু শেখও চটপট জবাব দিলো, মাঠের মধ্যি পানি কোথায়
পাবো রে হারামজাদা
পস্যাব করে দিইচি তোর মুখে!
তারপর দুজনে কাঁধ ধরাধরি করে ঢুকে গেল
গোদা-পা বিষ্টুর চা-মিষ্টির দোকানে

কে যায়? ও, পরাণ মণ্ডল,
খবর-টবর কী গো, দাদা?
খবর ভালো রে ভাই, ছোট মেয়েটার শুধু জ্বর
কে যায়? ও, সাধনের ছোট ভাইটা নয়?
খবর-টবর কী রে, হাট থেকে এলি?
খবর শোনোনি দাদা, আজ থেকে বেড়ে গেল
পাম্পের ভাড়া? তাই নাকি? কত? কত?
ডেলি চুয়াল্লিশ
কে যায়? ও, ফজল মামুদ
খবর-টবর কী গো, মিঞা?
দিন আনি দিন খাই, খবরের জুতসই মা-বাপ নাই!
কে যায়? ও, হারু গোলদার।
খবর-টবর কী রে, ছোঁড়া?
জবর খবর আজ, সাত গোলে হেরে গেছে লক্ষ্মীকান্তপুর
কে যায়? ও, সহদেবের মা
খবরটবর কী গো, ভালো?
ভালো নাকি মন্দ হবে? চতুদ্দিকে যত হিংসুটি!
কে যায়? ও-বাবা, এ যে গোরাই সামন্ত।
পেন্নাম, এদিকে কোথা থেকে গেলেন, জ্যাঠা?
এলাম সদর থেকে, বলাইকে বলিস আমি মামলা জিতেছি!
কে যায়, খালেদ নাকি? শোন্ তো এদিকে ভাইডি
শুকনো লঙ্কার দর তেজী না মিয়োনো?
খবর জানি না, তবে দেখলাম তো বস্তাগুলো
ডাঁই হয়ে আছে!
কে যায়? ও, বীরেশ্বরদা,
বলাইকে বলে দিও, তার আজ সর্বনাশ হলো!
কে যায়? ও, রসিক বাবাজী,
খবর-টবর সব ভালো তো গোঁসাই?
ভালো মন্দ কে কী জানে, রাধেশ্যাম যেমন রাখেন!
কে যায়? ও, সুবল ভূঁইমালি
খবর-টবর কী রে, ছুটছিস কোথায়?
খবরের মুখে ইয়ে, আজও হাটে নেই কেরাসিন!
কেরাসিন, কেরাসিন, কেরাসিন
দাও দাদা, দাও কিছু কেরাসিন
ওগো জোতদার দাদা, আমরা তোমার গাধা
জমিজমা নাও বাঁধা
দাও তবু, দাও কিছু কেরাসিন!
ওগো ভোট চাওয়া পার্টি, করে যাও ফোর টোয়েন্টি
যত খুশি
ইলশে গুঁড়ির মতো ছিটে-ফোঁটা দেবে নাকো
কেরাসিন?
ওরে কেরা কেরা রে, তুই কোথা গেলি রে?
ওরে সিন সিন রে, তুই বুকের সিনারে
ওরে আমার ভর্তি কেরাসিনের বোতল
তুই আমাদের বাদলা রাতের গন্ধ বকুল
তোর সুবাসে প্রাণের মধ্যে আল কাটা জল
খলখলায়
তুই আমাদের হ্যাংলা মনের পদ্মমধু
তুই আমাদের দিন-ঘুমের হেমামালিনী!
তোকে গলায় জড়িয়ে ধরবো, গরমা গরম চুমো খাবো
তোকে নিয়ে একলা শোবো, আয়!
পাম্প চালানি, কাঠ জ্বালানি, ঘর ভরানি,
ছেলেপুলের বই খোলানি আয়!
কোথায় আলো, কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো
বিরহানলে কেরোসিন কিছু ঢালো!

আমরা প্রণাম জানাই তাঁকে, যিনি
সৃষ্টি করেছেন ট্রানজিস্টার বেতার
মাত্র দু বস্তা ধানের বিনিময়ে তিনি আমাদের দিয়েছেন এই
অত্যাশ্চর্য উপহার
পৃথিবী আমাদের খবর রাখে না,
কিন্তু
আমরা জানি
পৃথিবীর হালচাল
আমরা জানি কানপুরের মাঠে সুনীল গাভাসকর
পরপর মেরেছে দু’খানা ছক্কা।
আমরা জানি বিলেতের বিমান বন্দরে সাহেবেরা
ন্যাংটো করে দেখে
আমাদের ভালো ভালো মেয়েছেলেদের
আমরা জানি কলকাতার বস্তির লোকগুলোকে স্বর্গে তুলবার জন্য
দয়ালু লোকেরা খুলছেন ক্লাব
অবাঙালী ছোট লাটসাহেব সেখানে বক্তৃতার
প্রথম দু লাইন দেন বাংলায়!
আমরা জানি জয়প্রকাশ নারায়ণের ফোঁটা ফোঁটা হিসি
আর ইন্দিরা গান্ধীর বিচার নিয়ে
চলছে খুব
কেরামতি ও ধুন্ধুমার
আমরা জানি আমেরিকার হাসি-খুশি প্রেসিডেন
আরবের মরুভূমিতে যুদ্ধ থামাবার জন্য
কুমীরের মতন কাঁদছেন!
আমিরা জানি ভিয়েতনাম নামে একটা দেশ আছে।
যেখানে কোনোদিন যুদ্ধ থামে না
আমরা জানি মরিচঝাঁপির হা-ঘরে বাঙালগুলোকে
তাড়াবার জন্য
সরকার বাহাদুর নিয়েছেন
উপযুক্ত বন্দোবস্ত
আমরা জানি একটা নদীর বুকে সেতু বানাবার জন্য
কোনো এক বড় মন্ত্রী এসেছেন
শিলান্যাস করতে গতকাল
শিলান্যাস? প্রাইমারির মাস্টামশাই জানে, ওর মানে পাথর
কপাল, এমন কপাল, এদিকে তেমন একটা নদীও নেই
যার বুকে পাথর ছুঁড়ে খেলতে
দেখবো কোনো মন্ত্রীকে!
সকালবেলা আমাদের মুড়ি-পেঁয়াজ খাওয়ার সময়
চমৎকার গান শোনায় কিশোরকুমার
নিতাই গড়াই এমনই শৌখিন যে বাঁশঝাড়ের পেছনে
জলের গাড়ু নিয়ে যাবার সময় সে অন্য হাতে
ঝুলিয়ে নিয়ে যায় ট্রানজিস্টার
আমরা জানি, রাইটার্স বিল্ডিংস, লালবাজার, লাল
কেল্লা, বিমান বাহিনী,
পনেরোই আগস্ট
খবরের কাগজের
স্বাধীনতা, বিল্লা রঙ্গা, ব্যাঙ্ক–
ডাকাতি, রবি ঠাকুরের
গান, পঞ্চম
বার্ষিকী পরিকল্পনা, রেল, পাতাল
রেল, অ্যাটম
বোমা, নক্সাল ছেলেদের জেল
থেকে ছাড়া পাওয়া,
কলকাতা অন্ধকার, বিবিধ
ভারতীতে আমাদের সমস্ত চোখে-না-দেখা জিনিসের বিজ্ঞাপন
দিল্লিতে আন্তজাতিক
শিশুবছরের উদ্বোধন…
এইসব ভালো ভালো জিনিস আছে আমাদের দেশে,
আমরা জানি সব
জানি তবু সন্ধেবেলা মোমবাতির আলোয় তাস খেলার বৈঠকে
কিংবা খুড়ো, আমাদের সব্বাইকার খুড়োর কীর্তনের আসরে
হঠাৎ হাট-ফেরতা কেউ
পটাশ-ভেজালের মতন বিশ্ব চমকানো খবর দিয়ে যায়!
রামজীবনপুরের হাট যেন চাঁদ, আমাদের টানে, টেনে রেখেছে
ঐ চাঁদকে কেন্দ্র করে ঘোরে
ঘুরতে থাকে
আমাদের ছোট ছোট নিয়তির বড় বড় চাকা

হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি যেও নাকো
হরিদাসপুরে
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি ঝুলে থাকো
লাউয়ের ডগায়
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি মাসে পাঁচ দিন
কুচো মাছ খেতে ভালোবাসো
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি নিচু মেঘ হও
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি কানু ঘরামিকে
দাও চোখ
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি দুধ হও
চিটে-পড়া ধানে
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি
গোপন আগুন হও
সামন্ত জ্যাঠার বড় লোহার সিন্দুকে
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি কিছু কম করে দাও
রহমান সাহেবের
পাম্পসেট ভাড়া
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি প্রজাপতিটির দিকে
স্থির চোখে অমন চেও না।
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি যাত্রা দেখে
তাড়াতাড়ি
ফিরে এসো বাড়ি
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি রাগী স্ত্রীলোকের হাতে
কখনো দিও না ফলিডল
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি বাঁজা পেঁপে গাছটিকে
একবার ছোঁও
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি মোগা গোরুটিকে দাও
সহজ নিশ্বাস
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি ইস্কুলের ছেলেদের
মুখে দাও ইস্কুলের ভাষা
হে জীবন, সুস্থির জীবন, তুমি নীল বিদ্যুতের শিখা
দেখে দুই চোখ মুছে নাও
হে জীবন, হে প্রিয় আমার, তুমি কাছে কাছে থেকো।

আমাদের এখানে কোনো বিখ্যাত ভাঙা মন্দির নেই
এখানে ঘটেনি চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ
বরফ কিংবা মাখন কখনো পদার্পণ করেননি
এখানে তবু আমাদের এই গ্রামটি ঐতিহাসিক
এই টোকো আম, ভূতি কাঁঠাল ও জারুল গাছ ঘেরা
লোকচক্ষুর অগোচর পল্লীটি
ছ’সাতশো মানুষ নিয়ে টিকে আছে
হাজার হাজার বছর
এই মেঠো রাস্তা ধরে হেঁটেছেন আমাদের চতুর্দশ পুরুষ
তেঁতুল গাছতলায় শ্মশানে পুড়েছেন আমাদের
বৃদ্ধ প্রপিতামহ
যে আঁতুড়ঘরে আমাদের পঞ্চম সন্তানটি জন্মালো
ঠিক সেখানেই জন্মেছিলেন আমাদের পিতৃপুরুষ
আমাদের শিশুরা মাতৃস্তন্য পান করে না,
তারা নিস্তনী মেয়েদের
বুক কামড়ে কামড়ে খায়
তবু মাতৃ ও ভূমিস্নেহ আমরা পেয়ে যাই উত্তরাধিকার সূত্রে
আমরা সবুজকে হলুদ করি আবার ধূসরকে বলি
সজল হতে
আমরা কেঁচো, গুগলি, শামুক, ব্যাঙ ও সাপেদের
সামঞ্জস্য ঠিকঠাক রেখে দিয়েছি
আমাদের এখানে নদী নেই, তবু বন্যা এসে যান
সূর্য অতি ক্রুদ্ধ হলে ঢেলে দেন
অতিরিক্ত আগুন
কখনো কখনো হাওয়ায় উড়ে আসে ইস্তাহার
জমিতে পোথিত হয় ঝাণ্ডা
আমরা ছেলেবেলার মতন দৌড়োদৗড়ি ও
মারামারির খেলা করি
আবার বিপরীত বাতাসে ভেসে যায় সব কিছু
আমাদের এখানে সব কিছুই, এমনকি ক্ষিদে পর্যন্ত
অত্যন্ত রহস্যময়ভাবে সরল
বীজতলার ওপর লাফালাফি করে গঙ্গাফড়িং
উনুনের ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে কেউ কেউ
গেয়ে ওঠে গান
হাঁসের ডিমের ঝোল রান্না হলে ছোট ছেলেমেয়েরা
মাটি চাপড়ে খলখল করে হাসে
আমরা আকাশকে রেখেছি নীল
আমরা নীলাভ ছায়ার মধ্যে খুঁজে বেড়াই আমাদের ভ্রমর
আমরা আবহমানকালকে ‘দাঁড়াও’ বলে
থমকে রেখেছি।